প্রথম অধ্যায়
দ্বিতীয় অধ্যায়
তৃতীয় অধ্যায় (প্রথম অংশ)
========================
তৃতীয় অধ্যায়ের প্রথম অংশে নিচের বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে –
ক) আধুনিক অনুলিপিকারক (রেপ্লিকেটর), অর্থাৎ ডিএনএ’র গঠন বর্ণনা
খ) ক্রোমোজোমে ডিএনএ’র সজ্জা, মায়োসিসের সময় জিনের পুনর্বিন্যাস
গ) জিনের বাসস্থান, অর্থাৎ প্রাণী বা উদ্ভিদদেহের সাথে জিনের মিথষ্ক্রিয়া
ঘ) জিনের অমরত্ব বা বংশানুক্রমে টিকে থাকার, প্রবাহিত হওয়ার ব্যাখ্যা
ঙ) ক্রসিং-ওভার, মিউটেশন ও সিসট্রনের বর্ণনা
======================================
অধ্যায় তিনঃ অমর অজর শিকল

তাহলে, এর চাইতে ছোট জিনগত এককের, যেমন ৮ক ক্রোমোজোমের দৈর্ঘ্যের ১/১০০ ভাগের আয়ু কতো? এই এককও আপনার পিতার কাছ থেকে এসেছে, কিন্তু হয়তো এটা তার শরীরে সন্নিবেশিত হয় নি। আগের যুক্তি অনুযায়ী ৯৯ ভাগ সম্ভাবনা যে এই অংশটি আপনার পিতা তার পিতা-মাতার একজনের কাছ থেকে অবিকৃত অবস্থায় পেয়েছেন। ধরি এটি তার মা অর্থাৎ আপনার দাদীর কাছ থেকে এসেছে। আবারও সেই ৯৯ ভাগ সম্ভাবনা যে দাদীও এটি তার পিতামাতার যে কোন একজনের কাছ থেকে অক্ষত অবস্থায় পেয়েছেন। এভাবে বংশ বিশ্লেষণ করে ক্রমশ পিছনে যেতে থাকলে এক পর্যায়ে আমরা এই এককের আদি-স্রষ্টাকে পাবো। কোন এক ধাপে এই এককটি প্রথমবার তৈরি হয়েছিলো, সৃষ্টি হয়েছিলো আপনারই কোন এক পূর্বপুরুষের শরীরের অণ্ডকোষে বা ডিম্বকোষে।

‘সৃষ্টি’ শব্দটিকে আমি যে বিশেষ অর্থে ব্যবহার করছি এবার তা ব্যাখ্যা করি। জিনগত একক তৈরিতে যে ছোট ছোট উপ-একক লাগছে সেগুলো হয়তো আরো আগেই তৈরি হয়েছিলো। আমাদের এই জিনগত এককটি একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে সৃষ্টি হচ্ছে; এর মানে হলো উপ-এককগুলো এক নির্দিষ্ট সজ্জায় সজ্জিত হয়ে জিনগত একক গড়ে তুলছে, এর আগে যার কোন অস্তিত্ব ছিলো না। এই সৃষ্টির মুহূর্তটি হয়তো খুব সাম্প্রতিক, হয়তো আপনার দাদী বা দাদার শরীরে। কিন্তু আমরা যদি খুবই ক্ষুদ্র কোন জিনগত এককের কথা চিন্তা করি, তাহলে সেটি হয়তো আরো পুরানো কোন পূর্বপুরুষের শরীরে সমন্বিত হয়েছে। পূর্বপুরুষটি হয়তো বানরের মতো একজন আদি-মানব ছিলেন। একইভাবে, আপনার শরীরে তৈরি একটি জিনগত একক হয়তো ভবিষ্যতে অনেক সময় পর্যন্ত টিকে থাকবে, আপনার বহু উত্তরসূরির শরীরে অক্ষত অবস্থায় বিরাজ করবে।

এও মনে রাখা জরুরি যে একজন মানুষের উত্তর-বংশ শাখা-প্রশাখায় বাড়ে, সরলরেখার মতো বাড়ে না। তার মানে আপনার যে পূর্বপুরুষ ৮ক ক্রোমোজোমের ক্ষুদ্র একাংশ ‘সৃষ্টি’ করেছিলেন, আপনি ছাড়াও তার অনেক উত্তরসূরি আছে। আপনার একটি জিনগত একক হয়তো আপনার সেকেন্ড কাজিনের শরীরেও আছে। এই একক হয়তো আমার শরীরেও আছে, হয়তো প্রধানমন্ত্রীর শরীরেও আছে। আপনার কুকুরের মাঝেও আছে, কারণ অনেক পেছনে গেলে আমরা সবাই একই পূর্বপুরুষের বংশধর। আবার এই একই একক হয়তো আলাদা আলাদা ভাবে কয়েকবার তৈরি হয়েছে। যদি এককটি খুব ক্ষুদ্র হয় তাহলে এই কাকতালীয় ঘটনার সম্ভাবনাও কম নয়। কিন্তু একজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের সাথেও আপনার একটি পূর্ণ ক্রোমোজোমের মিল পাওয়া যাবে না। জিনগত একক যতো ছোট হবে, আরেকজনের সাথে সেটা মিলে যাবার সম্ভাবনাও ততই বেড়ে যাবে। এই এককটির অনেকগুলো কপি অন্যান্য প্রাণীর মাঝে থাকার সম্ভাবনাও বাড়ব

নতুন জিনগত একক তৈরির সম্ভাবনা নির্ভর করে ক্রসিং-ওভারের কারণে উপ-এককগুলোর জুড়ে যাওয়ার দৈব সম্ভাবনার ওপর। এছাড়া আরেকটি উপায়ে নতুন একক তৈরি হতে পারে, তা হলো বিন্দু পরিব্যক্তি (point mutation)। যদিও এই প্রক্রিয়া বেশ বিরল। বিন্দু পরিব্যক্তি মূলত এক ধরনের ত্রুটি, যেমন বই ছাপানোর সময়ে কোন অক্ষর ভুল ছাপা হয়, তেমন। এটা বিরল, আর বোঝা যাচ্ছে যে জিনগত এককের দৈর্ঘ্য যতো বেশি হবে ততোই এই পরিব্যক্তি ঘটার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।

আরেক বিরল ধরণের ত্রুটি বা পরিব্যক্তি ঘটে যার দীর্ঘকালীন প্রভাব রয়েছে, একে বলে ইনভারশন। একটি ক্রোমোজোম এই প্রক্রিয়ায় পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেকে উলটে ফেলে। অনেকটা পায়ের দিকে মাথা আর মাথার দিকে পা দেয়ার মতো। তারপরে আবার আগের জোড়ার সাথে জুড়ে যায়। আমাদের আগের উদাহরণের সাথে মিলিয়ে বললে, এভাবে উল্টে যাবার পর ফাইলের কিছু পৃষ্ঠার নম্বর বদলাতে হবে। অনেক সময় ক্রোমোজোমের অংশগুলো এভাবে কেবল উল্টে যায় না, বরং একদম ভিন্ন এক জায়গায় জুড়ে যায়। অথবা অন্য আরেকটা ক্রোমোজোমের সাথে যোগ দেয়। যদি কিছু পৃষ্ঠাকে খুলে অন্য একটা খণ্ডে জুড়ে দেয়া হয়, তাহলে এই ঘটনার মতো কিছু ঘটবে। এরকম ত্রুটির গুরুত্ব আছে। বেশিরভাগ সময়েই এরকম ত্রুটির ফলে মারাত্মক ফলাফল হতে পারে। তবে মাঝে মাঝে দেখা যায় এরকম ভুলের ফলে কোন কোন জিনগত উপাদানের মধ্যে এক ধরণের ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র তৈরি হচ্ছে। এই যোগসূত্র সাধারণ নিয়মে তৈরি হতো না, কিন্তু এমন ভুলের ফলে এই জিনগত উপাদানগুলো একসাথে মিলে ভালোই কাজ করে। হয়তো দুটো সিসট্রন একসাথে থাকলেই কেবল উপকারী আচরণ করে – তারা এমন ইনভারশনের ফলে কাছাকাছি চলে আসে। তারপর হয়তো এই নতুন জিনগত এককটি প্রাকৃতিক নির্বাচনের আনুকূল্য পাবে আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে যাবে। জিন কমপ্লেক্সগুলো হয়তো অনেক বছর ধরেই এমন ব্যাপক পুনর্বিন্যাস ও ‘সম্পাদনা’র মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এই সম্ভাবনাও কম নয়।

এইরকমের আরো একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো মিমিক্রি বা শত্রুর হাত থেকে বাঁচতে আত্মরক্ষামূলক অনুকৃতির বিস্ময়কর ঘটনা। ব্যাখ্যা করছি। কিছু কিছু প্রজাপতি খেতে খুবই বিস্বাদ। এগুলো সাধারণত উজ্জ্বল এবং বিশেষ রঙের হয়ে থাকে। পাখিরা এদের গায়ের রঙ দেখে ‘চিনতে’ পেরে এড়িয়ে চলে। এইখানে অন্যান্য প্রজাপতি যেগুলো খেতে মজা, পাখিদের শিকার হয়, তারা এটার সুযোগ নেয়। তারা এই বিস্বাদ প্রজাপতিকে অনুকরণ করে। জন্মানোর সময় বিস্বাদ প্রজাপতির মতো রঙ নকল করে জন্মায়, কিন্তু তাদের স্বাদ ঠিকই থাকে, বিস্বাদ হয় না। তারা খুব সহজেই যেমন পাখিদের ধোঁকা দেয়, তেমনি অনেক প্রকৃতিবিদকেও ধোঁকা দেয়। যে পাখি একবার বিস্বাদ প্রজাপতি চেখে দেখেছে সে ওই রঙের সব প্রজাপতিকেই বিস্বাদ ভেবে এড়িয়ে চলে। এই দলে নকল-প্রজাপতিরাও পড়ে। তাই বলা যায় যে প্রাকৃতিক নির্বাচনের আনুকূল্যে অনুকৃতি জিন সুবিধা পায়। এভাবে অনুকৃতির বিবর্তন ঘটে।

প্রকৃতিতে হরেক রঙের বিস্বাদ প্রজাপতি আছে যেগুলো দেখতে একই ধরনের নয়। নকলকারী প্রজাপতি তাদের সবাইকে অনুকরণ করতে পারে না। তাকে একটা নির্দিষ্ট প্রজাতির বিস্বাদ প্রজাপতির আদল অনুকরণ করতে হয়। কিন্তু এমন অনেক অনুকরণকারী প্রজাতি আছে, যারা খুব আশ্চর্যজনক আচরণ করে। প্রজাতির কয়েকজন এক ধরণের বিস্বাদ প্রজাপতিকে নকল করে, আর বাকিরা অন্য আরেক ধরণের বিস্বাদ প্রজাপতিকে নকল করে। যদি এদের মাঝে কেউ দুইটা প্রজাতিকেই নকল করতে যায়, বা মাঝামাঝি পন্থা নেয়, তাহলে পাখিরা তাকেই শিকার করে। এই মধ্যবর্তী প্রজাপতি জন্মায় না। একজন যেমন কেবল নারী বা কেবল পুরুষ হতে পারে, ঠিক তেমনি একটা নকল-প্রজাপতি যে কোন এক ধরণের বিস্বাদ প্রজাপতিকে নকল করে। একটি প্রজাপতি হয়তো প্রজাতি ক-এর প্রজাপতিকে নকল করে, এবং তার ভাই নকল করে প্রজাতি খ-এর প্রজাপতিকে।

এখন মনে হচ্ছে যে একটিমাত্র জিন ঠিক করে দিচ্ছে যে একটি প্রজাপতি কোন প্রজাতিকে (ক নাকি খ) নকল করবে। কিন্তু খালি একটা জিনের পক্ষে অনুকরণের এতোগুলো বৈশিষ্ট্যকে নিয়ন্ত্রণ করা কীভাবে সম্ভব? কেমন করে প্রজাপতির রঙ, আকার, ফুটকি বিন্যাস, ওড়ার ছন্দ ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য একাই এটি ঠিক করে দিচ্ছে? উত্তর হলো যদি আমরা একটিমাত্র জিন বলতে একটি সিসট্রনকে বুঝিয়ে থাকি তাহলে এটা সম্ভব না। তবে ইনভারশন ও অন্যান্য দৈবিক পুনর্বিন্যাসের সময় যে অসচেতন এবং স্বয়ংক্রিয় ‘সম্পাদনা’ ঘটে থাকে, বিচ্ছিন্ন ও দূরবর্তী জিনগত উপাদান এভাবে ঘটনাচক্রে কাছাকাছি চলে আসে। আর এর ফলে ওই উপাদানের একটা বড় গুচ্ছের মাঝে খুব ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র তৈরি হয়ে যায়। একটি ক্রোমোজোমের ভেতরে এই বড়ো গুচ্ছটি একটি একক জিনের মত আচরণ করতে থাকে। তাই আমাদের সংজ্ঞামতে, এটাই একটি একক ‘জিন। এটারও একটা ‘অ্যালিল’ আছে যা একইভাবে সৃষ্ট অন্য কোন একটা গুচ্ছ জিন। এক গুচ্ছের মাঝে প্রজাতি ক-কে অনুকরণ করার তথ্য দেয়া আছে, আর অন্য গুচ্ছটির মাঝে দেয়া আছে প্রজাতি খ-কে অনুকৃতি করার নির্দেশাবলী। দুটো গুচ্ছেরই ক্রসিং-ওভারে ভেঙে যাবার সম্ভাবনা খুব কম, তাই মধ্যবর্তী নকল প্রজাপতি জন্মাতে দেখা যায় না। যদি পরীক্ষাগারে একইসাথে প্রচুর প্রজাপতি উৎপাদিত হয়, তখন এরকম ঘটনা কদাচিৎ ঘটতে পারে।

আমি জিন শব্দটি ব্যবহার করে একটি জিনগত উপাদান বোঝাচ্ছি যা আকারে বহুসংখ্যক প্রজন্মান্তরে অক্ষত থাকার মতো ক্ষুদ্র, একইসাথে যার অনেক নকল প্রজাতিগুলোতে বন্টিত হয়ে আছে। এটা কোন ‘হয়-এটা-নয়-ওটা’ ধরণের কঠোর সংজ্ঞা না, বরং বেশ খোলামেলা-ছড়ানো সংজ্ঞা। অনেকটা ‘বড়ো’ বা ‘বুড়ো’ শব্দের সংজ্ঞার মতো। ক্রোমোজোমের কোন অংশের যদি ক্রসিং-ওভারের কারণে ভেঙে যাওয়ার, কিংবা নানারকম পরিব্যক্তির কারণে বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে তাহলে আমার সংজ্ঞানুযায়ী সেটি জিন হিসেবে গণ্য হবে না। একটা সিসট্রন খুব সহজেই এই সংজ্ঞায় খাটে। একইভাবে আর একটু আকারে বড়ো একককেও সংজ্ঞানুযায়ী জিন বলতে পারি। এক ডজন সিসট্রন হয়তো ক্রোমোজোমের ভেতর এতই ঘন হয়ে সজ্জিত যে তাদেরকেও একসাথে আমরা একটি একক দীর্ঘজীবী জিনগত একক ধরতে পারি। প্রজাপতি অনুকৃতির জিনগত গুচ্ছ এটার ভালো উদাহরণ। সিসট্রনগুলো যখন এক দেহ থেকে অন্য দেহে প্রবেশ করে, যখন তারা শুক্রাণু বা ডিম্বাণুতে চেপে পরের প্রজন্মের দিকে যাত্রা শুরু করে, তখন হয়তো হঠাৎই খেয়াল করে যে বহুদিনের প্রতিবেশী সিসট্রনও সফরসঙ্গী হয়েছে। ছোট সেই তরীতে পুরানো সহচর, আদিতম পূর্বপুরুষের শরীর থেকে পাশাপাশি থাকা নাবিককে পাশে দেখতে পায়। একই ক্রোমোজোমের এই প্রতিবেশী সিসট্রনেরা নিজেদের মাঝে খুব গাঢ় ও দৃঢ় বন্ধন তৈরি করে ফেলে, যারা মায়োসিসের সময় খুব সহসা আলাদা নৌকায় চলে যায় না।

নির্দিষ্ট করে বললে, এই বইয়ের নাম কখনই স্বার্থপর সিসট্রন বা স্বার্থপর ক্রোমোজোম বলা যাবে না। এটার প্রকৃত নাম হতে পারে ক্রোমোজোমের কিছুটা স্বার্থপর বড়ো অংশ এবং তারচেয়েও স্বার্থপর ছোট অংশ। কিন্তু তাতে বইয়ের শিরোনামটা একদমই জমে না। তাই ক্রোমোজোমের এই ক্ষুদ্র দীর্ঘজীবী অংশটিকে জিন বলে আখ্যা দিলাম। আর বইয়ের নাম দিলাম স্বার্থপর জিন।

এখন আবার ঘুরে ফিরে আমরা প্রথম অধ্যায়ের শেষের কথায় ফিরে এসেছি। সেখানে আমরা দেখেছিলাম যে, কোন স্বতন্ত্র সত্তাকে যদি প্রাকৃতিক নির্বাচনের একক বলা যায়, তাহলে তার আচরণে স্বার্থপরতাই আশা করতে পারি। আমরা দেখেছি যে অনেকে প্রজাতিকে প্রাকৃতিক নির্বাচনের একক মনে করেন। অনেকে ভাবেন প্রজাতির মধ্যে একটি সমষ্টি (population), বা গোষ্ঠীই (group) একক, আবার অনেকে ভাবেন একক প্রাণীই নির্বাচনের একক। আমি বলছিলাম যে আমি বরং জিনকেই প্রাকৃতিক নির্বাচনের মৌলিক একক বলে বিবেচনা করি। সুতরাং এটাই আত্ম-স্বার্থের মৌল একক। এতক্ষণ যা করেছি, তা হলো ‘জিন’ শব্দটিকেই আমি এমনভাবে সংজ্ঞায়িত ও বর্ণনা করেছি যে আমার দাবি ঠিক না হয়েই যায় না।

একেবারে সাধারণ ভাষায় প্রাকৃতিক নির্বাচন বলতে বুঝায় স্বতন্ত্র সত্তার টিকে থাকার পার্থক্য (differential survival)। কোন সত্তা বেঁচে থাকবে, কোন সত্তা মরে যাবে। এবং পৃথিবীতে এই নৈর্বাচনিক মৃত্যুর কোন প্রভাব থাকার জন্যে অবশ্যই একটি শর্ত পূরণ করতে হবে। সেটা হলো প্রতিটি সত্তার অসংখ্য নকল থাকতে হবে, এবং এই নকলগুলোর মধ্যে কিছু নকলের মাঝে টিকে থাকার সক্ষমতা থাকতে হবে। টিকে থাকার সময়কাল বিবর্তনের হিসাবে উল্লেখযোগ্য হওয়াও বাঞ্ছনীয়। আমার বর্ণিত ক্ষুদ্র জিনগত এককের মাঝে এই বৈশিষ্ট্যগুলো রয়েছে: একক, গোষ্ঠী বা প্রজাতির মাঝে নাই। গ্রেগর মেন্ডেল এই ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন যে বংশগতির একককে আমরা অবিভাজ্য ও স্বাধীন কণিকা হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। এখনকার দিনে আমরা জানি যে এটা একটু সরলীকরণ হয়ে যায়। একটা সিসট্রনও অনেক সময় ভেঙে যেতে পারে, আর একই ক্রোমোজোমের যে কোন দুইটি জিন পুরোপুরি স্বাধীন না। আমি যা করেছি তা হলো জিনকে এমন একটি একক হিসেবে ব্যাখ্যা করেছি যা অনেকদূর পর্যন্ত সেই আদর্শ অবিভাজ্য কণিকার মতো হতে পারে। কোন জিনই অবিভাজ্য নয়, কিন্তু তা কালেভদ্রে ভাঙে। এটি যে কোন প্রাণীর শরীরে হয় থাকবে, নয়তো থাকবেই না। একটি জিন প্রথম প্রজন্ম থেকে তৃতীয় প্রজন্মে অক্ষত অবস্থায় চলে আসে। এই যাত্রায় মধ্যবর্তী প্রজন্মে অন্য কোন জিনের সাথে জোড়া না লেগেই সেটি চলে যেতে পারে। যদি জিনগুলো ক্রমাগত মিশ্রিত হতো, তাহলে আমরা এখন যে প্রাকৃতিক নির্বাচন জানি, সেটা ঘটতেই পারতো না। ঘটনাক্রমে, এটা ডারউইনের জীবদ্দশাতেই প্রমাণিত হয়েছিলো। ডারউইন এই বিষয়টি নিয়ে বিশেষ চিন্তিত ছিলেন কারণ তখন প্রচলিত ধারণা ছিলো যে বংশগতি একটি মিশ্রণ প্রক্রিয়া। যদি মেন্ডেলের আবিষ্কার তখন প্রকাশিত হতো, তাহলে ডারউইন হয়তো এই চিন্তা থেকে উদ্ধার পেতেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে তিনি তা জানতে পারেন নি। ডারউইন ও মেন্ডেলের মৃত্যুর অনেক বছর অবধি কেউ ওটা পড়েও দেখে নি। মেন্ডেলও সম্ভবত তার প্রাপ্ত ফলাফলের গুরুত্ব বুঝে উঠতে পারেন নি, নাহলে তিনি অবশ্যই ডারউইনকে তা জানাতেন।

জিনের আরো একটি বৈশিষ্ট্য হলো এটি কখনই জরাগ্রস্ত হয় না। একশ বছর বয়সী জিনের চাইতে এক মিলিয়ন বছর বয়সী জিনের মৃত্যুর সম্ভাবনা বেশি না। এটি দেহ থেকে দেহ, প্রজন্ম-প্রজন্মান্তর পার হয়ে চলে যায়, এটি দেহের পর দেহকে নিজের মতো করে নিজের প্রয়োজনে প্রভাবিত করতে থাকে, অসংখ্য মরণশীল শরীর ছাপিয়ে যাওয়ার পরে এর জরা ও মৃত্যু ঘটে।

জিনগুলো অমর, অন্তত জিনগত সত্তারই এই বিশেষণ পাওয়ার যোগ্যতা সবচেয়ে বেশি আছে। অপরদিকে, আমরা যারা পৃথিবীতে টিকে আছি, আরো কয়েক দশক থাকার আশা করতে পারি মাত্র। কেবল জিনদেরই এমন দীর্ঘ জীবনের নিশ্চয়তা আছে যা কেবল দশকে মাপা যায় না, মাপতে হয় হাজার হাজার মিলিয়ন বছরে।

যৌন জনন-ক্ষম প্রজাতির মধ্যে একটি প্রাণী প্রাকৃতিক নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ একক হতে পারে না। একটি প্রাণী জিনগত একক হিসেবে অনেক বড়ো আর ক্ষণস্থায়ী। এরকম প্রাণীর গোষ্ঠী তার চাইতেও বড়ো একক। জিনের চোখে দেখলে একক প্রাণী বা বেশকিছু প্রাণীর গোষ্ঠী আকাশের মেঘ বা মরুভূমির ধূলিঝড়ের মতো। এগুলো সাময়িক জোট বা দল। বিবর্তনিক সময়ের হিসাবে এগুলো ক্ষণস্থায়ী। সমষ্টি সেইদিক থেকে বেশ স্থায়ী হতে পারে, কিন্তু সমষ্টির এককগুলো ক্রমাগত অন্য সমষ্টির সাথে মিশে যাচ্ছে এবং স্বকীয়তা হারাচ্ছে। একইসাথে সমষ্টির ভেতরে ক্রমাগত বিবর্তন হতে থাকে। তাই প্রাকৃতিক নির্বাচনের একক হওয়ার মতো বিচ্ছিন্নতা এর মাঝে নেই। স্থায়িত্ব, এবং অন্য সমষ্টির থেকে আলাদা করে বাছাই করার মতো মৌলিকত্বও এরকম সমষ্টির নেই।

একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ দেহ যতদিন টিকে ততদিন বেশ বিচ্ছিন্ন একক হিসেবে বিরাজ করে। কিন্তু এই সময়টা কতো অল্প! প্রতিটি প্রাণী অদ্বিতীয়। যদি সেই সত্তার মাত্র একটি কপিই থাকে তাহলে বিবর্তন পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে অনেকগুলো সত্তার মধ্যে সেটিকে বেছে নেয়ার কোন উপায় নেই! যৌন জনন প্রক্রিয়া তো অনুলিপি-করণ না। যেভাবে একটি সমষ্টি অন্য সব সমষ্টি দিয়ে দূষিত হয়, ঠিক একইভাবে একজনের বংশধরের বৈশিষ্ট্যগুলো তার যৌন-সহচরের কারণে দূষিত হয়ে যায়। আপনার সন্তানদের অর্ধেকটুকুই খালি আপনার থেকে তৈরি, তাদের সন্তানদের সিকি অংশ আপনার থেকে তৈরি। কয়েক বংশ পার হলে আপনি বড়োজোর আশা করতে পারেন যে আপনার অনেকগুলো উত্তরসূরি থাকবে। তারা আপনার খুব ছোট ছোট অংশ বহন করবে – হয়তো কয়েকটা জিন, তাদের পদবি আপনার সাথে মিলে গেলেও তাতে কোন লাভ নেই।

একক প্রাণী কোন সুস্থির ব্যাপার না, এরা সারাক্ষণ দ্রুতগতিতে ছড়াতে থাকে। ক্রোমোজোমগুলোও ক্রমাগত মিশ্রিত হতে থাকে, তাসের পাতার মতো প্রতিবার ডিলের সময়ে বদলে যেতে থাকে। এখানে তাসগুলো হচ্ছে জিন। ক্রসিং-ওভারের কারণে জিন কিন্তু বিনষ্ট হচ্ছে না, কেবল তাদের সহচর বদলে যাচ্ছে। অতি জরুরি ভাবে এই বদলানোর পাশাপাশি সেগুলো প্রবাহিত হচ্ছে প্রজন্মের ভেতর দিয়ে। এটাই তাদের ধান্দা। তারা হলো নকলকারী, আর আমরা হলাম তাদের বাহন, যন্ত্র। আমাদের ভূমিকা পূরণ হয়ে গেলে একসময় আমরা একপাশে সরে যাবো। কিন্তু জিনগুলো ভূতাত্ত্বিক জাতক: তারা অবিনশ্বর।

আমাদের জিনগুলো হীরার মতোই অবিনশ্বর, তবে তুলনাটা পুরোপুরি মিলে না। হীরার একটা নির্দিষ্ট কেলাস থাকে, একটা নির্দিষ্ট অণুর বিন্যাস থাকে যা কখনই বদলায় না। ডিএনএ অণুর এধরণের স্থায়িত্ব নেই। একটি ডিএনএ অণুর জীবন খুবই ছোট – হয়তো কয়েক মাস। কোনোভাবেই তা এক জীবনকালের বেশি নয়। কিন্তু একটি ডিএনএ’র কপি লক্ষ লক্ষ বছর টিকে থাকতে পারে, সেদিক থেকে ডিএনএ অমর। আবার প্রাগৈতিহাসিক সুপের অনুলিপি-কারকদের মতোই একটি জিনের নকল সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে পারে। ওগুলো থেকে এখনকার ডিএনএ’র পার্থক্য হলো এখন তা খুব স্থায়ীভাবে প্রাণীদেহে সংরক্ষিত হয়।

আমি যে বিষয়টার ওপর জোর দিচ্ছি, তা হলো যে কোন জিনের নকল তৈরির মাধ্যমে প্রায়-অমরতার বৈশিষ্ট্যই তার বিশেষ গুণ। আমরা সিসট্রনকে জিন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করতে পারি, অনেকক্ষেত্রে তা সুবিধাজনকও বটে। কিন্তু এই সংজ্ঞাটাকে বিবর্তনের সূত্রের প্রয়োজনে একটু বিস্তৃত করতে হবে। সংজ্ঞার প্রয়োজন কতোটুকু, তার উপর ভিত্তি করে সংজ্ঞার বিস্তার করতে হবে। আমরা প্রাকৃতিক নির্বাচনের একটা ব্যবহারিক একক তৈরি করতে চাচ্ছি। এর জন্যে প্রাকৃতিক নির্বাচনের সার্থক এককের বৈশিষ্ট্যগুলোকে সঠিক রূপে চিহ্নিত করা দরকার। আগের অধ্যায়ে যেমন বলেছি, এই বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে স্থায়িত্ব, উর্বরতা, এবং নকল-বিশ্বস্ততা। যার মাঝে এইসব বৈশিষ্ট্যগুলো ঠিকমতো বিদ্যমান, তাকেই আমরা ‘জিন’ নামের সত্তা বলে সংজ্ঞায়িত করবো। জিন একধরণের দীর্ঘ-আয়ুর অনুলিপি-কারক, যার অনেকগুলো হুবহু নকল থাকে। এটি আয়ু অসীম না। আসলে হীরাও তো অসীম আয়ুর নয়। এমনকি সিসট্রনগুলোও ক্রসিং-ওভারের সময় দুইভাগে কাটা পড়তেই পারে। তাহলে জিন বলতে আমরা ক্রোমোজোমের এমন অংশকে বুঝে নিবো, যা বস্তুত দীর্ঘজীবী, যতদিন বেঁচে থাকলে তাকে বিবর্তনের উল্লেখযোগ্য একক হিসেবে গণ্য করা যায়।

প্রশ্ন হলো, যতদিন মানে কতদিন? এর কোন ধরাবাঁধা জবাব হয় না। এটা নির্ভর করে প্রাকৃতিক নির্বাচনের ‘চাপ’ কতোটা প্রবল তার ওপর। এই চাপের মানে, একটা ‘খারাপ’ জিনগত একক আরেকটা ‘ভালো’ জিনগত এককের চাইতে কতো তাড়াতাড়ি মরতে পারে। এটা এমনই এক সংখ্যাগত হিসাব যা এক এক উদাহরণে এক এক রকম। প্রাকৃতিক নির্বাচনের ব্যবহারিক একক – জিন – মূলত সিসট্রন ও ক্রোমোজোমের মাঝের জায়গায় বিরাজ করে।

জিনের সম্ভাব্য অমরতাই একে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মৌলিক এককের যোগ্য প্রার্থীতে পরিণত করেছে। এবার আসুন আমরা ‘সম্ভাব্য’ শব্দটিকে বিশ্লেষণ করি। একটি জিন লক্ষ লক্ষ বছর বেঁচে থাকতে পারে, কিন্তু এমন অনেক নতুন জিন আছে যেগুলো হয়তো প্রথম প্রজন্মই পার হতে পারে না। যে অল্প কিছু জিন পরের প্রজন্মে যেতে পারে, তারা বেশ ভাগ্যবান। ভাগ্যের চাইতেও বেশি জরুরি হলো তাদের মাঝে এমন কিছু আছে যা তাদের টিকে থাকতে সাহায্য করেছে। তারা আসলে টিকে থাকতে পারে এমন যন্ত্র তৈরিতে পারদর্শী। প্রতিটি দেহের ভ্রূণ গঠনের সময়েই এসব জিন এমন প্রভাব ফেলে যাতে সেসব দেহ বেশি দিন বাঁচতে পারে এবং জননে অংশ নিতে পারে। অন্য অ্যালিল ও প্রতিদ্বন্দ্বী জিনের চাইতে পারদর্শী জিন এই প্রভাব খাটানোর ব্যাপারে এগিয়ে থাকে। ধরা যাক, একটি ‘ভালো’ জিন যতোগুলো শরীরে যায় সবখানে শরীরের পাগুলোকে লম্বা করে দেয়, যা টিকে থাকায় ভূমিকা রাখে। সে দেহগুলিকে শিকারির হাত থেকে পালাতে ওই লম্বা পা সাহায্য করে। এটা একটা বিশেষ উদাহরণ, সর্বজনীন উদাহরণ না। সবসময় তো আর লম্বা পা হিতকর হতে পারে না। ছুছুন্দরের (mole) কাছে লম্বা পা আবার একধরণের প্রতিবন্ধকতা। নানারকম বিস্তারিত উদাহরণের পাঁকে আটকে না গিয়ে আমরা কি এমন কোন সর্বজনীন গুণের কথা ভাবতে পারি, সেটা সকল ভালো (দীর্ঘজীবী) জিনের মাঝে থাকা উচিত? ঘুরিয়ে বললে, আমরা কি এমন কোন বৈশিষ্ট্যকে বের করতে পারি যা একটি জিনকে সরাসরি ‘খারাপ’, স্বল্পায়ু হিসেবে চিহ্নিত করবে? এরকম অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে, কিন্তু আমাদের বইয়ের আলোচনায় একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। সেটা হচ্ছে জিন-পর্যায়ে স্বার্থহীনতা বা পরার্থপরতা খারাপ। স্বার্থপরতা ভালো। পরার্থপরতা ও স্বার্থপরতার প্রদত্ত সংজ্ঞা থেকে নির্মমভাবে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়। জিনগুলো টিকে থাকার জন্যে সরাসরি তাদের অ্যালিলের সাথে লড়াই করছে। কারণ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ক্রোমোজোমে প্রতিটি জিনের অ্যালিল তাদের জায়গার প্রতিদ্বন্দ্বী। যে যে জিন নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার আচরণ করে, জিন-সমষ্টির (gene pool) মধ্যে নিজের অ্যালিলকে হটিয়ে দিতে চায়, সেই জিনটাই টিকে থাকবে। যেভাবেই বলি না কেন, এই জিনটাই স্বার্থপরতার মৌলিক একক।

================================
(চলবে)