আজকের এই লেখায় কিছু অর্থহীন অদরকারী কথাবার্তা সবার সাথে ভাগবাটোয়ারা করব। অর্থহীন বলছি এই কারনে যে, এসব কথাবার্তা এই ব্লগে প্রতিনিয়ত এত এত উঠে আসছে যে নতুন করে বলার মত কিছু আছে কিনা তা আমার জানা নেই। তবুও বলি, নিজের কথা গুলো নিজের মত করে বলার চেষ্টা করি।

আমি কেন অবিশ্বাসী? অবিশ্বাসী হবার পর থেকে এ প্রশ্ন অনেকবার মাথার ভেতর দিয়ে আসা যাওয়া করেছে। প্রশ্নটা উলটো করে বললে হয় যে- আমি কেন বিশ্বাসী না? এ প্রশ্নের পেছনে অনেকের অনেক রকম চিন্তা ভাবনা ও অনেক রকম উত্তর থাকতে পারে। আমার উত্তর খুব সহজ। তবে উত্তর জানার আগে আসুন ইকটু আমার অতীত ঘুরে আসি। অর্থাৎ অবিশ্বাসী হবার অতীতকথন।

ছোটবেলায় আমি খুব একটা চঞ্চল ছিলাম না। এখন নই। ছোট বেলা থেকেই নিজের মত নিজে চিন্তা ভাবনা করতে আর যুক্তি তর্কে আসতে আমার ভালো লাগত। ছোট থেকেই কম বেশি বই পড়তাম। ধর্মকর্ম এত বেশি না করলেও ক্লাস ৫ এ এসে চার ওয়াক্ত করে নামাজ পরা ধরি হঠাৎই। তবে তখন বেহেশত দোজখ এত কিছু চিন্তা করে পড়তাম না। পড়াশোনা করার মত নামাজও পড়তে হয় এ ধরনের ভাবনা থেকেই পড়তাম। বেহেশত দোজখের ভয় বা ভাবনা আমার পরিবার থেকে তখনো মাথাইয় দেয়া হয় নি। এই ক্লাস ৫-৬ টার্মটা অন্য কারনে গুরুত্ব পূর্ন। এসময় আমার বড় খালার বাসায় বেড়াতে গিয়ে বেশ কিছু ধর্ম মূলক বই আমি নিজে থেকে নিয়েই ঘেটে পড়ে দেখি। এরপর প্রায় এ ধরনের বেশ কিছু বই টানা আমি পড়ি। বইগুলোর নাম ধাম এখন পুরো পুরি মনে নেই। কিছু কিছু মনে আছে- বেহেশত দোজখের বর্ননা,আদম ও শয়তান, ইসলামের অতি আশ্চর্য জনক ঘটনা সমূহ এবং আরো বেশ কিছু বই। তখন ওগুলো পড়ে কোন কোন ক্ষেত্রে মজা পেলেও প্রায় সরল মনে সব গুলো ঘটনা আর কথা্বার্তাই বিশ্বাস করে নিয়েছিলাম। তবে তখন সেগুলো পড়ে কোন লাভ না হলেও পরবর্তি সময়ের টার্নিং পয়েন্টে ঐ বই গুলোর ভেতরের কথাবার্তা আমার রাস্তা অনেক পরিস্কার করে দিয়েছিল। কারন আগে থেকেই যদি আমি ব্যপারগুলোর সম্পর্কে ভালোভাবে না জানতাম তবে সময়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে হত। যা হোক, ক্লাস সিক্সের শেষের দিকে সম্ভবত আমার প্রথম বারের মত হঠাৎ চিন্তা করতে করতে প্রশ্ন জাগে মাথায় যে, আমাদের যদি সৃষ্টিকর্তা থেকে থাকে তবে সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকর্তা নেই কেন? এটা ছিল ক্ষুদ্র একটা চিন্তা, যেটা আমি কাউকে জিজ্ঞাসা করতে সাহস পাইনি এবং নিজে থেকেও কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি। এরপর ক্লাস ৭ কি ৮ এ ইসলাম শিক্ষা স্যারের কিছু কথা আবার আমার মাথায় টোকা দেয়। তিনি বলেছিলেন যে, “তোমরা কি মনে কর মাদার তেরেসা মহত্মা গান্ধী ইনারা বেহেশতে যাবেন?” আমরা কয়েকজন বললাম,” হ্যাঁ তারা যেতে পারেন। কারন তারাতো সারা জীবন ভালো কাজ করেছেন।” স্যার বললেন,” না তারা কখনোই বেহেশতে যাবে না। কারন তারা কাফের!!! তারা ঈমান আনে নাই। তাই তারা কখনোই বেহেশতে যাবে না। নবীর উম্মাতরা দোজখে গেলেও একটা নির্দিষ্ট সময়কাল শাস্তি ভোগ করার পর তাদের বেহেশতে স্থান দেয়া হবে। কিন্তু কাফেররা অনন্তকাল দোজখের আগুনে জ্বলবে।” এই কথা তখন আবার আমার মাথায় টোকা দিয়ে যায়। আমরা তিন বেলা ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে আর কিছু না করেই বেহেশতে যাবো, খুন খারাবি করে হজ্জ করে এসে শিশুর মত নিস্পাপ হয়ে যাবো!!!! আর তারা এত এত ভালো কাজ করেও বিনিময়ে শাস্তি ভোগ করবেন!! আগে ভাবতাম সব ধর্মের ঈশ্বরই এক, শুধুমাত্র প্রার্থনার ধরন ভিন্ন। এই ঘটনার পরে ধরতে পারলাম যে সব ধর্মের ঈশ্বরও ভিন্ন ভিন্ন এবং ইসলাম ছাড়া বাকি ধর্ম গুলা ভূয়া!!! আর আরো মজা পেলাম যে এই ভেবে, আমি কিছু না করেই বেহেশতে যাবার অধিকার রাখি!! ক্লাস ৮,৯,১০ আমি যে স্যারের কাছে বিজ্ঞানের বিষয় গুলো পড়েছি ঐ স্যার ধর্ম কর্ম করতেন কম। এসব নিয়ে তার খুব একটা আগ্রহ ছিল না। তাকে যদি কোন ছাত্র কখনো এসব বিষয়ে জিজ্ঞাসা করত তখন তিনি মজা করে বলতেন,
“দোজখ কয়টা? ৭ টা। আর বেহেশত কয়টা? ৮ টা। পৃথিবীতে কাফের বেশি না মুসলমান বেশি? কাফের বেশি। তাহলে এত এত কাফের কে এই ৭ টা দোজখে রাখতে গেলে তো দোজখ ভরে যাবে!! তাই সব মুসলমান বেহেশতে যাবেই!!!”

এ কথা শুনে তখন মজা পেলেও কথাটা যে ধর্মের দিক থেকে খুব একটা মিথ্যা না তা বুঝে আনন্দ পেতাম খুব!!

ক্লাস ৭,৮,৯,১০ এই বিশাল সময়ে আউট বই পড়া হয়নি খুব একটা। কিন্তু এস এস সি পরীক্ষার পরের বন্ধে আবার পুরো দমে আউট বই পড়া শুরু করি। দম বন্ধ করে পড়া যাকে বলে! ঐ আড়াই কি তিন মাসের বন্ধে আমি প্রায় ১০০ এর উপরে বই পড়েছিলাম। এরপর শুরু হয় আমার বই কেনা আর পড়ার খেলা। কলেজে ভর্তির প্রথম দিকে আমি আবার নানা কারনে নিয়মিত নামাজ পড়া ধরি। এরকম করতে করতে বেশ কিছু সময় যায়। এরই মাঝে কলেজের প্রথম বর্ষের মাঝামাঝি অথবা শেষের দিকে প্রথম আমি আমার বাসার কম্পিউটারে অভিজিৎ ভাইয়ার ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ বইটা পাই এবং পড়া শুরু করি। পড়তে পড়তে মজা পেয়ে একটানে প্রায় পুরোটা পড়ে ফেলি। এই বইটাই প্রথম আমাকে নাড়া দেয়। এই বইটা যখন কম্পিউটারে পড়ছি সেই সময়েই কম্পিউটারে আরো দুটো বই পেয়ে যাই। একটা হচ্ছে প্রবীর ঘোষের ‘যুক্তিবাদীদের চ্যালেঞ্জাররা’ আরেকটা হচ্ছে আরজ আলি মাতুব্বারের প্রথম খন্ড। মজার ব্যপার হচ্ছে যে আমি যেখান থেকে নিয়মিত বই কিনতাম সেখানে এই দু লেখকের বই অনেক চলত! কিন্তু আমি কখনো এই বই গুলো ধরেও দেখিনি! আমার এক বন্ধু তার প্রাইভেট টিউটরের কাছ থেকে শুনে আমাকে আরজ আলির কথা বলেছিল (যদিও সে জানতো না যে, বইটার ভেতরে কি লেখা আছে!)। তখন আমি তাকে দূর দূর করে বলেছিলাম,”ধুর! এগুলা কেউ পড়ে নাকি!” এরপর যখন আমি কম্পিউটারে এ দুটা বই পাই পরের দিনই বইয়ের দোকানে গিয়ে আমি আরজ আলির এই বই আর প্রবীর ঘোষের অলৌকিক নয় লৌকিক সিরিজের প্রথম বই কিনে নিয়ে আসি। অভি ভাইয়ার বই টা কম্পুতে শেষ করার পর আমি বিভিন্ন বইয়ের দোকানে অনেক খুঁজেছি, কিন্তু পাইনি। তার পর একটা বইয়ের দোকানে অর্ডার দিয়ে প্রায় ৬ কি ৭ মাস ঘোরাঘুরি করার পর বইটা এইচ এস সি সেকেন্ড ইয়ারের মাঝামাঝি সময়ে হাতে পাই!! (অভি ভাইয়ার ই-বুকটা পড়ার পর আমি প্রথম ওখানে মুক্তমনার ঠিকানা পাই। এবং তখন থেকে নিয়মিত অভি ভাইয়াকে হাবি জাবি প্রশ্ন করে বিরক্ত করতে থাকি!! প্রথম প্রথম অভি ভাইয়াকে প্রচুর জ্বালাইসি!)

যা হোক, ঘটনা সেখানে না। আসল ঘটনা ঘটে আরজ আলির বইয়ের অতি সাধারন কিছু প্রশ্ন পড়ে। প্রশ্ন গুলো এত এত সাধারন! পুরো মাথা আমার এক ধাক্কায় এলোমেলো করে দেয়। এই ঘটনার পড় আমার পড়া্লেখার পুরো বারোটা বেজে যায়। আমার নিজের মাথায় হাজারো যুক্তি খেলতে থাকে। এই সময়েই সেই ছোটকালে পড়া বই গুলোর কথাবার্তা আমার মাথার রাস্তা পরিস্কার করে দেয়। কারন বই গুলোতে পরিস্কার বিভাজনের কথা লেখা ছিল। আগে থেকেই বিষয় গুলো সম্পর্কে জানাথাকায় আরজ আলির প্রতিটা কথার মর্ম বুঝতে আমার মোটেও কষ্ট হয় নি। বিবর্তন তত্ত্বের কথাও আগে থেকে হালকা পাতলা জানতাম। যদিও সেটা ছিল ল্যমার্কিয় চিন্তা ভাবনা। তবুও সেটাও আমার সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সহায়তা করেছে।

সবচেয়ে যে ব্যপারটা আমাকে প্রভাবিত করেছে সেটা হল প্রার্থনা। ঈশ্বর যেই হোন না কেন, পুরস্কার পেতে হলে তার তোষামদি করতে হবে কেন? প্রার্থনা ব্যপারটা তো পুরোই তোষামদি ছাড়া আর কিছুই না! আমাদের ধর্ম বইয়ে হাদিস ছিল,” তোষামদ কারীদের আল্লাহ পছন্দ করেন না” কিন্তু আসল ঘটনা কি দাঁড়ালো!! যে যত বেশি মাত্রায় নামাজ কালাম রোজা রাখবে, অর্থাৎ যে যত বেশি মাত্রায় আল্লার তোষামদ করবে সে তত বেশি পুরস্কৃত হবে!!! যার যত বেশি পয়সা, যে যত বেশি ঘুষ দিতে পারবে খোদার নামে (মসজিদ বানানো, হজ্জে যাওয়া, যাকাত দেয়া) তার পুরস্কার তত বেশি!! একজন কাফের হওয়ার কারনে সারা জীবন ভালো কাজ করেও শাস্তি পাবে! তো জীবনে আর ভালো কাজের মূল্য রইল কি?

আরো বেশি দুঃখ জনক এই যে, একজন মাদার তেরেসা বা একজন মহাত্মা গান্ধীর জন্য কি কোন নবী পয়দা হয়েছে এ যুগে? তারা তো শুধু মাত্র অন্ধ ভাবে তাদের পরিবারকে অনুসরন করেই এসেছে। তো এখানে তাদের দোষ কই? তাদের চৌদ্দ গুষ্টির দায়ভার কেন তাদের বহন করতে হবে? কই, একজন মুসলমান তো কখনো খৃষ্টান ধর্মের বা হিন্দু ধর্মের বই পড়ে দেখেন না। তাহলে তিনি কিভাবে সিদ্ধান্ত দেন যে আমার ধর্মই সেরা , আমার ধর্মই সত্য? আরজ আলির একটা কথা মনে পরে খুব,” সব মিষ্টির দোকানদারই বলে যে আমার দোকানের মিষ্টিই সেরা।” একথা আবার কোন মুসলমানকে বললে সে বলবে যে তুমি টেষ্ট করে দেখ যে কোন দোকানের মিষ্টি সেরা, তাহলেই তো হয়!! আরে ভাই, আপনি নিজে কি অন্য দোকানের মিষ্টি খেয়ে দেখেছেন কোন দিন? আপনি যে আপনার টা সেরা বলে ধরে বসে আছেন?

ভালো যদি কোন ধর্মকে বলতেই হয় তবে আমি বলব যে ৪টা ধর্মের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মই সেরা। যদিও আমি যতটুকু জানি বৌদ্ধ ধর্ম মূলত কোন ধর্ম নয়। অন্যান্য ধর্ম গুলোর মত তাদের কোন ঈশ্বর নেই, ঈশ্বরে পুজো দেবার ব্যপারও নেই। অন্তত গৌতম বুদ্ধ সেভাবেই ধর্মটা তৈরি করেছেন, তারপর তার অনুসারীরা ধীরে ধীরে প্রার্থনার ব্যপারটা চালু করে। সে হিসাবে বৌদ্ধ ধর্ম মূলত একটা জীবন বিধান।

তাই শেষ পর্যন্ত বলতে হয় যে, বিজ্ঞান বা দর্শন নয়। ঈশ্বর নিজেই আমার ঈশ্বরে বিশ্বাস ভেঙে দেয়ার পিছনে মূলত দায়ী!! অবিবেচক ঈশ্বরের তা্মাশাই আমার বিবেচনা বোধের কারন!! বাকি সব সাহায্যকারী মাত্র!!

এই সব ঘটনার পেছনে সবচেয়ে দুঃখজনক অংশ হচ্ছে যে, আরেকটু হলে এইসব হাবিজাবি আমার এইচ এস সি পরীক্ষার বারোটা বাজায়ে দিচ্ছিল! জীবনের এখন পর্যন্ত কোন পরীক্ষা এত বাজে প্রিপারেশন নিয়ে আমি দেইনি, যতটা বাজে প্রিপারেশন আমার এইচ এস সি পরীক্ষা দিয়েছি। তবুও ভাগ্য (!!!) ভালো যে ভালয় ভালয় সব পার করে আসতে পেরেছি!

এ ঘটনার পর আরেকটা সমস্যা দেখা দেয় যে, জীবনটা অর্থহীন মনে হতে থাকে। আগে তো জানতাম যে মরে গেলে বেহেশত নাহয় দোজখ কিছু একটা কপালে আছে!! এবং এক সময় না এক সময় আমি ৭০টা হুরের দেখা পাবই!! 😉 কিন্তু এখন জানি যে, আমার জীবন আর একটা মুরগীর জীবনের মধ্যে বস্তুত কোন পার্থক্য নাই!!! 🙁 তাই মাঝে মধ্য চিন্তা হয়, হুদাই বাইচ্যা থাকনের লাইগা ক্যন এত কষ্ট করা? বয়া বয়া খাইলেই তো জীবন পার হয়া যায়!!