এই লেখাটা আমার ব্যক্তিগত কিছু মত, পর্যবেক্ষণ আর প্রশ্নের সমাহার। আমার মতের সাথে অনেকের দ্বিমত থাকবে সন্দেহ নেই। আমার সাধারণ বোধ বা যুক্তির উপর ভিত্তি করে এই মত বা পর্যবেক্ষণে উপনীত হয়েছি । লেখাটা অসংলগ্ন, পরিপাটি, পাণ্ডিত্যপূর্ণ কোন লেখার চেষ্টা করিনি। হঠাৎ করেই প্রসঙ্গান্তরে চলে যাব।

ভাষার গুরুত্ব বা উপযোগিতা কিসে? দুটো কথা মনে আসে। এক হল কোন এক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভাবের আদান প্রদান বা তথ্য বিনিময় করার জন্য উদ্ভাবিত এক মাধ্যম। এই অর্থে ভাষা একটা সাধনী বা সাধিত্র মাত্র। এখানে আবেগ বা হৃদয়ের কোন ব্যাপার নেই। ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তাটাই মুখ্য। আর দ্বিতীয় যে ব্যাপারটা মনে আসে সেটা হল সেই জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, সাহিত্য, সঙ্গীত, প্রকৃতি বা আবহাওয়াকে কাব্যিক ভাবে প্রকাশের একটা মাধ্যম। এখানে আবেগ বা হৃদয়ের ব্যাপার জড়িত।

প্রথম উদ্দেশ্যের জন্য এক প্রমিত ভাষা প্রয়োজন। বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর (বাংলাদেশ ও ভারতে) জন্য সেই প্রমিত ভাষার ব্যবহার আমরা দেখতে পাই সংবাদপত্রে, রেডিও বা টেলিভিশনের সংবাদ পঠনে, স্কুলের পাঠ্য বইএ, সরকারী দলিল দস্তাবেদে, অভিধানে এবং লোকসংস্কৃতিভিত্তিক নয় এরকম সাহিত্য, সঙ্গীত বা নাটকের ভাষায়। আমি এখানে প্রমিত ভাষা আর উপভাষার (যাকে অনেকে আঞ্চলিকতা বলেন) পার্থক্য বোঝাতে চাইছি। অবশ্য প্রমিত ভাষারও দুটো রূপ আছে, সাধু ও চলিত। সাধু ভাষা বিলুপ্তির পথে। এই আলোচনায় প্রমিত বাংলা ভাষা বলতে চলিত বাংলা ভাষাই বোঝাব। শুদ্ধ বাংলা ভাষা বলতেও চলিত প্রমিত বাংলা ভাষাই বোঝাব। উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা হল বাংলাদেশ বা ভারতের বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে অঞ্চল ভেদে বাংলা ভাষার পরিবর্তিত বা ভ্রংশিত রূপ। প্রমিত ভাষা ও উপভাষা দুটোরই গুরুত্ব আছে, কিন্তু দুটির গুরুত্ব দুই জায়গায়। যখন বাংলাদেশ বা বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর সবাইকে শ্রোতা করে কিছু বলা বা লেখা হয় (যেমন এই ব্লগে) তখন অবশ্যই প্রমিত ভাষা ব্যবহার করা বাঞ্ছণীয়। সাধারণ বোধে তাই বলে। উপভাষা বা আঞ্চলিকতা অঞ্চল ভেদে ভিন্ন, তাই সার্বিক উদ্দেশ্যে লেখা বা বলার সময় কোন বিশেষ অঞ্চলের উপভাষা ব্যবহার করাটা অন্য অঞ্চলের জনগণের জন্য অসুবিধাজনক এবং সেটা তাদের প্রতি অসজৌন্যও বটে। যে দেশ বা সমাজের জনগোষ্ঠী বিভিন্ন ভাষা বা উপভাষার উপগোষ্ঠীতে বিভক্ত সেখানে সবার জন্য এক প্রমিত ভাষা নির্ধারণ করা জরুরি, বাস্তবসম্মত ও গণতান্ত্রিক। উপভাষার উৎপত্তি বা উদ্ভবের কারণ হল বিশেষ কোন গোষ্ঠীর বা অঞ্চলের জনগণের নিজেদের মধ্যে ভাবের আদান প্রদান ও সেই অঞ্চলের লোক সাহিত্য বা সংস্কৃতিকে ধারণ করা। প্রত্যেক অঞ্চলের লোক সাহিত্য বা সংস্কৃতিই একটা দেশের জাতীয় সম্পদ বা ঐতিহ্য তাই তা সংরক্ষণ করা আবশ্যক। যেমন রেডিও বা টেলিভিশনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অঞ্চলের লোক সাহিত্য, সঙ্গীত বা নাটককে ভিত্তি করে অনুষ্ঠান আয়োজন করা যেতে পারে। কিন্তু তাই বলে যে যার নিজের অঞ্চলের বা গোষ্ঠীর উপভাষাকে জাতীয় স্তরে বা সাধারণ শ্রোতার উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করতে চাইলে সেটা সঙ্কীর্ণ আঞ্চলিকতাবাদ বা আঞ্চলিক আধিপত্যবাদ হয়ে যায়, যা পরিহার করা বাঞ্ছণীয়। এখানে প্রমিত ভাষা সবার জন্য এক গণতান্ত্রিক মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা কাজ করে, কারণ প্রমিত ভাষা কোন বিশেষ অঞ্চলের জন্য নয়, সবার জন্য। অবশ্য বেশ কিছুদিন ধরে এক উপভাষা ধীরে ধীরে সৃষ্ট হচ্ছে যা সবার জন্য বলে চাপানোর এক সূক্ষ্ণ চেষ্টা করা হচ্ছে, সবার জন্য এক সাধারণ উপভাষা হিসেবে। এটা বিশেষ করে ঢাকা কেন্দ্রিক এক সংস্কৃতি, ঢাকা অঞ্চলের উপভাষাই এতে প্রাধান্য পায়। যদিও এর অনেক শব্দাবলী অনেক আঞ্চলিক ভাষাতেই বিদ্যমান। এটাকে সাধারণভাবে বাঙ্গাল ভাষাও বলে অনেকে। কিন্তু এটাকে প্রমিত ভাষা বা সবার জন্য সাধারণ উপভাষা বলে মেনে নেয়ার কোন যৌক্তিক কারণ নেই। কারণ প্রমিত বাংলা ভাষা ও উপভাষাসমূহ উভয়ই দীর্ঘদিন ধরে পরিবর্ধিত ও সমৃদ্ধ হয়ে ভালভাবেই প্রতিষ্ঠিত, সেখানে ঢাকা কেন্দ্রিক আলাদা কোন আঞ্চলিক ভাষা বিদ্যমান প্রমিত ভাষাকে সরিয়ে প্রমিত ভাষা বা সবার জন্য এক সাধারণ উপভাষা হিসেবে চালু হবার কোন প্রয়োজন দেখিনা। অবশ্য ঘরে বা বাইরে নিজেদের মধ্যে বা পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের বা একান্তচক্রের(Inner Circle) মধ্যে আড্ডাতে এই উপভাষাতে কথা বলা স্বাভাবিক। যেমন মুক্তমনারই অনেক পরিচিত সদস্যবৃন্দ নিজেদের মধ্যে এই ভাষায় কথা বলেন। কিন্তু ব্লগটা তো কোন একান্তচক্র নয়। এটা সমগ্র বাংলাভাষীদের একটা ফোরাম। অনেক মন্ত্রী, উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী, বুদ্ধিজীবী সাংবাদিকদের সাথে সাক্ষাৎকারে, বক্তৃতায় বা সরকারী ভাষ্যে আঞ্চলিকতা ব্যবহার করেন। এটাও দুঃখজনক। আমি বাঙ্গাল ভাষার বিরুদ্ধে নই। শুধু এটাকে প্রমিত ভাষার মর্যাদা দেয়ার বিপক্ষে। ইতিমধ্যে এই আঞ্চলিক ভাষা ঢাকার টিভি চ্যানেল গুলির অনেক নাটকেও ব্যবহৃত হচ্ছে, যদিও নাটকগুলি বাংলাদেশের সব দর্শকদের লক্ষ্য করে প্রচারিত হয়। এর কোন সঙ্গত কারণ দেখি না। আগেই বলেছি বিশেষ অঞ্ছলকে যউদ্দেশ্য বা ফীচার করে সেরকম অনুষ্ঠান করা যেতে পারে। আমার সঙ্গে দ্বিমত হবেন বা আপত্তি তুলবেন হয়ত অনেকে। কিন্তু এটা আমার মত বা রুচির প্রতিফলন বলে বিতর্কের খুব সুযোগ নেই। যে যার নিজের মত বা যুক্তি দিতে পারেন অবাধে।বিকল্প যুক্তি দেয়া হলে নৈর্ব্যক্তিকভাবে তার গুণাগুণ বিচারের চেষ্টা করব বা সম্মানের সাথে দ্বিমত পোষণ করব। এটাও বলার দরকার যে আমি বিশুদ্ধবাদ (Purism) বা অতিনীতিনিষ্ঠতা (Puritanism) প্রচার করছি না। চিন্তায়,বিচারে বা নীতিতে সামঞ্জস্য ও সাধারণ বুদ্ধি ও যুক্তি প্রয়োগের গুরুত্বের উপর জোর দিতে চাচ্ছি কেবল। আর আমি বলপ্রয়োগের আহবানও জানাচ্ছি না।

এবার আসি বাংলায় ইংরেজী শব্দ বা বাক্যের ব্যবহার নিয়ে। অনেকের মাঝে বাংলায় সামান্যতম ইংরেজী ব্যবহার নিয়েও ঘোর আপত্তি দেখা যায়। এই ব্লগেও সেটা দেখা যায়। বাংলা লেখা বা কথনে ৫০% বা তার বেশিই যদি ইংরেজী হয় তাহলে সেটা অর্থহীন ও হাস্যকর হয়ে যায় ঠিকই। কিন্তু কোন কোন প্রসঙ্গে ইংরেজী ব্যবহারের বিরুদ্ধে মাত্রাহীন খুঁতখুঁতানিরও কোন সঙ্গত কারণ নেই বলে মনে করি। আজকের জগতে ইংরেজী একটি কার্যত আন্তর্জাতিক ভাষা হয়ে গেছে। বিশেষ করে প্রাক্তন সমাজতন্ত্রী ইউরোপীয় দেশসমূহ ও চীন পশ্চিমা দেশের সাথে রাজনৈতিক, সামাজিক ও আর্থনীতিক বন্ধন জোরদার করায় ইংরেজীর আন্তর্জাতিকীকরণ ও গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছে। কাজেই সামান্য ইংরেজী ব্যবহারে কারো অসুবিধা হবার কথা নয়। তাছাড়া বাংলাদেশের সব স্কুলেই ইংরেজী পাঠ কোন না কোন পর্যায়ে বাধ্যতামূলক জানি। কাজেই সামান্য ইংরেজী ব্যবহার করলে বুঝতে অসুবিধা হয় বললে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। শুধু একটি ভাষা জানা আজকের পৃথিবীতে অচল। অপ্রয়োজনে ইংরেজী ব্যবহার করার কথা বলছি না। কিন্তু অনেক সময় কোন ইংরেজী প্রবাদ, বাক্য বা শব্দ যা অনেকের কাছে বহুল পরিচিত সেটা ব্যবহার করলে বক্তব্যের মূল ভাব প্রকাশের সহায়ক হয় বা জোর দেয়ার জন্য সুবিধা হয়। এতে বাংলাকে উপেক্ষা করা হয় না বা বাংলাভাষার কোন ক্ষতি করা হয় না। বরং ভুল বাংলা (বানান বা ব্যকরণগত) পরিহার করার উপর জোর দেয়াটাই বেশি অর্থবহ ও যথার্থ। যদিও ভুল আমরা সবাই কম বেশি করি। কয়েকটি প্রচলিত ভুলের উদাহরণঃ

১। এ্যাম্বুলেন্স, এ্যাটম, ষ্টেশন (অ্যাম্বুলেন্স,অ্যাটম, স্টেশন। “এ্যা” এর ব্যবহার বাংলায় নেই বলেই জানি)
২। উৎকর্ষতা, দারিদ্র্যতা, দৈন্যতা,…
৩। অর্থনৈতিক (সংসদ বাংলা অভিধান অনুযায়ী আর্থনীতিক এর অসংগত কিন্তু বহুল প্রচলিত রূপ)
৪। এই ব্লগে বহুল ব্যবহৃত বাক্য বা শব্দ যেমন, “জাগানিয়া (চিন্তা জাগানিয়া)”, “জানান দিয়েন”, “আপ্নের” ইত্যাদি। এগুলি কি প্রমিত ভাষা ? কবিতায় অনেক সময় (বিশেষ করে বিখ্যাত কবির) ভুল শব্দ বা বাক্যের ব্যবহার আর্ষপ্রয়োগ হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয়। কিন্তু এখানে তো আর্ষপ্রয়োগের কোন সুযোগ দেখছি না। অনেকে সামান্যতম ভুল বানানের জন্য ঘোর আপত্তি তোলেন কিন্তু এই ধরণের ভুল বাংলায় তাদের কোন আপত্তি নেই। এটা অনেকটা পরস্পরবিরোধী অবস্থান আমার মতে। তবে ব্লগে রহস্যচ্ছলে বা রসালাপে লাইকাইলাম (Like বোতাম এ টিপা) বা এধরণের কিছু শব্দের ব্যবহার আর্ষপ্রয়োগ হিসেবে দেখা যেতে পারে।

পরিভাষা নিয়ে কিছু কথা। অনেক ইংরেজী শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ ইতিমধ্যে বিদ্যমান। সেগুলোর নতুন করে পারিভাষিক শব্দ বের করার প্রয়োজন দেখি না। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম ১৯৭১ হলেও বাংলাভাষার ইতিহাস অনেক পুরানো। একশ বছরেরও আগের থেকেই কোলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পরিভাষা নির্মাণ কাজে লাগে। এই কাজে বিভিন্ন সময়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রাজশেখর বসু, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ এবং অবশ্যই আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এবং আরো অনেকে। ১৯৩৪ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজশেখর বসুর সভাপতিত্বে বৈজ্ঞানিক পরিভাষার এক শক্তিশালী সমিতি গঠিত হয়। প্রায় দশ বছর ধরে এই সমিতি বিজ্ঞানের প্রত্যেক শাখায় বিশাল এক পরিভাষা ভান্ডার গড়ে তোলে। পাক-ভারত স্বাধীনতার পর সরকারী স্তরে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বাংলা পরিভাষা প্রণয়নের জন্য পশ্চিম বাংলায় “পরিভাষা সংসদ”(১৯৪৮) ও “পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যভাষা কমিশন”(১৯৬৪) গঠিত হয়। আর সকল ভারতীয় ভাষার বৈজ্ঞানিক পরিভাষা উন্নয়নের জন্য ১৯৬১ সালে ভারতের শিক্ষামন্ত্রক “বৈজ্ঞানিক ও প্রয়োগিক শব্দাবলীর আয়োগ” (Commission for Scientific Terminology) গঠন করে। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) ১৯৫৬ এ বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃত হবার পর ১৯৫৭ সালে বাংলা অ্যাকাডেমি ও ১৯৬৩ সালে বাংলা উন্নয়ন “বোর্ড” গঠিত হয়। বোর্ড এর বাংলা পর্ষদ থাকা সত্ত্বেও কেন তখন নামে বোর্ড রাখা হয় বোধগম্য নয়। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের এই প্রতিষ্ঠান সমূহ বাংলা পরিভাষা উন্নয়নে অনেক কাজ করেছে। দীর্ঘ সময় ধরে অনেক ভাষা পন্ডিতদের শ্রমকে উপেক্ষা করে ও সেই শ্রমের সুফলকে সদ্ব্যবহার না করার কোন যৌক্তিক কারণ নেই । নতুন করে বাংলাদেশের জন্য আলাদা পরিভাষা প্রণয়ন করাটা অপ্রয়োজনীয়, কর্মদক্ষতা পরিপন্থী এবং শ্রম ও সময়ের অপচয় বলে মনে করি, অনেকটা চাকা পুনরাবিষ্কারের মত ব্যাপার (এখানে reinventing the wheel বললে ভাবটা আরো পরিস্কার হত)। নতুন শব্দ সৃষ্টি করাটা ভাষার সমৃদ্ধি ঠিকই। কিন্তু বিদ্যমান শব্দকে সরিয়ে যদৃচ্ছাক্রমে নতুন শব্দ চালু করার সঙ্গত কোন উদ্দেশ্য দেখি না। বাংলা এখন জাতিসঙ্ঘের স্বীকৃত একটা আন্তর্জাতিক ভাষা। তাই বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য দুই বাংলার মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতা আরো জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা যদি একক বা একতরফাভাবে বাংলা ভাষার পরিবর্তন করতে থাকি তাহলে একসময় হয়ত প্রশ্ন উঠবে আন্তর্জাতিক বাংলা ভাষা কোনটি, বাংলাদেশে যেটা ব্যবহৃত হয়, সেটি না কি পশ্চিমবঙ্গে? এটা অনাকাঙ্খিত । এটা আশার কথা যে ঢাকায় Bengali International এর প্রথম আন্তর্জাতিক বাঙ্গালী সম্মেলনের সভাপতি শামসুল হক বাংলা ভাষার ভিন্নতার কথা উল্লেখ করে এতে বাংলা ভাষার ক্ষতি হচ্ছে বলে মত দিয়েছেন। Bengali International এ ব্যাপারে আশা করা যায় উদ্যোগী হবে। বাংলায় আগ্রহী অনেক বিদেশী বাংলা ভাষাকে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দের ভাষা বলে জানে এবং বাংলা শিখতে আগ্রহী হয়ে ঢাকায় বা কোলকাতায় আসে। সেই ধারা যাতে বিপন্ন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অনেকে কোলকাতায় বাংলার সম্ভাব্য বিলুপ্তিতে শ্লাঘা অনুভব করে। এটাও দুর্ভাগ্যজনক। ভাষার পরিসর যত অধিক সংখ্যক জনগোষ্ঠী বা ভৌগলিক সীমানা জুড়ে বিস্তৃত থাকবে ততই সেই ভাষার জন্য মঙ্গল। দুই বাংলাতেই যাতে সাধারণ এক প্রমিত ভাষা ও নিজ নিজ উপভাষার ও উপভাষাভিত্তিক সাহিত্য সংস্কৃতি সংরক্ষিত ও উন্নত হতে থাকে সেটাই সবার কাম্য হওয়া উচিত।

যে সব ব্যবহৃত ইংরেজী শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ এখনও নেই আমার মতে বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার বাংলা ভাষার পণ্ডিতদের সমন্বয়ে ও যৌথ উদ্যোগে সেই প্রতিশব্দগুলি সৃষ্টি করা বাঞ্ছনীয় যাতে একই শব্দের দুই ভিন্ন পারিভাষিক শব্দ না চালু হয় দুই বাংলায়। এটা কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি ও সাশ্রয় পরিপন্থী। প্রমিত বাংলা ভাষা যেহেতু সব বাঙ্গালীর মধ্যে যোগাযোগ বা তথ্যের আদান প্রদানের সাধনী তাই এর যত কম বিভক্তি হয় ততই ভাল। এখানে ভৌগলিক সীমান্ত বিবেচ্য হওয়া উচিত নয় বলে মনে করি। সীমান্ত বা রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব একটা বাস্তবতা। কিন্তু ভাষায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সীমান্ত টানাটা বাস্তবতা বা বাঞ্ছনীয় নয়। এক ভাষা থেকেও পৃথক সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা সম্ভব। আমেরিকা ও বৃটেন দুই সার্বভৌম রাষ্ট্র, কিন্তু একই ভাষা দুদেশেরই। যদিও আমেরিকা বিপ্লবের মাধ্যমে বৃটেন থেকে স্বাধীনতা লাভ করেছিল। সামান্য কিছু বানানের হেরফের আছে ঠিকই। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে তাদের মধ্যে সাধারণ সীমান্ত নেই। মহাসাগর দ্বারা বিচ্ছিন্ন। সেখানে বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলা এত কাছের প্রতিবেশী হওয়া সত্ত্বেও বা সাধারণ সীমান্ত থাকা সত্ত্বেও ভাষার কৃত্রিম পার্থক্য তৈরী করাটা অযৌক্তিক।

অনেক বিদেশী বা ইংরেজী শব্দ বাংলায় বহুল প্রচলিত এবং বাংলা অভিধানে স্থান পেয়ে গেছে। সেগুলোর বাংলা প্রতিশব্দ ব্যবহারের উপর হেতুক জোর দেয়াটা খুঁতখুঁতানি। চেয়ার বা টেবিল ব্যবহার নিয়ে কেউ আপত্তি তোলে না। যে সব বহুল প্রচলিত ইংরেজী শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ সরকারীভাবে (বাংলাদেশ বা পশ্চিম বাংলায়) চালু হয় নি সেগুলোর ব্যক্তিপগত উদ্যোগে যথেচ্ছক্রমে বাংলা প্রতিশব্দ বের করে ব্যবহার করাটাও অপ্রয়োজনীয় এক প্রয়াস বলে মনে হয়। ইন্টার্নেট (বা ইন্টারনেট) এমন এক উদাহরণ। ইদানীং ব্লগে অন্তর্জাল শব্দের ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। এটা যেহেতু প্রমিত ভাষার জন্য সরকারীভাবে নির্ধারণ করা হয় নি বলেই জানি তাই বহুল পরিচিত ও প্রচলিত ইন্টার্নেট এর জায়গায় এটা ব্যবহার করার কোন কারণ দেখি না। চেয়ার টেবিল, স্টেশনের মত ইন্টারনেটকেও বাংলা ভাষায় স্থান দেয়াতে আপত্তির কোন কারণ দেখিনা। সব ইংরেজী শব্দেরই আক্ষরিক বাংলা করে প্রতিশব্দ বের করাটা ( যেমন Inter ->অন্তর net–> জাল) আতিশয্য বলে মনে হয় (আমার কাছে)। ইন্টারনেট একটা আন্তর্জাতিক শব্দ, তাই এটাকে বাংলা ভাষায় সম্পৃক্ত করলে বাংলা ভাষারই সমৃদ্ধি হবে। বাংলা ভাষার অনেক পণ্ডিতরাও তাঁদের অনেক লেখায় বাংলা ভাষায় বিদেশি শব্দের অন্তর্ভুক্তিকে বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাহলে এই ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হবে কেন। এ প্রসঙ্গে বাংলা অ্যাকাডেমির প্রাক্তন সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিভাষা প্রণয়ন কমিটির প্রাক্তন সভাপতি ড: এনামুল হক এর একটা উক্তি প্রণিধানযোগ্য : “বিজ্ঞানের পরিভাষার অনেকগুলি এমন শব্দ আছে, যাকে আন্তর্জাতিক শব্দ বলে নির্দিষ্ট করা যায়। অথচ এগুলোকে কোন জাতিবিশেষের শব্দ বলে নির্দিষ্ট করা চলে না। এগুলোকে নিজেদের বাংলাভাষার ধ্বনি ও রূপতাত্ত্বিক প্রকৃতি অনুসারে আত্মস্থ করে ভাষার অঙ্গীভূত করে নিতে হবে”

কতগুলি ইংরেজী শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ নেই (অভিধানে) বলে আমার জানা। এটা কি বাংলার সীমাবদ্ধতা, নাকি বাঙ্গালী জাতির সাংস্কৃতিক সীমাবদ্ধতা। যেমন Appreciate করার কোন বাংলা প্রতিশব্দ নেই। যদিও ধন্যবাদ আছে। তাহলে কি বাঙ্গালী মানসে Appreciate করার ধারণা নেই? বাস্তব জীবনে আমি এর ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা অনেক সময় অনুভব করি, বাংলা না জানায় ইংরেজীতেই বলতে হয়। এটাকে আমার মনে হয় বাংলা ভাষা বা সংস্কৃতির একটা দুর্বলতা হিসেবে দেখতে হবে। আরও কিছু বহুল ব্যবহৃত ইংরেজী শব্দ যার বাংলা প্রতিশব্দ নেই তার উদাহরণঃ
adjust, perfection, intellectual (adjective), oxymoron, academy, overlap, worthwhile

বাংলা একাডেমি (অ্যাকাডেমি) কেমন শোনায়?

ভাষা দিবস ২১শে ফেব্রুয়ারী তে পালিত না হয়ে ৮ই ফাল্গুন পালিত হলে বেশী মানানসই হত না কি? এবার ভাষা দিবস ৯ই ফাল্গুন পালিত হচ্ছে।

আসি ভাষায় টানের (Accent/Tone) প্রসঙ্গে । আমরা দেখি সব উপভাষারই নিজস্ব টান আছে। সিলেটের উপভাষার টান আর রাজশাহী বা চট্টগ্রামের উপভাষার টান ভিন্ন। প্রমিত ভাষার কোন টান নেই বা থাকার কথা না। যদিও অনেক সময় দেখা যায় যারা দীর্ঘদিন উপভাষায় কথা বলে অভ্যস্থ তারা যখন প্রমিত ভাষা বলে তাতে একটা টান বা উচ্চারণ ত্রুটি থেকে যায়। কিন্তু যদি প্রমিত ভাষা শুদ্ধ উচ্চারণ সহ বলা হয় সেটা কোন আঞ্চলিকতাকে প্রতিফলিত করার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে আমরা একটা মজার ব্যাপার লক্ষ্য করি। সেটা বলার আগে একটু ভূমিকা দিয়ে নেই। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। ছোটবেলায় ইংরেজী বাংলা উভয় স্কুলেই পাঠ করাতে এবং একই অঞ্চলে বেশিদিন না থাকার কারণে কোন বিশেষ অঞ্চলের টানে কখনো কথা বলিনি বা টান আয়ত্ত করিনি। পৈত্রিক গ্রামেও বড় হইনি অনেকের মত। তাই টানহীন প্রমিত ভাষাই বলতে অভ্যস্থ। আমার টানহীন প্রমিত বাংলা ভাষাকে বাংলাদেশের অনেকে কোলকাতার বাংলা (যা অনেকে ঘটী বলে উল্লেখ করে। যদিও সেরকম কোন অর্থ অভিধানে নেই) হিসেবে ভুল করে। গিয়েছিলাম/করেছিলাম ঘটী বাংলা নয়, গিয়েছিলুম/করেছিনু ঘটী বাংলা। মাংস হিন্দুদের ভাষা বা ঘটী বাংলা নয়, এটা প্রমিত বাংলা শব্দ। আবার যখন কোলকাতা বেড়াতে যাই, সেখানে অনেকে আমার বাংলা শুনে আমাকে বাংলাদেশ থেকে এসেছি বলে ধরে নেয় বা আমার কথায় বাঙ্গাল টান আছে বলে মনে করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে টানহীন শুদ্ধ উচ্চারণ সহ প্রমিত বাংলা বললে ঢাকার মানুষ তাকে ঘটী বাংলা মনে করে আর কোলকাতার লোক তাকে বাঙ্গাল ভাষা মনে করে। আসলে এই দুই বাংলারই অধিকাংশ মানুষ টানহীন শুদ্ধ উচ্চারণ সহ প্রমিত বাংলা বলতে অভ্যস্থ নয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের (এবং ঢাকার) যেমন নিজস্ব টান আছে তেমন পশ্চিম বাংলারও বিভিন্ন অঞ্চলের (এবং কোলকাতার) নিজস্ব টান আছে। কোলকাতা কেন্দ্রিক উপভাষা বা ঘটী বাংলা মুখ্যত হুগলী-নদীয়া প্রভাবিত। শুধু টানই নয় কিছু উচ্চারণ ভ্রংশও আছে যেমন পূবপারে “ছ” কে ‘স” বলা আবার পশ্চিম পারে sh কে s উচ্চারণ করা ইত্যাদি। মানুষের স্বভাব হল অনেক কিছুকে দ্বৈতভাবে দেখা। সব কিছুকে জানা দুটো ছকের মধ্যে ফেলার প্রবণতা মজ্জাগত। এটা না হলে ওটা। তৃতীয় বা মাঝামাঝির অস্তিত্বের সচেতনতা অনেকের নেই। তাই যখনই যে কোন পারের কোন বাংগালী যখন অপরিচিত বা টানহীন শুদ্ধ বাংলা ভাষা শোনে তখন মনে মনে ধরে নেয় যেহেতু এটা আমার মত শোনাচ্ছে না, বর্ধমানের ভাষার মত নয় বা কুমিল্লার টানের মত নয় তাই এটা নিশ্চয় “ওপার বাংলার” ভাষা। অবশ্য রেডিও টিভির সংবাদ বা ভাষ্য শুনে সেরকম ধরে নেয়না, মনে করে না। কেবল ব্যবহারিক জীবনে দৈনন্দিন কথোপকথনের সময় এই মানসিকতাটা বা চেতনাটা কাজ করে। ঢাকা বা কোলকাতার রেডিও/টিভির সংবাদ পঠনে খুব পার্থক্য দেখা যায় না বিশেষ করে সংবাদ পাঠক যদি নির্ভুল উচ্চারণ সহ বাংলা বলেন। তবুও কথার সুরের মধ্যে কিছু সূক্ষ্ণ লক্ষণীয় পার্থক্য দেখা যেতে পারে কখনো কখনো, বিশেষ করে সেই সংবাদ পাঠক যদি তার ব্যবহারিক জীবনে উপভাষা ব্যবহারে অভ্যস্থ হন (সেটা আঞ্চলিক টানই হোক বা ঢাকা কোলকাতা কেন্দ্রিক টানই হোক)। কিন্তু যারা কখনো উপভাষা বলে না তারা যখন শুদ্ধ প্রমিত ভাষা বলে তাতে বাংলাদেশের বা পশ্চিম বাংলার কোনটারই আঞ্চলিক কোন টান থাকার কথা না। টান থাকলে সেটা সেই ব্যক্তির নিজস্ব এক টান, তার আঙ্গুলের ছাপের মত্য অনন্য এক বৈশিষ্ট্য, কোন বিশেষ অঞ্চলের প্রতিনিধিত্বমূলক টান নয়। কিন্তু অধিকাংশের প্রবণতা হল এই অশ্রেণিভুক্ত টান বা টানহীন বাংলাকে ঢাকা বা কোলকাতার টান বলে শ্রেণীভুক্ত করার, অর্থাৎ অজানা বা অচেনাকে চেনা বা জানা ছকের মধ্যে ফেলার।

এবার আসি প্রমিত বাংলা ভাষা শুদ্ধভাবে লেখা ও বলার গুরুত্ব নিয়ে। প্রখ্যাত বহুভাষাবিদ ড: শহীদুল্লাহ বাংলা শুদ্ধভাবে লেখা ও উচ্চারণের উপর জোর দিয়েছিলেন। বলেছিলেন ভাষা শহীদদের উপযুক্ত সম্মান এভাবেই দেখান যায়। ১৯৪৮ এ প্রমিত বাংলা ভাষার উপরই আক্রমণ করা হয়েছিল। কোন উপভাষার উপর নয়। জিন্নাহ বলেছিলেন পুর্ব পাকিস্তান নিজেদের জন্য যেটা ইচ্ছা সেই ভাষাই বেছে নিতে পারে, কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা উর্দু হতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানের বা বাংলাদেশের উপভাষার উপর কখনো আক্রমণ হয়নি। উপভাষার কোন বিকৃতি হয় নি বা করার চেষ্টাও কেউ করে না। চট্টগ্রাম, সিলেট বা রাজশাহীর উপভাষা অতীতে যেমন ছিল এখনো তেমনই আছে। ১৯৪৮ সালে পশ্চিম অংশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত পাকিস্তান সরকার প্রমিত বাংলা ভাষাকেই আক্রমণ করেছিল। আর এখন অনেক বাংলাদেশী নিজেরাই প্রমিত বাংলা ভাষাকে বিকৃত করার অন্তর্ঘাতমূলক কাজে লিপ্ত হচ্ছে। প্রমিত বাংলা ভাষা বলা ও লেখাকে অনেকে অভিজাততন্ত্র (Elitism) বা উন্নাসিকতা হিসেবে দেখে, সোজা কথায় এটাকে আঁতেলদের ভাষা বা আঁত্‌লেমোর বৈশিষ্ট্য বলে মনে করে, এবং সেই কারণে এর প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করে। কিন্তু এরকম ভাবাটা ঠিক নয়। আঁতেল শব্দটা ব্যাঙ্গার্থে বুদ্ধিজীবীদের প্রতি ব্যবহার করা হয়, যারা প্রকৃত বুদ্ধিজীবী নয় বা উন্নাসিক বুদ্ধিজীবী, বা বুদ্ধিজীবীর ভান করে তাদের উদ্দেশ্যে। বুদ্ধিজীবী বা Intellectual হওয়াট দোষের কিছু নয়। ভান করা বা উন্নাসিকতা দেখান চরিত্রের একটা নেতিবাচক দিক হিসেবে দেখা উচিত, বুদ্ধিবৃত্তির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে নয়। আগেই বলেছি প্রমিত বাংলা ভাষার গুরুত্বটা মুখ্যত ব্যবহারিক। বিভিন্ন উপভাষা ভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাধারণ এক ভাষা নির্দিষ্ট করাই এর ব্যবহারিক গুরুত্ব। অতীতে প্রমিত বাংলা ভাষায় “অভিজাত” বাঙ্গালী শ্রেণীর জীবন নিয়ে সাহিত্য লেখা হয়েছে বলে তো সেই ব্যবহারিক গুরুত্ব কমে যায় না বা প্রমিত ভাষা নিজেই অভিজাত হয়ে যায় না। ভাষা কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হলে সেটা তো ভাষার দোষ নয়। প্রমিত ভাষায় সাধারণ (“মাটির মানুষ”) মানুষদের জীবন নিয়েও তো সাহিত্য লেখা হয়েছে। অনেকে হয়ত বলবে বাঙ্গাল ভাষাকে বাংলাদেশের প্রমিত ভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে দোষ কোথায়, সবাই তো এটায় বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে আর বাংলাদেশের নিজস্ব একটা আলাদা ভাষা তো থাকাই দরকার, আমরা কেন বৃটিশ আমলে কোলকাতার বাবুদের সৃষ্ট ভাষাকে গ্রহণ করব জাতীয় ভাষা হিসেবে। এটা বাঙ্গালাদেশী জাতীয়তাবাদী ধারণা। কিন্তু এর গুরুতর এক সমস্যা আছে। পিচ্ছিল ঢালের মত এই যুক্তি। এই যুক্তি আক্ষরিকভাবে অনুসরণ করলে কোথায় আমাদের নিয়ে নামাবে তার নিশ্চয়তা নেই। তাহলে আমাদের অতীতকে সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলতে হয়। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল,জীবনান্দদাশ, মীর মোশাররক হোসেন, কেউ আর আমাদের কবি বলে বিবেচিত হবেন না। বাঙ্গাল ভাষার শিকড়ও তো সংস্কৃতে, তাহলে তো নতুন অক্ষরে নতুন শব্দমালা নিয়ে এক প্রমিত ভাষা সৃষ্টি করতে হয়, যা একান্তই বাংলাদেশের সৃষ্টি। এটা অবাস্তব ও অনাকাঙ্খিত। এরকম জাতীয়তাবাদী চিন্তা অগঠনমূলক ও সঙ্কীর্ণতা। অতীতে কারা বাংলা ভাষা সৃজনে বা তার সমৃদ্ধিতে অগ্রণী ছিল সেটা একান্তই অবান্তর এক বিবেচনা। আর তা ছাড়া কোলকাতার বিদগ্ধ সমাজ অতীতে অগ্রণী হলেও প্রমিত বাংলা ভাষার বিবর্তন ও সমৃদ্ধিতে বিভিন্ন সময়ে হিন্দু, মুসলিম, রাড়ীয়, সমতটীয়, উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত সব বাঙ্গালীরাই ঐতিহাসিকভাবে জড়িত ছিল ও ভুমিকা রেখেছে। পৃথিবীর অনেক দেশের (ফিলিপিন, ইথিওপিয়া, ফিজি, পাকিস্তান, ভারত, আরও অনেক) সরকারী ভাষা ইংরেজী, যদিও আধুনিক ইংরেজী ভাষার সৃষ্টি হয়েছিল উন্নাসিক বলে পরিচিত বৃটিশদের দ্বারা। তাছাড়া অনেক দেশের মাতৃভাষাও ল্যাটিন লিপিতে লেখা হয়, যা তাদের ইতিহাসের বা সংস্কৃতি থেকে লব্ধ নয়। যেমন ভিয়েতনাম, সোমালীয়া এবং আরও অনেক দেশে। ভিয়েতনামের ভাষা ফরাসী ভাষার দ্বারা অনেকাংশে প্রভাবিতও বটে। সোমালীয়া মুসলীম প্রধান দেশ এবং তাদের ভাষা পূর্বে আরবী হরফে লেখা হলেও বর্তমানে ল্যাটিন হরফে লেখা হয়। এসব উদাহরণ দেয়ার উদ্দেশ্য এটা বলা নয় যে তারাই সঠিক বা অনুকরণীয়, উদ্দেশ্য হল সরকারী বা রাষ্ট্রভাষা সম্পূর্ণ নিজেদের তৈরী হওয়া উচিত এই যুক্তির যে সার্বজনীনতা নেই সেটা বোঝান। থাকলে এতগুলি ব্যতিক্রম দেখা যেত না। আর সেখানে প্রমিত বাংলা ভাষা তো বাংলাদেশের মাটি ও ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। এটাকে বিজাতীয় ভাষা ভাবার কোন যৌক্তিকতা নেই। দ্বিতীয়ত বর্তমান বাঙ্গাল ভাষায় বিশেষ অঞ্চলের প্রভাব অনেক বেশী। সিলেট, চট্টগ্রাম, খুলনা বা রাজশাহীর মানুষের কাছে এটা সহজে গ্রহণযোগ্য কোন ভাষা নয়। কাজেই এটাকে জাতীয় ভাষা বলাটা প্রকৃত গণতান্ত্রিক অর্থে সঠিক নয়। ঢাকা জিলা বা তার আশপাশের জিলার আধিপত্যই এতে পরিলক্ষিত হয়। তাছাড়া সব উপভাষার সমান প্রতিনিধিত্বমূলক জগাখিচুড়ী এক প্রমিত ভাষা সৃষ্টি করা বাস্তব বা বাঞ্ছণীয় নয়। যে কারণে ভারত বা পাকিস্তানে সেটা সম্ভব হয় নি।

অনেকে উপভাষায় দীর্ঘদিন কথা বলতে অভ্যস্থ হওয়ায় প্রমিত ভাষা বলতে বা লিখতে কষ্ট বা আলস্য বোধ করে। নিজের আলস্যকে স্বীকার না করে অনেকে প্রমিত ভাষার দোষ বা অনুপযোগিতা বের করার চেষ্টা করে যাতে কষ্ট না করার এক অজুহাত পাওয়া যায়। কিন্তু মনে রাখা উচিত একটা জাতি হিসেবে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ও ভাবের আদান প্রদানকে গণতান্ত্রিক রাখতে হলে ও বিশেষ কোন উপভাষার অন্যগুলির উপর সম্ভাব্য প্রাধান্য বা আধিপত্য বিস্তার রুখতে হলে সামান্য কিছু মূল্য (কষ্ট) দিয়েও প্রমিত বাংলা ভাষা বলা ও লেখার চেষ্টা করাটা কষ্টের যোগ্য মনে করি। আর এটা সম্ভবও। ১৯৭১ এর আগে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু ও বাংলা ছিল কিন্তু উর্দু ও বাংলার ৫০-৫০ মিশ্রণে কোন জগাখিচুড়ী ভাষা তৈরী করা হয় নি। কার্যত ইংরেজীই পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা ছিল। তখন অনেক অল্প শিক্ষিতরাও ইংরেজী বলতে ও লিখতে পারত। ভারতেও ইংরেজীই রাষ্ট্র ভাষা। হিন্দি জনপ্রিয় হলেও দক্ষিণ ভারতে এর গ্রহণযোগ্যতা নেই। চেন্নাই এর ট্যাক্সি চালকেরা ইংরেজী বলে কিন্তু হিন্দি বলতে পারেনা বা বলে না। সেখানে প্রমিত বাংলা ভাষা বাংলাদেশের জাতীয় ভাষা হিসেবে লিখতে ও বলতে অসুবিধা হবে কেন। সিলেট বা চট্টগ্রামের উপভাষা প্রমিত বাংলা ভাষা থেকে অনেক বেশী ভ্রংশিত হলেও এই দুই জিলার নিবাসী অনেকেই সাবলীলভাবে প্রমিত বাংলা বলতে পারেন। অনেক বিদেশীও ভাল প্রমিত বাংলা বলতে পারেন। সচেতন ইচ্ছা থাকাটাই মুখ্য।

ভাষা দিবসে ভাষা শহিদদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করা ছাড়াও প্রমিত বাংলা ভাষার যথাযথ সংরক্ষণ, শুদ্ধ উচ্চারণ ও শুদ্ধ লেখার সচেতনতা সৃষ্টি ও বৃদ্ধি হোক এই আশা ব্যক্ত করেই আমার দীর্ঘ ভাষের ইতি টানছি।

বাংলা ভাষা নিয়ে আমার উত্তরসূরী আর মুক্তমনা ফোরামে আমার দুটো পোস্ট:

http://groups.yahoo.com/group/uttorshuri/message/83
http://groups.yahoo.com/group/mukto-mona/message/32997

এই প্রসঙ্গে ড: সুখময় বাইনের নীচের মন্তব্যও প্রণিধানযোগ্যঃ
http://groups.yahoo.com/group/mukto-mona/message/33022