:: নিউ ইয়র্ক (প্রথমার্ধ) :: নিউ ইয়র্ক (দ্বিতীয়ার্ধ) :: সিলিকন ভ্যালি (ক্যালিফোর্নিয়া) :: ওয়াশিংটন ডিসি :: ডেট্রয়েট (মিশিগান) ::

১৮০৩ সালে প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যভাগের প্রায় ১৫টি স্টেইট (প্রদেশ) ফ্রান্সের কাছ থেকে নিজেদের আওতায় নিয়ে আসেন। যেটি বিখ্যাত লুইজিয়ানা পার্চেজ (লুইজিয়ানা ক্রয়) নামে পরিচিত। ফ্রান্স সেটা বিক্রি করেছে, না-কি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে সেটা আপাতত না ভাবলেই আমাদের জন্য ভালো। কিন্তু, এই বিশাল পরিমাণ সম্পত্তির সুষ্ঠু ব্যবহার ও বণ্টন নিয়ে প্রেসিডেন্ট জেফারসনতো আর না-ভেবে বসে থাকতে পারেন না। তাই, ১৮০৪ সালে এই বিপুল অঞ্চলে অভিযান চালানোর জন্য প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব দিলেন ইউএস আর্মির বর্ষীয়ান অফিসার ক্যাপ্টেন লুইসকে। পরবর্তীতে লুইসের সহযাত্রী হিসেবে দলে আসেন আর্মিরই আরেক অভিজ্ঞ সহযোগী সেনা মিস্টার ক্লার্ক।

লুইস ও ক্লার্ক এর অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিলো, লুইজিয়ানা পার্চেজ এর পর যে বিশাল পরিমাণ ভূ-খণ্ড সরাসরি আমেরিকার আওতায় চলে আসে, সেখানে অভিযান চালিয়ে নতুন নতুন উদ্ভিদ, প্রাণি ও বৈজ্ঞানিক তথ্য সংগ্রহ করা। সাথে সাথে ঐ অঞ্চলে অবস্থিত মিসৌরি নদীর অববাহিকায় বসবাসরত জনপদকে জানান দেয়া যে, তারা এখন আমেরিকার অধীনে; পূজারী এবং পূজার ধরণ একই থাকবে, শুধু দেবতার নাম পরিবর্তন হবে; ফ্রান্সের বদলে আমেরিকা হবে তাদের নতুন প্রভু। তবে মিস্টার জেফারসনের মনে মনে পরিকল্পনা ছিলো, যতদূর সম্ভব পশ্চিমে অভিযান চালিয়ে আমেরিকানদের পদচিহ্ন রেখে আসা, যাতে করে বেত্তমীজ ইউরোপীয়ানদের দল উড়ে এসে জুড়ে বসতে না পারে, হঠাৎ এসে দাবী করতে না পারে এই অঞ্চল তাদের । প্রায় দুই বছর সফল অভিযান চালিয়ে লুইস-ক্লার্ক অবশেষে সন্মুখীন হয় বিশাল বাধার, সেই বাধা অতিক্রম করে কোনোভাবেই আর পশ্চিমে যাওয়া সম্ভব নয়। ৩৩ জনের দল নিয়ে অভিযান শুরু করা লুইস-ক্লার্ক এই প্রথম থমকে দাঁডিয়ে অবাক দৃষ্টিতে দেখছিলো তাদের সেই মহাকায় দিগন্ত বিস্তৃত প্রতিপক্ষকে। নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ ছাড়া যার কাছে অন্য আর কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়- প্রশান্ত মহাসাগর, দ্যা প্যাসিফিক

            ছবিঃ এখানে এসে অভিযান থামাতে বাধ্য হন লুইস এন্ড ক্লার্ক

যে জায়গায় থমকে দাঁড়িয়েছিলো লুইস-ক্লার্ক, যেখানে শেষ হয়েছিলো তাদের সুবিখ্যাত অভিযান; সেখানটাতে আজ দাঁড়িয়ে আছে পোর্টল্যান্ড, ওরিগন স্টেইট এর সবচেয়ে বড় শহর। সিটি অব রোজেস্ নামে পরিচিত। এমনকি শহরটির অফিসিয়াল নামও এটিই।অবশ্য শহরের অন্য আরো অনেকগুলো ডাক নাম আছে, যার মধ্যে ব্রিজ টাউন এবং বিয়ার টাউন নাম দুটি উল্লেখযোগ্য। ওরিগনের গোলাপ বিখ্যাত, প্রচুর চাষও হয়, এখানেই আবার আছে আন্তর্জাতিক গোলাপ বাগান। তাই, সিটি অফ রোজেস ছাড়া শহরের নাম অন্য আর কী-ইবা হতে পারে। এখানকার ওয়াইন এবং বিয়ারের সুখ্যাতি আবার এতই যে, বিয়ারপ্রেমীর শহরকে বিয়ার টাউন বলতেই সুখ বোধ করেন। সারা আমেরিকার মধ্যে এখানেই সবচেয়ে বড় বিয়ার উৎসব হয়ে থাকে। অন্যদিকে, ইন্টারনেট বা অন্য কোথাও থেকে পোর্টল্যান্ড শহরের ছবি দেখলে দেখবেন মূল শহরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া উইলিয়ামিত্তি নদীর দুই পাড়কে জোড়া লাগানো হয়েছে বেশ কয়েকটা উঁচু এবং দৃষ্টিনন্দন ব্রিজ দিয়ে, যার কারণে কারো কারো কাছে শহরটি পরিচিত হয়ে গেছে ব্রিজটাউন নামে।

জুন মাসের প্রথম দিকে প্লেন থেকে নামার আগে জানালা দিয়ে চোখে পড়ল শহরের পাশে বিশাল বিশাল দুটো তুষারশুভ্র স্তুপ, সুর্যের আলো পড়ে চকচক করছে। পাইলট জানান দিলো ওগুলো মাউন্ট সেন্ট হেলেনস্ আর মাউন্ট হুড্। যেন প্রহরীর মত একজোড়া চোখ হয়ে চূড়া দুটি সারাটাক্ষণ শহরটাকে পাহারা দিয়ে যাচ্ছে। বিমানবন্দর থেকে শহরে যাবার ট্রেনে উঠে পড়লাম, মানুষজন খুবই মিশুক প্রকৃতির। একজন বয়স্কা মহিলা নিজ থেকেই কথা বলা শুরু করলেন, আমি এবং আমার ওয়াইফকে দেখেই বুঝতে পারলো ট্যুরিস্ট। আমরা অবাক হয়ে ট্রেনের জানালা দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পর্বতচূড়াগুলো দেখার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। প্রসন্ন চিত্তে ভদ্রমহিলা বলে চললেন, আমরা ঠিক সময়টাতেই ওরিগন এসেছি, বছরের এই সময়টাতে ওয়েদার খুব ভালো থাকে। শহরের কোথায় কি কি দেখার আছে, নিজ থেকেই সব বলে দিচ্ছেন একে একে। আমরা শিকাগো থেকে আসছি শুনে বললেন, হ্যাঁ সেখানে উঁচু উঁচু বিল্ডিং আছে বটে, কিন্তু প্রকৃতি দেখতে হলে এখানটাতেই ভালো।

শহরের মাঝখানে (ডাউনটাউন) এসে দেখলাম সবাই ট্রেনে উঠছেন নামছেন, এই ডাউনটাউন এরিয়াতে ট্রেনে যাতায়াত ফ্রি, যতখুশী উঠো-নামো। মানুষজন খুব আয়েশিভাবে শহরে হেঁটে বেড়াচ্ছে। শিকাগোর মত অত বড় কিংবা ব্যস্ত শহর নয়। কেমন জানি একটা অলস সৌন্দর্য আছে। একজায়গায় দেখলাম শহরের মাঝখানে একটা চত্ত্বরে ছেলেবুড়ো সবাই মিলে রোদ পোহাচ্ছে, সাথে করে ফোল্ডিং চেয়ার নিয়ে এসেছে। বাচ্চাগুলো স্ট্রলারের মাঝে পাশে রেখে দিয়েছে। শীতের সকালের বাংলাদেশের গ্রামে লোকজন জড়ো হয়ে রোদ পোহানোর মতন। আমরা ডাউনটাউন পার হবার পরই সাজিনা ভাবী ফোন করলেন, সুজন ভাইয়া একটু পরেই আমাদেরকে আনার জন্য স্টেশানে পৌঁছে যাবেন। সুজন ভাইয়া বুয়েটের স্টুডেন্ট ছিলেন। পারডু ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করার পর এখন ইন্টেলে চাকুরী করছেন। বিশ্বখ্যাত ইন্টেল কোম্পানীর প্রধান শাখা এই পোর্টল্যান্ডেই।

এত রং-বেরংয়ের মানুষ, এত ধরণের মানুষ এখানে দেখি। তবুও নিজের দেশের একটা শিশুকে দেখলেও যে আনন্দ অনুভব হয় সেটা আর কিছুতেই হয় না। সুজন ভাই সাজিনা ভাবীদের বাসায় যেন সেই বাংলাদেশের পারিবারিক আনন্দই খুঁজে পেলাম।আনন্দের খুঁজে পাওয়ার আরেকটা গোপন অবশ্য কারণ আছে। আলুর ভর্তা, গরুর মাংস আর পৃথীবির শ্রেষ্ঠ স্যুপ- মসুরের ডাল খাওয়ার একটা সমূহ সম্ভাবনা এখানে আছে। ভাগ্য ভালো থাকলে ইলিশ আর বেগুনভাজাও কপালে জুটে যাবে। কিন্তু কি আর ভাগ্য ভালো খারাপ, বাসায় গিয়ে দেখি ভাগ্যদেবী সাজিনা ভাবীর বাসায় বসবাস করেন। সুজন-সাজিনা, কি করে দুইজনের নামের সব অক্ষর এক হলো এই রহস্য উদ্‌ঘাটনের আগেই খাবারের মাঝে সেই যে ডুব দিলাম, ভেসে উঠতে উঠতে রাত গড়িয়ে সকাল হলো।

              ছবিঃ ছবির মত সেজে থাকা প্রকৃতির মাঝে গোলাপ বাগান

জুন মাসের সকাল। শুরু হলো আমাদের ওরিগন দেখা, পোর্টল্যান্ড দেখা। হায়রে সৌন্দর্য। এরা যেন প্রকৃতির জন্য এক অভয়ারণ্য তৈরী করে রেখেছে। প্রকৃতি নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে, হেলে দুলে বেড়ে উঠেছে এখানে। পুরো ওরিগন-ই যেন সৌন্দর্যের লীলাভূমি। মানুষজন সবাই প্রকৃতিতে বিচরণ করে কিন্তু কেউ প্রকৃতিকে বিরক্ত করে না। কী সমুদ্র, কী পর্বত, কী নদী, কী জঙ্গল, কী ঝর্ণা সবই আছে এখানে, এক অপার সৌন্দর্য নিয়ে। মাইলের পর মাইল গাড়ী চালাচ্ছেন সুজন ভাই। কিন্তু মনে হচ্ছে নিমিষেই বুঝি শেষ হয়ে গেলো পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে এগিয়ে চলা সুপ্রশস্ত রাস্তা। এক এক দিন করে আমরা এক একটা দিকে যাই আর বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যাই। রাতে বাসায় ফিরে ক্লান্তির বদলে চলে আসে শান্তি, সাজিনা ভাবীর কল্যাণে টেবিলে যখন দেখি হরেক রকমের সুস্বাদু খাবার।

                    ছবিঃ অপরূপ প্রশান্ত মহাসাগর-১

                    ছবিঃ অপরূপ প্রশান্ত মহাসাগর-২

                    ছবিঃ অপরূপ প্রশান্ত মহাসাগর-৩

                    ছবিঃ অপরূপ প্রশান্ত মহাসাগর-৪

এর মাঝে একদিন আবার চলে গেলাম মাউন্ট সেইন্ট হেলেনস্-এ; পৃথীবির অন্যতম এক সক্রিয় আগ্নেয়গিরি। ১৯৮০ সালের মে মাসের এক সকাল ৮টায় এই আগ্নেয়গিরির যে অগ্ন্যুৎপাত হয়, সেটাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ভয়াবহতম এবং ধ্বংসাত্মক বলে বিবেচনা করা হয়। ২৯৮ কিলমিটার সড়কপথ এবং ২৪ কিলোমিটার রেলপথ ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়ে সে-দিন। ধ্বংস হয়ে যায় ৪৭টি সেতু এবং ২৫০টি ঘরবাড়ী। রিখটার স্কেলে ৫ মাত্রার ভূমিকম্পে মৃত্যু হয় ৫৭জন মানুষের। পর্বতচূড়ার উচ্চতা কমে যায় প্রায় ১০০০ ফুট আর সেখানে সৃষ্টি হয় দেড় কিলমিটার লম্বা গর্তের। আট হাজার ফুট উচ্চতার এই আগ্নেয়গিরির কাছে গিয়ে বিধ্বস্ত সুবিশাল উপড়ে পড়া অসংখ্য গাছের শিকড় দেখলে বুঝা যায়, কি প্রচন্ড শক্তিতে আঘাত হানে অগ্ন্যুৎপাত। সেইন্ট হেলেনস্ এর অবস্থান অবশ্য পাশের ওয়াশিংটন স্টেইট এ। দুই স্টেটের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া কলম্বিয়া নদীকে ওয়াশিংটন আর ওরিগণ স্টেটের সীমানা প্রাচীর হিসেবে ধরা হয়।

                ছবিঃ দূর থেকে দেখা মাউন্ট সেইন্ট হেলেনস্

ওদিকে শহরের মাঝখানে দেখার জন্য জাপান গার্ডেন, চায়না গার্ডেন, রোজ গার্ডেন আছে। কিন্তু আলাদা করে গার্ডেনে যাবার কোনো প্রয়োজন দেখিনা। পুরো শহরটাই গার্ডেন। রোজ গার্ডেনে গিয়ে অবশ্য খুব একটা গোলাপ দেখতে পেলাম না। শুধু গাছের সাথে লাগানো ছোট্ট সাইন বোর্ডে দেখলাম উইনার ২০১০,উইনার ২০০৯; অত্যন্ত উচ্চবংশীয় গোলাপদল। ওদিকে, শহর থেকে একটু দূরে আছে মাল্টনোমাহ ফলস্, অদ্ভূত সুন্দর এই ঝর্ণা। দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে পড়তে থাকা ঝর্ণার অর্ধেক উচ্চতায় আবার একটা সাঁকো করে দেয়া হয়েছে। সেখানে দাঁড়ালে উপরে ঝর্ণা, নীচেও ঝর্ণা।

                  ছবিঃ ছয়শ বিশ ফুট উঁচু মাল্টনোমাহ্‌ ফলস্‌

প্রায় এক সপ্তাহের মত সুজন ভাইয়ের গাড়ীর গ্যালন গ্যালন তেল পুড়িয়ে, শত শত মাইল ড্রাইভ করে ওরিগনের সৌন্দর্যের কিছুটা হলেও কাছে যেতে পেরেছি। সৌন্দর্যের মাঝে গেলে সুন্দর হতে ইচ্ছে করে। সুউচ্চ মাউন্ট সেন্ট হেলেনস্ আর সুবিস্তৃত প্রশান্ত মহাসাগর বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে তাদের বিশালত্বের কথা। তারা কখনো আমাকে বলেনি আমি ক্ষুদ্র, কখনো বলেনি তারা বৃহৎ। বলতে হয়নি, আমিই বুঝে গেছি।

:: পোর্টল্যান্ড (ওরিগন) :: সিলিকন ভ্যালি (ক্যালিফোর্নিয়া) :: ওয়াশিংটন ডিসি ::

মইনুল রাজু (ওয়েবসাইট)
[email protected]