পৃথিবীর সকল লেখকদের প্রতি লিউ জিয়াবোর আবেদন
httpv://www.youtube.com/watch?v=2QJGuPOMPvE

*************
সকালে উঠে প্রথমেই যে খবরটার প্রত্যাশায় ছিলাম-বলাই বাহুল্য দেখেই অত্যন্ত খুশী হলাম। দলাই লামা, ডেসমন্ড টুটু চীনের মানবাধিকার নেতা লিউ জিয়াবোকে এবারের নোবেল শান্তি প্রাইজের জন্যে বেছে ছিলেন-এবং নরওয়ের নোবেল কমিটি চীনের বিদেশ মন্ত্রীর প্রচ্ছন্ন হুমকি উপেক্ষা করে লিউ জিয়াবোকেই বিজয়ী ঘোষনা করে। আগের বারে ওবামাকে নোবেল দেওয়া বেশ বিতর্কিত ছিল-এবার বলা যায় সুদে আসলে সেই খেদ মেটালো নোবেল কমিটি। চীনের গান্ধীকে যথাযোগ্য সন্মান দিয়ে নোবেল শান্তি পুরস্কার বহুদিন বাদে গেল তার কাছে, যিনি সত্যিই এর যোগ্য দাবিদার।

সাথে সাথে দুনিয়া দেখলো কমিনিউস্টদের বাঁদরামো। আমি চীনা কমিনিউস্টদের আলাদা করছি না-কারন পশ্চিম বঙ্গেও কমিনিউস্টদের অসভ্যতা, বাঁদরামো এবং গুন্ডামো দেখতে দেখতে আমরা বিরক্ত। বিংশ শতাব্দিতে অসভ্যতা, অত্যাচার এবং মানবিকতার দলনের ইতিহাসে কমিনিউস্টদের কেও হারাতে পারবে না ( এই নিয়ে আমার বিস্তারিত লেখা এই লিংকে পাবেন)। নোবেল প্রাইজ ঘোষনা করা মাত্র চীনে সি এন এন বন্ধ করে দেওয়া হয়। টুইটার ও বন্ধ হয়। লিউ জিয়াবো নামে সার্চ দিলে চিনের কোন সাইটে কিছু যাতে না আসে তা সিদ্ধ করা হয়। খবর পাচ্ছি একদিনে অন্তত ১০ টি চীনা ব্লগকে বন্ধ করা হয়েছে। কিন্ত তাতেও টুইটারকে আটকানো যায় নি-প্রক্সি সাইট দিয়ে চিনারা ভালো ভাবেই খবর পেয়েছেন। তারাও আজ গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে ভাবাবেগে আপ্লুত। টুইটারে বাঁধন ভাঙা জলের মতন ছড়িয়ে পড়ছে চীনে গণতন্ত্রের দাবী।

তবে লিউ জিয়াবো এখনো সম্ভবত তার বিজয় খবর জানেন না। হয়ত তিনি এখনো জেলে পাথর ভাংছেন। তার স্ত্রী লু জিয়াকে চীনা পুলিশ গতকালই তুলে নিয়ে গেছে যাতে তিনি মিডিয়ার সাথে কথা বলতে না পারেন। সাথে সাথে নরওয়েকে শাসাচ্ছে চীনা মিডিয়া এবং সরকার। প্রকাশ্যেই।

কি করেছেন লিউ জিয়াবো? যার জন্যে তিনি এই নিয়ে চতুর্থবারের জন্যে জেলে? ১৯৮৯ সালে তিয়েমান স্কোয়ারের বিক্ষোভের সময় তিনি আমেরিকাতে পড়াচ্ছিলেন। দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন দেখে বিদেশে স্থির থাকতে পারেন নি বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যের এই অধ্যাপক। জেল অবধারিত জেনেও চীনে ফিরে আসেন শুধু গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্যে। এবং দু বছরের জন্যে তাকে জেলে পাঠানো হল। মনে রাখতে হবে, তিনি কোন আইন ভাঙেন নি। শুধু গনতন্ত্রের দাবিতে লিফলেট ছড়িয়েছিলেন। অবশ্য কমিনিউস্টদের চোখে সেটাই অপরাধ। এর পর আবার জেল ১৯৯৫ সালে ছমাসের জন্যে-সেই গণতন্ত্রের দাবিতে। ১৯৯৬ সালে চীনা সরকার তাকে তিন বছরের জন্যে “কমিনিউস্ট রিহ্যাবিলেটশনে” পাঠায়। যেহেতু তিনি কমিনিউজমের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের জন্যে সোচ্চার দাবিদার- তাকে লেবার ক্যাম্পে পাঠানো হয় কমিনিউম বুর্জোয়া গণতন্ত্রের থেকে কত মহান তা পাথর ভেঙে শিক্ষা দিতে। তাতেও তাকে দমানো যায় নি। লিউ জিয়াবো পন্ডিত লোক। তিনি জানেন এবং বলেন, পৃথিবীতে যারাই স্বৈরাচারি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে-সবার ভাগ্যেই জুটেছে মৃত্যু বা জেল। তিনিই বা ব্যাতিক্রম হবেন কেন? এই বিশ্বাসেই তিনি হাঁসিমুখে জেলে গেছেন বারংবার-যার তুলনা শুধু মহত্মা গান্ধী। শেষ জেল যাত্রা ২০০৯ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর। মাত্র দুঘন্টার বিচারে তাকে ১১ বছরের জন্যে জেলে পাঠানো হল। অবশ্য তিনি ভাগ্যবান। তার আরেক ডেমোক্রেটিক সাগরেদকে মাত্র দশমিনিটের বিচারেই তিন বছরের জন্যে জেলে পাঠানো হয়েছে। তার স্ত্রী বা অন্য কোন ইন্টারন্যাশাল অবর্জাভারকে ঢুকতে দেওয়া হয় নি কোর্টরুমে।

তার অপরাধ?

চার্টার ০৮

চীনে গনতন্ত্র এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে একটি সনদ লিখে সেটি ব্লগ সাইটে প্রকাশ করার ইচ্ছা ছিল তার। চীনে বিশিষ্ঠ ৩০০ জন বুদ্ধিজীবী তাতে সাক্ষর করেন ( এদের মধ্যে ৬০ জন জেলে বাকিদের ভাগ্যে জুটেছে নানা রকমের হেনস্থা) । এই চার্টার প্রকাশের আগেই তাকে তুল নিয়ে যায় পুলিশে। কি বক্তব্য ছিল চার্টারে?

This year is the 100th year of China’s Constitution, the 60th anniversary of the Universal Declaration of Human Rights, the 30th anniversary of the birth of the Democracy Wall, and the 10th year since China signed the International Covenant on Civil and Political Rights. After experiencing a prolonged period of human rights disasters and a tortuous struggle and resistance, the awakening Chinese citizens are increasingly and more clearly recognizing that freedom, equality, and human rights are universal common values shared by all humankind, and that democracy, a republic, and constitutionalism constitute the basic structural framework of modern governance. A “modernization” bereft of these universal values and this basic political framework is a disastrous process that deprives humans of their rights, corrodes human nature, and destroys human dignity. Where will China head in the 21st century? Continue a “modernization” under this kind of authoritarian rule? Or recognize universal values, assimilate into the mainstream civilization, and build a democratic political system? This is a major decision that cannot be avoided.

খুব সুন্দর বক্তব্য-এই একবিংশ শতাব্দিতে পৃথিবীর কোন রাজনৈতিক সিস্টেমই বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রকে অস্বীকার করে চলতে পারে না। অথচ চীনের স্বৈরাচারী কমিনিউস্ট সরকার ঠিক তাই করে চলেছে। এমনকি প্রাইজ পাওয়ার পরেও বোকার মতন মিডিয়া সেন্সরশিপের বাঁদরামো করে পৃথিবীতে সবার সামনে হাস্যস্পদ হচ্ছে। ভাবা যায় চীনের কোন মিডিয়াতে এই খবর প্রকাশ করা হয় নি? যে কটি ব্লগ সাইট তা করার সাহস করেছিল-তাদেরকে বন্ধ করা হয়েছে। টুইটার নিশিদ্ধ -সি এন এন এবং সব আন্তর্জাতিক মিডিয়ার ওপর সম্পূর্ন ব্ল্যাক আউট।

লিউ জিয়াবোর মুক্তির দাবিতে সোচ্চার গোটা পৃথিবী। আমআদমি থেকে ওবামা একই সুরে কথা বলছেন। চীনের অবশ্য তাতে রক্ত চক্ষু দেখানো কমে নি। তারা নোবেল কমিটি একজন “অপরাধি” কে কি করে প্রাইজ দিতে পারে সেই নিয়ে
বোকা বোকা প্রশ্ন তুলছে! চীনা বিদেশমন্ত্রীর কি এটুকু পড়াশোনাও নেই যে তিনি জানেন না নেলসন ম্যান্ডেলা বা মহত্মা গান্ধী কবার জেল খেটেছেন? তারা কি জানেন না গান্ধী বলে গেছেন স্বৈরাচারীদের তৈরী জেল গণতন্ত্র প্রেমীদের পবিত্র মন্দির?

আমি বারবার যে কথাটা লিখতে চাই-সেটা ইতিহাসের সহজতম সত্য। ক্ষমতাই পচনের মূলে। কমিনিউজম তাত্বিক দিয়ে খুব খারাপ কিছু না হলেও, লেনিন যেভাবে ভোটে হেরে, গণতন্ত্রকে খুন করে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন করার স্কীম করে গেছেন, সেটাই কমিনিউস্টদের পৃথিবীর সব থেকে অত্যাচারী ঘৃণিত জীব বানিয়েছে। সিস্টেমের নাম ক্যাপিটালিজমই হোক বা কমিনিউজম হোক-সর্বত্র সমস্যার সূত্রপাত “ক্ষমতা”থেকে-সে ক্ষমতার উৎস টাকাও হতে পারে- আবার লেনিনিজমও হতে পারে ( আমি কমিনিউজম না বলে লেনিনিজম লেখাই ঠিক মনে করি-চমস্কির সাথে আমিও সহমত -আসলেই লেনিনিজম কমিনিউজমের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস)। মার্কেটের মনোপলি বা রাজনৈতিক ক্ষমতার মনোপলি দুটোই খারাপ-এবং কারনটাও সেই এক-ক্ষমতার পুঞ্জীভবন। লেনিন, স্টালিন বা মাওদের মতন অমানবিক নরদানবদের তান্ডবলীলা যে সোভিয়েতের পতনের মধ্যে দিয়ে শেষ হয় নি-লিউ জিয়াবোর নোবেল প্রাইজ আবার তা স্বরণ করালো।

আমাদের বঙ্গজ কমিনিউস্টরা লিউ জিয়াবোর নোবেল প্রাইজকে সহ্য করতে পারছেন না-আমি তাতে আনন্দিত। ওদের মুখোস আরো খসে পড়ছে। লিউ জিয়াবোর বিচারের কমিনিউস্ট তামাসা আজকে পৃথিবী ডিটেলসে জানল-কিন্ত আমাদের মতন যারা কমিনিউজমের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করেছে-তারা বিলক্ষন জানেন, কমিনিউজমে বিচার মানে, বিচারক অপরাধ পড়ে শোনায়। কয়েদি তা স্বীকার করে। খাতা কলমে তাই লেখা থাকে। ঠিক যেমন ভাবে বুখারীন তার “অপরাধ” স্বীকার করেছিলেন ৩০ মিনিটের বিচারে-এবং তাকে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়াতে হয়েছিল-ঠিক তেমন ভাবেই লিউ জিয়াবো “অপরাধ” স্বীকার করেছেন। যেমন গান্ধী করেছিলেন। স্বরাজ যদি অপরাধ হয়, গান্ধী সেই অপরাধে বার বার জেল খাটতে রাজী ছিলেন। লিউ ও একই দর্শনের পথিক। গণতন্ত্রের দাবি যদি অপরাধ হয় লিউ বার বার জেলে যেতে রাজি। সেটাই তার স্বৈরাচারী কমিনিউস্ট শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-যা কমিনিউস্ট বাঁদরদের মানুষের মুখোস আরেক বার খুলে নিল।