সপ্তাহের শেষ দিনটা খুব ভাল কাটে দীপের। নিজের মত করে দুইটি দিন পাওয়ার আনন্দে মনটা সারাদিনই থাকে চনমনে। সপ্তাহ জুড়ে একটানা কাজ করার পর যে কারোরই দেহ-মন অবশ হয়ে যাওয়ার কথা; অথচ দীপের কাজের স্পিড যেন উল্টো বেড়ে যায় এইদিনে! যাই হোক, হাতের সব কাজ শেষ করে সপ্তাহ শেষের পরিতৃপ্তি নিয়ে সেদিন যখন সে বাড়ি ফিরছিল, তখনই এহসানের ফোনঃ “আগামীকাল সকালে রমনায় হাটবি?’’ ভোরের হাওয়া খুবই প্রিয় দীপের; কিন্তু তার চেয়েও বেশী প্রিয় শুক্রবার সকালে বেলা করে ঘুমানো এবং জাগার পর হরেক রকম ভর্তার সাথে মায়ের হাতের সুস্বাদু খিচুড়ি। তবে দীপ সরাসরি ‘না’ বলে না এহসানকে, ‘’দেখ, আগামীকাল কিছু ব্যক্তিগত কাজ আছে। তবে পরের সপ্তাহে মিস হবে না, কথা দিচ্ছি।‘’ অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসে, ‘’ঠিক আছে, গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকলে আসার দরকার নেই। তবে আগামী সপ্তাহে কিন্তু মিলেশিয়া ফুল নাও পেতে পারিস।‘’ এবার একটু দ্বিধায় পড়ে যায় দীপ। এহসান এর আগেও মিলেশিয়ার কথা বলেছিল। বাসা কাছাকাছি থাকাতে এহসানের সুযোগ ঘটে প্রায় প্রতিদিনই রমনায় মর্নিং ওয়াক করার। আর দেখার সৌভাগ্য হয় প্রকৃতির রূপ-রস-চিত্র বদলে যাওয়ার খুঁটিনাটি সব দৃশ্য! দোমনা দীপ কোন সিদ্ধান্তে আসতে না পেরে ‘দেখি, সম্ভব হলে আসব’ বলে রেখে দেয় ফোন।
পরের দিন ভোর সাড়ে পাঁচটা। দীপ মিলেশিয়ার টানে ঘর থেকে বের হয়ে এসেছে। ভোরের শিরশির বাতাস দেহে সুখের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। এহসানকে মনে মনে ধন্যবাদ দেয়। ঘুম থেকে উঠতে কষ্ট হলেও, এখনকার অনুভূতির তুলনাই হয় না! সূর্যের প্রথম আলো। চারদিকে ঘুমন্ত শহর। প্রায় জন-মানুষ-হীন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একসময় পৌঁছে যায় রমনার ‘অরুণোদয়ে’। সেখানে এত সকালেও মানুষের কমতি নেই। ফেলে আসা ঢাকার তুলনায় এই ঢাকা অনেক জাগ্রত আর জীবন্ত। কিছুক্ষণ বাদেই এহসানের দেখা মেলে। ‘চল, তোকে আগে মিলেশিয়ার কাছে নিয়ে যাই।‘ এই এলাকা এহসান নিজ বাড়ি-ঘরের মতই চেনে। এহসানকে অনুসরণ করে পার্কের রাস্তা দিয়ে হাটতে থাকে দীপ। রমনার রমণীয় সৌন্দর্যে মুহূর্তেই মোহাবিষ্ট হয় সে। রাস্তার দু’ধারে কত নাম না জানা গাছ আর কত রকমের ফুল! এক সময় এহসান বলে উঠেঃ “ঐ দেখ তোর মিলেশিয়া!’’ পাশাপাশি কয়েকটা গাছ জুড়ে মিলেশিয়া ফুটে রয়েছে। গাছগুলিকে মিলিশিয়া শুধু রংই বিলায়নি, অদ্ভুত আভিজাত্যও দান করেছে। তবে দীপের পাগল হবার দশা হল, যখন আশে-পাশের রাস্তার দিকে তাকাল। অনিন্দ্যসুন্দর সব ফুলের বিছানা যেন চোখের সামনে ভাসতে লাগল। এমন দৃশ্য দেখে অনেকক্ষণ মুখ দিয়ে কথা সরে না দীপের। স্বর্গ কি এর চেয়েও সুন্দর, নিজেকেই জিজ্ঞেস করে দীপ। এহসানকে আবার মনে মনে ধন্যবাদ দেয়। অত্যন্ত রক্ষণশীল একটি পরিবারে জন্ম হলেও, এহসানের সৌন্দর্যবোধের আসলেই কোন ঘাটতি নেই।
আবার হাটতে থাকে দুই বন্ধু। হাটতে হাটতে একটা কথা মনে হয় দীপের। রমনার প্রাণী জগত তার উদ্ভিদ জগতের চেয়ে কম বৈচিত্র্যপূর্ণ নয়। কত ধরণের মানুষ যে এখানে এত সকালে এসেছে, তার ইয়ত্তা নাই। রয়েছে শূন্য বছরের শিশু থেকে শুরু করে অশীতিপর বৃদ্ধ। চোখ পড়ে একজন শ্বেত-শুভ্র মৌলবির দিকে, যিনি আবার তসবিহ জপতে জপতে হেটে যাচ্ছিলেন। লোকটার চোখ ও মুখাবয়বে রয়েছে এক অদ্ভুত প্রশান্তি, যার ছায়ায় দীপও যেন কিছুটা সিক্ত হয়! কিছু দূরেই আবার একজন মধ্য বয়সী মানুষকে দেখা যাচ্ছে চুপচাপ একটা বেঞ্চিতে বসে মূর্তির মত অত্যন্ত অলস ভঙ্গিতে হাত দুটোকে উঁচু-নিচু করতে; তার শরীরের আর কোথাও কোন স্পন্দন লক্ষ্য করা যাচ্ছিল না। দীপ হাসি চেপে রাখতে পারে না। কিছু দূর দেখা যায় একটি গাছকে আড়ালে রেখে এক অল্প বয়সী স্ফীত দেহের মহিলা বোরকা পরেই প্রাণপণ ব্যায়াম-প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। উনি যেভাবে বোরকা সমেত পাটাকে উপরে তোলার চেষ্টা করছিলেন আর স্থূল কোণ বানাচ্ছিলেন, তা দেখে দীপের আবার হাসি পেয়ে যায়। হঠাৎ একটা বাচ্চা ছেলের খলখল হাসির শব্দ কানে আসে। শব্দের উৎসে দেখা যায়, বাচ্চাটি তার বাবার সাথে ফুটবল খেলছে। বাবা বলটি বিভিন্নদিকে পাঠিয়ে দিচ্ছে এবং ছেলেটি তা উদ্ধার করতে পারার আনন্দে আটখানা হয়ে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুলছে। এদিকে হাঁটতে হাঁটতে এহসান একসময় গেয়ে উঠে, “মম জীবনও-যৌবনও, মম অখিল ভুবনও তুমি ভরিবে গৌরবে নিশীথিনী সম।” দীপ বলে, “এই যুগের ছেলে হয়ে কই ব্যান্ডর গান গাইবি, তা না, ধরলি একটি স্লো রবীন্দ্র সংগীত।” এহসানের জ্ঞানগর্ভ উক্তি, “দেখ, উনার লেখা যে কতটা প্রভাবশালী, তুই কল্পনাও করতে পারবি না। আমি আমার চাচাদের কাছে শুনেছি, রবীন্দ্রনাথ যদি মুসলিম হত, তা হলে অবশ্যই আল্লাহর একজন নবী বা অনেক বড় আউলিয়া হত।” দীপ অবাক হয় না; এহসানের পারিবারিক আবহ ওর ভালই জানা আছে।
একসময় সোনালু গাছের নীচে এলে দীপকে ছবি তুলে দিতে বলে এহসান। সোনালু গাছে সোনার ঝুমকোর মতই শত শত ফুল দুলছে। সোনালুর সোনার দুলের প্রতি এহসানের এই বিশেষ অনুরাগ দেখে খোঁচা দেয়ার লোভ সামলাতে পারে না দীপ, “সোনালু ঝুমকোর সাথে ছবি তুলেই জীবন পার করবি, সত্যিকারের ঝুমকোর নাগাল তো পাবি না কখনো।“ এহসানের জবাব যেন তৈরি করাই ছিল, “সুরবালাদের সব সময় পাওয়া যায় না রে। কোন এক বিশেষ মুহূর্তে তাদের অল্প সময়ের জন্য পাওয়াতেই জীবন সার্থক হয়ে উঠে।“ দীপের বিদ্রুপমেশানো কণ্ঠ, “তাইলে তুমি সেই সুরবালার তালাসেই থাক।“ এহসানের চোখ হঠাৎ স্থির হয়ে যায়। এহসানের শ্বাসের আওয়াজ পর্যন্ত টের পাওয়া যায়। দীপ জিজ্ঞেস করে, “এমন হাভাতের মত কি দেখছিস রে, গাধা?’’ যেন অনেক কষ্টে গলা থেকে স্বর বের হয় এহসানেরঃ “আমি সুরবালাকে দেখছি!’’ এহসানের চোখ অনুসরণ করে সত্যি এক সুনয়নাকে দেখতে পায় দীপ। মেয়েটির মুখশ্রীতে কাব্য আর কারুকাজের সত্যি কোন অভাব নেই। মেয়েটি মনে হয় কাউকে খুঁজছে। কিছুক্ষণ বাদেই একটা শিশু দৌড়ে মেয়েটির সামনে চলে আসে, আর বিজয়ীর ভঙ্গিতে বলতে থাকে, ”আম্মু দেখ, তোমার জন্য কতগুলি ফুল আনছি”। মেয়েটি এতে খুশি হল বলে মনে হল না; উল্টো শিশুটিকে এমন চড় লাগাল যে তার হাতের সব ফুল মাটিতে পড়ে গেল। শিশুটি সঙ্গে সঙ্গে বিকট কান্না জুড়ে দেয়। এদিকে এহসান তখন পুরো বিধ্বস্ত। থাপ্পড়টা যেন ওর গায়েই লেগেছে! এহসানকে আর একটু চেতিয়ে দেয়ার জন্য দীপ বলে, “ কি রে, চড়ের চোটে দেখি মুখ দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে!’’ এহসান ঝাঁঝের সাথে জবাব দেয়ঃ “দূর, এইসব মেয়েকে নিয়ে আমি আসলে কোন চিন্তাই করি না। আমি তো পর্দা করা মেয়ে বিয়ে করব; তাকে তোরা দেখতেই পাবি না।‘’ এহসানের ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড জানা আছে বলে, ওর কথাকে পুরোপুরি উড়িয়ে দিতে পারে না দীপ। “তাহলে তোর বৌভাত হবে কিভাবে? মানুষ বউ দেখতে এসে কাকে দেখবে”। দীপের জবাব, ‘’এইসব বউভাত-টাত আমাদের ধর্মে নাই, বুঝলি। এগুলি হল বিধর্মীদের যড়যন্ত্র, আমাদের ধর্ম নষ্ট করার পায়তারা। আমাদের ধর্ম মানলে, সত্যি সত্যি তোরা বিয়ের দিন কেন, কখনোই আমার বউকে দেখতে পারবি না; তাকে দেখার রাইট শুধু থাকবে তার মান্যবর স্বামী এহসানের।‘’ দীপ কিছুটা অবাক হলেও কোন বাদানুবাদে যায় না।
চলতে চলতে হঠাৎ গানের আওয়াজ ভেসে আসে । অদূরেই দেখতে পায়, একটা মেয়ে মাইক্রোফোন হাতে গান করছে আর তার সঙ্গীরা বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে অপূর্ব সঙ্গত করে যাচ্ছে। মেয়েটি গাইছিল ‘একি সোনার জীবন আলোয় ভরিয়ে দিলে ’। তার সুরের মূর্ছনা রমনার বাতাসে যেন উষ্ণতার ঢেউ ছড়িয়ে দিচ্ছিল। দীপ প্রায় পুরোই ডুবে গিয়েছিল গানের ভিতর। কিন্তু সম্বিত ফিরল এহসানের টানাটানিতে। ‘’এই, চল অন্যদিকে যাই। তাছাড়া ফেরারও সময় হয়ে গেছে।’’ এখুনি ফিরতে নারাজ দীপ বলেঃ “এত তাড়াহুড়ো করছিস কেন? একটু পরে গেলে কি সমস্যা?’’ এহসানের পাল্টা প্রশ্নঃ “তুই-ই বা এইসব ঘেউ ঘেউ শোনার জন্য এত অস্থির হয়ে গেলি কেন?‘’ দীপ তো তাজ্জব, “কি বলছিস, তুই? এগুলো আবার কি ধরণের ভাষা।” এহসান বললঃ “কেন তুই জানিস না, এভাবে দল বেঁধে ছেলে-মেয়ে প্রকাশ্যে একত্রে বাদ্য যন্ত্র বাজিয়ে গান করা ভয়ানক গুনাহ? এইগুলা সব শয়তানের চ্যালা-চামুণ্ডা! এদের কাছ থেকে যত দূরে থাকা যায়, ততই নিরাপদ। গুনাহ থেকে বাঁচতে চাইলে, চল, দ্রুত সরে পড়ি। নইলে শয়তান আমাদেরও ছাড়বে না।”
সকালের কোমল আলো আস্তে আস্তে উজ্জ্বল হতে শুরু করেছে। তবু দীপ হঠাৎ করে চোখে ঘোলা দেখতে শুরু করে। মনে হয় কিছু একটা লেগেছে। চোখ যেন কোটরে ডুবে যাচ্ছে। সকালের প্রশান্তি-মাখা সুখ যেন মুহূর্তেই বিলীন হয়ে গেছে। প্রচণ্ড একটা অবসাদ গিলে খেতে চাইছে। বাড়ি যাওয়া দরকার। কিন্তু বাড়ি গেলে কি ঘোলা চোখ ভাল হবে? দীপ চোখ বুজতে চেষ্টা করে আহত চোখকে সামান্য বিশ্রাম দেয়ার আশায়। সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের তীব্র আলো তার চোখের পাতাকে প্রকম্পিত করে তুলে। হুঁশ ফিরে পায় দীপ। দেরী না করে আলোর কণাদের জন্য চোখের পাতার বদ্ধ কপাট পুরোপুরি খুলে দেয়। হাঁস-ফাঁস করতে থাকা চোখ যেন এতক্ষণে প্রাণ ফিরে পায় আলোর কণাদের এত কাছে পেয়ে।
একটা ভিন্ন গোছের লেখা পড়লাম।তবে মনে হয় দ্বীপের কষ্টটাকে আর একটু গভীর ভাবে ফুটিয়ে তুললে আর একটু প্রান্জল হত।সার্বিকভাবে বেশ ভাল লাগল।
@অভ্র ব্যাণার্জী,
অনেক ধন্যবাদ, আপনাকে! আমাদের আশে-পাশের মানুষের মাঝে (যাদের মাঝে আবার আমাদের প্রিয়জনও রয়েছে) হর-হামেশাই যে চরম বৈপরীত্য লক্ষ্য করি আমরা, তারই কিছুটা তুলে আনার চেষ্টা করেছি এই লেখায়। এমন অনেকেই রয়েছেন যারা জগতের অমোঘ আকর্ষণগুলোকে উপেক্ষা করতে পারে না; কিন্তু রক্ষণশীলতার কঠিন শৃঙ্খলে আস্টে-পৃষ্টে বাঁধা থাকাতে সেগুলিকে দু’হাত বাড়িয়ে গ্রহণও করতে পারে না। ফলাফল হিসাবে আমরা পাই এহসানের মত অদ্ভুত এবং বিসদৃশ মানসিকতার তরুণ।
গভীর ভাব প্রাঞ্জল-ভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য ভাষার উপর যতখানি দখল থাকা প্রয়োজন, তা সত্যি আমার নেই। আপনাদের আশীর্বাদ আর অনুপ্রেরণা পেলে নিশ্চয়ই আরও ভাল লিখতে পারব!