আমার প্রিয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। আমি এই ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম, শিক্ষক ছিলাম। বুয়েটে আমার জীবনের নয়টি সোনালি বছর আমি কাটিয়েছি।

দেশের শ্রেণিবিভক্ত সমাজে বুয়েট কোন্ শ্রেণির কাজে লাগছে তার আর্থসামাজিক বিশ্লেষণ এবং রাজনৈতিক বিতর্কে আজ আর না হয় নাই গেলাম। সে বিতর্কে না গিয়েও বলতে পারি, দেশের প্রকৌশল ও কারিগরি শিক্ষার উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধিতে বুয়েটের যে একটা গৌরবজনক ভূমিকা আছে তা অস্বীকার করার জো নেই।

এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির আজ করুণ অবস্থা। ব্যাথাভরা মন নিয়ে আমি তাই দেখে এলাম।

এই সেদিন (২৭শে জুন, ২০১২) আমি বুয়েটে গিয়েছিলাম – পুরকৌশল বিভাগের ছাত্র-শিক্ষকদের সাথে দেখা করার জন্য। বুয়েট আমার কাছে যেন এক তীর্থস্থান, দেশে গেলে বুয়েটে যাওয়াটা আমার জন্য ফরজ একটা কাজ।

পুরকৌশল বিভাগের প্রধান ডঃ মুজিবর রহমান বিরাজমান অশান্ত, অনিশ্চিত এবং উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সত্বেও মাথাভর্তি শত ঝামেলা নিয়ে আমাকে ছাত্র-শিক্ষকদের জন্য আয়োজিত একটা সেমিনারে বক্তব্য দেয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।

(এই সুযোগে কৃতজ্ঞতা জানাই মুজিব ভাই ছাড়াও, বিভাগের শিক্ষক ডঃ রাকিব আহসান, ডঃ সেকান্দর আলী আর ডঃ মুক্তাদিরের কাছে। সেকান্দর আর মুক্তাদির বুয়েটে আমার সহপাঠী ছিলেন। বিভাগে সদ্য যোগদানকারী তরুন লেকচারার বাশার আমার দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন, ধন্যবাদ জানাই তাকেও।)

মুজিব ভাই অত্যন্ত গৌরবের সাথে সেমিনারে উপস্থিত ছাত্র-শিক্ষকদের কাছে আমার পরিচিতি দিচ্ছিলেন – আমি বিব্রত বোধ করছিলাম। বিব্রতভাব কাটানোর জন্য কিছুটা, আর কিছুটা আবেগের বশে বলেই ফেললাম আমার বক্তব্যের শুরুতে, ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক’। আমার পরিচিত শিক্ষকদের কয়েকজন, অনেক আগে আমার ছাত্র ছিলেন – বর্তমানে শিক্ষক – তাঁদের দুয়েকজন, এবং শেষ বর্ষের বেশ কিছু ছাত্র সিভিল বিল্ডিং-এর দোতালায় আমার বহুদিনের স্মৃতিবিজড়িত সেই সেমিনার কক্ষে উপস্থিত ছিলেন, আমার কথা শোনার জন্য। সাধারণতঃ নিরাবেগ মানুষ আমি -সেদিন আমিও কিছুটা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম, অস্বীকার করবো না।

হ্যাঁ, আমার এখনো ভাবতে ভাল লাগে, আমি বুয়েটের লোক। তবে আজকের লেখাটা আমার বুয়েট-জীবনের স্মৃতিতর্পণ নয় – আমার প্রিয় প্রতিষ্ঠানটির সাম্প্রতিক পরিস্থিতি মুক্তমনার পাঠকদের কাছে তুলে ধরার একটা অসম্পূর্ণ প্রচেষ্টা।

খবরে (জুলাই ১১, ২০১২) জানলাম – শিক্ষকরা প্রশাসনিক ভবনের সামনে লাগাতার অবস্থান ধর্মঘট করছেন। যোগ দিয়েছেন শিক্ষার্থীরাও। তার আগে উপাচার্য এক নোটিশ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেছেন। শেষ খবরে জানতে পারছি, একযোগে পদত্যাগ করেছেন ডিন এবং বিভগীয় প্রধানেরা।

কেন এই পরিস্থিতি? এককথায় এর কারণ সরকারী দলের আস্কারায় বুয়েট কর্তৃপক্ষের নির্লজ্জ দলবাজী আর স্বেচ্ছাচারিতা।

বর্তমান উপাচার্য ড. নজরুল ইসলাম ছিলেন বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদের সভাপতি। ভিসি হিসেবে নিয়োগ পেয়েই শুরু করেছেন দলীয়করণ। যেদিন দায়িত্ব নেন সেদিনই নিয়োগ দিয়েছেন কামাল আহমেদ নামে আরেক বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতিকে রেজিষ্ট্রার হিসেবে কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে।

এই উপাচার্য খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়েও ভিসি ছিলেন। ব্যর্থতার দায়ভাগ নিয়ে সেখান থেকেও পদত্যাগ করেছিলেন, শুনেছি।

আর উপ-উপাচার্যের কথা কি বলবো। নিজেই নাকি নিজের জন্য এই পদটা সৃষ্টি করে নিয়েছেন রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে। বুয়েটের রীতিনীতি ভঙ্গ করে আটান্ন জন সিনিয়র শিক্ষককে ডিঙ্গিয়ে তিনি সিলেকশন গ্রেড বাগিয়ে নেন। বুয়েটে বঙ্গবন্ধুর নামে একটা সংগঠনের তিনি উদ্যোক্তা। সজীব ওয়াজেদ জয়ের সাথে তোলা ছবি নাকি যত্রতত্র দেখিয়ে বেড়ান।

দেখুন সাপ্তাহিকের প্রতিবেদনে।

আরো দলীয়করণের নমুনা শুনতে চান? বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের এক সহ-সভাপতিকে উপাচার্য একাডেমিক কাউন্সিলকে পাশ কাটিয়ে কারচুপি করে একটা কোর্স ড্রপ করার সুযোগ করে দেন। পরে ধরা পড়ে একটা তদন্ত কমিটি করেন। তদন্ত কমিটির রিপোর্টে তিনি যে অনিয়ম করেছেন এবং এখতিয়ার বহির্ভূত কাজ করেছেন তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

এমন ‘করিৎকর্মা’ ভিসি আর প্রোভিসির পদত্যাগ দাবী করে বুয়েটের ছাত্র-শিক্ষকেরা আন্দোলন করছেন বেশ কয়েকমাস ধরে।

আন্দোলনরত সাধারণ ছাত্র আর শিক্ষকদের ভাবমূর্তিতে কালিমা লেপনের মহান দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন সরকারের মদদপুষ্ট মিডিয়া। তারা প্রচার করছে বুয়েটে জামাত আর হিজবুত তাহরিরের এজেন্টরা সক্রিয়। সরকারের গোয়েন্দারা নাকি বিশেষ সূত্রে জানতে পেরেছে।

শিক্ষক সমিতির সহ-সভাপতি ড. মাকসুদ হেলালীকে তারা হিজবুত তাহরিরের নেতা বানিয়ে ছেড়েছে। অথচ বুয়েটের নিবেদিতপ্রাণ এই শিক্ষক কিশোর বয়সে স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশ নেন। ড. হেলালীর জীবনবৃত্তান্ত পড়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মাথা অবনত হয়েছে।

বামপন্থী দলের সাথে যুক্ত থাকার কারণে আওয়ামি লিগের নিপীড়ণের শিকার হয়ে জেল খাটেন কয়েক বছর। মুক্তিযুদ্ধের আগের বছর এসএসসি পাশ করলেও তাঁর আর এইচএসসি দেয়া হয় নি। অবশেষে আটাত্তরে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে বোর্ডে প্রথম স্থান অধিকার করেন। বুয়েটেও ভাল ফল করেন এবং শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান।

শুধু ড. হেলালী নন, বুয়েটের আরো অনেকের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার শুরু হয়েছে সরকার-সমর্থিত পত্রপত্রিকায়। নমুনা দেখুন এখানে –

জনকণ্ঠের মিথ্যাচার

আজকের (জুলাই ১২, ২০১২) জনকণ্ঠের পুরো প্রতিবেদনটা পাবেন এখানে

রিপোর্টের এই অংশটা উল্লেখযোগ্য –

“এর আগে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা ও বুয়েটের প্রগতিশীল শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সরকারকে কয়েক দফা সতর্ক করেছিল বুয়েটের সরকারবিরোধী মৌলবাদী চক্রের বিরুদ্ধে। কেবল গণমাধ্যমের সংবাদ নয় সরকারের একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে বেরিয়ে পরে বুয়েটের চলমান শিক্ষক আন্দোলনের মূল রহস্যও। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রগতিশীল উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের নিয়োগের ফলে জামায়াত ও হিযবুত তাহ্রীর প্রভাবিত শিক্ষক সমিতির একচ্ছত্র আধিপত্য খর্ব হওয়াই বুয়েট আন্দোলন ও অস্থিরতার মূল কারণ। কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কোন অনিয়ম নয় বরং মহাজোট সরকারবিরোধী মৌলবাদী আদর্শের অনুসারীরা আধিপত্য বিস্তার করতেই মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে বুয়েটকে অশান্ত করছেন। প্রতিষ্ঠানটির মাত্র ২২ ভাগ শিক্ষক বর্তমান সরকার ও প্রগতিশীল মতাদর্শের অনুসারী। ৭০ ভাগ শিক্ষকই বিএনপি-জামায়াত ও হিযবুত তাহ্রীরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাকি ৮ ভাগ শিক্ষক মোটামুুটি নিরপেক্ষ। কেবল তাই নয়, ১৩ সদস্য বিশিষ্ট শিক্ষক সমিতির অধিকাংশই সরকারের ঘোরতরবিরোধী এবং তারাই হিযবুত তাহ্রীরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছাত্রদের মদদ দিচ্ছেন”।

সন্ত্রাস সৃষ্টি করে ছাত্রদের আন্দোলন থেকে নিবৃত্ত রাখার প্রয়াস দেখুন সরকারী ছাত্রলীগের কর্মকান্ডে।

আজকের প্রথম আলোয় (জুলাই ১২, ২০১২) –

“ছাত্রলীগের প্রচারপত্র: শিক্ষকদের সঙ্গে আন্দোলনে অংশ নিলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়ে বুয়েটের ছাত্রাবাসগুলোতে প্রচারপত্র বিলি করেছে ছাত্রলীগ। গত মঙ্গলবার রাতে বিভিন্ন কক্ষে গিয়ে বুয়েট শাখার ছাত্রলীগের প্যাডে প্রচারপত্র বিলি করা হয়। সেখানে লেখা রয়েছে, নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহ্রীর ও যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-শিবির বুয়েট ক্যাম্পাসকে অস্থিতিশীল করতে ষড়যন্ত্রের নীলনকশা প্রণয়ন করেছে। এই অবস্থায় যদি কোনো ছাত্রের বিরুদ্ধে সচেতনভাবে সরকারবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকার অভিযোগ পাওয়া যায়, তাহলে ছাত্রলীগ কঠোরতম ব্যবস্থা গ্রহণ করবে”।

জানি, বুয়েট কোন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। সারা দেশে যে অনাচার, স্বেচ্ছাচার চলছে তার তুলনায় বুয়েটে যা হচ্ছে তা হয়তো এমন কিছু নয়। তবুও বলবো, যেখানে অনাচার সেখানেই প্রতিরোধের প্রয়োজন রয়েছে। বুয়েটের ছাত্র-শিক্ষকদের এই আন্দোলন সফল হোক।