চৌধুরী পরিবারের হাতে সময় আর মাত্র পঁয়ত্রিশ মিনিট। ১:৪৫ তাদের বিমান ঢাকার উদ্দেশ্যে ওমান এয়ারপোর্ট ছেড়ে আকাশে যাবে।
মেয়ে জাতের যে সমস্যা। প্রতিটি লাগেজ ওভারওয়েট করেও শান্তি হয়নি। হাতের গুলো অব্দি একেকটা দশ হতে বারো পাউন্ড। এত শখ করে পরা দামী স্যুটটি তার। কোথায় ভীষণ গুরুত্তপুর্ণ মানুষের মতন তার হাতে শুধু থাকবে পাসপোর্ট আর টিকেটের ফাইল, সে আর হল কোথায়। তার স্ত্রী রেহনুমার হাত যদি খালি হত তবে ওর হাতেই সব দিতেন। অন্যান্য সময় যা করেন। বাজার করতে যাবার পথেও তার ছাতা বা কাগজের কোন ব্যাগ থাকে রেহনুমার হাতে। আর আজ এত দামী স্যুট আর টাই কিছুই ভালোভাবে দেখানো যাচ্ছেনা এইসব বাড়তি বোঝার জন্য।

সাত বছর পর নিজ দেশে যেতে পারার আনন্দে আর উত্তেজনায় রেহনুমা আর তার মেয়েরা ইচ্ছেমতন উপহার সামগ্রী নিয়েছে। মেজাজ বিগড়ে আছে। গত বার ঘন্টা প্লেনে বসে থাকা আর এখন একেকজনের হাতের দুটো করে ব্যাগ নেমেছে কিনা সেসব গুনে দেখা। ব্যাগ গুনতে গুনতে তার আটান্ন বছর বয়শী আড়চোখে মেয়েদের গতিবিধিও নজরে রাখতে ভুলছেননা।
রিমি বেশ ভাল করেই জানে তার বাবার সর্বক্ষন নজর তার উপর। সুমির পাশে সেও বসে আছে সুমিরই মতন শান্তভাবে। দুজনের বয়সের পার্থক্য এক বছর। তবুও সুমিকে দিদি ডাকতে হবে। ভাবতেই রিমির অবাক লাগে। ওরা দুজন খুব বন্ধু। এর মাঝে আবার দিদি ডাকাডাকি কেন আসবে?
দুজনের বসে থাকার ভঙ্গি এক হলেও রিমির মাথায় চিন্তার ঝড়। তার মস্তিষ্ক ঘুমোলেও বোধ হয় বিশ্রামে যায়না। অনবরত চলমান একটি চিন্তার মেশিন। রিমি ভাবছিলো এত সুন্দর পরিস্কার এয়ারপোর্ট, এত এত মানুষ। আচ্ছা সবাইকে জুতো খুলে হাঁটতে বললে কেমন হয়? সবাই জুতো খুলে ফেললে নিশ্চয়ই মেঝেটা কাল অব্দিও এতটা পরিস্কার থাকবে। “আমার নিজের জুতো ঝাডুদারের কাজ কতটা বাড়াচ্ছে?” ছোটমেয়ের খালি পা দেখে তার বদরাগী বাবার চেহারা কেমন হবে তা ভেবে হেসে ফেলল রিমি।
“কি?”
“কি, কি?”
“হঠাৎ হাসি?”
“আমার জুতো খুলে ফেলি সুদি?”
“বাবা যে পাশেই বসে আছেন সেটা আমি মনে করিয়ে দেই?”
ঠোঁট উল্টালো রিমি।
“জানি।“
সুমি তার এই একটু ভিন্ন প্রকৃতির বোনের দিক হতে চোখ সরিয়ে চেয়ারে মাথা এলিয়ে চোখ বুঁজলো।
“তো হঠাৎ জূতো কি দোষ করলো শুনি? পাঁচ দিনও হয়নি হিল গুলো কিনেছিস। তখন তো বেশ বলছিলি সুন্দর আর অনেক কম্ফি।“
“এমনি। খালি পা দেখে বাবার কি প্রতিক্রিয়া হ্য় তাই দেখতে।“
সুমি চোখ খুলে বোনকে দেখলো।
“ঠিক আছে, সত্যটা বলতে হবেনা।“
“আমি চাইছিলাম যারা এয়ারপোর্ট পরিস্কারের দায়িত্বে আছে তাদের কাজ একটু কমিয়ে দিতে। এই যা।“
“জুতো খুলে খালি পায়ে হেঁটে?”
“একটু ভাব সুদি। এ মুহুর্তে এই এয়ারপোর্টের সবাই যদি ও কাজটি করে cleaning crews এর একটি রাতের কাজ কমবে। একটি রাত ওরা কম ক্লান্ত হবে, একটি রাত তাদের পরিবারের কাছে দ্রুত ফিরতে পারবে, একটি রাত তাদের আনন্দে কাটবে।“
“ভুল। একটি রাত ওরা যদি কাজ না করে তাহলে তাদের বেতন একটু কম অথবা বন্ধ। যা নিশ্চয়ই কেউ চায়না।“
“কিন্তু এমন নিয়ম হয়তো শুধু স্বপ্নের দেশ এ্যামেরিকায়!”
“নাও হতে পারে।“
রিমির চেহারায় সন্তুষ্টির ছাপ দেখে সুমি আবারো চেয়ারে মাথা হেলান দিল।
এ উত্তর রিমির শোনা দরকার ছিল এ সময়। সুদিটা অমনই মাঝে মাঝে। অনেক প্রেক্টিকাল আর যুক্তিবান। খুব কাট কাট কথা আর ভাবনা। যেটা যেমন হবার কথা তেমনই হবে। জীবনে যে নিয়ম সৃষ্টি হয়েছে সব সে নিয়মে চলবে। ওখানে আর কোন গভীর ভাবনার দরকার নেই, কোন প্রশ্নের দরকার নেই। তার এই স্বভাব অনেক সময় রিমির চলমান মস্তিস্কে স্বস্তি দেয়। মাঝে মাঝে মনে হয় ওর মাথার ভেতরটায় সব জট পাকিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর সব কিছুর সাথে সব কিছু সংযুক্ত। এটা জানে আর বুঝে বলেই রিমি ভাবনা থামাতে অপারগ। ওর মনে হয় একটি ঘটনার সাথে আরেকটি ঘটনার যোগসূত্র, সম্পর্ক আর ব্যাখ্যা ভাবতে ভাবতে পুরো ব্যাপারটি শীতকালে বাবা অথবা অন্য কারো জন্য বোনা মায়ের উলের বলের মতন হয়ে যায়। চিন্তার পর চিন্তার সুতো। সব মিলিয়ে একটি জটপাকানো বল।
রিমি পালটা যুক্তি দেখাতে পারতো। বলতে পারতো যে এ ব্যাবস্থাটাও শোষক সমাজের সুক্ষ দক্ষতার ফলাফল।
ওদিকে আর গেলনা সে। এসব আলোচনা আগে অনেকবার হয়েছে। সব কিছু এসে থমকে গেছে শ্রেনী বৈষম্যে, শাষক কারা এবং কেন এসব প্রশ্নে। এ মুহুর্তে রিমি ওই উত্তরকে মনঃপুত করে নিল।

প্রায় বার ঘন্টা ওরা প্লেনে বসে ছিল। বার ঘন্টা টানা একই ভাবে বসে থাকা। শরীর তার নিজস্ব ভাষায় বিদ্রোহ তো করবেই। রিমি উঠে দাঁড়ালো। ডানপাশে তিনটি দোকান। একটি মদের, একটি উপহার সামগ্রীর, আরেকটি ঘড়ির।
“সুদি, আরবী দেশের ঘড়ি। কি বলিস?”
সুমি না সুচক মাথা নাড়লো।
“আরবী দেশের মদ?”
সুমি চোখ খুলে হেসে বললো-
“সেটা চলবে।“

রেহনুমা অনেক্ষন যাবত তার ব্যাগে লাগেজের চাবি খুঁজছিলেন। রিমির কথা শুনে ব্যাগ হতে চোখ তুলে তাকিয়ে হাতের ইশারা করলেন যার অর্থ দাঁড়ায় “কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”
রিমির হাত বুকের উপর ভাঁজ করা। চোখ আর ভুরুর ইশারায় মাকে জানালো ওই দিকের দোকানে।
“ওই দোকান গুলোতে এমন কিছুই নেই যা তুমি এ্যামেরিকায় গত সাত বছরে দেখনি। এখন কোথাও যেতে হবেনা। আমাদের হাতে মাত্র পঁয়ত্রিশ মিনিট সময় আছে। সবাই এখানে বসে আছি, তুমি ওদিকে শুধু শুধু কেন যাওয়া!”
“পঁয়ত্রিশ মিনিট মাত্র নয় মা। তাছাড়া, ঘড়ি বা গিফটের দোকানে নয়, আমি যাচ্ছি মদ কিনতে।“

ঘুরে দোকান মুখী হাঁটলেও রিমি পরিস্কার যেন দেখতে পাছে মা এখন সুদির দিকে ঝুঁকে হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করছে, রিমি কি সত্যিই ওই দোকানে ঢুকবে কিনা।
সুমি অধৈর্য হয়ে হাত নেড়ে বলল “তুমি তোমার মেয়েদের চেন না মা?”

যেখান হতে ওরা বসেছিল ওখান হতে ভালই দেখা যাছিলো যে মদের দোকানটি বন্ধ হয়ে গেছে। রাত অনেক হল বলে কিনা কে জানে। রিমি একটু হতাশ হল। যে দেশে নিরানব্বই শতাংশ নারী নিরানব্বই শতাংশ সময়ে থাকে ঘরবন্দী ঠিক ঘরের অন্যান্য সব আসবাবের মতন, যে দেশের এয়ারপোর্টের দেয়ালে এখানে ওখানে সুন্দর ফ্রেমে কুরআনের বাণি গর্বিত অক্ষরে শোভা পাচ্ছে, যে দেশের পুরুষেরা এমন ভাবে হেঁটে বেড়ায় যেন একেকজন স্বয়ং নবী, দিনে পাঁচ বার সেজদা দিয়ে ক্ষান্ত না হয়ে অমুসলিম আর নারীজাতির প্রতি অমানবিক অমানুষিক আচরনে সফল হয়ে আল্লাহর কাছ হতে স্বর্ণের মেডেল আদায় করেছে সে দেশের মদের দোকান গুলোয় কিভাবে কি হয় দেখার খুব ইচ্ছে ছিল তার। যদিও নুতন কিছুই নয়, জানে সে। মামার দোকানে কাজ করতে গিয়ে দেখেছে ওই দোকানের সব সিগারেট আর নেশা জাতীয় দ্রব্যের সরবরাহ দিত সব জুব্বা পরা মধ্য প্রাচ্যের মুসল্লিরা। বেশ হাসি পেত রিমি আর সুমির। প্রতি শুক্রবারে জুমার নামাজ শেষ করে ওরা দোকানে এসে সব বুঝিয়ে দিয়ে যেত।
রিমি মনে মনে ভাবত বোকার দল। আগে গুনাহ করে তারপর জুমাতে যা, পাপ যদি একটু কমে। জুমা পড়ে এসে এসব করলে আল্লাহতালা আরো ঘুষ চাইবেন পরে।

ঘড়ি ভর্তি দোকানে ঢুকতেই একটি মেয়ে এসে ইংরেজিতে সাহায্য লাগবে কিনা জানতে চাইলো। তাকে দেখলো রিমি। অল্প বয়শী একটি মেয়ে। অন্তত দেখতে তাই মনে হ্য়। আঠারো উনিশের বেশি হবেনা। বোরখা আর হিজাবে জর্জরিত।
হঠাৎ রিমির খুব ইচ্ছে করলো দুম করে মেয়েটিকে জিজ্ঞেশ করে বসে এই বোরখা আর হিজাব কি সম্পুর্ণ তার সিন্ধান্ত? পুরোপুরি? পরে ভাবল মেয়েটি অবাক হয়েই জবাব দেবে এটা আল্লাহর সিন্ধান্ত! উনি সেটাই চান।
রিমির মাথায় অনেক প্রশ্ন। যে ছেলেটি এই মেয়েটির সহকর্মী তার আচরন কি সম্মানসুচক মেয়েটির প্রতি? মেয়েটি কি দেখেছে দোকানের বাহিরে দাঁড়িয়ে এই ছেলে সুমি আর রিমিকে অনেক্ষন এমনভাবে দেখছিল যেন ওরা কোন পর্নোগ্রাফিক মুভি হতে এ মাত্র উঠে এসেছে? দোকানে ঢুকতে গিয়ে রিমিকে উদ্দেশ্য করে আস্তে করে যে “বম্বশেল” বলল তা কি মেয়েটি শুনতে পেয়েছে?

রিমি ভাবলো সুদিকে গিয়ে বলে আসে “বম্বশেল” ঘটনাটি যা আরো অনেক কিছুতে রুপ নিতে পারতো যদি রিমি মুখ খুলতো। পরে ভাবল নাহ, প্রথম প্রশ্ন সুদি যা করবে তা হচ্ছে – “তোর ওদিকে যাবার কি দরকার ছিল?” অথবা “তোর ওড়না ঠিক জায়গায় ছিল তো?”

সবকিছু ঝেড়ে ফেলে রিমি হেসে আলেয়াকে ধন্যবাদ জানালো। বাঁ বুকের একটু ওপর হতে নেম টেগে নাম। মেয়েটি আশেপাশেই আছে।
রিমি ঘড়ি দেখছে।
“ছোট্ট আফা…”
ঘুরে তাকিয়ে দেখল একজন অল্পবয়শী নারী সাথে আরেকজন মাঝবয়শি পুরুষ। চাপদাড়ি, কপালে নামাজের পুরস্কার, রক্তবর্ণ চোখ। “খুব বেশি পান করা হয়েছিল বুঝি গত রাতে ধার্মিক চাচ্চু?” ভাবল রিমি। পরক্ষনেই নিজেকে ধমকালো। ছি, এই মদের ব্যাপারটা নিয়ে বেশি বারাবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। নির্ঘুম রাতও চোখকে লাল করে দিতে পারে।
“জ্বি বলুন।“
এই মেয়েটির বয়স সতের আঠারোর বেশি হতেই পারেনা। অসাধারন সুন্দর একটি মুখ তার! তার এত সুন্দর চোখের দিকে তাকিয়ে রিমি একবারও ভাবলো না দ্বিতীয় তলার এত এত মানুষের মাঝে ইনি রিমিকেই কেন বেছে নিলেন কথা বলতে।
“আপনে বেয়াদবি নিয়েন না। আমি এইখানে আর কাউরে চিনিনা। তাই আপনের কাছে আসছি।“
“কোন সমস্যা নেই, আপনি বলুন।“ এই নারীর ছলছল চোখের দিতে তাকিয়ে খুব নরম, আন্তরীক আর মোলায়েম ভাবে বলল রিমি। হয় ইনার চোখ সত্যিই সুন্দর, নয় চোখের জল চোখ দুটোকে আর সৌন্দর্য দিয়েছে।
“আমি একটা ফোন করুম। কিন্তু কোন খান থেইকা করুম জানা নাই।“
“আপনি কোথায় ফোন করবেন?”
“ঢাকা আফা, আমার ভাই অপেক্ষা করতেছে।“
“এটা কোন ব্যাপার না। আপনি আমার সাথে আসুন। এই দোকানের মেয়েটিকে জিজ্ঞেশ করলেই জানা যাবে। আপনার কাছে ফোন কার্ড আছে?”
“জ্বে না।“
তক্ষুনি তার পাশের লোক ঝুঁকে সুন্দরীর কানে আস্তে করে বলল-
“ফোন নম্বর আমার জানা নাই।“
সুন্দরী (তার নাম না জেনে এই নামই রিমি দিল তাকে) রিমির হাতে ছোট্ট একটি ফোন বুকের মতন কি যেন এগিয়ে দিল। বাহ! আজকালকার নাম ক্রমানুসারে থাকা, চামড়ায় মোড়ান, আর গোছান কোন ফোন বুক নয়। এ ফোন বুক রিমি ছোটবেলায় দেখত তাদের এলাকার ছোট মুদির দোকানে। কাঠের ক্যাশবাক্স আর দোকানী চাচার মেদবহুল শরীরের মাঝামাঝি একটি জায়গায় উপর হতে সুতো দিয়ে ঝোলানো থাকত নানা রঙের এ ছোট নোট বইগুল।

বোঝা গেল দুজনের একজনেরও সামান্যতম পড়াশোনা নেই। নাম আর নাম্বার যে খুঁজে বের করবে ততটুকুও নেই। অবাক হলনা রিমি। এমন দৃশ্য আর মানুষের সাথে ও ছোটবেলায় দেশেই পরিচিত হয়েছে।
“খালেদা বেগম লেখা আছে। আফনে পাবেন।“

রিমি প্রতিটি ছোট ছোট পাতা উলটে যাচ্ছে। কোন এক কাঁচা হাতের লিখা। কেউ চেষ্টা করেছে খুব দ্রুত অনেক নাম্বার এই ছোট বইটিতে টুকে দিতে। তবে হাতের লিখা এতই খারাপ যে নাম পড়া গেলেও নাম্বার গুল কষ্টে উদ্ধার করতে হচ্ছে।
খালেদা বেগম, খালেদা বেগম… নেই…নেই…সব পৃষ্ঠা দেখা শেষ।
“কই, খালেদা বেগম তো পেলাম না। আপনি নিশ্চিত এ বইএ আছে?”
চোখের পানির গতি বেড়ে গেল মেয়েটির।
রিমি একবারো বলল না “কাঁদবেন না।“
হাতে বেশি সময়ও নেই। ভেতরে রিমি অনেক উত্তেজিত। মনে হচ্ছে পরিক্ষার হলে সে। সময় ফুরিয়ে আসছে। খুব দ্রুত এ নাম্বারটি খুঁজে না পেলে আর তার কাগজ ছিনিয়ে নেয়া হবে।
খালেদা বেগম…খালেদা বেগম…পাওয়া গেছে! শেষের পৃষ্ঠায়ও না, শেষের মলাটের গায়ে নিচে খুব দ্রুত ছোট করে লিখা খালেদা বেগম ও তার নাম্বার। রিমি হেসে মুখ তুলে চাইলো।

আলেয়ার কাছে গিয়ে রিমি জেনে নিল ফোন কার্ড কোথা হতে পাওয়া যাবে। দু ডলারের কোন কার্ড পাওয়া যাবে না এখানে, পাঁচ ডলারের কার্ড কিনতে হবে।
“আফা আমার কাছে দেশের টাকা নাই। ভাংতি ত্রিশ টাকা আছিল, সব এয়ারপোর্টে খালেদা আফারে দিয়ে দিছি।“
রিমির হাত খালি। কোন রকম ব্যাগ বহন করতে ভাল লাগেনা ওর। সব কিছু সুদির পাশে চেয়ারে রাখা। কিন্তু এখন আবার ও যায়গায় ফিরে গিয়ে টাকা নিয়ে আসা মানে বাবার শত প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া। কেন টাকা? ওরা কারা? কি চায়? ওত সময় নেই। আবার উপায়ও নেই। রিস্ক নিতে হবে।

রিমি ওদিকে ফিরে গেল। ব্যাগ হাতড়ে দেখল নেই।
“কি খুঁজছিস?” জানতে চাইলেন রেহনুমা।
“কিছু ক্যাশ লাগবে মা।“
“কত?”
“পাঁচ বা দশ ডলার। আমার সাথের ওদের জন্য।“
রিমি দেখল ওর বাবা তার পকেট হতে টাকা বের করে দিচ্ছেন। টাকা দেবার সময় ভাষণ দিতে ভুলছেন না।
“ওই মহিলা আর দাড়িওয়ালার সাথে এত কি কথা? টাকার দরকার হয়েছে, রিমি যেন টাকা দিয়েই ফিরে আসে। ওই মহিলার সাহায্য লাগলে সাথে তো একজন পুরুষ মানুষ আছেই, আবার রিমিকে কি দরকার এর মাঝে?”
টাকা নিল রিমি বাবার হাত হতে।
“আমি কিছুক্ষনের মাঝেই ফিরে আসছি।“
“আর কিছুক্ষন পরই আমাদের বিমান ছাড়বে! আবার কোথায় যাচ্ছিস!”
“ভেবনা মা, আমি আসছি।“
“কি হচ্ছে তা কি এখন বলবি, না পরে?” সুদি জানতে চাইল।
“পরে।“ রিমির জবাব।

তৃতীয় তলায় যেতে হবে। ওখানেই ফোন কার্ড এর দোকান। ওখানেই পে ফোন।
ওরা তিনজন লিফটের দিকে এগিয়ে গেল। সেই মাঝবয়শী লোকটা সাথে সাথে আসছে, মনে হচ্ছে সুন্দরীর ছায়া। তার উপস্থিতি অনেকটা কফির লাইন বা এটিএম মেশিনে দাঁড়ানো পেছনের মানুষটির মতন। আমাদের সামনে দাঁড়ানো মানুষটির সব কিছু যেমন শোনা যায় আর ভাবা হয় তাড়াতাড়ি কেন করছে না, পেছনের জনের কাজকর্ম কোন কিছুতে ব্যাঘাত ঘটায় না, আলতোভাবে শুধু তার উপস্থিতি মনে করিয়ে আমার পেছনে আরেকজন মানুষ আছে, জানা নেই সে কি ধরনের কফির ওর্ডার দেবে।

সবাই তৃতীয় তলায় নামল। দ্বিতীয় তলার চাইতে অনেক বেশি ভীড় এখানে। হেঁটে সামনে যেতেই স্যুট পরা একটি লোক, বোঝাই যাচ্ছে এখানে কোথাও কাজ করে, রিমিকে উদ্দেশ্য করে আস্তে করে বলল “ওয়াও, কারিশমা কাপুর”। এবার রিমির রাগের চাইতেও মজা বেশি লাগল।
অদ্ভুত! যে কেও এক নজর দেখেই স্বীকার করবে রিমির চাই্তেও তার পাশের এই নারী অনেকগুন সুন্দরী। তাও সবার নজর আর মন্তব্য রিমিকেই লক্ষ্য করে কেন? কি কারন হতে পারে? তখনই রিমির মাথায় এল নিশ্চয়ই পোশাক নির্ধারনের কারনে। রিমির পরনে বোরখা নেই বলেই কি ও এইসব মন্তব্যের নিশানা? তাই হবে, রিমি পরেছে ওর ইচ্ছে অনুযায়ী পোশাক, আর এই মাথাশূন্যের দল ধরে নিয়েছে তারাও এ কারনে তাদের ইচ্ছে মতন মন্তব্য করতে পারবে।

সুন্দরী জানতে চাইল লোকটি কি বলেছে। তাকে জানাল রিমি। তখন তাদের কথোপকথন অন্য দিকে মোড় নিল।

এদিকে পে ফোনের দেখা নেই কোথাও। অনেক খুঁজল রিমি। তারপর সুন্দরী কে জানালো এখানে কাউকে জিজ্ঞেশ করতে যাবে সে, তক্ষুনী এ্যানাউন্সমেন্ট – ঢাকাগামী সব প্যাসেঞ্জারদের গেট নং ৯ এ যেতে বলা হচ্ছে। রিমি বুঝতে পারছেনা কি করবে।
এখন কি হবে? এখন কি হবে? ইনার কাজ আমি কিভাবে অসম্পুর্ন রেখে যাই? সব জানার পরও কিভাবে পারব তা?
একজন অবাঙ্গালি দেখতে পুরুষ রিমির দিকে এগিয়ে এল। মুখে হাসি।
“আপনাদের কিছু লাগবে?”

অত সময় নেই রিমির যে এই ভদ্রলোককে সব জানাবে। অত সময় নেই যে বলবে ঢাকায় ফোন করাটা ইনার জন্য কতটা জরুরি। তার ভাই ঢাকা ছেড়ে চলে যাবার আগেই খালেদা বেগম কে ফোন করে জানাতে হবে তার ভাইয়ের হাতে যেন তিন হাজার টাকা দেয়া হয়। যা সুন্দরীর পরিবারের দু মাসের খরচ। নিজের দেশ আর মানুষ দের ছেড়ে আসার অবর্ণনীয় কষ্টে, চোখের জলে হ্রদয়ের ভেঙ্গে যাওয়া অনেকগুল টুকরো সাথে করে নিয়ে আসা, তারও বেশি চিরতরে দেশেই রেখে আসা, অজানা একটি দেশে একা যাওয়ার ভয় সব মিলিয়ে সে খালেদা বেগম কে বলে আসতে ভুলে গেছে যে তারই তিন হাজার টাকা তার ভাইয়ের হাতে দিতে।
তার মা বাবা অধীর আগ্রহে বসে থাকবেন তাদের ছেলে কখন কিছু টাকা নিয়ে ফিরবে। ঘরে কোন বাজার নেই গত দুদিন। তার ভাইয়ের নিশ্চয় ফিরে যাবার বাস ভাড়াটা অব্দি নেই। খালেদা বেগমের কাছে টাকা চাইবার কথাও সে ভাববেনা যেহেতু বোন কিছু বলে যায়নি। এ জন্যেই চোখে এত জল। বাঁধভাঙ্গা জল, পরিবারের ভবিষ্যতের কথা ভেবে।

ঢাকগামী প্যাসেঞ্জারদের গেট নং ৯… দ্বিতীয় ঘোষনা। রিমিকে যেতেই হবে। বাবার রাগ, মায়ের চিন্তা এসবই তুচ্ছ মনে হচ্ছিল এই মানুষটির প্রয়োজনের কাছে। খুব সহজ ভাবে যদি তার পরিবারের সবার কাছে গিয়ে বলে আসতে পারত যে তোমরা যাও, আমি পরের ফ্লাইটে আসছি। এই নারীর সমস্যার সমাধান না করে আমি প্লেনে উঠবনা। খুব বেশি কি অসম্ভব কিছু? হ্যাঁ, কারন সে নিজেও একজন নারী, যার নিরাপত্তা শুধুমাত্র পুরুষ দেবে। সময় নেই। আদৌ কি সময়ের ভয় না বাবার?

ভদ্রলোকের হাতে খালেদা বেগমের নাম আর নাম্বার দিয়ে রিমি জানালো খুব জরুরী এ জায়গায় ফোন দেয়া। এখানে সে কোন পে ফোন খুঁজে পায়নি।
লোকটির বুদ্ধি খারাপ না। যা বোঝার বুঝে নিল দ্রুত। জানালো সে নিশ্চিত পে ফোন দ্বিতীয় তলায়ই আছে। ওরা হয়ত রিমির কথা বুঝে উঠেনি তাই ভুলে তৃতীয় তলায় পাঠিয়েছে। তাছাড়া তার ব্যাগও ওখানে রাখা তার এক বন্ধুর সাথে। ওখানেই যেতে হবে, রিমিও দোতলায় যাচ্ছে? বেশ, সবার এক সাথে যাওয়া হবে।

কেন যেন এই শুভাষী, নিজ হতে সাহায্য করতে এগিয়ে আসা লোকটির সাথে এই মেয়ে কে একা ছাড়তে রিমির মন সায় দিচ্ছিল না। কিন্তু উপায় নেই। লিফটে সবাই। রিমি চাচ্ছেনা ইনি ভাবুক এদের সাহায্য করাটা রিমি বোঝা ভেবে নিজে সম্পুর্ণ না করে এখন তার উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। এরা যে পড়তে জানেন না, রিমি তা স্মরণ করিয়ে দিল, যেন ফোন কার্ড কিনে দিয়েই ইনি ক্ষান্ত না হন। কারন ফোন কার্ডের ব্যবহার এদের অজানা। যতই ভদ্রলোক কে মনে করিয়ে দেয় নাম্বারটি কোথায় আছে এবং কাকে কল দিতে হবে, দেখা গেল তার আগ্রহ রিমির সম্পর্কে জানার প্রতিই বেশি।
কি নাম ওর? বয়শ কত? কোথায় থাকা হয়? ও এ্যামেরিকায়! এত বড় দেশে একা থাকা হয়? পড়াশোনা কতদুর? তাই? তো রিমি কি একজন মুসলিম নারীর লক্ষ্য পূরণে সফল হয়েছে?
অনিচ্ছাকৃত রিমির জবাব – না, এখনো তার বিয়ে হয়নি। ভদ্রলোকের চোখ কি একটু উজ্জল দেখাল?

নিজের পরিচয় দিলেন উনি। নাম মোরশেদ। থাকা হয় মিশরে। একজন বড় ইমাম হবেন বলে ইংরেজী আর আরবীতে পড়াশোনা করছেন। দেশে যাচ্ছেন কনে খুঁজতে।
“ও আচ্ছা।“ রিমির জবাব।
ওড়না ঢাকা রিমির শরীর কে মোরশেদ সাহেবর চোখ প্রশংসার দৃষ্টি দিয়ে দেখছিল। না, একেও কিছুই বলা যাবেনা। ইনি সুন্দরীর উপকার করবেন পরে। তাকে ধন্যবাদ দিয়ে রিমি আবারো মনে করিয়ে দিল শুধু ইনিই পারেন এদের সাহায্য করতে। মোরশেদ রিমিকে আস্বস্ত করলেন উনি ওদের সাহায্য করবেন। তবে উনি কি রিমির ফোন নাম্বার পেতে পারেন?
তাড়া আছে, শুনেও শুনলোনা রিমি। এরকম অনেক কিছুই নারীদের শুনেও শুনতে হয়না।

লিফট হতে নেমে রিমি সুন্দরীকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিল।
“আমাকে যেতে হবে দিদি। আমার ফ্লাইটের সময় হয়েছে। আপনি ভাববেন না। এই ভদ্রলোক আপনাকে সাহায্য করবে। আর আমি নিশ্চিত আপনার ভাই এখনো ঢাকায়ই আছেন। আর একটি কথা। সৌদি আরবের কাজটি বেশি দিন করবেন না।“

সুন্দরী একটু হেসে রিমির হাত ধরে বললেন –
“আপনি আমার জন্য অনেক করেছেন আফা। আমি আপনেরে ভুলুম না।“
অসহ্য। কষ্টে রিমির বুক ফেটে যাচ্ছে। কি করেছে সে? কিবা করতে পেরেছে? অনেক কিছু করার কথা, করতে পারার কথা। নিজেকে অপদার্থ মনে হচ্ছে। একটি হাতল বিহীন হাতুড়ী রিমি। যার শুধু মাথার দিকের লোহার অংশ আছে, কিন্তু হাতল ছাড়া লোহার অংশটি বেকার। কিছু না করেই একজন মানুষ হতে এভাবে কৃতজ্ঞতা আশা করা যায়না।
চোখের জল জোর করে চোখের ভেতরেই পাঠিয়ে দিয়ে রিমি আবারো বলল
“সৌদি আরবের কাজটা বেশি দিন করবেন না দিদি।“
সুন্দরীর সাথের লোকটির দিকে তাকিয়ে বিদায়সূচক মাথা নাড়লো। তিনিও মাথা নেড়ে বললেন-
“আফনে মেলা কষ্ট করছেন।“

সময় নেই। রিমির বুক ধুপ ধুপ করছে। ওই যে দেখা যাচ্ছে মা, বাবা আর সুদি গেট ৯ এর লাইনে। বাবা হাত নেড়ে উত্তেজিত ভাবে কি যেন বলছেন। নিশ্চয়ই রিমিকে নিয়ে। মায়ের উদ্বিগ্ন চোখ। নিশ্চয়ই রিমিকে নিয়ে।
রিমি চুপচাপ সুমির পেছনে দাঁড়িয়ে মায়ের হাত হতে একটি ব্যাগ আর সুমির হাত হতে একটি ব্যাগ নিল। বাবা লাইনে সবার সামনে। রিমিকে এখনো দেখতে পায়নি।
“তোমার মেয়ে ভেবেছে আমি জানিনা? আমি কিছু বুঝিনা? আমি ঠিকই দেখতে পেয়েছি তোমার মেয়ে একটি পুরুষের সাথে লিফট হতে নামছে। সোজা কথায় বেশ্যা। এদেরকে বলে বেশ্যা। এইয়ারপোর্ট ভর্তি মানুষ। আর তোমার মেয়ে এমনভাবে হেঁটে বেড়াচ্ছে যেন এটা এ্যামেরিকা! যেন সে একটা কিছু! সবাই তোমার মেয়ের দিকে কিভাবে তাকাচ্ছিল দেখেছ তুমি? দেখেছ?”

তারপর রিমির উপস্থিতি তিনি দেখতে পেলেন। তার চোখ যেন আরো রক্তবর্ণ হল। গলার স্বর আরো উঁচুতে।
“কোথায় ছিলি? কোন জাহান্নামে গিয়েছিলি? আজ তোর কারনে ফ্লাইট মিস করতাম আমরা! নিজেকে কি ভাবিস তুই?” রিমিকে বোধ হয় চড় মারতে এগিয়ে আসছিলেন তিনি। রেহনুমা তাদের মাঝে এসে দাঁড়ালেন।
“কি করছ কি তুমি? এটা বাসা না। মেয়েটা শুধু ওই মহিলাকে সাহায্য করতে গিয়েছিল। তুমি নিজেই দেখেছ!”

এবার বলল সুদি।
“এসব বাদ দেয়া যায় না? আমরা সবাই জানি রিমি যখন যা মন চায়, তাই করে। কারো কথা শোনে ও কখনো? এসব নিয়ে পরে কথা বললেও তো হয়।“
রিমির এবার হাসি পেল। সুদি কি পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টায় আছে, নাকি আগুনে আরো তেল ঢালছে?

“চুপ! সবাই চুপ!” আবারো গর্জন।
“আর কারো মুখ হতে একটা কথা বেরুলে আলাহর কসম আজ এখানে খুন খারাবি হবে। আল্লাহর কসম আজ এখানে লাশ পড়বে। বাসায় পৌঁছে নেই, তুমি কি রকম বেশ্যা বড় করেছ তোমাকে বোঝাব ঘরে গিয়ে।“

সবাই গেট ৯ এর ভেতর সারিবদ্ধ ভাবে ঢুকছে। সাথে ঢুকছে চৌধুরী পরিবারের অপমান আর লাঞ্ছনা। চৌধুরীর অবিরাম গর্জন আর গালি গালাজ লাইনের সব বাঙ্গালি উপভোগ করছে। সবার চোখ ওদের পরিবারের উপর। সবার চোখ রিমির উপর।
রেহনুমা, সুমি আর রিমির ইচ্ছে হচ্ছিল দৌড়ে লাইন হতে পালিয়ে যায়।
আশ্চর্য! এতগুল মানুষের মাঝে কেউ কি সামান্য ভদ্রতা দেখিয়ে অন্যদিকে মুখ ফেরাতে পারছেনা? ছি!
আবারো হাসি পেল রিমির। কি অদ্ভুত আমাদের মনোজগত। আমারই বাবা সবার সামনে ভদ্রতার শেষ লেশ টুকু বাদ দিয়ে আমাদের সবাইকে অকথ্য ভাষায় বলে যাচ্ছে, আর আমি অন্যান্য মানুষের ভদ্রতার পরিমাপ করছি?

রেহনুমা সব চেষ্টাই করছিলেন তার ভীষণ চেনা এই মানুষটিকে শান্ত করতে। বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন যে এটা তাদের ঘর না, তাছাড়া ওরা তো ফ্লাইট মিস করেনি, আর চৌধুরি কি দেখেননি যে মেয়েটিকে রিমি সাহায্য করতে গেছে সে দেখতেই কত অসহায়?

“তোমার মেয়ে মাদার তেরেসা হয়েছে? তোমাকে বোকা বানাতে পারবে, আমাকে না। আজকাল কে কাকে সাহায্য করে বল তুমি? কে করে? কেউনা। তোমার মেয়েত ভাবে সে একটা কিছু। আমি কিছু দেখিনা ভাব তুমি? সে এয়ারপোর্টে হেঁটে বেড়িয়েছে পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য। ইচ্ছেমতন পোশাক করা, অনেক রাত করে ঘরে ফেরা। এসব আমি আর সহ্য করবনা। আর সহ্য করবনা তোমার মেয়েদের রাত করে নাইট ক্লাব হতে ঘরে ফেরা।“
একজন জন্মদাতা্র গর্বিত আর উচ্চ স্বরে তার মেয়েদের বেশ্যা ডাকা। এ লজ্জা আর অপমান কোথায় রাখা যাবে?

“এসব কি বলছ? আমার মেয়েরা কেন নাইট ক্লাবে যাবে? ওদের আমরা বড় করেছি, তুমি আর আমি, এতটুকু বিশ্বাস কি নেই তাদের প্রতি তোমার?”

“কিসের বিশ্বাস? দেশে থাকতে নামাজ কালাম শিখিয়েছি। এ্যামেরিকা গিয়ে সব ভুলে গেছে। টাইট পোশাক পরে ঘুরে বেড়ায়, ছেলেদের সাথে ফোনে কথা…তুমি নিজে ঠিক নেই, মেয়েদের কেও বড় করছ বেশ্যার মতন। জীবনে ওদের ভাল বিয়ে দিতে পারবেনা কোন ভাল মুসলিম ঘরে, এটা মনে রেখ।”

“আমার মেয়েরা বেশ্যা না! না! রাতের পর রাত তুমি যখন নাইট ডিউটিতে থাক তখন আমার মেয়েরাই আমাকে আগলে রাখে। ঈদ যায়, চাঁদ যায় আমার জন্য আমার মেয়েদের জন্য তোমার হাতে একটা টাকা উঠেনা। কারন সব টাকা পাঠাতে হবে বাংলাদেশে যেখানে তোমার স্বপ্নের একটা মাদ্রাসা গড়ে উঠবে। আমার সব প্রয়োজন মেটায় আমার মেয়েরা। আমি ওদের বন্ধু। আমি জানি আমার মেয়েদের।” এবার রেহনুমার চীৎকার।

ধরণী দ্বিধা হও। রিমি আর সুমির মনে হচ্ছিল মায়ের তাদের পক্ষ হয়ে কথা বলার সময় এটা না। শুধু চুপ হয়ে থাকাটাই শ্রেয়। ওই একমাত্র উপায় তাদের বাবাকে চুপ করানোর। রেহনুমার প্রতিটি কথার প্রেক্ষিতে চৌধুরী এত জোরে চীৎকার করছিলেন যে লাইনের সর্বশেষ ব্যক্তিও শুনতে পাবে রিমিকে কোন বিশেষণে ডাকা হচ্ছে।
কিছুক্ষন চৌধুরী চুপ চাপ। হয়তো লাইন সামনে এগুচ্ছে বলে। হয়তো প্লেনে বসে আবার নুতন করে সব শুরু হবে।

হঠাৎ রিমি দেখতে পেল তাদের বাবা তার হাতের ব্যাগ আর পাসপোর্ট মায়ের হাতে দিয়ে লাইন হতে বেরিয়ে গেলেন।
বাবা কোথায় যাচ্ছেন? রিমি ফিরে এসেছে! রিমির কারনে ওরা ফ্লাইট মিস করেনি! উনি কোথায় যাচ্ছেন?

রেহনুমা ঘুরে তাকালেন মেয়েদের দিকে। রিমি আর সুমির জিজ্ঞাসু দৃস্টি।
“আর কি, সেই সব সময়ের মতন শেষ মূহুর্তের বাথরুমে যাওয়া। গত আটত্রিশ বছর ধরে সহ্য করছি। এতক্ষন বসে ছিল, বাথরুমে গেলনা, যা এখন দৌড়া।“
রেহনুমার বলার ভঙ্গিটা এতই মজার ছিল রিমি হাসতে শুরু করল। তার সাথে যোগ দিল সুমি। তারপর অনেকক্ষন রিমির দিকে তাকিয়ে রেহনুমাও হাসতে শুরু করলেন।
ওরা জানে এমনটি হয়। ছোটবেলায় যখন দেশে ছিল তখন হতে দেখে আসছে। হয়তো সবাই মিলে কোথাও যাবে, সবাই তৈরী, বাহিরে ট্যাক্সি এসে গেছে। তখনই চৌধুরীর দৌড় বাথরুমের দিকে। আর ওখান হতে চেঁচিয়ে রেহনুমাকে জানানো “ট্যাক্সি কে অপেক্ষা করতে বলো।“
আর প্রতিবারই রেহনুমার জবাব-
“তুমি বাথরুমকে তোমার গলার সাথে সব সময়ের জন্য পেঁচিয়ে নিলেই পার। তাতে করে ট্যাক্সি বা আমরা কাউকেই অপেক্ষা করতে হয়না।“

প্রচন্ড গরমে ভীষণ তৃষ্ণায় এক গ্লাস ঠান্ডা জলের মতন এই হাসিটি ওদের দরকার ছিল। ভেতরের দমে থাকা নিশ্বাস, রাগ, অপমান আর ঘামকে হাসি জলের মতন ধুয়ে দিল। চারপাশের এত বাঙ্গালী এতক্ষন ওদের দেখছিল, ওদের অভদ্র আর রুচিহীন ভাবছে, তাদের তিনজনের হাসি এই চিন্তাকে অনেক দূর তাড়িয়ে দিল।
রিমির কি হল জানে না ও। শুধু চোখে জল আসে। হঠাৎ রিমি তার সেই আগের বাবার অভাব বোধ করল। যে বাবা দেশে হঠাৎ লোড শেডিং হলে সবাইকে একত্র করে গল্প করত। যে বাবা পুরনো দিনের বাংলা আর হিন্দি গান শোনাত সবাইকে। যে বাবার কনে আঙ্গুল রিমির ছোট্ট হাত মুঠি করে বাবার সাথে নেউ মার্কেট ঘুরতে যেত। হঠাৎ বিধর্মির দেশে এসে সে বাবাকে হটিয়ে দিয়ে তার জায়গায় দখল নিল একজন ভীষণ ধার্মিক। যার কাছে লুডু খেলার গুটির আওয়াজও মনে হয় শয়তানের টিক টিক। যিনি দেশে থাকতে অত কঠোর ছিলেন না তিনি যেন সেই আগের ভুলের মাশুল দিতেই তিন চার গুন বেশি আল্লাহ ভক্ত হয়ে উঠলেন। তিনি এখানে ভাল আছেন, ভাল খাচ্ছেন এই অপরাধবোধ হতে জন্ম নিল দেশে মাদ্রাসা আর মসজিদ গড়ার পরিকল্পনা। বিধর্মিদের দেখে তার নিজ ধর্মের প্রতি মমতা উথলে উঠল। তার দু মেয়ে আর স্ত্রীর প্রয়োজন কিভাবে মিটছে, অথবা আদৌ মিটছে কিনা সে ব্যাপারে অন্ধ। যতই রেহনুমা মনে করিয়ে দেন, মসজিদে চেরাগ দেবার আগে নিয়ম হচ্ছে ঘরে চেরাগ দেয়া ততই তিনি রেহনুমাকে দমিয়ে দিয়েছেন তার গলার আর গায়ের জোরে।

সামনে আর পনের থেকে বিশ জন মানুষ। চৌধুরি এখনো ফিরে আসেননি। রেহনুমা বারবার ফিরে তাকাচ্ছেন।
“তোরা সবাই আমাকে হার্ট ফেল করাবি। প্রথমে তুই, এখন তোর বাবা।“
অনেক লম্বা করিডোরের মতন।
চৌধুরি এখনো ফেরেননি। রিমি আর সুমি যতই তাকে সান্তনা দেয় আর বলে যে তাদের বাবা ফ্লাইট নং জানে, গেট নং জানে, তাছাড়া এখনো বিমান ছাড়তে অনেক সময়, তাকে এখানে রেখে বিমান চলে যাবেনা; রেহনুমা শুনতে নারাজ।
ওরা একে একে সবাই বিমানে উঠে গেল। সবাই যার যার সীটে। রেহনুমাকে শান্ত রাখা যাচ্ছেনা।
সুমি উঠে গিয়ে একজন স্টুয়ার্ড কে তার বাবার নাম সহ সব জানালো।
কিছুক্ষন পর স্টুয়ার্ড ফিরে এসে জানাল এ মাত্র তারা জানতে পেরেছে ও নামের একজন গেট ৯ এর পথ হারিয়ে ফেলেছিল, কিন্তু এখন সে প্রায় পৌঁছে গেছে।
বাবাকে আসতে দেখে সুমি ও রিমি তাদের সীটে গিয়ে বসল।

“তোর মাথা খারাপ কিনা আমি জানিনা। বাবা সাথে আছে তারপরও কি যে সব করিস! কি দরকার ছিল বাবাকে উস্কে দেবার, ওদের সাথে এয়ারপোর্টে ঘুরে বেড়ানোর?”

রিমি ভেবেছিল ওই হাসিই সব কিছুর উপসংহার টেনেছে। তাই একটু ধাতস্থ হয়ে পরে সুমিকে বিস্তারিত জানাবে বলে ঠিক করেছিল।
“জানিস দিদি, আমি ওই মেয়েটির নামটি পর্যন্ত জানিনা, তারপরও…”
“তারপরও তাদের সাথে তিন তলায় হন হন করে চলে গেলি, যেখানে তুই কাউকে চিনিস না, জানিস না…”
“হ্যাঁ কিন্তু আমি এমন একটি ভাষা জানতাম যা ওদের অজানা!”
“এয়ারপোর্ট ভর্তি অনেক মানুষ আছে যাদের ইংলিশ অজানা, তাই বলে সবাইকে কোমর বেঁধে সাহায্য করতে নামবি?”
“সবাইকে নয়, কিন্তু নিশ্চয়ই যারা আমার কাছে এগিয়ে এসে সাহায্য চায় তাদের! আর এখানে ভাষার ব্যাপারটা খুবই গৌন!”
“তবে মুখ্য কোনটি?”
“মুখ্য হচ্ছে সেই নিষ্ঠুর সত্য যে এই সুন্দরী বাচ্চা মেয়েটি যার চোখ ভর্তি জল, তাকে বিক্রি করা হয়েছে সৌদির এক শেখের কাছে। দশ হাজার টাকায় সুদি, মাত্র দশ হাজার টাকায়। তার পরিবার এখন পাবে তিন হাজার, বাকি টাকা প্রতি মাসে পাঠানো হবে।“ রাগে দুঃখে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল রিমি।

অনেক্ষন দুজনেই নীরব।
রেহনুমা পেছন ফিরলেন তার সীট হতে।
“কিরে তোরা আবার ঝগড়া শুরু করেছিস নাকি?”
তার দুমেয়ে একসাথে না সূচক মাথা নাড়ল।

“তিনি নিজে কি জানেন?” সুমির প্রস্ন।
“তিনিই তো আমায় জানালেন।“

তৃতীয় তলায় পৌঁছে লিফট হতে নেমে “কারিশমা কাপুর” মন্তব্যের পর এক কথা হতে আরেক কথায় সুন্দরী যখন জানতে পারল রিমি থাকে এ্যামেরিকায় তখন একটা দীর্ঘশ্বাস।
“অনেক সুন্দর আর বড় দ্যাশ, না আফা? কোন দুঃখ নাই, কস্ট নাই, খালি শান্তি।“
“সব জায়গায়ই কস্ট, বেদনা, আনন্দ সব মিলেমিশে থাকে। কারন এসবই মানুষের সৃষ্টি তো তাই। মানুষ যেখানে আছে, সেখানে কম বেশি এসবই আছে। আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”
“সৌদী আরব”।
“তাই? ওখানে আপনার পরিবারের আর কেউ আছে বুঝি?”
“জ্বেনা। আমারে বেইচ্যা দিছে, সৌদীর এক শেখের কাছে। এক হোটেলে কাম করব নয় মাস।“

প্রচন্ড ধাক্কা! ব্যাথা! হ্রদয়টা মুচড়ে ব্যাথা! এই ব্যাথা হতেই কি চোখে জল?
“আর কি কোনই উপায় ছিল না?” উত্তর জেনেও রিমির এ প্রশ্ন। তৃতীয় বিশ্বের জন্য এটা নুতন কিছু না। তৃতীয় বিশ্ব কি, উন্নত দেশ গুলোও এসব ব্যাপারে কতটা অনুন্নত তার প্রমান হাজারো পত্রিকায়, প্রবন্ধে, চলচিত্রে… সারা জীবন ইনাদের একজনেরই জীবনী পড়ে বা দেখে এসেছে রিমি, কখনো এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবেনি। কি সহজ ভাবেই না তার ধারালো সত্য কে বলে যাচ্ছে।

“না আফা, বড় পরিবার, বাপের বয়শ হইছে, খাওয়াইতে পারেনা। তাছাড়া আমাগো গ্রামের এক পোলা আমারে নষ্ট করছে মেলা আগে। এখন বেশি টাকা কামাইতে পারব। শুনছি বড় বড় মুসলিম দেশে শেখেরা বহুত টাকা দ্যায় আমাগো দেশের কম বয়শি মেয়েগো লাগি। হিন্দু হোক, মুসলিম হোক, বয়শ কম হইলেই হল।“ হাসছে মেয়েটি।

রিমির বিস্মিত দৃস্টি। ইনি হাসছেন কেন?
“আমরা নারী জাত কেমুন নাগো আফা? আমার জামাই আমারে ছাইড়া চইলা গেছে বহুত বছর আগে। এখনো সিন্দুর পরি। কেন পরি? হে ত আমারে বাল বরাবর পাত্তাও দিল না। তবুও কেন পরি। অভ্যাস হইয়া গেছে।“ আবারো হাসছে মেয়েটি।

রিমি অনেক কষ্টে নিজেকে ধরে রাখবার চেষ্টা করছিল। মাথাটা ঘুরছে। ইনি একজন হিন্দু নারী। বিবাহিতা হিন্দু নারী। যাকে বাধ্য করা হয়েছে বোরখা পরতে। যার সিঁথির সৌন্দর্য লাল সিঁদু্রকে ঢেকে রেখেছে কালো বোরখার পর্দা। যে বোরখার আড়ালে তার সারা জীবনের পরিচয় আর অস্তিত্ব ঢাকা। একটি নকল মুসলিম নাম আর ভীষন আসল স্বপ্ন। নিজের জন্য স্বপ্ন নয়, শুধু পরিবারের কিছু মানুষের জন্য। উচ্চাকাংখা নয়, স্বপ্ন দেখবার যে সীমা আছে তাও সুন্দরীর জানা। সবাই দুবেলা খেতে পারবে এখন এটাই বড় স্বপ্ন আর চাওয়া।
২০০৭ সাল। ভাবল রিমি। এই লজ্জা আর অপমান কোথায় লুকোনো যাবে? আর কত?

“দাড়িওলা লোকটা? আমার বডিগার্ডের মতন। ওনার কাজ হইল আমারে সৌদিতে নিরাপদে পৌঁছায়ে দেয়া। ভালো লোক, ভদ্র আছে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। ওনারে দাদা ডাকতে মন চায়, কিন্তু ভাইজান বলে ডাকি।“
হ্যাঁ রিমি জানে উনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। তার কপালে সে চিহ্ন পুরুস্কার হয়ে জ্বলছে।

চৌধুরী এসে রেহনুমার পাশে বসলেন।
“আসতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম বুঝলে?”
“কিন্তু কিভাবে? আমি তো অস্থির হয়ে পড়েছিলাম! তোমার মেয়েরা বলল তোমাকে না খুঁজে বিমান ছাড়বেনা।“
তারপর চৌধুরী বিস্তারিত বর্ণনা দিতে শুরু করলেন।
বাথরুম হতে বেরিয়ে এসে ডানে না গিয়ে ভুল করে বাঁয়ে চলে গিয়েছিলেন তিনি। ওখানে আগের মতন দোকান গুলো নেই, গেট ৯ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। বুঝলেন পথ ভুল করেছেন। তারপর আবার ফিরে গেলেন বাথরুমের ওখানে। এবার গেলেন ডানে। ৯ নাম্বার গেটের কাছে এসে কোন মানুষ জন না দেখে ভড়কে গেলেন। তখনই ঘড়ির দোকানের একটা কর্মচারী ছেলের কাছে তিনি গেলেন সাহায্য চাইতে।

“এত হেল্পফুল তোমাকে কি বলব রেহনুমা! প্রথমেই আমাকে দেখে বলল “আসসালামু আলাইকুম”। কি উচ্চারন, কি শুদ্ধতা, কি ভদ্রতা! তার কারনেই ভরসা হারাইনি। আজকাল কোথায় পাওয়া যায় কম বয়শী ছেলেরা এত ভদ্র আর ভাল? কে কাকে সাহায্য করতে ওভাবে এগিয়ে আসে বল? আসলে ধর্ম, সবই ধর্মের কারনে। যদি আমাদের দেশ বা বিশ্বের সব দেশ কুরান আর ইসলাম দ্বারা শাসিত হত, তাহলে আমরা সবাই ভাগ্যবান হতাম এরকম উচ্চারন শিখতে আর খাঁটি মুসলমানদের সাথে মিশতে। এটা মুসলিম দেশ। এখানে কোন বেলাল্লাপনা নেই, ওইসব দেশের মতন। আসলে আমাদের দেশটাও ডুবে যাচ্ছে বিধর্মিদের দেশ অনুসরন করে করে। আমাদের দেশের সব কম বয়শি দের উচিত এইসব দেশে এসে শিক্ষা গ্রহন করা…বিশ্বের ভাল ভাল দেশ…সৌদি আরব, মিসর, ইরান…।“

চৌধুরীর কথা সবই শুনতে পাচ্ছিলো রিমি। ইঞ্জিনের গর্জনের কারনে ধীরে ধীরে কথাগুলো আবছা হয়ে আসছে…

রিমির দৃষ্টি জানালার বাহিরে। শুধুই অন্ধকারের রাজত্বি বাহিরে। অন্ধকার কত গভীর, তারপরো দৃষ্টি ওদিকে যায়। কি যেন খুঁজে ওখানে। জীবনের গভীর কষ্টের ন্যায়। কষ্টের সাগরেও ডুবে ডুবে হাতড়ে হাতড়ে একটু সুখের জন্য কি যেন খোঁজা।
রিমির ঠোঁটে মৃদু হাসি।
“সুদি…”
“শুনছি…”
“বম্বশেল নিয়ে একটি গল্প আছে, পরে মনে করিয়ে দিস তো।“
“আচ্ছা”।

বিমান এক্ষুনি আকাশে উঠবে। সুমির উচ্চতার ভয়, মাথা ধরা, সব মিলিয়ে ক্লান্ত শরীরের ক্লান্ত মাথাটি রিমির কাঁধে এলিয়ে দিল। সুমির মাথার সাথে হেলানো রিমির মাথা। দুটি বোন। একে অপরের কাছে বিশ্রাম আর ভরসা।
সুমির চিন্তা কবে এই বিমান মাটিতে নামবে যাতে করে তার মাথা ব্যাথা আর উচ্চতার ভয় হতে মুক্তি পাবে।
রিমির চিন্তা মানুষকে পণ্য বানানো নিয়ে, মানুষের জীবনে শব্দ আর অনুভুতির খেলা নিয়ে।

সুন্দরী বলেছিল, সে অনেক আগেই নস্ট হয়ে গেছে। যে প্রশ্ন রিমি করতে চেয়েও করেনি – কার মতে, কাদের মতে এই নারী নষ্ট? কে নির্ধারন করবে কে নষ্ট?
তার চোখে রিমি দেখেছে ভাইয়ের জন্য দুশ্চিন্তা আর ভালোবাসা। তার পরিবারের জন্য যে কোমলতা আর ভাবনা তা রিমিকে ছুঁয়ে গেছে। নিজেকে উজাড় করে পরিবারের বাকি সবার ভবিষ্যত ঠিক করছে সে। রিমি দেখেছে তার কৃতজ্ঞ দৃষ্টি সেই লোকটির প্রতি যে তাকে নিরাপদে পৌঁছে দেবে। রিমিকে এই নারী বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে লোকটি তাকে ছেড়ে চলে গেছে বহু আগে, তারই জন্য সুন্দরীর হ্রদয়ের একটি জায়গা এখনো অক্ষত আর কুমারী রয়ে গেছে। এর চাইতে শুদ্ধ বা পবিত্র কে হতে পারে?

আচ্ছা মেয়েটি চোখের জল মুছবে কি দিয়ে? তার হাতে কোন রুমাল অথবা টিস্যু ছিলনা। হাতের উলটো পিঠ দিয়ে বোধ হয়। রিমিও তার হাতের উলটো পিঠ দিয়ে নিজ চোখের জল মুছে নিল।

***সত্য ঘটনা অবলম্বনে…***