বছরের প্রথম তুষারপাত হল গতকাল। তারপরই যেন হঠাত্ করে সব স্তব্ধ হয়ে গেল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি শব্দহীন পৃথিবী নগ্ন শিশুর মত থরথর করে কাঁপছে। বাতাস গতিহীন। গাছে গাছে বৈধব্যের বিষণ্ণতা। পাশের নদীতে জলের ওপর ঠায় দাঁড়িয়ে আছে থোকা থোকা বাষ্প। নিথর কুয়াশার মত। মাঘের আকাশে ঘোলাটে মেঘের মত। কিম্বা আধো আঁধারে আধো আলোতে ভেসে বেড়ানো পুরনো প্রেমিকার মত। মনটা কেমন ভার হয়ে যায়। স্তব্ধতার মৃদু কম্পন প্রাণের কেন্দ্রে প্রবেশ করে। আমি সেই নৈঃশব্দের বুকে কান পেতে তার স্পন্দন শোনার চেষ্টা করি। আশ্বাস পেতে চাই যে আবারো ফিরে আসবে কোলাহল। আবারো আসবে আমার বাগানের ড্যাফোডিল, শুনব হাইড্রেঞ্জিয়ার উত্ফুল্ল আনন্দধ্বনি। অভয় পেতে চাই যে এখনও অস্তিত্বের মৃত্যু হয়নি। আবারো জাগ্রত হবে জীবন।

প্রতিবেশীর বাড়িতে সামনে পেছনে গাছে গাছে ভরা। সেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি আসে এপ্রিলের শেষে বরফগলার সাথে সাথে। নানা জাতের নানা রঙের পাখি। তারা খড়কুটো দিয়ে ঘর বানায় ডালে ডালে, পাতার আড়ালে। একেকটি বাসাতে একেকটি পরিবার—-একটি পুরুষ পাখি, একটি মেয়েপাখি, গুটিকয় সন্তান। ঠিক মানুষেরই মত। তাদের খেলাতে লীলাতে কেলিতে সারা গ্রীষ্ম মুখর হয়ে থাকে পরিপার্শ্বের পথপ্রান্তর। তারপর হেমন্তের পাতারা যখন ঝরতে শুরু করে একে একে, আবরণ খসে পড়তে থাকে তাদের কুলায় থেকে, তখন তারা বুঝতে পারে এবার যাবার সময় হল। আবহাওয়া অফিসের খবর শোনার আগেই খবর পৌঁছে যায় তাদের কাছে যে উত্তরের মেরু থেকে বাতাস আসছে হু হু করে। তারা তাঁবু গুটিয়ে রওয়ানা হয় দক্ষিণের কোনও উষ্ণ দ্বীপের সন্ধানে। তাদের ডানা আছে তাই তারা যায়। যেতে পারে বলে যায়—যেতে হয় বলে যায়। পাখিরাই হল প্রকৃতির আদিম যাযাবর। সত্যিকার বেদুইন।

পাখির ডানা আমার পাখাহীনতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় তীক্ষ্ণভাবে। তাদের মত করে আমি যখনতখন যেখানে সেখানে চলে যেতে পারিনা। এই অপারগতা আমার পায়ের শেকল। পাখিদের প্রতি হিংসা হয় আমার। বিশেষ করে যখন দেখি ঝাঁকে খাঁকে পাখি সার বেঁধে, অবিশ্বাস্য শৃঙ্খলার সাথে, উড়ে বেড়াচ্ছে আকাশপথে। দেখি আর ভাবি এমন নিখুঁত জ্যামিতি তার শিখল কোথায়। শিখল কোথায় এতটা বৃন্দবন্ধন। যা আমরা কিছুতেই শিখে উঠতে পারিনা। ওদের সহজাত জ্ঞান বারবার হার মানিয়ে দেয় আমাদের শ্রমার্জিত জ্ঞানকে।

জানি ডানার দুটি রূপ—বাস্তব ও প্রতীক। বাস্তব পাখিদের, প্রতীকটি আমাদের। বাস্তব নিয়ে বড় হই আমরা, তারপর প্রতীকের সাধনায় জীবনকে করি উত্সর্গ—-অনেক সময় অজ্ঞাতেই। বস্তু আমাদের বন্ধন। প্রতীক আমাদের স্বাধীনতা। আমরা কি সত্যি সত্যি স্বাধীনতা চাই? মানে সত্যিকার মুক্তপক্ষ বল্গাহারা স্বাধীনতা? এমনকি জীবেরাও কি তা চায়? প্রশ্নটির উত্তর চট করে বলার নয়।

বাল্টিমোরে আমার এক ছোটভায়ের বাসা। ওর স্ত্রী তানিয়ার দুটি শখের পাখি। মখমলের মত নরম শরীরের দুটি আশ্চর্য সুন্দর ক্যানারি। স্বামীস্ত্রী দুজনই পূর্ণকালীন চাকরিজীবি—সকাল সাতটায় বেরোয়, ছটায় ফেরে। ক্যানারিদুটিকে বেজমেন্টে আপনমনে ছুটে বেড়াতে দেয় সারাবেলা। সন্ধ্যায় যখন বাড়ি ফেরে তারা, পাখিদুটি তখন তারস্বরে সোরগোল বাধিয়ে দেয়—-অর্থাত এত দেরি হল কেন তোমাদের ঘরে ফিরতে। জানোনা আমরা তেষ্টায় মরে যাচ্ছি? দানা দিয়ে গেছ, পানি দিতে মনে ছিল না বুঝি? তানিয়ার দৃঢ় বিশ্বাস এটাই তাদের অভিযোগ। তানিয়া কাপড় চোপড় ছেড়ে প্রথমেই তাদের তদারক করে, তারপর ঘরের কাজে হাত দেয়। পাখিতে-মানুষে দারুণ এক বন্ধন সৃষ্টি হয়ে গেছে।

উইকেণ্ডে হয় মজার দৃশ্য। একবার ওদের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে নিজের চোখেই দেখলাম। ক্যানারিদুটিকে বেজমেন্ট থেকে ওপরতলায় নিয়ে এল তানিয়া। তারপর খাঁচা খুলে ছেড়ে দিল ওদের। মানে একেবারেই ছেড়ে দেওয়া। ইচ্ছে করলে অনায়াসে চলে যেতে পারত জানালা দিয়ে। আমি গভীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকলাম ওদের দিকে—-দেখা যাক কি করে এবার। জেলের দরজা যদি খুলে দেওয়া হয় কোনও কারণে তাহলে কয়েদী তার সুযোগ নেবে না সেটা কিছুতেই সম্ভব নয়। সেটা হয়না। কিন্তু পোষা পাখি? যে কোনও অপরাধই করেনি কোনদিন? সে’ও কি পালাবে না? বাইরের অবারিত স্বাধীনতা প্রলুব্ধ করবে না তাদের? না, কি আশ্চর্য, তারা জানালার কিনারে গিয়ে বসল কিছুক্ষণ, পরস্পরের ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে বেশ কিছু প্রেমনিবেদনও হল, কিন্তু জানালার বাইরে সেই যে উদার উন্মুক্ত জগত,সেই সীমাহীন দেবদারু অরণ্যের সম্মোহনী অন্ধকার, তার বিন্দুমাত্র আকর্ষণ তারা বোধ করল বলে মনে হলনা। না, তারা যায়নি কোথাও। আমি অবাক হয়ে দেখলাম সেই অসাধারণ দৃশ্য।

বিখ্যাত দার্শনিক স্পিনোজা বলেছিলেন সত্যিকার স্বাধীন ইচ্ছা বলতে আসলে কিছু নেই। ইচ্ছা সবসময়ই শর্তের সীমানাতে আবদ্ধ। একটা তীর, ধনুকের ডগা থেকে ছাড়া পাবার পর দারুণ বেগে ছুটতে থাকে—-তখন সে মুক্ত, একেবারেই বাধাবন্ধহীন বিহঙ্গ যেন। কিন্তু সেই বেগেরও পা জড়িয়ে যায়, তার লয় আছে। একসময় সেই তীক্ষ্ণ, ধারালো বাণ নিস্তেজ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। জগতের বহুতর মহতী শক্তি তার নিরঙ্কুশ মুক্তির পথ রুদ্ধ করে রাখে, অদৃশ্যে, অন্তরালে। সেই শক্তির কাছে ইচ্ছা নিত্যই আনতমস্তক।

পরম মুক্তি বা পরম স্বাধীনতা (Absolute Freedom) একপ্রকার কল্পরাজ্য (Utopia), আমার মতে। প্রতীক শুধু নয়, অলীক। এর অস্তিত্ব কবির কল্পনায়, ঋষির জপসাধনায়। পূর্ণ স্বাধীনতা আমাদের কল্পনার মায়ামৃগ। সৃষ্টির উদ্যম দেয়, বাস্তবের নীলনক্সা দেয় না। আসলে আমরা তানিয়ার সেই ক্যানারিদুটিরই মত—-জানালাটি খোলা পেলেই খুশি। জানালার বাইরে যে অবারিত মুক্তি, অপার স্বাধীনতা, তা পোষা পাখির কাম্য নয়, আমাদেরও নয়। এক হিসেবে আমরাও কিন্তু পোষা প্রাণী—-বিশেষ কোনওমুনিবের নয়, নিজেদেরই মনগড়া মুনিবের । সেই মুনিব একেকজনের জীবনে একেকভাবে প্রকাশ পায়। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর মুক্তি মুদিতচক্ষু ধ্যানের মধ্যে, দরবেশের মুক্তি অন্তহীন জিগিরের মধ্যে, শিল্পীর মুক্তি চিত্ররচনায়, স্থপতির মুক্তি নির্মানে, গায়েনের সঙ্গীতে, কৃষকের মুক্তি উত্পাদনে। মানুষের মুক্তি বন্ধনে, পরম বন্ধনই তার আরাধ্য মুক্তি।

কথাগুলো সবার ভাল লাগবে না জানি—-বিশেষ করে এই ‘মুনিব’ শব্দটি। আমাদের আবার মুনিব থাকবে কেন? আমরা হলাম স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক। ‘মুনিবের’ যুগ চলে গেছে, বলবে সবাই সমস্বরে। হ্যাঁ স্বাধীন, স্থূল জাগতিক অর্থে স্বাধীন তো অবশ্যই, কিন্তু সূক্ষ্ণ জৈবিক বিচারে ঐ যে বললাম, আমরা সেই পোষা ক্যানারিরই মত স্বাধীন।আমাদের মুনিবের নাম ভীতি। স্বাধীনতাকে আমরা ভয় পাই। জানালার বাইরে আমরা শুধু চোখ পাঠিয়েই তুষ্ট, বাহু আর দেহ পাঠাতে দ্বিধান্বিত। বাইরে মৃত্যুর ভয়। ত্রাস ও বিনাশের রাজ্য সেখানে। মৃত্যু আমাদের সেই অদৃশ্য মুনিব। মুনিবকে খুশি রাখার জন্যে আমরা পূজার মণ্ডপ সাজিয়েছি বিবিধ উপকরণে। বানিয়েছি গির্জা মন্দির মঠ মসজিদ। রচনা করেছি মহাকাব্য, বর্ণালি রূপকথা, নির্মান করেছি মহা মহা তীর্থস্থান, পুন্যভূমি। এবং সেই মণ্ডপের মধ্যিখানে স্থাপন করেছি এক অলীক মূর্তিকে। সেই মূর্তির একহাতে দিয়েছি সৃষ্টির মশাল, আরেকহাতে ধংসের বজ্রদণ্ড। এতসব আয়োজন শুধু একটি অনিবার্যকে নিবারণ করবার মূঢ় আশাতে—মৃত্যু। আমাদের জীবনে মৃত্যু হল সেই অজানা অন্ধকার, তানিয়ার জানালার বাইরে মুক্তির-মুখোশ-পরা যে অরণ্যের অন্ধকার সেই ভয়াবহ, মোহিনী অন্ধকার।

ইতিহাস ঘাটলে অনেক তথ্যই জানা যায় সভ্যতার বিবর্তনী ধারার। প্রাচীনযুগের সমাজব্যবস্থায় তো অনেক নিষ্ঠুরতাই ছিল একসময়, এবং এখনও সব উঠে যায়নি। নানাযুগে নানা ধর্ম এসে পুরনো অনেক অন্যায়কে দূর করে নতুন অন্যায় সৃষ্টি করেছে অধিকাংশ সময়। নানা মতবাদ এসেছে নানা নিপীড়নকে নিবারণ করবার প্রতিশ্রুতি নিয়ে, এবং তা করতে গিয়ে স্থাপন করেছে নতুন নিপীড়নের কলকব্জা। উদাহরণ দরকার? ধরুণ যুদ্ধ—-সৃষ্টির আদিকাল থেকে সেই যে শুরু তার সেটা কি থেমেছে কোনওদিন? থামেনি। এবং কোনদিন থামবেও না। মানুষের ক্ষমতার ক্ষুধা যেমন তার প্রকৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত তেমনি ক্ষমতার আস্ফালন, অর্থাত্ যুদ্ধ, তার প্রবৃত্তিও একইরকম প্রকৃতিগত। মানবসমাজের সবচেয়ে কায়েমী ব্যবস্থা কোনটি? দাসত্ব। আকাশ থেকে পড়বেন না। ভেবে দেখুন। পৃথিবীর তিনটে বড় বড় ধর্ম। কোনটাতেই দাসত্বপ্রথাকে সরাসরি নিষিদ্ধ করা হয়নি। পানাহার বিষয়ক কতগুলো নগণ্য বস্তুকে ঢাকঢোল বাজিয়ে বেয়াইনী করা হয়েছে, এমনকি মূত্রত্যাগকালে দণ্ডায়মান অবস্থার প্রতিও ভ্রূকুটি করবার প্রয়োজন বোধ করা হয়েছে, কিন্তু দাসত্বের মত একটি নিষ্ঠুর, বর্বর প্রথাকে চূড়ান্তভাবে নিপাত করে দেবার কোনও তাগিদ বোধ করেননি আমাদের মহান নেতারা। করেননি কারণ প্রথাটির সঙ্গে ক্ষমতা ব্যাপারটি একেবার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত। উপরন্তু আরাম আয়েসের প্রতি সুখি মানুষদের যে স্বাভাবিক দুর্বলতা তার বাস্তয়ানের জন্যে দুঃখি মানুষ, অর্থাত্ ভৃত্যবাহিনীর পূর্ণ সহযোগিতা ছাড়া কি চলে? চলেনা। চলেনা বলে এই একটি প্রথা যা আইনের বই থেকে দূর হলেও অন্দরমহল থেকে দূর হয়নি, এবং কোনদিন হবে বলেও মনে হয়না।

তাই বলি, স্বাধীনতা আসলে আমরা কেউ ঠিক চাইনা। নিজেদের জন্যে চাইলেও সবার জন্যে নয়। কাউকে না কাউকে ক্যানারি হতেই হবে। তা নাহলে বাড়ির সৌন্দর্য থাকে না।

নিউ ইয়র্ক,
১৫ই নভেম্বর, ‘১০
মুক্তিসন ৩৯