প্লেটোর ডায়ালগ গুচ্ছ এক এক করে পড়ার আগে চেয়েছিলাম সক্রেটিস সম্পর্কে নিজের মধ্যে একটা সাধারণ ধারণা তৈরী করে নিতে। চেয়েছিলাম মানব ইতিহাসের অন্যতম নির্ভীক মানুষটির স্বরূপ প্লেটোর দৃষ্টিভংগীর বাইরে গিয়ে কিছুটা উদ্ঘাটন করতে, প্লেটো আমার মনে প্লেটোর সক্রেটিসকে বসিয়ে দেবার আগেই। সেই উদ্দেশ্যেই হাতে নিয়েছিলাম হাসান আজিজুল হকের ‘সক্রেটিস’ (সক্রেটিসকে নিয়ে এরিস্টোফেনিস, প্লেটো, জেনোফোনের লেখাগুলোর ভিত্তিতে)। সফল হয়েছি, সে দাবী করিনা। কারণ সক্রেটিসের পরিচয় মূলত আমরা পাই প্লেটোর কাছ থেকেই। এমনকি এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না, সক্রেটিস চরিত্রটি সম্পূর্ণরূপেই প্লেটোর এক অনবদ্য নিপুণ সাহিত্য কর্ম। সেই সময়ে যেহেতু ফিরে যেতে পারছি না, তাই এ কথাও আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়, সক্রেটিস কতটা বাস্তব আর কতটা শিল্প। যদি কোনদিন সেই রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব হয়, তাহলে হয়ত দেখা যেতে পারে, সক্রেটিস, সক্রেটিস নয় বরং প্লেটোই হল সম্পূর্ণ সক্রেটিস, যে নিপুনভাবে তার সৃষ্টির অন্তরালে আড়াল করে রেখেছে আপন ব্যক্তিস্বত্তাকে, অন্তর্গত দর্শনটুকু দিয়ে জীবন্ত করেছিল কেবল সক্রেটিসকে। অথবা সত্যিই ছিল সক্রেটিসের দর্শন, যার জন্য আমাদের প্লেটোর উপর নির্ভর কথা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। হয়ত সক্রেটিস কিছুই জানেন না বা তার কোন মতাদর্শ নেই বলেই একটি অক্ষরও লিখে যাননি আমাদের জন্য, তাই আমাদেরও তাকে খুঁজে পেতে চোখ বন্ধ করে ঝাপ দিতে প্লেটোর আগুনে।
‘সক্রেটিস’ বইটা পড়তে গিয়ে অনেক জায়গায় কেবল চোখ বুলিয়ে গেলেও একটা জায়গায় এসে আটকে গেল মনখানা।
“তাঁর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলোঃ ‘মানবজাতির নৈতিক উন্নতি সাধন। এ কাজ তো আর নৈতিক উপদেশ বিতরণ করে হয় না, একমাত্র ব্যক্তিগত যোগাযোগ স্থাপন এবং মানুষকে তাদের নিজেদের মুখোমুখি হবার কাজে প্রবৃত্ত করার ভিতর দিয়েই এটা হতে পারে।’ এই জিনিসটাকেই আত্মজ্ঞান বলা হচ্ছে। নিজের ভিতরটা খোঁড়াখঁড়ি করা, ভিতরে যা কিছু আছে তার সবটাই বুদ্ধি ও যুক্তির পরিষ্কার আলোতে মেলে ধরা। সক্রেটিস কিন্তু কারোর হাতে আত্মজ্ঞান তুলে দিতে পারেন নি- কোন প্রশ্নেরই চূড়ান্ত জবাব দেবার চেষ্টা করেন নি। তাঁর কোন সুসম্পূর্ণ দর্শনও নেই। কারণ তিনি জানতেন, তিনি কিছুই জানেন না। তিনি শুধু মানুষকে সংক্ষুব্ধ করে তুলতে পারতেন, বিরামহীন জিজ্ঞাসার যন্ত্রণায় তাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিতেন। তার সাথে কথা শুরু করার কিছুক্ষনের মধ্যেই যে কোন জ্ঞানগর্বিত মানুষের অহঙ্কার খসে পড়তো, তার ভিতরে দৈন্য প্রকাশ পেয়ে যেতো, তিনি তখন উপলব্ধি করতে পারতেন, যেসব ধ্যান-ধারণা, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, মত, সংস্কার নিয়ে তিনি এতোকাল জীবন কাটিয়ে এলেন, তার কোন কিছু সম্বন্ধেই তার স্পষ্ট জ্ঞান নেই। তিনি সুন্দর সুন্দর বলে চেঁচিয়ে মরেছেন, কিন্তু জানেন না, ‘সৌন্দর্য বলতে কি বোঝায়’; তিনি সারাজীবন ন্যায়-অন্যায় ভালো-মন্দের উপর নির্দ্বিধায় রায় দিয়ে এসেছেন অথচ ‘ন্যায়’ সম্পর্কে, ‘ভালো’ সম্পর্কে তার আদৌ কোন পরিষ্কার ধারণা নেই। উত্তম বা আদর্শ জীবন কাটাচ্ছেন বলে হয়তো অহমিকা প্রকাশ করে এসেছেন, কিন্তু সক্রেটিসের দুটো প্রশ্ন থেকেই ধরা পড়ে যাচ্ছে যে জীবনের ‘উত্তম’ সম্বন্ধে তিনি কোন তিনি কোন ধারণা গড়ে তুলতে পারেননি। অতএব সক্রেটিসের সাথে আলাপের পর জ্ঞানগর্বিত ব্যক্তিটির মনে দেখা দিতো এক প্রচন্ড লজ্জাবোধ, অজ্ঞানতার মধ্যে ডুবে থাকার লজ্জাবোধ, কিছুই না জেনে বাগাড়ম্বরকে প্রশ্রয় দেয়ায় লজ্জা, দেখা দিতো একধরণের হীনতার উপলব্ধি। তা ঐ অজ্ঞানতা সম্বন্ধে সচেনতা থেকেই জন্ম নিতো। মানুষটি তখন পড়ে যেতেন এক রকম আত্মিক সঙ্কটের মধ্যে। তাই বলা চলে যে মানুষের অস্তিত্বের গভীরে প্রলয়ংকরী ঝড় সৃষ্টি করার অন্য নাম ছিল সক্রেটিস। এই প্রচন্ড আলোড়নই শেষ পর্যন্ত জাগিয়ে তুলতো প্রবল জীবনতৃষ্ণা, জীবনের শ্রেষ্ঠতার বোধ এবং শ্রেয়কে অনুসন্ধান ও প্রাপ্তির ক্ষান্তিহীন বাসনা।”
এই যদি হয়ে থাকে সক্রেটিস, বাস্তব হোক আর প্লেটোর নিপুন শিল্প হোক, সক্রেটিসকে গুরু মানলাম। সক্রেটিস সহস্রাব্দান্তরের জলন্ত অগ্নিগর্ভ নক্ষত্র। আজ পর্যন্ত কাউকেই ঠিক পূজনীয় ভাবতে পারলাম না সম্পূর্ণভাবে। এই যে সক্রেটিসকে গুরু মানলাম, তবু জানি, সক্রেটিসের বা প্লেটো-সক্রেটিসের ঈশ্বরের সাথে আমার ঈশ্বরের তফাত সুবিশাল, সক্রেটিসের সামাজিক জীবন আমার জন্য অনুকরণীয় নয়। ব্যক্তিগত জীবনে, আমি অনেকটা সময় পার করেছি এক না বলা আত্মিক সঙ্কটে। কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করে, কোন একটা বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত মতামত কি, তখন উত্তর দেবার আগেই আমি পড়ে যাই সেই সঙ্কটের মুখোমুখি। আমি জানি, আমার নিজস্ব একটা চিন্তা আছে, আছে মতামত, কিন্তু সেই চিন্তাপ্রসূত মতামতকে অন্যদের চেয়ে শ্রেয় অথবা আমৃত্যু স্থায়ী বলে আমি নিজেই মানতে পারিনা। অন্যকারোর কাছে তাই মত প্রকাশে আমার চরম ভিতী। আমার স্বত্তার ভিতরে প্রতিদিন চলে ধারণার ভাঙ্গাগড়া। আমি যখন পড়তে বসি, তখন আমার স্বত্তা হয়ে যায় লিখিত সঙ্কেতের সাথে একাত্ম। যখন চিন্তা করি, তখন আমার মস্তিষ্কে চলে অনুরণন। এই মুহূর্তে হয়ত আমি যা ভাবছি, দুইদিন পরে হয়ত, সেই ব্যাপারে তুলনামূলক ভাবে পরিণত কোন সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারি। কিন্তু দুমাস পরেই হয়ত অন্য কোন দৃষ্টিভংগীর অন্য কোন সত্য অথবা তথ্য আমার সেইদিনের চিন্তাটাকেই আমূল উল্টে দিয়ে যাবে। এই আত্মিক সংকটই আমার মধ্যে জন্ম দিয়েছে আমার আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতায় বিশ্বাস। আমি সর্বোচ্চ এটুকু বলতে পারি, আমি জানতে চেষ্টা করি, উপলব্ধি করতে চেষ্টা করি। তাই আমি বিচরণ করে বেড়াই নিউরোসাইন্স, সাইকোলজী, বিবর্তনবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, মেডিক্যাল সাইন্স, দর্শন, সাহিত্য ইত্যাদি ইত্যাদি, যা আমার ভালো লাগে। এই বিচরনের মধ্যিপথেই মাঝে মাঝে আবিষ্কার করি, নিউরোসাইন্সের সাথে পদার্থবিদ্যা আর বিবর্তনবিদ্যার কি গভীর যোগাযোগ। সাইকোলজীর সাথে নিউরোসাইন্সের! দর্শনের সাথে বিজ্ঞানের, মানব সভ্যতার ইতিবৃত্তের! আমি বিস্মিত হই। কিন্তু কখনোই উপলব্ধি করতে পারিনা, আমি কিছু জানি।
আমি আসলে মহাজাগতিক ভ্রমনকারীর মত এক জাগতিক জ্ঞানের জগতেরও ভ্রমনকারী কেবল। হয়তো কোনদিনও আমার মনে হবে না, আমি জানি। সমস্ত জীবনব্যাপী রয়ে যাব শিক্ষানবীশ। আর রবে জানার প্রতি এক অগাধ তৃষ্ণা। এই যদি হয় জীবন, আর কারোর না হোক আমার জীবন, মন্দ কি? তাও তো বারবার নিজের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে বলে জানি, জানি মানব মনের অনন্ত সঙ্কটের কথা। দাঁড়িয়ে আছি এটুকু জেনেই।
আজকের দিনের সাথে সেই সময়কে মিলিয়ে ফেললে হবে না। আমরা জানি সক্রেটিসের ঈশ্বর ছিল, বিশ্বাস ছিল। প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র হতে পারে না, এরিষ্টটল অনেক ভুল বলেছেন। সেই সময়ের এইসব চিন্তা করেছেন বলেই তারা মহৎ।
@বোকা মেয়ে, 🙂
সময়টা প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের। ভাবতে ভালোই লাগে, তারা যদি গাঁজাখুরি ঈশ্বরে বিশ্বাস না করতো, তাহলে আমরা হয়ত আজ অন্যরকম একটা পৃথিবী পেতাম।
আপনার ৬০টি প্রশ্ন দেখে ভালো লেগেছে। ধৈর্য আছে আপনার। আশা করি ১০০০ বছর পরে আজকের ধর্মগ্রন্থগুলো যাদুঘরে স্থান পাবে। আর যাই হোক, প্রাচীন ভাষ্কর্যের মত তখন আমরা আমাদের অতীতকে সংরক্ষণ করবো। 🙂
@জওশন আরা,
আমার আশাও তাই। তবে টাইম ফ্রেমটা একটু বেশী মনে হচ্ছে। খালি একটা শুন্য কমিয়ে ১০০ বছর পরে বললে কি একটু বেশী আশা হয়ে যায়? 🙂
@ব্রাইট স্মাইল্, আমি তো তাই আশা করতে চাই। কিন্তু বাংলাদেশের মত ধর্মভীরু ধর্মই প্রানদের দেশের মানুষ আমরা। ৬০/৭০ বছর আগেও হিন্দু-মুসলিম-শিখেদের লজ্জাজনক কাটাকাটির ইতিহাস এখনো আমাদের চোখে জীবন্ত। ঐ মানুষগুলোর রক্ত এখনো এই উপমহাদেশের মাটিতে লেগে আছে, এমনকি এখনো ঝরছে। এই হল আমাদের অতীত। ১০০ বছর তাই মনে হয় কম হয়ে যায়। যাদুঘরে ধর্মগ্রন্থ পাঠাতে হলে আগে ধর্ম থেকে প্রানটা আলাদা করে ফেলতে হবে। 🙂
লেখাটা পছন্দ হল না। দর্শন নিয়ে লিখতে গেলে উদাহরন ছারা লেখা উচিত না। প্রশ্ন, দ্বন্দ এবং উদাহরন ছারা দর্শন নিয়ে লেখা উচিত না।
@বিপ্লব পাল, এই লেখাটা আসলে একটা ভূমিকা। দর্শন নিয়ে যখন দার্শনিক দৃষ্টিভংগী প্রকাশ করব, সেখানে প্রশ্ন, দ্বন্দ, উদাহরণ রাখার চেষ্টা করব। এইখানে কেবল মাত্র একটি বিষয়বস্তু, “আত্মজ্ঞান” এর প্রতিক্রিয়া লিখেছি। মানুষের ভিতরের অন্ধকারটা দেখিয়ে দেয়া সক্রেটিসের বিষয় বস্তু, যা বিশ্লেষন করতে গিয়ে আমি নিজেই এইখানে সাবজেক্ট। 🙂
প্লেটো তো সব বিষয়ে তার কালের বাইরে ছিলেন না। গনতন্ত্রের সুফল পাওয়া সম্ভব একমাত্র সে সমাজে যে সমাজের অধিকাংশ মানুষ শিক্ষিত ও গনতন্ত্র কি তা ভাল মতো বোঝে। তো প্লেটোর যুগে সেই প্রাচীন গ্রীসে অধিকাংশ মানুষ ছিল অশিক্ষিত ও গনতন্ত্রের অর্থ বুঝত না। সেরকম একটা সমাজে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলে সম্ভাব্য বিশৃংখলা সম্পর্কে তার ধারনা ছিল বিধায় তিনি সীমিত গনতন্ত্র তথা নগর রাষ্ট্রের ধারনা পেশ করেন যেখানে সেসব মানুষই একমাত্র ভোটাধিকার পাবে যারা শিক্ষিত ও অভিজাত। আজকের গনতন্ত্রের যুগে বিষয়টা খুবই অমানবিক ও বেমানান মনে হতে পারে কিন্তু সেই যুগের প্রেক্ষিতে খুব বেমানান ছিল না মনে হয়। তবে সীমিত হলেও গনতন্ত্রের ধারনা কিন্তু সেখান থেকেই গড়ে ওঠে। গ্রীক সভ্যতার পতনের পর কিছুকাল রোম সাম্রাজ্যে এ ধরনের গনতন্ত্র চালু ছিল, পরে কিন্তু সকল সভ্যতা থেকেই এ সীমিত গনতান্ত্রিক ধারনাটাও ঝেটিয়ে বিদায় করা হয়। গ্রীক বা রোমে এ ধরনের সীমিত গনতন্ত্র থাকার কারনেই সম্ভবত তারা জ্ঞান বিজ্ঞান দর্শনের যে উন্নতি করতে পেরেছিল তা আজও মানুষ বয়ে নিয়ে চলেছে। প্লেটোর সবচেয়ে বড় অবদান আমার কাছে এটাই মনে হয়। আজকে আমরা তার সেই ধারনারই সুফল ভোগ করছি গোটা মানব সভ্যতা জুড়ে। পরিশেষে শিক্ষিত মানুষ ছাড়া গনতন্ত্রের কি নিদারুন পরিস্থিতি হয় তার কিন্তু ভাল একটা উদাহরন বাংলাদেশ বা পাকিস্তান।
@ভবঘুরে,
প্লেটো-এরিস্টটলের যুগে এবং আগে গনতন্ত্র পরীক্ষিত ছিল না। তাঁদের গনতন্ত্রের প্রতি নিরোতসাহের ভাল বিশ্লেষণ করেছেন।
বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের দোষ দিচ্ছেন কেন? ব্লক ভোট নিয়ে এদেশে যা হচ্ছে এবং হতে যাচ্ছে তা দেখে এদেশের ভবিষ্যত নিয়ে আমি মাঝে মাঝেই হতাশ হই।
লিখবেন কথা দিয়েছিলেন। লেখা দেখে সত্যই ভাল লাগল।
আসলে সক্রেটিসের মূল্যায়ন করা আজকের যুগে একটু জটিলই। কেউ তাকে মাথায় তুলে নাচবেন সত্যের জন্য জীবনদায়ী ব্যক্তিত্ব হিসেবে , কেউ বা তাকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করতে চাইবেন, ভাববাদের প্রবক্তা হিসেবে। তবে সক্রেটিস যে সত্যই কি ছিলেন তা জানাটা দূরূহ। অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম তার বিজ্ঞানের দর্শন (প্রথম খন্ড) বইয়ে (যে বইটির কথা বন্যা উপরে বলেছে) একটু ভিন্নভাবে সে সময়কার প্রেক্ষাপটগুলো বিশ্লেষণ করেছেন। সে বইটি পড়লে সক্রেটিসকে নিঃসন্দেহে এতোটা মহান বলে আর মনে হবে না। যেমন তিনি বলেছেন –
(পৃঃ ৭৬)
আরো লিখেছেন –
ইত্যাদি।
শহিদুল ইসলামের বইটি মূলতঃ পদার্থবিদ জেডি বার্নল এবং জর্জ সাটনের ইতিহাস বিশ্লেষণের উপর ভিত্তি করে লেখা। বইটিতে গ্রীক এবং রোমান ইতিহাসকে ভিন্ন দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। বইটি নিয়ে আমি একসময় লিখেছিলাম এখানে।
তবে এই বিশেষ দিকটির বাইরেও নিঃসন্দেহে সক্রেটিসের আরো বহু দিক আছে। আপনি যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন সেটা সত্যই গুরুত্বপূর্ণ। এরকম লেখা আরো লিখুন।
@অভিজিৎ,
হ্যাঁ, গ্রীক দার্শনিকদের মধ্যে প্রি-সক্রাটিকদের কথা কম শোনা গেলেও তাঁদের অনেকেই সম্ভবত মহত্তর ছিলেন।
তবে গ্রীক দার্শনিকদের অবদান, আমার কাছে মনে হয়েছে, তাঁরা কোন একটা ইস্যুতে (যেমন গণতন্ত্র) ঠিক কি অবস্থান নিলেন সেটা নয়, বরং সেই অবস্থানে পৌঁছাতে তাঁরা যে সেকুলার পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন নবুয়ত্ব দাবি না করে, সেটা। রেনেসাঁস যুগে মাকিয়াভেলির মত।
@রৌরব, সহমত। আসলে আজ আমাদের দৃষ্টিতে গ্রীক দার্শনিকেরা যেমনই হোক না কেন, আজকের সময়টাতে এসে পৌছাতে তাদের অবদান কোনভাবেই খাঁটো করে দেখা যায় না। এরিস্টটল পড়তে গেলে আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, তিনি কিভাবে এই অবস্থান নিয়ে ছিলেন! তাঁর সময়টাতে হয়ত তাঁর বিরোধী অবস্থান তীব্রভাবে নেয়া হয়নি। কিন্তু পরবর্তীতে কিন্তু দর্শন বিজ্ঞান এগুলো থেকে ঠিকই তার প্রভাব বলয় ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। ধরে রাখার মত অ্যাট্রাকশন ফোর্সের চেয়ে বেরিয়ে আসার মত সেন্ট্রিফিউগাল ফোর্স বেশী ছিল বলেই এসেছি আমরা। ব্যাপার সেটা না, ব্যাপার হল, তিনি অ্যাট্রাকশন ফোর্স বা সেন্ট্রিফিউগাল ফোর্স তৈরী করতে তো চেষ্টা করেছেন, যার ক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়ায় আমরা পেয়েছি গতি। আর সেই জন্য নবুয়্যত দাবী না করা আসলেই মহান।
@অভিজিৎ, আপনার লেখাটা পড়ছি, রবীন্দ্রনাথকে মনে হয় কেবল সাহিত্যিক ভাবা ঠিক নয়। তার কবিতায় তার দর্শন এমন ভাবে ছড়িয়ে আছে, কবিতার ছন্দ ভেদ করে তাকালেই চোখে পড়ে যায়। সেক্ষেত্রে সাহিত্য বিজ্ঞানের মেলবন্ধন, দর্শন-বিজ্ঞানের মেলবন্ধনও হয়ে যেতে পারে।
মুক্তমনার লেখাগুলো আমি সবসময় সময় হাতে নিয়ে পড়ি, অনেক লেখা আছে, পড়ার অপেক্ষায় বসে আছি, আপনার এবং আরো অনেকের লেখাগুলো ধীরে ধীরে পড়ে শেষ করতে হবে।
বন্যা আপু এবং আপনার দুইজনের কথাতেই বিজ্ঞানের দর্শন বইটার ব্যাপারে বেশ আগ্রহ জাগছে।
জওশন আরা,
আপনি দর্শনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়ে লিখেছেন। মুক্তমনায় দর্শন নিয়ে খুব বেশী লেখা দেখা যায় না, আশা করি, আপনি আরো বেশী করে এসব বিষয় নিয়ে লিখবেন।
আমরা সক্রেটিস সম্পর্কে বেশী কিছু জানি না, যা জানি তা প্লেটোর মুখ থেকেই। সক্রেটিসই মনে হয় দর্শনের ইতিহাসের প্রথম বলি। সক্রেটিস সম্পর্কে খুব বেশী কিছু জানি না দেখে বেশী কিছু বলছি না।
কিন্তু প্লেটো এবং এরিস্টটলের কাজ এবং তাদের দার্শনিক, রাজনৈতিক দৃষ্টিভংগিগুলো বোঝা খুব জরুরী। আর প্লেটোই যদি সম্পূর্ণ সক্রেটিস হয় তাহলে সক্রেটিসকে বুঝতে হলে প্লেটো এবং সেই সাথে এরিষ্টটলকে বোঝাও অপরিহার্য হয়ে ওঠে। গ্রীক দর্শনে দু’টো দিক ছিলঃ ডেমোক্রিটাস, লিউসিপ্পাসেরা পীথাগোরাসের বস্তুবাদী সংখ্যাতাত্ত্বিক দিকটিকে গ্রহণ করেন, অন্যদিকে প্লেটো, এরিষ্টটল ( সম্ভবত সক্রেটিসই) অতীন্দ্রিয় এবং ভাববাদী দিকটিকেই ভিত্তি করে আগান। আয়োনীয় দার্শনিকেরা যে ডায়নামিক বিশ্বজাগতিক দর্শনের কথা বলে গেছিলেন পরবর্তীতে প্লেটো এবং এরিষ্টটল ঠিক তার বিপরীতে অবস্থান নিয়েছিলেন এবং এদের দর্শনই পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তার করে। প্লেটোর ভাববাদী দর্শনই কিন্তু পরবর্তীতে একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোর ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। এরিষ্টটলের স্থবির বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গিও পরবর্তীতে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রাকে টুটি চেপে ধরেছিল। তিনি স্থির বিশ্বজগতে বিশ্বাসী ছিলেন – ‘এখন যেমনটি আছে চিরকাল তেমনটিই ছিল’।বিজ্ঞান যত এগিয়েছে ততই কিন্তু প্লেটো এবং এরিষ্টটলকে নতুন করে মূল্যায়ন করার প্রয়োজন পড়েছে। বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছিলেন, ‘ almost every serious intellectual advance has had to begin with an attack on some Aristotelian doctrine; in logic, this is still true at the present day”। সে জন্যই অনেকেই বলেন যে ব্রুনোর মৃত্যর পিছনে খ্রিষ্ট ধর্ম নয় বরং প্লেটো এবং এরিষ্টটলের দর্শনই দায়ী।
এদের মূল কাজগুলো পড়তে পারলে তো ভালোই না হলে আপনাকে শহিদুল ইসলামের লেখা বিজ্ঞানের দর্শন বইটি পড়ে দেখতে অনুরোধ করবো। যে ডি বার্নাল এবং রাসেলের বেশ কিছু লেখাতেও এই দিকটি ভালোভাবে ফুটে উঠেছে। দর্শন আমি খুব কম বুঝি, ভবিষ্যতে সময় পেলেই এদিকটা নিয়ে পড়াশোনা করার ইচ্ছে আছে।
@বন্যা আহমেদ, আপু, দর্শনে আমার আগ্রহ ভালোই কিন্তু এইদিকে আমি বলতে গেলে নতুনই। আমিও একে একে চাচ্ছি, আগ্রহ মিটিয়ে আরো এগিয়ে যেতে।
প্লেটোর সব লেখা আছে এখানে
আমি শহীদুল ইসলামের বইটা অবশ্যই পড়ব। আপনার মন্তব্য আমার দারুন লেগেছে। 🙂
লেখাটা খুব ভাল হয়েছে দারুণ লেগেছে। সুন্দর লেখার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
জ্ঞানের অতৃপ্তি থাকা ভালো । এতে জ্ঞান আরও বাড়ে । তবে নিজ জ্ঞানের ঘাটতি খুঁজে বেড় করতেও জ্ঞানের প্রয়োজন । জ্ঞান যেহেতু ধ্রুব নয় , জ্ঞানকে সবসময় হালনাগাদ করা প্রয়োজন। তা না করলে , জ্ঞানের বদলে শুধু আত্মবিশ্বাসই বাড়বে ।
@সংশপ্তক, খাঁটি কথা বলেছেন।
:yes:
@ফারুক, 🙂
হাসান আজিজুল হক আমাদের দেশের একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লেখক। বেশ কয়েক বছর আগে তাঁর লেখা ‘সক্রেটিস’ বইখানা আমিও পড়েছিলাম। সহজ ভাষা ভঙ্গিতে তিনি অসাধারণ করে তুলে ধরেছেন মানবেতিহাসের এই মহান ব্যক্তিত্বকে। পরে তাঁর মুখেই শুনেছি, ছাত্রদের সক্রেটিস পড়াতে পড়াতে একদিন মনে হলো একখানা বই লিখলে কেমন হয়।
শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, এর বাইরে আমাদের মতো ছাত্রদের জন্যেও বইখানা উপযোগী হয়ে উঠেছে।
লেখাটার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।
@হাসানআল আব্দুল্লাহ, ধন্যবাদ আপনাকেও। সহজপাঠ্য যেকোন কিছু, যা হাতে নিয়ে পাঠকের মনে হবে না, এটা বোঝা কঠিন, তা কারোর না কারোর কাজে লাগেই। অন্তত গভীরে যাবার আগে হাতেখড়ি দরকার। 🙂
যীশুর বেলাতেও মনে হয় তাই!
মুসার বেলায়?
লেখাটায় আলোর ঝলকানির পরশ পেলাম!
@লাইজু নাহার, যীশু মুসায় এতো বেশি অতিরঞ্জন দেখি, চিন্তার স্বাভাবিকতার খেই হারিয়ে ফেলি। হাজার হলেও সক্রেটিস মানুষ, বড়জোর দার্শনিক। আর নবীদের ব্যাপারটা আসলে ঈশ্বর আর মানুষের প্রচলিত ধারণার মিথস্ক্রিয়া হয়ে গেছে।
ব্যাপারগুলো হয়ত একিরকম হয়ে যেতো, যদি মন্দিরে ডেলফির দৈববাণী সরাসরি সক্রেটিসকে দেয়া হত অথবা সক্রেটিস দৈববাণী খন্ডনের পিছনে না ছুটতেন। দৈববাণী খন্ডন করা যেতে পারে, এমন একটা সন্দেহ অন্তত তাঁর ছিল।
অসাধারন। অসাধারন আপনার লেখনী। খুবই চমৎকার লাগল আপনার চিন্তা ভাবনার কথা শুনতে।
প্রত্যেক মানুষের আলাদা আলাদা জীবন দর্শন থাকাটাই স্বাভাবিক। এবং এটাকেই আমরা স্বকীয়তা, বৈচিত্রতা বলতে পারি। কিন্তু আমি কখনই বলি না আমি কিছুই জানি না। এই কথাটা আমার কাছে অপ্রয়োজনীয় বিনয় মনে হয়। আমি সত্যিকার ভাবেই জানি যে আমি কিছু অন্তত জানি। আবার এও জানি যে অনেক কিছুই জানি না। তাহলে আমি কেন বলব আমি কিছুই জানি না? এটা আসলে বিনয় ছাড়া কিছুই নয়।
আবার প্রত্যেকের উপলব্ধি আলাদা ধরনের এটাও আমি মানি। সে জন্যই আপনার লেখাটা খুব ভালো লাগল। চালিয়ে যান। :yes: :yes:
চমৎকার পরিবেশন। মুগ্ধ হলাম, বিশেষ করে,
আমার অনার্স ছিল রাস্ট্র বিজ্ঞানে। প্লেটো, হবস,লক,রুশো একসময় পড়তে হত পরিক্ষা দেবার জন্য।অনেকদিন পর আসলেই উপলদ্ধি করছি কি পড়েছি,কতোটুকু মনে আছে,বা নেই। লিখে যান আরো। আপনার জন্য থাকল :rose2:
@আফরোজা আলম, উপলব্ধিটুকুর আলো ছড়িয়ে দিন না। ভালো লাগবে। 🙂
@সাইফুল ইসলাম,
সক্রেটিস কিন্তু বিনয় প্রকাশের জন্য কথাটা বলেন নি,
অজ্ঞতাই জ্ঞানের চাবিকাঠি, এই অর্থে মনে হয় কথাটা বলেছিলেন।
@ইরতিশাদ ভাই,
আমি অবশ্যই সক্রেটিসকে ঐ কথা বলিনি। সে সাহসও আমার নেই।
আমি বলেছি আমাদের মত সাধারন মানুষের কথা। যারা অকারনেই অতিবিনয়ী হয়ে পড়ে। 🙂
@সাইফুল ইসলাম,
একমত। অতিবিনয় ভাল নয়।
@সাইফুল ইসলাম, শিক্ষানবিশীর কাল পেরিয়ে যেদিন কিছুটা পরিণত হব, সেদিন হয়ত ভাবতে পারব, কিছু পড়েছি, পড়ে কিছু জেনেছি। ক্লান্ত হয়ে যখন হাতের বইটা বন্ধ করে অথবা কম্পিউটার ছেড়ে ঘুমাতে যাই, একটাই কথা মনে হয়, অনেক বাকি। 😕
@জওশন আরা,
গ্রীসের একনায়ক ডায়নোসিয়াস দার্শনিক এরিস্টিপাসকে প্রশ্ন করেছিলেন,দার্শনিকগন কেন বিত্তবানদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায়,অথচ ঐশ্বর্যশালীরা দার্শনিকদের খুজে বেড়ায় না।দার্শনিক এরিস্টিপাস জবাব দিয়েছিলেন,দার্শনিকগন জানেন তারা কি চায় কারন তারা জ্ঞানী,কিন্তু ধনীরা যেহেতু জ্ঞানী নয় তাই তারা জানেনা তারা কি চায়।
জ্ঞান অর্জনের দুইটা দিক রয়েছে একটি হচ্ছে নিজের সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারনা অর্জন আরেকটি হচ্ছে এর প্রায়োগিগ দি্ক,আমার মনে হয় দুই টাই বেশ গুরুত্তপূর্ন এবং একে অপরের সহায়ক হিসেবে কাজ করে।আপনার তখন মনে হবে,আপনি কিছু জেনেছেন যখন আপনি নিজের সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারনা পেতে শুরু করবেন,তার আগে নয়…আর জ্ঞান অর্জনের পথে পা বাড়ালে এই স্বচ্ছ ধারনা পাওয়ার ব্যাপারটা যে কোন সময় ঘটতে পারে…কারন আপনি হয়ত অনেক কিছু জানতে পারবেন কিন্তু বিষয় গুলি ততক্ষন পর্যন্ত ভালো ভাবে উপলব্দি করতে পারবেন না যতক্ষন পর্যন্ত না আপনি নিজে ব্যাক্তিগত ভাবে কিছু অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাবেন।সে জন্য আপনাকে অনেক বেশি মানুষের সংস্পর্শে আসার চেষ্টা করতে হবে…।যদি নিজের জীবনে এই ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ না থাকে তবে আপনি সমাজের বা সাধারন মানুষের সমস্যা গুলিকে নিজের মনে করে এগিয়ে যেতে পারেন………এই গুলি আসলে আমার নিজের ধারনা তাই ভুল হতেই পারে।
আপনার লেখা খুব ভাল হয়েছে,ধন্যবাদ।
@রনি, ধারণায় কি ভুলের কিছু থাকে, যদি না সেখানে তথ্যের গন্ডগোল থাকে? আপনি যা বলেছেন তা তো ঠিকই, নিজের সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না জন্মালে ব্যক্তিগত দর্শন এবং বিশ্লেষনের উপরে আত্মবিশ্বাস আসে না। সেই স্বচ্ছ ধারণা অর্জনের জন্য অনেক মানুষের সাথে মেশা, চারপাশের জগতটাকে পর্যবেক্ষন করা, অনেক পড়া, অনেক ভাবা এগুলো দরকার আছে আসলেই।
লেখার সহজীয়া ভঙ্গিটি ভালো লাগলো। চলুক। :yes:
@বিপ্লব রহমান, ধন্যবাদ 🙂