প্রতিবছর অক্টোবর মাস এলেই বিশ্বব্যাপী বড় বড় প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীদের রক্তচাপ বেড়ে যায়। বিশেষ করে তাঁরা যদি ইতোমধ্যেই বড় কিছু আবিষ্কার করে নাম করে ফেলেন- নোবেল কমিটির টেলিফোনের আশা তাঁরা করতেই পারেন। হার্ভার্ড, এম-আই-টি, স্ট্যামফোর্ড, ক্যালটেক, কেমব্রিজ, অক্সফোর্ড বা এরকম নোবেল-সমৃদ্ধ ইউনিভার্সিটিগুলোর প্রত্যাশা স্বাভাবিক ভাবেই বেশি থাকে। কারণ সারা পৃথিবীর সব ভালো ভালো গবেষক আর গবেষণাগারগুলো তো এসব ইউনিভার্সিটিরই দখলে। প্যাটেণ্ট অফিসের কেরাণীগিরি করতে করতে পৃথিবী বদলে দেয়া আইনস্টাইনের যুগে যতটা সম্ভব ছিলো এখন আর ততটা নেই। তবে আইনস্টাইনের গবেষণাগার অর্থাৎ “মস্তিষ্ক, কাগজ আর পেন্সিল” এর সাথে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক জুড়ে দিয়ে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণা এখনো হয়তো কিছুটা করা যায়, কিন্তু পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণার জন্য অত্যাধুনিক গবেষণাগার লাগে, উন্নত যন্ত্রপাতি লাগে, লক্ষ ডলারের পরীক্ষণ যদি অশ্বডিম্ব প্রসব করে তা সহ্য করে নিয়ে আরো লক্ষ ডলার খরচ করে পরীক্ষণ চালিয়ে যাবার সামর্থ্য ও সংস্কৃতি লাগে। তারপর প্রতিষ্ঠা, স্বীকৃতি আর প্রচার। তারপর অনেক স্নায়ুচাপ সহ্য করার পর নোবেল পুরষ্কার।

কিন্তু এত কিছুর পরেও মাঝে মাঝে আশ্চর্যজনক ব্যতিক্রম ঘটে যায়- যেমন ঘটেছে ২০১০ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কারের ক্ষেত্রে। ২০০৪ সালে দ্বি-মাত্রিক পদার্থ গ্রাফিনের ওপর যুগান্তকারী কাজ, আর ছ’বছরের মাথায় একেবারে নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্তি। পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এরকম ঘটনা ঘটেনি অনেক দিন। নোবেল পুরষ্কার প্রবর্তনের প্রথম দিকে এরকম কিছু ঘটনা ঘটেছিল- যেমন রন্টগেন ১৮৯৫ সালে এক্স-রে আবিষ্কারের ছ’বছর পর ১৯০১ সালে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন, ১৮৯৮ সালে পোলোনিয়াম ও রেডিয়াম আবিষ্কা্রের পাঁচ বছর পর পিয়েরে ও মেরি কুরি নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন ১৯০৩ সালে। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাবার কারণে এ অবস্থা বদলে যায়। তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে যুগান্তকারী আবিষ্কার করলেও তার পরীক্ষামূলক প্রমাণ পাওয়া না গেলে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয় না।সেজন্য অপেক্ষা করতে হয় অনির্দিষ্ট কাল। আর পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানের যুগান্তকারী আবিষ্কারের ক্ষেত্রে অপেক্ষা করতে হয় সেই আবিষ্কারের ব্যবহারিক প্রয়োগের ফলাফলের জন্য। যেমন ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং বা এম-আর-আই আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৯৭০ সালে। কিন্তু সেই আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়েছে চৌত্রিশ বছর পর ২০০৪ সালে- ততদিনে এম-আর-আই চিকিৎসাক্ষেত্রে একটা বহুল ব্যবহৃত প্রযুক্তি। চার্জ-কাপল্ড ডিভাইস বা সিসিডি এবং অপটিক্যাল ফাইবার আবিষ্কৃত হয়েছে ১৯৭০ সালে। তথ্য প্রযুক্তি ও ডিজিটাল ডিভাইসে এদের ব্যাপক ব্যবহার চলছে গত তিরিশ বছর ধরে। অথচ সিসিডি ও অপটিক্যাল ফাইবার আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়েছে মাত্র গতবছর ২০০৯ সালে। সে তুলনায় এ বছরের নোবেল প্রাপ্ত গ্রাফিনের ব্যবহার এখনো শুরুই হয়নি। তাই এ বছরের নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী ৫২ বছর বয়সী আন্দ্রে গাইম ও ৩৬ বছর বয়সী কনস্টান্টিন নভোসেলভ যখন নোবেল কমিটির ফোন পেয়েছেন- অবাক হবার ভান করতে হয়নি, সত্যি সত্যিই অবাক হয়ে গেছেন। এতটা আশা করেন নি তাঁরা নিজেরাও।

আন্দ্রে গাইম ও কনস্টান্টিন নভোসেলভ

আন্দ্রে গাইম ও কনস্টান্টিন নভোসেলভ

আশা করবেনই বা কীভাবে? পদার্থবিজ্ঞানের জগতে একেবারে অজ্ঞাতকুলশীল হয়তো নন, কিন্তু ততোটা বিখ্যাতও নন ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আন্দ্রে গাইম ও কনস্টান্টিন নভোসেলভ। বড় কোন রিসার্চ গ্রান্টও তাঁরা পাননি কোনদিন। তাছাড়া কোন সিরিয়াস গবেষণা থেকে নয়, আক্ষরিক অর্থেই ডাস্টবিন থেকে উঠে এসেছে তাঁদের আবিষ্কার। আবিষ্কারের গবেষণাটা তাঁদের কাছে প্রায়-খেলার মত। আন্দ্রে গাইমের চরিত্রের মধ্যেই আছে স্পোর্টম্যানশিপ। একবার না পারলে হাজার বার চেষ্টা করতেও পিছপা হন না তিনি। প্রত্যেকবার ভুল থেকে শিখছেন নতুন কিছু। তাই তাঁর প্রতিটি পরীক্ষা পদ্ধতিই নতুন, পরীক্ষার ক্ষেত্রও নতুন নতুন।

১৯৫৮ সালে রাশিয়ায় জন্ম আন্দ্রে গাইমের। মস্কো ফিজিক্যাল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে আন্ডার-গ্র্যাজুয়েট পরে চেরনোগোলোভ্কা’র ইনস্টিটিউট অব সলিড স্টেট ফিজিক্স থেকে পোস্টগ্র্যাজুয়েট। তারপর চলে যান নেদারল্যান্ডে। সেখানে নাইমিগান ইউনিভার্সিটিতে পড়িয়েছেন অনেক বছর। নেদারল্যান্ডের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন তিনি। ষোল বছর পর নিজের অজান্তেই গাইমকে অনুসরণ করলেন নভোসেলভ। কনস্টান্টিন নভোসেলভেরও জন্ম রাশিয়ায় ১৯৭৪ সালে। পড়াশোনাও প্রথমে মস্কো ফিজিক্যাল টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি, পরে চেরনোগোলোভ্কা’র ইনস্টিটিউট অব সলিড স্টেট ফিজিক্স। সেখান থেকে পি-এইচ-ডি করার জন্য পাড়ি জমান নেদারল্যান্ডের নাইমিগান ইউনিভার্সিটিতে। সেখানেই তাঁর পরিচয় হয় প্রফেসর গাইমের সাথে। নভোসেলভ যদিও গাইমের সরাসরি তত্ত্বাবধানে পি-এইচ-ডি করছিলেন না, কিন্তু গাইমের বহুমুখী গবেষণার প্রতি আকৃষ্ট হলেন। গাইমও নভোসেলভের উৎসাহ ও উদ্দীপনায় খুশি।

বেশির ভাগ বিজ্ঞানী সাধারণত একটা বিষয় নিয়েই গবেষণা করেন বছরের পর বছর। কিন্তু ক্ষুদ্র একটা অংশ আছে যাঁদের আগ্রহ বিভিন্ন রকম বিষয়ে। তাঁরা কয়েক বছর পর পর গবেষণার ক্ষেত্র বদল করেন সমান দক্ষতায়। আন্দ্রে গাইম তাঁদের দলে। তিনি বলেন, “বছরের পর বছর একই জিনিস নিয়ে গবেষণা করা খুব ক্লান্তিকর কাজ। তাই কয়েক বছর পরেই আমি হাঁপিয়ে উঠি। তখন ভাবতে থাকি নতুন কী করা যায়”। তাঁর কাছে গবেষণা হলো খেলার মত। খেলায় যে রকম আনন্দ থাকে, নেশা থাকে, উদ্দীপনা থাকে, জয় পরাজয় থাকে- সেরকম গবেষণাতেও আনন্দ, উদ্দীপনা, সাফল্য-ব্যর্থতা থাকে। যে কোন নতুন ক্ষেত্রের প্রতিই আগ্রহ প্রফেসর গাইমের। ১৯৯৭ সালে প্রফেসর গাইম ডায়াম্যাগনেটিজম নিয়ে কাজ করতে করতে আবিষ্কার করেন যে শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রে ডায়াম্যাগনেটিক পদার্থ বিকর্ষিত হয়। পানি ডায়াম্যাগনেটিক পদার্থ। তাঁর মাথায় এলো শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্রে পানি রাখলে পানির কণা বিকর্ষিত হয়ে শূন্যে ভাসতে থাকবে। এটাকে আরো আকর্ষণীয় করার জন্য পানির বদলে তিনি একটা জীবন্ত ব্যাঙ ব্যবহার করলেন। ব্যাঙের শরীরের জলীয় অংশ ডায়াম্যাগনেটিক। উপযুক্ত শক্তির চৌম্বক শক্তির ক্ষেত্র তৈরি করে গাইম দেখালেন যে সেই চৌম্বক ক্ষেত্রে একটা ব্যাঙ বিকর্ষণ বলের ক্রিয়ায় শূন্যে ভেসে থাকে। এরকম বিজ্ঞান মজার তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এটা কোন মৌলিক আবিষ্কার নয়। এরকম মজার আবিষ্কার যেগুলো দেখে ‘মানুষ শুরুতে হাসে, পরে ভাবতে বসে’- তাদের জন্য হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ইগ্-নোবেল কমিটি ইগ্-নোবেল পুরষ্কার চালু করেছে বেশ কয়েক বছর আগে থেকে। ২০০০ সালে
চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রভাবে শূন্যে ভাসমান ব্যাঙের জন্য ইগ্-নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয় প্রফেসর আন্দ্রে গাইমকে। একটা ধারণা ছিল যে যাঁরা ইগ্-নোবেল পুরষ্কার পান, তাঁদের পক্ষে সত্যিকারের নোবেল পুরষ্কার পাওয়া সম্ভব নয়। তাই ইগ্-নোবেল পুরষ্কার প্রদান অনুষ্ঠানে একজন সত্যিকারের নোবেল বিজয়ীকে অতিথি হিসেবে আনা হয়। ইগ্-নোবেলের সেই প্রচলিত ধারণা ভেঙে গেলো এবছর। প্রফেসর আন্দ্রে গাইম হলেন প্রথম বিজ্ঞানী যিনি ইগ্-নোবেল ও নোবেল পুরষ্কার দুই-ই পেলেন।

চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রভাবে শূন্যে ঝুলন্ত ব্যাঙ

চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রভাবে শূন্যে ঝুলন্ত ব্যাঙ

২০০০ সালে ইগ্-নোবেল পাবার পর কিছুটা খ্যাতি পেয়েছেন আন্দ্রে গাইম। তার মধ্যে বেশ কিছু মজার ব্যাপারও ঘটেছে। ইংল্যান্ডের একজন ধর্মীয় নেতা দশ লাখ পাউন্ড দিতে চেয়েছেন প্রফেসর গাইমকে। শর্ত একটাই- ধর্মীয় সমাবেশে ভক্তদের সামনে তিনি ঐ ধর্মীয় নেতাকে শূন্যে ভাসতে সাহায্য করবেন। ধর্মীয় নেতা বলবেন যে ঈশ্বরের মহিমায় তিনি অলৌকিক শক্তি বলে শূন্যে ভাসার ক্ষমতা অর্জন করেছেন। প্রফেসর গাইম সত্যিকারের বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে যারা জনগণকে ভাওতা দেন- তাদের সাথে হাত মিলাতে পারেন না কিছুতেই। হোক না সে মিলিয়ন বা বিলিয়ন পাউন্ড দেবার প্রস্তাব।

২০০১ সালে ম্যান্চেস্টার ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেন প্রফেসর গাইম। যোগ দিয়েই কনস্টান্টিন নভোসেলভকে পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো হিসেবে তাঁর ডিপার্টমেন্টে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করলেন। কনস্টান্টিন নভোসেলভের পি-এইচ-ডি শেষ হয়নি তখনো। থিসিস জমা দিয়েই ম্যানচেস্টারে চলে এলেন নভোসেলভ। কাজ শুরু করলেন গ্রাফিন নিয়ে। প্রতি শুক্রবার বিকেলে সবাই যখন নানারকম সামাজিক আনন্দে মেতে ওঠে- তখন গাইম আর নভোসেলভের গ্রুপ মেতে ওঠে ‘ফ্রাইডে ইভনিং এক্সপেরিমেন্ট’-এ। বড় কোন যন্ত্রপাতি নেই। প্রায় খালি হাতে ল্যাবে যা আছে তা কাজে লাগিয়েই নানারকম পরীক্ষা। এরকম একটা ‘ফ্রাইডে ইভনিং এক্সপেরিমেন্ট’-এর ফসল ২০১০ সালের নোবেল পুরষ্কার।

গ্রাফিন নতুন কোন পদার্থ নয়। গ্রাফিনের অস্তিত্বের কথা জানা আছে অনেক দিন আগে থেকেই। কার্বনের একটা রূপ গ্রাফাইট। ষড়ভুজ আকৃতির পারমাণবিক বন্ধন যুক্ত গ্রাফাইটের গঠন সম্পর্কেও সম্যক ধারণা আছে বিজ্ঞানীদের। আমরা যে পেন্সিল দিয়ে লিখি- সে পেন্সিলের শিস মূলত গ্রাফাইট। পেন্সিলের লেখাগুলো গ্রাফাইটের অনেকগুলো আস্তরণের সমষ্টি। গ্রাফাইটের এই আস্তরণগুলোর প্রতিটি একেকটা গ্রাফিন। গ্রাফিনের একেকটা আস্তরণ এতটাই পাতলা যে এর পুরুত্ব একটা মাত্র পরমাণুর ব্যাসের সমান, অর্থাৎ এক মিলিমিটারের এক কোটি ভাগের এক ভাগ। আরো পরিষ্কার ভাবে বলতে গেলে বলা যায়, দশ পাতা কাগজের পুরুত্ব যদি এক মিলিমিটার হয়, তাহলে দশ লক্ষ গ্রাফিনের আস্তরণের পুরুত্ব হবে এক পাতা কাগজের পুরুত্বের সমান। ইতিপূর্বে গ্রাফিনের আরো সব গঠন আবিষ্কৃত হয়েছে। কার্বন ন্যানোটিউবের কথা আমরা জানি। C60 বা ষাটটা কার্বন-পরমাণু মিলে ফুটবল আকৃতির ফুলারিন আবিষ্কারের জন্য রসায়নে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়েছে ১৯৯৬ সালে।

গ্রাফিন, ন্যানো-টিউব ও ফুলেরিন

গ্রাফিন, ন্যানো-টিউব ও ফুলেরিন

গ্রাফিনের অস্তিত্ব জানা থাকা সত্ত্বেও তাকে আলাদা করা যাচ্ছিলো না এতদিন। ফলে তার অনেক ধর্মও পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব হচ্ছিলো না। আন্দ্রে গাইম ও কনস্টান্টিন নভোসেলভ শুরু করলেন নানারকম পরীক্ষা। কিন্তু কিছুতেই সফল হচ্ছিলেন না। সিনিয়র গবেষকদের একজন গ্রাফিনের পুরু আস্তরণ তৈরি করেন আর সবাই মিলে চেষ্টা করা হয় কীভাবে তার একটা আস্তরণ আলাদা করা যায়। যে গ্রাফিনগুলো টেবিলে লেগে থাকতো তা পরিষ্কার করার জন্য ব্যবহার করা হতো স্কচ ট্যাপ। গ্রাফিনের ওপর টেপ লাগিয়ে পরে টান দিয়ে টেপটা তুলে ফেললে টেপের সাথে গ্রাফিনও উঠে আসে। ওই ব্যবহৃত টেপগুলো স্বাভাবিক ভাবেই ময়লার বিনে ফেলে দেয়া হয়। একদিন কী মনে করে ওরকম একটা ফেলে দেয়া টেপ ময়লার বিন থেকে তুলে নিলেন নভোসেলভ। কনফোকাল মাইক্রোস্কোপের নিচে টেপটাকে রেখে দেখলেন তাতে যে গ্রাফিন লেগে আছে তার পুরুত্ব অবিশ্বাস্য রকমের কম। একটা পথ পেয়ে গেলেন তাঁরা। ধরতে গেলে এভাবেই আলাদা হয়ে গেলো অবিশ্বাস্য রকমের পাতলা পদার্থ গ্রাফিন। এর পুরুত্ব এতই কম (এক মিলিমিটারের এক কোটি ভাগের এক ভাগ) যে নাই বললেই চলে। তাই গ্রাফিনকে বলা হচ্ছে দ্বি-মাত্রিক পদার্থ, যার শুধু দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ আছে, কিন্তু কোন পুরুত্ব নেই।

গ্রাফিন

গ্রাফিন

গ্রাফিনের একটা ষড়ভুজ আকৃতির কোষে দুটো কার্বন পরমাণু থাকে যার ক্ষেত্রফল মাত্র 0.052 বর্গ ন্যানোমিটার। ঘনত্ব 0.77 mg/sq-m. অর্থাৎ এক মিটার বাই এক মিটার আকৃতির এক খন্ড গ্রাফিনের ভর হবে এক মিলিগ্রামেরও কম। গ্রাফিন এত পাতলা যে এটা মাত্র 2.3% আলো শোষণ করে। অর্থাৎ এর মধ্য দিয়ে প্রায় সব আলোই বিনা বাধায় চলে যেতে পারে- মানে গ্রাফিন কাচের মত স্বচ্ছ। এত পাতলা, এত স্বচ্ছ, অথচ গ্রাফিন ইস্পাতের চেয়েও কমপক্ষে একশ’ গুণ শক্ত। গ্রাফিনের ভার সইবার ক্ষমতা 42.0 নিউটন/মিটার, অথচ ইস্পাতের ভার সইবার ক্ষমতা মাত্র 0.40 নিউটন/মিটার। এক মিটার দৈর্ঘ্য ও এক মিটার প্রস্থ বিশিষ্ট একখন্ড গ্রাফিন দুটো খুঁটির মধ্যে বেঁধে দিলে তার ওপর চার কিলোগ্রাম ভর রাখলেও গ্রাফিন খন্ডটি ছিঁড়বে না। এটা এতই পাতলা যে খালি চোখে একে দেখাই যাবে না। এর ওপর একটা বিড়াল শুয়ে থাকলে মনে হবে বিড়ালটি শূন্যের উপর শুয়ে আছে। এই গ্রাফিন খন্ডের ওজন হবে এক মিলিগ্রামেরও কম, অথচ বিড়ালের একটা গোঁফের ওজনও এক মিলিগ্রামের বেশি হবে। গ্রাফিন খুবই বিদ্যুৎ সুপরিবাহী। এর বিদ্যুৎ পরিবাহীতা তামার চেয়েও বেশি। গ্রাফিনের তাপ পরিবাহিতাও তামার চেয়ে দশ গুণ বেশি।

গবেষণাগারে গ্রাইম ও নভোসেলভ

গবেষণাগারে গ্রাইম ও নভোসেলভ

২০০৪ সালে গ্রাফিনের এসব গুণাবলী প্রকাশ করেন গাইম ও নভোসেলভ সায়েন্স জার্নালে [Science 306, 666 (2004)]। পরের বছর আরেকটি পেপার বিখ্যাত নেচার সাময়িকীতে [Nature 438, 197 (2005)]। দ্রুত সাড়া পড়ে যায় বিজ্ঞান জগতে। গ্রাফিনের ভবিষ্যৎ ব্যবহার নিশ্চিত হয়ে পড়ে অনেক গুলো ক্ষেত্রে। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটানোর ক্ষমতা রাখে গ্রাফিন। এর অবিশ্বাস্য রকমের কম ভর, স্বচ্ছতা, বিদ্যুৎ সুপরিবাহিতার কারণে কম্পিউটার টাচ-স্ক্রিন, কম্পিউটার চিপস ইত্যাদির ক্ষেত্রে গ্রাফিন অচিরেই সিলিকনের জায়গা দখল করে নেবে। সোলার সেল, মোবাইল ফোন, ইলেকট্রনিক্স, গাড়ির পার্টস, আকাশ-যানের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ থেকে শুরু করে স্যাটেলাইটেও জায়গা করে নেবে গ্রাফিন। প্রযুক্তির আগামী বিশ্ব হবে গ্রাফিন-বিশ্ব- এরকমই আশাবাদী বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎদ্রষ্টারা। সে কারণেই আগে ভাগেই গ্রাফিনের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে নোবেল পুরষ্কার।

কনস্টান্টিন নভোসেলভ

কনস্টান্টিন নভোসেলভ

মাত্র ৩৬ বছর বয়সে কনস্টান্টিন নভোসেলভের নোবেল পুরষ্কার পেয়ে যাওয়া একদম অভূতপূর্ব না হলেও কম আশ্চর্যের নয়। [এর আগে লরেন্স ব্রাগ মাত্র ২৫ বছর বয়সে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন।]। অনেকে মনে করেন নোবেল পুরষ্কার পাবার পর বিজ্ঞানীরা তেমন কিছুই করেন না আর। ব্যতিক্রম অনেক আছে। যেমন মেরি কুরি (১৯০৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পাবার পর ১৯১১ সালে রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পান), জন বার্ডিন (১৯৫৬ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পাবার পর ১৯৭২ সালে আবার নোবেল পুরষ্কার পান পদার্থবিজ্ঞানে)। আশা করা যায় প্রফেসর গাইম ও নভোসেলভের হাত ধরে আরো অনেক নতুন প্রযুক্তির জন্ম হবে।