ঈদিপাসের গল্প আমরা সবাই জানি। সফোক্লিস এর এই নাটকটিকে অনেকে ট্র্যাজেডির আদর্শ বহিপ্রকাশ বলে মনে করেন। ‘ঈদিপাস কমপ্লেক্স’ বলে একটি মনোবৈজ্ঞানিক টার্ম ও বহুল আলোচিত। যাই হোক আজকের বিষয় ঈদিপাস কমপ্লেক্স নয়। বরং ঈদিপাসের ট্র্যাজিক ফ্ল নিয়ে। এরিস্টটলের ‘পোয়েটিক্স’ এর কল্যাণে ট্র্যাজিক ফ্ল এবং ট্র্যাজেডির নির্মাণে এর ভূমিকার কথা আমরা জানি। তবু বলছি—ট্র্যাজেডির নায়ক একজন অতিকায় চরিত্র, সাধারন মানুষের চেয়ে তার উচ্চতা অনেক বেশি। যেমন- একিলিস বা হ্যামলেট বা সিরাজ-উদ-দৌলা। কিন্তু তার চরিত্রের বিশালতার মাঝে একটি ছোট্ট খুত থেকে যায় যা তার পতনে ভূমিকা রাখে, উদাহরণ- একিলিসের পায়ের গোড়ালি, হ্যামলেট এর অস্থির চিত্ততা বা সিরাজ-উদ-দৌলার অতি বিশ্বাস- বংগবন্ধুকেও এই কাতারে রাখতে পারেন। একটি অপুর্ণতার কারনে একজন বড় মাপের মানুষের পতন আমাদের ভারাক্রান্ত করে—তাতেই ট্র্যাজেডির পূর্ণতা। তবে সবকিছুর আগে ঈদিপাসের জানা গল্পটি আরেকটু ঝালাই করে নেয়া যাক।

থিবীর আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা। পুরো নগরীর উপর নেমে এসেছে মড়ক ও দূর্ভিক্ষ। নগরবাসি হাজির হয়েছে তাদের প্রিয় রাজা ঈদিপাসের দরবারে। তারা আশা করছে তাদের শক্তিমান প্রজা বতসল রাজা এর প্রতিকার করবেন। আর হবে নাই বা কেন? ঈদিপাসতো সেই রাজা যিনি পূর্বে থিবীকে রক্ষা করেছিলেন স্ফিংস এর ভয়াল থাবা থেকে। যে স্ফিংস থিবীকে জিম্মি করে রেখেছিল এবং বলেছিল তার তিনটি প্রশ্নের উত্তর দিলেই সে চলে যাবে। ঈদিপাস সেদিন তিনটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থিবীকে রক্ষা করেছিল। ঈদিপাসের আগে থিবীর রাজা ছিলেন লাঊস। যিনি নিহত হয়েছিলেন পথিমধ্যে এক পথচারীর হাতে। তখন এই যুবক ঈদিপাসই এসেছিল থিবীর রক্ষাকারি হিসাবে। থিবীকে রক্ষা করার পুরস্কার ও দিয়েছিল জনতা। ঈদিপাসকেই নতুন রাজা বানানো হল আর পূর্ব-রাজা লাউসের মহিষী জোকাস্টা হল ঈদিপাসের স্ত্রী। ঈদিপাস সুখেই রাজ্য চালনা করছিল।

কিন্তু হায়! সেই সুখের রাজ্যে দুখের আগুন। মড়ক ও দুর্ভিক্ষ। কিন্তু কেন? ডাকা হল ত্রিকালদর্শি পন্ডিত টাইরেসিয়াস কে। সমস্যার কারন দেখে টাইরেসিয়াস হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেন। তিনি রাজাকে বার বার বলতে লাগলেন- যে এক গভীর পাপ এই রাজ্যকে জড়িয়ে আছে। এবং সেই পাপে রাজা এবং রানী স্বয়ং জড়িত!! কি সেই পাপ? রাজ্যের পিতা ঈদিপাস, রাজ্যের যিনি রক্ষাকর্তা, যিনি এত প্রজা বৎসল, যিনি পিতার স্নেহে সবাইকে দেখেন- তার কি এমন পাপ থাকতে পারে? কিন্তু আবার দৈববাণী তো মিথ্যে হতে পারে না।

কিন্তু টাইরেসিয়াস কিছুতেই খুলে বলছেনা প্রকৃত ঘটনা। রাজাকে বার বার নিষেধ করছে এ নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি না করতে। তাতে রাজা সেই পাপের ভার নাকি নিজেই বইতে পারবেনা। টাইরেসিয়াস যতই না করে ঈদিপাসের জেদ ততই বাড়তে থাকে যে সে সত্যকে জানবে- তাতে যদি তার অসম্মান হয়, শান্তি হানি হয় বা মৃত্যুও হয়- তবু সে সত্যকে জানবে। কারন সত্য যত নির্মমই হোক- সেটা প্রকাশিত করতেই হবে। তখন টাইরেসিয়াস বলল সেই অবিশ্বাস্য পাপের কথাটি—ঈদিপাস তার পিতার হত্যকারি এবং নিজের মায়ের সয্যাসংগী!! সবাই হতবাক- বিমুঢ়- এটা কি করে সম্ভব? ঈদিপাসতো পাশের দেশের রাজার ছেলে আর ঘুরতে ঘুরতেই এসেছিল এ দেশে। সে তো এ দেশের কাউকেই চিনত না। তার পর শুরু হল অনুসন্ধান। বেরিয়ে এল আরেক অজানা কাহিনী—

থিবীর রাজা ছিলেন লাউস। লাউস ও জোকাস্টার সন্তান ছিল ঈদিপাস। এই রাজপরিবারে ছিল এক অভিশাপ। ডেলফির মন্দিরে দৈববানী হল – লাউসের পুত্র লাউসকে হত্যা করবে। সেই ভয়ে লাউস তার আপন শিশু সন্তান ঈদিপাসকে মেরে ফেলতে চাইল। সেইমত এক রখালকে দায়িত্ব দেয়া হল ঈদিপাসকে পাহাড় থেকে ছুড়ে ফেলে হত্যা করতে। কিন্তু সেই রাখাল বালক ঈদিপাসের মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে হত্যা করতে পারল না। বরং তাকে দিয়ে এল পাশ্বর্বতী রাজার কাছে। সেই রাজা ছিলেন নিসন্তান। ঈদিপাসকে পেয়ে রাজার সন্তান আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হল। ঈদিপাসও জানল এরাই তার মাতা পিতা। কিন্তু ঈদিপাস একদিন দৈববানী শুনল যে সে তার পিতাকে হত্যা করবে। সেই ভয়ে সে রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে গেল। পথে তার দেখা হল লাউসের সংগে- তার আসল পিতা। লাউসের সাথে বিতন্ডার এক পর্যায়ে সে হত্যা করল লাউসকে- এটা না জেনেই যে লাউস ই তার আসল পিতা। ঘুরতে ঘুরতে সে এসে গেল তার পিতার রাজ্য থিবীতে। স্ফিংসের ধাধার উত্তর দিয়ে সে থিবীবাসীর মন জয় করল সেই সাথে হল থিবীর রাজা। তার মা, জোকাস্টা হল তার পত্নী।

এই নির্মম সত্য জেনে ঈদিপাস প্রায় পাগলপ্রায়। নিজের হাতে নিজের চোখ দুটো সে উপড়ে ফেলল তার পর সব ত্যাগ করে চলে গেল রাজ্য ছেড়ে।

ঈদিপাসের গল্প শেষ। এবার দেখি তার ট্র্যাজিক ফ্ল কোথায়। সেই যে সত্যকে জানার প্রচেষ্টা—নিজের শান্তিহানি বা মৃত্যুর সম্ভাবনা জেনেও যে সে সত্যকে উদঘাটন করতে চায়—সেই চাওয়াটাই তার কাল হল। সত্য অনুসন্ধান অনেকসময় সুখকর বা স্বস্তিকর নাও হতে পারে। কিন্তু সত্য অনুসন্ধানই মানুষের নিয়তি- এভরিম্যান ইজ ঈদিপাস।

ধর্ম আমাদের একটি নিশ্চিত জীবনের – স্বাশ্বত সময়ের নিরাপদ গল্প দিতে পারে। কিন্তু সত্য অনুসন্ধানে সেই শ্বাস্বত জগত ভেঙ্গে পড়তে পারে। বেরিয়ে আসতে পারে যে স্বর্গ-নরক- হুর পরি – এসব রূপকথা- মানুষের কল্পনা বা অজানা জগতের মিথিক্যাল ব্যখ্যা। এই অস্বস্তিকর সত্যটি আসতে পারে জেনেও মানুষ ঈশ্বর নামক একটি মিথকে বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে পারেনা যদি না সেটির দাবীদাররা তাকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারে। সত্যের এই অনুসন্ধানই মানুষকে নিয়ে যায় মিথিক্যাল জগতের বাইরে- জ্ঞানের জগতে এবং এই প্রকৃয়া চলবেই কারণ- এভরিম্যান ইস ঈদিপাস।