সিনেমাটার নাম ইনোসেন্স অব মুসলিম। স্যাম বেসাইল নামে এক আমেরিকান ইহুদি এর ডিরেক্টর। সে শ খানেক ইহুদিদের কাছ থেকে কয়েক মিলিয়ান ডলার তুলে সিনেমাটা বানিয়েছে। ইউটিউবে খুঁজলে ১৮ মিনিটের একটা ট্রেলার পাওয়া যাচ্ছে। বি-গ্রেড সিনেমা-কোন এক্টিং নেই। মহম্মদকে নিয়ে কমেডি। আরো পরিস্কার ভাবে হজরত মহম্মদের দুর্বার যৌন জীবন নিয়ে কমেডি-যাতে সুন্দরী নারী এবং সুন্দর বালকের প্রতি নবীজির অপ্রতিরোধ্য আকর্ষন নিয়ে ব্যাঙ্গ করা হয়েছে এবং সেটাও খুব দুর্বল। সোজা কথায় ফাজিল ফালতু সিনেমা।

কিন্ত তাতে কি? মিশর এবং মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম সমাজ প্রতিবাদে শ্যামাপূজোর কালিপটকার মতন নিজেরাই ফাটছে আর ফাটাচ্ছে! উগ্র মুসলিমদের হাতে কাল প্রাণ হারিয়েছেন লিবিয়াতে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত ক্রিষ্টোফার স্টিভেনস। তোলপাড় হচ্ছে আমেরিকান রাজনীতি। কাল পরশুর মধ্যে পাকিস্থান আর আফগানিস্থানে আরো কত লোক লাশ হবে আর লাশ ফেলতে চাইবে জানি না। এর আগেও কোরান পোড়ানো বা টয়লেটে কোরান ট্রাশ করা নিয়ে লাশ হওয়া এবং লাশ ফেলার অভিলাশী উৎসাহে কোন ঘাটতি দেখা যায় নি।

আমি নিশ্চিত মুসলিম সমাজ এখন দুইভাবে বিভক্ত-একদল মর্মাহত, কিন্ত হিংসাত্মক উত্তরে বিশ্বাস করেন না। আরেক দল ধর্ম রক্ষার নামে এই ধরনের হিংসাত্মক কাজ কর্মকেই ধর্মীয় নিদান বলে বিশ্বাস করে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে এই যে ধর্মীয় ভাবাবেগ, যাকে ঘিরে এই কান্ড-সেই মিথটি একবিংশ শতাব্দিতে কি আমাদের সমাজ এবং সভ্যতার জন্যে কাম্য না সব থেকে বড় ক্যান্সার?

এটা খুব সহজেই বিচার করা যায়, যদি আমরা এই প্রশ্নগুলি করি।

• ধরা যাক ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করা উচিৎ না । তাহলে আমার মতন নাস্তিক নিধার্মিকদের ভাবাবেগেও আঘাত করা উচিৎ না। আমেরিকাতে নিধার্মিকদের সংখ্যা এখন ১৫% এর বেশি, অনেক দেশেই নির্ধামিকরাই সংখ্যাগুরু। কিন্ত প্রতিটা ধর্মগ্রন্থে সে কোরানই হোক, বা গীতাই হোক, নিধার্মিক বা বিধার্মিক বা ঈশ্বরে অবিশ্বাসীদের গর্দভ, শুয়োর থেকে শুরু করে সব ধরনের চোস্ত গালাগাল দেওয়া হয়েছে। তাহলে নিধার্মিক ধর্মের প্রতিনিধি হিসাবে আমাদেরও দাবী করা উচিৎ, আমাদের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করার জন্যে কোরান সহ যাবতীয় ধর্মগ্রন্থ যা নিধার্মিকদের বিরুদ্ধে বিদ্বেশগার করে, তাদের ও নিশিদ্ধ করা হৌক? আমরা কিন্ত কোন ধর্মগ্রন্থ নিশিদ্ধ করার পক্ষে না। কারন আমরা জানি ধর্মগ্রন্থগুলিই ধর্মীয় মূঢ়তার বৃহত্তম প্রমান। ইসলাম যদি সেই ধরনের সলিড কিছু হত-তাহলে “ইনোসেন্স অব মুসলিমের” মতন একটি তৃতীয় শ্রেনীর ভাঁড়ামোতে এর গোড়া নড়ে কেন?

• এর আগে আমেরিকাতে লাভগুরু বলে একটি সিনেমা রিলিজের আগে, হিন্দু ধর্মে আঘাত করা হচ্ছে বলে ভারতীয় হিন্দুরা এর রিলিজ বন্ধ করে দিয়েছিল। তবে হিন্দুদের সমাজ “শিক্ষার” দিক দিয়ে একটু বেশি “বিবর্তিত” বলে লাশ না ফেলে, কোর্টের আশ্রয় নিয়ে সিনেমাটা আটকানোর চেষ্টা করে। সফল হয় নি। এবার ব্যাপারটা ভাবুন। এই হিন্দু ধর্মের ছানাপোনারা দাবী করে, হিন্দু ধর্মের মতন দার্শনিক ধর্ম নাকি হতে পারে না কারন এই ধর্ম সকল ধর্মের মিউজিয়াম। আরে তাই যদি হয়, তাহলে লাভগুরুর মতন একটা সফট পর্ণ ধর্মের ভিত নড়িয়ে দেবে? লাভগুরু তাও সিনেমা হিসাবে ভদ্র ছিল-ইনোসেন্স অব মুসলিম আরো দুর্বল ভাঁড়ামো। তাহলে শুধু এই ধরনের যৌন ভাঁড়ামো করেই ইসলামের নাড়া নড়ানো যায়? সেটাই যদি সত্য হয়, তাহলে বুঝতে হবে, ইসলাম ধর্মের পুরোটাই জঙ্গিবাজি-ধর্মের ভিতরে কিছু নাই-সেই জন্যেই তা এত ক্ষণভঙ্গুর।

• কিন্ত হিন্দু বা ইসলাম ধর্ম এত অগভীর বা এত ফালতু এমন ভাবার কারন নেই । এগুলি বিবর্তনের পথে নির্বাচিত ধর্ম যারা হাজার হাজার বছর ধরে টিকেছে। সুতরাং এদের প্রানশক্তি আছে বইকি। না থাকলে, এরা নির্বাচিত হত না। সমস্যা হচ্ছে বিবর্তনের পথে যে আধুনিক উৎপাদন শক্তির উদ্ভব হচ্ছে, তার সাথে ধর্মগুলি দ্রুত খাপ খাওয়াতে পারছে না। এই ব্যাপারে বৌদ্ধ বা হিন্দু ধর্মগুরুরা কিছুটা এডাপ্টিবিলিটি বা অভিযোজন দেখালেও ইসলামিক সমাজের অভিযোজন হচ্ছে না তেলের টাকার কারনে। ৪০ বছর আগেও ইসলামি সমাজ এত ইসলামিক ছিল না কোন দেশে-কারন তাদের ইসলাম থেকে বেড়িয়ে এসে আধুনিক উৎপাদন শক্তিকে আশ্রয় করেই বাঁচতে হত। অর্থাৎ ইংরেজি শিক্ষা, পাশ্চাত্য দর্শন, আধুনিক রাজনীতি বিজ্ঞান, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি এর মাধ্যমে গোটা বিশ্বের অর্থনীতির সাথে তাদের যুক্ত হওয়ার একটা পক্রিয়া আরব জাতিয়তাবাদি আন্দোলনের মাধ্যমে শুরু হয়। কিন্ত সৌদি আরব সহ নানান দেশের রাজাদের সামন্ত তান্ত্রিক ক্ষমতা পিপাসা, তেলের টাকায় ইসলামিক জীবন এবং আমেরিকার প্রচ্ছন্ন মদতে ইসলামের চাকা উলটো দিকে ঘুরতে থাকে। এর সাথে একই রকম ধর্মীয় ভাবাবেগাচ্ছন্ন দক্ষিন ভারতীয়দের তুলনা করা যেতে পারে। তাদের খনিজ সম্পদ এত নেই যে তার টাকাতে পায়ের ওপর পা তুলে জীবিকা নির্বাহ সম্ভব। ফলে বাঁচার তাগিদেই তারা গোঁড়া হিন্দুত্ব থেকে বেড়িয়ে আস্তে আস্তে আধুনিকতার দিকে হাঁটতে বাধ্য হচ্ছে।

এই বাধ্যবাধকতাটা ইসলামিক সমাজে আসে নি তেলের টাকার জন্যে। সমাজ, রাষ্ট্র, মিডিয়া বা রাজনীতি যতই শেখাক, আমি হিন্দু বা মুসলমান, বাস্তব এবং বিজ্ঞান ভিত্তিক চিন্তা হচ্ছে- আমি একজন জৈবিক মানুষ। কারন দুদিন না খেতে পাওয়ার পর যদি কোন মুসলমানকে বলা হয় পুজো করলে খেতে পাবে, সেই তাই করবে। এটাত আমি ছোটবেলায়, আখছার দেখেছি পুজোর সময়গুলিতে ভাল খেতে পাওয়ার লোভে, অনেক দরিদ্র মুসলমান প্রসাদ খাওয়ার পাতে বসে। এটাই মানবিক ধর্ম। আবার তারই যখন টাকা হয়, সে পোত্তলিকতার অপরাধ নিয়ে ভাবে। কারন পেটে ভাত থাকলে এই সব মিথ নিয়ে ভাবার অবকাশ পায় লোকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অনেক হিন্দু ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছে। কারন সেটাই জৈবিক ধর্ম।

কালকের মধ্যপ্রাচ্যও সেই মানুষের জৈব ধর্মই পালন করবে বা করতে বাধ্য হবে। মধ্যপ্রাচ্যে তেলের উপায় কমতে থাকছে ইলেকট্রিক গাড়ির জন্যে। তার সাথে যুক্ত অবাধে জনসংখ্যা বৃদ্ধি। ফল এই যে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটা রাষ্ট্রে এখন তীব্র খাদ্য সংকট ঘণীভূত হচ্ছে। ইসলাম দিয়ে আর নামাজ পরে এই সমস্যার সমাধান হবে না। আধুনিকতা এবং যন্ত্র সভ্যতাকে গ্রহণ করেই তাদের এগোতে হবে। ভারতে এটা আমরা গত ৪০ বছর ধরে দেখেছি। ভারতে আস্তে আস্তে সামন্ততান্ত্রিক সমাজ এবং হিন্দুত্ববাদিরা পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে উন্নয়নকে জনগণ অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্যে। ফলে মন্দির এবং বাবার সংখ্যা বাড়লেও সমাজ ও রাজনীতির ওপর ধর্মের প্রভাব অনেক কমেছে। বিজেপি কিন্ত সেই নব্বই দশকের পর হুল ফোটাতে পারছে না। নরেন্দ্রমোদিকেও হিন্দুত্ববাদ বাদ দিয়ে উন্নয়নকে হাতিয়ার করে ভোটে জিততে হচ্ছে। আধুনিকতার চাপ।

সুতরাং মধ্যপ্রাচ্যে একবার যখন গণতন্ত্র আসতে শুরু করেছে, এই আশা, দুরাশা বা নিরাশা নয়, যে আস্তে আস্তে ধর্মীয় আবেগ সেখানেও ফিকে হবে। আধুনিক রাষ্ট্র এবং আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থাকে গ্রহণ না করলে, সেই সমাজ খাদ্যাভাবে গৃহযুদ্ধে ধ্বংস হবে যা আজ আমরা আফ্রিকাতে দেখছি। মধ্যপ্রাচ্য সাবসাহারান আফ্রিকার দিকে যাবে -না ইউরোপের পথে আসবে, সেটা আমরা দ্রুতই দেখতে পাব।