বঙ্গ সংযোগ দেখলেই মনটা কেন যেন উচাটন হয়ে ঘরে থাকে না আর। সম্ভবত বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের সাহায্যে এর একটা মাপসই ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে। একই জিনসম্ভারের অন্তর্গত ব্লা ব্লা ব্লা। তবে, কারণ যাই হোক, শিল্পেবিজ্ঞানেরাজনীতিতে তথা দুনিয়ার যেকোন ক্ষেত্রেই বাঙালি কিছুটা নাম কুড়োচ্ছে বা করে-টরে খাচ্ছে দেখলে এই অশালীন তৃপ্তিটা বেশ কাজ করে বৈকি। অনেকের হয়তো এটা হয় ধর্মীয় ক্ষেত্রে, “…দিলীপকুমার মুসলিম জানলে যেরকম ছোটবেলায় একটা আনন্দ হতো”, সেরকম আর কি। তবে, জ্যাজমিনের বেলায় সেটা অতোটা হয় নি, আমার পুরুষতান্ত্রিক পাপী মন!

বলছিলাম আসলে সুজয় ঘোষের নতুনতম ছবি ‘কাহানি’-র কথা। এই বঙ্গসন্তানের চতুর্থ অবদানের কথাটা লিখতে গিয়ে বস্তুতই বেশ শ্লাঘা অনুভব করছি, কারণ বলিউডে শুধু তিনি কাজ করেছেন বলে নয়, অন্তত এই কাজটা বেশ ভালোভাবে করেছেন বলে। বলিউডে বাঙালি নিয়ে কিন্তু বেশ লম্বাচওড়া সিরিজ বা বিরাটাকৃতির একটা বই নামিয়ে দেওয়া যায়, সেই এক্বেবারে আদ্যিকাল থেকেই শুরু করে।

বিশ্বাস হচ্ছে না?

বেশ, পড়ুন নিরপেক্ষ কথাকার সাদত হোসেন মান্টোর ‘গাঞ্জে ফারিশতে’ বা ‘চান্দিছিলা দেবদূতবৃন্দ’। কিছুটা বিবরণ পাবেন অন্তত এক ‘মহান কলাকার’ বাঙালির, নাম তাঁহার অশোককুমার গাঙ্গুলি। তা বলিউডের বঙ্গস্রোতে সুজয় ঘোষ কিঞ্চিন্মাত্রায় পুরনো পাপী। প্রথম ছবিটা নামিয়েছিলেন তিনি ‘ঝঙ্কার বিটস’, এরপর ‘হোম ডেলিভারি’, তারপর ‘আলাদিন’। সেই থেকেই বোধহয় বুড়ো বচ্চনের ছায়া তাঁর ঘাড়সঙ্গী, কারণ শেষটায়, মানে ‘কাহানি’-তে তিনি বাঙালি কালচার-গেঁড়ে বাবুদের ভ্রূ-টু কুঁচকে, সম্ভবত সাংস্কৃতিক ভাবমূর্তির কেশ দুয়েকটা খসিয়ে বচ্চন ব্যারিটোন ব্যবহার করেছেন কিনা পরমপূজ্যপাদ শ্রীলশ্রীযুক্ত মহর্ষিনন্দন গুর্দেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানে!

ঝঙ্কার বিটস দিয়ে তিনি ততোটা ঝঙ্কার তুলতে না-পারলেও অন্তত সমালোচকদের শুভদৃষ্টিতেই ছিলেন। তবে হোম ডেলিভারিটা নিতান্তই মিসক্যারেজড আর আলাদিন বাবাজীবন জিনের পাল্লায় পড়ায় বলা যায় এটাই তাঁর এক অর্থে প্রথম ছবি, প্রাইম ফ্লিক।

ছবিটা একার্থে বহুভাষিক, বা মেট্রোলিঙ্গুয়াল। ছবিটায় শুরুতে বাংলা রকের পাশাপাশি বেজে চলে রেডিওতে হঠাৎ একটা-দুটো পুরনো গান। বাংলায় মুখখিস্তি করে কলকাতার পুলিশ অফিসার, হিন্দিতে আইবির মেজকর্তা। দক্ষিণীদের মুখে হিন্দি অনেকটা অবিশ্বাস্য হলেও লন্ডনের পশ্চাদ্‌পটে বাঙালির সাথে তাও চলে। যাহোক, কলকাতার পটভূমিতে গড়ে-ওঠা একটা আন্তর্জাতিক বা অন্তত জাতীয় পর্যায়ের চলচ্চিত্রই বলতে হয় একে। আদ্যোপান্ত বাঙালিয়ানার রসায়নে জারিত অথচ সেরকম ঝকঝকে, অনুভবী ক্যামেরার কাজ; কাটছাঁট, গতিময় সম্পাদনা; লাগসই, নাত্যোচ্চ অভিনয়; টানটান, মেদহীন চিত্রনাট্য (দু’চারটে জায়গা ছাড়া); যথার্থ, ইঙ্গিতময় সুরসংযোজন; সর্বোপরি ঘটনার ঘনঘটায় দর্শকের সর্বেন্দ্রিয় মগ্নাবিষ্ট করে রাখার কৌশলপ্রয়োগে অষ্টসিদ্ধি ঠিক লাভ না-করলেও অন্তত বারো আনা ‘প্যায়সা বোসুল’ করেছেন ভদ্রলোক।

ছবির কাহিনি আসলে কোথা থেকে অনুপ্রাণিত বা অনুরণিত, সে নিয়ে কম মাথা ঘামান নি দর্শককুল, আন্তর্জালে ছড়ানো নানা প্রবন্ধে তার প্রোজ্জ্বল প্রমাণ হ্যুপস্থিত। হাতে খাতা-কলম, অভাবে ল্যাপিখানা নিয়ে লিস্টি করতে বসুন দিকিনি: ১. ইস্টার্ন প্রমিসেস, ২, রুবি কায়রো, ৩. দ্য মাইটি হার্ট, ৪. দ্যাট গার্ল ইন ইয়েলো বুটস, ৫. সানফ্লাওয়ার, ৬. টেকিং লাইভস, ৭. কিল বিল, ৮. দ্য সিক্সথ সেন্স…চলছেই। কোন একটা জিনিসকে সুনির্দিষ্ট কোন ছাঁচে ফেলতে না-পারলে বিশেষ অস্বস্তি বোধ করি আমরা, না? তবে কি, এক্কেবারে ইয়েমার্কা নকলি না হলে আমার বিশেষ সমস্যা হয় না। থাক মিল, পরে ওগুলোও দেখে মজা নেওয়া যাবে, ঠিকাসসসসসসে? “দুনিয়া আনন্দময়, যার মনে যাহা লয়!”

ছবিটার মূলধারাটি যে ঠিক কী, সেটা নিয়েও খুদে বাহাসে নামা যায়, তবে এককথায় থ্রিলার বললেই সেরে যায় বোধহয়। ছবির কাহিনিবিন্যাস কিছুটা এরকম: হলিউডি ভঙ্গিতে গবেষণাগারে প্রাণঘাতী বিষ আবিষ্কার, এরপর কলকাতায় এক আইনরক্ষাকারী কর্মকর্তার কাছে খবর আসে সেখানকার পাতালরেলে ‘সন্ধানযোগ্য, সন্দেহযোগ্য ‘কিছু’ আছে। নিচে নামেন তিনি, সূত্রবিহীন, সেল নেটওয়ার্কহীন একাকী মানবঘূর্ণিতে তিনি পাক খেতে থাকেন। হঠাৎ সন্দেহ তীব্রতর, ছোট্ট একটা ভাঙচুর, নীরবতা, চিরতরের।

এরপর ছুটে-চলা দু’বছর পর।

কোন এক রোদজ্বলা সকালে আকাশ থেকে টুপ করে নেমে আসেন এক ভদ্রমহিলা, ইন ফ্যাক্ট বিলেত থেকে। নাম ছিলো তার বিদ্যা ভেঙ্কটেশন-বাগচী (বিদ্যা বালান)। বিদ্যার নাম ও দক্ষিণী ইমেজ দুটোই ব্যবহার করেছেন পরিচালক, সম্ভবত দর্শকদের বিনোদনের গোড়ায় সুড়সুড়ি শুরু করতে। তবে বিনোদনপিয়াসী দর্শকদের কিছুটা বোধহয় হতাশ করেই এবং বেশ কিছুটা অস্বস্তি দিয়েই বিদ্যা সাত মাসের গর্ভবতী। অস্বস্তি বা উসখুসানি বাড়তে থাকে ছবির যাপিত দৈর্ঘ্যের সাথেই, যখন বিদ্যাবাহী গাড়ি এসে নামে কালীঘাট পুলিশের অফিসে। জানতে পারি বিদ্যার স্বামী অর্ণব বাগচীর (ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত) কথা। স্বামী-স্ত্রী দুজনাতেই পরম সুখে থাকতো। বিলেতে, সফটওয়্যার প্রোগ্রামার দুজনেই। বিদ্যা যখন গর্ভবতী, তখন অনেকটা স্ত্রীর নির্বন্ধাতিশয্যেই সে কলকাতায় এনডিসি (ন্যাশনাল ডেটা সেন্টার)-তে আসে একটা সেমিনারে। ওঠে লেক টেরেসের ‘মোনালিসা গেস্ট হাউজে’। নিয়মিত ফোন করতো সে স্ত্রীকে, বড্ড ভালোবাসা ছিলো তাদের, টুকরো টুকরো ফ্ল্যাশব্যাকে বিধৃত সেসব ঘরোয়ামধুর রোম্যান্স। তারপর একদিন কোন ইঙ্গিত না দিয়ে, সূত্রমাত্র না রেখে সে বেমালুম গায়েব হয়ে যায়। বিদ্যা প্রথমে উদ্বিগ্ন, পরে আশঙ্কিত ও আতঙ্কিত হয়ে শারীরিক এই অবস্থায় খুঁজতে চলে এসেছে ত্রিভুবনে একমাত্র অবলম্বন তার স্বামীকে। পাশে পায় সদ্য চাকুরে সাত্যকি সিনহা উর্ফ রানাকে (পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়)।

কিন্তু, কোথায় অর্ণব?

কলকাতার জনার্ণবে একবিন্দু অর্ণব তো কোনো ছাপ রেখে যায় নি। রহস্যজনকভাবে যে-হোটেল থেকে সে ফোন করতো বলে বিদ্যা পুলিশকে জানায়, সেখানটায় কোন পাত্তা নেই তার। রেজিস্টারে নাম নেই, তার ছবিটা কেউ চেনে না, দেখে নি। নেই এনডিসি-তে কোন সূত্র। নেই যেসব স্মৃতিময় জায়গার কথা সে বলতো, সেখানেও। কোন পদচিহ্ন না রেখে প্রেমময় এই স্বামীপ্রবরের উধাও হয়ে যাওয়াটা বিদ্যাকে বিবশ আর অসহায় করে, সাথে দর্শকদেরও। বিদেশবিভূঁইয়ে একলা এক গর্ভবতী শ্লথগতি নারীর একমাত্র অবলম্বনের এমনি অদ্ভুতুড়ে অন্তর্ধান বড়ই খচখচানি ফেলে দেয় হৃদমাঝারে। প্রতিবারই যখন বিদ্যার শ্বাস দ্রুত ও ভারি হয়ে উঠছে, কিংবা তার ভারসাম্য টলে-যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে, দর্শকেরা পড়ে যান ভারি বিপদে, উৎকণ্ঠায়।

ভাবি নিজের কথাই, ভাবতে বসি ছবি দেখতে দেখতেই। আজ যদি আমি এমনি করে হারিয়ে যাই আমার নিজের শহরেই, আমার প্রিয়জন থাকে গর্ভবতী, কী দুরবস্থা হতো তার? ভাবতে গিয়ে শিউরে উঠতে চাই, টের পাই আমার সাথে ওরকম কেউ নেই। অতো ভালোবাসাময়, অতো দৃঢ়চিত্ত কেউ নয়। যে হয়তো কিছুটা হতে পারতো, সে হারিয়েছে কোথায় কোন দূর অজানায়। মনে আচমকা মৃদুস্বরে বেজে-ওঠা নির্ভুল সাঙ্কেতিক সঙ্গীত ঠাঁই নেয়। “একবার বল নেই তোর কেউ নেই, কেউ নেই, কেউ নেই…”

কাহিনি মোড় নেয় এবার আরো ঘনীভূত রহস্যময়তায়।

ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর খোদ সদর দফতরে পড়েছে নাড়া। এনডিসি-র এইচআরের প্রধান এঞ্জেলা ডি মেলো ছবিটার সাথে মিল পান তাঁদেরই প্রাক্তন এক সহকর্মী মিলন দামজির। এমনিভাবে সেও উধাও হয়ে গিয়েছিলো বছর দুয়েক আগে। ছবিটা শুরু হয় দুবছর আগের এক দুর্ঘটনা দিয়ে, মনে রেখেছেন তো? কোথাও বেজে ওঠে সংকেত, স্বল্পশব্দের, কিন্তু নির্ভুল। আইবি থেকে ছুটে আসেন ইস্পপেক্টর এ. খান (নাওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি)। বারংবার বিদ্যা ও অন্যদের চুপ করিয়ে দিতে চান, বোঝাতে চান মিলন দামজি বলে কেউ নেই, কোথাও কেউ কস্মিনকালেও ছিলো না। ভদ্রলোকের অভদ্রজনোচিত (পড়ুন, পুলিশি) অভিনয় স্রেফ দুর্ধর্ষ। মনে হয়েছে যেন আইবির অফিস থেকে তুলে এনে তাঁকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে ফ্রেমে, রুপোলি পর্দায়। দর্শক মাথা চুলকায়, “কাহিনিটা কী আসলে?”

বিদ্যা হার মানবে না। রানাও তার সঙ্গ ছাড়ছে না। যতোটা না দায়িত্বপালনের তাগিদে, তার চাইতেও কি বেশি কিছু আছে তার সফেদ পুলিশি উর্দির পেছনে? কেন মিলন দামজি-র ব্যাপারটা নিয়ে চুপ করাতে ছুটে আসতে হয় আইবির সেকেন্ড ইন কমান্ডকে? কেন মিলন এতোটা অদৃশ্য বা অস্পৃশ্য? কেন অর্ণবের কথা কেউ জানে না? কী সম্পর্ক দুবছর আগের মেট্রোতে বিষক্রিয়ায় শত মানুষের মৃত্যুর সাথে অর্ণব বা মিলন বা আইবি বা বিদ্যার? আইবি থেকে স্বেচ্ছাবসরে-যাওয়া কর্নেল বাজপাই কেন মুখ ঘুরিয়ে নেন মিলনসন্ধান থেকে? কেনইবা আইবিপ্রধান ভাস্করন এতোটা মুখর কর্নেলকে ফেরাতে এবং কেনইবা কর্নেল ইঙ্গিত দেন খোদ আইবিতেই ঘর বেঁধেছে ঘোগ?
ছবির প্রতিচ্ছবি

উত্তর পাবেন ছবিটা দেখলে। পুরোই বিনোদনী। কিছুটা চিন্তারও। যেমন, খান যখন রানাকে শেষ দিকে বলেন, ক্রিমিনালের সাথে আমার কোনই পার্থক্য নেই। সে কাজ করে তার জন্যে, আমি দেশের জন্যে। তখন হয়তো কারোর মনে দানা বাঁধতেও পারে সবকিছু ‘ফেয়ার এন্ড লাভলি’ করার মনস্তত্ত্বটা ঠিক কতোটা জরুরি হওয়া উচিত, এই চিন্তা। কিন্তু জট-পাকানো আর জট-ছাড়ানোর প্রবল বানভাসিতে কোথায় হারায় সেটা, কে জানে!

অভিনয় নিয়ে কিছু বলা যায়। বিদ্যা নিজেকে বারবার তাঁর নানা ছবিতে পাল্টাচ্ছেন, বহুমাত্রিক অভিনেতার এই এক চিরচিহ্নিত রূপ। এই ছবিতে প্রায় আগাগোড়াই তিনি গর্ভবতী মহিলা, যিনি দৃঢ়সংকল্প প্রেম ও প্রতিজ্ঞায়। আশা করা যায় এর যোগ্য পুরস্কার লাভ করবেন তিনি। পরমব্রত নিজেকে কলকাতার নবযুগের বাংলা ছবির অনিবার্য অনুষঙ্গ করে তুলেছেন, এখানেও তিনি সমান সপ্রতিভ। অন্যেরাও যোগ্য নিঃসন্দেহে। বিশেষভাবে বলতে হয় শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের কাজটা। লাইফ ইন্স্যুরেন্সের এই ব্যর্থপ্রায় কমিশন এজেন্টের ভূমিকায় যিনি ডঃ জেকিল, তাঁর হাস্যমুখে মিঃ হাইড হওয়াটা শীতল শিহরণ দিতে পারে। আগেই বলেছি নাওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকির কথা। আরেকটা ছবিতেও তিনি ছিলেন, কাহানি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে ওটার কথাও উল্লেখ করেছেন অনেকে প্রসঙ্গত, পান সিং টোমার। হয়তো ভবিষ্যতে ওটা নিয়েও কিছু লিখে বসতে পারি, যথারীতি ভুল করে। খুদে কিন্তু জোরালো ভূমিকায় এগনেস ডি’ মেলো (কলিন ব্লানশ, একাকী ফ্ল্যাটে ভদ্রমহিলার নৃত্যের দৃশ্যটা দারুণ বাস্তব), ভাস্করন (ধৃতিমান চ্যাটার্জি, ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রতিভাধর ও অবহেলিত এক নাম), রমেশ পাল (কল্যাণ চ্যাটার্জি), বিষ্ণু (ঋতব্রত মুখার্জি, মোনালিসা হোটেলের খুদে বিচ্ছু), ইন্সপেক্টর চ্যাটার্জি (খরাজ মুখোপাধ্যায়) বেশ ভালো, ঠিকঠাক। কাস্টিঙেরও প্রশংসা করে রাখলাম এই ফাঁকে।

ছবিটার আরেকটা দিক বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো, সেটা তার সঙ্গীতায়োজন। লক্ষ্য করবেন, আমি স্রেফ ভারতীয় ছবির চিরচেনা মিউজিক্যাল স্কোরের কথা বলছি না। পুরো ছবিটায় বিশাল-শেখরের মতো ভারি নামগুলো স্রেফ যেন ময়ূরপুচ্ছ, রংবাহারি, কিন্তু তেমন কোনো কাজের নয় স্রেফ আকর্ষণ বাড়ানো ছাড়া। কারণ, পুরো ছবিজুড়েই মৌলিক গান বোধহয় এক-আধখানা। বরং অনেক বেশি ভালো লেগেছে ছবির নানান মুহূর্তে মোক্ষমভাবে নানা হিন্দি গান বসিয়ে-দেওয়া, সিচুয়েশন ব্যাখ্যা করতে কখনো, কখনো বা পূর্বগামী হিসেবে। কেয়ারফুলি কেয়ারলেসলি সঞ্চালিত এসব গানের ধাঁধাভেদ করায় বেশ আনন্দ পেয়েছি ব্যক্তিগতভাবে, অবশ্য সেগুলো ঠিক অতোটা কঠিন কিছু ছিলো না। তবে বচ্চন আর রবিবাবুর যুগলবন্দী তেমন মনোগ্রাহী হয় নি মূলত উচ্চারণের কারণে। এছাড়াও তিনি সংলাপে, সিচুয়েশনে এবং অন্যত্রও বসিয়ে দিয়েছেন ছোটখাটো পাজল। পুরো ছবিজুড়েই এমনি নানান দ্বিস্তরী ইঙ্গিত লুকিয়ে থাকে। এমনকি ছবির নাম থেকে শুরু করে চরিত্রের নামেও। সাত্যকি নামের অর্জুনের বাহনের পৌরাণিক রেফারেন্সের কথা ছবিতে সংলাপাকারেই পাওয়া যায়। দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি, উদযাপন এবং সমাপনের পুরো ব্যাপারটায় ছবির জের টেনে-যাওয়াটাও অর্থবহ। সবচেয়ে অর্থবহ বোধহয় প্রতিমা নিরঞ্জনের প্রস্তুতিতে ছবির চূড়ান্ত ব্যাপারে পৌঁছানোর অংশটা। অজানা আতঙ্কে কেঁপে ওঠে বুকটা, বিসর্জনের অন্য অর্থ আবিষ্কার করে। ছবি শেষ হওয়ার পর মনে পড়ে, বিজয়া দশমীরও আরেকটা অর্থ আছে। শেষমেষ ছবির ট্যাগলাইন: “A Mother of all films”। ছবি শেষ হওয়ার পর বোঝা যায় ‘মা’ শব্দটার অন্তত দুটো অর্থ আছে এখানে: জগজ্জননী ও বিদ্যা, হু ইজ ইমপ্রেগনেটেড উইথ দ্য কোর কনসেপ্ট: ‘কাহানি’।

শেষের মোচড়টা পছন্দ হয় নি অনেকের, অনেকে বলেছেন ঠোঁট বাঁকিয়ে, বলিউডি এন্ডিং! আমার অন্তত সেদিকটায় আপত্তি নেই, তবে কিছু অযৌক্তিক ব্যাপার ঠিক যেন বিবেচনাশক্তিকে পুরোটা বাগ মানাতে পারে নি। ঈশ্বর বিশ্বাস করি আর নাই করি, ডিভাইন প্রভিডেন্স উড়িয়ে দেই হেলায়, তারপরও কোথাও যেন “ভালো করলে ভালো হয়, খারাপ করলে খারাপ হয়” এই মিমটা বেশ জম্পেশ শেকড় গেড়ে বসেছে। তাই, অবচেতনে হলেও যথাধর্মোস্ততোজয়ঃ-ই কামনা করি। বহুচর্চিত এই ফর্মুলাটা নেহাৎ মন্দ না, খাটে অনেক মানবনির্মিত ক্ষেত্রেই, বাস্তবে অবশ্য ঠিক ততোটা নয়।

ছবির মূল জোর অবশ্যই ক্যামেরার কাজ। আলাদা করে নাম করতেই হয় ডিওপি সত্যজিৎ পান্ডের। তাঁর কলকাতার নিরাবেগ, বহুবর্ণিল চিত্রায়ন সত্যিই প্রচুর শংসাধ্বনি দাবি করে। ফ্রেমের কম্পোজিশন, আলোকসম্পাত মনোমুগ্ধকর পেশাদারি মানের। এটা দাবি করবো না যে এর চাইতে আরো ভালো কিছু সম্ভবপর ছিলো না, তবে যা হলো সেটা ভালোই হলো। নম্রতা রাওয়ের সম্পাদনাও যথেষ্ট মানসম্মত। হোঁচট খেতে হয় না বিশেষ। যখন যেখানে পরিচালক যা চান, ঠিক সেরকম তুলে ধরার মানুষ থাকলে তো পরিচালকের কাজটা নিতান্তই দুধভাত হয়ে যায়। কাহিনিবিন্যাসে পরিচালকের হাত আছে ভালোই, শোনা যাচ্ছে ওটার ২য় খণ্ডও আসতে যাচ্ছে। এছাড়া ছবিটা তামিল, তেলেগু আর ইংরেজিও হতে যাচ্ছে। মাত্তর ৮ কোটি টাকা খরচ করে প্রায় ১০৮ কোটি টাকা তুলে আনাটা নেহাৎ চাট্টিখানি কথা নয়।

শুভমস্তু। পারলে ছবিটা দেখে ফেলুন, সম্ভব হলে বড়পর্দায়। আনন্দ পাবেন বিনোদনমূলক, নিঃসন্দেহে।
আমার চলচ্চিত্রালোচনা এখানেই শেষ। অলমোস্ট আলবিদা।

এবারের অংশটা তাঁদের জন্যে যাঁরা ছবিটা এরই ভেতর দেখে ফেলেছেন বা দেখার ইচ্ছে পোষণ করেন না মোটেই। যাঁরা এখনও ছবিটা দেখার বিন্দুমাত্র আশা রাখেন, তাঁরা ঢুকলে নিজ দায়িত্বে ছবিদেখার মজা নষ্ট হওয়ার অনুভূতি পাবেন ভবিষ্যতে এবং তার জন্যে দায়ী হবেন নিজেই।

ছবিটা, বলেছি আগেই, বেশ টানটান, সমগতিময়, আটকে রাখে। পরিচালকের নিঃসন্দেহে বড় সাফল্য। কিন্তু ছবির পরে যখন যুক্তি ও বিবেচনাবোধ বেশ কিছুটা ফিরে আসে তখন ঠান্ডা মাথায় ভাবার পর দুচারটে বেশ ভালো ফাঁকফোকর ধরা পড়লো, যেগুলো হয়তো আরো ঠিকঠাক করা দরকার ছিলো। চলুন, সেসব জানাই এবং জানি আপনাদের মতামত।

১) মিলন দামজি কাজ করে এনডিসি-তে। উধাও হয়ে যায় সে মেট্রো দুর্ঘটনার পরপরই। এনডিসি-তে সে ছিলো আইবির এজেন্ট, বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত এজেন্ট। তাহলে তার ব্যক্তিগত তথ্য সম্পর্কে কিছুই জানা নেই আইবি-র, এটা কিভাবে বিশ্বাস করা যায়, বিশেষত এরকম লোকের বেলায় যাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরিই করা হচ্ছে? যদি ধরেও নেই এরকম পিছুটানহীন লোকদেরকেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছিলো, তারপরও কথা থাকে।

২) মিলনের কাগুজে ব্যক্তিগত ফাইল থাকে এনডিসি-র পুরনো অফিসে, ডেটাবেজে কিছু নেই, বা সংরক্ষিত। বিদ্যা আর রানা সে-পথে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে বাধা পায়, চুরি করে ঢোকে এনডিসি-র পুরনো অফিসে, সেখান থেকে মিলনের ব্যক্তিগত ফাইল ঘেঁটে তার একটা আবাসিক ঠিকানা পায়। সেখানে যায় তারা এবং এরপর একটার পর একটা সূত্র পেতে থাকে। কথা হচ্ছে, এই ফাইল বা ঠিকানা সবই তো দুবছর আগে আইবি-র না-পাওয়ার কোনোই কারণ ছিলো না! এতো দুর্ধর্ষ দুশমনের খোঁজ পেলো না আইবি যে কিনা এতো বিশাল একটা ক্রাইমের সাথে জড়িত, অথচ সব সূত্রই ছিলো নাকের ডগায়! সিম্পলি গ্রেট আ গ্লিচ!

৩) মিলনের রক্তের গ্রুপ বোম্বে ব্লাড গ্রুপ। খুব বিরল এই রক্তের গ্রুপটির তথ্য একটা বেশ বড়সড় সূত্র ছিলো বিদ্যাদের জন্যে। রমেশ পাল (কল্যাণ চ্যাটার্জি) নামে পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত যে-সোর্সের কাছ থেকে তারা জানতে পারে বছর দুয়েক আগে কখন, কোথায় এই রক্তের গ্রুপের প্রয়োজন পড়েছিলো, সেই সোর্সের কাছে আজগুবিভাবে আইবির তদন্তকারী কেউ যায় নি, বা কাজেই লাগায় নি তাকে। এমনকি তার যে এই দুর্লভ ব্লাডগ্রুপ আছে, সেটা এনডিসি-র এইচআর-এর শীর্ষজন জানেন, কিন্তু আইবি কিছুই জানে বলে মনে হয় না। কেমনে কিরে ভাই?

৪) বিদ্যা কোথাও কোন সূত্র রাখে না বলে বলা হয়। প্রথম থেকেই দেখি, পুলিশের খাতায় সে সই করে নি। কিন্তু, ভারতীয় আইনে বলা আছে, যিনি মিসিং রিপোর্ট করাতে এসেছেন তাঁকে পুলিশের খাতায় অবশ্যই সই করাতে হবে। নইলে সে-রিপোর্ট বাতিল বলে গণ্য হবে। এছাড়াও, অর্ণবের সাথে তার বিয়ের একমাত্র ছবি সে অনেকগুলো কপি করিয়ে নিয়ে আসে। সেরকম এক কপি এমনকি এনডিসি-তে ঘাপটি মেরে-থাকা এক কুচক্রীর (শান্তিলাল মুখার্জি) হাতেও গিয়ে পড়ে এবং সে ওই ছবি স্ক্যান করে কন্ট্রাক্ট কিলার বব বিশ্বাসের (শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়) মোবাইলে এমএমএস করে পাঠিয়ে দেয়। ববও কেন যেন অন্যদের “নমস্কার। এক মিনিট!” বলে গর্মাগর্ম সিসাকাবাব খাইয়ে দিলেও বিদ্যাকে স্রেফ মেট্রোর সামনে একটু ভড়কি দিয়েই ছেড়ে দেয়, তাও নিজের চেহারা জানান দিয়ে। মেরে দিলেই তো সব সাফ হয়ে যেতো! অবশ্য, মারার চেষ্টা সে পরে করে নি তাও নয়। যাকগে, কথা হচ্ছে বিদ্যার ওই ছবি পাওয়াটা আইবির বেলায় অতোটা অসাধ্য কিছু ছিলো না। এবং, সেই সূত্র ধরে বিদ্যাকে খুঁজে পাওয়াটাও। কাজেই…

৫) মিলনের শেষদিকে আসার কি খুব প্রয়োজন ছিলো ছবিটার সব সূত্র জোড়া-দেওয়া ছাড়া? অন্য কাউকে দিয়ে সহজেই এই ছোট্ট কাজটা হাসিল করিয়ে নেওয়া যেতো, তাই না? যাক, এইটুকু মেনেই নেওয়া যায় গল্পের শীর্ষবিন্দুর দরকারে। কিন্তু, বাকিগুলোর কী হবে?

ডঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল কি পারবেন এই প্রশ্নের জবাব দিতে?

অপেক্ষায় আপাতত আইজদ্দি (ডক্টর নাই)।

[পু.: অহৈতুকী আগ্রহের ঋণস্বীকার ও শোধ-করার একটা প্রচেষ্টা এটা।]