[ভূমিকাঃ এই লেখাতে আমার নিজস্ব ধারণা ও চিন্তা অনেকটা মিশে গেছে। যুক্তিবাদে বিশ্বাসী ও নিবেদিত হয়েও এমন কিছু বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ থাকতে পারে যা ঠিক যুক্তিবাদের আওতায় পড়ে না বা যুক্তিবাদের বিরুদ্ধেও যায় না, সেটা বোঝান এই লেখার এক পার্শ্ব লক্ষ্য। মূল কারন হল অধিবাস্তবতার বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত ধ্যান ধারণা ও অনুভূতিকে অন্যের কাছে তুলে ধরে দেখা যে কজন এই অনুভূতি অনুভব করেন বা অনুধাবন করতে পারেন। অধিবাস্তবতার সংজ্ঞা এক এক জন একেক ভাবে দিতে পারেন, তাই পাঠকের মন্তব্যে (যদি মন্তব্য কেউ দেয়) সেটা নিয়ে তর্ক না করে বরং অধিবাস্তবতাকে নিয়ে তাঁদের অনুভূতি ও ভাবনাকে একে অপরের সাথে বিনিময় করবেন বলে আশা করি।]
কতগুলি অনুভূতি বা ধারণাকে ভাষায় বা কথায় প্রকাশ করা বা সংজ্ঞায়ন করা দুরূহ কাজ। তবে সেই অনুভূতি যারা অনুভব করেন তারা ভাষার সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে ভাষায় ব্যক্ত এই ধারণার দ্যোতনা বা ব্যঞ্জনা অনুধাবন করতে পারেন। মরমীয়াবাদ (Mysticism) যেমন। একে সংজ্ঞায়ন করা সহজ নয়, কারণ এটা একটা অনুভূতি। অধিবাস্তবতা বা অধিবাস্তববাদ (Surrealism) সেরকম একটা অনুভূতিভিত্তিক ধারণা। এবং আমার মতে অধিবাস্তবতা ও মরমীয়াবাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক বিদ্যমান। দুটোরই মূলে রয়েছে বাস্তব জগতের বাইরে অজানা এক বিমূর্ত জগতের অস্তিত্বে বিশ্বাস, এর প্রতি এক বিস্ময়পূর্ণ আকর্ষণ বা কৌতুহল (ইংরেজী AWE কে বাংলায় বোঝাতে চেষ্টা করছি), এবং সর্বোপরি সেই অজানা বা চূড়ান্ত বাস্তবতাকে প্রত্যক্ষ করা বা তার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করার ইচ্ছা। প্লেটোর সেই গুহাবাসীদের গুহার ভেতরের ছায়া জগতের বাইরে এক জগতের অস্তিত্বে বিশ্বাসের মত। প্লেটোবাদ (Platonism) বলতে এই বিশ্বাসকেই বোঝায়। বিশুদ্ধ গণিতবিদেরাও প্লেটোবাদী। তাঁরা গণিতের বিভিন্ন প্রতিজ্ঞা, উপপাদ্য এই বাস্তব জগতের বাইরের এক বিমূর্ত জগতের প্রতিফলন বলে মনে করেন। ঐতিহাসিকভাবে মরমীয়াবাদ অবশ্য স্রষ্টার ধারণাকেন্দ্রিক, যদিও স্রষ্টার ধারণা বিভিন্ন মরমীয়াবাদ(বাদী) এর কাছে ভিন্ন। এক অর্থে আমি মনে করি স্ট্রিং তত্ববিদরা (String Theorist) ও মরমীয়াবাদী। তাঁরা খোঁজেন এক মহাতত্ব (Theory of Eveything) যার পরিণতি আর প্রতিফলন এই বাস্তব জগত বা প্রপঞ্চ। তাঁদের কাছে এই মহাতত্বই স্রষ্টা। এই স্রষ্টার অনুভূতি নিয়ে অন্যান্য মরমীয়াবাদীদের মত শুধু ধ্যাণে মগ্ন হয়ে বসে না থেকে স্ট্রিংবিদেরা কঠিন মননের দ্বারা তার স্বরূপ উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেন, গণিতের জটিল ভাষায়। অধিবাস্তববাদ অবশ্য স্রষ্টার ধারণাকেন্দ্রিক নয়(-কেন্দ্রিক কথাটা গুরুত্বপূর্ণ, স্রষ্টার ধারণা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হবে সেটা বলা হচ্ছে না)। মরমীয়াবাদকে এক অর্থে অধিবাস্তববাদ এর এক বিশেষ ক্ষেত্র হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। যাহোক অধিবাস্তববাদ নিয়েই কথা বলি। অধিবাস্তববাদ এর ধারণা ও শব্দটি চালু করেন এপলিনেয়ার (Apollinaire) ১৯১৭ সালে, যা নিয়ে আন্ড্রে ব্রেটন (Andre Breton) শিল্পের জগতে একটা নতুন বিপ্লব বা আন্দোলনের সূচনা করেন প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যকালীন সময়ে। এই আন্দোলন মূলত এর পূর্বের ডাডাইজ্ম (Dadaism) নামক শিল্প আন্দোলনের এক শাখা হিসেবে উদ্ভূত হয়। ডাডাইজ্ম এর মূল মন্ত্র ছিল প্রচলিত প্রথা ও নিয়মকানুনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ (শিল্পের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ). এই বিদ্রোহের একটা কারণ ছিল বিংশ শতাব্দির গোড়ার দিকের অতিমাত্রার যান্ত্রিকীকরণ (তখনকার নিরীখে) ও সেই যান্ত্রিকীকরণের পরিণতিতে প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে মারাত্মক অস্ত্রের উদ্ভাবন, ব্যবহার ও তজ্জনিত ধ্বংসলীলা। তবে অধিবাস্তববাদী আন্দোলন ডাডাবাদী আন্দোলনের দ্বারা সূচিত হলেও সেটা ডাডাবাদের মত নৈরাজ্যবাদী নয়। ডাডাবাদের মত নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ না থাকার ইচ্ছাটা অধিবাস্তববাদেও বিদ্যমান থাকলেও এই ইচ্ছার তাড়নায় মনের ভেতরের বিশুদ্ধ চিন্তার দ্বারা শিল্পের সৃষ্টিই এর মুখ্য উদ্দেশ্য। ব্রেটনই প্রথম অধিবাস্তববাদএর সংজ্ঞা দেন ১৯২৪ সালে প্রকাশিত অধিবাস্তববাদএর প্রথম ম্যানিফেস্টোতে। অধিবাস্তববাদকে তিনি মনস্তাত্বিক স্বয়ংক্রিয়তা (psychic automatism) বলে আখ্যায়িত করেন । তিনি বোঝাতে চাইলেন যে মন যখন বাস্তব জীবনের সব প্রভাব, চাপ ও নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়, তখন সেই মন স্বয়ংক্রিয়ভাবে যে চিন্তা, কথা বা লেখনীর জন্ম দেয় সেটাই মনের প্রকৃত ও বিশুদ্ধ চিন্তার প্রতিফলন। তবে মনস্তাত্বিক স্বয়ংক্রিয়তার দ্বারা যা কিছুই সৃষ্ট হয় সেটাই যে অধিবাস্তব্বাদ হবে তা নয়। অধিবাস্তবতার মূল উপাদান হল অমূলকত্ব (Irrationality), বা আজগুবিত্ব। তাই অধিবাস্তব চিন্তা প্রসূত কাল্পনিক ঘটনার দৃশ্যে জ্যামিতি, পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়ম যে পালিত হবে তার কোন গ্যারান্টি নেই, বা সেই দৃশ্য যে বাস্তবে দেখা যাবে তাও না। অধিবাস্তবতার ধারণাটাই কল্পনাভিত্তিক, মানসজগতে, যা শুধু শিল্পেই প্রকাশ হতে পারে। ব্রেটন অবচেতন মনের ক্ষমতার ফ্রয়েডিয়ান ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন। তবে ফ্রয়েড যেমন অবচেতনে মনের ক্ষমতার দ্বারা মনকে অস্বাভাবিক থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনার চেষ্টা করতেন ব্রেটন এর উলটো দিকে গিয়ে অবচেতন মনের বিশৃংখল শক্তির দ্বারা “স্বাভাবিক/বাস্তবভিত্তিক” চিন্তা কে “অস্বাভাবিক/অবাস্তব” এর দিকে অর্থাৎ অধিবাস্তববাদী চিন্তার দিকে ধাবিত করার চেষ্টা করতেন। অধিবাস্তববাদ এর মূলে আছে এক বিশ্বাস বা অনুভূতি, যা হল বাস্তব জগতের বাইরে এক উচ্চতর বিমূর্ত জগত আছে যা মানুষের মনের ভেতরে বাস্তব জীবনের প্রভাব, চাপ ও নিয়ন্ত্রণ মুক্ত অবস্থায়, বা স্বপ্নের মাধ্যমে, বা অমূলপ্রত্যক্ষের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। ব্রেটনের স্বয়ংক্রিয়তার মূলে আরেকটা বিশ্বাস ছিল সেটা হল “নৈর্ব্যক্তিক আপতন” (Objective Chance). এর দ্বারা বোঝাতে চেয়েচিলেন যে কোন কোন ঘটনা বা সমাপতন (Coincidence) এর কোন যৌক্তিক ব্যাখ্যা নেই কিন্তু যার কারণ হল এক উচ্চতর জগতের অস্তিত্ব যা অবচেতন মনের দ্বারা প্রত্যক্ষ করা যায়। বলাই বাহুল্য অধিবাস্তবতার প্রকাশ পাওয়াটা একটা অনুভূতি, যাকে আমরা অধিবাস্তব অনুভূতি (Surrealistic Feeling) বলতে পারি। আগেই বলেছি এই অনুভূতি সৃষ্টির পূর্ব শর্ত হল বাঁধা গৎ এর প্রতি আনুগত্য না দেখিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে শিল্পের ধারণা ও সৃজন। তবে অধিবাস্তব অনুভূতি অনুভব করতে শিল্পী হতে হবে তা নয়। কল্পনা ও ভাব থাকাটাই মুখ্য। অধিবাস্তব শিল্পীরা অধিবাস্তব অনুভূতি কে শিল্পের মাধ্যমে প্রকাশ করতে চেষ্টা করেন। মার্কিন জ্যাজ সঙ্গীতেরও মূলেও রয়েছে এই স্বতঃস্ফূর্ত সৃজন, যাকে Improvisation (পূর্বপ্রস্তুতিহীন, উপস্থিত) বলা হয় । চিত্রশিল্পে বা সাহিত্যে স্বয়ংক্রিয়তা (Automatism) আর সঙ্গীতের ক্ষেত্রে Improvisation এ দুটো তুলনীয়। তাই আমার মতে জ্যাজ সঙ্গীত অধিবাস্তব অনুভূতি সৃষ্টির এক ভাল মাধ্যম হতে পারে। তবে এতে আবশ্যিকতা নেই। অনেক সময় বিশেষ কোন লিখিত সঙ্গীতও (বা সেই সঙ্গীতের কোন বিশেষ অংশ) কারো মনে অধিবাস্তব অনুভূতি সৃষ্টি করতেও পারে। অনেকে কোন সু্র বা গান বা তার বিশেষ অংশ শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে তা স্বর্গীয় বা দেবদত্ত (Heavenly) ইত্যাদি বলেন। ধর্মের প্রভাব এখানে লক্ষ্যনীয়। ধর্মের খোসাটা ছাড়িয়ে নিলে তাঁরা যা বলতে চান তা মূলত এক অধিবাস্তব অনুভূতির প্রকাশ। তবে অধিবাস্তব অনুভূতির উদ্দীপক সঙ্গীত বা সুর যে সুরেলা (Melodic) বা জনপ্রিয় অর্থে সুন্দর হতে হবে তা নয়। এই মন্তব্য অবশ্য অধিবাস্তববাদের অন্য শিল্পমাধ্যম (চিত্র,কবিতা,চলচ্চিত্র) এর বেলায়ও প্রযোজ্য।
আগেই উল্লেখ করেছি অধিবাস্তব অনুভূতি উদ্দীপক বা ব্যক্তকারী শিল্পের এক প্রধান ব্যঞ্জন হল এতে অমূলক উপাদান থাকে, এর লক্ষ্যবস্তু বা বিষয়, দৃশ্য বা ঘটনাবলী বাস্তবের সাথে অসঙ্গতিহীন, উদ্ভট বা আজগুবী। কিন্তু সেই অসঙ্গতিহীন উদ্ভট বা আজগুবী এমনই ধরণের যা এই বাস্তব জীবনের বাইরের এক প্লেটনিক জগতের ইঙ্গিত বা হাতছানি দেয়। হাস্যকৌতুকোদ্দীপক উদ্ভট বা আজগুবী ঐ কাতারে পড়েনা। যেমন সুকুমার রায়ের কিম্ভূত ছড়াটা আজগুবী নিয়েই লেখা, কিন্তু সেটা অধিবাস্তব অনুভূতি সৃষ্টিকারী বলা যাবেনা। বরং তাঁর শেষ ছড়া আবোল তাবোলে (মেঘ মুলুকে ঝাপসা রাতে..) অধিবাস্তব অনুভূতির রস খুঁজে পাওয়া যায়। এবসার্ড সাহিত্যেও অবাস্তব বা অমূলক উপাদান থাকে, কিন্তু সেখানে পার্থিব জগতের বাইরের কোন ইঙ্গিত বা ইশারা লক্ষ্য করা যায় না। সেখানে দৈনন্দিন জীবনের গতানুগতিক ঘটনার পরিবর্তে পাত্র পাত্রীর কথোপকথন বা ঘটনার ধারাকে অগতানুগতিকভবে পেশ করা হয় । যেটা ঠিক অধিবাস্তবতার মত অমূলক বা স্বপ্নময় নয়। তবে কিছু ব্যতিক্রম ও আছে। বাংলায় অধুনা প্রয়াত সাইদ আহমেদের বা মোহিত চট্টপাধ্যায়ের এবসার্ড নাটকের কোন কোন অংশে বা আলাপে অধিবাস্তবতার স্বাদ পাওয়া যায়। সাইদ আহমেদের সেরকম এক নাটকের কথা মনে পড়ছে বহু বছর আগে ঢাকা টিভিতে দেখেছিলাম। ডঃ জিল্লুর রহমান খান (যুক্তরাষ্ট্রের উইস্কন্সিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল সাইন্সের অধ্যাপক ছিলেন) তাতে শক্তিশালী অভিনয় করেছিলেন। নাটকের নামটা মনে পড়ছেনা। মোহিত চট্টপাধ্যায়ের চন্দ্রলোকে অগ্নিকান্ডের কথা মনে পড়ে। বাংলা সাহিত্যে অধিবাস্তবতার আমেজ অন্তত আমার চোখে দেখতে পাই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বনফুলের কোন কোন লেখায়। আবারও নাম করতে পারছি না অবন ঠাকুরের এক লেখায় রাখাল বালক মাঠে হেঁটে যেতে যেতে দেখতে পেল হঠাৎ পূর্ণিমার চাঁদ যেন খসে পড়ে মাঠে চলন্ত চাকার মত গড়িয়ে দিগন্তের দিকে চলে গেল। অবন ঠাকুরের ভূত পত্রীর দেশেও অনেক অধিবাস্তব উপাদান সমৃদ্ধ বর্ণনা পাওয়া যায়, ধুধু মাঠের মধ্য দিয়ে পাল্কী ছুটছে ভূতূড়ে গানের সাথে। বনফুলের এক গল্পে (ছোটদের জন্য লেখা কোন পূজা বার্ষিকীতে) খোকাবাবু স্বপ্নে দেখছে এক বিরাট পদ্মফুল দীঘির জল ভেদ করে আকাশের দিকে ক্রমশঃ উঠে যাচ্ছে এবং একসময় ঐ পদ্মফুল এক বিকট দৈত্যের চেহারা নিয়ে খোকার দিকে ভাটার মত চোখ দিয়ে তাকিয়ে আছে। এর বেশী আর মনে নেই। অধিবাস্তব অনুভূতির উদ্রেককারী হতে পারে কোন বিশেষ শব্দ, সুর, ছবি বা স্থান। যেমন অধিবাস্তববাদী ম্যাক্স আর্ন্সট্ এর অধিবাস্তব অনুভূতির (যেমন কাল্পনিক লপলপের ধারণা) প্রেরণার পেছনে ছিল জার্মানীর বনে তাঁর ভয়ের ও রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা । এটা কি নিছক কাকতালীয় যে প্রায় সব অধিবাস্তববাদীরাই ফরাসী ছিলেন? মনে করা হয় প্যারিস এমন একটা শহর যা অধিবাস্তব অনুভূতি্র উদ্রেক করার জন্য আদর্শ, তার ক্যাটাকোম্ব (পাতাল গোরস্থান), গথিক্ দালান ও গারগয়েল সমূহ ইত্যাদির কারণে, যা অবাস্তব চিন্তার খোরাক যোগায়। ফরাসী অধিবাস্তববাদী সাহিত্যিক লুই আরাগনের প্যারিস পেজ্যান্ট প্যারিস শহরের অলি গলি দিয়ে আরাগনের স্বপ্নাবিষ্টের মত বিচরণের অধিবাস্তব অনুভূতিকে নিয়েই লেখা। এর বেশ আগে ফরাসী সাহিত্যিক লট্রোমং (প্রকৃত নাম ডুকাসে) এর লেখা ম্যাল্ডরর এর গান (Les Chants de Maldoror) নামক গদ্যকবিতা অধিবাস্তব প্যারিসের প্রেক্ষাপটে লেখা। ম্যাল্ডরর এর গান পরবর্তী অনেক অধিবাস্তববাদীদের প্রভাবিত ও অণুপ্রাণিত করেছিল।
অধিবাস্তব অনুভূতি উদ্দীপক দৃশ্য বা শব্দ দু ধরণের হতে পারে। প্রথম ধরণে উদ্দীপক দৃশ্যের লক্ষ্যবস্তু বা উপাদান গুলি বাস্তবে বিদ্যমান। কিন্তু সেই উপাদানগুলি একে অপরের সাথে এমনভাবে যুক্ত হয় যে পরিণতিতে এক অবাস্তব বা অপার্থিব অনুভূতি ও ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে। শহর থেকে দূরে কুয়াসাচ্ছন্ন রাতের গভীর অন্ধকার ভেদ করে দূর থেকে ভেসে আসা ট্রেনের হর্নের শব্দ ও হেডলাইটের আলো এক রহস্যময় আমেজ সৃষ্টি করতে পারে যা শহরের ব্যস্ত রাস্তায় গাড়ীর দৈনন্দিন হর্নের মত গতানুগতিক বাস্তব নয়, যদিও দুটোই বাস্তব। বা গভীর রাথে নির্জন বনের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে গাছের পাতায় ঝোড় হাওয়া আছাড় খেয়ে যে কান্নার মত করুণ সুরের সৃষ্টি করে সেটাও কোন গতানুগতিক বাস্তব শব্দ নয়। ডিজনীর “The Legend of Sleepy Hollow” কার্টুনে এরমক এক দৃশ্য আছে।
দ্বিতীয় ধরণের উদ্দীপক লক্ষ্যবস্তু বা উপাদান গুলি বাস্তবে দেখা যায় না। এগুলো অমূলক ও কাল্পনিক। আমেরিকার কার্টুনের স্বর্ণযুগের একটা কার্টুনের কথা মনে পড়ছে, “Porky in Whackyland” (আজব দেশে পর্কি), যেখানে হাত পা ওয়ালা ভেঁপু দৌড়ে বেড়াচ্ছে যারা নিজেরাই তাদের মাথা (অর্থাত ভেঁপু) টিপে ভেপু বাজাচ্ছে, বা ফুল ফুটে বাদ্যযন্ত্র হয়ে বাজনা বাজাচ্ছে ইত্যাদি। বেটি বুপ (Betty Boop) সিরিজের কিছু কার্টুনও অধিবাস্তব অনুভূতি উদ্দীপক (Vol-3 of Betty Boop Definitive Collections )। হলিঊডের গোড়ার দিকের (প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যকার সময়ে) অনেক মিউজিক্যাল (এর বাংলা কি হবে?) এ অধিবাস্তব অনুভূতির ছাপ সুস্পষ্ট। এটা কাকতালীয় নয় যে শিল্পে অধিবাস্তব আন্দোলনও সেই সময়েই ঘটছিল। বিশেষ করে বাস্বী বার্কলীর Hollywood Revues আর Extravaganza সিরিজের মিউজিক্যালগুলিতে তা লক্ষ্যনীয়। এই মিউজিক্যাল গুলিতে সিড়ি দেখান হয় যা আকাশের সাথে মিশে গেছে, স্টেজগুলিও জ্যামিতির নিয়ম ভংগ করে বলে মনে হয়। চিত্রশিল্পে এই ধরণের অধিবাস্তব উপাদান স্যালভাডর ডালীর চিত্রশিল্পে দেখা যায়, যার মধ্যে “The Persistence of Memory” সর্বাধিক পরিচিত। এর বেশ আগে হিয়েরনিমাস বশ (Hieronymus Bosch) এর চিত্রেও অধিবাস্তব দৃশ্য দেখা যায়, বিশেষ করে তাঁর নরকের দৃশ্য চিত্রায়নে। এছাড়া ইটালীয় চিত্রকর জর্জো ড্য কিরিকোর অধিবিদ্যক চিত্রগুলির (Metaphysical Paintings of Giorgio De Chirico) উল্লেখ করা যায় উদাহরণ স্বরূপ। এশারকে অধিবাস্তববাদী চিত্রকর হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করা না হলেও তাঁর অনেক ছবি (আসলে কাঠের খোদাইয়ের প্রিন্ট) স্পষ্টতই অধিবাস্তববাদী, যেমন তাঁর “Another World II”।
চলচ্চিত্রের মধ্যে অধিবাস্তবতার উদাহরণের মধ্যে আর্জেন্টিনীয় সুরকার মরিস কেগেলের “Match” এর নাম করা যায়।
এছাড়া আরো কিছু উদাহরণ দিয়ে শেষ করি। মাঝ সত্তরের দশকে McMillan and Wife নামের একটি টিভি সিরিয়াল দেখান হত ঢাকা টিভি তে যার এক এপিসোডে (The Devil,You say) সেটানিক রিচুয়ালের একটা দৃশ্য ছিল যা আমার কাছে অধিবাস্তব বলে মনে হয়েছিল। দৃশ্যে গেরুয়া পরা পাদ্রীদের (আসলে সেটানিস্ট) হাত ধরে সমন্বিত নাচের এক অদ্ভূত দৃশ্য দেখান হয়েছিল। যেটা দেখে আমার স্ট্যান কেন্টনের “The Waltz of the Prophets” নামক এক জ্যাজ সুরের কথা মনে হয়। আমার সবচেয়ে পছন্দের অধিবাস্তব দৃশ্য হল “5000 Thousand Fingers of Dr. T” ছবির এক দৃশ্য। দৃশ্যটা হল ডঃ টি এর কয়েদখানার কয়েদিদের এক ক্ল্যাসিকাল কন্সার্টএর । ডঃ টি এর কয়েদীরা সব অ-পিয়ানোবাদক যন্ত্রী, কারণ পিয়ানো বাদে আর সব বাদ্যযন্ত্রকে ডঃ টি সহ্য করতে না পারায় সে সব বাদ্যযন্ত্রীদের উনি বন্দী করেন। বন্দীরা তাদের বাদ্য বাজানোর অদম্য ইচ্ছার তাড়নায় হাজতে যে যা পারে যোগাড় করে এক অদ্ভূত অর্কেস্ট্রা গঠন করে কন্সার্ট দেয়। পুরো কন্সার্টটাই এক বিস্ময়কর অধিবাস্তব দৃশ্য। জ্যাজ সংগীতে আমার ব্যক্তিগত বিচারে অধিবাস্তব অনুভূতির উদ্দীপক ও পছন্দের সুরের মধ্য কিছুর উল্লেখ করি। পঞ্চাশের দশকে জ্যাজ সংগীতে তৃতীয় ধারা (Third Stream) নামে যে নতু পরীক্ষামূলক জ্যাজের উদ্ভব হয় তাতে অনেক অধিবাস্তব উপাদান ছিল। এর মধ্যে স্ট্যান কেন্টনের (Stan Kenton) এর “কাঁচের শহর” বা “আরশীনগর” (The City of Glass), পিট রুগোলোর মরীচীকা (Mirage, Pete Rugolo) গান্থার শুলার (Gunther Schuller) এর রূপান্তর (Transformation) আমাকে বিশেষভাবে আবেদন করে। এছাড়া পঞ্চাশের দশকে চার্ল্স মিন্গাসের ইক্লিপ্স ও উইর্ড নাইটমেয়ার (Eclipse and Weird Nightmare by Charles Mingus), সানরার “দুঃস্বপ্নের ওষুধ” (Medicine for a Nightmare by SunRa) এগুলিও। ষাটের দশকের জ্যাজের মধ্যে জো হ্যারিয়েট কুইন্টেট এর এবস্ট্র্যাক্ট (Abstract by Joe Harriett Quintet), সানরার আটলান্টিস ও ম্যাজিক সিটির উল্লেখ করতে হয় ।
ডঃ টি’র পাঁচ হাজার আঙ্গুল ছবির অধিবাস্তব দৃশ্যটির ভিডিও ক্লিপ আমি মিডিয়াফায়ারে আপলোড করেছি। যারা এটা দেখতে ইচ্ছুক নীচের লিংক থেকে ডাউনলোড করে নিতে পারেন। এটা প্রায় পাঁচ মিনিটের, ৭৭ মেগাবাইটের mpg ফাইল।
http://www.mediafire.com/?w2w1u5ymmu30buj
ভাল লাগল!
সালভাদর দালির চিত্র আমার ভাল লাগে।
বিমূর্ত জগতের হাতছানি তাতে।
আর পরাবাস্তবতা তো সবসময় জীবনের সাথে জড়িয়েই আছে।
অদ্ভুতস্বপ্নদেখার ব্যাখ্যা কি হতে পারে!
মানসিক রোগী ভাবাটা কি যৌক্তিক হবে? বুঝতে পারছিনা, খটকা লাগছে, আমরা সকলেই একবার না একবার অধিবাস্তবতার স্বাদ পাই জীবনে, খুব কম মানুষই মনে হয় পাওয়া যাবে যারা কোনোদিন অধিবাস্তবতার স্বাদ পায়নি। হ্য়ত এমন মানুষ খুজেই পাওয়া যাবেনা, তাহলে কি এটাকে কোন মানসিক রোগের কাতারে ফেলা যায়?
সালভাডর ডালীকে অনেকে মানসিক রোগী বলতে পারে, কিন্তু শিশুদের কি মানসিক রোগী বলা যাবে?
@সখা,
যৌক্তিক বা অযৌক্তিক কোনটাই বলা ঠিক বা বেঠিক হবে না। আসলে যুক্তি এখানে প্রযোজ্য নয়। সেটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম সাইফুলের প্রশ্নের উত্তরে। হয়ত সাইফুল প্রশ্ন করেছিলেন মাত্রাটা নিয়ে। অধিবাস্তবতা নিয়ে একটা অবসেশান হয়ে যায় যদি তাহলে। তখনো যে সেটা মানসিক রোগ বা অস্বাভাবিক হয়ে যাবে বলা যায় না। আমার মতে যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ অন্যের বা সমাজের ক্ষতি না করে নিজের জীবনের মৌলিক চাহিদা মিটিয়ে চলতে পারে ততক্ষণ সে অবশ্যই স্বাভাবিক। সালভাডর ডালীর ব্যাপারে ইস্যুটা ছিল কিছু বিকৃত কর্মকান্ড যা হত্যা পর্যন্ত গড়িয়েছিল। আর তাঁর কিছু চিতের নারী যৌন নির্যাতনের নগ্ন ছাপ ছিল যার জন্য অনেকে তাঁকে বিকৃত রুচির শিল্পী হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। তবে এটা পরিস্কার বোঝা উচিত যে অধিবাস্তবতার ধারণার বা অনুভূতিরে সঙ্গে এর কোন যোগাযোগ নেই। স্ট্যালিন অনেক মানুষ মেরেছিলেন বলে অনেকে সেটাকে নাস্তিক্কের সহিংসতার উদাহরণ হিসেবে দেখে। কিন্তু স্ট্যালিন একজন লম্বা, গোঁফ ওয়ালা শ্বেতাংগ লোকও ছিলেন। তাহলে তো এটাও বলতে হয় যে লম্বা লোকেরা, বা গোঁফ ওয়ালা বা শ্বেতাঙ্গরা সব খুনই।
বরাবরের মতই সুখপাঠ্য।
আচ্ছা অধিবাস্তববাদীদেরকে আমি যদি সাধারন মানুষ বলে মনে না করে মানসিক রোগী ভাবি তাহলে কি জিনিসটা অযৌক্তিক হবে?
@সাইফুল ইসলাম,
না। তবে যৌক্তিকও হবে না। মানসিক রোগী ভাবতে আপত্তির কিছু নেই। সালভাডর ডালীকে অনেকেই মানসিক ভাবে অসুস্থ মনে করতেন। তাঁর কিছু ছবির কারণে। ব্যক্তিগত জীবনেও তাঁর কিছু বিতর্কিত কর্মকান্ড নিয়ে তাঁর মানসিক অবস্থা নিয়ে সন্দেহ দেখা গিয়েছিল। এবিসি নাইটলাইনে এর উপর এক প্রামাণ্য অনুষ্ঠান দেখেছিলাম।
খেয়াল করুন লেখার নিচে একটি ফেসবুকে শেয়ারের আইকন দেখা যাচ্ছে। এটায় ক্লিক করে সরাসরি লেখাটি ফেসবুকে শেয়ার করতে পারেন। কয়বার শেয়ার করা হয়েছে সেটাও আইকনে দেখা যাচ্ছে।
অপার্থিবের লেখাটি শেয়ার করে এটি পরীক্ষা করে দেখেছি 🙂 ।
@রামগড়ুড়ের ছানা,
জ্বী খেয়াল করেছি। খুব ভালো হয়েছে। কাজ সহজ হয়ে গেল।