:: নিউ ইয়র্ক (প্রথমার্ধ) :: পোর্টল্যান্ড (ওরিগন) :: সিলিকন ভ্যালি (ক্যালিফোর্নিয়া) :: ওয়াশিংটন ডিসি :: ডেট্রয়েট (মিশিগান) ::

নিউ ইয়র্ক! মাসখানেক আগে হোটেল বুকিং না-দিলে, এখানকার হোটেলগুলোতে রুম খালি পাওয়া বেশ কঠিন। তার উপর, আমাদের আগমন উইক-এন্ডে হবার কারণে এক মাস আগেও রুম পাওয়া কঠিন হয়ে গেলো। এদিকে, আমার সহকর্মী দিল্লির ছেলে কুনাল একটা হোস্টেলের খোঁজ দিলো, যেটাতে রুমও খালি পাওয়া গেলো। অন্য আর কিছুই জানার দরকার নেই বলে কুনালকে শুধু জিজ্ঞেস করলাম, “ওখানে ড্রাঙ্ক লোকজনের উৎপাত কেমন?” কারণ, উইকএন্ড হবার কারণে তাদের উৎপাত, ক্ষেত্রবিশেষে অত্যাচারে পরিণত হয়। সাথে বউ থাকার কারণে এ-জিনিসটা আরও বেশি চিন্তা করতে হচ্ছে। কিন্তু কুনাল তার কোনো তথ্যই দিতে পারলো না। সে আমতা আমতা করে বললো, “আমি আসলে জানি না।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমিতো সেখানে ছিলে? না জানার কারণ কি?” তারপর সে আরো বেশি আমতা আমতা করে বললো, “আমি জানি না, কারণ, আমি আসলে ড্রাঙ্ক ছিলাম।” অর্থাৎ, সে ড্রাঙ্ক থাকার কারণে বলতে পারছে না, সেখানে ড্রাঙ্ক লোক থাকে কি-না। আমিও দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নিলাম।

অতএব, কোনো আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে থাকার সাথে সাথে তার অসংখ্য নীতিবাক্য হজম করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকলো না। শুধু নীতিবাক্য হলেও হতো, নোয়াখালীতে জন্মগ্রহণ করার সৌভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে আসায়, এই বিদেশের মাটিতে এসেও আমার নিজ এলাকার অসংখ্য গুণগ্রাহীর কৌতুকাচারণে ধন্য হতে হয়। “জন্মই আমার আজন্ম কৌতুক।”

নির্দিষ্ট দিনে পৌঁছে, বাস থেকে নেমে ম্যানহাটনের রাস্তায় ঘণ্টাখানেক ধরে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু, কোনো ট্যাক্সি আমাদের গন্তব্যে যাবে না। ইন্ডিয়ান দেখলে ট্যাক্সিচালকরা তাদের ট্যাক্সি থামান না। কারণটা খুব সোজাসাপ্টা। ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানি, বাংলাদেশিরা ট্যাক্সিতে উঠলে টিপ(স্‌) দেয় না। একবার মনে হলো, রাস্তায় একটা কার্ড ধরে দাঁড়িয়ে থাকি, “ভাই, আমি টিপ(স্‌) দেব, তাও একটু দাঁড়াও ভাই।” এক পর্যায়ে একজনের দিলে দয়া হলে এসে দাঁড়ালো। তারপর শুরু করলো দর কষাকষি। আমেরিকার অন্য আর বড় শহরগুলোতে সাধারণত ট্যাক্সিতে উঠে তারপর বললেই হয় কোথায় যেতে হবে। দামাদামির প্রশ্নই আসে না। কিন্তু, নিউ ইয়র্ক শহর আলাদা। অভিবাসীরা এখানে আমেরিকান কালচার পরিবর্তন করে নিজেদের কালচার ঢুকিয়ে দিয়েছে। যে ইন্ডিয়ান চালক তাঁর ট্যাক্সি নিয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের প্রতি বিশেষ দয়া প্রদর্শন করলেন, তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন একশো ডলার না-হলে ট্যাক্সি এক পা-ও এগোবে না। কিন্তু, এটা আমার পঞ্চম নিউ ইয়র্ক সফর। আমি ভালো করেই জানি যেখানে যাবো সেখানকার ভাড়া পঁচিশ ডলারের বেশি হবে না। তার উপর মোবাইলে গুগোল ম্যাপতো আছেই। আরেকটু দেখার পর, আরেকজন পাকিস্তানী এসে পঞ্চাশ ডলারে যেতে রাজী হলো। অগত্যা, তার ট্যাক্সিতে চড়েই রওয়ানা দিলাম।

আমার আত্মীয় মশাই বাড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। উনার নিজের পরিবার এখানে নাই। বয়স হবে সত্তর। কিন্তু, নিউ ইয়র্কে এসে উনার জিন্মায় না থেকে অন্য কোথাও থাকলে, উনার মান সন্মান যেহেতু মাটির সাথে মিশে যায়, সেহেতু উনার ব্যবস্থাপনায় থাকতে বাধ্য হলাম। উনার বয়সের ভার অন্যদের তুলনায় বেশি বলে, অন্যরাও উনার উপর কথা বলেন না। আমার এই আত্মীয় সাধারণত তার ব্যাংক ব্যালেন্স বলার মধ্য দিয়ে আলাপ শুরু করেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। ব্যাংক ব্যালেন্স বলে শেষ করে বললেন, “আমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা বাংলাদেশে গিয়ে কিছু একটা করা।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার বয়স কত?” তিনি বললেন, “সত্তর-আশি তো হবেই।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তাহলে আপনার আবার ভবিষ্যত কোনটা! আপনিতো ভবিষ্যত-ই পার করছেন।” আমি জানি, এ-প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দেয়া সম্ভব নয়। আরো জানি, এই সেই শহর! এই সেই নিউ ইয়র্ক শহর!! ভবিষ্যতের মূলো ঝুলিয়ে যে শহর কেড়ে নেয় প্রাণবন্ত বর্তমান।

ছবিঃ রাতের নিউ ইয়র্ক

আমাদের থাকার জায়গাতে প্রতিদিনই কিছু না কিছু মানুষের সাথে দেখা হচ্ছে। বিভিন্নভাবে বিভিন্নজন পরিচিত এবং বাইরে বের হলেও পরিচিতজনদের সাথে দেখা হয়ে যাচ্ছে। আলাপ-আলোচনার এক পর্যায়ে তারা নিজেদের সমালোচনা করে বলেন, “এখানে সবাই সবার পিছনে লেগে আছে। বাংলাদেশের থেকেও খারাপ অবস্থা। সারাদিন অযথাই রাজনৈতিক তর্কাতর্কি, বাক-বিতণ্ডায় লিপ্ত হয়ে আছেন।” যারা এ-কথাগুলো বলছেন, তারা বুঝানোর চেষ্টা করছেন, একমাত্র তারাই এ-ব্যাপারগুলো মধ্যে নেই এবং এই ধরণের কুৎসা জাতীয় জিনিস তাদের মধ্যে কখনো ছিলো না, থাকবেওনা। কিন্তু, মজার ব্যাপার হচ্ছে, তারা যে অযথা রাজনৈতিক আলাপ করেন না, নিজেরা তাদের সে গুণের কথা বলেই বেশিরভাগ সময় কাটিয়ে দিলেন। তবে, মুখে যত অনীহাই প্রকাশ করুক না কেন, ঠিকই বুঝা যায়, বাংলাদেশের মানুষের রক্তের মধ্যেই রাজনীতি। সাথে সাথে আরেকটা জিনিসও অবশ্য আছে- ধর্ম। ভুল হোক শুদ্ধ হোক, যৌক্তিক হোক অযৌক্তি হোক, এই দুটো জিনিস সম্পর্কে সর্বস্তরের সব ধরণের মানুষই মতামত দিতে পারে, অংশগ্রহণ করতে পারে। তাই তারা বিশ্বের যে-প্রান্তেই যাকনা কেন, এই দুটি বিষয়ই হয়ে উঠেছে তাদের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু, আবেগ অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম।

কিন্তু, নিউ ইয়র্কের সমস্যা হলো অন্য জায়গায়। এখানে, “মুসল্লির থেকে মুয়াজ্জিন বেশি, কর্মীর চেয়ে কর্তা বেশি।” একজন বলে, “এই যে বলেন- তার কোনো আকার নাই, এই কথাটা কি ঠিক! আসলেতো আকার আছে, কিন্তু সেটা চিন্তা করতে হবে এই ভাবে।” এই বলে কোনো এক মাওলানার নাম উদ্ধৃতি দিয়ে ঘোষণা করেন, উনার ওয়াজের সিডি শুনলে সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে। যারা সামনে বসা আছেন, তারাও মাথা নেড়ে মৌন সন্মতিটা জানিয়া দেন। ঠিক্‌ ঠিক্‌ ঠিক্‌। এরা অবশ্য মাওলানার নাম করে যাই বলা হবে তাতেই ঠিক্‌ ঠিক্‌ করতে থাকবেন। এ-পর্যন্ত আমার আপত্তি ছিলো না, সমস্যাও ছিলো না। সমস্যা হলো যখন তিনি নিজ দায়িত্বে সেই মাওলানার ওয়াজের সিডি আমার বাসায় পৌঁছে দিবেন বলে প্রতিজ্ঞা করে বসলেন।

ছবিঃ রাতের নিউ ইয়র্ক

ছবিঃ রাতের নিউ ইয়র্ক

এদিকে মানুষজনের বাসায় দাওয়াত রক্ষা করতে যাওয়াটা একটা অত্যাচারের পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে গেছে। এদেরকে বোঝানো খুব মুশকিল যে, মানুষ শত শত মাইল পাড়ি দিয়ে নিউ ইয়র্ক শহরে দাওয়াত খাওয়ার জন্য আসে না। ব্যাপক অজুহাত প্রয়োগের বিনিময়ে কিছু দাওয়াত উপেক্ষা করা সম্ভব হলেও, কিছু কিছু উপেক্ষা করা গেলো না। খুব কম সময় থাকার শর্তে সেখানে গিয়ে দেখা গেলো ভাবীসাহেবা শুধু কিচেন রুম-এ যাচ্ছেন আর একটার পর একটা আইটেম নিয়ে আসছেন। মূহুর্তের মধ্যেই এনে সব টেবিল ভর্তি করে ফেললেন। কথা বলার সময়টুকুও পাচ্ছেন না। কেন যেন মনে হচ্ছিলো, কত কম সময়ের মধ্যে, কত বেশি সংখ্যক খাবার টেবিলে এনে সাজিয়ে দেয়া যাবে, সেটাই এখানে চালাক হবার মাপকাঠি। খুব স্বাভাবিকভাবে অন্য আর সব বাড়ির মত এখানেও ছোট ছোট বাচ্চা থাকবে এবং তাদের বাবা-মা’রা বাচ্চাদেরকে দিয়ে এমন কিছু করিয়ে দেখাবেন, যাতে প্রমাণ হয়ে যাবে, একমাত্র আমেরিকা থাকার কারণে তাদের বাচ্চারা এই জিনিস শিখতে পেরেছে, বাংলাদেশে থাকলে এর ধারেকাছেও কিছু শিখতে পারতো না। সাধারণত, এই সব ক্ষেত্রে আমি ‘তাতো অবশ্যই, তাতো অবশ্যই’ জাতীয় মিনমিনে শব্দ বলে রক্ষা পাই। কিন্তু, সমস্যা হলো এই প্রথমবারের মত নিউ ইয়র্কে আমার সাথে বউও আছে। বাচ্চার বাবা বাচ্চা কে বলে, আন্টিকে ‘ফাই’ বলো। আমার বউও সোজা মানুষের মত বাচ্চার দিকে ‘হাই ফাইভ’ বলে হাত বাড়ালো! আমি তাকে বললাম, “তোমাকেতো হাই ফাইভ বলতে বলেনি। তোমাকে ‘হাই’ বলতে বলেছে।” ও বলে, “আমি যে শুনলাম, ফাইভ!” আমি বললাম, “ফাইভ বলেনি, ‘ফাই’ বলেছে!” ও আগামাথা কিছুই না বুঝে বললো, “‘ফাই’ কি জিনিস।” আমি বললাম, “আমার এলাকার লোকজন মনে করে তারা ‘প’ বলতে পারে না, ‘প’ কে ‘হ’ বলে। সেই কমপ্লেক্সিটি থেকে তারা মাঝে মাঝে শুদ্ধ করে কথা বলতে চাইলে ‘হ’ কে ‘ফ’ বা ‘স’ এবং কখনো কখনো ‘প’ দিয়ে প্রতিস্থাপিত করে ফেলে। যেমন, ‘হাকিমপুরী’ কে বলে ‘সাকিমপুরী’, হ্যাপী নামের মেয়েটির মা তাকে বেশি শুদ্ধ করে ডাকতে চাইলে ডাকবে প্যাপী। তারই ধারাবাহিকতায় ‘হাই’ এর শুদ্ধ রূপ ‘ফাই’।”

‘ফাই’ পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে, কমিউনিটির কিছু লোকজনের সাথে বের হলাম রাতের নিউ ইয়র্ক দেখতে। শহরের প্রতিটা অলিগলি এদের মুখস্ত। কোথায় কোন মোড়ে কি বিচিত্র খাবার আছে, সেটা এদের থেকে ভালো আর কেউ জানে না। নিউ ইয়র্কে সবচেয়ে ভাল খাবার খেয়েছি এস্টোরিয়ার হোটেল ‘আলাদিন’-এ। এখনকার অবস্থা অবশ্য জানি না। মিশিগানে অবস্থিত ডেট্রয়েট শহরে একটা ‘আলাদিন’ আছে। দুইটা একই মালিকানার কি-না জানা হয়নি। খাওয়া আর কথার মাঝখানে দেখছি রাতের নিউ ইয়র্ক। নিউ ইয়র্কের রাতের রূপ একদমই আলাদা। শুধু রঙ আর আলো দিয়ে কি করে মানুষকে মাতাল করে দেয়া যায়, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ নিউ ইয়র্কের টাইম স্কয়ার। বিশাল বিশাল স্ক্রিনে আলো ঝলমলে বিজ্ঞাপন, এটিই টাইম স্কয়ারের বৈশিষ্ট। ১৮৫২ সালে হেনরি রেইমন্ড কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আমেরিকার জনপ্রিয় দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমস ১৯০৪ সালে নবনির্মিত টাইম বিল্ডিংয়ে স্থানান্তরিত হওয়ার পর থেকে এই চত্বরের (স্কয়ার) নাম হয়ে যায় টাইম স্কয়ার। বছরের পর বছর ধরে টাইম স্কয়ারে বিশেষভাবে উদ্‌যাপিত হয় ইংরেজি নববর্ষ। বর্তমানে ‘নিউ ইয়ার’ মানেই ‘নিউ ইয়র্ক’, ‘নিউ ইয়র্ক’ মানেই ‘টাইম স্কয়ার’।

ছবিঃ টাইম স্কয়ার-১

ছবিঃ টাইম স্কয়ার-২

বাংলাদেশের ফুটপাতের চা আর ধূলিবালি মাখা সরিষা-মুড়ি-চানাচুর যে পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ খাবারগুলোর মধ্যে পড়ে, সেটা বিদেশের মাটিতে না আসলে বুঝা যায় না। আমেরিকায় রাস্তার পাশের দোকান দেখার জন্য মন উতলা হয়, কিন্তু কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে, খুঁজে পাওয়া যায় নিউ ইয়র্কে। নিউ ইয়র্ক শহরের অনন্য আরেকটি বৈশিষ্ট হচ্ছে রাস্তার পাশের দোকান। খাবারের দোকান, পত্রিকার স্ট্যান্ড, ড্রিংকসের দোকান। সেরকম একটি দোকানে গিয়ে টাকা বের করে হয়তো বলছেন, “পেপসি প্লিজ।” উত্তর আসলো, “কোনডা দিমু, বড়ডা না ছোড়ডা?” কেন জানি না, এই ছোট্ট জিনিসটাই আপনার নিউ ইয়র্ক ভ্রমণের আনন্দ দ্বিগুণ করে দেবে। আসলে এ-পৃথিবীতে মানুষ খুব একা। তারা অবিরত খুঁজে বেড়ায় আপনজন।

রাতের নিউ ইয়র্ক দেখে বাসায় ফিরছি। ট্রাফিক সিগনালে গাড়ি আটকালো আর আমাদের গাড়িতে সবাই হইহই করে উঠলো। কি ব্যাপার? ব্যাপার আসলে বড়ই অত্যাশ্চর্য। যে ট্রাফিক পুলিশ আমাদের গাড়ীর সামনে দাঁড়ানো, সে কমন পড়ে গেছে। আমার নিজ এলাকারই একজন। কিন্তু আমাদের দেখে কাছে এসে কথা বলেই সে উসখুস্‌ করতে শুরু করলো। কারণটাও সহজেই বুঝা গেলো। ঢাকা শহর হলে হয়তো অন্য আর বিশ-পঁচিশটা গাড়িকে আটকে রেখে আমাদের গাড়ী ছেড়ে দিয়ে ‘কিছু একটা করতে পারলাম’ ভেবে স্বস্তি বোধ করতো, কিন্তু এই মরার নিউ ইয়র্ক শহরে সেই ক্ষমতাটুকু দেখানো সম্ভব হচ্ছে না, তাই তার এত দুঃখ। নিজের এলাকার লোকজনকে ট্রাফিক সিগনালে আটকে রেখে কষ্ট দিচ্ছে, এ লজ্জা সে কোনোভাবেই লুকোতে পারছে না।

ছবিঃ রাতের নিউ ইয়র্ক

ছবিঃ রাতের নিউ ইয়র্ক

ছবিঃ রাতের নিউ ইয়র্ক

এদিকে বাসায় ফিরে দেখি আরো কিছু লোকজন আছেন। কথায় কথায় একজন বলছেন, উনার ভাইয়ের জন্য মেয়ে খুঁজছেন, বিয়ে দেবেন। ভাই কানাডা থাকেন। উনি আমাকে অনুরোধ করলেন একটা মেয়ে দেখে দেয়ার জন্য। আমি ভদ্রতা করে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার ভাই কি করেন?” উনি অবাক হয়ে বললেন, “বললাম না আপনাকে, কানাডায় থাকে।” আমি আর কথা বাড়ালাম না, শুধু মনে মনে ভাবলাম-“সহস্র আমেরিকান প্রবাসীর হে মুগ্ধ জননী।” তারপর মনে মনে ভাবাও বন্ধ করে দিলাম।

আসলেও বিচিত্র ধরণের মানুষ বাস করে এই নিউ ইয়র্কে। আমার বিচিত্র বন্ধু অপু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একসাথে পড়েছি। ঘুমের জন্য সে কিছুই করতে পারে না। একসাথে ক্রিকেট খেলার সময় ফাইন লেগে ফিল্ডিং করতো অপু। মাঠের মধ্যেই ঝিমাতে ঝিমাতে ঘুমিয়ে যেতো। আমরা অন্য সব প্লেয়াররা চিৎকার করে আগে তার ঘুম ভাঙ্গাতে হতো, তারপর সে হঠাৎ তাড়াহুড়ো করে উঠে, সম্ভব হলে বল কুড়িয়ে ফেরত দিত। কম্পিউটার সায়েন্স থেকে বিএসসি ডিগ্রি নিলো; সবাই চাকুরী নিয়ে ব্যস্ত, কিন্তু অপু চাকুরী করবে না, ঘুমাবে। তারপর, আইবিএ থেকে এমবিএ করলো। তাও সে চাকুরী করবে না, এখনো ঘুমাবে। তারপর নিউ ইয়র্ক এসে ফিন্যান্স এ উচ্চতর ডিগ্রি নিলো। না, এবার আর ঘুম নয়। নিউ ইয়র্ক ‘দিন-আনি-দিন-খাই’ শহর। নিউ ইয়র্ক কাউকে ঘুমাতে দেয় না। অপু এখন চাকুরী করে, ঘুমানোর সময় কোথায়! ছুটির দিনে ছুটে আসে দেখা করতে, আমিও ছুটে যাই। আগের মতই আছে সে, বাড়তি শুধু চাকুরীটা করে। অপু বলতে শুরু করলো, “ধুর্… নিউ ইয়র্ক শহরে দেখার কিছু নাই। খালি বিল্ডিং আর বিল্ডিং, আর মিউজিয়াম। এগুলা দেখার কিছু হইলো, তুই কও?” আমি বলি, “সারা দুনিয়া থেকে মানুষ কেন ছুটে আসে নিউ ইয়র্ক দেখতে।” অপু বলে, “হুদ্দাই!” আমিও বললাম, “এগুলো দেখার কিছুই হইলো না।”

নিউ ইয়র্ক থেকে ফিরে আসার আগের রাত। কেউ একজন ফোন করে দেখা করতে চাইলো। আমার সাথে পরিচয় নেই, কিন্তু আমাকে চেনে বললেন, আমার এলাকার কেউ হবে। আমি কোনো ভিআইপি না যে মানুষ জন দেখা করার জন্য উতলা হয়ে যায়, বরং আমিই ছুটে যাই নানা রকমের মানুষের কাছে। তবে, ছয় মাসে নয় মাসে কেউ যে আসে না তাও নয়, তাই এ-ধরণের দেখা করতে চাই জাতীয় জিনিসের সাথে আমি সুপরিচিত। বাসা থেকে বের হয়ে দেখা করতে যাই। ছোটো-খাটো একটা মানুষ। শরীরের এক চতুর্থাংশ উচ্চতার সমান দাড়ি। খুব সুন্দরভাবে আসতে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু ইট-কংক্রিটের ভার চেহারায় মাখা আছে। খুব চেষ্টা করছেন আমাকে কিছু খাওয়ানোর জন্য। এখানকার মানুষের কাউকে সমাদর করার একমাত্র মাধ্যমেই হচ্ছে খাওয়ানো। এই লোকটা খুবই সাধারণ, তাই তার সাথে আমার ব্যয় করা সময়ও বেড়ে চলে। এই নিউ ইয়র্কে অনেক বিখ্যাত, সুপরিচিত, গণ্য, মান্য, ভদ্র, উচ্চ বংশীয়, বুনিয়াদী, বিশিষ্ট, ক্ষমতাধর, বিত্তশালী, অনেক বিশেষণওয়ালা মানুষই আছেন। আমার পরিচিতজনদের মধ্যেই আছেন। এই মানুষদের আতিথ্যও আমি গ্রহণও করেছি। কিন্তু, তাঁরা কখনো আমার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু ছিলো না। আমার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু সাধারণ মানুষ। অতি সাধারণ মানুষ। কথা-বার্তার এক পর্যায়ে আমার সাথে দেখা হওয়া মানুষটি জানালেন, পরের মাসেই বাংলাদেশে যাচ্ছেন, মা বিয়ের ঠিক করেছেন। বলেই খানিকটা বিব্রতও বোধ করলেন। কিন্তু, চোখে-মুখের অনাবিল আনন্দ ঢাকতে পারলেন না। তার পরিশ্রমী চেহারার ভিতর ঝিলিক দিয়ে উঠে নির্ভেজাল আনন্দ। দেখতেই ভালো লাগে। তার সবচেয়ে আনন্দের স্থান মা-মাটি-মানুষ, কিছু দিন পর হতে যাচ্ছে নিজের একটা মানুষ। এখানে মানুষজন কষ্ট করে, প্রচণ্ড কষ্ট করে। বাংলাদেশ থেকে যারা মনে করেন নিউ ইয়র্ক মানে টাকার খনি, তারা ভুল মনে করেন। নিউ ইয়র্ক থেকে যারা বাংলাদেশে গিয়ে দেখাতে চেষ্টা করেন তারা স্বর্গ থেকে এসেছেন, তারা মিথ্যা চেষ্টা করেন। আমার যে আত্মীয়ের ব্যবস্থাপনায় এখানে আছি, তিনি বাংলাদেশে গিয়ে বলেন, “নিউ ইয়র্কে শুধু টাকা আর টাকা, উড়ছে টাকা, তোমাকে শুধু সেই টাকাটা হাত দিয়ে ধরে নিতে হবে।” তার সামনে বসে থাকা লোকজন শুধু চোখ বড় বড় করে শুনেন সেই কথা, আর স্বপ্ন দেখেন। ভাবতে থাকেন, “এ-কেমন দেশরে বাবা। ইস্‌! একবার যেতে পারলে হতো।” যে-লোকগুলো চোখ বড় বড় করে এই কথা গুলো সরল মনে শুনতো আর বিশ্বাস করতো, তাদের মধ্যে একজন এই আমি; যার চোখে আজ সেই কল্পিত স্বর্গের করুণ রূপটিও ধরা দিয়েছে বিব্রত-বিতৃষ্ণায়।

ছবিঃ রাতের নিউ ইয়র্ক

ছবিঃ রাতের নিউ ইয়র্ক

ফিরে আসার দিনে, প্লেনে উঠার সময় দেখি এক ভদ্রমহিলা সিকিউরিটিতে বিশাল ঝামেলা লাগিয়ে দিয়েছেন। উনার সাথে থাকে কিছু জিনিস কোনোভাবেই ভিতরে নেয়া যাবে না। কিন্তু, উনিও কোনোভাবে সেটা ফেলতে দিবেন না। তার উপর তিনি বসে আছেন হুইল চেয়ারে। ডিস্যাবল এবং বয়স্কদের জন্য এই বিশেষ ব্যবস্থা। অবশেষে সমঝোতা হলো, এয়ারপোর্ট এর যে লোক উনাকে হুইল চেয়ারে করে নিয়ে যাচ্ছেন, তিনি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা তার মেয়ের কাছে জিনিসগুলো পৌঁছে দিবেন। দূর থেকে দাঁড়িয়ে এসব দেখছিলাম। ঘটনার এত বিস্তারিত জানতে পারলাম যখন ভদ্রমহিলা গোল গোল চোখ করে আমাদেরকে এসে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি বাংলাদেশি? উত্তর শুনে উনি আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। কিন্তু, আমার পায়ের নীচ থেকে মাটির পৃথিবী সরে গেলো। কারণ, তার হাতের তিন চারটা ব্যাগ পুরো যাত্রাপথে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের অংশ হিসেবে আমাকেই বইতে হবে। ব্যাগ না বলে ভাণ্ড বলাই ভালো। আমি বলি, “এখানে কি?” উনি বলেন, “ইলিশ মাছ।” আমারতো শুনেই ফিট হয়ে যাবার দশা। ভাবতেই তো কেমন লাগছে, ইলিশ মাছের মৌ মৌ গন্ধে ভরে উঠেছে বিমান। উনি একটু থেমে আরো বলেন, “পটল।” সাথে সাথে জানান দেন, “শিকাগোতে পটলের পাউন্ড সাত ডলার, আর এখানে মাত্র তিন ডলার।” ওদিকে, বাংলাদেশ থেকে রবিবারে একেবারে বরফ দেয়া ফ্রেশ ইলিশ মাছ এসেছে, তাই ব্যাগ ভর্তি করে ছেলে-বউ-নাতি-নাতনীর জন্য নিয়ে যাচ্ছেন। আমি বলি, “আর কিছু নেই।” তিনি বলেন, “আছে।” আমি আৎকে উঠি। তিনি বলেন, “কুমড়ার শাক।” মনে মনে পরিকল্পনা করছি, যে করেই হোক পালিয়ে বাঁচতে হবে। আমেরিকায় এখন সাউথওয়েস্ট এয়ারলাইন্স বেশ জনপ্রিয়। ভাড়া কম। কোনো সিট প্ল্যান থাকে না, যে যার খুশী মতো সিটে বসে যাবেন। তবে আমাদের জন্য খুশির খবর হচ্ছে, তিনি যেহেতু হুইল চেয়ারে করে এসেছেন, সবার আগে স্পেশাল ব্যবস্থায় উনাকে নিয়ে যাওয়া হবে। তারপর, আর আমাদেরকে পায় কোথায়। কিন্তু প্লেনে উঠা শুরু হতেই উনি বলে উঠলেন, “শোনো, আমি গিয়েই আমার পাশের সীটগুলো তোমাদের জন্য দখল করে রাখবো, যাতে কেউ সেখানে বসতে না পারে।” আমি শুণ্য দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে, শুকিয়ে যাওয়া গলায় ঢোক গিলে বললাম, “জ্বী,আচ্ছা।”

এয়ারপোর্টের রানওয়ে ছেড়ে উড়ে যায় বিমান। ছেড়ে যায় নিউ ইয়র্ক। অনেকদিন থেকে চাকচিক্যময়, প্রখ্যাত, বিখ্যাত নিউ ইয়র্ক ছেড়ে যাচ্ছি। একবারের জন্যে, এক মূহুর্তের জন্যও মনে হয়নি কিছু একটা ছেড়ে যাছি; মনে হয়নি, ছেড়ে যাচ্ছি দালান-কোঠা-ইমারত, ছেড়ে যাচ্ছি ঝলমলে আলো। কষ্ট হয়নি পৃথিবীর সবচেয়ে বিত্তশালী, সবচেয়ে নামকরা এক শহরকে ছেড়ে যেতে। কিন্তু, এখনো কষ্ট হয়, যখন ভাবি, বহু বছর আগে একদিন এভাবেই ছিঁড়ে এসেছিলাম, ছেড়ে এসেছিলাম পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্রতম এক দেশের নামগোত্রহীণ এক ছোট্ট পল্লীগ্রাম; ছেড়ে এসেছিলাম, আমগাছের ডালে ছোট্ট টুনটুনি পাখিটির বাসা।

মইনুল রাজু (ওয়েবসাইট)
[email protected]