জেনেটিক যুদ্ধাস্ত্র : একটি ধারাবাহিক পর্যালোচনা (১)

কৃত্রিম সংশ্লেষণ
প্রথমেই বলে নেয়া দরকার যে, এখন আমি যা আলোচনা করতে চাইছি তা কোন কল্প বিজ্ঞান নয় বরং খুব সহজ এবং সরল প্রাণান্তকর বাস্তবতা। বিজ্ঞানের অপব্যবহারে কি করে অকস্মাৎ কিছু অনুজীব সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত হয়ে আবির্ভূত হয়ে একটি প্রাণচঞ্চল জনপদকে মৃত্যু উপত্যকায় পরিনত করতে পারে – তা আপনাদের সামনে তুলে ধরার এক ক্ষুদ্র প্রয়াস আমার এই লেখা। গত পর্বে , আমি প্রচলিত জৈব অস্ত্রের উপর সাধারণ কিছু ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছি। সেসব ধারণা কেবলমাত্র আমাদের বর্তমান এবং অতীতের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞাননির্ভর যার বাহিরে রয়েছে আরো বিস্তর এবং বিধ্বংসী বাস্তবতা যা হয়তোবা আমাদের দৃষ্টিসীমার অপর প্রান্তে অবস্থান করছে। আনবিক জীববিজ্ঞান (Molecular Biology) এবং বায়োমেডিক্যাল গবেষণার দ্রুত উন্নতি আমাদের সামনে কল্যাণকর জীবনের দুয়ার উন্মোচন করার পাশাপাশি সৃষ্টি করেছে নিত্য নতুন ভু-রাজনৈতিক ও সামরিক চ্যালেঞ্জ এবং জাতীয় নিরাপত্তা হুমকি। জেনিভায় ৭ই ডিসেম্বর , ২০১১ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী ক্লিনটন জৈব অস্ত্র কনভেনশনের উপর অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন :

“The emerging gene-synthesis industry is making genetic material widely available. This obviously has many benefits for research, but it could also potentially be used to assemble the components of a deadly organism.”

“A crude but effective terrorist weapon can be made by using a small sample of any number of widely available pathogens, inexpensive equipment, and college-level chemistry and biology,”

“Less than a year ago, al Qaeda in the Arabian Peninsula made a call to arms for, and I quote, ‘brothers with degrees in microbiology or chemistry to develop a weapon of mass destruction.'”

Remarks at the 7th Biological and Toxin Weapons Convention Review Conference

অর্থাৎ সামান্য কলেজ পর্যায়ের ছাত্রের রসায়ণ ও জীব বিজ্ঞানের জ্ঞান দিয়েই সাধারণ গবেষণাগারে কার্যকর জৈব অস্ত্র উৎপাদন করা সম্ভব। কিন্তু মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলেননি তা হলো, যুক্তরাষ্ট্র , রুশ প্রজাতন্ত্র , বৃটেন এবং জার্মানীর মত রাষ্ট্রের বিলিয়ন ডলার মূল্যের সরকারী সামরিক গবেষণাগার সমূহে কর্মরত পোস্ট ডক্টোরাল গবেষকেরা তাহলে কি উৎপাদন করতে সক্ষম ? কিছু উদাহরন দেয়া যাক যাতে পাঠকেরা হয়তোবা নিজেরাই এর উত্তর খুঁজে নিতে সক্ষম হবেন।

আমরা জানি যে , অত্যন্ত মরণঘাতী ও সংক্রামক অনুজীব সহজলভ্য নয়। এসব অনুজীবের পরিবহন এবং গবেষণার ব্যপারে নানা রকম সরকারী বিধি নিষেধ বলবৎ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে গুটি বসন্তের জীবাণু ভারিওলা ভাইরাসের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৮০ সালে গুটি বসন্ত পৃথিবী হতে নির্মূল হয়েছে বলে ঘোষণা দেয় এবং সারা পৃথিবীতে কেবলমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রুশ প্রজাতন্ত্রের দুটি গবেষণাগারে এই ভারিওলা ভাইরাস উচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সংরক্ষিত আছে। বলাই বাহুল্য যে, এমতাবস্থায় অন্য কারো পক্ষে গুটি বসন্তের ভাইরাসের মজুদ হস্তগত করা এক রকম অসম্ভবই বটে। কিন্তু সমসাময়িককালে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং তথা আনবিক জীব বিজ্ঞানের ব্যপক অগ্রগতির ফলে , এ ধরনের অনুজীবের কৃত্রিম সংশ্লেষন কিংবা নতুন কম্বিনেশনের অনুজীবের উৎপাদন খুবই সম্ভব। কেন নয় ?
ইন্টারনেটের বদৌলতে কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত বেশীরভাগ জীবের জিনোম সিকোয়েন্স এখন মুহুর্তের মধ্যে সংগ্রহ করা যায়। নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে ২০০২ সালে একদল গবেষক কৃত্রিম সংশ্লেষণের মাধ্যমে কৃত্রিম পোলিও ভাইরাস উৎপন্ন করেন (১) [চিত্র -১]। তারা পোলিও ভাইরাসের জেনেটিক সিকোয়েন্স ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করেন এবং সেই সাথে ৭,৫০০ বেইজ পেয়ারের ক্লোনকৃত ডিএনএ (cDNA) নমুনা অনলাইনে ক্রয় করে মেইল ওর্ডারে সংগ্রহ করেন এবং তারপর ধাপে ধাপে পোলিও ভাইরাসের সম্পূর্ণ জিনোম পুনঃনির্মাণ করেন। এর পর সেই সংশ্লেষিত ডিএনএ থেকে পুরোমাত্রার প্যাথোজেনিক গুনসম্পন্ন পোলিও ভাইরাস উৎপন্ন করা হয় । একই ভাবে ক্ষুদ্র ডিএনএ সিকোয়েন্সের নমুনা ব্যবহার করে অন্তত পাঁচ রকমের ভাইরাসের কৃত্রিম সংশ্লেষন সম্ভব যেগুলো জৈব অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারযোগ্য। এর মধ্যে রয়েছে , ইবোলা ভাইরাস, মারবুর্গ(Marburg) ভাইরাস এবং ভেনেজুয়েলান একিনা এনসেফালিতিস ভাইরাস (Equine Encephalitis) ।


চিত্র ১ : পোলিও ভাইরাসের কৃত্রিম সংশ্লেষণ।

এখন সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে পোলিও ভাইরাস যদিও জৈব অস্ত্র হিসেবে তেমন কার্যকর নয়, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির এই পরীক্ষা থেকে অন্তত অনুমান করা যায় যে, জেনেটিক ইনঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে কি রকম ফলাফল অর্জন করা সম্ভব। কৃত্রিম সংশ্লেষণ পদ্ধতি ব্যবহার করে গুটি বসন্তের জীবাণু ভারিওলা ভাইরাস তৈরী সম্ভব হলে দৃশ্যপট বদলে যাবে কেননা আদর্শ জৈব অস্ত্রের সব রকম গুনাগুন গুটি বসন্তের মাঝে বিদ্যমান । এটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে এবং এর কার্যকর প্রতিষেধক এখনও তৈরী হয় নি। এরকম কাজে খরচ কত হতে পারে বলে অনুমান করুন ! মাত্র এক মার্কিন ডলার খরচ করে ২০,০০০ বেইজ পেয়ারের একটা ডিএনএ অনু সংশ্লেষণ করা সম্ভব। হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে খরচ পড়বে কয়েক সেন্ট এবং ইবোলা ভাইরাস সংশ্লেষণে খরচ হবে মাত্র কয়েক ডলার। কিন্তু গুটি বসন্তের ভারিওলা ভাইরাসের জিনোমে রয়েছে প্রায় দুই লক্ষাধিক (২০০,০০০+ ) বেজ পেয়ার যা সংশ্লেষণ করা বেশ সমস্যা সংকুলই বটে ! তবে এর সমাধানও আছে যা আগামী পর্বের জন্য তুলে রাখলাম। (চলবে)

তথ্যসূত্র :
(১) Cello, J., Paul, A.V. & Wimmer, E. (2002) Chemical synthesis of poliovirus cDNA: generation of
infectious virus in the absence of natural template.
Science, 297, 1016–1018.