প্লেটোর ডায়ালগ গুচ্ছ এক এক করে পড়ার আগে চেয়েছিলাম সক্রেটিস সম্পর্কে নিজের মধ্যে একটা সাধারণ ধারণা তৈরী করে নিতে। চেয়েছিলাম মানব ইতিহাসের অন্যতম নির্ভীক মানুষটির স্বরূপ প্লেটোর দৃষ্টিভংগীর বাইরে গিয়ে কিছুটা উদ্ঘাটন করতে, প্লেটো আমার মনে প্লেটোর সক্রেটিসকে বসিয়ে দেবার আগেই। সেই উদ্দেশ্যেই হাতে নিয়েছিলাম হাসান আজিজুল হকের ‘সক্রেটিস’ (সক্রেটিসকে নিয়ে এরিস্টোফেনিস, প্লেটো, জেনোফোনের লেখাগুলোর ভিত্তিতে)। সফল হয়েছি, সে দাবী করিনা। কারণ সক্রেটিসের পরিচয় মূলত আমরা পাই প্লেটোর কাছ থেকেই। এমনকি এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না, সক্রেটিস চরিত্রটি সম্পূর্ণরূপেই প্লেটোর এক অনবদ্য নিপুণ সাহিত্য কর্ম। সেই সময়ে যেহেতু ফিরে যেতে পারছি না, তাই এ কথাও আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়, সক্রেটিস কতটা বাস্তব আর কতটা শিল্প। যদি কোনদিন সেই রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব হয়, তাহলে হয়ত দেখা যেতে পারে, সক্রেটিস, সক্রেটিস নয় বরং প্লেটোই হল সম্পূর্ণ সক্রেটিস, যে নিপুনভাবে তার সৃষ্টির অন্তরালে আড়াল করে রেখেছে আপন ব্যক্তিস্বত্তাকে, অন্তর্গত দর্শনটুকু দিয়ে জীবন্ত করেছিল কেবল সক্রেটিসকে। অথবা সত্যিই ছিল সক্রেটিসের দর্শন, যার জন্য আমাদের প্লেটোর উপর নির্ভর কথা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। হয়ত সক্রেটিস কিছুই জানেন না বা তার কোন মতাদর্শ নেই বলেই একটি অক্ষরও লিখে যাননি আমাদের জন্য, তাই আমাদেরও তাকে খুঁজে পেতে চোখ বন্ধ করে ঝাপ দিতে প্লেটোর আগুনে।

‘সক্রেটিস’ বইটা পড়তে গিয়ে অনেক জায়গায় কেবল চোখ বুলিয়ে গেলেও একটা জায়গায় এসে আটকে গেল মনখানা।

“তাঁর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলোঃ ‘মানবজাতির নৈতিক উন্নতি সাধন। এ কাজ তো আর নৈতিক উপদেশ বিতরণ করে হয় না, একমাত্র ব্যক্তিগত যোগাযোগ স্থাপন এবং মানুষকে তাদের নিজেদের মুখোমুখি হবার কাজে প্রবৃত্ত করার ভিতর দিয়েই এটা হতে পারে।’ এই জিনিসটাকেই আত্মজ্ঞান বলা হচ্ছে। নিজের ভিতরটা খোঁড়াখঁড়ি করা, ভিতরে যা কিছু আছে তার সবটাই বুদ্ধি ও যুক্তির পরিষ্কার আলোতে মেলে ধরা। সক্রেটিস কিন্তু কারোর হাতে আত্মজ্ঞান তুলে দিতে পারেন নি- কোন প্রশ্নেরই চূড়ান্ত জবাব দেবার চেষ্টা করেন নি। তাঁর কোন সুসম্পূর্ণ দর্শনও নেই। কারণ তিনি জানতেন, তিনি কিছুই জানেন না। তিনি শুধু মানুষকে সংক্ষুব্ধ করে তুলতে পারতেন, বিরামহীন জিজ্ঞাসার যন্ত্রণায় তাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিতেন। তার সাথে কথা শুরু করার কিছুক্ষনের মধ্যেই যে কোন জ্ঞানগর্বিত মানুষের অহঙ্কার খসে পড়তো, তার ভিতরে দৈন্য প্রকাশ পেয়ে যেতো, তিনি তখন উপলব্ধি করতে পারতেন, যেসব ধ্যান-ধারণা, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, মত, সংস্কার নিয়ে তিনি এতোকাল জীবন কাটিয়ে এলেন, তার কোন কিছু সম্বন্ধেই তার স্পষ্ট জ্ঞান নেই। তিনি সুন্দর সুন্দর বলে চেঁচিয়ে মরেছেন, কিন্তু জানেন না, ‘সৌন্দর্য বলতে কি বোঝায়’; তিনি সারাজীবন ন্যায়-অন্যায় ভালো-মন্দের উপর নির্দ্বিধায় রায় দিয়ে এসেছেন অথচ ‘ন্যায়’ সম্পর্কে, ‘ভালো’ সম্পর্কে তার আদৌ কোন পরিষ্কার ধারণা নেই। উত্তম বা আদর্শ জীবন কাটাচ্ছেন বলে হয়তো অহমিকা প্রকাশ করে এসেছেন, কিন্তু সক্রেটিসের দুটো প্রশ্ন থেকেই ধরা পড়ে যাচ্ছে যে জীবনের ‘উত্তম’ সম্বন্ধে তিনি কোন তিনি কোন ধারণা গড়ে তুলতে পারেননি। অতএব সক্রেটিসের সাথে আলাপের পর জ্ঞানগর্বিত ব্যক্তিটির মনে দেখা দিতো এক প্রচন্ড লজ্জাবোধ, অজ্ঞানতার মধ্যে ডুবে থাকার লজ্জাবোধ, কিছুই না জেনে বাগাড়ম্বরকে প্রশ্রয় দেয়ায় লজ্জা, দেখা দিতো একধরণের হীনতার উপলব্ধি। তা ঐ অজ্ঞানতা সম্বন্ধে সচেনতা থেকেই জন্ম নিতো। মানুষটি তখন পড়ে যেতেন এক রকম আত্মিক সঙ্কটের মধ্যে। তাই বলা চলে যে মানুষের অস্তিত্বের গভীরে প্রলয়ংকরী ঝড় সৃষ্টি করার অন্য নাম ছিল সক্রেটিস। এই প্রচন্ড আলোড়নই শেষ পর্যন্ত জাগিয়ে তুলতো প্রবল জীবনতৃষ্ণা, জীবনের শ্রেষ্ঠতার বোধ এবং শ্রেয়কে অনুসন্ধান ও প্রাপ্তির ক্ষান্তিহীন বাসনা।”

এই যদি হয়ে থাকে সক্রেটিস, বাস্তব হোক আর প্লেটোর নিপুন শিল্প হোক, সক্রেটিসকে গুরু মানলাম। সক্রেটিস সহস্রাব্দান্তরের জলন্ত অগ্নিগর্ভ নক্ষত্র। আজ পর্যন্ত কাউকেই ঠিক পূজনীয় ভাবতে পারলাম না সম্পূর্ণভাবে। এই যে সক্রেটিসকে গুরু মানলাম, তবু জানি, সক্রেটিসের বা প্লেটো-সক্রেটিসের ঈশ্বরের সাথে আমার ঈশ্বরের তফাত সুবিশাল, সক্রেটিসের সামাজিক জীবন আমার জন্য অনুকরণীয় নয়। ব্যক্তিগত জীবনে, আমি অনেকটা সময় পার করেছি এক না বলা আত্মিক সঙ্কটে। কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করে, কোন একটা বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত মতামত কি, তখন উত্তর দেবার আগেই আমি পড়ে যাই সেই সঙ্কটের মুখোমুখি। আমি জানি, আমার নিজস্ব একটা চিন্তা আছে, আছে মতামত, কিন্তু সেই চিন্তাপ্রসূত মতামতকে অন্যদের চেয়ে শ্রেয় অথবা আমৃত্যু স্থায়ী বলে আমি নিজেই মানতে পারিনা। অন্যকারোর কাছে তাই মত প্রকাশে আমার চরম ভিতী। আমার স্বত্তার ভিতরে প্রতিদিন চলে ধারণার ভাঙ্গাগড়া। আমি যখন পড়তে বসি, তখন আমার স্বত্তা হয়ে যায় লিখিত সঙ্কেতের সাথে একাত্ম। যখন চিন্তা করি, তখন আমার মস্তিষ্কে চলে অনুরণন। এই মুহূর্তে হয়ত আমি যা ভাবছি, দুইদিন পরে হয়ত, সেই ব্যাপারে তুলনামূলক ভাবে পরিণত কোন সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারি। কিন্তু দুমাস পরেই হয়ত অন্য কোন দৃষ্টিভংগীর অন্য কোন সত্য অথবা তথ্য আমার সেইদিনের চিন্তাটাকেই আমূল উল্টে দিয়ে যাবে। এই আত্মিক সংকটই আমার মধ্যে জন্ম দিয়েছে আমার আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতায় বিশ্বাস। আমি সর্বোচ্চ এটুকু বলতে পারি, আমি জানতে চেষ্টা করি, উপলব্ধি করতে চেষ্টা করি। তাই আমি বিচরণ করে বেড়াই নিউরোসাইন্স, সাইকোলজী, বিবর্তনবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, মেডিক্যাল সাইন্স, দর্শন, সাহিত্য ইত্যাদি ইত্যাদি, যা আমার ভালো লাগে। এই বিচরনের মধ্যিপথেই মাঝে মাঝে আবিষ্কার করি, নিউরোসাইন্সের সাথে পদার্থবিদ্যা আর বিবর্তনবিদ্যার কি গভীর যোগাযোগ। সাইকোলজীর সাথে নিউরোসাইন্সের! দর্শনের সাথে বিজ্ঞানের, মানব সভ্যতার ইতিবৃত্তের! আমি বিস্মিত হই। কিন্তু কখনোই উপলব্ধি করতে পারিনা, আমি কিছু জানি।

আমি আসলে মহাজাগতিক ভ্রমনকারীর মত এক জাগতিক জ্ঞানের জগতেরও ভ্রমনকারী কেবল। হয়তো কোনদিনও আমার মনে হবে না, আমি জানি। সমস্ত জীবনব্যাপী রয়ে যাব শিক্ষানবীশ। আর রবে জানার প্রতি এক অগাধ তৃষ্ণা। এই যদি হয় জীবন, আর কারোর না হোক আমার জীবন, মন্দ কি? তাও তো বারবার নিজের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে বলে জানি, জানি মানব মনের অনন্ত সঙ্কটের কথা। দাঁড়িয়ে আছি এটুকু জেনেই।