আবুল কাশেম

[রচনাটি এম, এ, খানের ইংরেজি বই থেকে অনুবাদিত “জিহাদঃ জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণ, সাম্রাজ্যবাদ ও ক্রীতদাসত্বের উত্তরাধিকার” গ্রন্থের ‘ইসলামি ক্রীতদাসত্ব’ অধ্যায়ের অংশ এবং লেখক ও ব-দ্বীপ প্রকাশনের অনুমতিক্রমে প্রকাশিত হলো।]

ইসলামি ক্রীতদাসত্ব, খণ্ড ৬

লেখক: এম, এ, খান

ক্রীতদাসদের সামাজিক মর্যাদা ও অবস্থান

ইবনে ওয়ারাকের মতে:

ইসলামের অধীনে ক্রীতদাসদের আইনগত কোনোই অধিকার নেই; তারা কেবল একটা ‘বস্তু’ হিসেবে বিবেচিত − তাদের প্রভুদের সম্পদ, যা তারা খেয়াল-খুশিমতো ব্যবহার করতে বা ফেলে দিতে পারে − বিক্রি কিংবা উপহার হিসেবে ইত্যাদি। ক্রীতদাসরা অভিভাবক বা আদালতে সাক্ষী হতে পারে না, এবং তারা যা আয় করবে তা হবে প্রভুর। অমুসলিম ক্রীতদাসদের ইসলামে ধর্মান্তরণও তাকে সরাসরি মুক্ত করবে না। মালিকের জন্য কোনো নারী বা পুরুষ ক্রীতদাসকে মুক্ত করে দেওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।[৯৩]

নিচে দেখা যাবে যে, শরীয়া আইনে ক্রীতদাসরা সাধারণ সম্পদ ও পণ্যের মধ্যে তালিকাভুক্ত এবং তাদেরকে বিক্রির জন্য বাণিজ্য-আইন ধারার নিয়ম-কানুন ও নির্দেশনা। ক্রীতদাসকে কেনার পর ক্রেতা-মালিক তার মধ্যে কোনোরকম খুঁত খুঁজে পেলে সে মালিক তাকে প্রহার করতে পারে, শরীরে দৃশ্যমান কোনো ক্ষত অথবা দাগ সৃষ্টি না করে। ‘ফতোয়া-ই আলমগীরি’ মোতবেক, প্রহার ও নির্যাতনের পর ক্রীতদাসের শরীরে যদি কোনো স্থায়ী দাগ না পড়ে, তাহলে ক্রেতা-মালিক পূর্ণ ক্ষতিপূরণসহ সে ক্রীতদাসকে বিক্রেতার কাছে ফেরত দিতে পারে। দ্বাদশ শতাব্দে রচিত হানাফী আইনের সারসংক্ষেপ ‘হেদাইয়াহ্’ গ্রন্থটি আমাদেরকে তথ্য দেয় যে, মুসলিম সমাজে ‘চুরির দায়ে ক্রীতদাসদের অঙ্গ-প্রতঙ্গ ব্যবচ্ছেদ করা আইন দ্বারা স্বীকৃত একটি সাধারণ নিয়ম ছিল।’ ইসলাম যদিও ক্রীতদাসদের প্রতি ভাল আচরণ করার কথা বলেছে, তবুও মালিক তার ক্রীতদাসকে হত্যা করলে সেটা ইসলামে স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে বিবেচিত।[৯৪]

অবিশ্বাসীদের উপর দখলকারী আক্রমণগুলোতে মুসলিম ধর্মযোদ্ধারা প্রায়শই অস্ত্রবহনে সক্ষম বয়সী সকল পুরুষ-বন্দিকে হত্যা করেছে (কেননা তারা পুনরায় সংগঠিত হয়ে হুমকি সৃষ্টি করতে পারতো) এবং ক্রীতদাস বানিয়েছে সকল নারী-শিশুকে, যাদেরকে স্বাভাবিকভাবেই ইসলাম গ্রহণ করতে হয়েছে। বন্দিদেরকে হত্যা সম্পর্কে হেদাইয়াহ্ বলেছে: ‘বন্দিদেরকে হত্যার ক্ষেত্রে ইমামের (শাসকের) ইচ্ছার স্বাধীনতা রয়েছে, কেননা নবি বন্দিদেরকে হত্যা করতেন, এবং তাদেরকে হত্যা তাদের অপকর্ম বা পাপের সমাপ্তি ঘটায়।’ হেদাইয়াহ্ বলে যে, নারী ও শিশু বন্দিরা, যারা কোনো হুমকি নয়, তাদেরকে সাধারণত ক্রীতদাস করা হবে, ‘কেননা তাদেরকে ক্রীতদাসকরণ (ইসলামে ধর্মান্তরের জন্যে) তাদের অপকর্মের সুযোগ নিরাময় করে এবং সে সাথে মুসলিমরা একটা সুবিধা অর্জন করে (তাদের শ্রম শোষণ ও মুসলিম সংখ্যা বৃদ্ধিকরণের মাধ্যমে)’।[৯৫] বিখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ ইবনে খালদুন (মৃত্যু ১৪০৬), যিনি অনেক পশ্চিমা পণ্ডিতদের দ্বারাও উচ্চ প্রশংসিত,[৯৬] তিনি মুসলিম বিশ্বে চলমান ক্রীতদাসকরণ পেশাকে ধর্মীয় গৌরবের সাথে বর্ণনা করতঃ লিখেছেন: ‘(বন্দিদেরকে) ‘যুদ্ধের ঘর’ (অমুসলিম বিশ্ব) থেকে ‘ইসলামের ঘর’-এ (মুসলিম বিশ্বে) এনে দাসপ্রথা আইনের অধীনে রাখা হয়, যা স্বর্গীয় তত্ত্বাবধানের মধ্যেই নিহিত; দাসকরণের মাধ্যমে আরোগ্যলাভ করে তারা অত্যন্ত দৃঢ়সংকল্প পাকা বিশ্বাসী হয়ে মুসলিম ধর্মে প্রবেশ করে।’[৯৭] ১১৯৪ সালে বখতিয়ার খিলজির কল (আলিগড়) বিধ্বস্ত করার সময় বন্দিদের মধ্যে যারা ‘জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান’ ছিল, তারা ধর্মান্তরিত হয়; কিন্তু যারা স্বধর্ম আঁকড়ে থাকে, তাদেরকে হত্যা করা হয় (পূর্বে উল্লেখিত)। এখানে তাদেরকে ‘জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান’ বলা হয়েছে, যারা তরবারির ভয়ে দ্রুত ইসলাম গ্রহণ করে ক্রীতদাসত্ব বরণ করে নিয়েছিল। ‘হেদাইয়াহ্’ বলে যে, কোনো যুদ্ধ-বন্দি যদি মুসলিম হয়ে যায়, তথাপি ‘তিনি (ইমাম বা শাসক) তাকে আইনসঙ্গতভাবেই ক্রীতদাস বানাতে পারেন, কেননা ক্রীতদাসকরণের কারণ (অর্থাৎ তার অবিশ্বাসী হওয়া) তাদের ইসলাম গ্রহণের পূর্বে বিদ্যমান ছিল (যুদ্ধ-বন্দি তথা ক্রীতদাস হওয়ার মাধ্যমে)। আটক হওয়ার পূর্বে কোনো অবিশ্বাসী মুসলিম হয়ে গেলে সেটা ভিন্ন ব্যাপার (অর্থাৎ তাকে ক্রীতদাস করা যাবেনা)।’[৯৮]

[আগামী পর্বে আলোচিত হবেঃ ক্রীতদাসদের দুঃখ-দুর্দশা ও ভোগান্তি]
সূত্রঃ

93. Ibn Warraq, p. 203

94. Lal (1994), p. 148

95. Hughes TP (1998) Dictionary of Islam, Adam Publishers and Distributors, New Delhi, p. 597

96. British historian Toynbee termed his Muqaddimah as “undoubtedly the greatest work of its kind that has ever been created by any mind in time or place”. Bernard Lewis in his The Arabs in History called him “the greatest historian of the Arabs and perhaps the greatest historical thinker of the Middle Ages.”
97. Lal (1994), p. 41

98. Hughes, p. 597

ইসলামি ক্রীতদাসত্ব, খণ্ড ৭

লেখক: এম, এ, খান

[রচনাটি এম, এ, খানের ইংরেজি বই থেকে অনুবাদিত “জিহাদঃ জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণ, সাম্রাজ্যবাদ ও ক্রীতদাসত্বের উত্তরাধিকার” গ্রন্থের ‘ইসলামি ক্রীতদাসত্ব’ অধ্যায়ের অংশ এবং লেখক ও ব-দ্বীপ প্রকাশনের অনুমতিক্রমে প্রকাশিত হলো।]

ক্রীতদাসদের দুঃখ-দুর্দশা ও ভোগান্তি

অন্যথায় মর্যাদা-সম্পন্ন স্বাধীন মানুষকে গৃহপালিত পশুর মত বোবা-কালা জন্তুতে পরিণত করা নিঃসন্দেহে বড় ধরনের মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক যন্ত্রণা, যা তার মর্যাদা ও আত্ম-সম্মান বোধও হরণ করে। তদুপরি মুসলিম বন্দিকারীরা সাধারণত বন্দিদেরকে প্রকাশ্যে চৌরাস্তার মোড়ে কুচকাওয়াজ করানোর মাধ্যমে উপহাস, বিদ্রূপ ও অমর্যাদার পাত্র বানাতো। উদাহরণস্বরূপ, সুলতান মাহমুদ কাবুলের হিন্দু রাজা জয়পালকে ক্রীতদাস করে গজনীতে নিয়ে যান এবং জনসমক্ষে তাঁকে চরম অসম্মানিত করেন। ক্রীতদাস বাজারে যেখানে তাঁকে সাধারণ ক্রীতদাসের মত নিলামে তোলা হয়েছিল, সেখানে তাঁকে ‘প্রকাশ্যে প্যারেড করানো হয়, যাতে তাঁর বন্দি সন্তান ও পরাজিত সেনাধ্যক্ষরা এ রকম লজ্জাজনক, বন্দি ও অমর্যাদাকর অবস্থায় তাঁকে দেখতে পায়; সাধারণ ক্রীতদাসের সঙ্গে একত্রে মিশিয়ে তাঁকে জনসমক্ষে অমর্যাদার পাত্র করা হয়।’[৯৯] এরূপ চরম অমর্যাদায় বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুকে শ্রেয় মনে করে তিনি আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন।

ইসলামি কর্তৃত্বের শেষকাল পর্যন্তও সর্বত্র ক্রীতদাসদের একইরকম, এমনকি তার চেয়েও খারাপ, ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে। মরক্কোর সুলতান মৌলে ইসমাইল (মৃত্যু ১৭৭২)-এর শাসনকালের শেষ দিকে সমুদ্রপথে ধৃত বাণিজ্যযাত্রী শ্বেতাঙ্গ বন্দিদেরকে উপকূলে ভেড়ার পর শিকল দিয়ে বাঁধা অবস্থায় উৎসব করে শহর ও রাজধানীর পথে পথে ঘুরানো হতো। তাদেরকে অভিশাপ দিতে ও উপহাস করতে বিপুল সংখ্যক অভব্য ও অভদ্র জনতা এসে জমা হতো, যারা তাদের সঙ্গে সর্ব প্রকারের অমর্যাদাকর ও শত্রুতামূলক আচরণ করতো। এক জাহাজে ধরা পড়া ইংরেজ বন্দি জর্জ এলিয়ট জানায়: যখন তাদেরকে তীরে নেয়া হয়, তখন ‘কয়েক শ’ অলস ও বদমাস প্রকৃতির লোক এবং অসভ্য তরুণরা’ তাকে ও তার সহকর্মীদেরকে চারিদিক থেকে ঘিরে ধরে অসভ্য গালাগাল করে এবং তাদেরকে ‘নগরীর বিভিন্ন রাস্তায় ভেড়ার পালের মতো ঘুরানো হয়।’[১০০]

তবে ক্রীতদাসদেরকে সবচেয়ে অসহনীয় যে যন্ত্রণা ভোগ করতে হতো, তা ছিল শারীরিক: যেমন শারীরিক কষ্ট, ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও রোগ ইত্যাদি। আটক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শারীরিক নির্যাতন ও কষ্ট শুরু হতো, যা চলতে থাকতো গন্তব্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত। গন্তব্য কখনো কখনো হাজার হাজার মাইল দূরের বিদেশী ভূখণ্ডে অবস্থিত ছিল, যেখানে তাদেরকে পশু-পালের মতো দুর্গম পথঘাট পাড়ি দিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো। সর্বশেষ মালিকের কাছে বিক্রি না হওয়া পর্যন্ত বন্দিদেরকে শৃঙ্খলে বাঁধা অবস্থায় রাখা হতো। কখনো কখনো একজন ক্রীতদাসের ২০ বার দাস-ব্যবসায়ীদের মধ্যে হাত-বদল হতো।

কীভাবে ক্রীতদাসদের দীর্ঘ ভ্রমণ শুরু হতো তার একটা দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় সুলতান মাহমুদ কর্তৃক রাজা জয়পালকে পরাজিত ও ক্রীতদাসকরণের বর্ণনা থেকে। আল-উতবি জানান: ‘তাঁর (জয়পালের) সন্তান ও নাতিপুতি, তাঁর ভাতিজা ও গোত্রের প্রধানবর্গ এবং তাঁর আত্মীয়-স্বজনদেরকে আটক করে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা হয় এবং সুলতানের সামনে দিয়ে তাদেরকে সাধারণ অপরাধীদের মতো নিয়ে যাওয়া হয়… তাদের কারো কারো হাত পিছনে শক্ত করে বাঁধা ছিল, কাউকে গলা-টিপে ধরা হয়, কাউকে গলায় ধাক্কা দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়।’[১০১]

স্মরণ রাখতে হবে যে, সুলতান মাহমুদ কখনো কখনো মাসের পর মাস ভারত থেকে পথিমধ্যে লাখ লাখ ক্রীতদাস আটক করতেন। এসব ক্রীতদাসকে একত্রে বেঁধে ভীষণ অসুবিধাজনক ও নিদারুণ যন্ত্রণাদায়ক অবস্থায় রাজধানী গজনীতে গরু-ছাগলের মতো তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হতো। ভারতের অভ্যন্তরভাগ থেকে গজনী শত-শত হাজার-হাজার মাইল দূরে অবস্থিত। আর সেসব ক্রীতদাসের অধিকাংশই ছিল দুর্বল নারী ও শিশু; অথচ তাদেরকে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষার মধ্য দিয়ে পাহাড়ি এবরো-থেবরো উঁচুনিচু দুর্গম পথ-জঙ্গল পাড়ি দিয়ে মাসের পর মাস পায়ে হেঁটে যেতে হতো। তিমুরের ভারত অভিযানের স্থায়ীত্বকাল ছিল চার-পাঁচ মাস (সেপ্টেম্বর ১৩৯৮-জানুয়ারি ১৩৯৯)। দিল্লিতে পৌঁছানোর পূর্বেই পথিমধ্যে তিনি ১০০,০০০ ক্রীতদাস সংগ্রহ করেছিলেন তার মধ্য-এশীয় রাজধানী সমরখন্দে নিয়ে যাওয়ার জন্য। দিল্লি থেকে ফেরার পথে তিনি আরো ২০ থেকে ২৫ লাখ ক্রীতদাসকে আটক করে হাজার হাজার মাইল দূরে অবস্থিত সমরখন্দে নিয়ে যান।

বন্দি ক্রীতদাসরা যে কী চরম অসহনীয় শারীরিক নিষ্পেষণ, যন্ত্রণা ও দুর্ভোগের শিকার হতো, এসব দৃষ্টান্ত তার জ্বলন্ত প্রমাণ দেয়। যারা শারীরিক দুর্বলতা বা অক্ষমতার কারণে সবার সাথে তাল মিলিয়ে এগুতে ব্যর্থ হয়েছে, তাদেরকে তাল রেখে হাঁটার জন্য অমানবিক ও নিষ্ঠুর প্রহারের শিকার হতে হয়েছে। এমন বিপুল সংখ্যক লোকের জন্য হাজার হাজার মাইলের নিদারুণ দুর্গম পথে যথেষ্ট খাবার ও পানীয়ের নিরাপত্তা খুব কমই ছিল। যারা অসুস্থ হয়ে পড়তো, নিশ্চয়ই তাদের জন্য কোনো চিকিৎসা বা সেবা-শুশ্রুষার ব্যবস্থা ছিল না। তাদের কেউ চলতে অক্ষম হয়ে পড়লে তাকে বিরান পথ-জঙ্গলে ফেলে রেখে যাওয়া হতো, যেখানে সে একাকী রোগ-যন্ত্রণায় মারা যেত ও বন্যপ্রাণীর খোরাক হতো।

বন্দিদের দুর্ভোগের একটা সুস্পষ্ট ও পরিপূর্ণ বর্ণনা পাওয়া যায় উলুগ খান বলবন কর্তৃক রাজস্থানের জালরের রাজা কনহরদেবকে আক্রমণের এক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে। সে আক্রমণে আটককৃত বিপুল সংখ্যক নারী-পুরুষকে বেঁধে গাদাগাদি করে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্ধৃতি দিয়ে পঞ্চদশ শতকের ভারতীয় লেখক প্রবন্ধা লিখেছেন: ‘‘(বালুকাময় রাজস্থান মরুভূমির মাঝে) মাথার উপর আচ্ছাদনহীন অবস্থায় দিনের বেলায় তারা প্রচণ্ড সূর্যতাপ সহ্য করে, আর রাত্রিকালে ভোগ করে খোলা আকাশের নিচে হাড়-কাঁপানো শীত। বাড়িঘর ও মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে আনা শিশুরা দুঃসহ দুরবস্থায় কাঁদতে থাকে। ইতিমধ্যে পিপাসা ও ক্ষুধার যন্ত্রণায়, এ অবস্থা তাদের কষ্ট-দুর্দশা বাড়িয়ে দেয়। কোনো কোনো বন্দি অসুস্থ, কেউ কেউ উঠতে-বসতে অপারগ। কারো কারো পায়ে জুতা নেই, না আছে পরার মতো কাপড়-চোপড়।” তিনি আরো লিখেছেন: ‘‘কারো পায়ে লোহার বেড়ি বা শিকল পরানো। প্রত্যেককে স্বজন-পরিজন থেকে আলাদা করে চামড়ার ফিতা দিয়ে বেঁধে গাদাগাদি করে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। শিশুদেরকে পিতা-মাতা থেকে, স্ত্রীদেরকে স্বামীদের থেকে, বিচ্ছিন্ন করেছে সর্বনাশা এ নিষ্ঠুর হামলা। শিশু ও বয়স্ক সবাই কষ্ট-যন্ত্রণায় প্রচণ্ডভাবে আর্তচীৎকার করে উঠে শিবিরের সে অংশ থেকে যেখানে তাদেরকে গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে। তারা ক্রন্দন ও বিলাপ করছিল, তখনো এ আশায় যে, কোনো অলৌকিক শক্তি হয়তো তাদেরকে রক্ষা করবে।’’[১০২]

এটা কেবলমাত্র প্রথম কয়েকদিনের দুর্ভোগের চিত্র। পাঠকদের অনুমান করতে অসুবিধা হবে না যে, ক্রীতদাসদেরকে মাসের পর মাস ধরে হাজার হাজার মাইল অতিক্রম করে সুলতান মাহমুদ, মোহাম্মদ গোরী ও আমির তিমুরের বিদেশী রাজধানীতে পৌঁছাতে কী অবর্ণনীয়, দুঃসহ ও ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা ও দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের ক্ষেত্রেও কষ্ট-যন্ত্রনা ভোগের একই বা আরো দুর্বহ চিত্র পাওয়া যায়। তাদেরকে মধ্যপ্রাচ্যের, এমনকি ভারতের, বাজারগুলোতে দীর্ঘতর পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছাতে যে ভয়ানক কষ্টের শিকার হতে হয়েছে, তা ভাষা দিয়ে বোঝানো অসম্ভব! বার্বার মুসলিম জলদস্যুদের হাতে ধরা পড়া ইউরোপীয় বন্দিদেরকে যে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হতো, তা আফ্রিকায় আটককৃত কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের প্রতি ভয়াবহ আচরণ ও দুর্ভোগের একটা ধারণা দিবে।

[আগামী পর্বে আলোচিত হবেঃ উত্তর আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ ক্রীতদাসদের ভোগান্তি]

সূত্রঃ

99. Lal (1994), p. 22

100. Milton, p. 65-66

101. Lal (1994), p. 22

102. Ibid, p. 54-55
————–
ইসলামে র্বরতা (দাসত্ব অধ্যায় ১)

ইসলামে বর্বরতা দাসত্ব অধ্যায় ২)

ইসলামে র্বরতা (দাসত্ব অধ্যায় ৩)

ইসলামে র্বরতা (দাসত্ব অধ্যায় ৪)

————–