(missing image)

দৃশ্যত অলৌকিক

চৈনিক উপকথায় আছে, হিসা সম্রাটদের রাজত্বকালে (খ্রিষ্টপূর্ব আনুমানিক ২২০৫ -১৭৮২) একদিন আমাদের এই মহাজাগতিক পরিবেশ ওলট পালট হয়ে গেলো। হঠাৎ করেই আকাশে দেখা যেতে লাগলো দশটা সূর্য। তাদের তাপে মানুষের দুর্ভোগের সীমা নেই। এসব দেখে সম্রাট এক বিখ্যাত তীরন্দাজকে বললেন সে যেন অতিরিক্ত সূর্যগুলোকে তীর মেরে ধ্বংস করে ফেলে। বিনিময়ে তীরন্দাজকে দেওয়া হলো অমরত্বের বটিকা। কিন্তু তীরন্দাজের স্ত্রী সেই বটিকা চুরি করে। পরে সেই অপরাধে তাকে (স্ত্রীকে) নির্বাসন দেওয়া হয় চাঁদে।

দশ সূর্যের একটা সৌরজগৎ যে মনুষ্য বসবাসের উপযোগী হতে পারে না, সে ব্যাপারে চায়নিজদের ধারণা সঠিক ছিলো। এখন আমরা জানি যে, বাড়তি সূর্য থাকলে ট্যানিং (সৌন্দর্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে রোদে পুড়ে বাদামি হওয়া) এর সুযোগ যতই বাড়ুক না কেন, এমন একটা সৌরজগতে জীবনের বিকাশ প্রায় অসম্ভব। এবং এর কারণ শুধুমাত্র চৈনিক উপকথায় কল্পিত সেই অসহনীয় গরম নয়। আসলে এমন গ্রহও থাকা সম্ভব যেটা একাধিক নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করার সময়ও বেশ সহনীয় তাপমাত্রায় থাকে। অন্তত বেশ কিছু সময় ধরে। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে সুষম তাপমাত্রা, যেটা জীবনের বিকাশে প্রয়োজনীয়, থাকার সম্ভাবনা কম। কেন? সেটা বোঝার জন্য আসুন আমরা একদম সরলতম একটা বহুনক্ষত্রব্যবস্তা দেখি। এই ব্যবস্থায় সূর্য আছে দুইটা, ফলে এদেরকে বলে দ্বিমিক নক্ষত্রব্যবস্থা। আকাশে আমরা যত তারা দেখি তার প্রায় অর্ধেকই হচ্ছে এ ধরনের দ্বিমিক নক্ষত্র ব্যবস্থার সদস্য। নিচের চিত্রে যেমন দেখানো হয়েছে, একদম সরলতম নক্ষত্রব্যবস্থাতেও স্থিতিশীল কক্ষপথ পাওয়া সম্ভব শুধুমাত্র কয়েক ভাবেই। এখন এসব কক্ষপথে কোনো গ্রহ থাকলেও দেখা যাবে কখনো সেই গ্রহটি অতিউত্তপ্ত আবার কখনো অতিশীতল হয়ে পড়ছে। ফলে সেখানে জীবনের বিকাশ সম্ভব নয়। অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায় যদি দুটির বদলে একগুচ্ছ নক্ষত্র নিয়ে এই ব্যবস্থাটি গড়ে ওঠে।

আমাদের সৌরজগৎ বেশ “ভাগ্যবান” কারণ এর এমন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা না থাকলে এখানে জটিল জীবনের সূচনাই সম্ভব হতো না। যেমন নিউটনের সূত্র বলছে গ্রহসমূহের কক্ষপথ হবে, হয় বৃত্তাকার, না হয় উপবৃত্তাকার (উপবৃত্ত অনেকটা চ্যাপ্টা বৃত্তের মতো যেটার একদিক একটু লম্বাটে অন্য দিক একটু চাপা)। একটা উপবৃত্ত কতটা চ্যাপ্টা সেটা প্রকাশ করা হয় যে সংখ্যা দিয়ে তার নাম কেন্দ্রবিমূখীতা। এর মান থাকে শূন্য থেকে এক এর মধ্যে। কোনো উপবৃত্তের কেন্দ্রবিমূখীতা শূন্যের কাছাকাছি হলে বোঝা যায় এটি প্রায় একটা বৃত্তের মতো। অন্য দিকে কেন্দ্রবিমূখীতা একের কাছাকাছি হলে উপবৃত্তটি হয়ে পড়ে একেবারে চ্যাপ্টা। গ্রহসমূহ পুরোপুরি বৃত্তাকার কক্ষপথে ঘোরে না দেখে কেপলার বেশ মনকষ্টে ভুগেছিলেন। যেমন পৃথিবীর কেন্দ্রবিমূখীতা ২ শতাংশ। মানে এর কক্ষপথ ঠিক বৃত্তাকার নয় তবে বৃত্তের কাছাকাছি। পরে দেখা গেছে, এ ব্যাপারটা আসলেই বিরাট সৌভাগ্যের।

(missing image)

পৃথিবীতে মৌসুমি আবহাওয়ার যে ধারা, সেটা নির্ধারিত হয় পৃথিবীর নিজের অক্ষের উপর ঘূর্ণনের তলটি কক্ষপথে সূর্যের চারিদিকে ঘূর্ণনের তলের তুলনায় হেলে থাকার কারণে। যেমন শীতকালে উত্তর মেরু সূর্যের থেকে দূরে হেলে থাকে। যদিও এসময় পৃথিবী সূর্যের সবচেয়ে কাছে থাকে – ৯১.৫ মিলিয়ন মাইল, যেখানে জুলাইয়ের দিকে দূরত্ব হয় ৯৪.৫ মিলিয়ন মাইল- তারপরও সেই দূরত্ব ব্ররদ্ধির চেয়ে এই কাত হয়ে থাকার প্রভাবই বেশি পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু যে সব গ্রহের কক্ষপথের কেন্দ্রবিমূখীতা অনেক বেশি তাদের ক্ষেত্রে সূর্য থেকে দূরত্বের এই হ্রাস-বৃদ্ধির প্রভাবও অনেক বেশি। যেমন, বুধ গ্রহের কেন্দ্রবিমূখীতা ২০ শতাংশ হওয়ায়, গ্রহটি যখন সূর্যের সবচেয়ে কাছে থাকে (পেরিহেলিওন) সে সময়কার তাপমাত্রা, যখন সবচেয়ে দূরে থাকে (এপিহেলিয়ন) তার চেয়ে ২০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটেরও বেশি হয়। আবার ধরুন আমাদের পৃথিবীর কেন্দ্রবিমূখীতা যদি এক এর কাছাকাছি হতো তাহলে, কক্ষপথে সূর্যের নিকটতম বিন্দুতে পৌছালে আমাদের সব সমূদ্র টগবগ করে ফুটতো আবার দূরতম বিন্দুতে গেলে তারা জমে একেবারে বরফ হয়ে যেত। অর্থাৎ আমাদের শীতের ছুটি বা গ্রীষ্মের ছুটি কোনোটাই আরামে কাটতো না। ফলে দেখা যাচ্ছে, কক্ষপথের খুব বেশি কেন্দ্রবিমূখীতা জীবন বিকাশে সহায়ক নয়। তাই আমরা বেশ ভাগ্যবান যে আমাদের পৃথিবীর কেন্দ্রবিমূখীতা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি।

(missing image)

আমাদের সূর্যের ভর এবং তা থেকে আমাদের দূরত্বের হিসাবেও আমরা বেশ ভাগ্যবান। কারণ একটা নক্ষত্রের ভর থেকেই আসলে নির্ধারিত হয় কী পরিমান শক্তি এটা বিকিরিত করে। সবচেয়ে বড় নক্ষত্র আমাদের সূর্যের প্রায় একশ গুণ ভারীও হতে পারে, আবার সবচেয়ে ছোটো নক্ষত্র হতে পারে আমাদের সূর্যের ভরের প্রায় একশ ভাগের একভাগের সমান। আবার সূর্য থেকে পৃথিবীর যে দূরত্ব, তাতে সূর্যের ভর যদি ২০ শতাংশও কম বা বেশি হতো তাহলে পৃথিবী হয় মঙ্গলের চেয়েও শীতল হয়ে যেত, অথবা হতো বুধের চেয়েও উত্তপ্ত।

বিজ্ঞানীরা যে কোনো নক্ষত্রের জন্য নির্দিষ্ট দূরত্বে একটা সংকীর্ণ স্থান সংজ্ঞায়ীত করেন বাসযোগ্য হিসাবে। এ স্থানের তাপমাত্রা এমন হয় যেন এখানে পানি তরল অবস্থায় থাকতে পারে। এই বাসযোগ্য জায়গাকে অনেকসময় বিজ্ঞানীরা “গোল্ডিলক’স জোন” বলেন। কারণ বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজনীয় তরল পানি এখানেই থাকা সম্ভব, যে কারণে এখানকার তাপমাত্রাকে বলা হয় “একদম ঠিকঠিক”। আমাদের সৌরজগতের এই বাসযোগ্য জায়গা একেবারেই সরু। কিন্তু সৌভাগ্যের ব্যাপার হলো আমাদের এই পৃথিবী ঠিক সেই অংশেই পড়েছে।

(missing image)

নিউটন বিশ্বাস করতেন আমাদের এই অদ্ভুত ভাবে বাসযোগ্য সৌরজগৎ “বিক্ষিপ্ততা থেকে এমনি এমনিই শুধু প্রকৃতির নিয়ম মেনেই উদ্ভুত হয় নি”। বরং তিনি বলেছিলেন, মহাবিশ্বের এই সুসংগততা “ঈশ্বরেরই সৃষ্টি, এবং শুরু করে দেবার পরে এখনো পর্যন্ত তিনিই সক্রিয় ভাবে এই অবস্থা বজায় রেখেছেন।” এরকম ভাবার কারণ অবশ্য সহজেই অনুমেয়।যদি পুরো মহাবিশ্বে আমাদের সৌরজগতটাই একমাত্র জগৎ মনে করা হয় তাহলে এই যে এত এত প্রায় অসম্ভব কাকতাল মিলে আমাদের অস্তিত্বকে সম্ভব করে তুলেছে, আমাদের বিশ্বকে করেছে মনুষ্যবান্ধব, তা দেখে সত্যিই মনে ধাঁধার সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু ১৯৯২ সালে প্রথম একটা গ্রহের অস্তিত্ব নিশ্চিত হয় যেটা আমাদের সূর্য ব্যতীত অন্য একটি নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করছে। এখন আমরা এমন হাজারটা গ্রহের কথা জানি। এবং এ নিয়ে কারো দ্বিধা নেই যে মহাবিশ্বের বিলিয়ন বিলিয়ন নক্ষত্রের মধ্যে এমন গ্রহ আছে আরো অসংখ্য। ফলে আমাদের গ্রহ ব্যবস্থার এইসব কাকতাল- একক সূর্য, সৌরভর এবং সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্বের দৈব সমন্বয়- এগুলো পৃথিবীকে যে শুধুমাত্র মানুষের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে, তার প্রমাণ হিসাবে জোর হারিয়েছে। এখন আমরা জানি সব ধরনের গ্রহই আছে। তাদের কোনো কোনোটাতে–অন্তত একটাতে তো নিশ্চিত- জীবনের অস্তিত্ব সম্ভব। আর এটাতো বোঝাই যায়, কোনো গ্রহের কোনো সত্ত্বা যখন তার চারপাশের জগৎকে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করবে, তখন দেখবে যে সেটা ঠিক ঠিক তাদের জীবনের অস্তিত্বের উপযোগী।

শেষের এই কথাটাকে একটা বৈজ্ঞানিক নীতিতে পরিণত করা সম্ভব: আমাদের অস্তিত্ব নিজেই, কখন এবং কোন অবস্থান থেকে আমাদের পক্ষে মহাবিশ্বকে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব, সেটা নির্ধারণ করে। অর্থাৎ, আমাদের সত্বার অস্তিত্বই, আমরা নিজেদেরকে কী ধরনের পরিবেশের মধ্যে খুঁজে পাবো, তার নির্ধারক। এ নীতিকে বলে দুর্বল নৃকেন্দ্রীকতার নীতি। (একটু পরেই আমরা দেখবো কেন একে “দুর্বল” বলা হচ্ছে।) “নৃকেন্দ্রীকতার নীতির” বদলে আরো ভালো হতো যদি বলা হতো “নির্বাচণ নীতি”, কারণ এ নীতিতে কীভাবে আমাদের স্বীয় অস্তিত্ব সম্পর্কে জ্ঞানই সম্ভাব্য সকল অবস্থার মধ্য থেকে সেই সব অবস্থাকে বাছাই করে ফেলছে যেখানে জীবনের অস্তিত্ব সম্ভব, সেটাই বলা হয়।

এসব শুনতে দর্শনের মত মনে হলেও, দুর্বল নৃকেন্দ্রীকতার নীতির সাহায্যে বৈজ্ঞানিক অনুমান করা সম্ভব। উদাহরণ স্বরূপ, যে প্রশ্নের উত্তরে এ নীতির প্রয়োগ হয়েছে সেটা হচ্ছে, মহাবিশ্বের বয়স কত? একটু পরেই আমরা দেখবো, আমাদের অস্তিত্বের জন্য যেসব মৌল দরকার তার একটা হচ্ছে কার্বন, যা তৈরি হয় নক্ষত্রের মধ্যে আরো হালকা মৌলসমূহ রান্না হয়ে। এই কার্বন পরে সুপারনোভা বিস্ফোরণ হয়ে নক্ষত্র থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে, এবং পরে ঠান্ডা হয়ে নতুন প্রজন্মের কোনো সৌরজগতের কোনো গ্রহে হাজির হয়। ১৯৬১ সালে পদার্থবিজ্ঞানী রবার্ট ডাইক যুক্তি দেখান যে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে প্রায় ১০ বিলিয়ন বছর প্রয়োজন। তার মানে, মহাবিশ্বের বয়স অন্তত অত বছর হবেই। আবার মহাবিশ্ব ১০ বিলিয়ন বছরের চেয়ে খুব পুরাতন হওয়া সম্ভব নয়। কারণ তাহলে নক্ষত্রসমূহের সব জ্বালানী শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। ওদিকে আমাদের অস্তিত্বের জন্য উত্তপ্ত নক্ষত্রমন্ডলীর প্রয়োজন। অতএব, মহাবিশ্বের বয়স নিশ্চই প্রায় ১০ বিলিয়ন বছর। এই হিসাব একেবারে পুঙ্খানুপুঙ্খ নয়, তবে কাছাকাছি। বর্তমান তথ্য-উপাত্ত মতে বিগ ব্যাং হয়েছিলো আজ থেকে ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে।

মহাবিশ্বের বয়সের ক্ষেত্রে আমরা যেমন দেখলাম, নৃকেন্দ্রীক নীতির সাহায্যে কোনো ভৌত চলকের সুনির্দিষ্ট মান পাওয়া না গেলেও, বিভিন্ন সম্ভাব্য মানের একটা বিস্তার পাওয়া যায়। কারণ আমাদের অস্তিত্ব অনেক সময় কোনো চলকের একেবারে সুনির্দিষ্ট মানের উপর নির্ভর করে না, বরং সেসব চলকের যে মান আমরা দেখি তার কাছাকাছি কিছু থাকলেও চলে। এ ছাড়াও দেখা যায়, আমাদের জগৎ-এর অবস্থা নৃকেন্দ্রীকতার নীতি থেকে প্রাপ্ত সীমার মধ্যে পড়াটা আহমারি কিছু নয়। ব্যাখ্যা করে বললে, ধরুন কক্ষপথের কেন্দ্রবিমূখীতা শূন্য থেকে ০.৫ মধ্যে হলে সেটা জীবনের উপযোগী। সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রবিমূখীতার মান ০.১ দেখে খুব অবাক হওয়ার কিছু নেই, কারণ সম্ভবত মহাবিশ্বের সকল গ্রহের মধ্যে যথেষ্ট সংখ্যক গ্রহ পাওয়া যাবে যাদের কেন্দ্রবিমূখীতা এরকম ছোটো। কিন্তু যদি দেখা যেত পৃথিবীর কক্ষপথ পুরোপুরী বৃত্তাকার, অর্থাৎ যদি দেখা যেতো এর কেন্দ্রবিমূখীতা, ধরা যাক, ০.০০০০০০০০০০১ তাহলে সত্যিই সেটা হতো একেবারে বিশেষ কোনো ব্যাপার। এবং তখন আমরা প্রশ্ন করতাম, কেন এই অদ্ভুত একটা গ্রহে আমরা বাস করছি। এ ধারণাকে অনেক সময় বলা হয় মধ্যমতার নীতি।

দৈবক্রমে গ্রহের কক্ষপথের আকার, সূর্যের ভর, এবং অন্যান্য চলকসমূহের যে মিলন আমরা দেখি সেটাকে পরিবেশোদ্ভুত আখ্যা দেওয়া হয়। কারণ, এটার উদ্ভব হয়েছে আমাদের পারিপার্শের ঘটনাবলির দৈবসংযোগে, প্রকৃতির মৌলিক নিয়মসমূহের কোনো বিচ্যুতি থেকে নয়। আমাদের পরিমাপকৃত মহাবিশ্বের বয়সও এমন একটা পরিবেশোদ্ভুত চলক। কেন না, আমরা যে অবস্থান থেকে এ বয়স মাপি তার আগেও মহাবিশ্ব ছিলো, পরেও থাকবে কিন্তু আমরা বাস করব এই বর্তমান যুগে, কারণ মহাবিশ্বের ইতিহাসে এটাই সেই সময় যেখানে জীবনের অস্তিত্ব সম্ভব হয়েছে। তাই পরিবেশোদ্ভুত দৈবসংযোগ বোঝা সহজ, কারণ আমাদের এই বাসস্থান মহাবিশ্বের এমন আরো অনেক স্থানের মধ্যে একটা। আর আমাদের অস্তিত্ব তো অবশ্যই তেমন একটা স্থানে থাকবে যেখানে জীবন সম্ভব।

দুর্বল নৃকেন্দ্রীকতার নীতি নিয়ে তেমন কোনো তর্কবিতর্কের সূচনা হয়নি। কিন্তু এখন আমরা এই নীতির আরো দৃঢ় একটা রূপ নিয়ে আলোচনা করবো, যেটা এমনকি অনেক পদার্থিবিজ্ঞানীরও বেশ অপছন্দ। দৃঢ় নৃকেন্দ্রীকতার নীতি অনুযায়ী আমাদের অস্তিত্ব শুধুমাত্র আমাদের পরিবেশের অবস্থার উপরই সীমা আরোপ করে না, এমনকি প্রকৃতির মৌলিক নিয়ম সমূহের উপাদান এবং স্বরূপও নির্ধারণ করে। এ ধারণার উদ্ভব হয়েছে কারণ শুধুমাত্র আমাদের সৌরজগতের বৈশিষ্টাবলীই যে অদ্ভুতভাবে মানব জীবনের বিকাশের উপযোগী, তা নয় । বরং পুরো মহাবিশ্বের বৈশিষ্টাবলিই জীবন বিকাশের উপযোগী, যেটা ব্যাখ্যা করা বেশ কঠিন।

সেই হাইড্রোজেন, হিলিয়াম এবং অল্প কিছু লিথিয়াম নিয়ে গঠিত আদিমহাবিশ্ব কীভাবে বিবর্তিত হয়ে এমন একটা মহাবিশ্বে পরিণত হলো, যেখানে বুদ্ধিমান জীবন ধারণকারী অন্তত একটা বিশ্ব আছে, সেটা এক বিরাট ইতিহাস। যেমনটা আমরা আগেই বলেছি, প্রকৃতির বলসমূহকে হতে হয়েছে ঠিক তেমন যেমনটা হলে আদি মৌলগুলো থেকে ভারী মৌলসমূহ –বিশেষকরে কার্বন- উৎপন্ন হতে পারে এবং অন্তত কয়েক বিলিয়ন বছর সেই কার্বন স্থিতিশীল থাকে। আমরা যাদেরকে নক্ষত্র বলি এরাই আসলে এভাবে ভারী মৌল রান্না করার চুল্লি। তাই শুরুতে মৌলিক বলসমূহ এমন হতে হবে যেন এধরবনের নক্ষত্রপুঞ্জ গঠিত হওয়া সম্ভব হয়। এসব গ্যালাক্সি এবং নক্ষত্রের সূচনা হয়েছিলো আদি মহাবিশ্বের ঘনত্বের ইষৎ অসমসত্বতা থেকে। আদি মহাবিশ্ব প্রায় পুরোপুরি সুষম হওয়া স্বত্তেও ভাগ্যক্রমে তাতে ১০০,০০০ ভাগের একভাগ অনুপাতে ঘণত্বের বিচ্যুতি ছিলো। অবশ্য শুধু এসব তারকাদের অস্তিত্ব এবং তাদের মধ্যে আমাদের গঠনকারী উপাদানের অস্তিত্বই যথেষ্ট নয়। এসব নক্ষত্রের অন্তর্বর্তী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকেও এমন হতে হয়েছে যেন তাদের কেউ কেউ শেষমেষ বিস্ফোরিত হয়, এবং এমন ভাবে বিস্ফোরিত হয় যেন সেটা তাদের মধ্যকার ভারী মৌলসমূহকে শূন্যে ছড়িয়ে দিতে পারে। এছাড়াও প্রকৃতির নিয়ম সমূহকে এমন হতে হয়েছে যেন বিস্ফোরণের সে সব উচ্ছিষ্টাংশ আবার জমাট বেঁধে নতুন প্রজন্মের নক্ষত্র গঠন করে, আর সে সব ভারী মৌল মিলে তাদের ঘিরে গ্রহসমূহ সৃষ্টি হয়। আমাদের বিকাশের জন্যে যেমন আদি পৃথিবীতে ধারাবাহিক কিছু ঘটনা ঘটতে হয়েছে, তেমনই আমাদের অস্তিত্বের জন্যও আন্তনাক্ষত্রিক এসব ব্যাপারগুলো ঘটতে হয়েছে ধারাবাহিক ভাবেই। যে সকল ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে মহাবিশ্ব বিবর্তিত হয়েছে সেগুলো যেমন প্রকৃতির মৌলিক নিয়মসমূহের একটা সাম্যাবস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তেমনই এসব নিয়মসমূহের মিথস্ক্রিয়াই আমাদের অস্তিত্বকেও সম্ভব করে তুলেছে।

এই পুরো ব্যাপারটাই যে যথেষ্ট দৈবসংযোগের ফল সেটা ১৯৫০ সালে প্রথম অনুধাবন করেন ফ্রেড হয়েল। হয়েল বিশ্বাস করতেন সকল রাসায়নিক মৌল আসলে গঠিত হয়েছে হাইড্রোজেন থেকে, যেটাকে তিনি সত্যিকার প্রাথমিক উপাদান মনে করতেন। হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াস হচ্ছে সবচেয়ে সরলতম কারণ, এটি শুধু একটি প্রোটন অথবা তার সাথে কখনো একটি বা দুটি সঙ্গী নিউট্রন নিয়ে গঠিত। (হাইড্রোজেনে বা অন্য কোনো নিউক্লিয়াসের বিভিন্ন রূপ, যেখানে প্রোটন সংখ্যা একই থাকলেও নিউট্রন সংখ্যা ভিন্ন ভিন্ন হয় তাদেরকে বলে আইসোটোপ)। এখন আমরা জানি, দুটি বা তিনটি প্রোটন নিয়ে গঠিত হিলিয়াম, ও লিথিয়াম নিউক্লিয়াসও খুব অল্প পরিমাণে শুরু থেকেই সৃষ্টি হয়েছিলো, যখন মহাবিশ্বের বয়স ছিলো ২০০ সেকেন্ডের মত। অবশ্য জীবনের বিকাশ আরো জটিল সব মৌলের উপর নির্ভরশীল। এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কার্বন, যেটা সকল জৈব রসায়নের ভিত্তি।

যদিও কেউ চাইলে বুদ্ধিমান কম্পিউটারের মত “জীবন্ত” কোনো জীব কল্পনা করতে নিতে পারে যেগুলো অন্যান্য মৌল, যেমন সিলিকন, দ্বারা গঠিত। কিন্তু কার্বন ছাড়া স্বতস্ফুর্ত ভাবে জীবনের বিবর্তন সম্ভব হতো কী না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণটা কার্বন কিভাবে অন্য মৌল সমূহের সাথে রাসায়নিক সংযোগ গঠন করে তার কারিগরি খুটিনাটির সাথে জড়িত। যেমন কার্বনডাই অক্সাইড স্বাভাবিক তাপমাত্রায় গ্যাসীয়, এবং জীববৈজ্ঞানিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ওদিকে সিলিকন যেহেতু পর্যায় সারণিতে কার্বনের ঠিক নিচেই অবস্থিত, এদের রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য অনেকটা কাছাকাছি। কিন্তু সিলিকন ডাইঅক্সাইড, বা কোয়ার্টজ, ফুসফুসের চেয়ে পাথরের মধ্যেই বেশি কাজের। তবুও এমন জীবন হয়তো বিকশিত হতে পারতো যেখানে প্রাণীরা পেট ভরে সিলিকন খায়, আর তরল আমোনিয়ার পুকুরে ডুবে লেজ নাড়ায়। কিন্তু শুধু লিথিয়াম, হাইড্রোজেনের ও হিলিয়ামের মত প্রাথমিক মৌল দিয়ে এমন কোনো উদ্ভট জীবনও বিকশিত হতে পারতো না। কারণ সেসব মৌল যে দুটি মাত্র স্থিতিশীল অণু সৃষ্টি করতে পারে তারা হলো, লিথিয়াম হাইড্রাইট, যেটা কঠিন বর্ণহীন কেলাস, এবং হাইড্রোজেন গ্যাস। এসব যৌগের কোনোটারই বংশ বিস্তার করা, বা অন্তত একে অপরের প্রেমে পড়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। আর এত কথার পরেও এটা তো সত্যি যে আমরা হচ্ছি কার্বন ভিত্তিক জীব। তাই কীভাবে ছয় প্রোটন বিশিষ্ট কার্বন নিউক্লিয়াস এবং আমাদের শরীরের অন্যান্য ভারী মৌলসমূহ গঠিত হলো সে প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই এসে যায়।

প্রথম ধাপটা ঘটে আদি নক্ষত্রের মধ্যে হিলিয়াম জমা হওয়ার মধ্যে দিয়ে। এই হিলিয়াম তৈরি হয় দুইটি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস সংঘর্ষের মাধ্যমে মিলিত হয়ে হিলিয়াম নিউক্লিয়াস গঠন করার ফলে। যে শক্তি আমাদের গরম রাখে, তা সৃষ্টি হয় এই ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমেই। এভাবে দুইটা হিলিয়াম পরমাণু মিলিত হয়ে গঠন করে বেরিলিয়াম, যার নিউক্লিয়াসে প্রোটন আছে চারটি। বেরিলিয়াম গঠন হয়ে যাওয়ার পরে তাত্ত্বিক ভাবে আরেকটা হিলিয়ামের সাথে মিলে সেটা কার্বন গঠন করতে পারতো। কিন্তু তা ঘটে না, বিক্রিয়ায় বেরিলিয়ামের যে আইসোটোপটি গঠিত হয় সেটি প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই ভেঙ্গে আবার হিলিয়াম নিউক্লিয়াস গঠন করে ফেলে।

অবশ্য এই ঘটনা বদলে যেতে থাকে যখন কোনো নক্ষত্রের জ্বালানী হাইড্রোজেন প্রায় শেষ হয়ে যায়। তখন নক্ষত্রের সারভাগ সংকুচিত হতে থাকে, এর তাপমাত্রাও বাড়তে বাড়তে ১০০ মিলিয়ন কেলভিনএ উঠে যায়। এই অবস্থায় নিউক্লিয়াসগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ বেড়ে যায় বহুগুণে, ফলে কিছু বেরিলিয়াম নিউক্লিয়াস ক্ষয় হয়ে যাবার আগেই অন্য হিলিয়াম নিউক্লিয়াসের সঙ্গে ধাক্কা খায়। আর তখনই বেরিলিয়াম হিলিয়ামের সাথে মিশে কার্বনের একটা স্থিতিশীল আইসোটোপ গঠন করে। অবশ্য রাসায়নিক যৌগসমূহের যেসব সন্নিবেশ তাদের জীবদ্দশায় মজা করে এক গ্লাস বোরডক্স (ওয়াইন) পান করবে, বা জলন্ত বোলিং পিন জাগল করবে, বা প্রশ্ন করবে মহাবিশ্ব সম্পর্কে, তাদের সৃষ্টি করতে এই কার্বনকে যেতে হবে আরো বহুদূর। মানুষের মত স্বত্তার অস্তিত্বের জন্য নক্ষত্রের কেন্দ্রে উৎপন্ন এসব কার্বনকে আগে আরেকটু বন্ধুবাৎসল কোনো পরিবেশে পৌছাতে হবে। এবং এটা ঘটে যখন নক্ষত্ররা তাদের জীবনচক্র শেষ করে সুপারনোভা আকারে বিস্ফোরিত হয়, ফলে কার্বন ও অন্যান্য ভারী মৌলসমূহ নক্ষত্রকেন্দ্র থেকে ছিটকে বেরিয়ে এবং পরে জমাট বেধে গ্রহ সৃষ্টি করে।

(missing image)

কার্বন প্রস্তুতির এই প্রকৃয়াকে বলা হয় ত্রি-আলফা প্রকৃয়া। কারণ অংশগ্রহণকারী হিলিয়াম আইসোটপের নিউক্লিয়াসের আরেক নাম আলফা কণিকা। আর এখানে এই নিউক্লীয় বিক্রিয়ায় শেষমেষ এধরণের তিনটি আলফা কণিকা মিলে কার্বন নিউক্লিয়াস তৈরি হচ্ছে। সাধারণ পদার্থ বিজ্ঞানের হিসাব মতে এই ত্রি-আলফা-প্রকৃয়ায় কার্বন তৈরি হবার হার খুবই কম হওয়ার কথা। ১৯৫২ সালে এ ব্যাপারটা খেয়াল করে হয়েল অনুমান করেন- যে, একটি হিলিয়াম নিউক্লিয়াস এবং একটি বেরিলিয়াম নিউক্লিয়াসের শক্তির যোগফল, নিশ্চই বিক্রিয়ায় কার্বনের যে আইসোটোপটি সৃষ্টি হচ্ছে তার কোনো একটা কোয়ান্টাম অবস্থার শক্তির সমান হবে, যাকে বলে অণুরণন শর্ত। এ শর্ত পূরণ হলে কার্বন উৎপাদনের হার বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। সে সময় এ ধরনের কোনো কোয়ান্টাম অবস্থার কথা জানা ছিলো না। কিন্তু হয়েলের পরামর্শের উপর ভিত্তি করে, ক্যালটেকের উইলিয়াম ফাউলার এ ধরণের একটা কোয়ান্টাম অবস্থা খুঁজে বের করেন যেটা ভারী মৌলসমূহের উৎপাদন বিষয়ে হয়েলের অভিমতকে পোক্ত করে।

হয়েল লিখেছিলেন, “আমি বিশ্বাস করি না, যে এসব তথ্য-প্রমাণ দেখেও কোনো বিজ্ঞানী এ উপসংহার টানতে ব্যর্থ হবেন, যে নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যার নিয়মসমূহ, নক্ষত্রের মধ্যে ঘটিত এসব ঘটনার কথা মাথায় রেখেই ইচ্ছা করে বানানো।” প্রকৃতির এইসব ভৌতনিয়মাবলী যে কী পরিমান দৈবসংযোগের ফল সেটা বোঝার মত নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যা সে সময় কারোই জানা ছিলো না। আজকাল দৃঢ় নৃকেন্দ্রীকতার নীতিকে আরেকটু খতিয়ে দেখার জন্য পদার্থবিজ্ঞানীরা প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন, কী হত যদি প্রকৃতির নিয়মগুলো ভিন্নতর হতো? এযুগে আমরা কম্পিউটার মডেল বানাতে পারি যার সাহায্যে জানা যায়, ত্রি-আলফা-প্রকৃয়ার হার প্রকৃতির মৌলিক বলসমূহের উপর কতটা নির্ভরশীল। এ ধরণের হিসাব থেকে দেখা যায় যদি শক্তিশালী নিউক্লিয় বলের মান ০.৫ শতাংশ বা তড়িৎ বলের মান ৪ শতাংশ এদিক ওদিক হতো তাহলে সকল নক্ষত্রের প্রায় সব কার্বন এবং অক্সিজেন পরমাণুই ধ্বংস হয়ে যেত। সেই সঙ্গে ধ্বংস হতো আমাদের পরিচত জীবন বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনাও। আমাদের মহাবিশ্বের নিয়ম সমূহকে যেই না একটু পাল্টানো হবে, অমনি হারিয়ে যাবে আমাদের অস্তিত্বের প্রয়োজনীয় সকল শর্তই!

মহাবিশ্বের যেসব গাণিতিক রূপায়ণ আমরা তৈরি করি সেগুলোর উপর পরীক্ষা চালিয়ে, পদার্থ বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলোকে বিভিন্ন উপায়ে পাল্টালে কী ঘটবে সেটা নির্ণয়ে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। এভাবে দেখা যায় শুধু যে শক্তিশালী নিউক্লিয় বল আর তড়িৎচৌম্বক বলের মানই আমাদের অস্তিত্বকে সম্ভব করতে সূক্ষ্মসন্নিবেশ করা হয়েছে তা-ই নয়, বেশিরভাগ মৌলিক ধ্রুবকও এমন ভাবে সূক্ষ্মসন্নিবিষ্ট যে তাদেরকে যদি একটুখানি বদলানো হয় তাহলেও মহাবিশ্বের গুণগত পরিবর্তন ঘটে যাবে। এবং অনেকসময় এটা জীবনের বিকাশের অযোগ্য হয়ে পড়বে। যেমন, যদি অন্য নিউক্লিয় বল, যেমন দুর্বল বল আরো বেশি দুর্বল হত তাহলে মহাবিশ্বের সব হাইড্রোজেন হিলিয়ামে পরিণত হতো; ফলে কোনো স্বাভাবিক তারাই থাকতো না। এটা যদি আরো শক্তিশালী হতো তাহলে সুপারনোভার বিস্ফোরণ তার বাইরের আবরণকে ছিন্ন করে ছুড়ে দিতে পারতো না, ফলে জীবনের বিকাশে প্রয়োজনীয় ভারী মৌল সমৃদ্ধ গ্রহ তৈরি হতো না। প্রোটন যদি আরো ০.২ শতাংশ ভারী হত তাহলে সেগুলো সব ক্ষয় হয়ে নিউট্রনে পরিণত হতো। এবং পরমাণুসমূহ অস্থিতিশীল হয়ে পড়ত। যদি প্রোটনের গঠনকারী কোয়ার্কদের সম্মিলিত ভর ১০ শতাংশও পরিবর্তিত হতো তাহলেও আমরা অনেক কম সংখ্যক স্থিতিশীল পরমাণু দেখতাম; এমনকি দেখে মনে হয়, কোয়ার্কদের ভরের যোগফল এমন ভাবে মেলানো যেন সবচেয়ে বেশি সংখ্যক স্থিতিশীল নিউক্লিয়াস গঠিত হতে পারে।

কেউ যদি ধরে নেয়, যে কোনো গ্রহে জীবনের বিকাশ হতে কয়েকশ মিলিয়ন বছরের স্থিতিশীল কক্ষপথ প্রয়োজন, তাহলে দেখা যাবে স্থানিকমাত্রার সংখ্যাও আমদের অস্তিত্ব দ্বারা নির্ধারিত। কারণ মহাকর্ষের সূত্র মতে শুধু মাত্র ত্রিমাত্রিক জগতেই স্থিতিশীল উপবৃত্তাকার কক্ষপথ সম্ভব। অন্যান্য সংখ্যক মাত্রার ক্ষেত্রে বৃত্তাকার কক্ষপথ অবশ্য সম্ভব, কিন্তু নিউটন যেমনটা আশঙ্কা করেছিলেন, সে সব কক্ষপথ স্থিতিশীল হবে না। যদি তিন ছাড়া অন্য সংখ্যক স্থানিকমাত্রা থাকতো, তাহলে একটুখানি বিচ্যুতি, আশেপাশের গ্রহের মৃদু আকর্ষণে যেটা হতে পারে, আমাদের গ্রহকে তার বৃত্তাকার কক্ষপথ থেকে বের করে, হয় পেঁচানো পথে সূর্যের বুকে, অথবা সৌরজগতের বাইরে পাঠিয়ে দিতো। ফলে হয় আমরা পুড়ে ছাই হতাম, নইলে জমে বরফ। এছাড়াও তিনের অধিক মাত্রা থাকলে, মহাকর্ষীয় বলও দূরত্বের সাথে সাথে এখনকার চেয়ে আরো দ্রূত হ্রাস পেত। তিন মাত্রার জগতে, মহাকর্ষীয় বল ১/৪ গুণে হ্রাসপায় যখন দূরত্ব বেড়ে হয় দ্বিগুণ। চার মাত্রার ক্ষেত্রে এটি হ্রাস পেতো ১/৮ গুণ, পাঁচমাত্রার ক্ষেত্রে ১/১৬ গুণ… ইত্যাদি। তাই মাত্রা তিনের অধিক হলে, সূর্যের অন্তর্বর্তী চাপ, তার মহাকর্ষীয় টানকে কাটাকাটি করতে পারতো না। এটা হয় ফেটে পড়তো, না হয় সংকুচিত হয়ে একটা কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হতো। যার দুটোই আমাদের জন্য দুঃসংবাদ। এবং এক্ষেত্রে পারমাণবিক স্কেলে, তড়িৎবলও মহাকর্ষের মতই আচরণ করতো। অর্থাৎ, ইলেক্ট্রনগুলো হয় পরমাণু থেকে বেরিয়ে যেত বা পেচানো পথে গিয়ে পড়তো নিউক্লিয়াসের উপর। যার কোনো কোনোটা ঘটলেই আমাদের পরিচিত পরমাণুগুলোর আর অস্তিত্ব থাকতো না।

এইসব জটিল সংগঠন যেগুলো বুদ্ধিমান পর্যবেক্ষকের উদ্ভব ঘটিয়েছে, তাদের বিকাশ খুবই ভঙ্গুর পরিস্থতিতিতে হয়েছে বলে মনে হয়। আর প্রকৃতির নিয়মগুলো দেখে মনে হয় এগুলো খুব যত্ন করে এমন ভাবে সূক্ষ্মসন্নিবেশ করা, যেন জীবন বিকাশের সম্ভাবনা বিনাশ না করে এর খুব কমই পাল্টানো সম্ভব হয়। ভৌত নিয়মসমূহের খুটিনাটিতে এইসব ধারাবাহিক এবং চমকপ্রদ সব দৈব মিল না থাকলে, মানুষ বা এধরণের জীবের অস্থিত্বই সম্ভব হতো না।

সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক দৈবসংযোগ পাওয়া যায় আইনস্টাইনের মহাজাগতিক ধ্রুবক সংক্রান্ত একটা ব্যাপারে। যেমনটা আমরা আগেও বলেছি, ১৯১৫ সালে যখন তিনি এই তত্ত্ব দাঁড় করান, আইনস্টাইনের বিশ্বাস ছিলো মহাবিশ্ব স্থিতিশীল, অর্থাৎ এটা প্রসারিতও হচ্ছে না, সংকুচিতও হচ্ছে না। যেহেতু সকল পদার্থ একে অপরকে আকর্ষণ করে, সেহেতু তিনি তার তত্ত্বে একটি প্রতি-মহাকর্ষীয় বল আমদানি করলেন, যেটা মহাবিশ্বকে নিজের উপর নিজে সংকুচিত হয়ে পড়া থেকে রক্ষা করে। অন্যান্য বলের সাথে এই বলের পার্থক্য ছিলো যে, অন্যদের মত এটা কোনো উৎস থেকে না এসে বরং একেবারে স্থান-কালের গঠনের মধ্যেই স্থাপিত ছিলো। মহাজাগতিক ধ্রুবক এই বলের তীব্রতা নির্দেশ করতো।

যখন প্রমাণিত হলো যে মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে, তখন আইনস্টাইন তার তত্ত্ব থেকে এই ধ্রুবককে অপসারিত করেন। এবং এটা স্বীকার করেন যে এই ধ্রুবক ধরে নেওয়াটা তার জীবনের সবচেয়ে বড় বোকামি। কিন্তু ১৯৯৮ সালে পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা গেল, মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে ক্রমবর্ধমান হারে, যেটা কোনো বিশেষ ধরণের বিকর্ষণ বল পুরো জগৎ জুড়ে কাজ না করলে ঘটার কথা না। ফলে মহাজাগতিক ধ্রুবককে পুনরুত্থিত করা হলো। এখন যেহেতু আমরা জানি এই ধ্রুবকের মান শূন্য নয়, তাই প্রশ্ন থেকেই যায় কেন এই ধ্রুবকের মান তত, যতটা আমরা দেখি? পদার্থবিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল ঘটনাবলী থেকে এ ধ্রুবকের মান হিসাব করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু যে মান তারা হিসাব করে পেয়েছেন তা সুপারনোভা পর্যবেক্ষণ করে পাওয়া প্রকৃত মানের চেয়ে ১২০ সুচক গুণে বেশী (অর্থাৎ, ১ এর পিঠে ১২০ টা শূন্য গুণ বেশি)। এর অর্থ হয় হিসাবে কোনো গড়মিল আছে, অথবা এমন কোনো ঘটনা এখনো অগোচরে রয়ে গেছে যেটা অলৌকিক ভাবে এই বলের একটা অতিক্ষুদ্রাংশ বাদে প্রায় সবটুকুই বিনাশ করে ফেলে। তবে একটা জিনিস নিশ্চিত যে মহাজাগতিক ধ্রুবকের মান তার বর্তমান মানের চেয়ে অনেক বেশি হলে কোনো ধরণের গ্যালাক্সি গঠিত হবার আগেই মহাবিশ্ব নিজেই ফেটে চৌচির হয়ে যেতো – ফলে আবারো- আমাদের জানা এই জীবনের অস্তিত্ব হয়ে পড়তো অসম্ভব।

তাহলে এসব কাকতাল থেকে আমরা কী বুঝবো? ভাগ্যক্রমে মৌলিক নিয়মসমূহের খুটিনাটির যে মিলন সেটা পরিবেশোদ্ভুত চলকসমূহের ভাগ্যক্রমে মিলে যাওয়া থেকে আলাদা। একে তো এটাকে এত সহজে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়, তার উপর এতে গভীর ভৌত ও দার্শনিক ইঙ্গিত নিহিত রয়েছে। আমাদের মহাবিশ্ব এবং তার আইনসমূহ দেখে মনে হয় যেন একেবারে নকশা অনুযায়ী দর্জির হাতে কেটে এমন ভাবে বানানো, যেমনটা হলে এখানে জীবনের অস্তিত্ব সম্ভব হবে, এবং যেখানে এই নকশা থেকে বিচ্যুতির প্রায় কোনো অবকাশই নেই। ব্যাপারটার ব্যাখ্যা সহজ নয়, ফলে স্বাভাবিক ভাবেই এ সম্পর্কে একটা প্রশ্ন আসে: এটা এমন কেন?

এইসব কাকতালকে যদি আমরা ঈশ্বরের কীর্তি বলি তাহলে অনেকেই খুশি হবেন। মহাবিশ্বকে মানবজাতির জন্যই বানানো হয়েছে এই ধারণা বিভিন্ন ধর্মীয় পূরাণে ও উপকথায় হাজার বছর ধরেই আছে। মায়াদের ঐতিহাসিক উপকথা পোপোল ভুহতে বর্ণীত আছে ঈশ্বর দাবি করছেন, “মানুষের অস্তিত্ব ও সংজ্ঞার জন্য প্রয়োজনীয় যা কিছু আমরা সৃষ্টি করেছি তা থেকে আমরা কোনো গৌরব বা সম্মান পাবো না”। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালের একটা প্রাচীন মিসরীয় লেখনীতে পাওয়া যায়, “মানুষ, যারা ঈশ্বরের গবাদিপশু, তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই দেওয়া হয়েছে। এবং তিনি [ঈশ্বরের পূত্র] তাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন আকাশ এবং পৃথিবী”। চৈনিক টাও দার্শনিক লিয়েহ উ-কউ (খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক ৪০০) তার এক কাহিনির চরিত্রের মাধ্যমে এমন ধারণা প্রকাশ করেছেন যেখানে চরিত্রটি বলছে, “ঈশ্বর আমাদের উৎপাদনের জন্য পাঁচ প্রকারের শস্য তৈরি করেছেন, এবং পাখা ও পালকযুক্ত প্রজাতিও সৃষ্টি করেছেন আমাদেরই স্বার্থে”। পশ্চিমা সংস্কৃতিতে, অর্থাৎ আদি বাইবেলে বর্ণীত সৃষ্টির কাহিনিতেও ঐশ্বরিক পরিকল্পনার ছাপ পাওয়া যায়। অবশ্য প্রচলিত খ্রিস্টান ধ্যান-ধারণা মূলত অ্যারিস্টটলীয় ধারণা দ্বারা প্রভাবিত, তিনি এমন একটি, “বুদ্ধিমান প্রাকৃতিক জগতে” বিশ্বাস করতেন যেটা “সুনির্ধারিত পরিকল্পনা অবলম্বনে পরিচালিত হয়”। মধ্যযুগীয় খ্রিস্টান ধর্মতাত্ত্বিক থমাস অ্যাকুইনাস ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণে প্রকৃতির সুসজ্জা বিষয়ক অ্যারিস্টটলীয় যুক্তি প্রয়োগ করেছিলেন। অষ্টাদশ শতকে আরেকজন খ্রিস্টান ধর্মতাত্ত্বিক তো এমন দাবিও করেন যে, খরগোশের লেজ সাদা হয়েছে যেন তাদেরকে গুলি করতে আমাদের সুবিধা হয়। ভিয়েনার যাজক কার্ডিনাল ক্রিস্টফ স্কনবর্ন কয়েকবছর আগেই এ বিষয়ে আধুনিক খ্রিস্টীয় ধ্যান-ধারণার একটা চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, “এখন, এই একবিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে, আধুনিক বিজ্ঞানের অভাবনীয় সব আবিষ্কারের ফলে প্রকৃতিতে বিরাজমান উদ্দেশ্য ও নকশার ছাপ প্রকাশ হয়ে পড়েছে, যেগুলো ঢাকার জন্য সৃষ্ট নব্য-ডারউইবাদ এবং মাল্টিভার্সের [বহু মহাবিশ্ব] মতো প্রস্তাবনাগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে, ক্যাথলিক চার্চ আবারও ঘোষণা করছে প্রকৃতিতে বিরাজমান প্রকাশ্য পরিকল্পনাই বাস্তব”। জনাব কার্ডিনাল জ্যোতির্বিদ্যা থেকে প্রাপ্ত উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনার যে অভাবনীয় প্রমাণের কথা বলেছেন, সেটা হচ্ছে একটু আগে আমাদের বর্ণীত ভৌত নিয়মসমূহের সেই সূক্ষ্মসমন্বয়।

ইতিহাসের যে ক্রান্তিলগ্নে মানবকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের ধারণার পরিত্যাগ করা হয়েছিলো, সেটা হচ্ছে কোপার্নিকাসের সৌরমডেল আবিষ্কার, যার আগে পৃথিবীকে আর সব কিছুর কেন্দ্র হিসাবে ধরা হতো। মজার ব্যাপার হলো, কোপার্নিকাসের নিজের ধ্যান-ধারণা ছিলো এতটাই মানবকেন্দ্রীক যে তিনি বলেছিলেন, যদিও সৌরজগৎ সূর্যকেন্দ্রীক কিন্তু পৃথিবীকে মহাবিশ্বের প্রায় কেন্দ্র হিসাবে ধরা যায়। তার কথা উদ্ধৃত করলে: “ যদিও [পৃথিবী] জগতের কেন্দ্রে অবস্থিত নয়, তারপরও স্থির তারকারাজির দূরত্বের তুলনায় [কেন্দ্র থেকে] তার দূরত্ব কিছুই না।” টেলিস্কোপের আবিষ্কারের সাথে সাথে অন্যান্য গ্রহেরও যখন উপগ্রহ আবিষ্কার হতে লাগলো, তখন মহাবিশ্বে যে আমাদের বিশেষ কোনো অবস্থান নেই, সে ধারণা আরো জোরদার হয়। পরবর্তী শতাব্দীসমূহে যখন মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমরা আরো জানতে লাগলাম তখন এটাই প্রতিয়মান হলো যে আমাদের গ্রহটা আসলে অনেকগুলোরর মধ্যে স্রেফ আরেক প্রকারের একটা গ্রহ। কিন্তু ভৌত বিধিসমূহের এই সূক্ষ্মসমন্বয় যেটা অপেক্ষাকৃত নতুন আবিষ্কার, সেটা আমাদের অনেককেই আবার সেই পুরাতন ধারণার কাছেই ফিরিয়ে নিয়েছে। যা হলো, “এই মহান নকশা নিশ্চই কোনো মহান নকশাকারের কাজ।” যুক্তরাষ্ট্রে, যেখানে পাঠ্যসূচীতে ধর্মশিক্ষা নিষিদ্ধ, তাই এখন নতুন এক ধারণা আমদানি করা হয়েছে যার নাম বুদ্ধিদীপ্ত নকশা, যেখানে উহ্য থাকলেও এটাই বোঝানো হয় যে এই নকশাকার হচ্ছেন ঈশ্বর।

আধুনিক বিজ্ঞানের উত্তর তা নয়। আমরা পঞ্চম অধ্যায়ে দেখেছি আমাদের মহাবিশ্ব বিভিন্ন রকম প্রাকৃতিক নিয়ম নিয়ে গঠিত বহুসংখ্যক মহাবিশ্বের মাঝে একটা। এই বহুমহাবিশ্বের ধারণা ভৌতবিধিসমূহের অলৌকিক সূক্ষ্মসমন্বয়কে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য গঠিত হয়নি। এটা সীমাহীনতার শর্ত সহ আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যার আরো অনেক তত্ত্ব থেকে পাওয়া একটা ফলাফল। এটা সত্যি হলে, দৃঢ় নৃকেন্দ্রীকতার নীতিকে দুর্বল নৃকেন্দ্রীকতার নীতির সমতুল হিসাবে ভাবা যাবে। যেখানে পরিবেশোদ্ভুত চলক সমূহের সূক্ষ্মসমন্বয়ের মতো, ভৌতবিধিসমূহের সূক্ষ্মসমন্বয়ও একই ভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। কারণ তখন আমাদের জীবনসহায়ক সৌরজগৎ, যেমন এ ধরণের অনেকগুলোর মধ্যে একটি; তেমনি আমাদের পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বও, যেটাতে আমাদের অবস্থান, তেমন অনেক মহাবিশ্বের ভীড়ে একটি হিসাবে প্রতিয়মান হবে। অর্থাৎ, ঠিক যেভাবে আমাদের সৌরজগৎ এর বিভিন্ন ঘটনার কাকতলীয় মিলন, এমন বিলিয়ন সৌরজগৎএর অস্তিত্ব মেনে নিলে একেবারে সাদামাটা একটা ব্যাপারে পরিণত হয়, তেমনই ভাবে বহু-মহাবিশ্বের অস্তিত্বের সাহায্যে ভৌতবিধিসমূহের সূক্ষ্মসমন্বয়ও সহজেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়। যুগে যুগে অনেক মানুষই প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং জটিলতাকে ঈশ্বরের অবদান হিসাবে মেনে নিয়েছেন, কারণ তাদের সময়ে মনে করা হতো এসবের বুঝি কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। কিন্তু ঠিক যেভাবে ডারউইন এবং ওয়ালেস কোনো সর্বময় স্বত্তার অস্তিত্ব ছাড়াই সকল প্রাণীর এই অনেকটা অলৌকিক নকশা কিভাবে সৃষ্টি হতে পারে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তেমনি বহুমহাবিশ্বের ধারণাও ভৌতবিধিসমূহের সূক্ষ্মসমন্বয়কে কোনো দয়াময় সৃষ্টিকর্তার- যিনি আমাদের স্বার্থে সব কিছু ঠিকঠাক সৃষ্টি করেছেন- প্রয়োজন ছাড়াই ব্যাখ্যা করতে পারে।

আইনস্টাইন একবার তার সহকারী আর্নেস্ট স্ট্রাউস কে প্রশ্ন করেছিলেন, “ঈশ্বরের কি এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি না করে কোনো উপায় ছিলো?” ষোড়শ শতকের শেষদিকে কেপলার নিশ্চিত ছিলেন যে ঈশ্বর মহাবিশ্বকে কিছু নিখুঁত গাণিতিক নিয়মে বেঁধে বানিয়েছেন। নিউটন দেখিয়েছেন যেসব সূত্র মহাকাশের বস্তুসমূহের উপর খাটে সেগুলো, পৃথিবীর বস্তুসমুয়ের উপরও কাজ করে। তিনি যে সকল গাণিতিক সমীকরণের সাহায্যে এসব সূত্র লিপিবদ্ধ করেন সেগুলো এতটাই নান্দনিক ছিলো যে সমসাময়ীক বিজ্ঞানীদের মধ্যে রীতিতমত একটা ধর্মীয় জেল্লা চলে এসেছিলো এটা প্রমাণ করতে, যে ঈশ্বর নিজে আসলে একজন গণিতবিদ।

নিউটনের পরে, বিশেষকরে আইনস্টাইনের সময় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানের লক্ষ্য ছিলো সবকিছুর সরল গাণিতিক নিয়ম বের করা। যেমনটা কেপলারও ভাবতেন, যে এই নিয়মগুলো সবকিছুর একটা সার্বিক তত্ত্ব দেবে এবং এদের সাহায্যে প্রকৃতিতে পর্যবেক্ষীত সকল পদার্থ ও বলের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ব্যাখ্যা করা যাবে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষে এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ম্যাক্সওয়েল এবং আইনস্টাইন চৌম্বকত্ব, তড়িৎ ও আলোর একটি সম্মিলিত তত্ত্ব গঠন কতে সক্ষম হন। ১৯৭০ সালে স্টান্ডার্ড মডেল গঠিত হয় যেটা দুর্বল ও শক্তিশালী নিউক্লিয় বল এবং তড়িৎচৌম্বক বলের একটা সম্মিলিত তত্ত্ব। এরপরে মহাকর্ষকে এই চিত্রে আনতে আসে স্ট্রিং তত্ত্ব এবং এম-তত্ত্ব। লক্ষ্য ছিলো, শুধু সকল বল ব্যাখ্যাকারী একটা একক তত্ত্ব খুঁজে বের করাই নয়, বরং যেসব মৌলিক ধ্রুবকের কথা আমরা এতক্ষণ বলেছি, অর্থাৎ বিভিন্ন বলসমূহের তীব্রতা এবং মৌলিক কণিকাদের ভর ও আধান, এদের পর্যবেক্ষীত মান এমন কেন, সেটাও ব্যাখ্যা করা। আইনস্টাইন যেমনটা বলেছেন, আশা ছিলো এটা বলতে সক্ষম হওয়া যে, “প্রকৃতি এমনভাগে ঘঠিত যেখানে যুক্তিপ্রয়োগে এমন শক্তিশালী কিছু নিয়ম বের করা সম্ভব যেসব নিয়মের ধ্রুবক সমূহ শুধুমাত্র যুক্তির ভিত্তিতেই পুরোপুরি নির্ধারিত হয় (অর্থাৎ এমন কোনো ধ্রুবকই থাকবে না, এই তত্ত্বকে ধ্বংস না করে যেটার মান পরিবর্তন করা সম্ভব)।” একটা একক তত্ত্বে, আমাদের অস্তিত্বের প্রয়োজনে যে ধরণের সূক্ষ্মসমন্বয় প্রয়জন, তা থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কিন্তু বর্তমান অগ্রগতির আলোকে আমরা যদি আইনস্টাইনের স্বপ্নকে এভাবে ব্যাখ্যা করি, যে এমন একটা অদ্বিতীয় তত্ত্ব থাকবে যেটা আমাদের এবং অন্য সকল মহাবিশ্বের সম্ভাব্য সকল ভৌতনিয়ম সমূহকে ব্যাখ্যা করে, তাহলে এম-তত্ত্বই হতে পারে সেই তত্ত্ব। কিন্তু এম-তত্ত্ব কি আসলেই অদ্বিতীয়, বা শুধুমাত্র কোনো সরল যৌক্তিক নীতি থেকেই উৎসরিত? কেন এম-তত্ত্ব?

‘দ্য গ্রান্ড ডিজাইন’ < পর্ব ৬ । পর্ব ৭। পর্ব ৮(শেষ)>

[অনুবাদকের নোট]

দ্বিমিক নক্ষত্রব্যবস্থা – Binary Star System
কেন্দ্রবিমুখীতা – eccentricity
দুর্বল নৃকেন্দ্রীকতার নীতি – Weak Anthropic Principle
সামান্যতার নীতি – Principle of Mediocrity
দৈব সংযোগ- Serendipity
দৃঢ় নৃকেন্দ্রীকতার নীতি – Strong Anthropic Principle
জীব – Organism
পর্যায় সারণি – Periodic Table
কেলাস – Crystal
জীবনচক্র – Life Cycle
ত্রি-আলফা-প্রক্রিয়া – Triple Alpha Process
কাকতাল – Coincidence
ভাগ্যক্রমে – Luckily
চেতনা – Sentience
মানবকেন্দ্রীক – Anthropomorphic
সূর্যকেন্দ্রীক – Heliocentric

কৃতজ্ঞতা: যত্ন করে অনেকগুলো বানান এবং বাক্যের ভুল সংশোধন করে দিয়েছেন সেজবা