এক বিকল্প জগতের গল্প

মীজান রহমান
এক
থিওডোর এডর্ণো (১৯০৩-১৯৬৯)নামক এক জার্মান দার্শনিক সুন্দর কথা লিখেছিলেন একজায়গায়ঃ The highest form of morality is not to feel at home in one’s own home.(নিজের ঘরেই গৃহান্তরী বোধের মত উচ্চমানের নৈতিক বোধ আর হতে পারেনা)। এডর্ণো সাহেব বিশিষ্ট দার্শনিকই ছিলেন না কেবল, একই সঙ্গে ছিলেন সমাজবিজ্ঞানী ও সঙ্গীতবিশারদ। তাঁর মত গুণি লোকের চিন্তাজগতে এমন একটি আলোকিত ভাবনা উদয় হওয়া মোটেও বিচিত্র নয়।
আসলে উদ্ধৃতিটি আমি এডর্ণোর লেখা থেকে সংগ্রহ করেছি তা নয়। সম্প্রতি “Reading Lolita in Tehran” নামক একটা বই পড়লাম—এটি সেখান থেকে তোলা। বইটা লিখেছেন আজার নাফিসি বলে এক ইরাণী অধ্যাপক। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য পড়ান। আধুনিক ইংরেজি উপন্যাসের ওপর বিস্তর পড়াশুনা তাঁর—ওতেই তাঁর বিশেষত্ব। তাঁর প্রিয় লেখকদের মধ্যে প্রথমেই আসে নোবেল বিজয়ী রুশ-মার্কিন ঔপন্যাসিক ভ্লাডিমির নাবুকফের (১৮৯৯-১৯৭৭)নাম। তারপর আসে এ ফ স্কট ফিট্সেরাল্ড, এমিলি ও শার্লট ব্রন্টি, হেনরি জেম্স্, সল বেলো, মার্গারেট এটউড, প্রমুখেরা। এঁদের সবার কাজ নিয়েই অল্পবিস্তর আলোচনা আছে বইটিতে। যদিও, আলোচনার সিংহভাগ দখল করেছেন নাবুকভ—সম্ভবত তাঁর রচনাভঙ্গীর সঙ্গেই লেখিকার নিজের মনের মিল সবচেয়ে বেশি। নাবুকভ মূলত রাশিয়ান হলেও ইংরেজীর ওপর তাঁর ছিল অসামান্য দখল, তার তুলনা কেবল সেক্সপীয়ার আর চার্চিলের মত কালোত্তর যুগস্রষ্টাদের সঙ্গেই চলে। ইংরেজী ভাষায় তাঁর অনবদ্য গদ্যশৈলী কিংবদন্তীয় রূপ ধারণ করেছিল তাঁর জীবনকালেই। তাঁর কলমের ছোঁয়া্য শব্দেরা জীবন্ত হয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই যেন কলকাকলিতে মুখর হয়ে ওঠে, প্রমত্ত ছন্দে উত্তাল হয়।একরকম অলৌকিক যাদুকরি খেলায় মেতে ওঠে তারা, এমনই মোহিনী শক্তি তাঁর লেখনীতে। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত বই ‘ললিতা’।১৯৫৫ সালে বইটা বের হবার পর সারা পৃথিবীজোড়া সাড়া পড়ে যায়। পাঠকমহলে খবর ছড়ায় দাবাগ্নির মত। সাধারণ পাঠকদের জন্যে এর বড় আবেদন সাহিত্যগুণ আর ভাষাশৈলী যতটা তার চাইতে বেশি হয়ত ছিল এর বিষয়বস্তু—কুহকিনী কিশোরী, যার অর্ধনগ্ন শরীরের ভাঁজে ভাঁজে নবযৌবনের পূর্ণপুষ্ট যৌনতার মুকুলিত প্রতিভাস, এবং অদূরে নীল পর্দার অন্তরালে তার প্রৌঢ় বিপিতার তৃষিত দৃষ্টি—সব মিলিয়ে আমার এবং আমার সমবয়স্ক যুবকদের ক্ষুধার্ত প্রাণে দারুণ শিহরণ সঞ্চার করেছিল তখন। আমরা গোগ্রাসে গিলেছিলাম বইটা। গল্পের বাইরের খোলসটি এমন ছিল যে মনে হত যৌবনোছ্বাসের প্রবল জোয়ারে প্রবাহিত এক কামাক্ষী রূপসী তার মায়ের স্বামীকে চোখের ভাষাতে হাতছানি দিয়ে তাকে উত্তপ্ত ও উদ্ভ্রান্ত করে তুলছে। কিন্তু বোদ্ধা পাঠক জানতেন যে ভেতরের ছবিটা ঠিক তার বিপরীত। একটি অল্পবয়স্ক নিষ্পাপ জলপরীকে, শুধুমাত্র তার অকালপূর্ণতাপ্রাপ্ত দেহসৌষ্ঠবের অপরাধে, নির্মমভাবে, লোভাতুর কামাতুর চোখ দিয়ে, ভোগের লালায়িত লিপ্সা দিয়ে, নিরন্তর বলাৎকার করে যাচ্ছেন এক প্রবীন পুরুষ—তার নিজেরই বিপিতা, যার অভিভাবকত্ত্বের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিল তার নিরাপত্তা। চিরকালের শিকারী পুরুষ, তার নগ্ন ভোগাকাঙ্খা চরিতার্থ করবার জন্যে নানারকম নীতিবাক্য উদ্ভাবন করে পাঠককে তার পক্ষে দাঁড় করিয়ে নারীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেবার আয়োজন করেছেন, এবং বহুলাংশে সক্ষমও হয়েছে্ন—অন্তত সাধারণ পাঠকদের বেলায়। আজার নাফিসি তাঁর ‘ললিতা’ বইটিতে এই মর্মবাণীটিকেই নানাদিক থেকে বিশ্লেষণ করে তাঁর ছাত্র-ছাত্রী আর পাঠকদের সামনে দাঁড় করাবার চেষ্টা করেছেন। শুধু এই বইটিই ছিলনা তাঁর আলোচ্য বিষয়। স্কট ফিটসেলাল্ডের ‘গ্রেট গ্যাটসবি’, নাবুকভের প্রতীকি উপন্যাস ‘Invitation to a Beheading’, জেইন অস্টিনের ‘Pride and Prejudice’, হেনরি জেইমসের একাধিক গ্রন্থ—এগুলোর ওপরও বিস্তর আলোচনা আছে এতে। আধুনিক উপন্যাস বলতে কি বোঝায় সেটা তাঁর বক্তব্যের ভেতর দিয়ে পরিষ্কার হয়ে ওঠে পাঠকের কাছে। শুধু তাই নয়। ভাল উপন্যাস, বিশেষ করে কালোত্তীর্ণ মহৎ উপন্যাস বলে ধরা হয় যে-কটি বইকে, ওগুলো পাঠককে কেন এত আকুল করে, কেন যুগ যুগ ধরে তার মনকে আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে থাকে, সেটাও বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
কিন্তু আমার আলোচ্য বিষয় আজকে ঠিক তা নয়। নাফিসির দীর্ঘ আলোচনাতে অত্যন্ত নগ্ন স্পষ্টতায় যে-জিনিসটা উঠে এসেছে, অন্তত তাঁর নিজস্ব আধুনিক ও মুক্তমনা দৃষ্টিতে, সেটা হল ইরাণের উত্তর-বিপ্লব সমাজটির কথা যা আমরা নিত্যনিয়ত শুনে থাকি, পড়ে থাকি পত্রপত্রিকায়, বেতার আর দূরদর্শনে, তারই একটি প্রত্যক্ষ ও ব্যক্তিগত মূল্যায়ন। এর সবকটি বর্ণে বর্ণে সত্য কিনা সেটা যাচাই করবার কোনও বস্তুনিষ্ঠ পন্থা নেই আমার, কিন্তু এগুলোর বেশির ভাগই যুক্তিসঙ্গত এবং বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়েছে ।অন্ত আমার দৃষ্টিতে।
দুই

তেহরানের এক উচ্চশিক্ষিত বনেদী পরিবারে আজার নাফিসির জন্ম, ১৯৪৭ সালে। জ্ঞানবিজ্ঞানের সাধনা এবং উন্নতমানের সাংস্কৃতিক জীবনযাপনই ছিল নাফিসি পরিবারের বৈশিষ্ট্য। কথিত আছে যে তাঁর বাবা যখন শাহ পহলবির শাসনকালে বছর দুয়েকের জন্যে তেহরানের মেয়র নিযুক্ত হন তখন তাঁর পরিবার এতই ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন তাঁর প্রতি যে লজ্জায় কারো কাছে সেটা প্রচার করতে চাননি। কারণ তাঁদের বিচারে মেয়র পদ গ্রহণ করে তিনি পরিবারের সুনাম নষ্ট করেছিলেন—জ্ঞানচর্চার পথ ছেড়ে তিনি সস্তা জনপ্রিয়তার জন্যে দুর্বলতা প্রকাশ করেছেন, যা তাঁদের পারিবারিক ঐতিহ্যের পরিপন্থী। আজার নাফিসির ছোটবেলার স্মৃতির মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছে তাঁর বাবা রোজ তাঁর বিছানার ধারে বসে বড় বড় কবিদের কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন, বিশেষ করে ইরাণের প্রিয় কবি ফেরদৌস আর রুমির কবিতা। দেশবিদেশের নানা বিচিত্র কাহিনী শুনিয়ে তাঁর মনে জাগিয়ে তুলতেন এক রঙ্গিন জগতের কল্পনা। তাঁর আত্মজীবনীতে মায়ের চাইতে বাবার প্রসঙ্গই ব্যক্ত হয়েছে বারবার।
নাফিসি পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যের লেখাপড়া প্রধানত পশ্চিমে। আজার নাফিসির বয়স যখন তেরো তাঁর বাবা তাঁকে বিদেশের আবাসিক স্কুলে পাঠিয়ে দেন। ছোটবেলা থেকেই তাঁর পক্ষপাতিত্ব ছিল ইংরেজী সাহিত্যের প্রতি। শেষে ইংরেজী উপন্যাসে পি এইচ ডি ডিগ্রি করেন আমেরিকার ওক্লাহোমা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক ধারা অনুযায়ী তাঁর রক্তেও বামপন্থী চিন্তাধারা ও বিদ্রোহীভাবের প্রবণতা সবসময় টগবগ করত। সেসময়কার ইরাণী যুবসমাজের মধ্যে ডঃ মোসাদ্দেক ও তাঁর সমাজতান্ত্রিক মতবাদের ব্যাপক প্রভাব—তেহর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বামপন্থী রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র (অনেকটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেমন ছিল স্বাধীনতার আগে)। ওক্লাহোমার ইরাণী ছাত্রসমাজের রাজনৈতিক উদ্যোগ-আন্দোলনে সবসময়ই সক্রিয় ভূমিকা রাখতেন নাফিসি। ষাটের দশকের আমেরিকান প্রতিবাদ-মুখরতার বাতাস থেকে মোটেও মুক্ত ছিলেন না তিনি, বরং সাগ্রহে তাকে বরণ করে নিয়েছিলেন। পশ্চিমের অন্যান্য মুক্তিকামী মেয়েদের মত তিনিও জিন পরে ক্লাসে যেতেন, চুল খাটো রাখতেন, এবং কাউকে তার পদমর্যাদার খাতিরে তোয়াজ করে কথা বলার কোনও তাগিদ বোধ করতেন না। অর্থাৎ একেবারেই লাগামবিহীন, বেপরোয়া, এবং উদ্ধতপ্রকৃতির একটি অত্যাধুনিক নারী। ‘৬০এর আমেরিকান উচ্ছৃঙ্খল সমাজচিত্রের দৃষ্টিভঙ্গীতে এগুলোর সবই স্বাভাবিক ও সাদামাঠা, কিন্তু ইরাণের মুসলিম সমাজের কঠোর বিধিনিষেধের দিক থেকে রীতিমত রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পৌঁছানোর মত দুর্বীনিত ব্যবহার, যা কোনও রক্ষণশীল সমাজে কখনোই বরদাস্ত হবার নয়।
মজার ব্যাপার যে এত উচ্ছৃঙ্খলা উন্মত্ততার মাঝেও নাফিসির মন থেকে একটা জিনিসের মায়া একমুহূর্তের জন্যে মুছে যায়নি— তাঁর দেশ। তাঁর প্রাণের দেশ—ইরা্ণ। কথায় কথায় তাঁর বিদেশী বন্ধুদের কাছে ইরাণের প্রসঙ্গ টেনে আ্নতেন। এই যে অসম্ভব সুন্দর একটি বিকেলের কোমল সূর্যের শীতল আলোতে বসে আমরা এলিয়েটের কবিতা পড়ছি, তেমনি করে আমরা ইরাণের পাহাড়ী চূড়া থেকে নেমে আসা শেষ বিকেলের লোহিত বর্ণতে গা ভাসিয়ে পড়েছি ফেরদৌস আর হাফেজের কবিতা। এই যে দেখছ ঝি্রঝির করে বয়ে চলেছে শীর্ণকায়া জলস্রোত তোমার-আমার পায়ের ধূলো নিয়ে মিসিসিপি নদীর কাছে সমর্পণ করতে, তেমনি করে আমার দেশের স্রোতেরাও আমাদের মনের কথাগুলো দূর দূর দেশের নীল জলেদের কাছে পৌঁছে দিত। অর্থাৎ আমেরিকার প্রতিটি প্রিয় দৃশ্যের মাঝে তিনি খুঁজে পেতেন স্বদেশের প্রতিচ্ছবি। যেন তাঁর দেশেরই কোনও পুরাতন দৃশ্যের অবিকল নকলমাত্র।
সময়টা তখন ১৯৭৯ সাল— শাহবিরোধী আন্দোলনে মুখর হয়ে উঠেছে সারাদেশ। গণবিপ্লবের অগ্নিমশাল চতুর্দিকে প্রজ্জ্বলিত। পরাক্রান্ত শাহ পহলবির বংশানুক্রমিক সিংহাসন গণবিক্ষোভের মুখে কম্পমান। রাজতন্ত্রের চূড়ান্ত অবসানের দাবিতে ইরাণের আবালবৃদ্ধবনিতা আমরণ সংগ্রামের জন্যে প্রস্তুত। সেই সংগ্রাম যখন অপ্রতিরোধ্য বন্যাধারার তীব্রতা অর্জন করে বিশ্ববাসীকে উচ্চকিত করে তোলে এবং নিরুপায় অবস্থা দেখে শাহ প্রাণরক্ষার জন্যে সপরিবারে পলায়ন করে ভিনদেশে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হন, তখন কন্ঠদেশে বিজয়মাল্য ধারণ করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন বিপ্লবের একচ্ছত্র নেতা মহান আয়েতুল্লা খোমাইনি। আজার নাফিসি দারুণ ভক্ত ছিলেন আয়েতুল্লার তা নয়, কোনও মোল্লাই তাঁর মত মুক্তমনা নারীর আদর্শপুরুষ হতে পারেনা। কিন্তু বিপ্লবের খাতিরে, গণতন্ত্র ও আধুনিকতার খাতিরে, সর্বোপরি দেশের সার্বিক মঙ্গলের খাতিরে সেই অস্বস্তিকর ব্যবস্থাটিকেও তিনি মেনে নিতে রাজি ছিলেন। সবকিছুর উর্ধে তাঁর দেশ, যে দেশ তাঁর সমগ্র চিন্তাচেতনাকে দখল করে ছিল অনেক অনেক কালব্যাপী। যে পরিবর্তনের স্বপ্ন বুকে ধারণ করে এতদিন ভিন দেশের ক্যাম্পাসে গলা ফাটিয়ে আন্দোলন করে এসেছেন, সেই পরিবর্তনের হাওয়া তাঁর নিজের দেশেই আজকে ঝড়ের বেগে প্রবহমান। সেই দৃশ্যপটে তাঁর উপস্থিতি এক নৈতিক কর্তব্যের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। সিদ্ধান্ত নিলেন, আর নয়। দেশে ফিরে যেতে হবে। দেশ তাঁকে ডাকছে—নতুন দিনের শুভযাত্রায় তাঁরও দেবার আছে কিছু। সে দান তাঁকে উজাড় করেই দিতে হবে। বিদেশের আয়েসী জীবনের মোহ উপেক্ষা করে তিনি ফিরে গেলেন দেশে ’৭৯ সালে—যখন তাঁর বয়স ত্রিশের ওপর। এর মাঝে নাফিসির ব্যক্তিগত জীবনে দুচারটে উল্লেখযোগ্য ঘটনা যে ঘটেনি তা নয়। আঠারো বছর বয়সের অপরিপক্ক আবেগোচ্ছ্বোসে বিয়ে করে ফেলেছিলেন একটি, যা টেকেনি দুবছরের বেশি। তারপর দ্বিতীয় বিয়ে—স্বামীর নাম বাইজান। ধীরস্থির বিচক্ষণ পুরুষ, যার বিচারবুদ্ধির ওপর ভরসা করে বিবাহিত জীবন কাটানো সম্ভব হয়েছিল তাঁর মত তেজস্বী নারীর পক্ষেও। বাইজান আগেই দেশে ফিরে গিয়েছিলেন। এবার দুজনে মিলে সংসারী জীবন শুরু করতে পারবেন সেই স্বপ্ন মনের ভেতরে লালন করে তিনি বিমান থেকে দুরুদুরু বুকে তেহরানের মাটিতে পা রাখলেন। একটা মৃদু শিহরণ তাঁর শিরা উপশিরাতে এক অপূর্ব অনুভূতি জাগিয়ে তুলল।
দেশের পরিবর্তনের খবর পত্রপত্রিকায় তিনি অনেকই পড়েছিলেন। কিন্তু স্বচক্ষে তার স্বাক্ষর দেখা ভিন্ন জিনিস। বিমানবন্দরে নামার সাথে সাথে একদিকে যেমন স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের স্বাভাবিক উত্তেজনা, অপরদিকে দেয়ালে দেয়ালে বিশালকায় মুরালের মূর্তিতে দাঁড়িয়ে থাকা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ, ভ্রূকুঞ্চিত চেহারার ইমাম খোমায়নির গা-হিম করা ভয়াল মুখচ্ছবি ততটাই বিচলিত করে তোলে তাঁকে। ইমিগ্রেশন আর শুল্কবিভাগের কর্মচারীদের চোখেমুখেও বিন্দুমাত্র হাসিখুশি বা প্রীতিভাবাপন্নতার নামগন্ধ ছিল না। কেমন দম বন্ধ করা গুমোট আবহাওয়া চতুর্দিকে। একটি মহিলা যাত্রীর প্রতি যৎসামান্য সৌজন্য প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা যে একটা আছে সেটি যেন তাদের কর্তব্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং তাঁর বাক্সপ্যাঁটরা তন্নতন্ন করে তল্লাশ করা ( তারা নাকি খুঁজছিল কোনও মাদকদ্রব্য এনেছেন কিনা সঙ্গে)থেকে একই প্রশ্ন বারবার জিজ্ঞেস করা, একাধিক অফিসারের কাছে, অর্থাৎ যতপ্রকার হয়রানি সম্ভব তার সবকটাই তাঁকে ভোগ করতে হয়েছিল। দেশের ‘পরিবর্তনের’ একটা পরিষ্কার ছবি তিনি পেয়ে গেলেন সেখানেই।
যে-মানুষের আবাল্য শিক্ষাদীক্ষা পশ্চিম বিশ্বের সেরা স্কুলকলেজে তাঁর চিন্তাভাবনাতে পাশ্চাত্য প্রভাব অন্তত কিছুটা হলেও থাকবে সেটা তো খুবই স্বাভাবিক। তাছাড়া ইংরেজী সাহিত্যের প্রতি যাদের অনুরাগ, বিশেষ করে আধুনিক ইংরেজী উপন্যাসে, তাদের মনমানসিকতার সঙ্গে কোনরকম গোঁড়ামি বা অন্ধ বিশ্বাস একেবারেই খাপ খায় না। নাফিসি পরিবার মূলত শিয়া ধর্মাবলম্বী হলেও শিয়া মতবাদের সঙ্গে আধুনিক চিন্তাধারার সংঘাত যেখানে, সেখানে তাঁরা বরং আধুনিকতাকেই সমর্থন করে এসেছেন। ধর্মনিরপেক্ষতা, এমনকি ধর্ম-ঔদাসীন্য বলতে গেলে তাঁদের পারিবারিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। আজার নাফিসি সে-সংস্কৃতির উর্বর পলিমাটির জারকরসে লালিত হয়ে মুক্তবুদ্ধির সাধনাকেই তাঁর ব্যক্তিগত ধর্মের মত করে গ্রহণ করেছেন। ইরাণের আরো অজস্র গণতন্ত্রপ্রেমিক নাগরিকের মত তিনিও শাহ পহলবির একনায়কত্ত্বের পতন কামনা করেছিলেন (তাঁর মেয়র পিতাকে শাহের শাসনকালেই জেল খাটতে হয়েছিল মিথ্যা অপবাদে), কিন্তু স্বৈরতন্ত্রের পরিবর্তে মোল্লাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক সেটাও তিনি কামনা করেননি। তবুও দেশ স্বাধীন হয়েছে, রাজতন্ত্রের নাগপাশ থেকে মুক্তি পেয়েছে ইরা্ণ, সর্বোপরি ইরাণ তাঁর জন্মভূমি, তাঁর ছোটবেলার খেলাঘর, ইরাণের নদীনালা পাহাড়পর্বত বনবনানী তাঁর রক্তধারাতে নিত্য প্রবহমান—১৭ বছর দেশের বাইরে থেকে থেকে তাঁর মন কাতর হয়ে উঠেছিল দেশের জন্যে। ডিগ্রি শেষ করে তেহরাণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগে (ঠিক ইংরেজী বিভাগ বলে আলাদা কোনও বিভাগ ছিল না যদিও; ছিল Persian and Western Languages Faculty এর একটি গুরুত্ত্বপূর্ণ শাখা হিসেবে)চাকরির দরখাস্ত পাঠানোর সাথে সাথে যখন পেয়েও গেলেন চাকরি, তখন তাঁর মনে হয়েছিল তাঁর মত ভাগ্যবান মেয়ে সারা ইরাণে কেউ নেই। তাঁর নিজের ভাষ্য অনুযায়ীঃ “ আমাকে যদি একই চাকরি সাধা হত হার্ভার্ড বা অক্সফোর্ড থেকে তাহলেও আমি ভাবতাম তেহরাণ বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি তার চেয়ে ঢের বেশি সম্মানের”। এতটাই তীব্র ছিল তাঁর দেশাত্নবোধ। তাই বিমানবন্দরের দাড়িওয়ালা কর্মচারীদের দুর্ব্যবহার এবং গোটা পরিবেশটার দমবন্ধকরা আবহাওয়া তাঁকে খানিক দমিয়ে দিলেও দেশে ফেরার উত্তেজনা তাতে এতটুকুও প্রশমিত হয়নি।
ইংরেজী বিভাগের অধ্যক্ষের অফিসে ঢোকার পূর্বমুহূর্তেই নাফিসি পেলেন এক ধাক্কা। ‘বিপ্লবের’ আগে যে-লোকটি চেয়ারম্যান ছিলেন দীর্ঘকাল শোনা গেল তিনি এখন জেল খাটছেন। কেন খাটছেন, সেটা পরিষ্কার না হলেও একটা জিনিস বুঝতে বাকি রইলনা যে শাহ আমলে যারা চাকরিবাকরি করে জীবিকা অর্জন করতেন, সরকারি বা বেসরকারি যা’ই হোক, তাদের অনেককেই পাইকারি হারে জেলে ভরা হচ্ছে, কারো কারো গলা কাটা যাচ্ছে কোনরকম কোর্টকাচারি ছাড়াই। ‘বিপ্লবী’ সরকারের বড় তাকটা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর, কারণ মোল্লাতন্ত্রের বিরোধিতা করার সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা তো সেখানেই। এটা কারুরই অজানা নয় যে দেশের প্রগতিশীল যুবসমাজের বড় আখড়া হল তেহরাণ বিশ্ববিদ্যালয়। একে বাগে আনতে পারলে বাকিটা অত শক্ত হবেনা। দেশে যত বড় বড় আন্দোলন হয়েছে তার বেশির ভাগই শুরু হয়েছে তেহরাণ বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্ত্বরে। সেখানে জ্ঞানবিজ্ঞানের মুক্ত পরিবেশে পাশ্চাত্য চিন্তাভাবনায় প্রভাবিত ছাত্রসমাজ কোনরকম বিধিনিষেধ বিনা প্রতিবাদে গ্রহণ করবে না—মেনে নেবে না তাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর কোনরকম গণ্ডীবদ্ধতা। তাই গোড়া থেকেই খোমায়নি সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে এই শয়তানকে বশ মানাতে হবে, তার ত্যাড়া ঘাড় সোজা করতে হবে। সেই উদ্দেশ্যে প্রথমেই যে উদ্যোগটি তাঁরা নিলেন সেটা হল জুম্মার নামাজ তেহরাণের অন্য কোথাও অনুষ্ঠিত না করে বিশ্ববিদ্যালয় ময়দানে করা। একই সাথে এলোপাথারি ছাঁটাই শুরু হল অধ্যাপকদের, কারো কারো মুণ্ডচ্ছেদ।
এরকম অনিশ্চয়তা এবং ভীতিকর পরিবেশে ধীরে সুস্থে ক্লাসে গিয়ে ছাত্র পড়ানো সহজ নয়। ক্যাম্পাসে তখন নিত্য কানাঘুষা—কখন কার চাকরি যায়, কাকে হাতকড়া পরে জেলে যেতে হয়, বা গায়েব হয়ে যেতে হয় চিরকালের জন্যে। তবুও, নতুন চাকরির কারণেই হোক আর সদ্য-পশ্চিম-থেকে-আসা উৎসাহ উদ্দীপনার কারণেই হোক, আজার নাফিসি আপ্রাণ চেষ্টা করলেন ক্যাম্পাসের বিষাক্ত আবহাওয়া যাতে তাঁর উদ্যমকে চুপসে না দেয়। প্রথম দিনের প্রথম ক্লাসে তিনি ঢুকলেন ঠিক যেমন করে নব-নিযুক্ত প্রফেসাররা ঢোকেন—ভেতরে ভয় বাইরে বীরত্ব প্রকাশের চেষ্টা—সোজা কথায় নার্ভাস। প্রথম দুচার মিনিট। তারপরই আজার নাফিসি ওক্লাহোমার সেই পরিচিত প্রত্যয়ী নাফিসিতে ফিরে গেলেন—সেই উচ্ছ্বাস সেই উচ্ছলতা আর প্রগলভতা সহজেই ধরা দিল তাঁর কাছে। প্রাথমিক আলাপ পরিচয়ের পর তিনি গোটা ক্লাসের কাছে এক অদ্ভূত প্রশ্ন উত্থাপন করলেন—অদ্ভূত অন্তত ইরাণী ছাত্রদের গতানুগতিক চিন্তাধারার পরিপ্রেক্ষিতে—মানুষ উপন্যাস পড়ে কেন? উপন্যাসের কি মূল্য তাদের জীবনে? সে-প্রশ্নের জবাব ওরা কেউ সঠিক দিতে পারেনি, কারণ এনিয়ে চিন্তা করতে তারা অভ্যস্ত ছিল না। নাফিসি জানতেন যে এর উত্তর কেউ দিতে পারবে না তেমন গুছিয়ে, তাই তিনি নিজেই তার জবাব তৈরি করে দিলেনঃ মানুষ উপন্যাস পড়ে নিজের ঘরে বসে অন্যত্র চলে যাওয়ার জন্যে—নিজের পরিচিত পৃথিবীতে বাস করে এক বৃহত্তর ও বিচিত্রতর পৃথিবীর কল্পনাতে বিভোর হয়ে যাবার জন্যে। উপন্যাস বাস্তবকে অবাস্তব করে, অবাস্তবকে করে বাস্তব। এই সুরেই আজার নাফিসির ইংরেজী অধ্যাপনার শুভ সূচনা। আস্তে আস্তে ছাত্রছাত্রীরা তাঁর ভক্ত হয়ে ওঠে, তাঁর অধ্যাপনাভঙ্গীর অভিনবত্ত্ব তাদের আকৃষ্ট করে। বাইরের পৃথিবীর আলোড়ন-আন্দোলন অগ্রাহ্য করে তিনি একনিবিষ্টভাবে ছাত্রপড়ানোর কাজে পুরোপুরি নিমজ্জিত হয়ে যান। অর্থাৎ যতদিন পর্যন্ত তারা সরাসরি তাঁর অধ্যাপনার কাজে বাধা সৃষ্টি করেনি। কিছুদিন করেও নি তারা—যার ফলে নাফিসির মনে হয়ত একপ্রকার ভ্রান্ত নিরাপত্তার ভাব সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু সে-নিরাপত্তা যে জোনাকির ক্ষণদ্যুতি ছাড়া কিছু নয় তা অত্যন্ত স্পষ্ট ও নগ্নভাবে প্রকাশ পেতে লাগল অচিরেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিমঘেঁষা বামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর মেরুদণ্ড ভাঙ্গবার যত উদ্যোগ আয়োজন দরকার তার কোনটাতেই বিন্দুমাত্র শৈথিল্য ছিল না সরকারের—যেন ওটাই তাদের সবচেয়ে কঠিন অগ্নিপরীক্ষা। জুম্মার নামাজ ছিল তার প্রথম পদক্ষেপ মাত্র। দ্বিতীয় পদক্ষেপ ছাত্রছাত্রীদের ওপর নানারকম বিধিনিষেধ আরোপ করা। বিশেষ করে মেয়েদের ওপর—মেয়েরাই তো যে-কোনও ধর্মরাষ্ট্রের প্রথম লক্ষ। শাহ পহলবির আমলে মেয়েদের পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল যে-কোন পোশাক পরার। মোল্লারা বললেনঃ না, তা হবে না, ইসলামী পোশাক পরতে হবে। অর্থাৎ চুল ঢাকতে হবে, নিদেনপক্ষে, হিজাব বা সেজাতীয় কোনও শিরাবরণ দ্বারা। তবে বোরখাই হল মেয়েদের শ্রেষ্ঠ পোশাক—ইসলামী প্রজাতন্ত্রের ওটাই কাম্য। মূল কথা হল ছেলেমেয়েদের মধ্যে অবাধ মেলামেশা, যা আগে ছিল, সেটা সহ্য করা হবে না। ওটা একেবারেই নিষিদ্ধ। ইসলামী তরিকা অনুযায়ী তাদের জীবনযাপন করতে হবে এখন থেকে—ওতে কোনও ছাড় দেওয়া হবে না। নাফিসির একটি মেধাবী ছাত্র ছিল ক্লাসে যার একটা প্রবন্ধ পড়ে তিনি এত মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তাকে অভিনন্দন জানাবার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন করমর্দনের জন্যে। ছেলেটা তার হাত বাড়িয়ে দেয় নি—গুটিয়ে রাখল। প্রথমে তিনি বুঝতে পারেননি কেন। এ তো রীতিমত অভদ্রতা, মনে মনে হয়ত ভাবলেন তিনি। পরে কেউ একজন তাঁকে বুঝিয়ে দিল যে নিজের স্ত্রী আর মা-বোন-খালা-ফুফু জাতীয় নিকটাত্নীয় ছাড়া কারো সঙ্গে হাত মেলানো মানা ইসলামী আইনে। কেমন একটা ধাক্কা খেলেন তিনি নিজের মনে। টের পেলেন যে তাঁর প্রাণের দেশটি সত্যি সত্যি বদলে গেছে। শাহের আমলে স্বৈরাচার ছিল বটে, কিন্তু ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর এতটা হস্তক্ষেপ আগে কখনও হয়নি।
দ্বিতীয় ধাক্কাটা খেলেন তিনি বই কিনতে গিয়ে। বিশেষ করে আধুনিক ইংরেজী সাহিত্যের বই, তাঁর প্রিয় লেখকদের লেখা বই, যা আজার নাফিসির প্রাণধারণের জন্যে পানাহারের চেয়ে কম প্রয়োজনীয় ছিল না। তেহরাণ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকটবর্তী রাস্তাগুলোতে বেশ কিছু বইয়ের দোকান ছিল—নতুন বই, পুরনো বই, দেশী বিদেশী সব জাতের বই। একদিন তাঁর পরিচিত পুস্তকবিক্রেতা তাঁকে বললেনঃ বই যদি কিনতে চান দেরি করবেন না, এখুনি কিনে ফেলুন। পরে সময় থাকবে না। কেন বলুন তো, বোকার মত প্রশ্ন করেন নাফিসি। ভদ্রলোক কাষ্ঠহাসিতে বললেনঃ বিদেশি বই, বিশেষ করে ইংরেজী সাহিত্যের বই একে একে বাজেয়াপ্ত হয়ে যাচ্ছে। সরকার ওগুলোকে অনৈতিক ও ইসলামবিরোধী পুস্তক হিসেবে গণ্য করছে। সত্যি সত্যি তাই হল। আস্তে আস্তে পশ্চিমা বইপত্র, সাময়িকী, বাজার থেকে উধাও হতে শুরু করল। আজার নাফিসির মত জ্ঞানপিপাসু মানুষ যার শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্যেই অনিবার্যভাবে প্রয়োজন অস্টেন, জেমস, ফিটসিরাল্ড আর নাবুকভের মত বড় বড় লেখকদের সৃষ্টিশীলতার সঙ্গে যোগসূত্র বজায় রাখা সর্বক্ষণ, তাঁর জন্যে এ’ও একরকম মৃত্যুদণ্ড। তাছাড়া এসব বই যদি পাওয়া না যায় বাজারে তাহলে তাঁর ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরাই বা পড়বে কি, শিখবে কি।
‘আয়েন্দাগান’ নামে একটা অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল পত্রিকা ছিল তেহরাণে যার যথেষ্ঠ জনপ্রিয়তা ছিল রাজধানীর আধুনিকতাপন্থী বুদ্ধিজীবি মহলে। দুর্ভাগ্যের বিষয় যে ‘আধুনিকতা’ এবং ‘প্রগতি’ দুটি শব্দই মোল্লাদের চোখের দুশমন—দুটিতে পশ্চিমের দুষ্ট চরিত্রহীনতার তীব্র গন্ধ। এগুলো চরমভাবে ইসলামবিরোধী, সুতরাং কোনক্রমেই সমর্থনযোগ্য নয়। ফলে পত্রিকাটির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়ে গেল। সেকালে প্রগতিশীল দলটারও সংখ্যা নেহাৎ নগণ্য ছিল না। ‘আয়েন্দাগান’এর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়াতে তারা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন সরকারের প্রতি। নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে তারা ঝাণ্ডা নিয়ে রাস্তায় নেমে পরলেন বিক্ষোভ প্রকাশ করতে। কিন্তু ইসলামিক প্রজাতন্ত্র কি তাতে দমবার পাত্র? মোটেও না। লেলিয়ে দেওয়া হল তাদের গুণ্ডাবাহিনীকে সেই মিছিলের ওপর। বিপদ দেখে তারা প্রাণের দায়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়লেন যে যেখানে পা্রেন। গুণ্ডারা সহজেই আয়ত্তে এনে ফেলল আন্দোলন। মহামান্য আয়েতুল্লা ওপর থেকে হুঁশিয়ারবানী প্রচার করলেনঃ “এই বিপ্লব পাগড়িধারী চাদরপরিহিতদের বিপ্লব—তারা কোনরকম বিরোধিতা সহ্য করবে না। তোমরা যারা এর বিপক্ষে অবস্থান নেবার ফন্দী আঁটছ তাদের আমরা গোড়াতেই সাবধান করে দিয়েছিলাম। মনে রেখো প্রত্যেক বিপ্লবের ইতিহাসই অসংখ্য অসৎ ও গণবিরোধী ব্যক্তির মুণ্ডপাতের করুণ কাহিনী দ্বরা রঞ্জিত। সেটা অনিবার্য। সেটা জাতির পাপমোচন ও চিত্তশুদ্ধির জন্যে অপরিহার্য। সেই মহান প্রক্রিয়াতে অনেক অবাঞ্ছিত পত্রিকা নিষিদ্ধ হয়ে যাবে, অনেক অসাধু ব্যক্তি প্রাণ হারাবে। বিপ্লবের প্রথমদিকে আমরা ভেবেছিলাম যাদের সঙ্গে আমাদের কায়কারবার তারাও মানুষ। এখন দেখছি সেটা ভুল। তারা মানবেতর জীব। তারা করুণার যোগ্য নয়। তাদের পাপের শাস্তি অবশ্যই ভোগ করতে হবে”। এই বুককাঁপানো শীতল বাণী গর্জে উঠল ইরাণের আনাচে কানাচে।
১৯৮০ সালের ৯ই জুন ওমিদ ঘারিব নামক এক যুবককে গ্রেফতার করে হাজতে নেওয়া হল। অপরাধ? তার আচারব্যবহারে পাশ্চাত্য প্রভাব। পশ্চিমপন্থী পরিবারে তার জন্মবৃদ্ধি। লেখাপড়ার জন্যে অতিরিক্ত সময় ক্ষেপণ করা হয়েছে ইউরোপে। উইন্সটন সিগারেট খায়! বামঘেঁষা চিন্তাধারা। শাস্তিঃ প্রথমে তিনবছরের সশ্রম কারাদণ্ড। তারপর ফাঁসিকাষ্ঠ। ছেলেটিকে আর কখনও জেলের বাইরে দেখেনি কেউ। এমনেস্টি ইন্টারনেশনালের খবর অনুযায়ী ছেলেটির মৃত্যুদণ্ড কার্যকরি করা হয়েছিল ১৯৮২ সালের ৩১শে জানুয়ারি।
ইরাণের এই ক্ষমাহীন দমননীতির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ক্রমেই সোচ্চার হয়ে উঠছিল। সাধারণত কোনও অত্যাচারী সরকারই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানদের সমালোচনা একেবারে উড়িয়ে দিতে সাহস করেনা—আর কিছু না হলেও অন্তত ঘাপটি মেরে থাকে কিছুদিন। কিন্তু ইরাণের বিপ্লবী সরকার তার ব্যতিক্রম। ওরা থোরাই তোয়াক্কা করত পশ্চিম বিশ্বের কোনও শক্তিকে—তা সরকারই হোক আর মানবেধিকার সংস্থাই হোক। তাদের চোখে ইরাণী ইসলাম সব শক্তির সেরা শক্তি। সমালোচকদের নিন্দার জবাবে খোমায়নি সাহেব বললেনঃ
“যারা অপরাধ করেছে তাদের আবার বিচার কিসের? ওসব ফালতু বিচারের জন্যে আদালতের দ্বারস্থ হওয়াটাই বরং মানবতাবিরোধী। মানবাধিকার বলতে কি বোঝায়? বোঝায় যে লোকটা যেমুহূর্তে অপরাধী বলে সাব্যস্ত হয়ে গেল সেমুহূর্তেই তার কল্লা কেটে ফেলা। ব্যস, কোনরকম দানাইপানাই চলবেনা”।
এই ছিল ‘বিপ্লবী’ সরকারের বৈপ্লবিক বিচার!

তিন

শাহ পহলবির বাবা রেজা শাহ ইরাণী মেয়েদের বোরখা নিষিদ্ধ করেছিলেন ১৯৩৬ সালে। শিয়া ইরাণের রক্ষণশীল সমাজের জন্যে সেটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। আইন জারি করে একটা প্রাচীনপন্থী জাতিকে আধুনিক করে ফেলা যায় না। উল্টো ফল হয় তাতে, যেমন হয়েছিল ইরাণে। রাজতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ-বিক্ষোভের পূর্ণ সুযোগ নিয়ে আধুনিকতাবিরোধী মোল্লাদের রাজনৈতিক আন্দোলন ক্রমেই শক্তি সঞ্চার করে চলে। যেহেতু রেজা শাহ নারীর বোরখাকে তাঁর আধুনিকতা সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন সেহেতু সেই একই প্রতীক মোল্লাদের হাতেও ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম মুখ্য অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায়। এবং সেই অস্ত্র তাঁরা ব্যবহার করতে থাকলেন শতগুণ সৌর্যবীর্যের সাথে। তাঁরা যেন পণ করে বসলেন যে যেমন করেই হোক নারীর পর্দাকে বলবৎ করতেই হবে—এর ওপরই নির্ভর করছে বিপ্লবের ভবিষ্যৎ।
সাধারণ গায়ে-খাটা জনগোষ্ঠীর ওপর বোরখা চাপানো মোটেও কঠিন কাজ নয়—তাদের ঘরের মেয়েরা এমনিতেই পর্দা করে অভ্যস্ত, পর্দা না হলে তারা অস্বস্তি বোধ করে। কিন্তু আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত, পশ্চিমা বেশভূষায় অভ্যস্ত শহুরে মেয়েদের বেলায় পর্দা মানে অবরোধ, নারীর স্বাধিকারের ওপর পুরুষের কর্তৃত্ব ও আধিপত্য স্থাপনের এক নগ্ন, উগ্র প্রয়াস। সুতরাং তাদের ক্ষেত্রে পর্দাকে বাধ্যবাধকতার পর্যায়ে নিয়ে আসতে বেগ পেতে হবে সেটা ভাল করেই জানতেন ইরাণের মোল্লা সম্প্রদায়। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে। তার ওপর তেহরাণ—সেখানেই সত্যিকার যুদ্ধক্ষেত্র। তেহরাণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অসতী, বেশরম’ মেয়েগুলোর গায়ে বোরখা পরাতে পারলে শত্রু-নিধন পর্ব পুরোপুরি সাঙ্গ হয়েছে বলে ঘোষণা দেওয়া যেতে পারে—সম্ভবত এ’ই ছিল মোল্লাদের সহজ হিসাব।
অবশ্য বোরখা যে ক্ষমতার স্থূল প্রতীকমাত্র তা নয়, মোল্লাদের জন্যে এর গুরুত্ব আরো গভীর। বোরখা মানে ইসলামবিরোধী সকল পাপাচার থেকে বিরত থাকা। এবং এই ‘পাপাচার’গুলোর বেশির ভাগ মেয়েদের বেলাতেই প্রযোজ্য। অর্থাৎ মেয়েরা সচ্চরিত্র হলে পুরুষও সচ্চরিত্র থাকবে। যার পরোক্ষ অর্থ দাঁড়ায় এই যে পুরুষ নিজে বিপথগামী হয়না, নারীর প্ররোচনাতেই হয়। কথিত আছে যে হজরত আলী (রাঃ) একবার বলেছিলেন যে আল্লাতা’লা মানবজাতিকে দশভাগ কামলিপ্সা দিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন, যার একভাগ দিয়েছিলেন পুরুষকে, আর নয়ভাগ নারীকে। এইরকম চিন্তাধারায় দীক্ষিত মোল্লাসম্প্রদায় যে নারীকে যমের মত ভয় পাবে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। ইরাণী মোল্লাদের চোখে পর্দার খেলাপ তো গুরুতর অপরাধ অবশ্যই, তবে বোরখা পরাটাই যথেষ্ঠ নয়। সাথে সাথে তাদের আচারব্যবহারের ওপরও জারি হয় নানা বিধিনিষেধ। জোরে হাসা যাবে না—তাতে কর্মরত পুরুষের মনোযোগ নষ্ট হতে পারে। জোরে কথা বলাটাও মেয়েদের জন্যে অশোভন—নারীকন্ঠেরও একরকম যৌন আবেদন আছে। একই কারণে মেয়েদের গানের শব্দও পুরুষের জন্যে অত্যন্ত ক্ষতিকর—নারীর সুরেলা গলায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়া যে-কোনও পুরুষের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। ক্ষুরাওয়ালা জুতোর খট খট শব্দ অবশ্যই পুরুষের কোমল কর্ণেন্দ্রিয়তে অবাঞ্ছিত ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে! সুতরাং সব্বনাশ, কোনও ইরাণী মেয়ে যেন বোরখা পরেও ক্ষুরাওয়ালা জুতোপায়ে রাস্তায় বের না হয়।
জুজুর ভয় বলে একটা কথা আছে। পৃথিবীর আপামর মোল্লা জাতির জন্যে সেই জুজুটি বোধ হয় ‘যৌনতা’। সেই যৌনতাটি অন্যের না নিজেদের তার ওপর মনোবিজ্ঞানীরা কোনও গবেষণা করেছেন কিনা জানিনা, তবে সেই যৌনতার ষোল আনা দায়িত্বটি যে বেচারি মেয়েদের ওপরই চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে ইরাণের ( সৌদি আরবেরও) ইসলামিক রাষ্ট্রে তার লক্ষণ দেশের সর্বত্র। সাধারণ মোল্লার দৃষ্টিতে ‘যৌন’ একটি অভিধানিক শব্দ নয় কেবল—এ যেন কোনও বিস্ফোরক দ্রব্য। একটি শ্বাপদ জন্তু, বিশালকায় কোনও দৈত্যদানব। আজার নাফিসির বই পড়ে জানলাম, মোল্লাদের চোখে মেয়েদের বোরখার অন্যতম যুক্তি হল যে, পর্দাহীন নারীর মাথার চুল পুরুষের যৌনাকাঙ্খা বাড়িয়ে দিতে পারে, যেমন পারে সংগীতরত নারীর সুমধুর কন্ঠস্বর। নারীদেহের যেকোনও অংশই পুরুষের যৌন উত্তেজনাকে অসংযত মাত্রায় উত্তোলিত করতে পারে। তাদের পায়ের নখ, নাকের ডগা, গালের টোল, ঠোঁটের তিল, —সবই পুরুষের কামাকাঙ্খাবর্ধক। মেয়েরা কিভাবে আপেলে কামড় দেয়, কি ভঙ্গিতে আইসক্রিম চাটে, তাতেও নাকি পুরুষ উত্তেজিত হতে পারে। ডক্টর নাফিসির এক ছাত্রী একবার বিপদে পড়েছিল ‘ইসলামবিরোধী’ ভঙ্গিতে আপেল খেতে গিয়ে!
বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ক্রমেই বিষাক্ত হয়ে উঠছিল—বিশেষ করে মেয়েদের জন্যে। ছাত্রী-শিক্ষক সব নারীর ওপর একই চাপ—বোরখা, বোরখা। কোন্ অধ্যাপক কি পড়াচ্ছেন ক্লাসে তার চেয়ে হাজারগুণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ালো তাঁরা কিরকম কাপড়চোপড় পরে ক্লাসে ঢুকছেন। মেয়েদের পোশাক-আশাক নিয়ে মোল্লাদের এতটাই বাতিক ছিল যে ইরাণ-ইরাকের যুদ্ধের সময় ফরমান জারি করা হয়েছিল যে মেয়েরা যখন ঘুমুতে যায় তখন যেন ভালো করে কাপড়চোপড় পরে, যাতে শত্রুপক্ষের বোমাতে যদি প্রাণ হারাতে হয় তাহলে যেন পরপুরুষ তাদের অনাবৃত বা অর্ধাবৃত শরীর দেখতে না পায়।
অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা ক্লাসরুমে কি পড়াচ্ছেন তাতেও যে নাক গলায়নি তারা তা নয়। ডক্টর নাফিসির প্রিয় উপন্যাস ‘গ্রেট গ্যাটসবি’র ওপর তাদের রাগ কারণ তাতে পরকীয়া প্রেমের ব্যাপার আছে, চারিত্রিক উচ্ছৃংখলার ঘটনা আছে—সুতরাং এটা ইসলামবিরোধী। সর্বোপরি বইটি মোল্লা ইরাণের জাতশত্রু আমেরিকার জাতীয় স্বপ্নের ওপর লেখা—অতএব ইরাণের নিষ্পাপ নিরীহ ছাত্রছাত্রীদের জন্যে সেটা দুঃস্বপ্ন ও পথভ্রষ্টকর ভাবনার উপকরণ ছাড়া আর কিছু হতে পারেনা। এ নিয়ে কত যে যুদ্ধ করতে হয়েছিল প্রফেসার নাফিসিকে। গোড়া থেকেই ইসলামী ছাত্রগোষ্ঠীর লক্ষ্ ছিল গোটা ক্যাম্পাসে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। তারা যা বলবে তাই করতে হবে সবাইকে—ছাত্রশিক্ষক নির্বিশেষে। তারা ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাবে যখন ইচ্ছে তখন, মিটিং করবে নিজেদের মধ্যে। সেজন্যে অধ্যাপকদেরও বাধ্য করা হত ক্লাস বাতিল করতে। সবচেয়ে ভয়ানক ছিল যে জিনিসটা সেটা হলঃ ছাত্ররাই সিদ্ধান্ত নিচ্ছিল কোন্ প্রফেসার কখন চাকরি হারাবেন এবং কি অপরাধে। অনেক সময় চাকরিচ্যুত হওয়াটাই যথেষ্ঠ শাস্তি ছিল না, সরকারের কাছে অপরাধগুলোর ফর্দ পাঠিয়ে কারাবাস, বেত্রাঘাত, এমনকি মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থাও করে ফেলতে পারত তারা। এতটাই দুর্ধর্ষ হয়ে উঠছিল তেহরাণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিক্রিয়াশীল (যদিও তাদের বিচারে তারাই ছিল বিপ্লবী দল)ছাত্রসমাজ ইরাণী বিপ্লবের প্রাথমিক পর্যায়ে। তাদের দাপটে পড়াশুনা দূরে থাক মানসম্মান নিয়ে জান বাঁচানোও দুষ্কর হয়ে উঠছিল সাধারণ ছাত্রছাত্রী আর শিক্ষকমণ্ডলীর জন্যে। দুঃখের বিষয় যে ইসলামী ছাত্রদের দৌরাত্নের জন্যে ওরা দায়ী ছিল না, দায়ী ছিল খোমাইনি সরকার—কারণ ছাত্রদের যা কিছু কর্মকাণ্ড তার কোনটাই তাদের নিজেদের উদ্যোগে হয়নি, হয়েছিল সরকারের উস্কানি ও প্ররোচনাতে। ওরা ছিল সরকারের অস্ত্র।
বহির্বিশ্বের অনেকেরই হয়ত মনে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তেহরাণস্থ কূটনৈতিক দপ্তর অবরোধের ইতিহাস। ঘটনাটির সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৭৯ সালের ৪ঠা নভেম্বর, এবং সেই আটকাবস্থা বলবৎ ছিল পাকা ৪৪৪ দিন। সরকারি ঘোষণাতে বলা হত যে খোমাইনির অনুমোদনে বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশপ্রেমিক ছাত্রছাত্রীরাই এর নেতৃত্ব দিয়েছিল। যে কথাটি তখন জানতাম না আমরা সেটা হল যে আসলে ঘটনাটির মূল হোতা ছিলেন সরকার স্বয়ং—ছাত্রবাহিনী ছিল একটা ধূম্রজাল মাত্র, বাইরের জগতকে ধোকা দেওয়ার চাল। সেসময় পত্রপত্রিকায় সরকারি ইস্তাহারে প্রচার হত যে কূটনীতির নামে ঐ রাষ্ট্রদূতের অফিসখানি ছিল ইরাণের গণআন্দোলনের বিরুদ্ধে চক্রান্তকারী গুপ্তচরবাহিনীর আড্ডা। সুতরাং সেই অবরোধটি ছিল জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ ও বীতশ্রদ্ধার বাহ্যিক অভিব্যক্তি। বাইরের জগতে প্রচার হত যে, দেশের প্রতিটি অঞ্চল থেকে দলে দলে মানুষ, ছেলেবুড়ো নারীশিশু সুস্থ অসুস্থ সর্বপ্রকার মানুষ, স্বতঃপ্রনোদিত হয়ে সেই গুপ্তচরের আড্ডাকে ভেঙ্গে চূড়ে ধ্বংস করে ফেলার জন্যে অধৈর্য হয়ে উঠেছিল—সরকারের আইনরক্ষক বাহিনী তাদের বাধা দিয়ে দূতাবাসের কর্মচারীদের জীবনরক্ষা করেছে। কিন্তু আজার নাফিসির বই থেকে সেই মহান উদ্যোগের একটা ভিন্ন ছবি পাওয়া গেল। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে গ্রামগঞ্জ থেকে সাধারণ মানুষ মার্কিন দূতাবাস আক্রমণ করার হুমকি দিয়েছিল, কিন্তু তারা নিজেদের খরচ বা উদ্যোগে আসেনি, এসেছিল সরকারের উদ্যোগ-আয়োজনে। তাদের অনেকের কোন ধারণাই নাকি ছিল না কি কারণে এত আদর করে তেহরাণে নিয়ে আসা হল। কেউ কেউ নাকি এমনও ভেবেছিল যে তাদের ভিসা দেওয়া হবে আমেরিকা যাওয়ার। আবার এমনও ছিল অনেকে যে আমেরিকা বলে একটা দেশ আছে পৃথিবীতে সেটিও তারা জানত না। আরও একটা ঘটনা সম্ভবতঃ অনেকেরই মনে নেই যে দূতাবাস অবরোধের প্রতিবাদে তৎকালীন ইরাণের মেহদি বাজারগান নামক অত্যন্ত বিদ্বান ও মান্যগণ্য প্রকৌশলী, যিনি গোড়াতে খোমাইনি সরকারের অত্যন্ত অনুগত সমর্থক ছিলেন, এমনকি সে সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্ত ছিলেন, তিনি পদত্যাগ করেন, ৬ই নভেম্বর। আসলে ইরাণের কোন লেখাপড়াজানা সুশীল ব্যক্তিই সেই আন্তর্জাতিক আইনবিরোধী সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। কিন্তু সেসময়কার ইরাণি মোল্লাদের কাছে আন্তার্জাতিক আইনকানুন আর সুশীলতার কোনও দাম ছিল না।
দূতাবাস অবরোধ এবং তার সকল সদস্যদের বলপূর্বক জিম্মি রেখে খোমাইনি সরকার যে ‘দুঃসাহসের’ পরিচয় দিয়েছিলেন তাতে করে সাময়িকভাবে তাদের জনপ্রিয়তা দারুণভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত্র হয়। সাধারণ ইরাণীদের দৃষ্টিতে খোমাইনির একটি অতিমানবিক ভাবমূর্তি তৈরি হয়ে যায়। অনেকে দাবি করতে থাকল যে আকাশে চাঁদের বুকে তারা স্বচক্ষে দেখেছে আয়েতুল্লার প্রতিমূর্তি (আমার স্বদেশী ভাইবোনদের কারো কারো মনে থাকতে পারে যে কয়েক বছর আগে দেশের কাগজে খবর বেরিয়েছিল মুরগির ডিমের ওপর আরবি হরফে লিখিত ‘আল্লা’ নিজের চোখে দেখেছে কোনও পুণ্যবান ব্যক্তি, কেউবা দেখেছে নবজাত বাছুরের গা’তে)।
মোল্লাদের সবচেয়ে কোপদৃষ্টি ছিল শাহ পহলবির আমলে যারা সরকারি আমলা বা মন্ত্রীটন্ত্রী ছিলেন। শাহপুর বখতিয়ার তেমনি এক উচ্চপদস্থ আমলা ছিলেন বিপ্লবপূর্ব সময়ে, কিন্তু চিন্তাচেতনায় ভাবাদর্শে ছিলেন সম্পূর্ণ শাহবিরোধী। পহলবির দেশত্যাগের পর তিনি দেশপ্রেমের তাগিদেই অন্তর্বর্তীকালীনভাবে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। অত্যন্ত সরলপ্রাণ, সাধু সজ্জন মানুষ ছিলেন একটি। কিন্তু তাতে তাঁর শেষরক্ষা হয়নি। মোল্লাদের তলোয়ারের নিচে তাঁরও কল্লা গেল। এভাবে অসংখ্য প্রাক্তন সরকারি কর্মচারি, সামরিক বিভাগের সদস্য, বিনা বিচারে, পাইকারি হারে নিহত হতে থাকেন মোল্লাদের হাতে। সারা দেশ চুপটি করে থাকল—টুঁ শব্দটি করতে সাহস পেল না কেউ। এমনকি সেসময়কার বামপন্থী সম্প্রদায়—তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক বা সাম্যবাদী গোষ্ঠীগুলো, তারা প্রতিবাদ করা দূরে থাক বরং সক্রিয় সহযোগিতাই প্রদর্শন করছিল চরম ডানপন্থী মোল্লাদের সঙ্গে। আজার নাফিসির জন্যে সেটাই ছিল সবচেয়ে দুর্বোধ্য, অবিশ্বাস্য দৃশ্য। তিনি নিজে সারাজীবন বামপন্থী চিন্তাধারাতে আকৃষ্ট ছিলেন—তাদের একটা নিজস্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে বলেই তিনি জানতেন। কিন্তু ইরাণের কমুনিস্টরা যেভাবে হতাশ করেছিল তাঁকে সেরকম হতাশ তিনি মোল্লাদের বর্বর আচরণেও হননি। কমুনিস্টদের কি যুক্তি? যুক্তি ছিল এই যে মোল্লার চেয়ে বড় শত্রু হল ঔপনিবেসিক শক্তি আমেরিকা—প্র্থমে বড় মাছটিকে ঘায়েল কর, তারপর ছোটটিকে ধরা যাবে! আন্তর্জাতিক চালচাতুরি যা’ই হোক বামপন্থীদের সহযোগিতার ফলে মোল্লাদের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কেউ যে সামান্য প্রতিবাদ জানাবে তারও কোন উপায় রইল না। ফলে গোটাদেশব্যাপী বিরাজ করে রইল এক বিপুল ত্রাসের রাজ্য—প্রতিটি মানুষেরই বুকে ভয় কখন তার দরজায় ধাক্কা দিয়ে প্রবেশ করে সশস্ত্র ধর্মপুলিশ, কোন্ অজুহাতে ধরে নিয়ে যায় তাদের প্রাণের মানুষটিকে যার মুখ তারা আর কোনদিন দেখতে পাবে না। এই ত্রাস আস্তে আস্তে সমস্ত জাতিকে মানসিকভাবে আড়ষ্ট করে ফেলল, যার প্রভাব থেকে বাচ্চা ছেলেমেয়েরাও রক্ষা পায়নি। নাফিসির বইতে পড়লামঃ এক পরিবারে একটি দশ বছরের ছেলে রোজ রাতে চিৎকার করে উঠে যেত ঘুম থেকে এই বলে যে সে একটি “বেআইনি স্বপ্ন” দেখেছে। বেআইনি স্বপ্ন? এর মানে কিরে বাবা? জিজ্ঞেস করতেন তার বাবামা। ছেলেটা কেঁদে কেঁদে বলতঃ সে স্বপ্নে দেখেছে একটা সমুদ্রতীরে শুয়ে যুবকযুবতীরা পরস্পরকে চুম্বন করছে, অথচ তার কিছু করার ছিল না অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকা ছাড়া।
বিদ্যাবুদ্ধিতে যতই হালকা হোক মোল্লারা, এটুকু ঘিলু তাদের মাথায় ছিল যে তলোয়ার, বন্দুক আর চাবুক দিয়ে সারা দেশ কাবু করা সম্ভব হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বেলায় ঠিক একই পন্থা কাজ করবে না। এরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত সম্প্রদায়—দেশবিদেশের খবরাখবর রাখে। এরা স্বাধীনচেতা, গোঁয়ার, অনমনীয়। সরকারিভাবে চাপানো কোনও সীমাবদ্ধতা তারা মাথা পেতে মানবে না। সে কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে তারা হয়ত ধীরে-চল নীতি অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। প্রথমে জুম্মার নামাজ। তারপর বেয়াড়া শিক্ষকগুলোকে ছাঁটাই করা। দুচারজনকে বিনা বিচারে বা নিছক মোল্লাবিরোধিতার সন্দেহে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো। এরপর তাঁদের দৃষ্টি পুরোপুরি নিক্ষিপ্ত হল ক্যাম্পাসের মেয়েগুলোকে কিভাগে বাগে আনা যায়, তার প্রতি। মহিলা অধ্যাপক ও ছাত্রীদের তাঁরা আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন যে পর্দাহীনতার পরিণাম আজ হোক কাল হোক তাদের ভোগ করতেই হবে একদিন। সুতরাং এখন থেকেই অভ্যেসটা আয়ত্ত করে ফেলা উচিত। অপরদিকে প্রগতিশীল ছাত্রগোষ্ঠীকে ইসলামের সহি রাস্তা প্রদর্শনের দায়িত্ব চাপিয়া দেওয়া হল যারা ইসলামী বিপ্লবের পক্ষে সেসব ছাত্রদের ওপর—অর্থাৎ কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার ফন্দী। বুদ্ধিটা মন্দ ছিল না, তবে শেষ পর্যন্ত ওটা কতখানি কার্যকরি হতে পারত বলা মুস্কিল। সেটা ধীরে-চল নীতির অন্তর্গত। ধীরে চলার মত ধৈর্যশীল, ধীরস্থির নেতা ইমাম খোমাইনি বোধ হয় ছিলেন না। তিনি ছিলেন অবিলম্ব ফলাফলের পক্ষপাতী—একটা রাষ্ট্রনীতি ধার্য করা হয়েছে, ব্যস, এই মুহূর্তেই সেটা কার্যকরি করতে হবে। বিপ্লবের লক্ষপথে কোনপ্রকার বিলম্ব সহ্য করা হবে না। কথিত আছে যে একবার তিনি রীতমত রেগে গিয়েছিলেন ইসলামী ছাত্রগোষ্ঠীর ওপরঃ “ এটা কি করে বরদাস্ত করা যায় যে সারা বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে ফেলল একদল কম্যুনিস্ট ছোকরা-ছুকরি, আর তোমরা দিব্যি নাকে তেল দিয়ে ঘুমুচ্ছ?” ওদের আশু কর্তব্য কি কি তা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ব্যক্ত করে দিলেন্ তিনি “ শোন তোমরা। একটা গল্প বলে বুঝিয়ে দিই তোমাদের। মোদারেস নামক এক রাজনৈতিক মোল্লাকে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, শহরে এক বদমাস অফিসার আছে যে তার দুই কুকুরের নাম রেখেছে শেখ ও সাইয়িদ (অর্থাৎ মোল্লাদের প্রতি অপমানজনক কটাক্ষ), তার কি শাস্তি হওয়া উচিত? মোদারেস সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেনঃ তৎক্ষণাৎ মৃত্যুদণ্ড কার্যকরি করা। সুতরাং এসব অপরাধের একটাই সুরাহাঃ প্রথমে তার মুণ্ডপাত, তারপর কে কি চেঁচামেচি করল কিছু আসে যায় না। অজুহাত না দেখিয়ে উদ্দেশ্য হাঁসিল করা, এই হল মোদ্দা কথা”।
নাফিসি আস্তে আস্তে বুঝে উঠতে পারছিলেন যে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ু ফুরিয়ে এসেছে। এরকম শ্বাসরোধকর পরিবেশে ইংরেজি সাহিত্য পড়ানো কি সম্ভব? যেদিকে তাকান সেদিকেই বাধা, সেদিকেই দুর্ভেদ্য দেয়াল দাঁড়ানো। যখন তখন যাকে তাকে ছাঁটাই করা হচ্ছে। তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু, অত্যন্ত স্পষ্টবাদী এক নারীবাদী বন্ধু, যে কিছুতেই পর্দা মানবে না বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তাকে কেবল বরখাস্ত করেই ক্ষান্ত হয়নি তারা, একেবার গুম করে দিয়েছিল। ইংরেজি বিভাগের অধ্যক্ষ, ডক্টর ‘এ’ বলেই যাঁর পরিচিতি নাফিসির বইতে, বরাবরই তিনি ‘ইসলামী বিপ্লবের’ ঘোর সমর্থক ছিলেন। তবে লোকটার মনুষ্যত্ব ছিল। স্বল্পভাষী, সাধুসজ্জন একজন খাঁটি ভালমানুষ। ইংরেজি সাহিত্যের বিরাট পণ্ডিত না হলেও নিজের বিষয়টা ভাল জানতেন, বুঝতেন। সাহিত্য আর রাজনীতিকে একসাথে জড়িয়ে একটা কুৎসিৎ জিনিস তৈরি করে ফেলা—না, সেরকম মানুষ তিনি মোটেও ছিলেন না। কর্তৃপক্ষ তাঁকে পছন্দ করতেন কারণ তারা জানতেন যে তাদের চূড়ান্ত লক্ষের প্রতি তাঁর যথেষ্ঠ সহানুভূতি ও অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল। বলতে গেলে তিনি ওদেরই দলের মানুষ। কিন্তু তাই বলে তারা যা ইচ্ছে তাই করে যাবেন, অন্যায় অবিচার কোনরকম বাচবাছাই না করে, সেটা মুখ বুঁজে সহ্য করার লোক তিনি কখনোই ছিলেন না। দুঃখের বিষয় যে মোল্লাদের জন্যে এসব মানবিক গুণাবলী ছিল মানসিক দুর্বলতার শামিল। একবার তাঁর ইংরেজি বিভাগের এক ছাত্রকে পাকড়াও করে নিয়ে যায় সরকারি গুণ্ডারা। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ—অমান্যতা, সরকারকে জনসমক্ষে হেয় প্রতিপন্ন করার চক্রান্ত, ইত্যাদি। ডক্টর ‘এ’র নিশ্চিত বিশ্বাস অভিযোগগুলোর অধিকাংশই একেবারে ভিত্তিহীন। তিনি স্বেচ্ছায় আদালতে গিয়ে ছেলের সপক্ষে সাক্ষী দিয়ে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করলেন। যেহেতু ডক্টর ‘এ’ একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি সমাজের, সেহেতু তাঁর সাক্ষ্যের গুরুত্ব অবহেলা করা যায়নি। ছাত্রটির শাস্তি খুব হালকা করে দু’বছরের কারাদণ্ডে নামানো হল। সে অল্পতেই ছাড়া পেল বটে, কিন্তু বিপদ ঘনিয়ে উঠল ডক্টর ‘এ’র ভাগ্যাকাশে। বেচারাকে শেষ পর্যন্ত তারা বাধ্য করে পদত্যাগ করতে।
ডক্টর ‘এ’ মানুষটিকে দারুণরকম পছন্দ করতেন আজার নাফিসি তা নয়, তবে তাঁর প্রতি প্রচুর শ্রদ্ধাবোধ তাঁর ছিল। মতামতে মিল থাক বা না থাক জেনেশুনে কারো ক্ষতি করার মত নিচু মন তাঁর ছিল না। বিবেকের তাড়নায় তিনি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত ছাত্রের পক্ষ নিয়ে কথা বলেছিলেন হাকিমের সামনে, আর সেই অপরাধে তাঁকে চাকরি হারাতে হল, এটা তিনি কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারলেন না। এমনিতেই তাঁর মন বিষিয়ে উঠছিল সবকিছু দেখেশুনে। যে স্বপ্ন নিয়ে তিনি বিদেশের মোহ বর্জন করে স্বদেশের অনিশ্চয়তাকে বাছাই করে নিয়েছিলেন, যে আশা উদ্দীপনা, দেশের প্রতি যে প্রচণ্ড ভালবাসা তাঁকে প্রবলভাবে টেনে এনেছিল তেহরাণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে, সব স্বপ্নই যেন একে একে চূর্ণ হয়ে গেল।
রাষ্ট্রব্যাপী পর্দাকে বাধ্যতামূলক করে তোলার ওপর নির্ভর করছিল ইরাণী বিপ্লবের সাফল্য। কিন্তু তেহরাণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক চিন্তাচেতনাপুষ্ট গতানুতিক প্রগতিপন্থী ছাত্র ও শিক্ষক সমাজকে তারা জোর জবরদস্তি করে বশ মানানোর কল্পনা বাদ দিয়ে বরং আকারে-ইঙ্গিতে সামাজিক-মানসিক চাপ সৃষ্টি করে কাজ আদায় করার চেষ্টা করেছিল প্রথমদিকে—যেমন প্রতিক্রিয়াশীল ছাত্রদের হাতে অধ্যাপক ছাঁটাই-নিয়োগের পরোক্ষ ক্ষমতা দেওয়া, দলীয় মতাদর্শের সাথে সহানুভূতিশীল প্রশাসকদের হাতে অবাধ্য অধ্যাপকদের চাকরি হারাবার প্রচ্ছন্ন বা সুস্পষ্ট হুমকি দেবার অধিকার দান, তাদের মতামতের সঙ্গে হুবহু খাপ খায় না এমন দেশীবিদেশী বইপুস্তক বাজেয়াপ্ত করা। কিন্তু তাতে তেমন কাজ হচ্ছিল না, বা যতটা বেগের সঙ্গে কাজটি সিদ্ধ করতে চেয়েছিলেন ততটা হয়নি। ফলে তাঁরা ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন এই ধীরে-চল নীতির ওপর। একদিন বোরখা ছাড়া ক্যাম্পাসে কোন মহিলা, ছাত্রী-শিক্ষক যে’ই হোক, আইনটি কার্যকরি করবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন তাঁরা। তাঁদের মনের ভাব, আর নয়, তোষামোদ ঢের হয়েছে। আইনের জোর ছাড়া কাজ হবে না এখানে। যদি কেউ ভুল করেও আইন ভাঙ্গার চেষ্টা করে তাহলে তাকে জবাবদিহি করতে হবে সরকারের কাছে। এতে এমন একটা পরিবেশ দাঁড়িয়ে গেল ক্যাম্পাসে যে কোন অধ্যাপিকা যদি পর্দা ছাড়া ঢোকার চেষ্টা করেন তাহলে তাঁকে বাধা দেওয়া হবে—না মানলে তাঁর ওপর বলপ্রয়োগও হতে পারে। এবং তিনি চাকরি থেকে বরখাস্ত হবেন।
সরকারের বিরুদ্ধে কোনও অবস্থান নেওয়ার পরিণতি যে কত মারাত্মক হতে পারে সেটা কারো অজানা ছিল না। ক্যাম্পাসের অধিকাংশ মহিলা অধ্যাপক হাল ছেড়ে দিয়ে বোরখা চাপালেন গায়ে। গোঁ ধরে থাকলেন কেবল তিনজন—নাফিসি, ফারিদা, লালিহা। তিনজন তিন বিভাগের, কিন্তু আধুনিক মতাদর্শের দিক থেকে একই পথের পথিক—সরকারের দমননীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার একাকি যাত্রায় সহচর বন্ধু।
ফলে একে একে তিনজনই চাকরি থেকে বরখাস্ত হলেন। তাতে নাফিসির খুব একটা আর্থিক সংকট হয়নি, কারণ তাঁর স্বামী বেশ ভাল চাকরিই করতেন তখন, ফারিদারও চলে যাচ্ছিল কোনরকমে। কষ্ট হচ্ছিল বেচারি লালিহার, বড়রকমের কষ্ট। তাঁর অন্য কোনও সংস্থান ছিল না উপার্জনের। ভাগ্যিস শেলাইটা শিখে নিয়েছিলেন অনেক আগেই। পর্দা না মানার অপরাধে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপনা থেকে অব্যাহতি পেয়ে তিনি জীবনধারণের তাগিদে বাধ্য হলেন পাড়াপ্রতিবেশীর জামাকাপড় শেলাই করে যৎসামান্য যা উপার্জন করতেন তাই দিয়ে হীনদরিদ্র দশায় দিনযাপন করতে। আর আমাদের আজার নাফিসি? তিনি বাড়িতে বসে ভগ্নহৃদয়ে ভাবতে থাকলেন কি হয়ে গেল দেশটার। এর জন্যে কে বা কারা দায়ী? দায়ী তো মোল্লারা নয়, তাঁরাই। দেশের শিক্ষিত অশিক্ষিত সবাই আদর করে ঘরে ঢুকিয়েছে এই অসভ্য অসুর জাতিকে। নাম দিয়েছে ‘বিপ্লব’। হাঃ।

চার

ধর্মের মাহাত্ন্য নিয়ে সবচেয়ে গালভরা বুলি ঝাড়ে কারা? যারা সবচেয়ে বেশি অজ্ঞ। যারা জীবনের সিংহভাগ সময় কাটিয়েছে প্রতিদিন দুবেলা পবিত্র কোরাণ পরম ভক্তিসহকারে তেলোয়াত করে করে, কিন্তু কোরাণের একটা অক্ষরেরও অর্থ বুঝবার প্রয়োজন বোধ করেনি। আর ঝাড়েন আমাদেরই অতিপ্রিয় ব্যবসায়ীগণ—মানে ধর্মই যাদের ব্যবসা, সম্মিলিতভাবে যাদের ‘মোল্লা’ বলে অভিহিত করা হয়। তারা অহরহই আমাদের কর্ণকুহরে সুধাবর্ষণ করে যাচ্ছেন যে ইসলামের মত সহনশীল ধর্ম সংসারে আর একটি নেই। তাই নাকি? বইপত্র ঘাঁটাঘাটি করে যা দেখলাম তাতে তো সহনশীলতা ব্যাপারটি খুব উচ্চস্বরে আত্মঘোষণা করে উঠেছে বলে মনে হয়নি। প্রাচীনকালের কথা নাহয় বাদই দিলাম—সেকালে, মানে নবিকরিমের কাল থেকে পরবর্তী পাঁচ-ছ’শ বছর ইসলামের যে অপেক্ষাকৃত গৌরবযুগটি দেখেছি আমরা, সেটা অতিক্রান্ত হবার পর ধর্মীয় বর্বরতায় মুসলমানদের চাইতে বরং শান্তি ও ক্ষমার প্রতীক যীশুখ্রীষ্টের পুণ্যবান শিষ্যগণই অধিকতর অগ্রসর ছিলেন। তারপর যখন ইউরোপে যুক্তিবাদ আর আলোকায়নের প্রথম সূর্যের আলোর ধারা প্রবাহিত হতে শুরু করে মধ্যযুগের শেষপ্রান্তে, ঠিক তখনই মরুভূমির শুষ্ক বালুকণার কট্টর অন্ধকারে বিলীন হয়ে যেতে লাগল মুসলিম সাম্রাজ্যের শানশওকত, সাথে সাথে তাদের ধর্মীয় শিষ্টাচরণের যেটুকু বাহ্যিক আবরণ অবশিষ্ট ছিল, সেটুকুও।
দীর্ঘকাল রাজনৈতিক ক্ষমতার শীর্ষচূড়া থেকে বঞ্চিত থাকার পর ১৯৭৯ সালে রাষ্ট্রচালনার অধিকার হস্তগত হয় ইরাণের মোল্লাদের। সারা মুসলিম জাহান তখন উল্লাসে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছিল, পরিষ্কার মনে আছে আমার। আবার বুঝি ইসলামের জয়পতাকা গর্বের সাথে উড্ডীন হবে বিশ্বের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। ক্যানাডার রাজধানী অটোয়াতে বসে আমি নিজের কানে শুনলাম, আমারই ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবরা সগর্বে ঘোষণা করছেনঃ আমাদের চিরকাঙ্খিত সেই স্বর্ণযুগ, খোলাফায়ে রাশেদিন, এবার বাস্তবে পরিণত হয়ে যাবে, সময়ের ব্যাপার মাত্র। গোটা পৃথিবীটাই একদিন ইসলামের সবুজ পতাকা দ্বারা আবৃত হবে, দেখবেন। আনন্দে আত্মহারা হবার কথাই বটে, তাই না? যদিনা আপনার জন্ম হয়ে থাকে কোনও অমুসলমান পরিবারে। যদিনা ছোটবেলায় আপনার জ্ঞান হবার বয়স থেকে আপনি জানতে পান, যে-দেশটিতে আপনি জন্মগ্রহণ করেছেন ভাগ্যলীলায়, সেদেশটার জলবায়ু বৃক্ষলতা বনবনানী যতই ভালোবাসুন, যতই আপনার মন কাঁদুক সেদেশের মাটির জন্যে, আপনার পিতৃপুরুষের স্মৃতিফলকের সামনে নতজানু হয়ে যতই অশ্রুবর্ষণ করুন না কেন আপনি, সেদেশ আপনাকে কেবল ‘সখ্যালঘু’ বলেই জানে। বড় কথা, সংখ্যাগুরুরা সেদেশে সাধারণভাবে বেঁচে থাকার বিষয়গুলোকে সহজাত অধিকার বলে গণ্য করে, সেগুলো আপনার জন্যে সহজলভ্য তো নয়ই, বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেগুলো নিষিদ্ধ আপনার জন্যে। উপরন্তু আপনার একটি আলাদা পরিচয় থাকবেঃ কাফের, মালাউন বা নিদেনপক্ষে বিধর্মী।
ইরাণের বর্তমান শাসনকর্তাগণ কতখানি উদারমনস্ক ও সহনশীল তার দুচারটে উদাহরণ দিতে হয়।
দুটি বড় বড় ধর্মের জন্মস্থান পারস্য, যার আধুনিক নাম ইরাণ—জুয়ারাষ্ট্রিয়ান ও বাহাই। জুয়ারাষ্ট্রের জন্ম ঠিক কোন সালে কেউ জানেনা, তবে অন্তত খৃষ্ট্রপূর্ব ৩০০তে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। একসময় পারস্যের বেশির ভাগ মানুষই তাঁর অনুসারী ছিলেন। তারপর ৬৪২ সালে আরবের মুসলমানরা এসে যখন সমস্ত দেশটা দখল করে ফেলেন তখন এই প্রাচীন ধর্মটি অতি অল্প সময়ের মধ্যেই প্রায় নিশ্চিহ্ন অবস্থায় দাঁড়িয়ে যায়। বাহাই ধর্মের আদিগুরু বাহাউল্লার জন্ম ইরাণের পূর্বাঞ্চলে। তাঁর প্রবর্তিত ধর্মের বাণীটি ছিল এরকম যে পৃথিবীর সব ধর্মই মূলত একই ঈশ্বরের উপাসনার আদর্শে প্রতিষ্ঠিত, অতএব তাদের মাঝে মৌলিক কোনও বিরোধ নেই, এবং সবগুলোই সমান শ্রদ্ধাভক্তির সাথে পালনীয়। অর্থাৎ বাহাই ধর্ম একহিসেবে কোনও নতুন ধর্ম নয়—সব ধর্মের সংমিশ্রনে গড়ে তোলা একটি সার্বিক নীতিমালা মাত্র। প্রথমদিকে কট্টর ইসলামবাদীদের বিরাগভাজন হলেও তাদের ওপর বিধর্মিতার অভিযোগ এনে পাইকারি হারে তাদের হয়রানি করার কোনও সঙ্ঘবদ্ধ প্রচেষ্টা চালানো হয়নি সরকারিভাবে যদিও বাহাউল্লাহ সাহেবের ওপর প্রচণ্ড চাপ দেওয়া হচ্ছিল এসব ‘ইসলামবিরোধী’ প্রচারকর্ম থেকে বিরত থাকতে। এতটাই চাপ যে শেষ পর্যন্ত তাঁকে দেশ ছেড়ে দক্ষিণ ভারতে্র কোন এক জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। তার বেশ কিছুকাল পরে অবশ্য পারস্যের শাসনকর্তারা এই নিরীহ সম্প্রদায়টিকে খুব একটা নিগ্রহ করেনি। সেই অপেক্ষাক্তৃত শান্তিপূর্ণ সময়টি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি নতুন যুগের নতুন ইসলামের অসহিষ্ণু নীতিমালার কারণে। খোমাইনি সাহেবের বিপ্লবী সরকারের দৃষ্টিতে বাহাইবাদ ছিল একরকম চোখের কাঁটা। প্রথম থেকেই তাদের ওপর যত অন্যায় অত্যাচার কল্পনা করা যায় চালানো শুরু হয়ে গেল। তাঁরা উঠে পড়ে লেগে গেলেন কিভাবে বাহাইদের ঝেঁটিয়ে বের করা যায় দেশ থেকে। ইরাণের বিপ্লবী সংবিধানে বাহাইদের সবরকম নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। স্কুলকলেজে গিয়ে পড়াশুনা করবার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় তাদের ছেলেমেয়েরা। সবচেয়ে অমানুষিক কাজ যেটা করা হল সেটা হল যে কোনও বাহাই ধর্মাবলম্বী মানুষ, পুরুষ নারী যে’ই হোক, তার দেহসৎকার করে কোথাও কবর দেওয়া যাবে না—বাহাই গোরস্থান যেটি ছিল সেটাকে বুলডোজার দিয়ে ধ্বংস করবার পর সেখানে নতুন দালান তৈরি হয়ে গেল সরকারেরই কোনও কর্মসূচি উপলক্ষে।
নাফিসির ‘রিডিং ললিতা…’বইটিতে একটি তরুণ বাহাই ছেলের করুণ কাহিনী পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। সাধারণ মানুষ নিষ্ঠুর হলে মনকে যুক্তিটুক্তি দিয়ে অবোধ দেওয়া যায়, কিন্তু পুরো একটা রাষ্ট্রই যখন তার সমস্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে একটি তরুণ ছেলেকে পিষে মারার উদ্যোগ নেয় তখন কি বলে মানাই মনকে। ছেলেটির নামধাম উল্লেখ করেননি লেখক—শুধু ‘কিড’ নামে চালিয়েছেন এক হিতৈশি বন্ধু। কিডের বাবামা ভাইবোন সবাই ক্যানাডার অভিবাসী—কি এক দুর্বোধ্য কারণে শুধু সে’ই দেশে থেকে যায় তার দিদিমার সঙ্গে। একদিন বৃদ্ধ দিদিমা হাসপাতালে থাকাকালেই মারা যান। ছেলের আপনজন বলে কেউ ছিল না, কেবল সেই হিতৈশি বন্ধুটি ছাড়া। খবর পেয়ে বন্ধু ছুটলেন কিডের কাছে। গিয়ে দেখেন ছেলে দিদিমার লাশ সামনে রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, কারণ সে দিশাহারা হয়ে ভাবছে কোথায় তার প্রাণপ্রিয় দিদিমাকে নিয়ে কবর দেবে—বাহাইর লাশ কবর দেবার অধিকার তো কারো নেই। তেহরাণের নগরসীমাতে কোথাও ‘বেয়াইনী’ভাবে কবর দেবার চেষ্টা করে যদি ধরা পড়ে যায় তাহলে সর্বনাশ—কত বছর জেলখানার অত্যাচার সহ্য করতে হয় কে জানে। বন্ধুটির গাড়ি ছিল বলে রক্ষে—একটা বুদ্ধি বের করা হল। লাশটাকে গাড়ির ট্রাঙ্কে ঢুকিয়ে তারা চলে গেল শহর থেকে বেশ দূরে একটা নিরিবিলি গ্রামের মত জায়গায়—লোকচক্ষুর আড়ালে, রাতের অন্ধকারে। খুঁজে খুঁজে গোরস্থান পাওয়া গেল একটা। গোরস্থানের গোররক্ষক এক বৃদ্ধ কুব্জদেহ নিরীহ মানুষ—পকেটে বেশ মোটারকমের টাকা ঢোকাতেই লোকটা রাজি হয়ে গেল লাশ দাফন করতে। টাকাটা অবশ্য কিড ছেলেটির কাছে ছিল না, সেটা এল তার হিতৈশি বন্ধুটির পকেট থেকে—অত্যন্ত বড় মনের মানুষ ছিলেন ভদ্রলোক। মনে শুধু বড় ছিলেন না, বিদ্যাবুদ্ধি আর জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও লোকটার প্রচুর নামধাম ছিল তেহরাণের সুধিমহলে। এই ভদ্রলোক সঙ্গে না থাকলে ছেলেটির কোনও উপায়ই থাকত না তার দিদিমাকে যথাযথ সম্ভ্রমের সাথে সৎকার করে কোথাও।
ঠিক আছে, মৃতদেহের সৎকার তো হল মোটামুটি সাফল্যের সঙ্গে, যেটাতে এই অসম্ভবরকম ভালো মানুষটি পারলেন তার উপকার করতে। কিন্তু বুড়ো দাদীর মৃতদেহকে কবর দেওয়া যত সহজ তত সহজ মোটেও ছিল না কিডের জীবনের ন্যূনতম আকাঙ্খাগুলোকে কোনরকমে সফল করে তোলার পথে তাকে সাহায্য করা। ছেলেটির মেধা ছিল সাধারণের অনেক উর্ধে। বড় আশা ছিল সে ডাক্তারি পড়বে। ভবিষ্যতের অনেক স্বপ্ন তার। পড়াশুনায় এত ভাল ছিল সে যে ফাইনেল পরীক্ষায় সেরা ছাত্রদের তালিকায় তার নাম ছিল একেবারে চূড়ার দিকে। এরকম রেজাল্ট নিয়ে ডাক্তারি কলেজে ভর্তি হতে পারা কোন সমস্যাই হবার কথা নয়। দরখাস্ত করার পর বিনা প্রশ্নেই তার ঠিকানাতে অনুমতিপত্র পাঠিয়ছেলেন কলেজকর্তৃপক্ষ। সে তো মহা আনন্দে চিঠি সহকারে কলেজ প্রাঙ্গনে ছুটে গেল ভর্তি হবে বলে। কিন্তু হা কপাল! হতভাগ্য বাহাইসন্তান ভর্তির অফিসে ঢুকেই খবর পায় যে তার ভর্তির অনুমোদন খারিজ করে ফেলেছেন কর্তৃপক্ষ যখন তাঁরা ওর জাতপরিচয় জানতে পেলেন—বাহাই ছেলেকে ভর্তির অনুমতি দিলে কলেজের অস্তিত্ব নিয়েই টানাটানি শুরু হয়ে যাবে। কিডের বহুদিনের স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল একনিমেষে।
এই হল বর্তমান ইরাণের ধর্মীয় সহনশীলতার একটি ছোট্ট নিদর্শন। ১৯৪৮ সালে দেশের বাহাইসংখ্যা ছিল এক লক্ষ, ২০০৪ সালে সেটা নেমে এসেছিল ২০ থেকে ২৫ হাজারে। একেবারে শূন্যতে নামানোই ছিল কর্মকর্তাদের মূল উদ্দেশ্য—সেটা সফল হতে পারেনি কেবল জাতিসঙ্ঘের প্রবল আপত্তি প্রকাশের কারণে।
এবার আমাদের মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে পরম প্রীতির সম্পর্ক দ্বারা সংযুক্ত নয় সেই ইহুদী সম্প্রদায়ের প্রতি ইরাণ সরকারের কি মনোভাব সেটা একটু পরীক্ষা করে দেখা যাক। বহুকাল আগে, পহলবি বংশের রাজ্য দখলেরও অনেক আগে ইরাণের জনসংখ্যার একটা মোটা অংশই ছিল ইহুদী। তার অর্থ এই নয় যে তাদের নাগরিক অধিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের মতই ছিল—মোটেও নয়। দক্ষিণ ভারতের তৎকালীন নমশূদ্রদের চাইতেও মানবেতর ছিল ওদের অবস্থা। একটি উদাহরণ দিলে হয়ত জিনিসটা একটু পরিষ্কার হবে। ইহুদীদের পরিচয়সূচক একরকম বিশেষ ব্যাজ পরিধান তো বটেই, উপরন্তু তাদের ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা ছিল যেন বর্ষাকালে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলে ভুল করেও কোন ইহুদী বাড়ির বাইরে পা বাড়ায়—বাড়ালেও কোনক্রমেই যেন সে বৃষ্টিতে গা না ভেজায়। কেন? একটা ইহুদীর গা-ধোয়া জল যদি দৈবাৎ নালা দিয়ে গড়াতে গড়াতে কোনও জলাশয়ে গিয়ে মেশে তাহলে সেই পানি নাপাক হয়ে যায়, ফলে ওতে অজু করে নামাজ পড়লে কোন মুসুল্লিরই নামাজ কবুল হবে না! অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে কি আপনার? হবার কথাই। ধর্মভিত্তিক ঘৃণা কতদূর যেতে পারে এ তার এক জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত। এটি আমি পড়েছিলাম Nine Parts of Desire নামক গ্রন্থে। বইটির প্রণেতা Geraldine Brooks মূলত অস্ট্রেলিয়ার মেয়ে, মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন দীর্ঘকালব্যাপী, এবং মূল্যবান সব তথ্য জোগাড় করেছেন নানা জায়গা থেকে। ইহুদীদের বৃষ্টিতে ভেজার ব্যাপারটি কতখানি সত্য সেটা আমার পক্ষে যাচাই করা সম্ভব হয়নি, তবে ধর্মীয় বিদ্বেষ যে কিরকম উগ্রতায় পৌঁছুতে পারে তার উদাহরণ তো আমরা নিজেদের উপমহাদেশেই দেখেছি বহুবার।
পহলবিদের যুগে অবশ্য এসব বর্বরতা একবারেই তুলে নেওয়া হয়েছিল—ইহুদীদের নাগরিক সম্মান যতটা সম্ভব সমপর্যায়ে বহাল রাখবার আপ্রাণ চেষ্টা তাঁরা করেছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ কেবল মুখের বুলিই ছিল না, সেটা কার্যকরি করারও আন্তরিক প্রচেষ্টা তাঁদের ছিল, যতই স্বৈরাচারি শাসক তাঁরা হোন না কেন রাষ্ট্রীয়ভাবে। দুর্ভাগ্যবশত ’৭৯ সালের মোল্লারা ক্ষমতায় আসার পর অতীতের সেই ঘৃণাত্নক অন্ধকারে ফিরে যায় ইরাণ। ওদের ঘৃণার মাত্রা কোথায় পৌঁচেছিল সেটা শুনলে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন যে কোন মোল্লারও গা কাঁটা দিয়ে উঠবে। একটা উদাহরণ দিই। রেজা পহলবি, যাঁর আদেশে মেয়েদের হিজাব-নিকাব পরা নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, মোল্লাদের হাতে শাসনক্ষমতা এসে যাবার পর তারা প্রথমে তাঁর কবরের ওপর তৈরি করা স্মৃতিসৌধটি ধূলিসাৎ করে ফেলে বুলডোজার দিয়ে। এবং সেজায়গাতে তারা নির্মাণ করে ফেলে একটি পাব্লিক শৌচাগার। তাতেও তাদের আক্রোশ মেটেনি। শৌচাগারটির নির্মাণক্রিয়া সমাপ্ত হবার পর বিভাগীয় মন্ত্রীমহোদয় নিজে সেখানে মূত্রত্যাগ করে সেটা উদ্বোধন করেন উপস্থিত সংবাদমাধ্যম ও অগণিত জনতার বিপুল হর্ষধ্বনিতে!
মোল্লাশাসিত ইসলামী রাষ্ট্রের সহনশীল উদার নীতিমালার আরো একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পেলাম নাফিসির বইটিতে। দেশের অমুসলমান রেস্টুরেন্টওয়ালাদের ওপর কড়া নির্দেশ ছিল যাতে তাদের রেস্টুরেন্টের দরজাতে বড় করে লেখা থাকে যে এটা সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠান। তাহলে পুণ্যবান মুসলমানরা বুঝতে পারবে যে সেখানে খাদ্যগ্রহণ করা যাবে না। কাফেরের দোকান থেকে কেনা খাবার মুখে দিলে ধর্মপ্রাণ মুসলমানের ঈমাণ নষ্ট হয়ে যায়।
আরো উদাহরণ দরকার? হয়ত নেই, তবুও আরেকটা দেবার লোভ সামলাতে পারছি না। ইরাকইরাণ যুদ্ধের সময় একদিন বেশ বোমা আক্রমন হয় তেহরাণের ওপর। তাতে জানমালসহ অনেক ক্ষয়ক্ষতি ঘটে শহরের এমন এক পাড়ায় যেখানে দেশের বড় বড় ধনকুবের আর হোমরাচোমরাদের বাস। পরের দিন তৎকালীন উচ্চপদস্থ সরকারি নেতা জনাব রাফসানজানি মসজিদের জামাতে গিয়ে প্রকাশ্যে আল্লাতা’লার কাছে শুকরগুজারি আদায় করেন যে শত্রুপক্ষের বোমা তেহরাণের ধনী গোষ্ঠীটাকে কাবার করে দিয়েছে, দেশের কোনও ক্ষতি হয়নি—আলহামদুলিল্লাহ!

পাঁচ

তেহরাণ বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি হারাবার পর আজার নাফিসি কল্পনা করেননি ইরাণের অন্য কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য পড়াবার সুযোগ হবে আবার। সুযোগ হলেও তাঁর ইচ্ছা থাকবে কিনা তাতেও খুব নিশ্চিত ছিলেন না তিনি। পর্দা থেকে মুক্তি নেই এদেশে, সেটা বুঝে ফেলেছিলেন নাফিসি—পর্দা মেয়েদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করেনা আর, এটাই আইন। বাজারে গেলে দোকানদার চাল-ডাল বিক্রি করবে না তাঁর কাছে পর্দা নাহলে, কাপড়ের দোকানি কাপড় দেখাবে না তাঁকে পর্দা ছাড়া দোকানে ঢুকলে। কশাইখানাতে মাংস কেনার উপায় নেই পর্দা ছাড়া। আপত্তিটা ব্যবসায়ীদের নিজেদের নয়, পর্দাহীন মেয়ের কাছে সওদা বিক্রি করে জানমাল দুটোই হারাতে হতে পারে, সেই ভয়েতে। নাফিসি বুঝতে পেরেছিলেন যে ইরাণের এই আবহাওয়াতে কোথাও তাঁর কর্মসংস্থান হবে না যদিনা তিনি পর্দার কছে মাথা নোয়ান। সেটা কি পারবেন তিনি? নাফিসির মন দ্বিধাসংশয়তে আচ্ছন্ন হয়ে যায় মাঝে মাঝে।
তারপর একদিন এমন হল যে মিসেস রেজভান নামক এক অধ্যাপক তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে জানালেন যে আল্লামা আবাটাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যক্ষ আজার নাফিসির পাণ্ডিত্যপূর্ণ লেখালেখি পড়ার পর খুব করে চাইছেন তাঁকে অধ্যপনার পদে নিযুক্ত করতে—মিসেস রেজভান নিজেও সেখানে ইংরেজি পড়ান। ভদ্রমহিলাকে খুবই চটপটে এবং বেশ আশাবাদী গোছের লোক বলে মনে হল তাঁর। হয়ত অন্যান্যদের মত গোঁড়ামি নেই তাঁর মধ্যে, যদিও তাঁর স্বামীটি নাকি একজন উচ্চপদস্থ মোল্লা ও সরকারি কর্মচারী, এবং সেটাকে মহিলা নিজের সুবিধামতই বেশ কৌশলে কাজে লাগাতে দ্বিধা করেন না। সুতরাং সেদিক থেকে চিন্তা করলে চাকরিটি পত্রপাঠ পায়ে ঠেলে দেবার মত নয়। প্রশ্ন হল তিনি আদৌ চান কিনা সেখানে চাকরি করতে। মিসেস রেজভান অবশ্য একেবারে নাছোড়বান্দা—কাজ আদায় না করে হাল ছেড়ে দেবার মানুষ নন। তিনি বললেনঃ আপনাকে তো এখনই পর্দা পরতে হচ্ছে নিজের দৈনন্দিন জীবনযাপনের জন্যে, রোজ মুদির দোকান আর কশাইর দোকানে যাচ্ছেন পর্দা পরে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পরতে এত আপত্তি কেন? নাফিসির সোজা জবাব তার—বিশ্ববিদ্যালয় কোনও মুদির দোকান বা কশাইখানা নয়। সেখানে বিশ্ব নিয়ে ব্যাপার, সেটা জ্ঞানমন্দির।
বন্ধুবান্ধব হিতৈষী আত্মীয়স্বজন সকলের সঙ্গেই আলাপ করলেন এ নিয়ে। কেউ বললেন দেশের খাতিরে এটুকু ত্যাগ তোমাকে করতেই হবে। কেউবা বললেনঃ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এ তোমার নৈতিক কর্তব্য। তবে এক প্রাক্তন অধ্যাপক বন্ধু যাঁর দূরদৃষ্টি ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার ওপর তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা, তাঁর কথাই শেষ পর্যন্ত নাফিসির সিদ্ধান্তটির সহায়ক হয়ে দাঁড়াল। ভদ্রলোক একরকম তিরস্কারের সুরেই বললেন তাঁকে, দেশপ্রেম, কর্তব্য, দায়িত্ব ওসব বাজে কথা। আসল কথা তোমার মন কি চায়, তুমি সবচেয়ে ভালোবাসো কোন জিনিসটিকে। তোমার ভালোবাসা হল শিল্পের সঙ্গে, সাহিত্যের সঙ্গে এবং সে সাহিত্যের অমৃত স্বাদের ভোজে তোমার ছাত্রছাত্রীদের প্রাণে প্রেরণা জানাতে। তোমার দায়িত্ব তোমার নিজের প্রেমের কাছে, জীবনের সবচেয়ে কাঙ্খিত বস্তুটির কাছে। নাফিসি, তোমার জন্ম হয়েছে ইংরেজি সাহিত্য পড়াবে বলে—অতএব সব দানাইপানাই বাদ দিয়ে সুবোধ বালিকার মত ক্লাসে ঢোক তোমার ফিটসেরাল্ড, অস্টেন আর নাবুকভ নিয়ে। ওটাই তোমার সত্যিকার বাসগৃহ। মনে মনে তিনি সেটা জানতেন, কিন্তু ঠিক ভরসা পাচ্ছিলেন না, জীবনে যা কোনদিন করেননি তিনি, মানে আপাদমস্তক আবৃত অবস্থায় ময়দার বস্তার মত একঘর ছাত্রছাত্রীর সামনে গিয়ে দাঁড়ানো অস্টেন আর জেমস পড়াতে, সেটা আদৌ সম্ভব কিনা তাঁর পক্ষে। হ্যাঁ সম্ভব। ক্লাসে ঢুকে ললিতা আর ডেইজি মিলারের চরিত্র বিশ্লেষণের যে আনন্দ তার কাছে সংসারের আর সবই হার মেনে যায়। প্রাণের চাহিদার মত চাহিদা আর কি আছে বিশ্বজগতে।

ছয়

কিন্তু। সময়ের শাসন বলে একটা কথা আছে। অধ্যাপনার আকর্ষণ অপ্রতিরোধ্য হলেও অধ্যয়নের আবহাওয়া কি দেশের কোথাও ছিল সেসময়? ছিল না। থাকবার কথাও নয়। সরকারের চোখ তো আধুনিক শিক্ষার ওপর নয়, চোখ হল ইসলামী শিক্ষার ওপর। “ইরাণের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে পূর্ণমাত্রায় ইসলামায়িত করে ফেলতে হবে—এতে কোনও আপস মানা হবে না”। চূড়ান্ত বাণী মহান নেতা আয়েতুল্লা খোমাইনির। অর্থাৎ দেশের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী উভয় সম্প্রদায়ের জ্ঞানসাধনার অবারিত স্বাধীনতা সমূলে উৎপাটিত করে ফেলতে হবে—পশ্চিমা প্রভাব থেকে পুরোপুরি ছাড়িয়ে নিতে হবে ওদের। সে অনুযায়ী দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়তেই খোমাইনিবাদ প্রতিষ্ঠা করতে উঠে পড়ে লেগে গিয়েছিলেন সরকার—গুরুত্বের দিক থেকে পর্দার পরেই এর স্থান, তাদের দৃষ্টিতে। প্রথম ধাপে তারা পুরনোদের ঢালাওভাবে ছাঁটাই করে নিজেদের বিপ্লবপন্থী শাসক-প্রশাসক, অধ্যক্ষ-আচার্য ঢোকালেন ক্যাম্পাসকে ইসলামী ক্যাম্পাসে রূপান্তরিত করার লক্ষে। তবে যেটা সবচেয়ে মারাত্মক পদক্ষেপ সেটা ছিল প্রতিটি ক্লাসের ভেতর কট্টর মতবাদের ছাত্রছাত্রী ঢোকানো—তারা একাধারে প্রচণ্ডরকম পশ্চিমবিদ্বেষী এবং উগ্র ইসলামপন্থী। এদের হাতে ক্ষমতা দেওয়া হয় প্রফেসারদের কথাবার্তা আচার আচরণ বেশভূষা চলনবলনের ওপর নজর রাখা, দরকার হলে তাঁদের সন্দেহজনক কর্মকাণ্ডের খবর পাচার করা বড়কর্তাদের কাছে। শুধু তাই নয়। কোনও অধ্যাপক যদি তাঁর ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের জন্যে কোনরকম ভিডিও বা স্লাইডশোর ব্যবস্থা করতে চান পাঠ্যবইরের বাইরের তথ্যাদি সম্পর্কে তাদের ওয়াকিফহাল করার উদ্দেশ্য নিয়ে, তাহলে তাঁর ক্লাসের সেই নেতাস্থানীয় ছাত্রদের কাছ থেকে অগ্রিম অনুমতি চাইতে হবে। তাদের অনুমোদন ছাড়া ছবির মাধ্যমে কোন জ্ঞানই বিতরণ করা যাবে না ক্লাসে। তাতে এমন একটা আবহাওয়া সৃষ্টি হয়ে গেল যে ক্লাসের ভেতরে সত্যিকার ক্ষমতা অধ্যাপকের নয়, তাঁর মাতব্বরগোছের ছাত্রগুলোর। নাফিসির প্রতিটি ক্লাসেই অন্তত একজন ছাত্র বসানো হয়েছিল এধরণের। সাধারণত ক্লাসে তাদের মুখই দেখা যেত না বেশির ভাগ সময়, অথচ রেগে লাল হয়ে যেত তা্রা পাসের নম্বর না পেলে। (আমাদের বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার সঙ্গে খানিকটা মিল নিশ্চয়ই পাঠকের দৃষ্টি এড়াচ্ছে না)।আশার কথা যে অধিকাংশ ছাত্রই ক্লাসে যেত লেখাপড়ার জন্যে, এমনকি যারা বিপ্লবের সপক্ষেও। তারা রাজনীতির সাতেপাঁচে নেই, পশ্চিমের প্রভাব আর পূর্বের প্রভাব দুটোর কোনটাই তাদের প্রধান বিবেচ্য নয়, প্রধান বিবেচ্য তাদের নিজেদের জীবন, তাদের ভবিষ্যৎ, তাদের আশা-আকাঙ্খা, স্বপ্ন। ইংরেজী সাহিত্য পড়তে এসেছে তারা সাহিত্যকে ভালোবাসে বলে, ইংরেজী সাহিত্যের মধ্যে তারা ভিন্নরকমের স্বাদ পায়, এবং তারা আজার নাফিসির পড়ানোর ভঙ্গি পছন্দ করে, তাঁর অগাধ জ্ঞান ও গভীরতা তারা অনুভব করতে পারে সহজেই। তাঁর প্রতি সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল ক্লাসের মেয়েগুলো। তাদের সবারই সারা শরীর বোরখাঢাকা, তবু তাদের মনের ক্ষুধা, জ্ঞানের স্পৃহা, সর্বোপরি নাফিসির পাঠ্যতালিকার উপন্যাসগুলোর চিত্তাকর্ষক চরিত্রগুলোর বর্ণাঢ্য বৈচিত্র্য যা প্রফেসার নাফিসি অত্যন্ত স্বচ্ছ বিশ্লেষণ ও আবেগের সঙ্গে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন সেই উচ্ছ্বাসের উত্তাপ যেন তাদের মনেও বড় একটা জানালা খুলে দেয়। বহির্বিশ্বের নিষ্ঠুর অবরোধের মধ্যে তাদের মনে মুক্তির পিপাসা জাগে।
এক ক্লাসে ঢুকে প্রথমদিনই তিনি লক্ষ্ করেন একটি ছাত্রী যার মুখে পর্দা থাকা সত্বেও তার নড়াচড়ার ভঙ্গীটাই চেনা চেনা মনে হয় তাঁর। ক্লাস শেষ হবার পর মেয়েটি তাঁর পেছন পেছন গেল তাঁর অফিসে। দারুণ সুন্দরি এক পুরনো ছাত্রী তাঁর—নাসরিন। যা ভেবেছিলেন। ওকে দেখে একটু অবাকই হলেন, কারণ তেহরাণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবার সময় সে হঠাৎ করেই একদিন একেবারে উধাও হয়ে গেল। গেল তো গেলই। তার কোনও খোঁজখবরই পাওয়া যায়নি গত সাত বছর।
মেয়েটির অশেষ সম্ভাবনা আছে সেটা তিনি তখনই বুঝতে পেরেছিলেন, কিন্তু বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ করে এমনভাবে গুম হয়ে যাওয়ার কারণ তাঁর বোধগম্য হয়নি। যাই হোক, ওকে দেখে ভীষণ খুশি হলেন প্রফেসার নাফিসি। ঠাট্টা করে বললেন, ক্লাসের সেই টার্ম পেপারটা কিন্তু এখনো পাওনা তোমার কাছে। মনে আছে? গ্যাটসবির ওপর? হ্যাঁ,অবশ্যই মনে আছে। কিন্তু কেন ক্লাস কামাই করে থাকলাম এতগুলো বছর তার একটা কারণ আছে। হ্যাঁ, কারণ তো অবশ্যই থাকবে, মনে মনে ভাবলেন নাফিসি। ইরাণের প্রতিটি নারীরই এখন একটা-না-একটা কারণ প্রস্তুত হয়ে থাকে স্বাভাবিক জীবনধারাতে নিদারুণভাবে রোডব্লক দাঁড়িয়ে যেতে।
নাসরিন তার অভিজ্ঞতাগুলো একে একে বর্ণনা করে গেল এমন শান্ত নিরুত্তাপ গলায় যেন এটা তার নিজের কাহিনী নয়, অন্য কারো কাছ থেকে শোনা গল্প।
ও ছিল রাজনৈতিকভাবে বিরোধী দল মুজাহেদিনের সপক্ষে। একদিন সে তার দুয়েকজন সহমুজাহেদিনকে সঙ্গে নিয়ে প্রচারপত্র বিলি করছিল রাস্তায়—খোমাইনির রাজত্বে সেটা গুরুতর অপরাধ। পুলিশ তাদের সবাইকে জেলে নিয়ে যায়। সাধারণত এরকম “রাষ্ট্রবিরোধী” অপরাধের একটাই শাস্তি—মৃত্যুদণ্ড। কোনও আপিল সুপারিশের উপায় থাকে না। সৌভাগ্যবশত নাসরিনের বেলায় মাননীয় জজসাহেব দয়াপরবশ হয়ে মাত্র দশ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। ঠিক মায়ার শরীর জনাব বিচারপতির, তা হয়ত নয়। আসল কারণ মুরুব্বি—নাসরিনের বাবা নিজে খুব নামাজরোজা করতেন বলে ওপরতলার কিছু মোল্লার সঙ্গে জানাশুনা ছিল। তাঁদের সুপারিশেই নাসরিন ‘দশ বছরের দণ্ড’ পেয়েই খালাশ—বিরোধীদলের লিফলেট বিলি করার অপরাধে! পরে বাবার উপর্যোপরি তদবিরের ফলে তিন বছর জেল খাটার পরই নাসরিন ছাড়া পেয়ে যায়। তবে পুরোপুরি নয়। তার ওপর একপ্রকার গৃহবন্দীত্ব আরোপ করা হয় একাধারে চার বছরের—এ সময়ের মধ্যে কোন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যাবে না, শহরের বাইরে কোথাও ভ্রমণ করা যাবে না, নিজের ঘনিষ্ঠ পরিবারের বাইরে কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে না। কাহিনী শেষ করে নাসরিন একটু হাসবার চেষ্টা করে বললঃ আশা করি এবার বুঝতে পারছেন প্রফেসার কেন আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি আপনার টার্ম পেপার জমা দেওয়া।
তারপর নাসরিন খোমাইনি আমলের জেলখানার আভ্যন্তরীন দৃশ্যাবলির কিছুটা বিবরণ দিয়ে তাঁর প্রিয় প্রফেসারের খানিক জ্ঞানবৃদ্ধি করে। দুটি মেয়ের গল্প। দুজনেরই বয়স বারো। একটি গল্প খুবই সংখিপ্ত, সাদামাঠা। কি এক পর্দাঘটিত অপরাধে বেচারিকে তারা জেলখানাতে ঢোকায়। নিশ্চয়ই ভয়ে তার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। রাতের বেলা সে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে তার মায়ের জন্যেঃ ‘মা, মা’। জেলগার্ডরা তাকে ধমক দিয়ে চুপ করতে বলে। বোকা মেয়ে চুপ হয় না। আরো জোরে কাঁদা শুরু করে। বিরক্ত হয়ে তখন এক গুলিতে তার ঘুলি উড়িয়ে দেয়—মেয়ের কান্না যাদুমন্ত্রের মতই বন্ধ হয়ে যায় মুহূর্তের মাঝে। দ্বিতীয় মেয়েটির গল্প একটু জটিল। ও কোনও প্রকাশ্য অপরাধ করেনি—-একমাত্র দোষ অপরূপ সুন্দরী হওয়া। মূর্খ মোল্লাদের স্থূল মস্কিষ্কে এটা কিছুতেই বোধগম্য হছিল না যে একটা অসামান্য রূপের অধিকারি কিশোরীর পক্ষেও নিষ্পাপ থাকা সম্ভব। এমন চোখ ঝলসানো যার রূপ সে তো কোনক্রমেই সতী থাকতে পারেনা—-খোমাইনি আমলের মোল্লাদের এই ছিল চিন্তাধারা। অতএব তাকে পাকড়াও করে জেলে ঢোকাও, যাতে অন্য কোন পুণ্যাত্মা পুরুষকে পথভ্রষ্ট করতে না পারে। রূপের দোষে জেল—-পৃথিবীতে বোধ হয় এই প্রথম। অন্তত একটা বিষয়ে তো সেসময়কার ইরাণের নাম গিনেজ বইতে স্থান পাবার দাবি রাখে!
তারপর যা হবার হল। মেয়েটাকে জেলরক্ষকরা একের পর এক, ক্রমাগত, মুহূর্মুহূ, অবিরাম, নির্মমভাবে, বনের ক্ষুধার্ত শ্বাপদ জন্তুরা যেভাবে শিকারের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ টুকরো টুকরো করে কামড়ে খায়, তেমনি করে কামড়ে, দুমড়ে, খণ্ড খণ্ড করে ছিন্ন করে, ভোগ করল পুরো একটা মাস। শেষে যখন বেচারির শরীরে দুচারটে শুষ্ক অস্থি ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট থাকল না তখন তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে এই নষ্টা নারীকে কিছুতেই বাইরের পৃথিবীতে ছেড়ে দেওয়া নিরাপদ হবে না—-তার উপস্থিতিতে পুরো দেশটাই কলুষিত হয়ে পড়বে। অতএব একটা বন্দুকের গুলিতেই তারা সে সমস্যার সমাধান করে ফেলল। জিন্দাবাদ মোল্লাবাদ!
নাসরিনের বর্ণনা সবটা শুনতে পেরেছিলেন কিনা আজার নাফিসি নিজেও বলতে পারবেন না। এধরণের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েই তো হরার মুভি তৈরি হয়, তৈরি হয় বিভীষিকার স্বপ্ন দেখে গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে চিৎকার করে ওঠার গল্প। আজার নাফিসির মুখে শব্দ বেরুল না অনেকক্ষণ।

সাত

নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ছাত্রছাত্রী আর নতুন সহকর্মীদের সংস্পর্শে আজার নাফিসির মনে যদি নতুন আশা সঞ্চার হয়ে থাকে কিঞ্চিৎ সে-আশাতে বৈরি হাওয়া ধীরে ধীরে বইতে শুরু হতে সময় লাগেনি। এটা তো ইরাণের কোনও নাগরিকের পক্ষে এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলে যাওয়া সম্ভব নয় যে দেশটিতে তখনো ইমাম খোমাইনির একনায়কত্ব দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর প্রতিটি কথা, প্রতিটি শ্বাসপ্রশ্বাস ঐশ্বরিক আশীষপুষ্ট, যার ওপর কোনও আইন নেই, কোনও সালিশ সুপারিশের পথ নেই—খোমাইনি যে পথটি দেখিয়ে দিয়েছেন দেশবাসীকে ওটাই একমাত্র পথ। ওটা জান্নাতে ফেরদৌসের পথ। তিনি হুকুম করেছেনঃ ইরাণের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পূর্ণমাত্রায় ইসলামায়িত করে ফেলতে হবে, এতে কোনও আপস বা ব্যতিক্রম চলবে না। পশ্চিমের দূষিত প্রভাব থেকে দেশের তরুণদের উদ্ধার করতেই হবে। ওরাই আমাদের ভবিষ্যৎ—এবং আমাদের ভবিষ্যৎ এখন আমাদেরই হস্তগত।
অতএব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ইসলামায়িত করার কাজে সহয়তাদান প্রতিটি ইরাণী নাগরিকের নাগরিক কর্তব্য। নাফিসি হয়ত ভেবেছিলেন পর্দার কাছে মাথা নত করেই তাঁর কর্তব্য পালন করে ফেললেন, কিন্তু না, তাঁর দ্বিতীয় এবং পর্দার মতই গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য হল ক্লাসরুমের ভেতর, যেখানে তিনি পশ্চিমের ‘চরিত্রহীন’ লেখকলেখিকাদের প্রনীত উপন্যাস থেকে অধিকতর দুশ্চরিত্র নায়কনায়িকার কথোপথন আর গল্পকাহিনী পড়াতে পড়াতে এত উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েন—মোল্লাতন্ত্রের প্রধান সমস্যা সেখানে। তারা ভয়ানক উদ্বিগ্ন এই অবোধ ছাত্রছাত্রীগুলো না-জানি কোন সর্বনাশের পথে পরিচালিত হয়ে যাচ্ছে এই ইয়াংকি-ঘেঁষা মহিলা অধ্যাপক দ্বারা। সুতরাং সঙ্গতকারণেই কর্তৃপক্ষ তাঁর ক্লাসরুমেই দুয়েকজন বাছাই করা ইমানদার মুসলিম ছাত্রকে ঢুকিয়ে দিলেন যাতে তারা ওঁর ওপর কড়া নজর রাখতে পারে। এদের মধ্যে একজনের নাম মিস্টার ধোমি; দ্বিতীয়জন মিস্টার ফরসাটি। দুজনের কেউই প্রত্যহ ক্লাসে এসে মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনার করার কোনরকম গরজ বোধ করত না—অদের দায়িত্ব শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা নয়, শিক্ষককে শেখানো! মহান নেতা সে-দায়িত্ব দিয়েছেন্ তাদের ওপর। তারা ক্লাসে আসত কালেভদ্রে—-এসে বা এসাইনমেন্ট লিখে যথাসময়ে জমা দেওয়ার কোনও দায়িত্ব তারা মানত না। মাঝে মাঝে দর্শন দিত তারা অধ্যাপকের সঙ্গে পশ্চিমা উপন্যাসের চরিত্রগুলোর চারিত্রিক উচ্ছৃংখলার তীব্র নিন্দা প্রকাশ করার জন্যে—-এসব ইসলামবিরোধী, চরিত্রনাশক, ভ্রষ্ট পশ্চিমের পুঁতিগন্ধময় ঘৃণ্য দ্রব্যের প্রতি কেন এত আকৃষ্ট তিনি এবং কেন এসব অকথ্য জিনিস আমাদের কচি কচি নিষ্পাপ নিরীহ ছেলেমেয়েদের কানে ঢালছেন দিনের পর দিন, তার একটা যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দাবি করতে।
এ এক দুঃসহ পরিবেশ। নাফিসি ভাল করেই জানতেন এরা কারা। ইরাণের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়তে ঠিক একই অবস্থা সেসময়। ভর্তির সময় একটা বিশেষ ‘কোটা’ রাখা হতঃ ওটার নাম ছিল ‘রাজনৈতিক কোটা’ ( ঠিক আমাদের দেশের সরকারি কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মত, যেখানে মেধার কোটার চেয়ে মূল্যবান কোটা হল রাজনীতির কোটা)। এই কোটাতে যারা ভর্তি হয় তাদের কোন ক্লাস করার প্রয়োজন হয়না, তারা হল ইসলামের পাহারাদার, তাদের আবার ক্লাস কিসের! ইসলামের চেয়ে বড় জ্ঞান আর কে দেবে—ইসলামের খেদমতের চেয়ে বড় জ্ঞান আর কার দেবার ক্ষমতা আছে?
আজার নাফিসির সমস্যা অবশ্য বাইরের এই দম-আটকানো নারকীয় পরিবেশ নয়, সমস্যা হল তাঁর নিজের বিবেক নিয়ে। পর্দা নিয়ে আপস করা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়, কিন্তু শিক্ষার বিশুদ্ধতা, জ্ঞানের নির্ভেজালতা, তার সঙ্গে আপস তিনি করবেন কেমন করে—- এ তো তাঁর নিজের অস্তিত্বের সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা করার শামিল, যেন তাঁর আত্নাটিকেই বাজারের সস্তা পণ্যদ্রব্যের মত বিক্রি করে সামান্য কটি মুদ্রা নিয়ে ঘরে ফিরছেন পাঁড় মাতাল যেমন করে টলতে টলতে ফেরে। আর যা’ই সম্ভব তথাকথিত ‘দেশের’ জন্যে, এমনকি নতুন প্রজন্মেরই জন্যে, নিজের আত্নাকে তো কোনক্রমেই বিকোতে পারেন না। ইমামসাহেব ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন বলেই তিনি ইংরেজি সাহিত্যের ক্লাসে ‘প্রাইড এণ্ড প্রেজুডিস’ আর ‘ওয়াদারিং হাইটস’ না পড়িয়ে ইমাম খোমাইনির বাণী পড়াতে পারেন না। তাঁকে যদি আধুনিক ইংরেজি উপন্যাসের স্বাদ দিতে হয় দেশের রসকষ বঞ্চিত ক্ষুধার্থ তরুণদের, যদি তাদের প্রাণেও সেই উপন্যাসের যাদুকরি চরিত্রগুলোর মত মুক্তির পিপাসা, সুন্দর সার্থক জীবনের পিপাসা জাগাতে হয় তাহলে কেমন করে তিনি মোল্লাদের খেয়ালখুশিমত ধর্মের সস্তা বুলিতে তাদের সে তৃষ্ণা মেটাবেন। না, তা সম্ভব নয় কোনও সৎ শিক্ষকের পক্ষে। শিক্ষকের কাজ তার শিক্ষার্থীদের স্বপ্নের দ্বার রুদ্ধ করা নয়, নব নব স্বপ্নপুরির সন্ধান দেওয়া। সৎ শিক্ষকের কাজ কল্পিত কাহিনীর কাল্পনিক চরিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে এই অবরুদ্ধ দেশটির প্রবঞ্চিত, প্রতারিত প্রজন্মের প্রাণের মাঝে কল্পনার অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করে তোলা, তাদের বাধাবন্ধহীন চিন্তার আকাশে নতুন তারকা সঞ্চার করা। এ তাঁর নির্বাচিত পেশার কাছে প্রদত্ত অঙ্গীকার—এ থেকে ভ্রষ্ট হয়ে পড়াটাই তাঁর জন্যে সত্যিকার চারিত্রিক স্খলনের শামিল। এ যে তাঁর ধর্ম, পৈতৃক ধর্মের চেয়ে যার মূল্য শতগুণ বেশি।
অথচ এই প্রচারসর্বস্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুর্বলচিত্ত এবং বহুলাংশে ক্ষীণবুদ্ধি প্রশাসকদের সাথেই দায়দরবার করতে হয় নিয়মিত, রিপোর্ট লিখতে হয় দিস্তা দিস্তা, অধ্যাপনার বিষয়বস্তু আর উদ্দেশ্য নিয়ে অন্তহীন আলোচনাতে নষ্ট করতে হয় অমূল্য সময়। এই বড়কর্তাদের প্রায় সকলেই পুরুষ এবং মনেপ্রাণে মোল্লাভক্ত, সুতরাং মহান নেতার অন্ধ সমর্থক। নাফিসি যখন তাদের সঙ্গে দেখা করতে যান তখন পর্দা করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন না—কিন্তু পর্দাহীন নারীর সঙ্গে তাঁরা কখনোই সহজভাবে কথা বলতে পারেন না। হয়ত তিনি মুখোমুখি বসে কথা বলছেন অথচ তাঁর বস একবারও তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন না। কথা বলছেন একজনের সঙ্গে, চোখ রাখছেন অন্য কারো দিকে, কিম্বা কোন জানালা, টেবিল বা নিজের আঙ্গুলের দৃঢ় বেষ্টনীতে আবদ্ধ ক্রমঘূর্ণায়মান পেন্সিলের দিকে। এ এক অদ্ভুত, অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। একজন উচ্চশিক্ষিত, বিবাহিত মহিলা অধ্যাপকের মুখের দিকে তাকালেই কি কোনও পুণ্যবান মুসলমানের ধর্ম নষ্ট হয়ে যায়? কে জানে, হতেও পারে। আজার নাফিসির জীবনের অনেকটা সময়ই তো নাসারাদের দেশে অতিবাহিত হয়েছে। তাঁর পক্ষে এসব সূক্ষ বিষয় অনুধাবন করা সহজ হবে কেমন করে। একটা মজার গল্প সেসময় ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলাবলি হচ্ছিল। এক কলেজে-পড়া যুবক যুদ্ধে গিয়ে বন্দুক উঁচিয়ে শত্রু নিধন করার মুহূর্তে একটি মৃত, যুবতী মেয়ের উন্মুক্ত গোড়ালি দেখে অন্যমনষ্ক হয়ে পড়ে, অর্থাৎ তার যৌন উত্তেজনাবোধ এসে যায়। তখন সে শত্রু মারবে না নারীর উলঙ্গ পায়ের নখ আর গোড়ালি দেখবে সে সমস্যার সমাধান হতে-না-হতেই তারই বুকে লেগে যায় গুলি। ইরাণে মরা মেয়ের খোলা গোড়ালিও অত্যন্ত মারাত্নক অস্ত্রতে পরিণত হতে পারে, এমন একটি উক্তি করেছিল নাফিসির সেই ঠোঁটকাটা ছাত্রী নাসরিন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ক্রমেই অসহনীয় হয়ে উঠছিল। সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী ক্লাসের ভেতর একমাত্র একজন মানুষের কথাই শেষ কথা—তিনি যা বলবেন অন্যদের তা মেনে চলতে হয়। কিন্তু ইরাণের মোল্লাতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতায় সেই সহজ সমীকরণের মূল ফর্মুলাটি আগাগোড়া পালটে গিয়েছিল। প্রফেসারদের সম্মতি আছে কি নেই সামান্য ভদ্রতার খাতিরেও সেটা জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করত না সেযুগের রাজনীতিপরায়ন ছাত্ররা। যখন খুশি তখন ক্লাস ক্যান্সেল করে দিচ্ছে—আর হতভম্ব প্রফেসার বোকার মত হাঁ করে তাকিয়ে আছেন। তাঁদের কিছু করার সাধ্য নেই। বাধা দিতে যাওয়া মানে সমূহ বিপদ ডেকে আনা, নিজের ওপর শুধু নয়, তাঁর সমস্ত পরিবারের ওপর। ক্লাস যদি আদৌ তারা করতে দেয়, তাহলেও ছাত্রছাত্রীরা তাঁর লেকচার শুনতে পারে না, শুনলেও কোন প্রশ্ন-আলোচনাতে অংশ নিতে পারেনা, বাইরের হলে অনুক্ষণ গোলমাল আর চেঁচামেচি চলতে থাকে বলে। স্বাভাবিক পুরিস্থিতিতে প্রফেসারের এক ধমকেই সবাই চুপ হয়ে যেত, কিন্তু ইরাণের অবস্থা তখন স্বাভাবিক ছিল না—একেতো পশ্চিমের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে ইসলামের আমরণ সংগ্রাম, তার ওপর ইরাকের যুদ্ধ। এই পরিস্থিতিতে ধমকটা আসে ছাত্রদের কাছ থেকে, প্রফেসার সেখানে নীরব দর্শক মাত্র।
সবচেয়ে দুঃখজনক বিড়ম্বনাটি হল আজার নাফিসির মত বিবেকবান, একনিষ্ঠ এবং মুক্তমনা প্রফেসারদের জন্যে। রাজনৈতিক নেতাদের মন রক্ষা করাই তাঁর অধ্যাপনা জীবনের লক্ষ্ ছিল না, বা ওদের চিন্তাধারার সঙ্গে একমত হয়ে শিক্ষাকে একটা পূর্বপরিকল্পিত ধারাতে এগিয়ে নেওয়াতেও বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না তাঁর। কোনও সৎ, সাধু ও উচ্চশিক্ষিত শিক্ষকের পক্ষে কখনোই তাঁর আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়ে গড্ডালিকা প্রবাহের সঙ্গে নিজেকে সমর্পণ করে দেওয়া সম্ভব নয়। তার চেয়ে বরং কাজে ইস্তফা দিয়ে আপন গৃহের স্বাধীন নিলয়ে আশ্রয় নেওয়া অনেক সম্মানজনক।
অবশেষে যুদ্ধ থেমে গেল একদিন কোনরকম ঢাকঢোল বজ্রবাদ্য ছাড়াই। আপনা থেকে থেমে যায়নি, অনেক বাদানুবাদ আর দাবিদাওয়া নিয়ে আপস-মীমাংসা হবার পর—দুপক্ষেই, যা আল্লামা বড়মুখে পণ করেছিলেন কখনোই সমর্থন করবেন না। সন্ধিপত্র স্বাক্ষর হয়ে গেলে মহান নেতা দেশবাসীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন যে ইরাকের সঙ্গে সন্ধি করা তাঁর জন্যে ছিল বিষ পান করার চেয়েও কষ্টকর। আসলে সন্ধিতে রাজী তিনি হতেন না যদি না বাগদাদের সেই জালেমটি তেহরাণের জনসাধারণের ওপর বিষাক্ত বায়বীয় আক্রমণের হুমকি না দিতেন। নিজ দেশের কুর্দিজাতির ওপর যে এই মারাত্মক বোমা নিক্ষেপ করতে পারে তার পক্ষে তেহরাণের ওপর অনুরূপ হামলা করা খুবই স্বাভাবিক।
সন্ধিস্থাপনের শর্তটর্ত যা’ই হোক, ইরাণের যুদ্ধক্লান্ত জনগণের কাছে যুদ্ধ যে সত্যি সত্যি থেমে গেছে সেটাই ছিল বড় সংবাদ—আর সব জাহান্নামে যায় যাক। তারা স্বাভাবিক শান্তিপূর্ণ জীবনে ফিরে যেতে পারবে, তারপর আর ‘যদি’ ‘কিন্তু’ ‘কেন’র জায়গা থাকে না। সাধারণ মানুষ যুদ্ধের জয়পরাজয় নিয়ে মাথা ঘামায় না, তাদের প্রধান চিন্তা পরিবারের নিরাপত্তা, দৈনন্দিন জীবনযাপনের পথে অহেতুক বাধার সম্মুখিন না হওয়া।
যুদ্ধ শেষ হবার প্রায় একবছর পর আল্লামা খোমাইনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। তারিখটা ছিল ৩রা জুন, ১৯৮৯। স্বভাবতই খবর শোনা মাত্র সারা দেশ শোকের সাগরে ভেসে গেল। পুরো চারদিন সরকারি অফিস-আদালত সব বন্ধ। স্কুলকলেজ ছুটি তারও বেশি। তার কিছুদিন পর ক্যাম্পাসে ঘটল এক ভয়াবহ ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের খোমাইনিপন্থী এক ছাত্রনেতা যুদ্ধে গিয়ে স্নায়বিক বৈকল্যঘটিত রোগে আক্রান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে আসে। যার ফলে সৈনিক হিসেবে তার যোগ্যতার ওপর সন্দেহ প্রকাশ হতে থাকে রাজনৈতিক মহলে। সে কি সত্যি সত্যি কোনও রোগে আক্রান্ত হয়েছে, না, ভয়ে কাতর হয়ে পেছনদিকে দৌড় দিয়েছে? মোটকথা ছেলেটির যা কিছু প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল যুদ্ধে যোগ দেবার আগে সব ভেস্তে যায় লজ্জাবনতমুখে ফিরে আসার পর। একসময় সে ছিল ক্যাম্পাসের একজন ডাকসাঁইটে নেতা, এখন তার দিকে ফিরেও তাকায় না কেউ। সে আছে কি নেই সেদিকে কারো ভ্রূক্ষেপ নেই। কিছুদিন আগে যে ছিল সামবডি, আজকে সে নোবডি। যুদ্ধ তাকে বিশাল একটা ভাবমূর্তি দিয়েছিল, যুদ্ধ থেমে যাবার পর সেসব একেবারে ধূলায় মিশে গেছে। আল্লামা খোমাইনি একবার বলেছিলেনঃ এই যুদ্ধ বড় নেয়ামত আমাদের জাতির জন্যে। অতি ভাগ্য আমাদের যে আমরা নিজ দেশের জন্যে যুদ্ধে যেতে পেরেছি। হ্যাঁ, সেই হতভাগা ছেলেটির জন্যে যুদ্ধ আসলেই মানুষের ভাগ্য ফিরিয়ে দিয়েছিল, অন্তত ওর মত বিপ্লবী ছাত্রনেতাদের। যুদ্ধ থেমে যাওয়াতে তাদের ভাগ্যও বুঝি ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গেছে। এই ছেলেটির জীবনে যুদ্ধসমাপ্তি এসেছে অভিশাপ হয়ে। যুদ্ধগামী নেতাদের ভাবমূর্তি যা তৈরি হয়েছিল যুদ্ধের কল্যানে তা মাটিতে মিশে যায় শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর। তখন তাদের কোনও সম্মান থাকে না জনগণের কাছে, থাকে না সরকারের কাছেও। তারা মানসিকভাবে দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ে। যুদ্ধফেরত সৈন্যদের এই করুণ দশাটি প্রায় প্রতিটি দেশেরই অতি পরিচিত দৃশ্য।
ঘটনার দিন সেই ছেলেটি কোথা থাকে এক জগ গ্যাসোলিন জোগাড় করে একটা খালি ক্লাসরুমে ঢুকে পুরো জগের গ্যাসোলিন সর্বাঙ্গে ঢেলে দেয়। মুহূর্তের মাঝে বাইরের হলঘরে ছাত্রছাত্রীদের ভিড় জমে গেল—ওর উত্তেজিত চেহারা দেখে কেউ তার কাছে ভিড়তে সাহস পায়নি। ও তখন চিৎকার করে বলে উঠলঃ তোমরা বিশ্বাসঘতকতা করেছ আমাদের সঙ্গে। মিথ্যা ছলনায় আমাদের ভুলিয়ে ভালিয়ে জীবনে্র সবকিছু বিসর্জন দিয়ে এক অর্থহীন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্ররোচিত করেছ। তোমরা প্রতারক, মিথ্যাবাদী। আমাদের জীবন নিয়ে তোমরা ছিনিমিনি খেলা খেলেছ। তোমরা জাহান্নামে যাও।
এ বলে সে দেশলাইর কাঠি জ্বালিয়ে আগুন লাগিয়ে দিল গায়ে। তৎক্ষণাৎ দাউ দাউ করে তপ্ত আগুনের লেলিহান শিখা ওকে গ্রাস করে নিল আপাদমস্তক—তার জ্বলন্ত শরীর হয়ে উঠল ভয়াবহ এক কৃষ্ণবর্ণ কাষ্ঠখণ্ড। হলঘরে ইরাণের তরুণ ছাত্রদল বিষ্ময়বিমূঢ়, বিস্ফারিত চোখে অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকল চলচ্ছক্তি হারিয়ে। এ যেন গোটা দেশটারই সকল আশা আকাঙ্খার চূড়ান্ত পরিণতি।
ছেলাটাকে নিয়ে এবার সদর রাস্তায় ঘটা করে শোকযাত্রা হয়নি, যেমন হয়ে থাকে যে-কোনও আল্লামার এন্তেকালের পর, কিম্বা হত ‘মহান যুদ্ধে’ শহীদ হয়ে জান্নাতগামী কোনও কিশোরের লাশ মাথায় করে শোকের রাহাজারিতে আকাশ পাতাল টালমাতাল করে তোলার সময়। এ-মৃত্যু কোনও মহৎ মৃত্যু নয়। এ-মৃত্যুতে কারো গৌরব নেই, এ-মৃত্যু যে দেশের মুখ-কালো-করা নিদারুণ লজ্জার মৃত্যু। এ-মৃত্যু হারাম মৃত্যু—কলঙ্কময় মৃত্যু। এ মৃত্যুকে গলা টিপে মেরে ফেলতে হবে ‘বিপ্লব’এর খাতিরে, দেশের খাতিরে। শোনা গেল বেচারির সংসারে এক বৃদ্ধা মা ছাড়া আর কেউ ছিল না—বড় কষ্টে তাদের সংসার চলত—-কোনরকমে দিন এনে দিন খেত। বিপ্লবের পর তার মন নতুন আশা-উদ্দীপনায় ভরে উঠেছিল। ভেবেছিল এবার যদি তাদের ভাগ্যের চাকা ঘোরে কিঞ্চিৎ। তাই সে খোমাইনির ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি। শহীদ হলে তো শুধু যে সে বেহেশতে চলে যেতে পারত সরাসরি (মহান নেতা তো সেই মর্মে একটা চিরকুট লিখেই রেখেছিলেন সব তরুণ সৈন্যদের গলাবন্ধে), তার ওপর তার দুঃখিনী মায়েরও একটা সুসংস্থান করে দেবেন সরকার সেরকম প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কোথায় গেল সেসব। সব পুড়ে ছারখার।

আট
প্রফেসার নাফিসি এবার নিজেই পদত্যাগ করে বেরিয়ে এলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা দিয়ে—এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে এখন ‘বিশ্ব’ বা ‘বিদ্যা’ কোনটারই কোনও সংশ্রব নেই, এ-সিদ্ধান্তটি অনেক আগেই আকার নিচ্ছিল মনে। সেদিন সেটা কার্যকরি করে বেশ হালকা বোধ করেন তিনি। এবং আগেরবারের মত ‘তারপর কি হবে’ নিয়ে কোনও শূন্যতাবোধেও ভুগছেন না। মনে মনে ঠিক্ করে রেখেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পর কিভাবে সময় কাটবে তাঁর। প্রথমত একটা বই লেখার পরিকল্পনা অনেকদিন থেকেই দানা বেঁধে উঠছিল মনে। দ্বিতীয়তঃ, যা প্রথমটির সঙ্গে জড়িত, নিজের লিভিং রুমেই একটি পাঠচক্র দাঁড় করাবেন, যেখানে তাঁর সাহিত্যানুরাগী ছাত্রছাত্রীদের মাঝ থেকে বাছাই করা সবচেয়ে বেশি আগ্রহী যারা তাদের আমন্ত্রণ জানাবেন সেই ক্লাসে যোগ দিতে। তারা আসবে ইংরেজি সাহিত্যের আকর্ষণীয় চরিত্রগুলোর সঙ্গে নিবিড় ঘনিষ্ঠতার পরিবেশে আলাপচারিতায় লিপ্ত হতে, তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো এপিঠ-ওপিঠ উল্টে-পাল্টে পরীক্ষা করে দেখতে, বুঝতে। সর্বোপরি তাদের নিজেদের কল্পনার রাজ্যটি কতটা সম্প্রসারিত হতে পারার সুযোগ পেল ওই চরিত্রগুলোর ভেতর দিয়ে, এবং নিজ নিজ জীবনের নানা অভিজ্ঞতার সাথে কোথায় তাদের মিল বা কোথায় মিলের অভাব তা’ও পরীক্ষা করার সুযোগ পাবে। নাফিসি নিজে থেকে যাদের আমন্ত্রণ পাঠালেন তারা সবাই তাঁর ক্লাসের ছাত্রী—-নাসরিন, ইয়াসি, মাহসিদ, আজিন, সানাজ, মান্না। মান্নার একটি ছেলেবন্ধু ছিল যার নাম নিমা—-ভীষণ মুক্তমনা ও আধুনিক মনোভাবের ছেলে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে নাফিসির ক্লাসেই যেত। অত্যন্ত মেধাবী ও তীক্ষ্ণ বোধসম্পন্ন একটি অসাধারণ ছাত্র। দুটিতে বিয়ে হবে এমন একটা পাকাপাকি ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছিল বলেই প্রকাশ্যে একসাথে ঘোরাফিরি করার সাহস পেত তারা। তার অর্থ এই নয় দুজনে হাত ধরাধরি করে নিশ্চিন্তে, খুশিমনে হাঁটাহাঁটি করতে পারত রাস্তায়। ইরাণে কখনোই সেটা সম্ভব নয়।
প্রফেসার নাফিসি কেন শুধু মেয়েদের নিয়েই ক্লাস করতে চেয়েছিলেন তার কারণ তো দুর্বোধ্য কিছু নয়—তাঁর বাড়িটাই বোধ হয় একমাত্র জায়গা যেখানে তারা মন খুলে কথা বলবার সাহস পেত, এমনকি ইচ্ছে হলে অনেক দুর্বিনীত, উদ্ধত কথাও। নাফিসির শিক্ষাদীক্ষা সবই বলতে গেলে পশ্চিম বিশ্বের বাধাবন্ধহীন উণ্মুক্ত পরিবেশে, যেখানে ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রধান শর্ত, নির্ভয়ে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করার সহজাত অধিকার, বিশেষ করে মুক্তচিন্তার অবাধ স্বাধীনতা। যা তৎকালীন মোল্লাশাসিত ইরাণে একেবারেই ছিল না। ওই পরিবেশটি অত্যন্ত প্রয়োজন পশ্চিমজগতের আধুনিক উপন্যাস নিয়ে বস্তুনিষ্ঠভাবে আলাপ আলোচনা করতে, যেটা কিছুতেই পারা যাচ্ছিল না ধর্মবাতিকগ্রস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রফেসার নাফিসির ক্লাসে এসে তারা নারী হতে পারত, নিজেদের আত্মসত্তা খুঁজে পেত, ফিরে পেত তাদের নিজ নিজ পরিচয়, সর্বোপরি, তাদের মনুষ্যত্ব। ওরা তাঁর ক্লাসে আসার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে সারা সপ্তাহ—দিন গোণে, সময় দেখে ঘড়িতে। এমনিতে তাদের ‘সময়ে’র কর্তৃত্ব তাদের দখলে থাকে না, থাকে পরিবারের পুরুষদের দখলে। বাবা, ভাই বা এরকম কোনও ঘনিষ্ঠ নিকটাত্মীয় না হলে তো তারা বাড়ি থেকে পা বাড়াতে পারত না—অর্থাৎ নাফিসির ক্লাসে আসতেও কোনও ‘বৈধ’ পুরুষকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে হত। শানাজ মেয়েটিকে সেখানে নিয়ে যাবার দায়িত্ব ছিল ওর ছোটভায়ের—ওর চেয়ে বয়সে ছোট পুঁচকে ভাইটিই ছিল বেচারির ‘লিগ্যাল গার্ডিয়ান’। সে তার হালফ্যাশানের আমেরিকান গাড়ি হাঁকিয়ে বোনকে প্রফেসারের দরজায় নামিয়ে আঙ্গুল উঁচিয়ে শাসিয়ে যেত যেন ফিরে যাওয়ার সময় কোনরকম টালবাহানা করে দেরি না করে ফেলে। এমনই দুঃসহ অবস্থা ছিল সেসময়কার ইরাণি মেয়েদের—-একমাত্র পুরুষ লিঙ্গ নিয়ে জন্মানোর ফলে কনিষ্ঠ ভ্রাতাও অনায়াসে তার ‘অভিভাবক’ হয়ে যেতে পারত।
নাফিসির বাড়িতে ঢোকামাত্র ওরা বোরখা খুলে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। ভেতরে তারা যেভাবে খুশি সেভাবেই পরে পোশাক আশাক—কেউ কেউ রুজ লিপ্সটিক লাগাতেও দ্বিধা করে না। নাফিসির ক্লাসের কোন কোন মেয়ে হয়ত হাতকাটা পাতলা জামা পড়ে এল একটা, যদিও সেটা একেবারে বিপদমুক্ত তা কিন্তু নয়—ধর্মপুলিশদের মেয়ে-সদশ্যগণ মাঝে মাঝে বড় রাস্তায় হয়ত একটা মেয়েকে পাকড়াও করে শুরু করে দিল বোরখার নিচে কি পোশাক পরেছে মেয়ে তার তল্লাশী। শরিয়াবিরোধী কোনকিছু পেলে তো মেয়ের রক্ষা নেই— পশ্চিমা বিলাসদ্রব্য হলে তো সর্বনাশ। জেলহাজত থেকে তাকে বাঁচানোর সাধ্য কার। নারীর যৌন আবেদনকে মোল্লাদের দারুণ ভয়। হবার কথাই, যেখানে একটা মেয়ে কিভাবে আপেলে কামড় দেয় তাতেও তাদের অংগপ্রত্যঙ্গে অগ্নিসংযোগ হবার অবস্থা দাঁড়ায়। নাসরিন তার এক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে যৌনবিষয়ে মোল্লাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উদাহরণ দিচ্ছিল একদিন। এক বিশাল নামজাদা, দরবেশতুল্য আল্লামা তাদের পারিবারিক বন্ধু ছিলেন। নাসরিনের বয়স যখন দশ আর এগারোর মাঝামাঝি তখন তাঁর ওপর মেয়েকে আরবিশিক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয় । আরবির পাশাপাশি কিছু অঙ্ক আর বিজ্ঞানও পড়াতে পারতেন তিনি—বিরাট বিদ্বান ব্যক্তি বলেই। মেয়েদের চারিত্রিক পবিত্রতা ও পুরুষজাতির যৌনসংযম নিয়ে তাঁর অনেক দামি দামি বক্তব্য সর্বজনবিদিত—সম্ভবত সেকারণেই বাবামা তাঁর কাছে কিশোরি কন্যার দায়িত্ব অর্পণ করে নিরাপদ বোধ করেছিলেন। স্বাভাবিক—তাঁর মত পূতপবিত্র পুরুষ তো সারা মুল্লুক খুঁজে পাবার উপায় ছিল না।
যাই হোক, নাসরিনকে আরবি পড়াতেন তিনি একটা টেবিলের একপাশে বসে—ছাত্রী আর শিক্ষক একেবারে পাশাপাশি বসা, যাতে পড়া বুঝাতে সুবিধা হয়। সমস্যা হল যে মানুষের হাতের সংখ্যা দু’টি। একটির ব্যবহারই যথেষ্ট পড়া বুঝাতে—দ্বিতীয়টিকে একেবারে অকেজো রাখা তো ঠিক নয়। সুতরাং তাঁর সেই পবিত্র হস্তখানি টেবিলের তলা দিয়ে অনায়াসে খুঁজে পায় নাসরিনের হাঁটুর ওপরকার মাংসপেশি, এবং অদূরবর্তী অন্যান্য লোভনীয় দ্রব্যাদি। এভাবে তাঁর উভয় হস্তের অবাধ ব্যবহার চলে ছাত্রীর সুশিক্ষা সন্তোষজনকভাবে সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত। গল্পটা শেষ করে নাসরিন তার ঠোঁটের বাঁকা হাসিতে উপস্থিত সকলকে বুঝিয়ে দেয় যে তারা যখন নিজেদের কন্যাসন্তানের দায়িত্ব নিয়ে সমস্যায় পড়েন তখন যেন একটু সাবধানতা অবলম্বন করেন।
আরেকদিন আরো এক ব্যক্তিগত গল্প শুনিয়ে সবাইকে স্তম্ভিত করে দেয় নাসরিন। গল্পটা ওর মাকে নিয়ে। তেহরাণের এক সম্ভ্রান্ত, উচ্চশিক্ষিত, আধুনিক পশ্চিমা সংস্কৃতি ও আচার আচরণে অভ্যস্ত পরিবারের দ্বিতীয় কন্যা ছিলেন তিনি। বাড়িতে দৈনন্দিন জীবনের প্রায় সবকিছুতেই পশ্চিমের প্রভাব—-পোশাক আশাক থেকে শুরু করে খাবার দাবার কথাবার্তা সবকিছু। একসময় বাবামা ভাবলেন মেয়ে তো পুরোপুরি মেমসাহেব হয়ে যেতে পারে না, কিছু ধর্মশিক্ষাও দরকার। বিশেষ করে আরবি। এক তরুণ, দাড়িওয়ালা পাক্কা মুসলমান ছেলে নির্বাচন করে তাঁরা নিশ্চিন্তে মেয়ের আরবিশিক্ষার ভার ছেড়ে দেন । তাতে কোনও সমস্যা হয়ত হত না, কিন্তু মেয়ে নিজেই সমস্যা সৃষ্টি করে ফেলল—বিরাট সমস্যা। সে মৌলবিসাহেবের প্রেমে পড়ে গেল। পড়ে গেল মানে ডুবে গেল আকন্ঠ—ওই বয়সে মেয়েদের যা হয় অনেকসময়। আধুনিক বাবামা মেয়ের মনরক্ষার জন্যে রাজি হয়ে গেলেন সেই বিয়েতে। তারপরই শুরু হল বাস্তব জীবন। মুর্খ প্রেমের মাশুল দিতে হল জীবনের বিনিময়ে। তাঁর স্বপ্ন ছিল আমেরিকায় গিয়ে পড়াশুনা করবেন, আর স্বামীর স্বপ্ন হয়ত ছিল একটি সতীসাধ্বী পতিব্রতা বিবি যে পর্দা ছাড়া বাড়ির বাইরে পা বাড়াবে না, বছর বছর বাচ্চা পয়দা করবে, শ্বশুর-শ্বাশুরির সেবা করবে, পরিবারের খানাবিনা হালহকিকতই যার হবে একমাত্র সাধনা–ধর্মপ্রাণ পুণ্যবানরা যা স্বাভাবিকভাবেই আশা করেন। তবে নাসরিনের বাবা অন্যান্য মোল্লাদের মত একেবারে দয়ামায়াহীন ছিলেন না—স্ত্রীর মনরক্ষার জন্যে তাঁকে পশ্চিমা খাবার রাঁধবার অনুমতি দিতেন মাঝেমধ্যে। পশ্চিমা খাবার মাত্রেই তাঁর ভাষাতে ছিল ফরাসী খাদ্য। মা তাতেই কৃতজ্ঞ থাকতেন—এ ছাড়া উপায়ই বা কি ছিল। তাঁর তো আর কোন সখের জিনিস করার স্বাধীনতা ছিল না— এমনকি জানালা খুলে বাইরের খোলা বাতাস প্রাণ ভরে গ্রহণ করবারও সাহস ছিল না, পাছে না কোনও ধর্মপুলিশের নেকনজরে পড়ে যান।
এক নিঃশ্বাসে মাতৃজীবনের একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেবার পর সে হঠাৎ এমন একটা কথা বলে ফেলল যাতে নাফিসিশুদ্ধ ঘরের সবাই যেন চমকে উঠল—সর্বনাশ, এ কি বলছে মেয়ে! বললঃ মাঝে মাঝে এমনও ইচ্ছে হয় আমার, মা যদি কারো সঙ্গে অবৈধ প্রেম করতে পারতেন তাহলে হয়ত একটু দম ফেলার সুযোগ পেতেন!
আরেকদিনের কথা। এবারের কথক আজিন নামের ভদ্র নম্র প্রকৃতির মেয়েটি।
“আচ্ছা, নারীপুরুষের যৌনসম্পর্কের ভেতর সুখানুভূতি বলতে যে একটা জিনিস আছে বলে শোনা যায় তার দখলীস্বত্ত্বটি কেবল পুরুষেরই আয়ত্তাধীন থাকবে কেন? নারী কি সেখানে কেবল নীরব দর্শক, না, তারও একটা সক্রিয় ভূমিকা আছে? সেই অধিকারটি যদি তার না থাকে তাহলে ভিন্ন কোনও মনের মত পুরুষের সঙ্গদ্বারা সেই অতৃপ্তি মোচন করার মানবাধিকার থেকে সে বঞ্চিত হবে কেন?” এরকম প্রশ্ন যে প্রফেসার নাফিসির ঘরোয়া পরিবেশ ছাড়া অন্য কোথাও সম্ভব হত না মোল্লাশাসিত ইরাণে সে তো বলাই বাহুল্য।
পাঠচক্রের মেয়েরা একটা কিছু খাবার নিয়ে আসত প্রতি সপ্তাহে—একেকজন একেক খাবার। সাধারণত এ-নিয়ম সবাই পালন করত বেশ আনন্দের সাথেই। একদিন তার ব্যতিক্রম ঘটে গেল। সেদিন খাবার আনার কখা ছিল শানাজের। কিন্তু খাবার নিয়ে আসা দূরে থাক সে নিজেই আসেনি। একেবারে নিখোঁজ—ফোন করে একটা খবর দেওয়া, সে-সৌজন্যটূকুও তার কাছ থেকে পাওয়া গেল না সেদিন। পরের সপ্তাহে সবাই চলে এসেছে, শুধু শানাজেরই দেখা নেই। স্বভাবতই প্রফেসার নাফিসি একটু ভাবনায় পড়ে গেলেন—খারাপ কিছু ঘটেনি তো? এমন সময় হঠাৎ তাদের কানে এল রাস্তায় গাড়িতে জোরে ব্রেক কষার কর্কশ শব্দ, এবং সাথে সাথে সজোরে গাড়ির দরজা লাগানোর পাড়াকাঁপানো আওয়াজ। তার একটু পরেই দরজার ঘন্টা। শানাজ এসেছে হাতে কেক নিয়ে। খুব উত্তেজিত ভাব। যেন রাগে গা কাঁপছে। নিশ্চয়ই ছোট ভাইটির সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়েছে। যা প্রায়ই হয় দুটিতে। ছোট ভাই যখন বড় আপার ওপর দাপট দেখানোর অধিকার পায় তখন কার সহ্য হবে সেটা। ওদের সামনে মনের ভাব প্রকাশ যাতে প্রকট না হয়ে ওঠে সেজন্যে সে যথাসাধ্য চেষ্টা করে মুখে একটা হাসি ফুটাতে। হাসি এল বটে—কিন্তু সে-হাসিতে প্রচণ্ড রোষ আর কূলভাঙ্গা অশ্রুকে কোনরকমে চেপে রাখবার করুণ চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই প্রকাশ পেল না।
একটু পরে খানিক সুস্থির হবার পর সে বলতে শুরু করল কেন তার পক্ষে আসা সম্ভব হয়নি গত সপ্তাহে। না, খাবার আনা সম্ভব হয়নি বলে নয়, প্রফেসারের দেওয়া হোম্ওয়ার্ক করা হয়নি বলেও নয়, দিনটা জেলখানায় বসে কাটাতে হয়েছিল বলে। অপরাধঃ তার আগের উইকেণ্ডে কটি সমবয়সী বান্ধবীর সঙ্গে একটু আমোদফুর্তি করতে গিয়েছিল কাস্পিয়ান সাগরের পারে—মোট ছ’টি মেয়ে। পোশাক আশাকে কোনরকম ত্রুটি হয়নি একজনেরও—যথারীতি পর্দা-আব্রুতে সবারই শরীর পূর্ণমাত্রায় ঢাকা ছিল। কর্তৃপক্ষের আপত্তি তোলার মত শুধু একটা কাজই হয়ত একটু নিয়মবহির্ভূত হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু বেআইনী নয়—-একটি মেয়ের ছেলেবন্ধু, যার বাসা ছিল সে উপকূল অঞ্চলেই, সেই ছেলেটা ছিল তাদের আড্ডাতে। তাতে যে কোন দোষ হতে পারে সেটা তাদের মাথায় ঢোকেনি, কারণ ওই ছেলেবন্ধুর সঙ্গে মেয়ের বিয়ের কথাবার্তা সব পাকাপাকি হয়ে গিয়েছিল—অর্থাৎ একরকম স্বামীস্ত্রীই বলা চলে। কিন্তু অন্ধ ধর্মপুলিশের দৃষ্টিতে নারী আর পুরুষ একসঙ্গে মিলে কেবল শয্যাকক্ষেই, সমুদ্রসৈকতে নয়। তারা সবাইকে পাকড়াও করে নিয়ে গেল জেলখানায়। ছেলেটাকে কোথায় নিয়ে গেল জানা যায়নি, কিন্তু মেয়েগুলোকে অনেকটা চালের বস্তার মত করে ঢুকিয়ে দিল ছোট্ট এক কুঠুরিতে যেখানে আরো কয়েদী ছিল, যারা নাকি বেশ্যাবৃত্তির অপরাধে শাস্তিপ্রাপ্ত। শানাজদলের মেয়েরা মূর্খ গার্ডগুলোকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে তারা ‘বেশ্যা’ নয়, সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে, তারা স্কুল কলেজের ছাত্রী, বড় কথা, তারা কি অপরাধে জেলে এসেছে তারা জানেনা। এক গার্ড তখন জবাব দেয়, তাদের চালচলন পশ্চিমাদের মত, কখাবার্তা পশ্চিমাদের মত, সুতরাং পেশায় বেশ্যা না হলেও কার্যতঃ তাই। ওরা দাবি করে বাবামার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার সুযোগ দেওয়ার জন্যে। তারা ভ্রূক্ষেপ করে না। অকথ্য অপমান আর মানসিক অত্যাচার চলে লাগাতার দুদিন দুরাত। তাদের ঘুমুতে দেওয়া হয়নি, ঝিমিয়ে পড়লে লাঠির বাড়ি মেরে চমকে তোলা হত, বাথরুম ব্যবহারের অনুমতি ছিল গার্ডদের মর্জিমত সময়ে, প্রয়োজনের সময় নয়। ৪৮ ঘন্টার মাঝে কেবল দুবারই জেলখানার বাইরে যাবার সৌভাগ্য হয়েছিল—-দুবার একই কারণে। ওদের কুমারিত্ব পরীক্ষা, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় Virginty Test—যার চেয়ে অসম্মান কোনও আত্মমর্যাদা বোধ সম্পন্ন মেয়ের হতে পারেনা। বদমাস গার্ডগুলো ধরেই নিয়েছিল যে ওরা কেউই সতী নয়। ফলে প্রথমবারের পরীক্ষাতে যখন কোনও প্রমাণ পাওয়া গেল না সতীত্ত্ব হানির, তারা চট করে মেনে নিতে পারল না সেটা। দ্বিতীয়বার নিয়ে যাওয়া আরো বড় হাসপাতালে। সেখানেও একই ফলাফল—-গার্ডদের মন খারাপ হয়ে গেল ভীষণ। তারা আশা ছেড়ে দিয়ে মেয়েগুলোকে ফিরিয়ে আনল জেলখানাতে। পরের দিন চারিদিকে পাগলের মত ছুটে ছুটে শেষ পর্যন্ত বাবামা যখন এসে পৌঁছালেন হাজত অফিসে, তখন তাদের মুক্তি দিতে রাজি হলেন কর্তৃপক্ষ বটে, তবে একটা শর্তে—-একটা স্বীকারোক্তি সই করে নিজেদের চারিত্রিক স্খলনের কথা ‘স্বেচ্ছায়’ স্বীকার করতে হবে। অর্থাৎ অপরাধ না করা সত্ত্বেও তাদের অপরাধ স্বীকার করতে হবে এবং তা কাগজে-কলমে প্রমানসিদ্ধ করে রাখতে হবে, যাতে কর্তৃপক্ষ দরকার হলে ভবিষ্যতে সেটা ব্যবহার করতে পারে ওদের বিরুদ্ধে।
অবশ্য একটা সাদা কাগজে মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিয়ে যে তারা খালাশ পেয়ে গেল তা হয় কি করে। অপরাধের একটা নামমাত্র শাস্তি তো হতেই হবে, তা নাহলে কি ইসলামিক রাষ্ট্রের সম্মান থাকে? মাননীয় হাকিমসাহেব ওদের প্রত্যেককে পঁচিশটি চাবুকাঘাতের রায় দিয়ে মামলা মিটমাট করে দিলেন—অসীম দয়াবান হাকিম বলেই এত সহজে তিনি ছেড়ে দিলেন ওদের। শানাজের কপাল খারাপ যে সে বোরখার নিচে শুধু গেঞ্জি পরেছিল একটি। ওটা দেখে তো গার্ডবিবির মাথাখারাপ—নিশ্চয়ই একটা অসভ্য মেয়ে, মনে মনে ভাবলেন তিনি। টিটকিরি করে বললেনঃ তোমার তো মোটা কাপড় গায়ে, সুতরাং আরো পাঁচটি দোররা অনায়াসে সইতে পারবে তুমি। অতএব গেঞ্জির দোষে অতিরিক্ত পাঁচ ঘা চাবুক মুখ গুঁজে সহ্য করে নিতে হল ওকে।
প্রফেসার নাফিসি এবং অন্যান্য যারা ছিল সেখানে তারা বেশ কিছুক্ষণ চুপ হয়ে থাকল। এরকম গল্প যে প্রতিদিন শোনে না তারা তা নয়, কিন্তু যতবার শোনে ততবারই হতবাক হয়ে যায়, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। এরকম দেশও আছে বর্তমান যুগে, এবং তারা সেদেশেই বসবাস করছে!
প্রফেসার নাফিসির বাড়িতে প্রতি সপ্তাহে ক্লাস করতে আসাটা অত সহজ ছিল না মেয়েগুলোর জন্যে—-অভিভাবকদের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়েছিল। শুধু পারিবারিক সম্মানের জন্যেই নয়, শরিয়া আইনে সেটা তাদের অবশ্য কর্তব্যের আওতায় পড়ে। এই অনুমতির জন্যে ওদের সবাইকে নিজ নিজ কল্পনা অনুযায়ী একেকটি অজুহাত তৈরি করতে হয়েছিল। তার মধ্যে নাসরিনের অজুহাতটিই সম্ভবত সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল। বাপমাকে সে বুঝিয়েছিল যে প্রফেসারের বাড়িতে যাওয়ার উদ্দেশ্যঃ ইরাণের বড় বড় আলেম-উলামাদের ফারসী ভাষায় লিখিত মুখ্য কাজগুলো সে ইংরেজিতে তরজমা করতে চায়, এবং তার জন্যে প্রফেসার নাফিসির সাহায্য দরকার। বিশেষ করে আয়েতুল্লা খোমাইনির শ্রেষ্ঠ পাণ্ডিত্যপূর্ণ কাজ(magnum opus) বলে খ্যাত গ্রন্থ “ The Political, Philosophical, Social and Religious Principles of Ayetollah Khomeini”. এমন একটি পবিত্র গ্রন্থ অনুবাদ করার উদ্যোগ নিয়েছে মেয়ে, বাবা তো শুনে খুশিতে বাগবাগ।
রসের গল্পটি নাসরিনের মুখ থেকে শুনল সবাই।
তরজমা করা কালে একটা জায়গাতে গিয়ে সে থমকে যায়, যেন ভূত দেখেছে। মহান নেতার বাণীটি পুরুষদের যৌনক্ষুধার বিষয় নিয়ে। তিনি বলছেন যে যৌনতাড়না নিবারণের অন্যতম পন্থা হল পশুজগতের দ্বারস্থ হওয়া। যেমন কুক্কুটির সঙ্গে সঙ্গম—সেটা জায়েজ। তবে তার একটা শর্ত আছে। একবার একটা মুরগির সঙ্গে যৌনসঙ্গম ঘটে যাবার পর সে-মুরগির মাংস তার জন্যে হারাম। শুধু সে নয়, তার গৃহসংলগ্ন প্রতিবেশীর জন্যেও। অবশ্য দু’ঘর পরের প্রতিবেশীদের জন্যে তাতে কোনও নিষেধ নেই।
অবিশ্বাস্য, তাই না? আমি অনেকবার পড়ার পরও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। তাই পাঠকের কাছে অনুরোধ, তাঁরা যেন আজার নাফিসির এই “Reading Lolita in Tehran” বইটির ৭১ পৃষ্ঠাতে চোখ বুলিয়ে আমি ঠিক দেখেছি কি দেখিনি সেটা যাচাই করে নিন। আরো ভাল হয় যদি কোনও ফারসি জানা লোক খোমাইনির বইটির মূল কপিটি নিজে পড়ে এই অদ্ভুত উক্তিটির সত্যমিথ্যা্র প্রমান সংগ্রহ করে আমাকে জানিয়ে দিন। তাহলে খুব উপকার হয়।

অটোয়া,
২৪শে সেপ্টেম্বর,’১১; মুক্তিসন ৪০