Genghis Khan

১৯৯৫ সালের ৩১শে ডিসেম্বর আমেরিকার নেতৃস্হানীয় সংবাদপত্র ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ এবং টেলিভিশন নিউজ চ্যানেল সিএনএন গত এক হাজার বছরের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসাবে চেঙ্গিস খানকে “ম্যান অব দ্য মিলেনিয়াম” হিসাবে নির্বাচিত করে। আধুনিক ইতিহাসবিদরা মনে করেন তার দোষ ত্রুটির তুলনায় সাফল্যের পরিমাণ অনেক অনেক বেশী ছিলো। চেঙ্গীস খান ছিলেন পৃথিবীর সর্বকালের সর্ব্বৃহত অবিচ্ছিন্ন সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা।

১২২৭ সালে তার মৃত্যুর সময় পীত সাগর থেকে শুরু করে ইরান, ইরাক, এবং দক্ষিণ রাশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তার সাম্রাজ্য। ১২০৬ সালের মধ্যেই মঙ্গোলিয়ার সবগুলো ছোট-বড় গোত্রকে একত্রীভূত করে বৃহত্তর মঙ্গোলিয়ার পত্তন ঘটান তিনি। এই তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের যুগও পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ তাকে চেনে অন্যতম একজন নৃশংস যুদ্ধবাজ নেতা হিসাবে। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই যে চেঙ্গীস খান বহু নৃশংস ঘটনা ঘটিয়েছেন তবে সেই সব নৃশংসতা ক্রুসেডারদের তুলনায় খুব বেশী কিছু যে ছিলো তা মনে হয় বলা যাবেনা। তবে তার জীবনের ঘটনাবলী নির্মোহ ভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে তিনি খুব সহজেই আধুনিক নৈতিকতার মানদন্ডে উত্তীর্ণ হয়ে পরিচিতি পেতে পারেন একজন মহান মানুষ হিসাবে। একবার তার শাসনের আওতায় যারা এসেছে তারা অন্য যে কোন স্থানের তুলনায় অনেক বেশী নিরাপদ, প্রগতিশীল, এবং স্বাধীন ছিলো। পৃথিবীর অন্যতম দূরদর্শী নেতা হিসাবে চেঙ্গীস তার শাসনামলে একটি দেশ, একটি ভাষা, ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতা, পোস্ট অফিস/পোনি সার্ভিস, লিখিত আইন ব্যবস্থা, টোল রোডের নেটওয়ার্ক সহ অন্যান্য আরও অনেক নতুন জিনিষের গোড়াপত্তন কিংবা প্রচলন শুরু করেন।

Genghis-Kindom

তৃতীয় ক্রুসেডে (১১৮৯ – ৯২) কিং রিচার্ড উত্তর ইসরায়েলের বন্দর শহর অ্যাক্রে বহুদিন অবরোধের পরে পরিশেষে দখল করে নেন। সুলতান সালাহউদ্দীনের সাথে অঙ্গীকার করেন বেসামরিক নাগরিকদের কোন ক্ষতি সাধন করবেন না। কিন্তু দখল করে নেয়ার পর রিচার্ড সকল মুসলিম, তাদের স্ত্রী, এবং শিশুদের হত্যা করেন। সেই রিচার্ডকেই অনেক পস্চিমা ইতিহাসবিদরা এবং বিশেষ করে ইংরেজরা ভালবেসে “সিংহ হৃদয়” রিচার্ড নামে ডেকে থাকেন।

বানু কুরাইজা গোত্রের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ এনে সাবালক সকল বয়সের পুরুষকে হত্যা করার আদেশ দেন মুসলমানদের চোখে পৃথবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ মোহাম্মদ। একদিনে প্রায় সাতশ থেকে নয়শর মত লোককে মেরে ফেলা হয় গলা কেটে এবং নারী ও শিশুদের দাস/দাসী হিসাবে মুসলিমদের মধ্যে বন্টন করা হয় । কিন্তু এরকম ঘটনাও মোহাম্মদের অনুসারীদের মাঝে তাকে সর্কালের সেরা মানুষ হিসাবে দাবী করা থেকে বিন্দুমাত্র বিরত রাখতে পারেনি এবং পারবেওনা।

যুদ্ধের অজুহাতে মানুষ মারাটা কারও ভাল মানুষ হিসাবে পরিচিতি পাওয়ার ব্যাপারে কোন বাধা সৃষ্টি করেনি বা করেনা। এরকম অসংখ্য নজীর ইতহাসের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাই সচেতনভাবেই চেঙ্গিস খানের বিরুদ্ধে যে বিশাল সংখ্যক মানুষ হত্যার অভিযোগ আছে তা এখানে আলোচনার বাইরে রাখব। যুদ্ধক্ষেত্রে তার নিষ্ঠুরতার ব্যাপারে কোন সংশয় নেই, সংশয় নেই তার বহু বিবাহ (৬ টি) এবং অসংখ্য কনকিউবাইনের ব্যাপারেও। কিন্তু ইতিহাস আমাদের স্বাক্ষী এ দুটি ব্যাপারের কোনটিই একজন মানুষের ভাল মানুষ কিংবা শ্রেস্ঠ মানুষ হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য কোন সমস্যাই না।

বাবা ইয়েসুগেই এবং মা ইয়েলুন উজিনের বড় সন্তান তেমুজিন ১১৬২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তেমুজিনের জন্মের দিনই বাবা ইয়েসুগেই পুরোনো শত্রু তাতারদের সাথে যুদ্ধে জয়ী হয়ে দুজন বন্দী তাতার নেতাকে বন্দী করে নিয়ে আসেন। তাদের একজনের নাম ছিলো তেমুজিন। যুদ্ধ জয়ের আনন্দে পরাজিত শত্রু নেতার নামে বাবা ইয়েসুগেই ছেলের নাম রাখেন তেমুজিন। ১২০৬ সালে তেমুজিন যখন সমগ্র মঙ্গোলিয়ার খান নির্বাচিত হন তখন নতুন নাম নেন চেঙ্গিস খান। চেঙ্গিস নামের অর্থ হলো universal ruler বা সারা বিশ্বের শাসক। চেঙ্গিস খানের যখন ৯ বছর বয়স তখন তার বাবা ইয়েসুগেই কেরাইট গোত্রের বোরটের সাথে তার বিয়ে ঠিক করেন। বোরটে ছিলো চেঙ্গিসের চেয়ে বয়সে ১ বছরের বড়। মঙ্গোল রীতি অনুযায়ী বিয়েটা ছেলে-মেয়ে সাবালক হওয়ার পরেই হত। বিয়ে ঠিক হওয়ার কিছুদিন পর পুরোনো এক তাতার শত্রু ইয়েসুগুইকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলে। নিজ গোত্রের কিছু কুচক্রী লোক বালক চেঙ্গিসের নেতৃত্ব মেনে নিতে অস্বীকার করে দলবল সহ মা, ভাই বোন সহ চেঙ্গিসকে গোত্র থেকে বের কর দেয়। এর পরের সাত বছর চেঙ্গিস খানের জীবন ছিলো এক ভয়াবহ কঠিন সংগ্রামের জীবন। মঙ্গোলিয়ার বিস্তীর্ন বিরাণ সমতল ভূমিতে গাছপালার শিকড়-বাকড় আর খরগোশ জাতীয় প্রাণী শিকার করে বেঁচে থাকবার সংগ্রাম। ১১৭৯ সালে চেঙ্গিসের বয়স যখন ১৭ বছর এবং অবস্হার বেশ কিছুটা উন্নতি হয়েছে তখন সে তার বাগদত্তা বোরটেকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে কেরাইট গোত্রে উপস্হিত হয়। বোরটেও এতদিন তেমুজিনের অপেক্ষায় ছিলো। বিয়ের কিছুদিন পরেই ইয়েসুগেইয়ের আরেক পুরোনো শত্রু মেরকিটরা চেঙ্গিস এবং তার পরিবার এবং সহোযোগীদের উপর হামলা চালায় এবং বোরটেকে ধরে নিয়ে যায়। অসহায় চেঙ্গিস স্ত্রীকে উদ্ধার করার আশায় বাবা ইয়েসুগেইয়ের পুরোনো বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করেন। উপযুক্ত সময় এবং লোকবলের অভাবের কথা বলে তারা কিছুদিন অপেক্ষা করার পরামর্শ দেয় এবং প্রায় একবছর অপেক্ষার পর মিত্রদের সহায়তায় মেরকিটদের আক্রমণ করে চেঙ্গিস খান স্ত্রী বোরটেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। উদ্ধার করার সময়ই বোরটে সন্তান সম্ভবা ছিলো। এর কয়েকমাস পর বোরটে জন্ম দেন তাদের বড় ছেলে জুচি’র। চেঙ্গিস খান নিজে কোনদিন জুচিকে নিয়ে কখনও দ্বিধা দ্বন্দে ভোগেননি। এমনকি তার ভয়ে কেউ কখনও জুচির পিতৃত্ব নিয়েও প্রশ্ন করার সাহস পায়নি। এ কথার সত্যতা পাওয়া যায় এর বহুদিন পর খোয়ারিজম সাম্রাজ্য আক্রমণের আগের দিন উত্তরাধিকার মনোনীত করার উদ্দেশ্যে তিনি তার সব জেনারেলদের এবং ছেলেদের ডেকে পাঠান। বড় ছেলে জুচিকে তার মতামত জিজ্ঞাসা করলে মেজ ছেলে চাহেতাই (চাগেতাই) আপত্তি করে
ওঠে এই বলে যে, “পিতা আপনি জুচিকে সবার আগে জিজ্ঞাসা করলেন এর মানে এই কি যে আপনি সিংহাসনের দায়িত্ব তাকেই দিয়ে যাবেন? কিন্তু সেতো মেরকিটদের বংশধর। তার কথা কিভাবে মেনে নিতে পারি?” এ কথায় জুচি ক্ষুব্ধ হয়ে বলে ওঠে, “পিতার এ ব্যাপারে কোন আপত্তি নাই, তুমি কোন সাহসে এরকম কথা বলো?” একথায় দুভায়ে হাতাহাতি শুরু হয়ে গেলে চেঙ্গিস খান অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হন এবং বলেন, “জুচি আমার বড় সন্তান, ভবিষ্যতে এ ব্যাপারে কেউ যেন আর কোন কথা না বলে।” সমঝোতা হিসাবে দুভাইয়ের সম্মতি নিয়ে তাদের দুজনকেই বাদ দিয়ে সেজভাই উকুতাই’কে (উগেদাই) তার উত্তরসূরী হিসাবে মনোনীত করেন।

চেঙ্গিস তার জীবনে বোরটে ছাড়াও আরও পাঁচজনকে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু আর কাউকেই তিনি তার ছোটবেলার ভালবাসা বোরটের মত বোধহয় ভালবাসেননি। তিনি সবসময়ই বোরটের পরামর্শ শুনতেন এবং তা প্রয়োজনে গ্রহণও করতেন। মেরকিটদের কাছে নির্যাতিত সেই দুঃসহ এক বছরের ঘটনা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বোরটের প্রতি তার ভালবাসায় চিড় ধরাতে পারেনি।

চেঙ্গিস খান ছিলেন আপাদ মস্তক একজন ধর্ম নিরপেক্ষ মানুষ। আজীবন তার নিজের ধর্ম শামানে বিশ্বাসী ছিলেন। শামানরা আকাশ দেবতায় বিশ্বাসী ছিলো। ১২০৬ সালে যখন ঐক্যবদ্ধ মঙ্গোলিয়ার খান নির্বাচিত হন তখন শামান ধর্মের প্রধান পুরোহিত কুকচু ঘোষণা করেন যে আকাশের দেবতাদের পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী চেঙ্গীস খান সমগ্র পৃথিবী শাসন করার জন্যে এসেছেন। চেঙ্গীস নিজেই কুকচুর এই কথা বিশ্বাস করতেন। আর তাইতো ঐক্যবদ্ধ মঙ্গোলিয়ার খান নির্বাচিত হয়ে বলেছিলেব, “The Sky has ordered me to govern all peoples. With protection of the everlasting Sky I defeated Keraits and attained to supreme rank.” আর এ কারনেই তিনি তার নতুন নাম নিয়েছিলেন চেঙ্গিস খান বা সারা পৃথিবীর শাসনকর্তা। কিন্তু তার পরও তিনি ছিলেন সব ধর্মের প্রতি অত্যন্ত সহনশীল। তার কড়া নির্দেশ ছিলোসব ধর্মকেই সমান গুরত্ব দিতে হবে এবং কোন ধর্মকেই অন্য ধর্মের উপরে স্হান দেয়া যাবে না, এমন কি তার নিজের ধর্ম শামানকেও না। চেঙ্গীস খান সারা জীবনে বহু ধর্মের ধর্মীয় গুরুদের সংস্পর্শে এসেছিলেন এবং খ্রীস্টান, বৌদ্ধ, ইসলাম, তাওবাদ সহ অন্যান্য ধর্ম, তাদের সৃষ্টিকর্তা কিংবা দেবতাদের সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তিনি আদেশ দিয়েছিলান কোন ধর্মের অনুসারীরাই ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে চরমপন্হা অবলম্বন করতে পারবে না।

যেকোন বিষয়ে দক্ষ, পারদর্শী, জ্ঞানী, গুণী ব্যক্তি, চিত্রকর, ভাস্কর, প্রকৌশলী, এবং ধর্মীয় গুরুদেরকে তিনি সন্মানের চোখে দেখতেন তার কড়া নির্দেশ ছিলো এধরণের মানুষদের যেন কোন ভাবেই হত্যা করা না হয়। আর অন্য ধর্মীয় গোত্রের লোকদের, বিশেষ করে ধর্মীয় গুরু এবং বিশেষ কাজে পারদর্শী যেমন প্রকৌশলী, চিত্রকর, এবং অন্য জ্ঞানী মানুষদের কর মওকুফের ব্যবস্হা রেখেছিলেন। তবে শান্তি নষ্ট করতে পারে এমন ধর্মীয় অসহিন্ষুতার ব্যাপারেও তিনি ছিলেন খড়গ হস্ত।

চেঙ্গীস খান এবং তার মা জীবনে মোট চার জন ছেলেকে পালক হিসাবে গ্রহন করেন। মজার ব্যাপার হলো এরা সবাই ছিলো শত্রু গোত্রের ছেলে এবং তাদের সবার বয়স ছিলো খুবই অল্প। মেরকিটদের সাথে যুদ্ধের পর চেঙ্গিস ৫ বছর বয়সী কুচুকে (মেরকিট) নিয়ে এসে তার মাকে দেন। ইয়েলুন ছেলেটাকে পছন্দ করে ফেলেন এবং তাকে তার পালক ছেলে হিসাবে গ্রহণ করেন। পরবর্তী কালে কুচু একজন প্রসিদ্ধ মঙ্গোল জেনারেল হয়েছিলেন। ১১৯৬ সালে চিরদিনের শত্রু তাতার বাহিনীকে জিন রাজ্যের ওয়াং ইয়ানজিনের সহায়তায় যুদ্ধে পরাজিত করে। এই যুদ্ধের পর এক তাতার বালককে নিয়ে এসে মাকে দেন। এই ছেলেকেও ইয়েলুন পালক ছেলে হিসাবে গ্রহণ করেন। এই তাতার বালক শিজি হুতুহু পরবর্তিকালে মঙ্গোল সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ বিচারক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সর্বোচ্চ বিচারকের পদটিও চেঙ্গিস খান সৃষ্টি করেছিলেন দেশের আইন কানুন এবং প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম চালানোর জন্য। ঝুদের সাথে যুদ্ধে চেঙ্গিস বোয়েরহু নামে আরেকটি ছেলেকে এনে তার মাকে দেন। ইয়েলুন একেও পালক ছেলে হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। বড় হয়ে বোয়েরহু নামকরা যোদ্ধা হয়েছিলো।

চেঙ্গীস খান সাহসী এবং বিশ্বস্ত মানুষদের পছন্দ করতেন এবং বিনিময়ে ফেরৎ দিতেন সেই বিশ্বস্ততা। তিনি মানুষ চিনতে খুব কমই ভুল করতেন। একের পর যাদের তিনি পরাজিত করেছেন পরবর্তীতে তারাই তার বিশ্বস্ত অনুসারীতে পরিনত হয়েছিলো। তাতারদের সাথে যুদ্ধে ঝু গোত্রের যোগ দেবার কথা ছিলো। কিন্তু তারা তা না করে চেঙ্গিস খানের পিছিয়ে পরা সৈন্যদের আক্রমণ করে এবং তাদের সম্পদ লুন্ঠন করে। চেঙ্গিস খান এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তাতারদের পরাজিত করেই আবার ঝু’দের আক্রমণ করে এবং পরাজিত করেন। ঝুদের পরাজিত করে চেঙ্গিস খানে সবচাইতে বড় যে পুরষ্কারটি লাভ করেন তার নাম হলো ‘মুহুলাই’। মুহুলাইয়ের সাহসীকতা এবং বীরত্বের জন্য চেঙ্গিস তাকে নিজের দলে নিয়ে নেন। পরবর্তী কালে মুহুলাই কুচুর মতই চারজন বিখ্যাত মঙ্গোল জেনারেলের একজন হন। ১২০২ সালে চেঙ্গিস তায়িচুদের সাথে যুদ্ধে তীরবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছিলেন। যুদ্ধের পর ঝিবি নামে এক অসীম সাহসী যোদ্ধা তার কাছে এসে বলেন, ” গতকাল আমার তীরেই আপনি আহত হয়েছিলেন। আপনি যদি আমাকে বাঁচিয়ে রাখেন তবে আমি আপনার দলে যোগ দিতে চাই।” চেঙ্গিস তার সততায় মুগ্ধ হয়ে ঝিবির ইচ্ছা পূরণ করেন। পরবর্তী কালে ঝিবি চারজন বিখ্যাত ভ্যানগার্ডের একজন হয়েছিলো।

প্রথম লিখিত মঙ্গোল ভাষা সৃষ্টির সাথে সাথে চেঙ্গিস তার রাজ্যের জন্য ইয়াসা নামে পরিচিত প্রথম লিখিত আইন বা কোড-অব-ল তৈরী করেছিলেন। উইঘুরদের সাথে যুদ্ধে চেঙ্গিস তাতাঙ্গেরকে বন্দী করেন। তাতাঙ্গের ছিলেন একজন উইঘুর ভাষাবিদ। চেঙ্গিসের আদেশে তাতাঙ্গের উইঘুর ভাষার সাহায্যে লিখিত মঙ্গোল শব্দ সৃষ্টি করেন এবং প্রথমবারের মত লিখিত মঙ্গোলিয়ান ভাষার সৃষ্টি করেন। বর্তমানের মঙ্গোলিয়ান ভাষা সেই লিখিত উইঘুর-মঙ্গোলিয়ান ভাষারই আরও উন্নত সংস্করণ।

তথ্য আদান প্রদান ছিলো চেঙ্গীস খানের সাফল্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আর একারণে তিনি চালু করেছিলেন ইয়াম (Yam) পদ্ধতির। ইয়াম পদ্ধতির কারণে তার তথ্য বাহকেরা দিনে প্রায় ২০০ মাইলেরও বেশী পথ পাড়ি দিয়ে এক যায়গা থেকে অন্য যায়গায় তথ্য নিয়ে যেতে পারত। এজন্য তিনি বিভিন্ন চেকপোস্ট তৈরী করেছিলেন যেখানে সবসময়ই তথ্য বাহকদের জন্য ঘোড়া, খাদ্য, এবং পানির সুব্যবস্হা থাকত। এর রক্ষাণাবেক্ষনে নিয়োজিত ব্যক্তিরা চাহিবা মাত্র তথ্য বাহকদের এইসব সেবা প্রদান করতে বাধ্য ছিলো। ফলে দূরবর্তী অঞ্চলের মধ্যে সবসময়ই খুব সহজেই যোগাযোগ রক্ষা করতে সমর্থ ছিলেন। অনেক সময় সাধারণ নাগরিকরাও তথ্যবাহকদের তাদের নিজেদের গুরুত্বপূর্ন খবর আদান-প্রদানের কাজে ব্যবহার করতে পারত। তথ্য বহনের এই রাস্তা ধরেই তিনি ব্যবসায় নিয়োজিত দেশী বিদেশী ক্যারাভানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আদেশ দিয়েছিলেন। তার কড়া নির্দেশ ছিলো কেউ যেন এ সমস্ত ক্যারাভান আক্রমণ না করে। এর ব্যত্যয় ঘটলে তার শাস্তি ছিলো ভয়াবহ। আর এর ফলেই সম্ভব হয়েছিলো পূর্ব এবং পশ্চিমের মধ্যে ব্যবসা-বানিজ্য, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আদান প্রদানের।

চেঙ্গীস খান অন্য সব মঙ্গোলিয়ানের মতই ছিলেন অশিক্ষিত। বালক বয়সে বাবাকে বিষ প্রয়োগে শত্রুরা হত্যা করলে পরিবার সহ যুদ্ধবাজ গোত্র থেকে বিতারিত হয়েছিলেন এবং বছরের পর পর বছর নিজ গোত্রের এবং বাইরের পুরোনো শত্রুদের কাছ থেকে পালিয়ে বেরিয়েছেন। ছোট বেলায় দুর্ঘটনাবশতঃ সৎভাইকে হত্যা করেন। তার স্ত্রীকে শত্রুরা অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিলো। ত্যার সবচাইতে কাছের বন্ধু তাকে বহুবার হত্যার চেষ্টা করেছে। এতসব কিছুর পরও তার একটা “ভিশন” ছিলো; দূরদর্শিতা ছিলো সেটাকে বাস্তবায়িত করার। একটা নিরুপদ্রব সাম্রাজ্য গড়েছিলেন যেখানে ছিলো ধর্মীয় স্বাধীনতা, শিল্পীর স্বাধীনতা, শিক্ষা এবং আন্ত্রজাতিক বাণিজ্য সহায়ক। চেঙ্গীস যে শুধুমাত্র একজন সামরিক জেনারেলই ছিলেন তা নয় তিনি ছিলেন একজন মহান নেতাও। যদিও চেঙ্গীস তার জীবদ্দশাতেই বিশাল বড় বড় সব সাফল্য অর্জন করেছিলেন তবুও তিনি তার প্রতিকৃতি আঁকাননি, কোন মনুমেন্ট তৈরী করাননি, মুদ্রার পিঠে নিজের ছবি বসাননি, তার গৌরব গাঁথা নিয়ে গান কিংবা কবিতা লেখাননি, প্রাসাদ কিংবা উপাসণালয়ের নাম নিজের নামে রাখেননি। তিনি যখন মারা যান তখন তার জন্মভূমিতে কবর দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে গিয়েছিলেন এবং কোনরকম স্মৃতিসৌধ বানাতে নিষেধ করে গিয়েছিলেন।

একজন অশিক্ষিত, বর্বর, যুদ্ধবাজ মানুষের পক্ষে এতসব সাফল্য অর্জন করা কিভাবে সম্ভব হয়েছিলো সেটা হৃদয়াঙ্গম করা আমার মতে এককথায় একটি অসম্ভব ব্যাপার।

সূত্রঃ

1. Genghis Khan – His Life and Legacy By Paul Ratchnevski

2. Genghis Khan By Robert N. Webb

3. Genghis Khan – Heavens Proudest Son of An Era By Liu Yi and Dan Pool

4. Rulers of The world By Philippe Gigantes

5. Bringing Genghis Khan to America (Interview with Don Lessem) By Kallie Sxczepanski