নবদ্বীপের পিরল্যা গ্রামের এক ব্রাহ্মণ যুবক এলো দিল্লীর বাদশাহ কর্তৃক যশোরের শাসনকর্তা হিসাবে সদ্য নিয়োগকৃত সেনাপতি খান জাহান আলীর (মৃত্যু ১৪৫৮ খ্রি.) কর্মচারী হয়ে। পূর্ব নাম জানা যায়নি। সে এক মুসলমান মেয়েকে ভালবেসে বিয়ে করে।

হিন্দুধর্ম এমনই এক গন্ডিবদ্ধ যে সেখানে অন্য ধর্মের মানুষের প্রবেশাধিকার নেই। এই ধর্ম কাউকে গ্রহণ করে না, বরং নানা ছলছুতায় নিজেদের লোককেই অন্য ধর্মের। দিকে ঠেলে দিয়ে তৃপ্তি পায়। ব্রাহ্মণ ছেলে যবনীকে বিয়ে করেছে বলে তাকে হিন্দু ধর্ম থেকে বাদ দেয়া হলো। জাতিভ্রষ্ট হওয়ার পর তার নাম হলো মামুদ তাহির। মধ্যযুগে বাঙালীদের নামের পাশে কোন পদবী যুক্ত হওয়ার রেওয়াজ না থাকায়, পিরল্যা গ্রাম থেকে এসেছে বলে যুবকটিকে আগে থেকেই “পিরল্যাই” বলে সম্বোধন করা হতো। মুসলমান হওয়ায় এই ডাকটিকে চমৎকারভাবে প্রয়োগ করা গেল, পির আলী।

একমাত্র হিন্দু ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্মগুলো নবাগতদের সাদরে গ্রহণ করে, পারলে কিছু কিছু পুরুষ্কারেরও ব্যবস্থা করে। সেই হিসাবে মামুন তাহির ওরফে পির আলী তার প্রভুর নিকট থেকে পেলো চেঙ্গুটিয়া পরগণার উজিরগিরি। কামদেব ও জয়দেব নামের দুই ব্রাহ্মণ দেওয়ানী করতো পির আলীর অধীনে। সদা হাসি-খুশী উজিরের সঙ্গে তারা একদিন এক অপ্রত্যাশিত রসিকতা করে ফেললো।

রোজার মাস, রোজাদার পির আলী হাতে একটি গন্ধ লেবু নিয়ে সভাসদগণের সঙ্গে আলাপ করেছেন আর মাঝে-মধ্যে লেবুর গন্ধ শুকছেন। তা দেখে কামদেব বা জয়দেবের কেউ একজন বলে বসলো, ‘উজির সাহেব, আপনার আজকের রোজা তো ভঙ্গ হয়ে গেল। কারণ, আমাদের শাস্ত্র মতে, ঘ্রানেন অর্ধভোজনম্‌’। কথা শুনে পির আলী শুধু হাসলেন। এই হাসিতেই লুকিয়ে ছিল গভীর রহস্য তা কে জানতো?

একদিন পির আলী তাঁর দরবারে অনেক হিন্দুকে ডেকে এনে কথাবার্তার মাঝে ভৃত্যদেরকে কী যেন ইঙ্গিত করলেন। ইঙ্গিতের সঙ্গে সঙ্গে ভূত্যরা সভাকক্ষের পাশে জ্বলন্ত উনুনে গো-মাংস রান্না শুরু করে দিলো। লোকশ্রুতি আছে, এদিন একশত গো-বধ করা হয়েছিল। গো-মাংসের গন্ধে অনেক হিন্দু নাকে কাপড় দিলো, অনেকে সভা ছেড়ে পালালো। কিন্তু যেতে দেওয়া হলো না কামদেব আর জয়দেবকে। পির আলী বললেন, ‘তোমরা পালাচ্ছো কোথায়? তোমাদের শাস্ত্র মতেই তো তোমাদের অর্ধেক ভোজন হয়ে গেছে। বাকিটা আমার সঙ্গে বসে সেরে ফেলো’।
গো-মাংস ভক্ষণের অপরাধে জাত যাওয়া কামদেব ও জয়দেবের নাম হলো কামালউদ্দিন ও জামালউদ্দিন। ধর্মান্তরিত হওয়ায় তারাও পুরুস্কার পেলো জায়গীরদারী। কোন হিন্দু ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ধর্মান্তরিত হলে তার বাকি পরিবারও রেহাই পায় না। তাদের অন্য দুই ভাই, রতিদেব ও শুকদেবের প্রতি সমাজ খরগহস্ত হলো, আত্মীয়-স্বজনরা জল অচল করলো। এবং পির আলীর কর্মের সুবাদে এদের পরিবারের নামের সঙ্গে পিরালী আপবাদ যুক্ত হলো। লোকে এদের ব্রাহ্মণ বলে না, বলে পিরালী বামুন।
নিকটজনের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সন্তানহীন রতিদেব গৃহত্যাগ করে বৈরাগ্যবরণ করলো। কিন্তু শুকদেব এমনটি করতে পারলো না, কারণ, তার একটি ভগ্নি ও কন্যা তখন বিবাহযোগ্যা। পরিবারে জাতিভ্রষ্টের কলংক থাকায় কোনও ব্রাহ্মণ এদের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে রাজী নয়। শেষে শুকদেব সমাজের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করলো শেষ অস্ত্রটি, যার চেয়ে অমোঘ অস্ত্র আর হয় না। টাকা দিয়ে কিনে ফেললো দুই ব্রাহ্মণকে। শুকদেবের ভগ্নির বিবাহ হলো ফুলে গ্রামের মঙ্গলানন্দ মুখোপধ্যায়ের সঙ্গে এবং কন্যার স্বামী হলো পিঠাভোগ গ্রামের জগন্নাথ কুশারী।

গাঙ্গুল গ্রামের ব্রাহ্মণরা যেমন গাঙ্গুলী, সেই রকম কুশ গ্রামের নিবাসীরা কুশারী। এই কুশ গ্রামটি বর্ধমান শহরের কাছে। ক্রমে এই কুশারীরা বাকুড়ার সোনামুখী, খুলনার পিঠাভোগ ও ঢাকার কয়কীর্তন গ্রামে বসতি নেয়। এই কুশারীরা অবশ্য সুদীর্ঘ বংশ গৌরব দাবি করতে পারে।
আদিশূর নামক গৌড়ের রাজা নাকি কনৌজ থেকে পাঁচজন খাটি ব্রাহ্মণ এনেছিলেন। এতে মনে হয়, গৌড়-বাংলা তখন অনার্য অধ্যুষিত এলাকা ছিল। এই পাঁচ ব্রাহ্মণ থেকেই শান্ডিল্য, ভরদ্বাজ, কাশ্যপ ও সাবর্ণ গোত্রের উদ্ভব- যা পরবর্তীকালে বহু জটিলতার সৃষ্টির কারণ হয়েছিল। যা হোক, শান্ডিল্য গোত্রের প্রথম পুরুষ ক্ষিতীশের এক পুত্রের নাম ভট্টনারায়ণ- যিনি ‘বেণীসংহার’ নাটকের রচিয়তা। ভট্টনারায়ণের বংশধররাই কুশারী। শান্ডিল্য গোত্রের জন্য এদেরকে বন্দঘটি বা বন্দ্যোপাধ্যায় বলা হলেও গ্রামীণ নিরিখে এরা কুশারীই। বংশ গৌরব থাকলেও যবন সংস্পর্শ হেতু পিঠাভোগের কুশারীরা পিরালী বামুন অপবাদ থেকে নিস্কৃত পেলো না।

কয়েক শতাব্দী পরে এই কুশারী বংশের সন্তান পঞ্চানন এবং তার খুল্লতাত শুকদেব আত্মীদের সঙ্গে বিবাদ করে বাড়ি ছেড়ে বসতি গড়লেন গোবিন্দপুরের খাড়ির পাশে, যার বর্তমান নাম আদি গঙ্গা বা টালির নালা। জেলে, মালো, কৈবর্ত অধ্যুষিত এলাকায় এসে এরা ব্রাহ্মণের মতো যথাযথ সম্মান পেলেন। গোবিন্দপুর, সুতানটি ও কোলকাতা নামে তিনটি গ্রাম জুড়ে ইংরেজরা তখন একটি নতুন শহরের পত্তন করেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা ইংরেজদের সঙ্গে কথা বলার জন্য ব্রাহ্মণ দু’জনকে এগিয়ে দেয়। ব্রাহ্মণ দেবতুল্য, গ্রামের মানুষ তাদেরকে ঠাকুর বলে ডাকে, সাহেবরা ঠাকুর বলতে পারে না, তারা বলে টেগোর। কুশারী ও পিরালী পরিচয় মুশে গিয়ে পঞ্চানন ও শুকদেব কাঙ্খিত ঠাকুর হলেন। ইংরেজদের সঙ্গে ব্যবসা-দালালি করে এরা প্রচুর ধন-সম্পদেরও মালিক হলেন।

পরবর্তীকালে এই বংশের দুই ভ্রাতার নাম নীলমণি ও দর্পনারায়ণ। বড় ভাই নীলমণি ইংরেজদের চাকরি করে প্রতিনিয়ত বিপুল অর্থ পাঠান ছোটভাই দর্পনারায়ণের কাছে। এই অর্থ দ্বারা দর্পনারায়ণ সংসারে উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি করতে থাকেন। আর্থিক অবস্থা ভালো হওয়ায় তারা গোবিন্দপুরের খাড়ির কিনারা ছেড়ে মেছুবাজারের পাথুরিয়াঘাটা নামের অভিজাত পল্লীতে চলে আসেন।

নীলমণি চাকরি ছেড়ে বাড়ীতে এলে বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে বিরোধ এত চরমে ওঠে যে, একদিন বর্ষার রাতে নীলমণি তার স্ত্রী-পুত্র; কন্যার হাত ধরে এবং গৃহদেবতা ‘নারায়ণশিলা’ সঙ্গে নিয়ে গৃহত্যাগ করলেন। অবশ্য এ সময় দর্পনারায়ণ দাদার হাতে এক লক্ষ টাকা তুলে দিয়েছিলেন- যাতে পরবর্তীকালে নীলমণি ওয়ারিশ দাবি না করতে পারে।

গৃহহীন ব্রাহ্মণ নীলমণিকে আশ্রয় দিলেন কোলকাতার বিখ্যাত ধনপতি ও গঙ্গাজল ব্যবসায়ী শেঠ বৈষ্ণবচরণ, উদ্দেশ্য ব্রাহ্মণকে ভূমিদানের পূণ্যার্জন। জোড়াসাঁকো অঞ্চলে বৈঞ্চবচরণ প্রদত্ত জমিতে প্রতিষ্ঠিত হলো ঠাকুর বংশের দ্বিতীয় শাখাটি। নীলমণি ক্রমে ক্রমে আরো জমি কিনে নিজের প্রাসাদ বানালেন।
নীলমণির তিন সন্তান। জ্যৈষ্ঠের নাম রামলোচন। পিতার মৃত্যুর পর দক্ষ, সৌখিন ও বিলাসী রামলোচন কিছু কিছু জমিদারি কিনে আস্তে আস্তে কোলকাতার ধনী সমাজে নিজের ঠাই করেন নেন। তার কোনও পুত্র সন্তান ছিল না, এক কন্যা, তা-ও অকালমৃতা। পত্নী অলকাসুন্দরীর সম্মতি নিয়ে রামলোচন তার মেঝ ভাইয়ের একটি ছেলেকে দত্তক হিসাবে গ্রহণ করেন এবগ ছেলেকে নিজের আদর্শ মতো গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু পুত্রটির বয়স যখন তের বছর তাখন রামলোচন ইহধাম ত্যাগ করেন। রামলোচনের এই দত্তক পুত্রের নাম দ্বারকানাথ। পালিকা মাতা অলকাসুন্দরী ও তার বড় ভাই রাধানাথের তত্ত্বাবধানেই দ্বারকানাথ মানুষ হতে লাগলেন।
তখনো হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠত হয়নি। জোড়াসাঁকোরই ফিরিঙ্গি কমল বসুর বাড়ীতে শেনবোর্ন নামের কেজন সাহেব একটা স্কুল খুলেছেন। দ্বারকানাথ এই স্কুলেই এনফিল্ডস স্পেলিং, রিডিংবুক, তোতা কাহিনী, ইউনিভার্সাল লেটার রাইটিং, কমপ্লিট লেটার বুক এবং রয়েল ইংলিশ গ্রামার পড়তে লাগলেন। আঠারো বছর পূর্ণ হতেই তিনি স্বাবলম্বী হতে সচেষ্ট হলেন।
পালক পিতার নিকট থেকে দ্বারকানাথ জমিদারি সম্পত্তি পেলেও তার আয় খুব বেশী ছিল না। তাই তিনি ইংরেজদের অধীনে দেওয়ানীর চাকরি করেছেন, জমিদারদের মামলা মোকদ্দমায় ল এজেন্ট হয়েছেন এবং বাড়িয়েছেন নিজস্ব জমিদারীর পরিধি।

জমির মালিকানার প্রতি বাঙালীর আকর্ষণ চিরন্তন, কিন্তু দ্বারকানাথ বুঝেছিলেন, লক্ষীর আনাগোনা চলে বাণিজ্যেই। তাই তিনি ব্যাংকিং, ইন্সুরেন্স, রেশম, নীল, কয়লা ও জাহাজ ব্যবসায় নিয়োজিত হয়ে অতি অল্পদিনেই অর্থের পাহাড় গড়ে তুললেন।

অত্যাধিক বিত্তবৈভবের তাপে ধনকুবের দ্বারকানাথ ভোগসাগরে নিত্য অবগাহন শুরু করলে ভাগ্যদেবীর পিছটান দেয়া ছাড়া গত্যন্তর রইলো না। জীবনের শেষ দিকে আর্থিক কষ্টে নিপতিত না হলেও তাঁর প্রাচুর্যের জৌলুস অনেকটাই ম্লান হয়ে গিয়েছিল।

যাহোক, পুত্র দেবেন্দ্রনাথের অক্লান্ত পরিশ্রমে ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্না হয়ে আবার ঠাকুর পরিবারের দিকে মুখ ফিরালেন। ভাগ্যদেবী এবার আর একা এলেন না, সঙ্গে করে আনলেন বিদ্যাদেবী সরস্বতীকেও। ব্যবসা-আইন-সমাজনীতি-ধর্মনীতি-রাজনীতি কী ছিল না ঠাকুর পরিবারের এক্তিয়ারে? সঙ্গত কারনেই বিংশ শতকের ঠাকুর পরিবার ভারতবর্ষের আপামর মানুষের সমীহ আদায়ে সমর্থ হয়েছিল।

শিক্ষা-সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতি ও ধর্মীয় রেনেসাঁসে এই পরিবার বাঙালীদেরকে চিরঋণে আবদ্ধ করেছে। স্বভাবতই এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা বলা হচ্ছে ।