সত্যি বলতে কি শুধু ধাক্কাধাক্কি ও নিজ পকেট সামলাতেই ব্যস্ত ছিলাম ২০০৯ সনে একুশে ফেব্রুয়ারীর দিনে শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে। আমার এই লিখাটি পড়ে দেখুন তাহলে বুঝতে পারবেন কি ঝুকি নিয়ে বঙ্গসন্তানরা আজকাল শহীদ মিনারে যায় ভাষা দিবস পালন করতে। এই লিখার এক তিল পর্যন্ত কল্পনাপ্রসূত নয়।
২০০৯ সনের জানুয়ারীতে আমার বড় ছেলে রাশাদ যে এখন ওয়াশিংটনে ভাষাতত্ত্বের উপর গবেষণা করে তার কাছ থেকে একটি আমন্ত্রণ পেলাম ঢাকা যেতে বসন্তের কোনো এক সময়। উত্তরে আমি বললাম, “গত চল্লিশ বছরে একটি বারও ঢাকায় গিয়ে একুশে উদ্যাপন করতে পারিনি। এ’যাত্রায় সেটাই না হয় হোক।” বাপ ও ছেলে মিলে ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝিতে ঢাকায় গিয়ে উপস্থিত হলাম। রাশাদ বাংলাসংক্রান্ত কাজ নিয়ে বাংলা একাদেমী, এসিয়াটিক সোসাইটি, ঢাবির ভাষাতত্ত্ব বিভাগে যাবে বেশ কয়েকবার তাই তাকে আমি উপদেশ দিলাম শাহবাগের সেরাটন হোটেলে থাকার যাতে ভার্সিটি ক্যাম্পাসে যে কোনো সময় পায়ে হেটে যাওয়া আসা করা যায়।
ঢাকায় গত ১০-১২ বছর ধরে ক্রমান্বয়ে যে ভাবে যানজট বেড়েই চলেছে তাতে মহানগরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত যাওয়ার কথা মনে হলে ভড়কিয়ে যাই! আর বাপ-ছেলে মিলে হোটেলে থাকার জন্য নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকে অনেক ভালমন্দ কথা আমাকে শুনতে হয়েছে। একুশের উদ্যাপনের পর আমরা প্রথম হবিগঞ্জের এক বদ্ধ গ্রামে গিয়েছিলাম আমার পৈত্রিক ভিটে বাড়ী স্বচক্ষে দেখার জন্য। সেখান থেকে গিয়েছিলাম সিলেট শহরে আমার মায়ের বাড়িতে তারপর ছুটে চলে গেলাম তামাবিল-ডাউকি সীমান্তে যেখান থেকে শিলং শহরে যাওয়ার রাস্তা আছে। সড়কযোগে শিলং গেলাম আর সেখানে পরিভ্রমন করে আবার সড়কযোগে গেলাম আসামের রাজধানী গৌহাটিতে। সেখান থেকে বিমানযোগে গেলাম শিলিগুড়ি। তারপর চড়াই রাস্তাধরে সড়কযোগে গেলাম কালিমপং শহরে যেটি সিকিমের অত্যন্ত সন্নিকটবর্তী পাহাড়ী শহর। কালিম্পং এ ৩ দিন থাকার পর সড়কযোগে গেলাম দার্জিলিং শহরে হিমালয়ের কাঞ্চনজংগা ‘পিক্’ দেখতে। দার্জিলিং থেকে সড়কযোগে কুচবিহার হয়ে বাংলাদেশের লালমণিরহাটের বুড়িমারী এসে পৌছলাম। বুড়িমারী থেকে সুপার-কোচ ধরে ঢাকা এসে পৌছে গেলাম ভোর রাতে। সেই ভ্রমন বৃত্তান্ত না হয় দেব পরবর্তী লিখায়। এবারে শুধু লিখছি একুশে উদ্যাপন কি ভাবে করলাম সেটির বৃত্তান্ত দিয়ে।
সেরাটনের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম কী ভাবে আমার জীবনের ৪০টি বছর কেটে গেল বিদেশ বিভূই এ। আমার স্মৃতিপটে এখনো মনে আছে ১৯৬৯ সনে তেজগা থেকে কি ভাবে খালি পায়ে হেঁটে আজিমপুর কবরস্থানে গিয়েছিলাম ভাষা শহীদদের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপণ করতে। তার মাস কয়েক পরই আমি আমেরিকায় চলে এলাম স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করতে। এই এত বছরে একবারো পারিনি একুশে উদযাপনের জন্য ঢাকা যেতে। সেজন্য আজ রাতে চরম উৎসাহজনিত কারণে ঘুম এসে এসেও দূরে চলে যাচ্ছিল।
সকাল আটটায় বিদেশী পোশাক বর্জন করে দেশী জামা কাপড় পরে শাহবাগের চৌরাস্তা পার হলাম অনেক কষ্টে। এরি মধ্যে ভীড় প্রচন্ড বেড়ে ওঠে। যাদুঘরের পাশের রাস্তার ওই পারে ফুলের দোকানগুলোতে ভীষণ ভীড় জমে উঠেছে। রাশাদ থেমে কিছু ফুল কিনলো শহীদ মিনারে ফুলাঞ্জলী দেয়ার সংকল্পে। আমি শুধু হাসলাম এই ভেবে যে সেখানে ভীড়ের ঠেলায় কেউ কী থেমে ফুলাঞ্জলী দিতে সক্ষম হবে?
ট্রাফিক পুলিশ রাস্তা কোর্ডন দিয়ে রিকশা আর সি-এঞ্জি গুলোকে ঢুকতে দিচ্ছিল না তাতেই রক্ষে ! ভীড়ের ঠেলায় মুহূর্তের মধ্যে চলে এলাম ঢাবির ফাইন আর্টস ভবনের সমনে। সেখানে দেখলাম যে হবু শিল্পী বিশেষতঃ ভার্সিটির মেয়েরা ‘স্কীন-ইলাস্ট্রেশন’ এর কাজে মহা ব্যস্ত। তুলি দিয়ে মুখে শহীদ মিনারের নক্শা বা প্রজাপতি বা বাংলাদেশের পতাকা এসব আঁকা হচ্ছে এন্তার। ভীড়ের হৈচৈ এর মাঝেও গানের সুমধুর শব্দ ভেসে এলো ক্যাম্পাসের ভেতর থেকে। সেখানে গেলাম সমাবেত কন্ঠ সঙ্গীত শুনতে। তবলা, সিন্থেসাইজার , এসবও ছিল গানগুলো কে জোরদার করার জন্য। বেশ কয়েকটা গান শুনার পর প্রাচীন পাবলিক লাইব্রেরীর দিকে ধাবিত হলাম জনসমুদ্র ঠেলে।
টিএস্সি চত্তরে এসে দেখি যে ভীড়ের মাত্রা আরো বেড়ে গেছে! ঢাকার এক টেলিভিশনের সংবাদদাতা আমাকে এসে জিজ্ঞেস করলো রাশাদ কি বাংলা বলতে পারে? আমি হেসে বললাম, “ওকে বলেই দেখুন না?” অতি সহজেই বুঝতে পারলো আমি কী ‘মিন’ করছি। রাশাদকে সে ছেঁকে ধরলো ইন্টারভিউ নেয়ার জন্য। সুদূর আমেরিকা থেকে এসে একুশে উদযাপণ করতে রাশাদের কেমন লাগছে সেটা জানতে চাইলেন টিভি সাংবাদিক। আমি ভেবেছিলাম এই ‘মিনি ইন্টারভিউ’ এর অপমৃত্যু ঘটবে অতি শীঘ্রই! কিন্তু পরে আত্মীয়স্বজনের মুখ থেকে শুনলাম বেশ কয়েকবার নাকি ‘এন-টিভি-তে রাশাদের এই প্রাণবন্ত ইন্টারভিউ পালাক্রমে দেখানো হয়েছে ২১শে ফেব্রুয়ারীর দিনে।
টিএস্সি চত্তরে যে এত ভীড় হতে পারে সেটি আগে বুঝে উঠতে পারি নি। ব্যাপার খানা কী? রাজপথে খোলা আকাশের নীচে নাটিকা হচ্ছে – রীতিমত যাকে বলে জনপথে ‘পার্ফরমিং আর্টস্’। রাজাকারদের নিয়ে কৌতুক অভিনয় হচ্ছে খাটি বাঙাল্ ভাষায়! উপস্থিত জনতা বেশ উপভোগ করছিল কটাক্ষযুক্ত ‘ডায়োলোগ’ গুলো শুনে। সেখান থেকে ভীড় ঠেলে আমরা এগিয়ে চললাম শহীদ মিনারের দিকে।
রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুলিশ দাঁড়িয়ে শুধু যে পাহারা দিচ্ছে তাই নয়, জনতা যাতে উচ্ছৃঙ্খল না হয় দাঁড়ায় সে দিকে তাদের সতত দৃষ্টি ছিল। টিএস্সি চত্তর থেকে ২০-৩০ মিনিট হেটে গিয়ে উপস্থিত হলাম শহীদ মিনারে। সেখানেও বেজায় ভীড়। পুলিশরা জনতা কন্ট্রোলে শশব্যস্ত! টিভি সেন্টারের ক্যামেরাম্যান ইয়া বড় ‘ট্রাইপড’ লাগিয়ে মিনার প্রাঙ্গণে জনতার দেয়া শ্রদ্ধাঞ্জলীর ‘মুভিং ইমেজ’ তুলতে ব্যস্ত। কিছু বুঝার আগেই পুলিশ এসে আমাদের সারিবদ্ধ করে লাইনে ঢুকিয়ে দিল। পেছন থেকে জনসমুদ্রের ঢেউ এত জোরে ধাক্কা দিচ্ছিল যে সমতা রক্ষা করতে আমরা অতি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। পেছন থেকে কারা যেন হাত বুলিয়ে আমাদের পকেটে কি আছে না আছে তার হিসেব নিচ্ছিল। রাশাদ কোনো মতে তার আনা ফুল মিনারে ছুঁড়ে দিল। মিনার প্রাঙ্গণে কতক্ষণ আমরা ছিলাম তা বুঝে উঠতে পারিনি; তবে সেটি যে এক মিনিটের চেয়ে কম তা হলপ করে বলতে পারবো।
মিনার প্রাঙ্গণ থেকে বের হয়ে আমরা দোয়েল চত্তরের দিকে ছুটে গেলাম। রাস্তার চারিদিকে হাতের বানানো জিনিষের স্টল বসে গেছে। দেখে মনে হছিল যেন একটা মিনা বাজারে ঢুঁকে পড়েছি! এখানে দেখছি ভীড়ভাট্টা অনেকটা কম। রাশাদ আঙ্গুল দিয়ে চার নেতার কবরস্থান দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো ওই মনুমেন্টটা কী? উত্তরে আমি বললাম, “যে নেতারা বেচে থাকাকালীন একে অপরের ছায়া পর্যন্ত মাড়াঁতে চান নি, তাঁরা এখান মহা শান্তিতে বাহুলগ্ন হয়ে পাশাপাশি শুয়ে আছেন, রেস্টিং –ইন-ইটারনাল্ পীস্!”
এই বিশাল মনুমেন্টে পৌছে রাশাদ বুঝতে পারলো যে তার সেল-ফোনটি পকেট থেকে খোয়া গেছে। আমি তাকে বললাম যে শহীদ মিনারে জনতার স্রোতে আমরা যখন ভাসছিলাম তখন পকেটমাররা তাদের কাজ হাসিল করেছে। ঢাকা আসার আগে মাত্র সেল-ফোনটি সে কিনেছিল, সেটি খুইয়ে মেজাজ তার খারাপ হয়ে গেছে। তার মনের অবস্থা লঘু করার জন্য আমি বললাম, “পকেটমাররাও তো মানুষ! তাদেরকে তো বাঁচার তাগিদে কিছু করে খেতে হবে?” রাশাদের সকরুন অবস্থা দেখে মনুমেন্টে প্রায় শ’খানেক লোক জমা হয়ে আমাদেরকে জিজ্ঞেস করলো ব্যাপারখানা কী ? তাদের সব বুঝিয়ে বললাম। জনতার কেউ কেউ শাহবাগ থানায় গিয়ে রিপোর্ট করতে বললো। দু’ এক জন আবার চুটকি কেটে বললেন যে পুলিশের সাথে পকেটমারদের হট-লাইন আছে। উনারাও লুটের ভাগ পান। আমাদের বই মেলায় যাওয়ার কথা ছিল এসিয়াটিক সোসাইটির স্টলে, সে’ কথা রাশাদকে মনে করিয়ে দিলাম।
ভীড় ঠেলতে ঠেলতে বাংলা একাদেমীর প্রাঙ্গণে গিয়ে হাজির হলাম। সেখানে এসিয়াটিক সোসাইটির স্টলে গেলাম। তারা আগে থেকেই জানতেন যে আমরা তাদের বুক স্টলে আসবো। আমাদেরকে স্টলের ভেতরে বসানো হলো। জল-খাবারের বন্দোবোস্ত করলেন ম্যানেজার সাহেব। ক্রেতারা মনে করলো যে আমরাও বিক্রেতা, তাই বাংলাপেডিয়া সিডির কথা বারবার জিজ্ঞেস করলো অনেক ক্রেতারা। পরে শুনলাম যে এই সিডিটার নাকি খুব কাটতি বাজারে।
এসিয়াটিক সোসাইটির ম্যানেজার রাশাদের মুখ থেকে শুনলেন যে রাশাদের সেল-ফোনটি চুরি হয়ে গেছে দিন-দুপুরে। তিনি পরামর্শ দিলেন যে আমরা যেন শাহবাগের পুলিশ স্টেষনে গিয়ে এক্ষনি একটা জিডি করি এই চুরির ব্যাপারটা জানিয়ে। তিনি আরো বললেন, “আপনারা বিদেশ থেকে এসেছেন, বলা যায় না, এটা রিট্রিভ করে দিতে হয়তো পারবে তারা।”
শাহবাগের পুলিশ স্টেশন ‘বেই মেলা’র ভ্যানু হাতের কাছেই, তাই জনসমুদ্র ঠেলে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলাম। পুলিশ স্টেশনে মহা কান্ড চলছে। খবরে বের হয়েছে যে তালেবান সমর্থিত সন্ত্রাশীরা নাকি বোমা ফাটাবে একুশের উদযাপনিতে, তাই পুলিশরা মহা ব্যস্ত। সামান্য এই সেল-ফোন খোয়ানোর ‘ডিটেইল’ কোন পুলিশ আর শুনিতে চায় না আমাদের কাছ থেকে। অনেক খোঁজাখুজির পর একটি কক্ষে গিয়ে হাজির হলাম। এই সেকেন্ড আফিসার আমাদের কথা শুনে পরিশেষে বললেন যে একটা জিডি করে দেন। আমি ইংরেজীতে লিখা একটা পিটিশন সাথে এনেছিলাম, সেটি তার হাতে উঠিয়ে দিলাম। তিনি সেটি দেখলেন দু’তিন বার আর বললেন, “সব ঠিকই আছে, তবে দরখাস্তটা হতে হবে বাংলায়।” আমি বললাম, “তথাস্তু!” তিনি আমাকে ডিক্টেশন দিলেন কি কি লিখতে হবে, আমি তাই লিখলাম। এরি মধ্যে তিনি চা আনালেন আমাদের জন্য। জিজ্ঞেস করলেন কি করি, কোথায় থাকি, কবে দেশ থেকে বিদেশে গেছি, ইত্যাদী, ইত্যাদী।
আমরা পুলিশ স্টেশনে বসে থাকাকালীন অনেক খবর পেলাম রাহাজানি, পকেটমারী, আর চুরিচামারীর। শহীদ মিনারের কাছে কোথায় নাকি এক ডজন পকেটমার ধরা হয়েছে এই মাত্র। পুলিশরা নাকি এই সব সিন্ডিকেটদের অনেক খবর রাখে। রাশাদ বললো ধৃত পকেটমারদের কাছে গেলে হয় না কী? পুলিশ আফিসার বললেন তাতে কোনো কাজ হবে না। চুরির মাল ওরা নাকি হাতে রাখে না, অল্প সময়ের মাঝে সেটি পার করে দেয় ঘটনাস্থল থেকে। আমরা বসে থাকাকালীন এক ক্যানেডিয়ান বংগ সন্তান এসে বললেন তারও নাকি সেল-ফোন শহীদ মিনারের ভিড়ে পকেটমারী হয়েছে। ভীষণ দামী ফোন, মাত্র কেনা টোরান্টতে ঢাকায় আসার আগে। বেজার মুখে তিনি চেয়ারে বসলেন জিডি করতে। পুলিশ আফিসার বললেন যে সেল-ফোনটি পাওয়া গেলে আমাদের কন্টেক্ট করবেন স্থল-ফোনে। আমি রাশাদকে কানে কানে বললাম সেটি আর হবে বলে মনে হয় না। আমার ভবিষৎবাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্য হিসেবে প্রতিপন্ন হয়েছে। আমরা আমেরিকায় ফেরত আসার পর আমাদের ঢাকার আত্মীয়রা পুলিশের কাছ থেকে কোনো ফোন কল পায় নি গত একবছরে!!!
সারাদিন ঘুরাঘুরি করার পর সন্ধ্যার দিকে পায়ে হেঁটে সেরাটন হোটেলে ফিরলাম আমরা দুই বাপ-ছেলে। শরীর অবসন্ন, তবে রাশাদের মানসিক অবস্থা আরো শোচনীয়! তার সব ফোন এড্ড্রেস-বুক খুইয়ে যাওয়ার শোক তার চোখে মুখে বিদ্যমান। এ’রকমটি যে হতে পারে তা আমি জানতাম, তাই শুন্যপকেটে আমি বের হয়েছিলাম একুশে উদ্যাপন করতে।
এখানে একটি ব্যাপার না বললেই নয়। ছোট বেলায় ১৯৫০ দশকে আমরা বেশ ভাব-গম্ভীর পরিবেশে একুশে পালন করতাম। তবে, এই দিবসের উদ্যাপন এখন একেবারে অন্যরকম ভাবে হয়। এই দিনকে এখন বলা হয় “বিশ্ব ভাষা দিবস”। গত অর্ধ শতাব্দীতে পৃথিবীর সাথে সাথে বাংলাদেশও অনেক বদলে গেছে। আমার হারিয়ে যাওয়া ঢাকা শহর যেখানে শুধু মাত্র রিকশা, ঘোড়ার গাড়ী, বেবী-টেক্সী, আর ব্রেড-ফোর্ড মুড়ীরটিনের বাস সরু রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করতো, সেখানে এখন চলে হাজার হাজার টেক্সী, সিএঞ্জি। ১৯৫০ দশকে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৩০০,০০০ থেকে ৪০০,০০০। এখন তার পরিমাণ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০,০০০,০০০ থেকে ১২,০০০,০০০। অর্থাৎ ৩০-৪০ গুন বেশী লোক এখন ঢাকায় থাকে।
একুশের রাতে রাশাদ যখন ফাগুনের আগুন ঝরা রাতে বিছানায় ঘুমিয়ে ছিল, তখন হোটেল কক্ষের এসি পুরোদমে চলছিল, আমি নীরবে রুম থেকে বের হয়ে পায়ে হেঁটে বই মেলায় গেলাম আরেকবার তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় রচনা সমগ্র কিনতে। রাত তখন ৮ টা। ঢাবির ক্যাম্পাসে ও রাস্তায় অনেক যুগল কপোত-কপোতিদের দেখলাম বাহুলগ্ন অবস্থায়। মনে হলো যেন ‘মডার্নিটি’ অবশেষে ঢাকায় এসে পৌছেছে!
—————
ড, জাফর উল্লাহ্ মার্কিনমুল্লুকের নিউ ওর্লিয়ান্স শহরে বসবাস করেন।
চমৎকার লাগলো লেখাটা, আরো সুন্দর ছবিগুলো। গতবছর ফেব্রুয়ারীতে জাফর ভাইয়ের দেশে যাবার কথা যখনই শুনেছিলাম তখনই ভেবেছিলাম এ নিয়ে লেখা একটা পাওনা আছে। প্রত্যাশার প্রাপ্তি এ বছরে।
জাফর ভাইয়ের কাছ থেকে এ ধরণের আরো লেখা আশা করছি।
@অভিজিৎ,
আপনারটা কি খুব সহসাই আমরা পাওয়ার প্রত্যাশা করতে পারি,না-কি ? ?
জাফর ভাই,
আজকে জীবনানন্দের জন্মদিন। আপনার কাছে একটা লেখা আশা করেছিলাম।
@বকলম,
অতি ব্যস্ত জীবনে ভুলেই গিয়েছিলাম যে আজ আমাদের প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশের জন্ম দিন। কবি নজরুলও কিন্তু ১৮৯৯ সনে জন্ম। দেখি তাড়াহুড়া করে একটা পোস্ট দাঁড়া করানো যায় কিনা আজকে।
জাফর ভাই,
ওটা কী চার নেতার মন্যুমেন্ট নাকি তিন নেতার মাজার বা মন্যুমেন্ট। আমার জানামতে ওখানে তিন রাজনৈতিক নেতা – হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিমুদ্দিন ও শেরে-বাংলা এ.কে. ফজলুল হককে কবরস্থ করা হয়েছে। চতুর্থ কোন নেতার কবর ওখানে আছে বলেতো আমার জানা নেই। থাকলে কে তিনি? বাংলা উইকিপিডিয়াও দেখলাম তিন নেতার মাজারই বলছে।
@ফরিদ আহমেদ,
এটি আমারই অনিচ্ছাকৃত ভুল। এই মনুমেন্টটি তিন নেতার কবরস্থান। এঁরা ১৯৬০ দশকে মারা গিয়েছিলেন। তখন আমি দেশেই ছিলাম ছাত্রাবস্থায়। খাঁজা নাজিমুদ্দিন সবসময়ই মুসলিম লীগ করতেন তবে জিন্নাহর পাঁ-চাটা ছিলেন বলে পূর্ব বঙ্গের শিক্ষিত সমাজ তাকে খুব একটা পছন্দ করতেন না। শেখ ফজলুল হক করতেন কৃষক সমাজ পার্টি বিভাগোত্তর কাল থেকেই। হক সাহেব তাঁর জীবনে একটি বড় ভুল করেছিলেন জিন্নাহকে সমর্থন করে এবং ১৯৪৭ সনের পর তিনি সেটি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। হোসেন শহীদ সোরওয়ার্দী সাহেব ও সেই ভুলটি করেছিলেন ১৯৪০ দশকে। তিনি প্রথম জীবনে নেতাজী শুভাষ বোসের চেলা ছিলেন এবং কোলকাতায় ফোরওয়ার্ড ব্লকের সমর্থক ছিলেন। জিন্নাহসহ আরো অনেকেই এনার মগজ ধোলাই করেছিল পাকিস্তান পাকিস্তান করে করে। এই তিন নেতার রাজনৈতিল দর্শন ছিল তিন প্রান্তে। কি ভাবে যে তিন জন এক প্রাঙ্গনে সমাহিত হলেন তা কোনসময়েই বুঝে উঠতে পারি নি। আবারো ধন্যবাদ ভুলটি সংশোধন করার জন্য!
@ফরিদ আহমেদ, আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যতদূর জানি, খাজা নাজিমুদ্দিন বাংলাদেশের ইতিহাসের কোন উজ্জ্বল চরিত্র না। কেন তাঁকে এত আদরযত্নের সাথে সমাহিত করা হল?
@পৃথিবী,
এর জবাব আমার কাছে নেই। এরা তিনজনই ত্রিশ, চল্লিশ এবং পঞ্চাশের দশকে রাজনীতি করতেন, তখনকার সময়ের হেভিওয়েট ছিলেন। মারা গেছেন ষাটের দশকের শুরুতে। যারা ওই সময়কার রাজনীতিকে কাছের থেকে দেখেছেন তারাই বেশি ভাল করে বলতে পারবেন এর কারণটা কী।
খাজা নাজিমুদ্দিন কখনোই বাঙালিদের স্বার্থ দেখেননি, বরং এর বিরোধিতাই করেছেন সবসময়। তার শ্রেণীগত অবস্থান এবং উর্দুভাষী হবার কারণে পশ্চিম পাকিস্তানীদের দালালীই করেছেন তিনি সারাজীবন ধরে। তারপরও তাকে আমরা জাতীয় নেতা বলছি, তার জন্য মন্যুমেন্ট তৈরি করেছি, তার নামে পুরনো ঢাকায় গুরুত্বপূর্ণ একটি রাস্তার নামকরণও করছি।
@ফরিদ আহমেদ,
খাজা নাজিমুদ্দিন ভাষা আন্দোলনের সময়কালে পূর্ব বাংলার মূখ্য মন্ত্রী ছিলেন মনে হয়। ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের গুলি চালানো তার সরকারের নির্দেশেই হয়।
@ফরিদ আহমেদ,
আমার ভুল হয়েছিল। খাজা নাজিমুদ্দিন ভাষা আন্দোলনের সময় বাংলা নয়, পাকিস্তানেরই প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
তবে এরপরেও কেন তাদের নামে এখনো আমাদের দেশে এত জয়জয়কার তার কিছু কারন আছে।
ইনি ছিলেন ঢাকার ঐতিহ্যবাহী নবাব পরিবারের লোক। ঢাকা শহরের উন্নতির পেছনে এনাদের প্রভূত অবদান আছে। যেমন ঢাঃবিঃ বুয়েট মেডিকেল এসবের যায়গা এই পরিবারের দান বলেই শুনেছি।
@পৃথিবী,
নাজিমুদ্দিন যখন ইহধাম ত্যাগ করেন ১৯৬৪ সনে তখন ছিল আইয়ুব খাঁর যুগ। আইয়ুব খাঁ এরি মধ্যে মুসলিম লীগে যোগ দিয়েছিল। সে’ জন্য মুসলিম লীগার নাজিমুদ্দিনের জায়গা হয়েছে রমনার এই প্রাঙ্গনে। নাজিমুদ্দিনের আগে ১৯৬২ সনে ফজলুল হক ও ১৯৬৩ সনে হুসেন শহীদ সোরয়ার্দী মারা যান।
বইমেলা আসলে আমাদের সংস্কৃতিকে অনন্য করে তুলেছে।