বেতার যোগাযোগের ক্ষেত্রে গবেষণায় স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর অবদানের কথা আমরা জানি। ভারতীয় উপমহাদেশে বেতার যোগাযোগ সম্পর্কিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদান শুরু হয়েছে যাঁর হাত দিয়ে – তিনিও আরেকজন বাঙালি – ডক্টর শিশির কুমার মিত্র। তিনিই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতার-পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সূচনা করেন। তিনিই উপমহাদেশের প্রথম বেতার সম্প্রচার চালু করেন – কলকাতা থেকে তাঁর ‘রেডিও টু-সি-জেড’ (2CZ) কেন্দ্রের মাধ্যমে। বায়ুমন্ডলের আয়নোস্ফিয়ারের বিভিন্ন স্তরের অস্তিত্বের পরীক্ষামূলক প্রমাণ প্রথম যাঁর হাত দিয়ে ঘটে – তিনি আমাদের শিশির কুমার মিত্র।

শিশির কুমার মিত্র

শিশির কুমারের বাবা জয়কৃষ্ণ মিত্র ছিলেন হুগলি জেলার কোন্নগরের এক গোঁড়া হিন্দু পরিবারের সন্তান। কিন্তু তৎকালীন হিন্দু সমাজের অনেক গোঁড়ামি তিনি মেনে নিতে পারেন নি। তারুণ্যে ব্রাহ্মসমাজের উদার আধুনিকতায় আকৃষ্ট হয়ে ব্রাহ্মসমাজে যাতায়াত শুরু করেন। সেখানে পরিচয় হয় ব্রাহ্মসমাজের আধুনিক মেয়ে শরৎকুমারীর সাথে। ১৮৭৮ সালে মা-বাবার অমতে তিনি বিয়ে করেন শরৎকুমারীকে। স্বাভাবিক ভাবেই বাড়িতে ঠাঁই হলো না তাঁদের। বাধ্য হয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন মেদিনীপুরে। শরৎকুমারীদের বাড়ি ছিল মেদিনীপুরে। জয়কৃষ্ণ মিত্রের বন্ধু ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, শিবনাথ শাস্ত্রী, বিপিন চন্দ্র পাল প্রমুখ। মেদিনীপুরে তাঁরা ছিলেন দশ বছর। বাবার বিষয়-সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত জয়কৃষ্ণ ভয়াবহ রকমের আর্থিক কষ্টে পড়েন। স্থানীয় স্কুলে শিক্ষকতা করে যা পান তা দিয়েই চলতে হয়। ইতোমধ্যে তাঁদের দুই ছেলে ও এক মেয়ের জন্ম হয়েছে। শরৎকুমারী কলেজের পড়াশোনা শেষ করেছেন অনেকদিন। লেখাপড়ায় অত্যন্ত মেধাবী শরৎকুমারীর আরো পড়াশোনা করার ইচ্ছে। ১৮৮৯ সালে তাঁরা মেদিনীপুর থেকে কলকাতায় চলে এলেন।

কলকাতায় এসে আরেকটা স্কুলে পড়ানোর কাজ পেলেন জয়কৃষ্ণ। শরৎকুমারী ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেলেন ক্যাম্পবেল মেডিকেল স্কুলে। তখনকার সমাজ ব্যবস্থায় বাঙালি মেয়ের পক্ষে মেডিকেল স্কুলে পড়া সহজ ছিল না। সামান্য স্কুল মাস্টারির আয় থেকে ছেলে-মেয়ে সহ সংসার- তার ওপর স্ত্রীর মেডিকেল কলেজে পড়াশোনার খরচ চালানো অনেক কঠিন। এরকম সময়ে ১৮৯০ সালের ২৪শে অক্টোবর জন্ম নিলো জয়কৃষ্ণ-শরৎকুমারীর চতুর্থ সন্তান। বড় দুই ছেলে সতীশ কুমার ও সন্তোষ কুমারের নামের সাথে মিলিয়ে নাম রাখা হলো শিশির কুমার। ১৮৯২ সালে ডাক্তারি পাশ করলেন শরৎকুমারী। চাকরির সুযোগ পেলেন বিহারের ভাগলপুরে – লেডি ডাফরিন হাসপাতালে। স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিলেন জয়কৃষ্ণ। সবাইকে নিয়ে ভাগলপুরে চলে এলেন। জয়কৃষ্ণ ভাগলপুর পৌরসভায় কেরাণীর চাকরি নিলেন। ভাগলপুরে জয়কৃষ্ণ ও শরৎকুমারীর আরেকটি সন্তান সুকুমারের জন্ম হয়।

ভাগলপুর জেলা স্কুলে শিশিরকুমারের পড়াশোনার শুরু। বাড়িতে বিজ্ঞানের বই আছে অনেক। জগদীশচন্দ্র বসু, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি, জগদানন্দ রায় – দাদারা পড়ে শোনায় তাকে। এ সময় কলকাতায় গড়ের মাঠে রামচন্দ্র ব্যানার্জি নামে এক যুবক বেলুনে চড়ে আকাশে উঠেছিল। কয়েকশ ফুট উঁচুতে উঠে কয়েক মাইল গিয়েছিল। গড়ের মাঠ থেকে বসির হাট। এ নিয়ে একটা ছড়া প্রচলিত হয়ে গেলো-
“উঠল বেলুন গড়ের মাঠে
নামল গিয়ে বসিরহাটে”।
ছড়াটা লোকমুখে ছড়াতে ছড়াতে শিশিরকুমারের কানেও পৌঁছল। শিশিরকুমারের বয়স তখন মাত্র ছয় কি সাত। তখন থেকেই তার মনে প্রশ্ন জাগতে শুরু করেছে – সব জিনিস উপর থেকে নিচে পড়ে যায় – কিন্তু বেলুন কেন উপরে উঠে যায়?

মোটামুটি আনন্দেই শৈশব শুরু হয়েছিল শিশিরকুমারের। কিন্তু বেশিদিন রইলো না সে আনন্দ। পরিবারে ঘটে গেলো একের পর এক দুঃখজনক ঘটনা। শিশিরকুমারের বড় দু’ভাই সতীশকুমার আর সন্তোষকুমার অসুখে পড়ে পর পর মারা গেলো। নিজে ডাক্তার হয়েও মা তেমন কিছু করতে পারলেন না। কোন রকমে শোক সহ্য করে নিলেন। কিন্তু বাবা জয়কৃষ্ণ এ শোক সহ্য করতে পারলেন না। খুবই ভেঙে পড়লেন। মানসিক ভাবে এতটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেন যে একসময় অপ্রকৃতস্থ হয়ে পড়লেন। হার্ট এটাক হলো। পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে বিছানায় পড়ে রইলেন। পুরো সংসারের দায়িত্ব এসে পড়লো একা মায়ের ওপর।

স্কুলের পড়াশোনা বন্ধ হবার জোগাড়। কিন্তু শক্ত হাতে হাল ধরলেন মা শরৎকুমারী। বাড়ির গুমোট পরিবেশে দিনরাত পড়াশোনায় ডুবে থাকে শিশিরকুমার। এন্ট্রান্স পাশ করার পর ভাগলপুরের টি-এন-জে কলেজ থেকে এফ-এ পাশ করেন। দীর্ঘ রোগভোগের পর বাবা জয়কৃষ্ণ মারা যান। শিশিরকুমার ভাবলেন পড়াশোনা আর না করে একটা চাকরি নিয়ে মায়ের বোঝা কিছুটা হালকা করবেন। মাকে বললেন কথাটা। কিন্তু মা শরৎকুমারী ছিলেন অন্য ধাতুতে তৈরি। প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি করে দিলেন ছেলে শিশিরকুমারকে।

১৯০৮ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে এলেন শিশিরকুমার। এতদিন যাঁদের নাম শুনেছিলেন – জগদীশচন্দ্র বসু – প্রফুল্লচন্দ্র রায় – তাঁদের সংস্পর্শে এলেন এখানে এসে। এ যেন এক অন্যজগৎ। জ্ঞান-বিজ্ঞানের এ যেন এক আশ্চর্য মিলন-ক্ষেত্র। জগদীশচন্দ্র বসুকে কাছ থেকে দেখে পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণার প্রতি ভীষণ আগ্রহী হয়ে উঠলেন শিশিরকুমার। ১৯১২ সালে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে এম-এসসি পাশ করলেন। এবার একটা চাকরি দরকার। বিধবা মা-কে কিছুটা সাহায্য করা দরকার। হাসপাতালে দিন রাত কাজ করতে করতে মা বড়ই দুর্বল হয়ে গেছেন।

সে বছর জগদীশচন্দ্র বসুকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ডি-এসসি ডিগ্রি প্রদান করেছে। জগদীশচন্দ্র বসু তখন উদ্ভিদের বৃদ্ধি-মাপার যন্ত্র আবিষ্কারের চেষ্টা করছেন। একদিন তিনি ডেকে পাঠালেন শিশিরকুমারকে। সহকারী গবেষক হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব দিলেন। শিশিরকুমারের কাছে এ যেন মেঘ না চাইতে জল। মহাউৎসাহে কাজ শুরু করলেন জগদীশচন্দ্রের সাথে। কিন্তু একটা সমস্যা দেখা দিলো। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে জগদীশচন্দ্রের অবসরের সময় হয়ে এসেছে। গবেষণা করার জন্য কোন আলাদা টাকা দেওয়া হয় না তাঁকে। তাঁর গবেষণা-সহকারীরা সবাই অবৈতনিক। জগদীশচন্দ্র নিজের টাকা থেকে মাঝে মাঝে তাঁদের কিছু কিছু দেন। শিশিরকুমারের মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। শিশিরকুমারের পক্ষে আর অবৈতনিক কাজ করা সম্ভব নয়। সবেতন চাকরির চেষ্টা করতেই হলো। কিছুদিন পর ভাগলপুরের যে কলেজ থেকে তিনি এফ-এ পাশ করেছিলেন সেই টি-এন-জে কলেজে পদার্থবিজ্ঞানের লেকচারার পদে নিয়োগ পেলেন। সেখানে কিছুদিন কাজ করার পর বাঁকুড়া খ্রিস্টান কলেজে যোগ দিলেন। মন-প্রাণ দিয়ে ছাত্রদের পদার্থবিজ্ঞান পড়াচ্ছেন। কিন্তু গবেষণার জন্য মন কেমন করছে। অথচ মফস্বল কলেজে গবেষণার তেমন কোন সুযোগ নেই। বাংলায় বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে লিখতে শুরু করেন। ১৯১৪ সালে শিশিরকুমারের বিয়ে হয় বরিশালের রায়বাহাদুর হরকিশোর বিশ্বাসের মেয়ে লীলাবতী বিশ্বাসের সাথে।

এদিকে ১৯১৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১৯১৬ সালে বিজ্ঞান কলেজে চালু হচ্ছে পদার্থবিজ্ঞানের স্নাতকোত্তর ক্লাস। উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখার্জি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তরুণ প্রতিভার সন্ধানে আছেন। ১৯১২ সালের পদার্থবিজ্ঞানের ফার্স্টবয়কে খুঁজে বের করলেন তিনি। শিশিরকুমার স্যার আশুতোষ মুখার্জির কাছ থেকে ডাক পেলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার জন্য। শিশিরকুমারের বয়স তখন ছাব্বিশ। শিশিরকুমার এসে যোগ দিলেন আরো সব প্রতিভার সাথে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে তখন চাঁদের হাট – সিভি রামন, দেবেন্দ্রমোহন বসু, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু সবাই এক জায়গায়।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে একটুও সময় নষ্ট করলেন না শিশিরকুমার। সি ভি রামন আলোকবিজ্ঞানের গবেষণায় ক্রমেই খ্যাতি লাভ করছেন তখন। জোরেশোরে কাজ চলছে ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশান ফর দি কাল্টিভেশান অব সায়েন্সের ল্যাবোরেটরিতে। শিশিরকুমার আলোকবিজ্ঞান নিয়ে কাজ শুরু করলেন রামনের তত্ত্বাবধানে। ১৯১৮ সালে ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হলো শিশিরকুমারের প্রথম গবেষণাপত্র [1]। ১৯১৯ সালে শিশিরকুমার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি-এসসি ডিগ্রি লাভ করেন তাঁর “ইন্টারফিয়ারেন্স এন্ড ডিফ্রাক্‌শান অব লাইট” থিসিসের জন্য [2]।

১৯২০ সালে ইউরোপে যাবার সুযোগ পেলেন শিশিরকুমার। প্যারিসের সারবোন ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে যোগ দিলেন প্রফেসর চার্লস ফেব্‌রির গ্রুপে। চার্লস ফেব্‌রি ১৯১৩ সালে বায়ুমন্ডলের উপরের স্তরে ওজোনের উপস্থিতি আবিষ্কার করে খ্যাতি লাভ করেছেন। শিশির মিত্র তাঁর গ্রুপে থেকে কাজ করলেন তামার বর্ণালী নিয়ে। এই কাজের ওপর লেখা থিসিসের জন্য তিনি তাঁর দ্বিতীয় ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করলেন সারবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৩ সালে। মেরি কুরি তখন ইনস্টিটিউট অব রেডিয়ামের প্রধান। শিশিরকুমার রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে গিয়ে মেরি কুরির গ্রুপে কাজ করলেন কিছুদিন। মাসখানেক পর প্যারিসের ন্যান্সি ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে যোগ দিলেন প্রফেসর গুটনের গ্রুপে। প্রফেসর গুটন তখন কাজ করছিলেন রেডিও ভাল্ব নিয়ে। বেতার যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা রেডিও ভাল্বকে ব্যবহার করছেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও কিছুটা ব্যবহার হয়েছে। প্রফেসর গুটনের গ্রুপের গবেষণা কাজ দেখে বেতার তরঙ্গ সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠলেন শিশিরকুমার। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় জগদীশচন্দ্র বসুকে কাছ থেকে দেখেছিলেন বেতার তরঙ্গ নিয়ে কাজ করতে। তখন থেকেই হয়তো অবচেতন মনে বিষয়টা সম্পর্কে আগ্রহ জন্মেছিল। এখন তা রীতিমত নেশায় পরিণত হল। রেডিও ভাল্ব নিয়ে সিরিয়াসলি কাজ শুরু করলেন। কয়েক মাসের মধ্যেই একটা ভিত তৈরি হয়ে গেল। যে বিষয়ে একটার পর একটা করে দুটো ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেছেন – সেখান থেকে সরে এসে বেতার তরঙ্গ নিয়ে কাজ করছেন। কিন্তু কাজ করতে করতে খেয়াল হলো রেডিও ওয়েভের কাজ শিখে যে কলকাতায় ফিরে যাবেন সেখানে তো এখনো রেডিও-ফিজিক্সের কোন গবেষণা দূরে থাকুক রেডিও-ফিজিক্স পড়ানোও হয় না। মনে মনে ঠিক করলেন কলকাতায় ফিরে নিজেই রেডিও-ফিজিক্স পড়ানো শুরু করবেন। উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখার্জিকে চিঠি লিখলেন শিশিরকুমার। লিখলেন ফিজিক্সের এম-এস-সি কোর্সে রেডিও-ফিজিক্স বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।

স্যার আশুতোষ মুখার্জি তাঁর চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন ১০ই মে ১৯২৩- “প্রিয় ডক্টর শিশির, তোমার ১৮ই এপ্রিলের চিঠি পেয়ে খুশি হলাম। তোমার কাজে সাফল্য এসেছে জেনে খুব ভালো লাগছে। তুমি লিখেছো সিলেবাসে ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফি যোগ করার কথা। বিষয়টা খুবই দরকারি এবং সময়োপযোগী তাতে কোন সন্দেহ নেই। বেশি টাকা-পয়সা লাগবে না এমন করে একটা প্রস্তাব তৈরি কর। তারপর দেখি কী করা যায়। তবে নিশ্চিত থাকতে পারো বিরোধিতার অভাব হবে না। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যুদ্ধ করেই এগিয়ে যাব। নভেম্বরে তোমার ফিরে আসার অপেক্ষায় রইলাম” [2,3]।

১৯২৩ সালে ফ্রান্স থেকে ফিরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘খয়রা অধ্যাপক’ পদে যোগ দিলেন শিশিরকুমার। বেতার যোগাযোগ সংক্রান্ত পদার্থবিজ্ঞান বা রেডিও-ফিজিক্স বিষয়ক পড়াশোনা ও গবেষণা শুরু করার দায়িত্ব নিলেন তিনি। ভারতবর্ষে প্রথম এই বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে যোগ হলো। সহকর্মীদের মধ্যে অধ্যাপক মেঘনাদ সাহার আগ্রহ ছিল রেডিও-ফিজিক্স বিষয়ে। কিন্তু মেঘনাদ সাহা জার্মানি থেকে ফিরে এসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সুবিধে খুব একটা না পেয়ে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেছেন শিশিরকুমারের ফেরার আগেই। উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখার্জির প্রত্যক্ষ সহায়তায় শিশিরকুমার দ্রুত গড়ে তুললেন রেডিও-ফিজিক্স গবেষণা-কেন্দ্র। উৎসাহী ছাত্রও পেয়ে গেলেন কয়েকজন।

শিশিরকুমার যখন রেডিও-ফিজিক্স সম্পর্কিত গবেষণা শুরু করেন – তখনো পর্যন্ত এ সংক্রান্ত গবেষণা খুব বেশিদূর এগোয়নি। মাইক্রোওয়েভ সংক্রান্ত গবেষণা শুরু করেছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু, হার্টজ ও অলিভার লজ। জগদীশচন্দ্র বসু মাইক্রোওয়েভ কমিউনিকেশান সংক্রান্ত গবেষণায় সাফল্য পেয়েছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে। মাইক্রোওয়েভের ট্রান্সমিটার ও রিসিভার তৈরি করে সাফল্যজনক ভাবে তার প্রদর্শন করেছিলেন জগদীশচন্দ্র। কিন্তু সেসময় বিজ্ঞানীদের মনে একটা ধারণা ছিল যেহেতু মাইক্রোওয়েভ কিংবা ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের যে কোন তরঙ্গ আলোর মত সরলরেখায় চলাচল করে – সেহেতু তাদেরকে কোন ধরণের বক্র-তলে পাঠানো সম্ভব নয়। পৃথিবী যেহেতু গোলাকার – তার বায়ুমন্ডলও গোলাকার। ফলে বেতার তরঙ্গ কোনদিকে পাঠালে সেটা সরাসরি সোজা চলে যাবে। দিক পরিবর্তন করে অন্যদিকে তার যাওয়া সম্ভব নয়। এরকম ধারণার কারণে রেডিও-ওয়েভ সংক্রান্ত গবেষণায় আর তেমন উৎসাহ দেখায়নি কেউ।

১৮৮২ সালে বায়ুমন্ডলের আয়নোস্ফিয়ার সম্পর্কিত ধারণা দেন স্কটিশ পদার্থবিজ্ঞানী ব্যালফোর স্টূয়ার্ড। বায়ুমন্ডলের উপরিভাগের এই স্তরের বাতাসে তড়িৎ-প্রবাহ সৃষ্টি হতে পারে বলে ধারণা দেন স্টুয়ার্ট। এর কারণ হিসেবে তিনি পৃথিবীর ক্রম-পরিবর্তনশীল চৌম্বক-ক্ষেত্রের উপস্থিতির কথা বিবেচনায় রাখেন। কিন্তু এই আয়নোস্ফিয়ার কখনো মানুষের কোন কাজে লাগবে বলে ভাবেন নি কেউ। তাই স্টুয়ার্টের আয়নোস্ফিয়ারের দিকে খুব একটা মনযোগ দেননি কেউ। কিন্তু ১৯০১ সালের ১২ ডিসেম্বর কানাডার নিউফাউন্ডল্যান্ডে বসে ২৭০০ কিলোমিটার দূরের ইংল্যান্ড থেকে প্রেরিত বেতারবার্তা যখন শুনলেন মার্কনি – সবাই আশ্চর্য হয়ে গেলেন। বেতার সম্প্রচারের ক্ষেত্রে বায়ুমন্ডলের ‘আয়নোস্ফিয়ার’-এর কী অপরিসীম ভূমিকা রয়েছে তা মার্কনি বা আর কেউ তখনো জানতেন না। বিজ্ঞানীরা নতুন করে ভাবতে বসলেন আয়নোস্ফিয়ার সম্পর্কে। ১৯০২ সালে আয়নোস্ফিয়ারের উপস্থিতি ও ভূমিকা সম্পর্কে আলাদা আলাদা ভাবে ব্যাখ্যা দিলেন ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানী অলিভার হেভিসাইড ও আমেরিকার আর্থার কেনেলি। তাঁরা ধারণা দিলেন ভূ-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় আশি কিলোমিটার উচ্চতায় বায়ুমন্ডলের আয়নোস্ফিয়ার বিদ্যুৎ-প্রবাহ তৈরিতে সক্ষম। বেতার তরঙ্গ বায়ুমন্ডলের এই স্তরে আলোর মত প্রতিফলিত হয়ে আবার পৃথিবীতেই ফিরে আসে। কোথায় কতদূরে যাবে এই তরঙ্গ তা নির্ভর করে তরঙ্গের শক্তি ও কম্পাঙ্কের ওপর। এই মতবাদ গৃহীত হলো। এই স্তরের নাম দেয়া হলো কেনেলি-হেভিসাইড স্তর। কিন্তু এই পর্যন্তই। পরবর্তী বিশ বছর পর্যন্ত কেউ কোন পরীক্ষামূলক প্রমাণ দেখিয়ে বলতে পারলো না ঠিক কীভাবে কাজ করে এই বিদ্যুৎ-প্রবাহী বায়ুস্তর।

বেতার তরঙ্গ সম্প্রচারে আয়নোস্ফিয়ারের ভূমিকার ব্যাপারটা পুরোপুরি জানা না গেলেও বেতার সম্প্রচার বসে নেই। ভারতবর্ষে বেতার সম্প্রচার বিষয়ে উৎসাহিত হলেন শিশিরকুমার। ১৯২৩ সালে ‘ইন্ডিয়ান স্টেট্‌স এন্ড ইস্টার্ন এজেন্সি’ নামে একটা প্রাইভেট কোম্পানি প্রথম সম্প্রচার ট্রান্সমিটার চালু করে কলকাতায়। ‘রেডিও ক্লাব অব বেঙ্গল’ নামে একটা সংগঠন তৈরি হলো। জে আর স্টেপলেটন হলেন ক্লাবের সভাপতি। ‘রেডিও’ নামে একটা পত্রিকা বেরোত ওই ক্লাব থেকে। বেতার সম্পর্কিত অনেক তথ্য থাকতো সেই পত্রিকায়। শিশির মিত্র এ ক্লাবের সদস্য। ক্লাবের নিজস্ব সম্প্রচার কেন্দ্র ছিল ডালহৌসি স্কোয়ারে এবং রোজ সন্ধ্যেবেলা এই কেন্দ্র থেকে নানা বিষয় প্রচারিত হত। শিশিরকুমার মিত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের পরীক্ষাগারে একটি ট্রান্সমিটার তৈরি করে সেখান থেকে সম্প্রচার শুরু করে দিলেন। এই সম্প্রচার কেন্দ্রের নাম ছিল রেডিও টু-সি-জেড (2CZ)। ১৯২৭ সালে ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হবার আগ পর্যন্ত শুধুমাত্র রেডিও ক্লাব ও শিশির কুমারের ট্রান্সমিটার থেকেই নিয়মিত অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো।

১৯২৪ সালে ইংল্যান্ডের স্যার এডোয়ার্ড এপলটন ও স্যামুয়েল জ্যাকসন বারনেট বায়ুমন্ডলে ‘কেনেলি-হেভিসাইড’ স্তরের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। এর পরের বছর আমেরিকার প্রফেসর ব্রেইট ও টুভে এই প্রতিফলক স্তরের উচ্চতা পরিমাপের একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। বেতার-তরঙ্গ আলোর বেগে চলে। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে তরঙ্গ উৎক্ষেপণের সময় ও প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসার সময় পরিমাপ করতে পারলে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে প্রতিফলক স্তরের উচ্চতা নির্ণয় করা যায় অতি সহজেই। তাঁরা একটি ট্রান্সমিটার থেকে ছোট্ট একটা বেতার-তরঙ্গ পাঠিয়ে কয়েক কিলোমিটার দূরে রাখা একটি রিসিভারে প্রতিফলিত বেতার-তরঙ্গ পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্তে এলেন যে ‘কেনেলি-হেভিসাইড’ প্রতিফলক স্তরের উচ্চতা ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে বিস্তৃত। পরবর্তী কয়েক বছরে স্যার এপেলটন এ ব্যাপারে ব্যাপক অনুসন্ধান চালান। তিনি বায়ুমন্ডলে আরো কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন প্রতিফলক স্তরের সন্ধান পান। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২০০ থেকে ৪০০ কিলোমিটার উচ্চতার স্তরটির নামকরণ করা হয় ‘এপলটন স্তর’। পরে স্যার এপলটন ‘কেনেলি-হেভিসাইড’ স্তরের নাম রাখেন ‘ই-স্তর’ (E layer) ও ‘এপলটন’ স্তরের নাম রাখেন ‘এফ-স্তর’ (F layer)। ১৯২৮ সালে তিনি ই-স্তরের নিচে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ৫০ থেকে ৯০ কিলোমিটারের মধ্যে আরো একটি স্তর আবিষ্কার করেন। এই স্তর ডি-স্তর নামে পরিচিত। এপলটন তাঁর আবিষ্কারের জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯৪৭ সালে।

এপলটন যখন বায়ুমন্ডলের বিভিন্ন স্তরের অবস্থান ও বৈশিষ্ট নিয়ে নানারকম পরীক্ষা চালাচ্ছিলেন – তখন শিশিরকুমার আগ্রহী হয়ে ওঠলেন এই কাজে। কাজের জন্য কয়েকজন মিলে দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে যন্ত্রপাতি তৈরি করে ফেললেন। কলকাতা বেতার থেকে নির্দিষ্ট সময়ের বাইরেও মিডিয়াম-ওয়েভ পাঠিয়ে পরীক্ষা চালানো হতো। ১৯৩০ সালে কলকাতা থেকে ৭৫ মাইল দূরে রিসিভার রাখা হলো। তরঙ্গ পাঠিয়ে আয়োনোস্ফিয়ারে একটি প্রতিফলক স্তর ধরা পড়ল যা এপলটনের ডি-স্তরের উচ্চতার সাথে মিলে যায়। এটা ভারতে প্রথম সনাক্তকরণ। শিশিরকুমারের এ আবিষ্কার ভারতের বেতার-পদার্থবিজ্ঞানে এক উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। এপলটন ডি-স্তরের প্রাথমিক ধারণা দিয়েছিলেন। শিশিরকুমার ডি-স্তর সম্পর্কিত আরো বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। আবহাওয়ার পরিবর্তন, ঝড়-বৃষ্টি বা ব্জ্রপাতের সময় বায়ুমন্ডলের বিভিন্ন স্তরে কী কী পরিবর্তন ঘটে সে সম্পর্কিত অনেক পরীক্ষা করেন শিশিরকুমার ও তাঁর তরুণ গবেষকরা। শিশিরকুমারের গ্রুপ ই-স্তরের সঠিক অবস্থানও নির্ণয় করতে সক্ষম হন। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে মাত্র বিশ কিলোমিটার উচ্চতায় একটি নতুন প্রতিফলক স্তরের সন্ধান পান শিশিরকুমার। শিশিরকুমার এ স্তরের নাম দেন সি-স্তর। ১৯৩০ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত নিরলস গবেষণা চললো শিশিরকুমারে নেতৃত্বে। শুরুতে ইউরোপ আমেরিকায় বিজ্ঞানীরা কিছুটা নাক উঁচু ভাব নিয়ে থাকলেও পরে শিশিরকুমারের কাজের স্বীকৃতি দিয়েছেন তাঁরা। ১৯৩৬ সালে ম্যাক্সওয়েল সোসাইটি আয়োজিত কিংস কলেজের সভায় আমন্ত্রিত হলেন শিশিরকুমার। সেখানে স্যার এপলটন সহ আরো সব বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী উচ্ছসিত প্রশংসা করলেন শিশিরকুমার মিত্রের গবেষণার।

ইংল্যান্ডের রেডিও-ফিজিসিস্টদের সাথে আলোচনা করে শিশিরকুমার বুঝতে পারলেন রেডিও-ট্রান্সমিটিং সংক্রান্ত গবেষণা শুধুমাত্র কলকাতায় বসে করা সম্ভব নয়। রেডিও-ওয়েভ শুধু এক জায়গা থেকে ট্রান্সমিট করলে হবে না। দেশের আরো জায়গা থেকে গবেষণা করতে হবে। একটা ন্যাশনাল রেডিও রিসার্চ বোর্ড হওয়া খুব জরুরি। পরাধীন দেশে তাঁর কথায় কান দেয়ার মানুষ ব্রিটিশ সরকার নয়। কিংস কলেজে বক্তৃতার সময় পারস্পরিক সহযোগিতার কথা আলোচিত হয়েছে। শিশিরকুমার এ ব্যাপারে আরো আলোচনা ও সহযোগিতা লাভের উদ্দেশ্যে একটা ডিনারের ব্যবস্থা করলেন। স্যার এপলটন, রবার্ট ওয়াটসন-ওয়াট (যিনি ‘আয়নোস্ফিয়ার’ নামকরণ করেছিলেন), নেচার সাময়িকীর সম্পাদক ডক্টর গ্রেগরি সহ আরো অনেক খ্যাতনামা বিজ্ঞানী এসেছিলেন সেই নৈশভোজে। ভারতে ন্যাশনাল রেডিও রিসার্চ বোর্ডের প্রয়োজনীয়তার সপক্ষে নেচার পত্রিকায় সম্পাদকীয় বেরোল “ভারতে রেডিও রিসার্চ বোর্ড তৈরি করবার এই-ই উপযুক্ত সময়। এই বিষয়ে গবেষণা এখনও কলকাতায় অধ্যাপক মিত্র ও এলাহাবাদে অধ্যাপক সাহার মধ্যেই সীমিত রয়েছে” [3-5]। মেঘনাদ সাহা এলাহাবাদ থেকেই সহযোগিতা করছিলেন শিশিরকুমারের সাথে। শিশিরকুমার ও মেঘনাদ সাহা মিলে জোর তদারকি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বছর গড়িয়ে যায় – কিছুই হয় না। ১৯৩৮ সালে মেঘনাদ সাহা কলকাতায় ফিরে এলে তাঁদের চেষ্টা আরো জোরদার হয়। অবশেষে ১৯৪২ সালে প্রতিষ্ঠিত হল আকাঙ্খিত বোর্ড। অধ্যাপক মিত্র সেই বোর্ডের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এরপর দায়িত্ব নিয়েছিলেন মেঘনাদ সাহা। কলকাতার বাইরে হরিণঘাটায় একটা গবেষণা কেন্দ্র তৈরি করেছিলেন শিশিরকুমার। ভারতে এটিই প্রথম আয়োনোস্ফিয়ার ফিল্ড স্টেশন।

বায়ুমন্ডলের ই-স্তরের উৎপত্তির কারণ সম্পর্কে গ্রহণযোগ্য বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেন শিশিরকুমার [6]। বায়ুমন্ডলে সক্রিয় নাইট্রোজেন ও আয়নের উপস্থিতি বিষয়ে অনেক গবেষণা কাজ করেছেন শিশিরকুমার। বিখ্যাত নেচার সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে সেই গবেষণার ফল [7-10]। বায়ুমন্ডলের উপরিভাগে কী করে নাইট্রোজেন তৈরি হয় তার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন শিশিরকুমার।

শিশিরকুমার মিত্র কখনো গবেষণাকে শুধুমাত্র গবেষণাগারে সীমিত রাখার পক্ষপাতি ছিলেন না। নিজেই পরীক্ষাগারে সম্পূর্ণ দেশীয় যন্ত্রাংশ দিয়ে মাইক্রোফোন, লাউড স্পিকার তৈরি করেছিলেন। ইলেকট্রন টিউব তো আগেই তৈরি করতেন। রেডিও ট্রান্সমিটার, রিসিভার ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারেই সংযুক্ত করতেন। ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শিল্প-কারখানার ব্যাপক প্রসারের স্বপ্ন দেখতেন শিশিরকুমার।

বিজ্ঞানের গবেষণার সুফল সাধারণ মানুষের কাজে লাগানোর জন্য বিজ্ঞান সংগঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন শিশিরকুমার। বিজ্ঞান-চর্চা ও গবেষণার পাশাপাশি বিজ্ঞান সংগঠনেও প্রচুর সময় দিয়েছেন তিনি। ১৯৩৪ সালে তিনি ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেস এসোসিয়েশানের গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৩৫ ও ১৯৩৮ সালে তাঁর উদ্যোগে ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কলকাতায়। ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত তিনি ইন্ডিয়ান সায়েন্স এসোসিয়েশানের জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ অবস্থাতেও তাঁর বিশেষ উদ্যোগে ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে কলকাতায়। ১৯৫৪ সালে বরোদায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনের সর্বভারতীয় সভাপতি ছিলেন শিশিরকুমার। ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশান ফর দি কাল্টিভেশান অব সায়েন্স – এর পরিচালনা পরিষদের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন শিশিরকুমার। এসোসিয়েশানের সেক্রেটারি, সহসভাপতি ও ট্রাস্টি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বিভিন্ন সময়ে। ১৯৩৫ সালে অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা ও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের উদ্যোগে ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ এসোসিয়েশান প্রতিষ্ঠিত হবার শুরু থেকেই এসোসিয়েশানের সক্রিয় সদস্য ছিলেন শিশিরকুমার। বিভিন্ন সময়ে এই সংগঠনের সম্পাদক, সহসভাপতি এবং সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। সংগঠনের সাময়িকী ‘সায়েন্স এন্ড কালচার’ এর প্রকাশ, প্রচার ও প্রসারে নিরলস ভূমিকা রেখেছেন শিশিরকুমার। ১৯৪৮ সালে তাঁর নেতৃত্বে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় আলাদা রেডিও ফিজিক্স ও ইলেকট্রনিক্স বিভাগ। ১৯৫১-৫২ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি ছিলেন শিশিরকুমার।

এটমোস্ফেরিক ফিজিক্সের জগতে শিশিরকুমার মিত্রের যে অবদানের কথা সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয় – তা হলো তাঁর রচিত বই ‘দি আপার এটমোস্ফিয়ার’। এই বইটির আগে বায়ুমন্ডল সম্পর্কিত এরকম পূর্ণাঙ্গ বই লেখা হয়নি। ১৯৩৫-৩৬ সালে তাঁর ইউরোপ ভ্রমণের সময়ে এরকম একটি বইয়ের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন তিনি। দেশে ফিরেই কাজ শুরু করে দেন। তাঁর গ্রুপের রিচার্স ফেলো ও সহকর্মীদের মধ্যে বিভিন্ন জনকে বিভিন্ন অধ্যায়ের জন্য তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব দেন। বইয়ের কাজ এগোতে এগোতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ফলে বইটি শেষ হতে প্রায় দশ বছর লেগে যায়। ১৯৪৭ সালে বইটির রচনা শেষ হয়। বায়ুমন্ডল সম্পর্কিত সমসাময়িক সমস্ত গবেষণার তথ্য ও তত্ত্ব এই বইতে সংযুক্ত হয়। স্যার এপলটন বইটির বিষয়বস্তু সম্পর্কে জেনে এটাকে ‘বীরোচিত উদ্যোগ’ (heroic attempt) বলে প্রশংসা করেন [2]। শিশিরকুমার আশা করেছিলেন ইউরোপের বিখ্যাত প্রকাশকেরা বইটি প্রকাশ করার জন্য এগিয়ে আসবেন। কিন্তু যুদ্ধ-পরবর্তী মন্দার কারণে হোক বা অন্য কোন কারণে হোক ইউরোপের কোন প্রকাশক বইটি প্রকাশ করতে রাজী হলেন না। নোবেল বিজয়ীর প্রশংসা-পত্রেও কোন কাজ হলো না।

অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা তখন এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি। এত ভালো এবং দরকারী একটা বই প্রকাশিত হবে না তা তিনি মেনে নিতে পারলেন না। তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে বইটি ছাপানোর ব্যবস্থা করলেন। বইটি প্রকাশের সাথে সাথে অকল্পনীয় সাড়া পড়ে যায়। প্রকাশের তিন বছরের মধ্যে দু’হাজার কপি বিক্রি হয়ে যায়। ১৯৫২ সালে আরো বড় আকারে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক-১ উৎক্ষেপণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন রাশিয়ান মহাকাশ-বিজ্ঞানীরা একটি-মাত্র বইকে তাঁদের কাজের জন্য নির্ভরযোগ্য উৎস হিসেবে সাথে রেখেছিল – তা হলো শিশিরকুমার মিত্রের ‘দি আপার এটমোস্ফিয়ার’ [11]। ১৯৫৫ সালে বইটি সোভিয়েত সরকার রুশ ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করে।

১৯৫৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন অধ্যাপক শিশিরকুমার মিত্র। তখন পশ্চিমবঙ্গের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থার হাল খুব খারাপ। সরকারের বিশেষ অনুরোধে শিক্ষা বোর্ডের দায়িত্ব নিলেন শিশিরকুমার। দু’বছরের মধ্যে পুরো মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি ঘটালেন শিশিরকুমার। উচ্চমাধ্যমিকের নতুন সিলেবাস প্রবর্তন করলেন ১৯৫৭ সালে। নির্দিষ্ট সময়ে নতুন সিলেবাস অনুযায়ী পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা করলেন। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত শিক্ষা বোর্ডের দায়িত্বে ছিলেন তিনি।

যে কোন কাজেই নিয়মানুবর্তীতার ব্যাপারে অধ্যাপক শিশির কুমার মিত্র ছিলেন ভীষণ রকম অনমনীয়। সারাদেশে যখন স্বদেশী আন্দোলন চলছে স্বাধীনতার যুদ্ধ চলছে – তখনো একটা দিনের জন্যও গবেষণা বন্ধ রাখেন নি তিনি। প্রতিদিন ঠিক সাড়ে দশটায় অফিসে আসতেন। তাঁর ছাত্র ও সহকর্মীরা একদিনও এর ব্যতিক্রম দেখেননি [12]। ক্লাসে লেকচার দেবার সময় একটা শব্দও অপরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করতেন না। প্রতিটি লেকচারের প্রতিটি বাক্য নিঁখুতভাবে তৈরি করতেন তিনি। তাঁর ল্যাব, অফিস সবকিছু গোছানো থাকতো সবসময়। ছোট বড় যে কোন কাজই নিঁখুতভাবে করতে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি।

ব্যক্তিগত জীবনে অনেক কষ্ট ছিল তাঁর, কিন্তু কাউকে প্রকাশ করতেন না। জন্মের কিছুদিন পরেই তাঁদের প্রথম সন্তান মারা যায়। পরে তাঁদের আরো দু’টো ছেলে হয়। কিন্তু ১৯৩৯ সালে তাঁর স্ত্রী মারা যাবার পর খুবই একা হয়ে পড়েন তিনি। সন্তানদের নিজের হাতে মানুষ করেছেন – বাড়িতেও নিয়ম মেনেই সবকিছু চলতো। বিজ্ঞানের বাইরে শখ করে একটি কাজই করতেন তা হলো রবিবারে বিকেলে কিছুক্ষণ দাবা খেলতেন বন্ধুদের সাথে। সে খেলাও চলতো পুরোপুরি টুর্নামেন্টের নিয়মে।

গবেষণা ও কাজের স্বীকৃতি হিসেবে অনেক পুরষ্কার পেয়েছেন শিশিরকুমার। ১৯৩৫ সালে পেয়েছেন কিং জর্জ সিলভার জুবিলি মেডেল, ১৯৪৩ সালে ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশান ফর দি কালটিভেশান অব সায়েন্সের জয়কৃষ্ণ মুখার্জি গোল্ড মেডেল, ১৯৫৬ সালে পেয়েছেন এশিয়াটিক সোসাইটির সায়েন্স কংগ্রেস মেডেল। ১৯৫৮ সালে রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ পেয়েছেন শিশিরকুমার মিত্র। ১৯৬১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারী স্বর্ণপদক দেয়া হয় তাঁকে। ১৯৬২ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার ও পদ্মভূষণ উপাধি পান অধ্যাপক শিশিরকুমার মিত্র। ভারত সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেন ১৯৬২ সালে।

১৯৬১ সালে এক দুর্ঘটনায় তাঁর বড় ছেলের মৃত্যুর পর ভীষণভাবে ভেঙে পড়েন শিশিরকুমার। কিন্তু কাজের আড়ালে গোপন করে রাখেন নিজের শোক। ১৯৫৩ সাল থেকেই তাঁর হৃদরোগ ধরা পড়ে। এখন তা ক্রমশ মারাত্মক আকার ধারণ করে। ১৯৬৩ সালে ‘অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা স্মারক বক্তৃতা’ দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হয় শিশিরকুমারকে। তিনি বক্তৃতার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বছরের শুরু থেকেই। বক্তৃতার বিষয় নির্বাচন করেছেন “ফিজিক্স অব দি আর্থ’স আউটার স্পেস”। বক্তৃতার জন্য তথ্য জোগাড় করার দায়িত্ব দিলেন তাঁর প্রিয় ছাত্র এবং সহকর্মী ডক্টর মৃণাল দাশগুপ্তকে [12]। তিনি বক্তৃতার খসড়া তৈরি করে দিলেন। স্বভাবতই শিশিরকুমার প্রতিটি শব্দ, বাক্য, বিষয়বস্তু নিখুঁত না হওয়া পর্যন্ত বক্তৃতা পরিবর্তন-পরিমার্জন করেই চলেছেন। বক্তৃতার দিন ২৯শে মার্চ। সেদিন ঠিক সাড়ে দশটায় অফিসে এসেই শিশিরকুমার মৃণাল দাশগুপ্তকে ডেকে পাঠালেন। বললেন “বিক্রম সারাভাই তাঁর একটা সাম্প্রতিক একটা পেপার আমাকে পাঠিয়েছেন। উপরের বায়ুস্তরে চৌম্বক-ক্ষেত্র সম্পর্কিত কিছু নতুন তথ্য আছে সেখানে। তুমি কি একবার দেখবে আমার বক্তৃতার কোন জায়গায় এই নতুন তথ্যগুলো ঢোকানো যায় কি না”। তাঁর শরীর ভালো যাচ্ছিলো না কিছুদিন থেকে। সন্ধ্যাবেলা বক্তৃতার সময় শরীর আরো খারাপ হলো। বক্তৃতার প্রথম কয়েক পৃষ্ঠা পড়ার পর বাকিটা আর পড়তে পারলেন না। বাকিটুকু পড়লেন মৃণাল দাশগুপ্ত। এর কয়েক মাস পর ১৯৬৩ সালের ১৩ই আগস্ট মারা যান অধ্যাপক শিশির কুমার মিত্র।

তথ্যসূত্রঃ

[1] Mitra SK. On the asymmetry of the illumination curves in oblique diffreaction. Philosophical Magazine 1918;35:112.
[2] Ratcliffe JA. Sisir Kumar Mitra. Biographical Memories of Fellows of the Royal Society 1964;10 (Novemver).
[3] শ্যামল চক্রবর্তী. বিশ্বসেরা বিজ্ঞানী. কলকাতা: শিশু সাহিত্য সংসদ, ১৯৯৯.
[4] Mitra SK. Ionospheric studies in India. Nature 1936;137:503.
[5] Mitra SK. Need of a radio research board for India. Science and Culture 1936;1 (13).
[6] Mitra SK. Origin of the E-layer of the ionosphere. Nature 1938;142:914.
[7] Mitra SK. Active nitrogen and N2+ (X-) ions. Nature 1944;154:212.
[8] Mitra SK. Active nitrogen. Nature 1944;154:511.
[9] Mitra SK. Energy imperted by active nitrogen. Nature 1944;154:831.
[10] Mitra SK. Variation in the after-glow brightness of active nitrogen under varied experimental conditions. Nature 1944;154:576.
[11] Mitra AP. Sisir Kumar Mitra. Resonance 2000;July:3-5.
[12] Mrinal Kumar Das Gupta. Professor Sisir Kumar Mitra – As I Remember Him. Resonance 2000;July:92-9.