বিষয়টি গুরুতর সন্দেহ নেই। বিজ্ঞানের সাথে দর্শনের কী সম্পর্ক? বৈজ্ঞানিক তথ্য-তত্ত্বের কি দার্শনিক তাৎপর্য আছে? বিজ্ঞানের দর্শন (Philosophy of Science) কি সম্ভব? এসব অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করেছেন অনেক বিজ্ঞানী ও দার্শনিক। এখানে আমরা মূলত বিজ্ঞানের জ্ঞানতাত্ত্বিক (epistemological) সমস্যা নিয়ে আলোচনা করব।
দর্শন ও বিজ্ঞান হাত ধরাধরি করে চলেছে – অন্তত প্রাথমিক যুগে। কিন্তু বর্তমানে আমরা দেখি এ দুটো সম্পূর্ণ পৃথক পদ্ধতি (methodology) মেনে চলে। দার্শনিক পদ্ধতি ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অভিন্ন নয়। হয়ত নীতিগতভাবে এদের মধ্যে কোনো বৈসাদৃশ্য থাকার কথা ছিল না। কারণ প্রাচীনকালে সভ্যতার ঊষালগ্নে আমরা বিজ্ঞানকে দার্শনিক বিষয়বস্তু হিসেবেই আলোচিত হতে দেখি। বলা হতো, Natural Philosophy বা ভৌত দর্শন। নিউটনের ‘ন্যাচারালিস ফিলোসফিয়া প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা’ এর প্রমাণ। পদার্থবিজ্ঞানে যুক্তির প্রয়োগ, আরোহী-অবরোহী পদ্ধতির প্রয়োগ – এসবই দার্শনিক ভাবপ্রসূত। কিন্তু ক্রমশ গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান শাস্ত্রীয় দর্শন থেকে আলাদা হয়ে বর্তমান বিজ্ঞানের ভিত্তিভূমি রচনা করেছে। মনে হয়, সপ্তদশ শতকের দর্শন থেকে বিজ্ঞানের ধারণাসমূহের সৃষ্টি। আর সপ্তদশ শতকের দর্শন বুঝতে হলে গ্রিক উপলদ্ধি করতে হবে। গ্রিক দর্শনের দুই মহারথী প্লেটো-অ্যারিস্টটলের দর্শন আমাদের বুঝতে হবে। গ্রিক দর্শনের সবচেয়ে বড়ো গুণ হলো এটি একেবারে মৌলিক যেকোনো প্রতিভাস ব্যাখ্যা করতে প্রয়োজনীয় দার্শনিক ধারণা গ্রিক দার্শনিকরা নিজেরাই তৈরি করেছেন। এই ভাবধারা দুহাজার বছরের পুরনো ভাবধারা; কাজেই বলা চলে এই মতবাদগুলো বর্তমানকালে উপযোগরিক্ত। তবু এ দর্শনের পদ্ধতি, প্রশ্ন করার ক্ষমতা, অনুধাবনের তীক্ষèতা প্রশংসনীয়। ঐতিহাসিকভাবে গ্রিক দর্শন “বিজ্ঞানের সূতিকাগার” এবং

ইউরোপীয় রেনেসাঁ আধুনিক বিজ্ঞানের সূত্রপাত করে।

চেতনার উৎস - মানবমস্তিষ্ক


দুর্ভাগ্যক্রমে, প্রাচ্যের দর্শনগুলোর বাহ্য বাস্তবতার প্রতি অনীহা বিজ্ঞান সৃষ্টিতে সহায়ক হয়নি। এরা শুধু শব্দের ধুম্রজালই তৈরি করেছে।
বিজ্ঞান ও দর্শনের আলোচনায় বিজ্ঞান বলতে আমরা গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান বুঝব। কারণ, ভৌত বাস্তবতা এবং তার দার্শনিক সমস্যা আধুনিক ভৌত বিজ্ঞানই সৃষ্টি করেছে। অবশ্য জীববিজ্ঞানের বংশগতিবিজ্ঞানে জিন-প্রযুক্তি অতি সম্প্রতি অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। আজকাল নিখুঁত মানুষ তৈরির কথা শোনা যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, জিন প্রযুক্তির বদৌলতে রোগমুক্তি বংশ পরম্পরায় সম্ভব হবে। এমনকি ‘অমরত্বের’ সম্ভাবনাও অনেকে করছেন। ভবিষ্যতে এ প্রযুক্তি যথেষ্ট দার্শনিক তাৎপর্যময় হয়ে উঠবে। অতি সম্প্রতি মানবমস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা বেশ দার্শনিক তাৎপর্যময় হয়ে উঠেছে। মানবমস্তিষ্কের মৌলিক কার্যকারিতা এখনো অজানা। তবে এ কথা ঠিক, মানুষের মনুষ্যত্বের জন্য দায়ী যে চেতনা (consciousness) তা মস্তিষ্কের এক অতি উচ্চতর পর্যায়ের সমন¦য় ক্রিয়ার ফল। প্রশ্ন হচ্ছে, মস্তিষ্কের ঠিক কোন অংশটি চেতনার জন্য দায়ী। মস্তিষ্কের একটি সাধারণ পরিচয় আমাদের জানা থাকা দরকার। মস্তিষ্কের পেছনদিকে নিচে ডানে-বামে দুটো বাটির মতো অংশ আছে- এরা cerebellum এবং মস্তিষ্কের ওপরের বিশাল অংশটি cerebrum। সেরেব্রাম ডান ও বাম অর্ধে দ্বিধাবিভক্ত। সেরেব্রাম হলো গুরুমস্তিষ্ক। মস্তিষ্কের এ দুটো অংশই প্রধান। আরেকটি ব্যাপার, সাধারণত মস্তিষ্কের বামার্ধে থাকে ব্রোকা ও র্ভেনিকের অঞ্চল (Broca’s and Wernicke’s area) – এ দু’টো অঞ্চল কথা বলা ও উপলব্ধি করার জন্য দায়ী। মনে হয়, লঘুমস্তিষ্ক (cerebellum) স্বয়ংক্রিয় কাযকর্মেও জন্য দায়ি। অন্যদিকে, গুরুমস্তিষ্ক চিন্তাশীল কাযকর্মের জন্য দায়ী। অর্থাৎ যে সমস্ত কায স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয় (যেমন হাঁটার সময়ে বিভিন্ন মাংসপেশীর সংকোচন-প্রসারণ) সেগুলো লঘুমস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু হাঁটার সিদ্ধান্ত গ্রহণ মূলত গুরুমস্তিষ্কই নেয়। অনেকের মতে মস্তিষ্ককান্ডের উর্ধ্বভাগ (upper brain-stem, থ্যালামাস ও মধ্যমস্তিষ্কসহ) চেতনার পীঠস্থান। অবশ্য এর সাথে গুরুমস্তিষ্কের ক্রিয়াও অন্তর্ভুক্ত আছে। প্রকৃতপক্ষে এ সম্পর্কে নানা মুনির নানা মত। বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন অংশকে চেতনার জন্য দায়ী করেন। অনেক সময়ে এমন দেখা গেছে, যদি কোনো কারণে মস্তিষ্কের ডান ও বাম অর্ধের মধ্যের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয় (upper brain-stem) এবং যদি ডানচোখে পেন্সিল ও বামচোখে কলম দেখানো হয়, তবে রোগী পেন্সিলকেই সনাক্ত করবে (এর কারণ মস্তিষ্কের বাম অংশ দেহের ডান অংশ নিয়ন্ত্রণ করে এবং উপলব্ধি ও কথা বলার উদ্দীপক অংশ এই বাম অংশেই প্রধানত থাকে); তাই মনে হয়, মস্তিষ্কের বামার্ধই চেতনা সৃষ্টি করে। আসলে দেখা যায় যে, জ্যামিতিক (বা ত্রিমাত্রিক) চিন্তাভাবনা, সঙ্গীত – এগুলো মস্তিষ্কের ডান অর্ধাংশ নিয়ন্ত্রণ করে, অন্য অংশ নিয়ন্ত্রণ করে গাণিতিক ক্রিয়াকর্ম। তাহলে কি আমাদের মধ্যে চেতনার দুইটি সত্তা আছে? অনেক সময়ে দেখা যায়, পর্যাপ্ত দীর্ঘকাল পর ডান অর্ধাংশও বাম অর্ধাংশের মতো সচেতন হয়ে ওঠে। মানবমস্তিষ্ক নিয়ে এসব পরীক্ষা দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের যথেষ্ট ভাবিয়ে তুলছে। তাছাড়া অনেকে বলেন, মস্তিষ্কক্রিয়া আসলে এক জটিল অ্যালগরিদম (সমস্যা সমাধান প্রণালী); কিন্তু সচেতনতা মনে হয় না কোনো অ্যালগরিদমিক পদ্ধতি তা সে যতো জটিলই হোক না কেন। আমরা প্রত্যেকেই দৈনন্দিন জীবনে হঠাৎ কোনো নতুন আইডিয়া পেয়ে থাকি। এই আইডিয়াগুলো মাথায় একেবারে হঠাৎ করেই আসে। এগুলো যদি অ্যালগোরিদমিকই হতো তবে এগুলো এ রকম হঠাৎ আবির্ভূত হয় কেন? কেন প্রণালীবদ্ধভাবে যথোচিত সময়ে আবির্ভূত হয় না?

স্প্লিট ব্রেইন পরীক্ষা

বিগত কয়েকশ বছরে বিজ্ঞানের বিকাশের ফলে জীবন ও বিশ্বজগৎ সম্পর্কে একটি সংগতিপূর্ণ চিত্ররূপ তৈরি করা সম্ভব হয়েছে এবং “এর চেয়ে সুন্দরতর ছবি আমাদের জানা নেই”; এই ছবি গণিতের ভাষায় রচিত এবং বিজ্ঞানের ছাত্র না হলে এটা বোধগম্য হওয়া সুকঠিন। প্রকাশের এই সমস্যা নিয়ে ভিট্গেনস্টাইন তাঁর ভাষা-দর্শনে আলোচনা করেছেন,

যা বলা যায় তা সুস্পষ্ট [বিজ্ঞানের বিশুদ্ধ ভাষায়] বলা যায়। আর যে বিষয়ে পরিষ্কার করে কিছু বলা যায় না, সে বিষয়ে চুপ করে থাকাই শ্রেয়।

লুদভিগ ভিট্গেনস্টাইন

বিজ্ঞানীদেরও একই সমস্যা আছে। বিজ্ঞান তার নিজস্ব গাণিতিক ভাষা তৈরি করে নেয়। এ ভাষার সৌন্দর্য উপলব্ধি না করলে বিজ্ঞান ও নান্দনিকতার দ্বন্দ্ব অবশ্যম্ভাবী। আকাশের অনন্ত নক্ষত্রবীথি অবশ্যই সুন্দর; কিন্তু তাদের আয়নিত গ্যাসের গোলক ধরে নিলে আর কাব্যিকতা চলে না। তাই বলা হয় “বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ”; কেন এই দ্বন্দ্ব? আবিষ্কৃত ভৌত আইনগুলোর অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য এই সমস্যার সুন্দর সমাধান দেয়- “পৃথিবীর সকল ভাষার সকল কবিতার চেয়ে তা সুন্দরতম।” কারণ এক সময়ে অনেকেই মনে করতেন : “ঈশ্বর বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন সুন্দর গণিতের ভিত্তিতে”।
বলা হয়ে থাকে, বিজ্ঞান হচ্ছে সাধারণ অভিজ্ঞতার ব্যাখ্যা, আর বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা হলো দর্শন। দর্শন হলো সমন্বিত (Comprehensive) জ্ঞান। বিজ্ঞানের অনুমান-তত্ত্ব-তথ্যের সমালোচনা করে দর্শন। বিজ্ঞান সত্যের অনুসন্ধান করে কিন্তু (পন্টিয়াস পিলেটের বিখ্যাত প্রশ্ন) “সত্য কী” এর উত্তর দেয় না। বিজ্ঞান এখন মডেল-র্নিভর বাস্তবতা ও সত্যের কথা বলে। মানুষ তাঁর পঞ্চেন্দ্রিয়ের সাহায্যে বাস্তবতার স্বাদ গ্রহণ করত। পঞ্চেন্দ্রিয়ের বাইরে বাস্তবতার যে সূক্ষ্মরূপ বিরাজমান, সেটা জানতে শক্তিশালী তত্ত্ব নির্মাণ করতে হয়। সেই তত্ত্বকে পরীক্ষা করে দেখতে হয়। এই নির্মিত মডেল সত্য ও বাস্তবতা সম্পর্কে যা বলবে, সেটাই বাস্তব। এর বাইরের কিছুকে বিজ্ঞান স্বীকৃতি দেবে না। যেমন, ইদানিং যে স্ট্রিং তত্ত্বের কথা শোনা যাচ্ছে, সেটা ১০^৫০০ সংখ্যক বিশ্বের কথা বলে। অর্থাৎ, মহাবিশ্ব একটি নয়, একাধিক। এইসব একাধিক বিশ্বে পদার্থবিজ্ঞান এবং ভৌত রাশিসমূহ অন্যরকম হতে পারে। ফলে সেইসব বিশ্বে বাস্তবতা আমাদের থেকে ভিন্ন। এই মডেল-নির্ভর বাস্তবতাই বিজ্ঞানীর বাস্তবতা, এটা দার্শনিকের বাস্তবতা থেকে ভিন্ন। বলা ভালো, সত্য কী – এর উত্তরে বিজ্ঞানের দ্বিধা আছে, কারণ বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সত্য আপেক্ষিক এবং তা একাধিক হতে পারে, তবে গাণিতিক সত্যের সুস্পষ্ট সংজ্ঞা রয়েছে। গণিতে আজকাল উচ্চতর সেট ও দলতত্ত্বের (গ্রুপ থিওরি) ব্যবহার হচ্ছে, এসবের ভিত্তিতে নানা উপপাদ্য রয়েছে, আছে হাইপার-জ্যামিতি, অন-ইউক্লিডিয় জ্যামিতি। এগুলোর (গাণিতিক) সত্যতা অনস্বীকার্য। একথা সত্য যে সত্য কী, ভালো-মন্দ কী, ঈশ্বর কে, সুন্দর কী, এসবের মূল্যই বা কী (axiology) এসব প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞানের আওতা বহির্ভূত (অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে আংশিক সমাধান আছে); কিন্তু ভৌত বাস্তবতা সম্পর্কে বিজ্ঞানের বক্তব্য সুস্পষ্ট এবং তা অবশ্যই জানা প্রয়োজন। আমাদের জানতে এবং বুঝতে হবে বিজ্ঞান কী পেয়েছে। দেকার্তে বলেছিলেন

All philosophy is like a tree. The roots are Metaphysics, the trunk is physics and the branches are all the other sciences.

দেকার্তে নিয়ে একটি কার্টুন, দেকার্তে বলেছিলেন “I think, therefore I am.”

চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান (নিউটনীয় বিজ্ঞান, চিরায়ত ক্ষেত্রতত্ত্ব, ম্যাক্সওয়েলের বিদ্যুৎ-চৌম্বকতত্ত্ব) বা ক্ল্যাসিক্যাল ফিজিক্স দর্শনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। গ্যালিলেওর পর্যবেক্ষণের নিবিড় প্রভাব দেখা যায় দেকার্তে বা স্পিনোজার লেখনিতে। নিউটনীয় পদার্থবিজ্ঞান ইমানুয়েল কান্টের বদৌলতে উনবিংশ শতকের দর্শনের ভিত্তিভূমি রচনা করে। কান্ট ডেভিড হিউমের “সব জ্ঞান অভিজ্ঞতা থেকে আসে” – এই ধারণার বিরোধী ছিলেন। প্রশ্ন করা যায়, আগামীকাল যে সূর্য উঠবে তা জানা যায় কীভাবে? এর উত্তর হলো, যেহেতু অনাদিকাল থেকে এ রকমই ঘটে তাই কালকেও সূর্য উঠবে। কিন্তুঅতীতে ঘটলেই যে ভবিষ্যতে ঘটবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? আসলে অতীতের ঘটনা দিয়ে ভবিষ্যত বিচার করার কোনো যৌক্তিক উপায় নেই। কার্ল পপার এই হিউমীয় সমস্যাকে আরো এগিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন “অভিজ্ঞতা সম্ভব হয় কেন”? কান্ট হিউমের এই সমস্যাকে সমাধান করতে কিছু পূর্বশর্ত (a priori) ধরে নিলেন অভিজ্ঞতাকে সম্ভব করতে হলে এসব পূর্বশর্ত পূরণ করতে হবে। তাই বলা যায়, সময় না থাকলে অভিজ্ঞতাও থাকে না। কাজেই সকল তত্ত্বে সময়ের অবিচ্ছিন্ন উপস্থিতি পূর্বশর্তরূপে মেনে নিতে হবে। যাহোক, কান্টের দর্শন আমাদের আলোচ্য নয়। আসলে চিরায়ত বিজ্ঞান বাস্তবতার একটি নিশ্চয়তাভিত্তিক (deterministic) সংজ্ঞা দেয়। এখানে দর্শক বা মনের (চেতনার) কোনো দরকার নেই। এই তত্ত্বে পর্যবেক্ষণের উপর কোনো বাধ্যবাধকতা থাকে না (কান্টের দর্শনেও দর্শকের কোন স্থান নেই); সময় এখানে পরম (সম্মানীয়) রাশি। চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের আরো একটি প্রভাব লক্ষ করা যায় যৌক্তিক দৃষ্টবাদে (logical positivism)। এখানে প্রত্যক্ষই পরম। এর বাইরে কিছুই সম্ভব নয় (অতএব অধিবিদ্যা বা metaphysics সম্ভব নয়); এর সাথে চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের মতের ঐক্য আছে। ভিয়েনা কেন্দ্রিক এই যৌক্তিক দৃষ্টবাদের মুখ্যপুরুষ ছিলেন আর্নেস্ট মাখ।
আপেক্ষিক তত্ত্বের প্রণেতা আইনস্টাইন প্রথম সময়কে তার ধ্রুপদী স্থান থেকে সরিয়ে দেন। সময় আসলে পরম কিছু নয়, গতি নির্ভর রাশি মাত্র। রিম্যানের জ্যামিতি ব্যবহার করে আইনস্টাইন সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের সুবিশাল (গাণিতিক) সৌধ গড়ে তোলেন এবং এভাবেই কান্টের ইউক্লিডিয় জ্যামিতি ভিত্তিক দর্শনকে খন্ডিত করেন। কান্ট বলেছিলেন বিশ্ব সসীম না অসীম তা কোনোদিন জানা যাবে না। কিন্তু আধুনিক সৃষ্টিতত্ত্বে (কসমোলজি) এর সুস্পষ্ট গাণিতিক এবং অধুনা পর্যবেক্ষণলব্ধ সমাধান আছে।
চিরায়ত জগৎ নিশ্চয়তা ভিত্তিক থাকা সত্ত্বেও তা ছিল অর্ধসত্য। কারণ (পরমাণু-স্কেলে) বাস্তবতার স্বরূপ এটি সম্পূর্ণ দিতে পারে না। অতিক্ষুদ্রের জগতে চিরায়ত বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সূচনা করে। কোয়ান্টাম তত্ত্বে মাপন-ক্রিয়া এবং এ প্রক্রিয়ায় দর্শকের উপস্থিতি প্রয়োজনীয়। “কীভাবে পরীক্ষণ করতে হবে তা তত্ত্বই নির্ধারণ করবে”; এ সম্পর্কে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি স্মর্তব্য। আসলে বস্তুকণার পরিবর্তে স্থানিক তরঙ্গ-প্যাকেট ধরে নেয়ার জন্যই এই অনিশ্চয়তা। কিন্তু এছাড়া কোন উপায়ও নেই। কারণ, চিরায়ত জগতে যা বস্তুর গতি, অন্যত্র তা তরঙ্গ-গুচ্ছের গুচ্ছবেগ। কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের একটি মূলনীতি অনুযায়ী যেকোনো বস্তুকণা (বা বস্তুকে) একটি তরঙ্গ-অপেক্ষক (বা ওয়েভ ফাংশন) হিসেবে ধরে নেয়া যেতে পারে যা একটি অন্তরকলন সমীকরণকে (শ্রোডিংগারের সমীকরণ) সিদ্ধ করবে। গণিতের নিয়মানুযায়ী এই তরঙ্গ-অপেক্ষকের একাধিক (মূলত অসীম সংখ্যার) সমাধান সম্ভব যারা প্রত্যেকে পৃথক পৃথক সম্ভাব্য অবস্থার নির্দেশ করে। এখন এই তরঙ্গ-অপেক্ষকের লঘুকরণ বা চুপসে যাওয়া (collapse or reduction of wave function) দর্শকের চেতনায় ঘটে। এ সম্পর্কে ‘শ্রোডিংগারের বিড়াল’ নামক মানস পরীক্ষাটি স্মর্তব্য। একটি বাক্সে একটি বিড়াল আছে। প্রথমাবস্থায় এটি জীবিত। এই বাক্সের মধ্যে এমনভাবে বিষ রাখা আছে যা নির্দিষ্ট সময় পর কোনো কৌশলের মাধ্যমে ক্রিয়া শুরু করবে। এখন বাক্সের বাইরে অবস্থিত কোনো দর্শকের কাছে বিড়ালটির একটি সম্ভাবনাময় অস্তিত্ব থাকে। বাক্সটি খুললেই নিশ্চিত করে তা জানা যায়। বাক্স না খোলা পর্যন্ত বাইরের দর্শকের কাছে বিড়ালটি ‘না জীবিত না মৃত’ – এরকম একটি জীবন্মৃত অবস্থায় থাকে। একে কোয়ান্টাম রৈখিক উপরিপাতন বলে linear superposition)। এভাবে বিড়ালটির অবস্থান বর্ণনায় কোনো দর্শকের উপস্থিতি একান্ত কাম্য। কাজেই দর্শকের দেখার উপরই (বা চেতনার উপর) বিড়ালের জীবিত বা মৃত থাকা নির্ভর করছে। এরকম আরো একটি পরীক্ষণের কথা বলা যায়। চিরায়ত বিজ্ঞানের সুবিখ্যাত ইয়ঙের দ্বি-স্লিট পরীক্ষা (double slit experiment)। একটি উৎস হতে আলোক তরঙ্গ নির্গত হয়ে দুটি কাছাকাছি স্লিটের (ছোট ছিদ্র) উপর পড়বে। এবার দুই স্লিটই (গৌণ) উৎস হিসেবে আলোক তরঙ্গ বিকিরণ করবে। এখন দূরবর্তী একটি পর্দার উপর যখন এই দুই তরঙ্গের স্রোতধারা মিলিত হবে তখন ঘটবে ব্যতিচার (Interference)। এর ফলে পর্যায়ক্রমে উজ্জ্বল ও অন্ধকার রেখা গঠিত হবে। তার কারণ – যদি দুই তরঙ্গের শীর্ষ পরস্পরের সাথে মিলিত হয় তবে উজ্জ্বল রেখা গঠিত হবে, কিন্তু একটির শীর্ষ অন্যটির খাদ মিলিত হলে তখন অনুজ্জ্বল রেখা হবে। ইয়ঙের এই দ্বি-স্লিট পরীক্ষা বহুবার পরীক্ষাগারে সম্পন্ন করা হয়েছে এবং কোনো ব্যতিক্রম হয়নি।

ইয়ঙের দ্বি-স্লিট পরীক্ষা

সমস্যা হবে তখনই যখন আলোর কণারূপ আমরা বিবেচনা করব। ধরা যাক, উৎস থেকে একটি ফোটন নির্গত হলো। এবার যা হবার কথা তা হলো এই ফোটন অর্ধেক হয়ে দুই স্লিট দিয়ে প্রবেশ করবে। কিন্তু তা হতে পারে না। কারণ বস্তুকণা এরকম দ্বিধাবিভক্ত হতে পারবে না। কোয়ান্টাম বর্ণনানুযায়ী, আসলে ফোটন তরঙ্গ হিসেবে দুই স্লিটের উপর পড়ে এবং তারপর নিজেই নিজের সাথে ব্যতিচার করে উজ্জ্বল-অনুজ্জ্বল রেখা গঠন করবে। এবার একটি ডিটেক্টর ব্যবহার করা যাক, যাতে আমরা জানতে পারি আসলে কোন স্লিট দিয়ে ফোটনটি গেল (অর্থাৎ ফোটনকে কণা ধার্য করে); মজার ব্যাপার, ডিটেক্টর ব্যবহার করা মাত্রই পর্দায় যে উজ্জ্বল-অনুজ্জ্বল রেখার পারম্পর্য ছিল তা অদৃশ্য হয়ে যায়। অর্থাৎ কোনো ব্যতিচার হয় না। এর তাৎপর্য হলো এই যে, যদি আমরা ব্যতিচার ঘটাতে চাই তাহলে জানা চলবে না কোন স্লিট দিয়ে ফোটনটি গেল। আর যদি তা জানতেই চাই তাহলে আর ব্যতিচার হবে না। প্রকৃতি কখনোই জানতে দেবে না ঠিক কোন স্লিট দিয়ে ফোটনটি গেল। এই রহস্যময়তাই দার্শনিক ভাবনার উৎস। এভাবে ভৌত ঘটনার জগতে মানসিক প্রক্রিয়ার অনুপ্রবেশ ঘটে। নীল্স্ বোরের ভাষায়:

অস্তিত্বের মহান নাটকে আমরা দর্শক ও অভিনেতা দুটোই

কোয়ান্টাম বাস্তবতা আসলে সম্ভাবনাভিত্তিক (probabilistic) একে ‘কোপেনহেগেন ব্যাখ্যা’ বলে। এটাই আধুনিক বিজ্ঞানের জ্ঞানতাত্ত্বিক সমস্যা। বোরের মতে,

কোয়ান্টাম জগৎ বলে কিছু নেই। শুধু আছে একটা বিমূর্ত কোয়ান্টাম বর্ণনা। এখানে বলা ভুল যে পদার্থবিজ্ঞানের কাজ প্রকৃতি কেমন তা নির্ধারণ করা। প্রকৃতি সম্বন্ধে কী বলতে পারি তা-ই পদার্থবিজ্ঞান।

কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের এই ব্যাখ্যা সরাসরি বিরোধিতা করতেন আইনস্টাইন ও শ্রোডিংগার। আইনস্টাইন বলতেন,

ঈশ্বর পাশা খেলেন না;

ওঁরা একে অসম্পূর্ণ মনে করতেন এবং এ সম্পর্কে আইনস্টাইন-বোর বিতর্ক সর্বজনবিদিত। এ সম্বন্ধে ই.পি.আর. সমীক্ষা স্মর্তব্য। সেখানে বলা হয়েছে : ধরা যাক, এমন একটি বিক্রিয়া যাতে একটি শূন্য স্পিনের কণা ভেঙে দুটি কণিকা তৈরি হয় যার একটির স্পিন +১/২, অন্যটির -১/২; অন্যান্য কেয়ান্টাম সংখ্যা সংরক্ষিত থাকে। এখন এ দুটোকে পৃথক করে যথাসম্ভব দূরে নিয়ে যাওয়া যাক। এখন যেকোনো একটি কণিকাকে পরীক্ষা করলে যদি জানা যায় যে সেটির স্পিন +১/২, তাহলে অন্যটির স্পিন পরীক্ষা না করেও বলে দেওয়া সম্ভব (-১/২)। কেন এরকম হবে? এদের মধ্যে পরে তো কোনো মিথস্ক্রিয়া ঘটেনি? এরাতো পৃথক দুটি স্থানে রয়েছে। যদি দুটি বস্তুর মধ্যে মিথস্ক্রিয়া ঘটার পর পরস্পরের প্রভাবমুক্ত করে পৃথক করা হয়, তাহলে একটির অবস্থা অন্যটির ওপর কোনো ক্রিয়া ঘটানো হচ্ছে কি-না – তার উপর নির্ভর করবে না। কারণ এরা অবস্থানগত ভাবে পৃথক। এটাই পৃথকীকরণের নীতি যা আইনস্টাইন-পডোলস্কি-রোজেনে’র (ই.পি.আর.) মানস পরীক্ষাটিতে বর্ণিত হয়েছে। সেখানে আরো বলা হয়েছে, এ নীতির সুনির্দিষ্ট অর্থ দিতে হলে তা কোয়ান্টাম তত্ত্বের বিরুদ্ধে যায়। কারণ “দুটো রাশির অবিনিময়ী কারক দিয়ে বর্ণনা করলে একটির সঠিক জ্ঞান অন্যটিকে অনির্দিষ্ট করে দেয়।” ফলে উভয়ের যুগপৎ বাস্তবতা অসম্ভব। এজন্য ধারণা করা হতো (যেমন ডেভিড বম মনে করেন) তত্ত্বে লুকনো চলরাশি (hidden variable) আছে। কিন্তু জে.এস.বেল প্রমাণ করেছেন “কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাথে সংগতিপূর্ণ এমন কোনো লুকনো চলরাশির তত্ত্ব স্বষ্টি করা যায় না যা পৃথকীকরণের নীতি মেনে চলে”। বেলের গাণিতিক অসমতাগুলো পরীক্ষা করা হয়েছে এবং তা কখনো কোয়ান্টাম তত্ত্বের বিপক্ষে যায়নি।

বোর ও আইনস্টাইন, কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন

তাছাড়া কণা পদার্থবিদরা যে কোয়ার্ক নকশা তৈরি করেছেন তাতে ৬টি কোয়ার্ক থাকার কথা। এরাই বস্তুজগতের মৌলিক উপাদান। কিন্তু কিছু তাত্ত্বিক বাধ্যতামূলক শর্তের জন্য এদের কোনোদিনই ‘দেখা’ যাবে না অর্থাৎ সরাসরি পরীক্ষণে প্রমাণিত হবে না। এরা কেবল অপ্রত্যক্ষ প্রমাণেই ধরা দেবে। এই ৬টি কোয়ার্কই এখন পর্যবেক্ষণে পাওয়া গেছে, তাদের ভরও নির্ণীত হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন করা যায় বাস্তবতা কী? এর স্বরূপ কী? আমাদের চেতনার সাথে এর সম্পর্ক কী? গাণিতিক সৌন্দর্যের তাৎপর্যই বা কী? এটা সাবজেক্টিভ না অবজেক্টিভ? হাইজেনবার্গের মতে :

বস্তুকণার বিষয়মুখী বাস্তবতার অবসান ঘটেছে এবং সেখানে এসেছে গণিতের পরিস্কার স্বচ্ছতা। এই গণিত বস্তুকণার ব্যবহার ব্যাখ্যা করে না, বরং তাদের ব্যবহার সম্পর্কে এটাই আমাদের জ্ঞান।

দেখা যাচ্ছে, বাস্তবতার সম্ভাবনাভিত্তিক ব্যাখ্যা মেনে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। মনে হয়, জগৎ সম্পর্কে আমাদের অনুধাবনে একটা বিপ্লবী তত্ত্বের দরকার (অন্তত রজার পেনরোজ তাই মনে করেন); হয়ত বোরের কথাই ঠিক – চিরায়ত জগতের এক পর্যায়ের নিচে আর কোনো বাস্তবতা নেই। এই ‘শ্বাসরুদ্ধকর’ অবস্থান থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায়ও জানা নেই। মনে হয়, ঘুরে ফিরে প্লেটোর সেই গুহাবন্দী মানুষের দশাতেই আমরা রয়ে গেছি। রবার্ট ফ্রস্টের কবিতার মতো :

We dance ’round in a ring and suppose
But the Secret sits in the middle and knows

এই জ্ঞানতাত্ত্বিক সমস্যার সমাধান কি দর্শন দিতে পারবে? হালের স্টিফেন হকিং মনে করেন

দর্শন মৃত।

তার কারণ, আগের মত চিন্তার সুগভীর চ্যালেঞ্জ নেয়ার কোনো তত্ত্বীয় ক্ষমতাই দর্শনের আর অবশিষ্ট নেই। যেহেতু বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক ও পর্যবেক্ষণীয় আবিষ্কারসমূহ রিয়ালিটি বা বাস্তবতা সম্পর্কে আমাদের এমন অনেক তথ্য দিচ্ছে, যা অনেক সময়েই কা-জ্ঞানের বিপরীত, এবং যেহেতু দার্শনিক চিন্তার মাধ্যমে সেসবের সমাধান ইহজীবনে সম্ভব নয় – তাই আধুনিক বিজ্ঞানীরা ক্লাসিকাল দর্শনের এখতিয়ার নিয়ে শংকিত, এবং তার ভবিষ্যৎ কার্যকারিতা নিয়ে ভাবিত। বিশুদ্ধ চিন্তা দিয়ে কি অভিকর্ষজ ত্বরণ মাপা সম্ভব? মনে হয়, ভাষা-দার্শনিক ভিট্গেনস্টাইনের উপদেশ মতো ‘চুপ’ করে যাওয়াই শ্রেয়।

তথ্যপঞ্জি:
১. বিজ্ঞান ও দর্শন – এ.এম. হারুন-অর রশীদ।
২. সংস্কৃতি : সংঘর্ষ ও নির্মাণ – প্রবীর ঘোষ।
৩. মাধ্যমিক বিজ্ঞান – ১ম খণ্ড।
৪. বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান – ড. এ. এম. হারুন-অর রশীদ।
৫. শ্রডিংগারের বেড়াল এবং তারপর – পথিক গুহ, দেশ, ৫ই অক্টোবর, ১৯৯৬|
৬. Introduction to Philosophy– J.N. Sinha.
৭. Physics and Philosophy– C.F. Von Weizsacker.
৮. Emperor’s New Mind– R. Penrose.
৯. The Grand Design – Stephen Hawking and Leonard Mlodinow

কার্টুন