একটি আজগুবি গল্প


সাত দিন হল বড় সাহেব অফিসে আসেন নি।আছিয়া আজও অনেক্ষণ বড় সাহেবের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে।নিজের পেটের দিকে কয়েকবার তাকায় সে।“ধভিশাপ!”-বিড় বিড় করে বলে আছিয়া।মন্থর গতিতে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে যায়; টয়লেট গুলোর যে অবস্থা তাকালেই খিঁচিয়ে বমি বের হয়ে আসে।এদিক-ওদিক খুব একটা তাকায় না আছিয়া। টয়লেটের কপাট লাগিয়ে পাজামার ফিতা ঢিলা করে ওখানটাতে হাত দিয়ে দেখে-মাসিক হওয়ার ডেট এক সপ্তাহ পার হতে চলল।মাসিকের সময় তলপেটের ব্যথায় কুঁকড়ে যায় আছিয়া।এই ব্যথাটাই প্রতি মাসে তাকে কত শত দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেয়।এইবার এত দেরি হওয়া দেখে আছিয়ার ভেতরটা একবারে শুকিয়ে গেছে।বাথরুমের কপাট খুলতেই কে বা কারা যেন দ্রুত সরে পড়ে।আছিয়া বেশ ভালো করেই বোঝে মহিলাদের বাথরুমের পাশে এই সব পুরুষরা কেন এত ঘুরঘুর করে।

কাজে ফিরে যায় আছিয়া।সহকারী মহিলারা কি যেন একটা বিষয় নিয়ে হাসাহাসি করছিল, আছিয়া দেখে থেমে গেল।
“রুপ আর গতর থাকলে কি আর এখানে পড়ে থাকি !”- চোখ টিপে এক মহিলা বলল ।
“আমি তো আর কম চেষ্টা করলাম না।বড় সাহেবের চোখ কি আর যেখানে সেখানে পড়ে !” – অন্য একজন বলল।
বড় সাহেবকে আসতে দেখে সকলে মনোযোগ দেয় কাজে।অফিসের বড় সাহেব শমসের হাজী, গতবছরে একটা হজ্জ করে নামের শেষে ঘটা করে হাজী শব্দটা লাগিয়েছেন তিনি, বেশ কিছুক্ষণ ওদের কাজ পর্যবেক্ষণ করলেন।
এই শোনো মেয়েরা, মহিলা বিষয়ক মন্ত্রি রাহেলা আক্তার আমার খুব কাছের মানুষ।তাঁর নির্দেশে একটা সংস্থা গার্মেন্টস মহিলাদের সার্বিক অবস্থা নিয়ে জরিপ চালাচ্ছে।আমার এখানেও আসবে।নেগেটিভ কোনো কথা যেন আমি না শুনতে পাই।ঢাকায় একটা কাজ খুঁজে পাওয়া যে কত কঠিন তা নিশ্চয় সকলের জানা আছে! কথাগুলো বলতে বলতে বড় সাহেব চেম্বারের দিকে পা বাড়ালেন।


ঐদিন আর বড় সাহেবের সাথে দেখা হয় না আছিয়ার।রাত দশ টার দিকে ঘরে ফেরে সে।বস্তির এক কক্ষে ওরা ১৪ জন থাকে।আছিয়া থাকে রাধার চৌকির তলে।চৌকিতে থাকে রাধা আর রাধার তিন মেয়ে।চৌকির যা অবস্থা কবে ভেঙ্গে না পড়ে! ঘরে ঢুকেই টয়লেটে যায় আছিয়া।পানি নেই।পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে তার।পুরানো একটা শাড়ীর এক পাশ ছিড়ে টয়লেটে প্রবেশ করে সে।এই পরিস্থিতির সাথে এখানকার সকলেই অভ্যস্থ্।পানি না থাকার কারণে টয়লেটের মুখ মলে ভরে গেছে।কাজ সারতে সারতে বমি করে ফেলে আছিয়া তারপর বাথরুম সেরে চৌকির তলে ঢুকে যায় ।সকালে কাজে যাওয়ার সময় পিওন একখান চিঠি দিয়েছিল; আছিয়া জানে চিঠির বক্তব্য কি।এখানে আসার পর থেকে একই চিঠি বার বার পড়ে আসছে সে –
“মা আছিয়া,
তোর বাবার শরীর ভালো নেয়।ঔষধ কিনতে আরো টাকা লাগবে। তুই যা পাঠাস তাতে তোর বাপের কিছুই হয়না।তুই তো জানিস কত কষ্টে আমি সংসার চালাই।এবার পারলে কিছু ধরে পাঠাস।আর শরীরটার যত্ন নিস।
ইতি
তোর চাচা।”
শরীরটার যত্ন নিস? শালা জুয়াখোর-মাতাল! চাচাকে গালি দিতে দিতে চিঠিটা খোলে আছিয়া।একবার চোখ বুলিয়ে মাথার কাছে রেখে দেয় সে।রত্নার ছেলে দুইটা এই যে শুরু করলো, সারারাত চলবে ওদের কান্না। রত্নার শুকনো বুকে মুখ লাগিয়ে কাঁদতে থাকে বাচ্চা দুটো আর রত্না অঘোরে ঘুমায়।আছিয়া নিজের বুকে হাত দিয়ে অনুভব করে এখনো শুকাইনি সে।চিঠিটা আবারো পড়ে।
“আছিয়া ঘুমালি নাকি ?” চৌকির ওপর থেকে জিঙ্গেস করে রাধা।
“না।”উত্তর দেয় আছিয়া।
“এখনো তো মাস পুজতে দিন দশেক বাকী! বাড়িতে কি পাঠাবি রে?”
“আর পাঠাতে হবে না দিদি!”
“মানে ? ওইটা তাইলে কার চিঠি?”
“মুক্তির চিঠি! এখন আমি মুক্ত দিদি! আমার আর কোন পিছুটান রইল না।”
“কবে মরেছে চাচা?”
“গেল হপ্তায়।”
“তোর তো একবার বাড়ি যাওনের দরকার!”
“যাব না, কি হবে গিয়ে! কার কাছেই বা যাবো!”
“হুম, ঘুমা এখন। ভোরে আবার উঠতে হবে।এই মাগিরা চিৎ হয়ে শুস্ কেন, কাত হয়ে শো।” রাধা মেয়েদেরকে গুতিয়ে গুতিয়ে নিজের জায়গা করে নেয় একপাশে। অন্যদিকে চেচিয়ে ওঠে মরিয়ম, “এই হারামজাদি রত্না, ছেলে সামলা বলছি। আমার বাচ্চা কি খাবে শুনি?” আছিয়া আর কোন শব্দ করে না। চাটায়ের ছিদ্র দিয়ে পাশের বিল্ডিং থেকে এক ছটা আলো আছিয়ার মুখের ওপর এসে পড়ে। মাঝে মধ্যে ঘুম না আসলে আছিয়া ঐ ছিদ্র দিয়ে সামনের বিল্ডিংটির দিকে তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে। ঢাকা শহরের বিল্ডিংগুলো নাকি খুবই নড়বড়ে।একটা যুৎসই ভুমিকম্প হলেই সব হুড়মুড় করে ধসে পড়বে আছিয়াদের উপর, মনে মনে প্রায়ই ভাবে আছিয়া।আছিয়া মুখের ওপর কাপড় টেনে নেয় : ঘুমানোর চেষ্টা করে আপ্রাণ। এই এক ছটা আলো ঘুমাতে দেয় না তাকে। আছিয়া উপুড় হয়ে চাটাইয়ের ছিদ্র দিয়ে বিল্ডিংটির দিকে তাকিয়ে থাকে। বড় সাহেব এরকমই উঁচু এক বিল্ডিং-এ থাকেন, ভাবে আছিয়া। কত ব্যবধান এখন ওদের মাঝে! অথচ বড় সাহেবের চেম্বারে, দেহের কাপড় গলে পড়ার সাথে সাথে এই ব্যবধান কোথায় যেন উবে যায়। আছিয়া বিস্মিত হয়ে পরখ করে তার দেহের শক্তি। কি আছে এই মাংসে-নিজের অজান্তেই তার হাত চলে যায় বুকে।

আছিয়া ঐ বিল্ডিং এর আলোয় চিঠিটা আবারো পড়ে। আজ আছিয়ার নিজেকে খুব বেশি একা মনে হচ্ছে। দুঃখের না হউক সুখের ভাগ বসানোরও যে আর কেউ রইল না তার । চার বছর হল বাবাকে দেখেনি সে, অনুভবও করেনি খুব একটা। পৃথিবীর কোন এক প্রান্তে কেউ তার জন্য অপেক্ষা করছে এই বিশ্বাসটাই তার একমাত্র সঙ্গী ছিল এতদিন। এই বিশ্বাসটুকু বাদ দিলে বাবার থাকা না থাকার কোনো মূল্যই নেই না আছিয়ার কাছে।


বড় সাহেব ব্যবসায়ের কাজে এক মাসের জন্য দেশের বাইরে চলে যায়, দেশে ফিরলে তার সাক্ষাৎ পেতে আরো একমাস কেটে যায় আছিয়ার ।
“স্যার আমি আপনার সন্তানের মা হতে চলেছি,”- বড় সাহেবের পা ধরে বলে আছিয়া।
“বেশ তো, বাচ্চা ফেলে দে।”- বড় সাহেব পা সরিয়ে নিয়ে বলেন।
“কিন্তু স্যার, ও ছাড়া আমার আর কেউ নেয়! ওকে যে আমার বড় দরকার!”
“তাহলে কিছু টাকা নিয়ে কেটে পড় এখান থেকে।”
“আপনি না আমাকে বিয়ে করার কথা বলেছিলেন?”
“আমি তো তোকে বুদ্ধিমান ভাবতাম। এখন দেখছি তুই খুবই বোকা!”
“স্যার ওর পরিচয়টা দিয়ে দিন, আমি কথা দিচ্ছি অনেক দূরে চলে যাবো, আপনার কাছে আর আমার কিছুই চাওয়ার থাকবে না।”
বড় সাহেব মিটিং এর অজুহাতে অফিস থেকে বের হয়ে যায়। পরের সপ্তাহে বড় সাহেবকে ব্লাক মেল করার অভিযোগে গার্মেন্টস থেকে বের করে দেওয়া হয় আছিয়াকে। রাধা সব শোনার পর আছিয়াকে গর্ভপাত করানোর জন্য অনুরোধ করে। বিভিন্নভাবে বোঝায় সে কিন্তু কিছুতেই রাজি হয় না আছিয়া। এই অনাগত শিশুই তার একমাত্র আপনজন, একে সে কোনভাবেই হারাতে চায় না। ঢাকায় কোন ঠাঁই খুঁজে না পেয়ে ফিরে যায় গ্রামে চাচার কাছে। চাচার কাছেও আশ্রয় হয় না। তার অন্ত:সত্ত্বা নিয়ে গ্রামের মোড়ে মোড়ে জটলা পাকে। একপর্যায়ে শালিস ডেকে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া হয় আছিয়াকে। নিরুদ্দেশ হয় আছিয়া।

বছর যেতে না যেতেই পরিচিত সকলেই ভুলে যায় আছিয়ার কথা। তাই বলে আছিয়ার জীবন থেমে থাকে না। এই সভ্যতার অন্য কোনো প্রান্তে সংগ্রাম চালিয়ে যায় আছিয়া। বছর তিনেকের মাথায় দিনাজপুরের এক জেলে কে যেন প্রথম আবিষ্কার করে আছিয়াকে। যে সস্তানকে ধারণ ও লালন করার অপরাধে তাকে সমাজচ্যুত করা হয়েছিল একদিন, সেই সন্তানকে খুন করার সুবাদে তাকে আবার সমাজে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।


যতদূর জানা যায়, আছিয়া বাঁচতেই চেয়েছিল এবং বাঁচাতে চেয়েছিল তার সন্তানকে, হয়ত এ জন্যই…!

## গল্পটি গতকাল লেখা। আপনাদের কমেন্টের উপর ভিত্তি করে আরো কয়েকবার এডিট করা হবে। দয়া করে মন্তব্য করবেন।