খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথমভাগ হতে (508 BC) গণতন্ত্রের সূচনা হলেও আধুনিক গণতন্ত্রের যে রূপ আমরা আজ দেখি সেটির ধারণা আমরা পাই আঠারো শতাব্দীর শুরুতে এসে। গণতন্ত্রের প্রাথমিক অবস্থা হতে আজকের আধুনিকতম রূপে আসতে গিয়ে গণতন্ত্রকে নানা রূপান্তরের মাঝে দিয়ে যেতে হয়েছে। গণতন্ত্রের ভবিষ্যত স্বরূপটি কল্পনা করতে হলে এবং এর সুফল পেতে হলে আমাদেরকে এই রূপান্তরগুলো এবং রূপান্তরের কারণগুলোকে জানতে হবে এবং বুঝতে হবে। এই লেখাটিতে আমরা গণতন্ত্রের সেই ক্রমবিকাশকেই দেখবো। প্রথমে আমরা দেখবো গণতন্ত্রের একদম শুরুর কথা যেটাকে আমরা বলবো গণতন্ত্রের প্রাথমিক রূপান্তর। তারপর দেখবো গণতন্ত্রের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পরিবর্তনটি। সবশেষে থাকবে। গণতন্ত্রের এর ভবিষ্যৎ রূপটি কেমন হতে পারে সেটি নিয়ে কিছু কথা।

গণতন্ত্রের প্রাথমিক রূপঃ সরাসরি গণতন্ত্র বা নগরকেন্দ্রিক গণতন্ত্র

খুব সহজ ভাষায় যদি বলা হয় – কিছু মানুষ সব সময়ই এমন ধারণা পোষণ করতো যে সকল মানুষ রাজনৈতিকভাবে সমান এবং সমষ্টিগত ভাবে নিজেরাই নিজেদের শাসন করার ক্ষমতা রাখে এবং শাসন যন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতা অথবা শাসনযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতেই থাকবে। এই ধারণার উৎপত্তি মূলত গ্রীক দেশে, এবং আরো সুনির্দিষ্টভাবে বললে এথেনিয়ানদের। খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর শুরুর দিকে গ্রীসের কিছু ছোট ছোট নগর, যারা মূলত শাসিত হতো বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক শাসক, যেমন রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র, স্বৈরশাসক কিংবা কতিপয়তন্ত্রের মাধ্যমে, তারা এমন একটি ব্যবস্থা গ্রহন করলো যেখানে নাগরিকগণ নিজেরাই নিজেদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবে এবং সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় শাসনযন্ত্রও তারাই পরিচালনা করবে। সে জন্য তাঁদের নির্ধারিত সংসদ ছিল যেখানে নাগরিকগণ তাঁদের মতামত তুলে ধরবে এবং নিজের ভোট প্রদান করবে। এই ছিল গ্রীক সময়কার সহজ এবং সাধারন গণতন্ত্রের ধারণা যা আজকের আধুনিক গণতন্ত্রের মূলেও রয়েছে। এবার তাহলে দেখি গ্রীক গণতন্ত্রের রূপটি কেমন ছিল।

প্রাচীন গ্রীসের গণতান্ত্রিক ধারণার ছয়টি মূল উপাদান ছিলঃ

১। নাগরিকগণেরর মাঝে একরকম ঐক্য থাকবে যেন তারা নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব এড়িয়ে সার্বিক ভালোর জন্য কাজ করতে পারে।
২। নাগরিকগণ হবে মানসিকগত, অর্থনৈতিকগত ভাবে বৈষম্যহীন।
৩। গণের আকার ছোট থাকবে অর্থাৎ গণতন্ত্র হবে নগরকেন্দ্রিক।
৪। গণতন্ত্রের ধরণ হবে সরাসরি (Direct democracy), অর্থাৎ প্রতিনিধিমূলক (Representative) নয়।
৫। প্রতিটি নাগরিককেই স্বল্প সময়ের জন্য হলেও শাসনযন্ত্রে অংশ গ্রহন করতে হবে।
৬। নগরটি হতে হবে স্বায়ত্বশাসিত।

যদিও আজকের মতো কোন প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব প্রাচীন গ্রিসে ছিল না, কিন্ত পারিবারিক কিংবা বন্ধুত্বের সম্পর্কের জোরে তখনো ক্ষমতার অপব্যবহার লক্ষ্য করা গিয়েছে। কিন্তু মূল সমস্যা ছিল যে উক্ত সময়ে গ্রীসের গণতন্ত্রে সকল নাগরিকের অংশগ্রহণ ছিল না। নারী, দাস, শিশু এদেরকে এই গণতান্ত্রিক পদ্ধতির বাহিরে রাখা হয়েছিল যার ফলে সকল নাগরিক রাজনৈতিক ভাবে সমান এই তত্ত্বটি এখানে সত্যিকারভাবে পালিত হয়নি। তাই গণতান্ত্রিক পদ্ধতি হলেও ক্ষমতা সীমাবদ্ধ ছিল শুধুমাত্র একশ্রেণীর নাগরিকদের মাঝে। দ্বিতীয় সমস্য ছিল যে সরাসরি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ছোট ছোট নগরকেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থায় কার্যকর, কিন্তু বেশ বড় নগর কিংবা পুরো দেশের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি ততটা কার্যকর নয়। অনেক নাগরিকের সে ক্ষেত্রে সংসদে এসে নিজের মতামত তুলে ধরা সম্ভবপর হয় না।

গণতন্ত্রের দ্বিতীয় রূপান্তরঃ প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্র বা দেশকেন্দ্রিক গণতন্ত্র

প্রজাতন্ত্রের ধারণাঃ

গণতন্ত্রের কাছাকাছি আরেকটি ধারণা একই সময়ে গড়ে উঠেছিল তা হল প্রজাতান্ত্রিক ধারণা। এই ধারণায় মানুষ প্রকৃতিগতভাবে সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রাণী। একজন ভাল মানুষ একজন ভাল নাগরিক এবং একটি গণ হল কিছু ভাল নাগরিকের সমন্বয়ে করা সংস্থা। একজন ভাল নাগরিক হচ্ছে নাগরিকচেতনা গূণাবলি সম্পন্ন একজন মানুষ। প্রজাতান্ত্রিকদের মতে একটি সমাজে সকল মানুষ পুরোপুরিভাবে সমান নয়। তাঁদের মতে সমাজ বিভক্ত কতিপয়তান্ত্রিক এবং গণতান্ত্রিক অংশে। সব সময় সমাজে লঘু এবং গরিষ্ঠের অবস্থান দেখতে পাওয়া যায়। তার সাথে যুক্ত করা যেতে পারে এরিষ্টটলের মতে তৃতীয় অংশেরঃ একের শাসন বা রাজতন্ত্রের। প্রজাতন্ত্রের ধারণার মূলে হচ্ছে শাসন যন্ত্রের মাঝে এক, কতিপয় এবং বহু এই তিন অংশের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একধরনের ভারসাম্য রক্ষা করা।

আধুনিক গণতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমরা এই চিন্তারই প্রতিফলন দেখতে পাই। যেমনঃ আমেরিকা কিংবা ইংলেন্ডে দেখি প্রেসিডেন্ট বা রানী যিনি একের প্রতিনিধিত্ব করে, উচ্চ-কক্ষ সংসদ যাঁদেরকে তুলনা করা যায় অভিজাতশ্রেণী বা কতিপয়শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসেবে এবং সব শেষে নিম্ন-কক্ষ সংসদকে কল্পনা করা যায় গরিষ্ঠের প্রতিনিধি হিসেবে। প্রজাতান্ত্রিক ধারণা পৃথকভাবে আসলেও এটি আধুনিক গণতন্ত্রের দ্বিতীয় পরিবর্তনে বেশ বড় ভুমিকা রাখে। প্রজাতান্ত্রিক ধারণা আসে রোমের শাসন যন্ত্র হতে। গ্রীকের গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সাথে রোমানদের প্রজাতান্ত্রিক পদ্ধতির বড় পার্থক্য হল যে গ্রীকের ধারণায় সকল নাগরিক শাসন যন্ত্রে অংশগ্রহন করে আর রোমানদের ধারণায় বিভিন্ন প্রতিনিধিরা শাসন যন্ত্র নিয়ন্ত্রন করে, যদিও তাঁদের প্রতিনিধিরা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ছিল না। মূলত বংশগতভাবেই তাঁরা প্রতিনিধিত্ব করতো। তাই ইতিহাসের এই সময়েও নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বের ধারণাটি আসেনি।

প্রতিনিধিমূলক ধারণাঃ

গ্রীকদের ধারণা থেকে আমরা দেখি যে বড় আকারের গণের দিকে তাঁদের অনীহা ছিল, এবং তারা কখনোই প্রতিনিধিমূলক শাসনযন্ত্র তৈরী করেনি। ঠিক তেমনি রোমানরাও। এমনকি রোমান সাম্রাজ্যের আকার দিন দিন বৃদ্ধি পেলেও সংসদই ছিল নিজের মতামত তুলে ধরার একমাত্র স্থান। যে কারণে যখন কেউ সংসদে যোগদান করতে অক্ষম হতো কোন কারণে, সে তার নিজের মতামত পাঠাতো কোন প্রতিনিধির মাধ্যমে। তারপরেও সেটা বর্তমানের মত প্রতিনিধিমূলক শাসনব্যবস্থা ছিল না। প্রতিনিধিত্ব শুধু মাত্র সীমাবদ্ধ ছিল নিজের মতামত প্রদানের মাধ্যম হিসেবে।

বর্তমান প্রতিনিধিমূলক শাসন ব্যবস্থা বাস্তবে আসে প্রথম আঠারো শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের প্রথম গৃহযুদ্ধের পরে। এই প্রথম রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, যাঁদের সেই সময় বলা হয় লেভেলার (Leveller) সমস্যায় পড়লো কিভাবে একটি দেশের মত বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু করা যায়। তারা খুব ভালভাবেই বুঝতে পারছিল যে সরাসরি গণতন্ত্র এই ক্ষেত্রে বিশেষ কার্যকর হবে না। তখনই তারা নিয়ে আসে প্রতিনিধিমূলক পদ্ধতি, আরো পরিষ্কার ভাবে বললে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি মূলক গণতন্ত্র, যেখানে জনগণের পক্ষে তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সংসদের মতামত দিবেন, সিদ্ধান্ত গ্রহন করবেন। এর ফলে গণতন্ত্রের আকারের (size) যে সীমাবদ্ধতা ছিল সেটা দূর হয়ে গেল।

তবে প্রতিনিধিমূলক শাসন ব্যবস্থা গণতান্ত্রিকরাই প্রথম উদ্ভব করে নি। প্রতিনিধিমূলক শাসন ব্যবস্থা তারও আগে থেকে মধ্যযুগের রাজতন্ত্র এবং অভিজাততান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বিদ্যমান ছিল যেখানে বিভিন্ন দূর রাষ্ট্রে রাজার পক্ষে বিভিন্ন প্রতিনিধিরা শাসন পরিচালনা করতো এবং রাজ্যের সংকটকালীন (যুদ্ধ) অবস্থায় রাজাকে পরামর্শ প্রদান করতো। এই ধারণাটিই পরবর্তীতে গণতান্ত্রিকরা ধারণ করেন প্রতিনিধিমূলক গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। এর কয়েক যুগের মাঝে প্রতিনিধিমূলক শাসন ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক এবং প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থাতে সকলেই স্বাচ্ছন্দে গ্রহণ করেন।

গণতন্ত্রের তৃতীয় রূপান্তর বা বহুসংস্থার শাসনতন্ত্র (Polyarchy**) :

গণতন্ত্রের দ্বিতীয় রূপান্তরের মূল প্রাপ্তি হলো প্রতিনিধিমূলক শাসন ব্যবস্থা। এর ফলে সরাসরি গণতন্ত্রের যে আকারগত সীমাবদ্ধতা ছিল সেটি নিমিষেই দূর হয়ে গিয়েছে। নগরকেন্দ্রিক গণতন্ত্র থেকে আমরা চলে যাই এখন দেশকেন্দ্রিক গণতন্ত্রে। কিন্তু এর ফলে এখন নুতন কিছু সীমাবদ্ধতার উদ্ভব হয়েছে। প্রথমতঃ প্রতিনিধি নির্বাচনের পদ্ধতি কী হবে কিংবা ক্ষেত্র কী হবে? নির্বাচন কি পপুলারিস্টিক ভোটের মাধ্যমে হবে নাকি ভোটের হার অনুপাতে হবে? দ্বিতীয়তঃ নাগরিকদের সরাসরি শাসন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ যা গ্রীক গণতন্ত্রের মূলে ছিল সেটা এখন আর সম্ভব নয়। তৃতীয়তঃ রাষ্ট্রের আকার বৃদ্ধির ফলে নাগরিকদের মাঝে বৈচিত্র আরো বেড়ে যায় এবং যার ফলে মতভেদ আরো তীব্র হয়, শাসন ব্যবস্থা আরো জটিলতর হয়।

বৃহৎ আকারের গণতন্ত্রে শাসনযন্ত্রকে সঠিক ভাবে পরিচালিত করার লক্ষ্যে গণতন্ত্রের মাঝে আরো এক ধরনেরর রূপান্তর ঘটে। তৈরী হয় বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠী, জন্ম নেয় বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের। এর ফলে শাসন যন্ত্র শুধু প্রতিনিধিদের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে না, ক্ষমতার বন্টন ঘটে নানান প্রতিষ্ঠানের হাতে যারা নিজেরা হয়ে উঠে স্বায়ত্বশাসিত। এভাবে সৃষ্টি হয় বহুসংস্থার শাসন। এমনই কিছু সংস্থা হচ্ছেঃ বিচার বিভাগ, মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, স্বাধীন মিডিয়া ইত্যাদি।

বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রের মৌলিক সাতটি উপাদান লক্ষ্য করা যায়ঃ
১। নির্বাচিত প্রতিনিধি ২। প্রভাবমুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ৩। ইনক্লুসিভ সাফরেজ (Inclusive Suffrage) ৪। নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার ৫। বাক স্বাধীনতা ৬। বিকল্প তথ্যের অধিকার ৭। স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা

একটি রাষ্ট্রে যদি সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে থাকে, যদি আধুনিক ও উন্নত সমাজ ব্যবস্থা থাকে, যদি জাতিগত বিভেদ বা জনগণের মাঝে মতভেদ প্রকট না থাকে, যদি বহিঃশক্তির প্রভাব না থাকে এবং রাজনৈতিক সংস্থাগুলো বহুসংস্থার শাসনে বিশ্বাস ও চর্চা করে তবে সেই রাষ্ট্রে বহুসংস্থার শাসনের উদ্ভব হবে এবং সেটি টিকে থাকবে। বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রকে লেখক বলেছেন গণতন্ত্রের সর্বোচ্চরূপ, যা আমরা আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির মাঝে দেখতে পাই।

আগামী দিনের গণতন্ত্রঃ

প্রায় দু’সহস্র বছরের অধিক পূর্বে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার চালু হয়েছিল যেখানে সকল সদস্য একে অন্যের তুলনায় রাজনৈতিক ভাবে সমান এবং সমষ্টিগত ভাবে নিজেরাই নিজেদের শাসন যন্ত্রের নিয়ন্ত্রক ছিল। এই ব্যবস্থা অন্যান্য যে কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থার তুলনায় উৎকৃষ্ট ছিল কারণ- প্রথমতঃ এই ব্যবস্থা সর্বোচ্চ ব্যাক্তি স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করে, দ্বিতীয়তঃ এই ব্যবস্থা মানব সভ্যতার উন্নয়ন করে, তৃতীয়তঃ মানুষের সার্বজনিন ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করার এটাই সবচেয়ে উন্নত পন্থা । গণতন্ত্রের প্রথম রূপান্তরটি ঘটে গণতন্ত্র অথবা প্রজাতন্ত্রের মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্র, কতিপয়তন্ত্রকে দূর করে ক্ষমতার কেন্দ্রে জনগণকে নিয়ে আসার মাধ্যমে। কিন্তু সেই ব্যবস্থা ছিল মূলত ক্ষুদ্র নগর কেন্দ্রিক এবং সরাসরি গণতন্ত্র। দ্বিতীয় রুপান্তরটি ঘটে যেখানে প্রতিনিধিমূলক গনতন্ত্রের মাধ্যমে নগর কেন্দ্রিক গণতন্ত্র হতে দেশকেন্দ্রিক গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়। বৃহৎ আকারের শাসন যন্ত্রের কাজ যথাযত ভাবে সম্পন্ন করার জন্য উদ্ভব হয় শাসন যন্ত্রের বিভিন্ন বিভাগ, যেমনঃ সংসদ, আদালত, নির্বাচন কমিশন। একে আমরা বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রের (Polyarchy) প্রথম রূপ বলতে পারি।

শাসন যন্ত্রের ধরন আরো জটিলতর আকার ধারণ করলে নির্বাচিত প্রতিনিধির পক্ষে সকল সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে অনির্বাচিত প্রতিনিধি যারা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ। তৈরী হয় বিভিন্ন অভিজ্ঞ কমিটি। এটি একধরণের ছদ্ম অভিভাবকত্ব (Guardianship) যেখানে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা নিজেদের ইচ্ছা জনগণের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে না কিন্তু জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনের উদ্দেশ্য জনপ্রতিনিধিদের সাথে কাজ করছে। বিভিন্ন স্বায়ত্বশাসিত মিডিয়া কিংবা জনগোষ্ঠী নানান ভাবে জনপ্রতিনিধিগণকে উপদেশ, পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করে থাকে। এই ধরণের ব্যবস্থাকে আমরা বলতে পারি বহুসংস্থার শাসন যন্ত্রের দ্বিতীয় রূপ। এটিই এই পর্যন্ত গণতন্ত্রের আধুনিকতম রূপ যা আমরা সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দেখে থাকি।

এখন বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রের তৃতীয় রূপান্তর কি অবশ্যাম্ভাবী? লেখকের মতে এটি হতে পারে সাধারণ জনগণের সাথে রাজনৈতিক এলিটদের যে জ্ঞানের ব্যবধান রয়েছে সেটিকে কমিয়ে। ক্ষমতায় আরোহীরা সাধারণ জনগণের চেয়ে অধিকতর বোঝদার সেটা নয় বরং তাঁরা সাধারণ জনগণের চেয়ে বেশি তথ্য পেয়ে থাকেন। যদি জনগণের কাছে সকল তথ্যের প্রবাহ নিশ্চিত করা যায় তবে জনগণও সঠিক ভাবে যে কোন সিদ্ধান্ত প্রদান করতে পারতো। তাই তথ্যের বিকল্প ব্যবস্থার উপর লেখক জোর দিচ্ছেন এবং অভিবাবকদের উপর নির্ভিরতা কমিয়ে জনগণের উপর নির্ভরতা বাড়ানোর উপর জোর দিচ্ছেন। লেখকের মতে বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রের শেষ ধাপ হবে যখন জনগণের সরাসরি অংশ গ্রহণেরর মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত প্রতিফলিত হবে, অনেকটা প্রাচীন গ্রীসের সরাসরি গণতন্ত্রের মত।

শেষ কথাঃ

এটি একটি বড় প্রশ্ন, আমরা কি আসলেই প্রাচীন গ্রীসের সেই সরাসরি গণতন্ত্রে ফিরে যেতে পারি। এর তাত্ত্বিক জবাব হতে পারে আজকের এই তথ্যপ্রযুক্তির যুগে একটি দেশের এর মত বৃহৎ আকারের গণের ক্ষেত্রেও এখন সরাসরি গণতন্ত্র সম্ভব। কিছুদিন আগেও আমাদের হাতে এমন উন্নত প্রযুক্তি ছিল না যার মাধ্যমে নিমিষে বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর মতামত গ্রহন করা সম্ভবপর হতো। কিন্তু আজকের এই মিডিয়া, মোবাইল, ফোন, ইন্টারনেট এর যুগে কয়েক ঘন্টার মাঝেই যেকোন আকারের জনগোষ্ঠীর সিদ্ধান্ত জানা সম্ভব। তাই তাত্ত্বিক জবাব হল, হ্যাঁ, সরাসরি গণতন্ত্র এখন সম্ভব। তার উপর বিভিন্ন কারণেই আজ প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্র মানুষের সার্বজনিন ইচ্ছার প্রতিফলেন ব্যর্থ হচ্ছে। মানুষের মাঝে আজ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি এক ধরণের হতাশা দেখা যাচ্ছে। তাই এটি একটি বড় প্রশ্ন হতে পারে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে সরাসরি গণতন্ত্রই কি হবে আমাদের পরবর্তী রূপান্তর?

কিন্তু সরাসরি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কথা আমরা জানি। রাষ্ট্রের প্রতিটি কাজে যদি জনগণের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে হয় তবে সেটা বাস্তবসম্মত ও কার্যকরী হবে কি? আবার সরাসরি গণতন্ত্রের জন্য নাগরিকদের মাঝে বৈষম্য প্রকট না হওয়া উচিত। কিন্তু যে কোন বৃহৎ আকারের জনগোষ্ঠির ক্ষেত্রে বৈষম্য থাকবেই। তাই আসলে সরাসরি গণতন্ত্র একটি বৃহৎ আকারের রাষ্ট্রের জন্য বাস্তব সম্মত নয়। বিভিন্ন ব্লগ কিংবা ক্ষুদ্র কমিউনিটির জন্য সরাসরি গণতন্ত্র কার্যকর হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সমাধান হতে পারে প্রতিনিধিমূলক ও সরাসরি গণতন্ত্রের এক মিশ্র ব্যবস্থা যেখানে রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কাজ জনগণের পক্ষ হতে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা করে যাবেন জনগণের দ্বারা রচিত বিধিমালা (সংবিধান) মোতাবেক।

কিন্তু জনপ্রতিনিধিরা কখনই ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকবে না। কেন্দ্রে থাকবে জনগণ, অনেকটা সরাসরি গণতন্ত্রের মত। যে কোন মুহুর্তে, যে কোন জনপ্রতিনিধিকে জনগণ অপসারণ করতে পারবে, তাদের ভোটের মাধ্যমে। যেকোন ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবে জনগণ, সরাসরি ভোটের মাধ্যমে। এই ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন ও বিভিন্ন স্বাধীন সংস্থাগুলো জনগণকে সহায়তা প্রদান করবে। বর্তমান পদ্ধতির সাথে এই নুতন পদ্ধতির একটি বড় পার্থক্য হচ্ছে যে কোন জনপ্রতিনিধিকেই দীর্ঘমেয়াদের জন্য নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। অনেকটা চাকুরীর ক্ষেত্রে যেমন বছর বছর কাজের মূল্যায়নের উপর নির্ভর করে চাকুরীর নবায়ন করা হয় সেরকম। এ রকম প্রতি ছয় মাস বা প্রতি এক বছর বা যে কোন সময়েই যে কোন জনপ্রতিনিধির কাজের মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকবে। কেউ ভাল কাজ করলে তিনি আজীবন থাকবেন, না হয় নুতন প্রতিনিধি আসবে। এভাবে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে জনপ্রতিনিধিদের জবাবদীহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব এবং জনগণের কার্যকরী অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা সম্ভব।

দ্বিতীয় বিষয়টি হল তথ্যের বিকল্প ব্যবস্থার পথ নিশ্চিত করা। জনগণকে ক্ষমতার কেন্দ্রে রাখতে হলে, জনগণের কাছ থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত পেতে হলে তথ্যের অবাধ প্রবাহের বিকল্প নেই। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি এই ক্ষেত্রেও সহায়ক হতে পারে। প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠনের তথ্য যদি অন্তর্জাল, পত্রিকা, মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণের দ্বারপ্রান্তে পৌছানো সম্ভব হয় তবে জনগণ সঠিক সিদ্ধান্ত প্রদানে ভুল করবে না এবং এর দ্বারা জনপ্রতিনিধিদের জবাবদীহিতাও নিশ্চিত করা সম্ভব।

গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ভিন্ন অন্য কোন উন্নতর শাসন ব্যবস্থা সম্ভবপর নয়। তাই শুধু প্রয়োজন এর সীমাবদ্ধতাগুলোকে দূর করে ব্যবস্থাটিকে আরো উন্নত করা। জনপ্রতিনিধিদের জবাবদীহিতার মাধ্যমে, জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতার অপব্যবহার রোধের মাধ্যমে, জনগণের হাতে মূল ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে আমরা গণতন্ত্রকে আরো সুসংহত করতে পারি। বহুসংস্থার শাসন, ই-গভর্নমেন্ট, ই-ভোটিং, আনুপাতিক হারে প্রতিনিধি নির্বাচন, ইত্যাদির মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও জনগণের কার্যকরী অংশগ্রহণ আরো বৃদ্ধি করা উচিত যেন জনপ্রতিনিধিরা ক্ষমতার মূল কেন্দ্রে না থেকে জনগণই ক্ষমতার প্রকৃত কেন্দ্রে থাকে। গণতন্ত্র আরো সুসংহত হোক এই আশা ব্যক্ত করে লেখাটি এখানেই শেষ করছি।

** Polyarchy এর অনুবাদ গুগুল ডিকশনারি দেখায় বহুজন কর্তৃক শাসনব্যবস্থা বা বহুশাসনতন্ত্র। কিন্তু আমার কাছে বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রকেই সঠিক বলে মনে হয়েছে এর চরিত্র দেখে। বহুজন শাসনতন্ত্র এক প্রকার গণতন্ত্রের সাথে সামঞ্জস্য। তাই আমি Ployarchy এর অনুবাদ বহুসংস্থার শাসনতন্ত্র হিসেবেই ব্যবহার করেছি।

নোটঃ এই লেখাটি রবার্ট ডাহ্‌ল এর “গণতন্ত্র ও এর সমালোচনা” (Democracy and its critics (Dahl R. A., 1989)) এই বইটির আলোকে লেখা। লেখার “শেষ কথা” অংশটুকু আমার নিজের বক্তব্য। এই লেখা্র আরো্ বেশ কিছু অংশ রয়েছে যা মূলত গণতন্ত্রের কিছু তত্ত্বীয় বিষয় নিয়ে যা সকল পাঠকের ভাল নাও লাগতে পারে, তাই এই লেখায় দিইনি। তাছাড়া লেখার আকার ছোট রাখারও একটি চিন্তা ছিল। বিস্তারিত জানতে কেউ আগ্রহী হলে আমার ব্যক্তিগত ব্লগে সেই অংশগুলো পড়তে পারেন। সেখানে রয়েছে এই বিষয়গুলো গণতন্ত্রের সমালোচনা নৈরাজ্যবাদী ও অভিভাবকতন্ত্রবাদীদের দৃষ্টিকোণ হতে, গণতন্ত্রের যৌক্তিকতা কি, কিংবা বহুসংস্থার শাসন কিভাবে উদ্ভব হয় ইত্যাদি।