আমার না বলা কিছু কথা।

আকাশ মালিক

(উৎসর্গ, ম্যারিয়া ওয়েলস)

যে কথা বলবো বলে আজ লিখতে বসেছি তা কোন ঘটনাই নয়। তাই কোথায়, কী ভাবে, কোথা হতে, কখন এর শুরু, সঠিক ভাবে বলা যাবেনা। স্মৃতির পাতা তন্নতন্ন করেও খুঁজে পাইনা আমি অবিশ্বাসী হলাম কোন্ দিন থেকে? কোন খনিজ দ্রব্যের সঙ্ঘর্ষের ফলে বিস্ফোরণ, বা বিগ ব্যাং এর মত ঘটনা হলে সময় কাল নির্ধারণ করা যেতো। বেঙ, মাছি বা প্রজাপতিরা কি বুঝতে পারে তারা আগে কী ছিল, ঠিক কোন্ শুভক্ষণে তাদের রূপান্তর ঘটে? ব্যাপারটা বোধ হয় এ রকম কিছু। এ প্রশ্নটি অনেকেই আমাকে করেছেন যে, আমি অবিশ্বাসী হলাম কী ভাবে কোন্ দিন থেকে? ‘কোন্ দিন থেকে’ এ প্রশ্নের যেহেতু সঠিক উত্তর জানা নেই, তাই ‘কী ভাবে অবিশ্বাসী হলাম’ তা’ই বলা ভাল। স্মৃতির পাতার অনেক কিছুই আজ অস্পষ্ট, আর কিছু বিলীন হয়ে গেছে চিরতরে। জীবনে চলার পথে বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা যা কিছু আজও স্পষ্ট দেখতে পাই তা থেকে কুড়িয়ে কুড়িয়ে এনে আজ কিছু ঘটনা বর্ণনা করবো।

একটি রক্ষণশীল ধার্মিক পরিবারে আমার জন্ম। ঠিক কত বয়সে বাবা আমাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করেছিলেন আজ আর মনে নেই। ছোট বেলা থেকেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতাম মহা-পরাক্রম, প্রতাপশালী বিরাট শক্তিশালী আল্লাহ একজন সাত আসমানের উপরে বসে আছেন, তিনি আকাশে পাতালে যা কিছু দৃশ্য অদৃশ্য সবকিছুর স্রস্টা, রক্ষক ও নিয়ন্ত্রক। বিশ্বাস করতাম সত্য, কিন্তু তাকে অন্যান্য মানুষের মত, বা যেভাবে মানা উচিৎ সেভাবে কোনদিনই মেনেছি বলে মনে পড়েনা। ছোট বেলায় আল্লাহকে যত গালি দিয়েছি (অবশ্যই মনে মনে) সারা জীবনেও মানুষকে এতো গালি দেইনি। অকথ্য অশ্লীল ভাষায়ও গালি দিয়েছি, এমন কি একদিন পূর্ণিমার চাঁদনী রাতে, ভরা গাঙ্গের জলে নৌকা ভাসিয়ে দিয়ে গলুইয়ের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে প্রস্রাব করেছি, এই আশায় যে আল্লাহ যদি কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়। আল্লাহ কিছুই করেনা। তখন ভাবতাম আল্লাহ তো বিরাট বড় মহান, এই সীমাহীন আকাশ, বিশাল পৃথিবীর দায়িত্ব তার হাতে, তাই আমার মত পিচ্চি বালকের দুষ্টুমিতে তার সাড়া দেয়া ইজ্জতে ধরে, অথবা তিনি আমাকে সুযোগ দেন বা পরীক্ষা করেন। আল্লাহকে এমনিতে বকাবকি করতাম না, এর পেছনে কারণও ছিল। কোন খেলায় বা প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বিকে হারাতে না পারার ক্ষোভে, অথবা আমি যা চাই তা না পেলে আল্লাহকে অভিশাপ দিতাম- তুমি বেটা অন্ধ, বোবা, কিছু করতে পারোনা তো মরো না কেন? শবে বরাতের রাতে সারা রাত গাছের দিকে তাকিয়ে কাটিয়েছি, কোন গাছ-বৃক্ষ আল্লাহকে সেজদা করতে দেখলাম না। বড়দেরকে কারণ জিজ্ঞেস করায় বললেন, ‘গাছের সেজদা বড়বড় আউলিয়াগণ ছাড়া কেউ দেখতে পায়না’।

যখন দিন তারিখ ঠিক করা হলো আমার মুসলমানী (Circumcision) হবে, মানত করলাম একটা রোজা রাখবো, রেখেছিও। শাহ পরাণের মাজারে গিয়ে মোমবাতি, আগরবাতি দিলাম, শিন্নী দিলাম, দোয়াও করলাম- ‘আল্লাহ, যে আজম বেটা আমার মুসলমানী করবে তাকে ফেরাও, একটা রোগ দাও, না হয় তাকে মেরে ফেলো, সে যেন আমাদের বাড়িতে আসতে না পারে’। আল্লাহ আমার কথা শুনলেন না, তাই আমি তাকে গালি দিয়েছি।

গ্রামে রাস্তায় চলার পথে প্রশস্ত পরিষ্কার রাস্তা ছেড়ে, বন-বাদাড় জংগলের বাঁকা সংকীর্ণ দুর্গম পথে চলা, আর নিষিদ্ধ এলাকায় প্রবেশ করা আমার একটা নেশা ছিল। কেন ছিল জানিনা। তবে ভাবতাম, নিত্যদিনের পরিচিত সোজা পথে সবাই তো হাটে, অন্য পথে গেলে নতুন কিছু দেখা বা পাওয়া যেতেও পারে। হিজল গাছের মরা শাখার গর্তে দোয়েলের বাচ্চা, বা কালাকচুর পাতায় টুনটুনির বাসা পেলে মন্দ কি? আমাকে বলা হতো, মাদ্রাসায় যাওয়া আসার পথে কালণী বুড়ির জঙ্গল দিয়ে কোনদিন যাবেনা কারণ ঐ জঙ্গলের বিশাল উঁচু চৈতা গাছের মাথায় নারায়ণ সিং দানবের বাসা। শুনতে অবশ্যই ভয় লাগে, কিন্তু সত্য কথা বলতে কি ঐ চৈতা গাছের নিকটে আসলেই আমার কেন জানি প্রস্রাবের বেগটা বেড়ে যেতো। আবুল (আমার সহপাটি) বলতো, দেখবে একদিন তোর ওটা পঁচে গলে নিঃশেষ হয়ে যাবে আর খুঁজেও পাবিনা। আমি বলতাম তা হউক, তুই শুধু হুজুরকে বলবিনা আমি পেশাব করে পানি লই নাই। জীবনে ভাল মতে একদিনও অজু করে নামাজ পড়ি নাই। আর রোজা? ঐ একদিনই রেখেছিলাম। তারপর তওবা করেছি আর না। তবে রোজা রেখে বিড়ি যদি খাওয়া যেতো তাহলে হয়তো আরো দু একটা রাখতাম। মাদ্রাসায় মাঝে মাঝে নামজের আজান দিতাম, নামাজ পড়তাম না। আবুলকে একটা বিড়ি ঘুষ দিয়ে বলতাম- তুই আকামত দিবি, আমি মাদ্রাসার পেছনে তেঁতুল গাছের গুড়িতে বসে মনের সুখে বিড়ি টানব। আমার এই বিশ্বস্ত সহপাটি বন্ধু আবুল একদিন আমাকে ভীষণ দুঃখ দিয়ে দিল। আমরা তখন মক্তব পাঞ্জমে (পঞ্চম শ্রেণী) পড়ি। বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহনকারী ছাত্রদেরকে দুই মাস মাদ্রাসায় রেখে পড়ানো হতো। একদম গরুর খোয়াড়ে বন্দী অবস্থা। একদিন ‘তারিখুল ইসলাম’ (ইসলামী ইতিহাস) এর হুজুর বললেন- ‘তিন মাইল দূরে এক গ্রামে বিরাট ওয়াজ মাহফিল আছে আমাদেরকে রাতে সেখানে যেতে হবে’। হুজুর আরো বললেন যে, দেশের সেরা আলেমগণ সেখানে আসবেন। তম্মধ্যে একজন আউলিয়া আসছেন, যাকে একই সাথে দুই জায়গায় অবস্থান করতে লোকে দেখেছে। আবুল বললো সেও কার কাছ থেকে শুনেছে ঐ মৌলানাকে কেউ নাকি একই দিনের একই সময়ে ঢাকায় এবং সিলেটে ওয়াজ করতে দেখেছে। আমি মনে মনে আল্লাহর কাছে একটা লম্বা দোয়া করলাম- ‘হে মাবুদ, আমি যদি ছহি-সালামতে ঐ আউলিয়ার জুতা মুবারক চুরি করতে পারি, কসম তোমার, আমি বিড়ি খাওয়া ছেড়ে দেবো’। আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করলেন, কিন্তু আমি বিড়ি ছাড়ি নাই। ফজরের নামাজের আগে জিকির শুরু হলো। সবাই হেলেদুলে চোখ বুঁজে জিকিরে মত্ত। আমার কাজটা সেরে নিতে কোনই অসুবিধা হলোনা। ঐ দিনই জোহরের নামাজের পরে হুজুর আমাকে ডেকে তার রুমে নিলেন। তার চেহারার দিকে তাকিয়ে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। রক্তবর্ন গাল, ঠোঁট কাঁপছে, হাতে একটি এবং পাশে আরো চারটি মুড়ালী বাঁশের কাঁচা পাকা বেত। হুজুর জিজ্ঞেস করলেন- ‘জুতা কই’? আমি বললাম, ‘আসার পথে কাছিম বাড়ির ডরে (গভীর জলের কুয়ো) ফেলে দিয়েছি’। হুজুর জানেন এই ডরের নিচে শুধু বিশালাকারের কাছিমই (কচ্ছপ) নয় আরো ভয়ংকর জন্তুরাও বাস করে। এই ডরে পা রাখার সাহস সাত গ্রামে কারো নেই। সুতরাং জুতা উদ্ধার করা আর সম্ভব নয়। হুজুর আমার গায়ে বেত্রাঘাত করার আগেই আমি ডান হাত বাড়িয়ে দিলাম। তিনি দরজা বন্ধ করে দিলেন। যতটুকু শক্তি তার গায়ে ছিল সব উজাড় করে বেত্রাঘাত শুরু করলেন। আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। প্রথম চার পাঁচটা বাড়ির পরপর আমি হাতের মুষ্টি শক্ত করে বন্ধ করে আবার খুলে দিয়েছিলাম। এই ট্রিকসটাও শিখেছিলাম আবুলের কাছ থেকে। সে প্রায়ই পড়ার জন্যে পিটুনি খেতো। বলতো, হাতের মুষ্টি শক্ত করে বন্ধ রাখলে হাতে রক্ত চলাচল কম হয়, আঘাত বেশী টের পাওয়া যায়না। একটি বেত আগা থেকে ভেংগে ভেংগে যখন গোড়ায় আসলো হুজুর তখন ক্লান্ত আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না, আমারও মুষ্টি বন্ধ করার শক্তি আর হাতে নেই। তিনি চারটি বেত একসাথে নিয়ে কয়েকটি আঘাত করলেন, আমি আর কিছুই টের পেলাম না। হুজুর বসে পড়লেন, হাত দিয়ে ইশারা করলেন বেড়িয়ে যেতে। এখান থেকে আবুলের সাথে আমার বন্ধুত্বের সমাপ্তি আর হুজুরের শাস্তির প্রতিশোধ নেয়ার শুরু।

দুই মাস মাদ্রাসায় থেকে পড়ার সময় প্রায় শেষ। বৃত্তি পরীক্ষায় যাওয়ার দু দিন আগের কথা। মাটির বেড়া টিনের ছাউনীর মাদ্রাসার দক্ষিণ বেড়া ঘিরে দুটো পেঁপে গাছ ছিল। একটা পাঁকা পেঁপে হুজুরের দৃস্টিতে পড়লো। তিনি একজন ছাত্রকে হুকুম করলেন ফলটি নিয়ে আসতে। এবার আর আল্লাহর কাছে দোয়া করলাম না। আগের বার আল্লাহ দোয়া কবুল করেছিলেন সত্য, কিন্তু পরে আমাকে শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে। ফলটি তৈরী করতে করতে আজানের সময় হয়ে গেলো। টিনের বরতনে (প্লেইট) কাটা পেঁপে রেখে হুজুর নামাজে চলে গেলেন। নামাজ শেষে তার রুমে ফিরে আসলেন। আমি পাশেই টিউব-ওয়েলের (নলকূপ) নিচে বসে টুপি ধোয়ার ভান করছিলাম। বিসমিল্লাহ বলে হুজুর এক টুকরো পেঁপে মুখে দিলেন। পরক্ষণেই থুথু করে বের করে ফেলে দিলেন। একজন ছাত্রকে ডেকে এনে বললেন- ‘দেখতো ফলটা কি পঁচা নাকি, কি যেন একটা গন্ধ লাগে, পাঁকা পেঁপে নুনটা হয় কী করে’? আমি মনে মনে বললাম, খাও বাবাজী খাও, মনের সুখে পেট ভরে খাও, আমার হাতের দাগ এখনও শুকায়নি, তুমি খাও। হুজুরের বেত্রাঘাতে সেদিন মোটেই চোখে জল আসেনি, আমি কেঁদেছি তার বিদায়ের দিনে। আমার অজান্তে মাদ্রাসার ভেতরে গত দুই মাসে একটা ঘটনা ঘটে গেছে যার কিছুই আমি ভালভাবে বুঝতাম না। ছাফেলা আউয়ালে (ষষ্ঠ শ্রেনী) উঠে শুনলাম ঐ হুজুরকে সমকামিতার অভিযোগে মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বিদায়ের দিন হুজুর গোপনে আমাকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন- ‘তুই আমাকে বদ-দোয়া (অভিশাপ) দিয়েছিলে’? আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। কী উত্তর দেবো ভেবে পাইনা। হুজুরের চোখের উপর চোখ ফেলে অপলক নির্বাক নিরুত্তর ঠাই দাঁড়িয়ে আছি। ঐ দিনের কথা মনে পড়লো। হঠাৎ আমার ডান হাতের পাঁচটা আঙ্গুল মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেল আর ঠিক তখনই অঝোরে দু চোখ বেয়ে নেমে আসলো অশ্রুধারা। বুকটা বারবার ফুপিয়ে ফুপিয়ে উঠছিল। দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে কাঁপা ভগ্নকণ্ঠে অস্পষ্ট স্বরে বলেছিলাম- ‘হুজুর সেদিন আপনি আমাকে এভাবে না মারলেও পারতেন’।

এ ছিল আমার দশ থেকে বারো বৎসর বয়সের কাহিনি। পরের বৎসর আমার মা মারা যান। আমার জগৎটা যেন উলট পালট হয়ে গেল। পাড়ার ছেলেদের সাথে লুকিয়ে লুকিয়ে মারবেল খেলতে, ফুটবল খেলতে গিয়ে মাঝে মাঝে ধরা পড়ে হুজুরদের হাতে কত মার খেয়েছি। এখন আর সেদিকে মন যায়না। সেই চঞ্চলতা, দুরন্তপনা ভাব আর নেই। নিজের অজান্তেই শান্ত হয়ে গেলাম। ওদিকে ছাফেলা আউয়াল থেকে ফার্সী ও ছাফেলা দুওম (সপ্তম শ্রেনী) থেকে আরবী গ্রামার শুরু হয়। হুজুররা বলতেন এই দুই বিশেষ জামাতের ছাত্রদের কুত্তার মগজ হওয়া চাই। আসলেই আমাদের পড়ার অবস্থা দেখলে কুকুরও অবাক হতো যে, এই ছাত্রগুলো রাতদিন এত বকবক করে কীভাবে? এ ভাবে আরো চার বছর অতিবাহিত হলো। ৯টি বছর মাদ্রাসার শিক্ষা জীবনে যা পড়লাম, তা শুধুই মৃত্যুর পরে কবরের জীবন নিয়ে। কো্রান হাদীস চষে এতদিনে যা জেনেছি তা এক আরব্য উপন্যাস ছাড়া আর কিছু নয়। তবে ওমর খৈয়্যাম, শেখ সা’দী ও জালালুদ্দীন রুমীর মতো বেশ কয়েকজন বিখ্যাত পার্সীয়ান কবি, সাহিত্যিক দার্শনিক এর লেখা পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। এ মহা বিশ্ব, এ সুন্দর পৃথিবী নিয়ে মাদ্রাসার কোন ভাবনা চিন্তা নেই।

ছোট বেলায় বিশেষ কয়েকটি জিনিস নিয়ে আমি খুবই ভাবতাম। যেমন, জোয়ার ভাটা, সূর্য-গ্রহণ, চন্দ্র-গ্রহণ, চাঁদের বুড়ীর সুতা কাটা, ভুমিকম্প, রংধনু, যাদু-টোনা, জীন-ভুত, ভুতের আগুন, সাপের মন্ত্র আর তাবিজ। এ ছাড়াও মানুষের দাঁত থেকে বাইদানীরা কী ভাবে পোকা বের করে, সিলেটের হাসান মার্কেটের চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে গোড়া কৃমির ঔষধ বিক্রেতা, বালকের গলা কেটে কেমনে জোড়া লাগায়, টিয়া পাখি কী ভাবে ভবিষ্যত বলে দেয় ইত্যাদি জানার তীব্র আগ্রহ আমার সব সময়ই ছিল। মাদ্রাসা থেকে হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার মধ্যবর্তী এক বৎসর অবসর সময়টা এ সমস্ত বিষয়ের সমাধানে, আর স্কুলের ছাত্রদের সাথে আড্ডা দিয়ে কাটিয়েছি। প্রতি বৎসর আষাঢ় জৈষ্ঠ মাসে ঝাঁকে ঝাঁকে বাইদানীরা আমাদের গ্রামে আসতো। সাপ ধরার মন্ত্র শেখার জন্যে এক বাইদানীকে খালা ডাকা শুরু করলাম। মাঝে মাঝে বাড়িবাড়ি গিয়ে তার কাষ্টমার যোগাড় করে দিতাম। প্রথমে অসম্মতি জানালেও নাছোড় ভগ্নীপো’কে শেষ পর্যন্ত খালা বাধ্য হলেন মন্ত্র শেখাতে। এখান থেকে দাঁতের পোকা বের করার পীরাকি, আর ওঝা কী ভাবে সাপের বিষ নামায় তাও শিখলাম। যেহেতু বাইদানী খালা কসম কীড়া দিয়েছিলেন কাউকে না বলতে তাই আজ তা আর বলতে পারলাম না। যাদু-টোনা, জীন-ভুত আর তাবিজ কবজের অলৌকিক বিদ্যা মাদ্রাসায় থাকতেই জেনে নিয়েছিলাম। তাবিজের ভেতরে আল্লাহর নাম লিখে দিলে রোগী যে ফল পায়, শয়তানের নাম লিখলেও একই ফল পায়। আরবীতে লিখলেও যা হয় বাংলায় লিখলেও তা হয়। ভুতগ্রস্থ যুবতীর মাথা থেকে ভুত তাড়িয়েছি, লোহার জিঞ্জিরে বাঁধা যুবকের জীনও বোতলে ভরে গাঙ্গের জলে ভাসিয়ে দিয়েছি, কোন প্রকারের কোরান, পুরাণের একটি বাক্য-আয়াত বা কামরূপ-কামাইখ্যার তন্ত্র মন্ত্রও উচ্চারণ করিনি। মন্ত্রের নামে আরবী, উর্দু, ফার্সী, সংস্কৃত ও বাংলা মিশায়ে যে পঞ্চরূপী ভাষা উচ্চারণ করতাম, তা ছাগলের ভাষার চেয়েও দূর্বোধ্য। এই অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হতে হলে, বিশ্বস্ত একজন সাথী আর বুদ্ধিমান একজন গুপ্তচরই যথেষ্ট।

একদিনের ঘটনা- প্রায় একসপ্তাহ রিহার্সেল দিয়ে অমাবশ্যার এক মেঘলা দুপুর রাতে একজন মহিলাকে আমার বুজুর্গী দেখালাম। মহিলা মুগ্ধ হয়ে শ্রদ্ধা ও ভক্তির নিদর্শন স্বরূপ আমাকে তার গলার স্বর্ণালংকার খুলে দিতে চাইলেন। আমি বিকট গুংগানীর মত শব্দ করে, লম্বা চুলের মাথায় একটা ঝাকুনি তুলে বিরক্তি প্রকাশ করলাম। আমার গুনধর শিষ্য গুংগানী আওয়াজ ও বিরক্তির বাংলা তরজমা করে দিল। বললো, ‘এই দরবেশ খাসিয়া- জৈন্তা পাহাড়ের ফলমূল আহার করে জীবন কাটান, মাছ মাংস ভক্ষন করেন না। তিনি বাংলা জানেন না, কোন প্রকার দান খয়রাত, উপহার গ্রহন করেন না। তিনি দুনিয়ায় শুধু দিতে এসেছেন, নিতে আসেন নি’। মহিলা আমার পা ছুঁয়ে সালাম করতে চাইলেন, আমি পা সরিয়ে নিলাম। তিনি আমার নাভী তক লম্বা শুভ্র দাড়ি আর পিঠ পর্যন্ত দীর্ঘ চুল দেখে কল্পনাই করতে পারেন নি, বিগত কয়দিন আমি আর আমার গুপ্তচর তার কতো কাছে ছিলাম। এই আইডিয়াটা মাথায় ঢুকেছিল, দুই সপ্তাহ পূর্বে ঢাকার জোনাকী সিনেমা হলে শাবানা অভিনীত ‘দস্যু রাণী’ ছবি দেখার পর।

মাদ্রাসায় থাকতে ছুটি পেলে, কিংবা একটু ফুরসত পেলেই প্রতিবেশী পাঠশালা ও হাইস্কুলের ছাত্রদের পড়ার ঘরে যেতাম। মাঝে মাঝে তাদের প্রাইভেট টিউশন- মাস্টারের পাশে চুপ করে বসে তাদের পড়া শুনতাম। কিছুটা তাদের কাছ থেকে শুনে আর কিছুটা তাদের বই থেকে পড়ে জোয়ার ভাটা, সূর্য-গ্রহণ, চন্দ্র-গ্রহণ, চাঁদের বুড়ীর সুতা কাটা, ভুমিকম্প, রংধনু, ভুতের আগুন এসব ব্যাপারে মোটামুটি একটা ধারনা পেয়ে যাই, যার কোন কিছুই মাদ্রাসায় পড়ানো হয়না। সব চেয়ে বেশী আশ্চর্য হয়েছি পৃথিবী গোল জেনে। হাইস্কুলে নবম শ্রেণীতে বিজ্ঞানের স্যার গ্লোবের উপর টর্চলাইট ফেলে দেখালেন কী ভাবে রাত-দিন হয়, কী ভাবে সূর্য- গ্রহণ, চন্দ্র-গ্রহণ, শীত ও গ্রীষ্ম মৌসুম হয়। পাড়া গাঁয়ের হাইস্কুল, সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে উন্নতমানের যন্ত্রপাতি ছিলনা। তবুও দশম শ্রেণীতে কেমিস্ট্রী ও ফিজিক্সের স্যারের সাহায্যে অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, হিলিয়াম, কার্বন ডাইওক্সাইড, কার্বন মনক্সাডাইড ইত্যাদির উপর বাস্তব পরীক্ষার মাধ্যমে পরিচয় হয়েছিল। একদিন স্যার, শুধু মাত্র আগুন ঝরা প্রখর রৌদ্রের ফাল্গুন চৈত্র মাসের সন্ধাবেলা কেন বিলের ধারে ভুতের আগুন দেখা যায়, তাও পরীক্ষা করে দেখালেন। এই বিজ্ঞানের স্যারই একদিন ল্যাবরেটরিতে বসে আলাপকালে বিজ্ঞানীদের নতুন আবিষ্কৃত কোন একটা উপগ্রহের কথা জানাতে গিয়ে বললেন, ‘এ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা আল্লাহর সৃষ্টির যা কিছু আবিষ্কার করতে পেরেছেন তা কোরানের মাত্র এক পৃষ্ঠা’। তখনও আমি এ নিয়ে কোন প্রকারের প্রশ্ন করার বা সন্দেহের কারণ বোধ করিনি। আমার মনেই পড়েনি আমিও যে মাদ্রাসায় পড়েছি বা কোরানের অর্থ বুঝি। স্কুলে এসে এতসব বিস্ময়কর নতুন নতুন বস্তুর সাথে পরিচয় হলো, অনেক অজানা সত্য জানা হলো, কিন্তু কোনদিন প্রশ্ন করিনি, মাদ্রাসায় এ সমস্ত কেন পড়ানো হয়না? আসলে স্কুলে এসে আমি জীবনের অন্য একটা রূপ দেখতে পাই। মাদ্রাসার জীবনটাকে ভুলে যাওয়াতেই ছিল যেন আমার সুখ, আমার আনন্দ। খুবই সুখী, বর্ণালী, ও সুন্দরতম দিনগুলো ছিল হাই স্কুলের ঐ ক’টি বছর।

ইংল্যান্ড আসার পর, বছর খানেকের মধ্যে ম্যারিয়া নামের এক সমবয়সী ইংরেজ যুবতীর সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে উঠে। নতুন পরিবেশে, নতুন এক ভিন্নধর্মী জীবনে প্রবেশ করে আমার মনেই হয়নি যে আমি এমন একটি দেশে এসেছি, যে দেশে জন্ম গ্রহন করেছিলেন, William Shakespeare, আর Isaac Newton এর মত মনীষীগণ। Shakespeare আর Newton সম্মন্ধে স্কুলে পড়েছি, এখানে এসে আরো নতুন তিনজন বিজ্ঞানীর নাম শুনলাম, Charles Robert Darwin, Thomas Henry Huxley ও Edmond Halley। আমরা যে এলাকায় থাকতাম, সেখানে, দু একটা বাঙ্গালী পরিবার ছিল তাদের কাউকে কোনদিন ধর্ম-কর্ম করতে দেখিনি। রোজা ঈদের চাঁদ কবে আসে কবে যায় কেউ খোঁজ নিতোনা। বান্ধবী ম্যারিয়া Patrick Moore এর The Sky at Night আর David Attenborough এর উপস্থাপনায় Life on Earth দুটো টিভি সিরিজ দেখার উৎসাহ দেখে বুঝতে পারলেন যে, বিজ্ঞানে আমার আগ্রহ আছে। নিজের পকেট থেকে পয়সা খরছ করে, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞানের উপর এক গাদা বই নিয়ে আসলেন। বইগুলো পড়তে পারলাম কিন্তু এর অনেক কিছুই বুঝতে পারলাম না, যদিও ম্যারিয়া মাঝে মাঝে নিজেও ইংরেজী থেকে ইংরেজী তরজমা করে আমাকে বুঝাতে চেষ্টার ত্রুটি করেন নি। একদিন সন্ধায় আমরা বসে টিভিতে Wild Life প্রোগ্রাম দেখছিলাম। একটি হরিণী বাচ্চা প্রসব করবে। নিকটেই ঝোপের আড়ালে বসে কয়েকটি Hyena তা দেখছে। বাচ্চাটি মাটিতে পড়ার সাথে সাথে Hyena রা তার মায়ের চোখের সামনে থেকে বাচ্চাটিকে কেড়ে নিল। মা ফ্যালফ্যাল করে শুধু তাকিয়ে দেখলো, একবার বাচ্চাটিকে ছুঁয়েও দেখতে পারলোনা। আমি ম্যারিয়াকে বলি, ‘এটা অসম্ভব, এ হতেই পারেনা’। ম্যারিয়া অবাক হন। জিজ্ঞেস করেন, ‘ব্যাপার কী’? আমি বিরক্ত চোখে বললাম, ‘ছবির ক্যামেরা ম্যান, প্রডিউসার, ডাইরেক্টর এরা এতো নিষ্ঠুর কেন, বাচ্চাটিকে তারা ইচ্ছে করলে বাঁচাতে পারতো’। ম্যারিয়া শান্তস্বরে বলেন, ‘পরের সিনটায় দেখোনা কী হয়’। ওদিকে Hyena র ক্ষুধার্ত ছোট্ট বাচ্চারা মায়ের পথের পানে চেয়ে আছে। গর্তের বাইরে উঁকিবাকি দিচ্ছে কিন্তু সম্পূর্ণ বেরিয়ে আসছেনা, যদি অন্য কোন জীব তাদেরকে আক্রমন করে বসে। আমার কাছে ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগে। এমন দৃশ্য আমি আগে কোনদিন দেখিনি। কী অবাক কান্ড, এসব হচ্ছেটা কী? প্রত্যেকটা জীব অপর একটি জীবের উপর নির্ভরশীল। একজনের বিলুপ্তিতেই আরেকজনের উৎপত্তি! একজনের মৃত্যুই আরেকজনের বাঁচার উপায়। আমার মাঝে এক অস্থিরতা দেখা দেয়, আমি হতবাক। ম্যারিয়াকে বললাম, ‘বাঘেরা নিষ্ঠুর ভাবে হরিণ শাবক মেরে খাচ্ছে, নতুন জলে আনন্দে উল্লসিত নির্দোষ Salmon Fish ভল্লুকেরা ধরে ধরে খাচ্ছে, আর আমরা মানুষ’? ম্যারিয়া বলেন, ‘আমরাও তাই, আজকের ডিনারে তো Salmon Fish তুমিও খাবে’। আমার অস্বস্তি দেখে ম্যারিয়া তার নারীসুলভ উৎফুল্লতা প্রকাশ করে বললেন, ‘’তোমাকে কিছু আফ্রিকান ট্রাইবদের খাদ্য সংক্রান্ত কিছু ভিডিও চিত্র দেখাবো, দেখবে তাদের ডিনারের লিষ্টে জীবন্ত কীট-পতঙ্গ, টাটকা জীবের রক্ত, আর কুমীর, ইঁদুর, বানর এমনকি সাপও আছে’’। ছবিগুলো দেখে আমার বমি হওয়ার উপক্রম। ম্যারিয়া তার রক্তজবা ঠোঁটে হাসি তোলে বলেন, আমরাও এসেছি ওখান থেকে। আমি একবার শ্যাম বর্ণের আমার দেহ, কৃষ্ণাঙ্গ দেহের ঐ মানুষগুলো, আর একবার শ্বেত বর্ণের ম্যারিয়ার দিকে তাকাই। ম্যারিয়া বলেন, ‘কী ভাবছো’? আমি বলি, ‘কিছু না’।

ম্যারিয়ার হাত ধরে আমার প্রথমে কলেজ তারপর ইউনিভার্সিটিতে আসা। অবিশ্বাসের ধারণাটা মূলত ম্যারিয়ার কাছ থেকে পেয়েছিলাম। তবে শুধু ধারণাই। প্রথমে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল যে, কী ভাবে এত সহজে নির্দ্বিধায় মানুষ বলতে পারে, ‘আমি আল্লাহ বিশ্বাস করিনা’। ম্যারিয়ার অবিশ্বাস আর আমার বিশ্বাসে কার্যত কোন পার্থক্য ছিলনা। যেখানে পাপের বা কোন ঐশ্বরিক শক্তির কাছে জবাবদিহিতার কোন ভয় নেই, সেখানে বিশ্বাস থাকায় আর না থাকায় কী আসে যায়? ইউনিভার্সিটিতে সাবজেক্ট নিলাম, সোসিয়েল সায়েন্স। পরিচয় হলো, Karl Marx, Max Weber, Bertrand Russell এর মত সমাজ বিজ্ঞানীদের লেখার সাথে। ধর্ম বিষয়ে তাদের বক্তব্য বা চিন্তা ধারণার সাথে আগে আমার কোন পরিচয় ছিলনা। আমার মনে প্রশ্ন জাগে, আমি তো কতো আকুতি মিনতি, গালিগালাজ করেও কোনদিন আল্লাহর সাড়া পেলাম না, জগতের সেরা জ্যোতির্বিজ্ঞানী, জীববিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী মনীষীগনও আল্লাহর কোন সন্ধান পেলেন না, বিষয়টা কী? আমি ভাবতে থাকি, তাহলে আসলেই কি আল্লাহ আছেন? আল্লাহর অস্তিত্বের উপর আমার সন্দেহ জেগে উঠে। তবে আমার বিশ্বাসের প্রদীপ তখনও নিভু নিভু হয়ে জ্বলছিল।

ইউনিভার্সিটিতে আসার দু বছরের মাথায় চোখের সামনে এক আশ্চর্য এবং মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে যায়। ২৫ বৎসর বয়সে ম্যারিয়া তার মায়ের মত ক্যান্সারে মারা যান। মৃত্যুর একমাস আগেও (সম্ভবত ১৯৮৫/৮৬ সালে) ম্যারিয়া আমার জন্যে হিলের-ধুমকেতু সংক্রান্ত, সেই সময়ে টিভিতে প্রচারিত সকল সংবাদ ডুকুমেন্টারী, রেকর্ড করে রাখতে ভুলেন নি। সাগর পারে বেঞ্চের উপর বসে আমরা দুজনে হাতে হাত রেখে হিলের-ধুমকেতু আর কোনদিন দেখতে পারবোনা জানতাম, কিন্তু একমাস পরে একসাথে বসে আর কোনদিন পূর্ণিমার চাঁদও দেখতে পারবোনা তা কল্পনাও করিনি। ম্যারিয়ার মত একজন সত্যবাদী, স্পষ্টবাদী, নৈতিক চরিত্রের মানুষ আমি জীবনে খুব কমই দেখেছি।

কয়েক বছর পরের কথা- একদিন রাস্তায় দেখা হলো ঢাকা থেকে আগত চারজন ছাত্রের সাথে, তারা ভাড়াটিয়া ঘর খুঁজছেন। পরের সপ্তাহে কুশলাদি জিজ্ঞেস করতে তাদের বাসায় গিয়ে উপস্থিত হলাম। ঘরটির মালিক একজন ইরাণী ভদ্রলোক। আলাপকালে তাদের টেবিলের উপর রাখা একটি বইয়ের উপর আমার দৃষ্টি পড়লো। ‘‘নির্বাচিত কলাম’’। প্রথম পৃষ্ঠা পড়েই আমি তাদের কাছে আবদার করলাম, বইটি আমাকে ধার দিতে হবে। একজন বললেন, এই লেখিকার বই ভাল লাগলে আরো দু একটা বই আছে আপনি নিতে পারেন। তারা আমাকে তাসলিমা নাসরিনের ‘’নির্বাচিত কলাম’’ ‘’অপর পক্ষ’’ ও ‘’যাবো না কেন যাবো’’ বই তিনটি দিলেন। একটি বইয়ের (সম্ভবত ‘অপর পক্ষ’, বইগুলো এখন আর আমার কাছে নেই) এক জায়গায় এসে আমার চক্ষু স্থির আটকে গেল। তাতে লিখা আছে (বাক্যটা বোধ হয় এ রকমই ছিল) ‘রাস্তার বখাটে ছেলেরা নারীদের দেখে যেমন ‘মাল’ বলে, ইসলামের নবী মুহাম্মদও নারীকে ‘মাল’ বলেছেন’। বইটিতে হাদীসের রেফারেন্স উল্লেখ করা। অন্য একটি জায়গায লেখিকা কোরানের সুরা ও আয়াত নম্বর উল্লেখ করে ইসলামের দৃষ্টিতে নারীর মর্যাদা বর্ণনা করেছেন। সংশ্লিষ্ট হাদীস ও কোরানের আয়াত দুটো আমি আগে মাদ্রাসায় থাকতে ওয়াজীনদের মুখ থেকে শুনেছি, নিজেও পড়েছি। সেই বয়সে, তখন মনে করতাম, এটাই নিয়ম, এ ভাবেই হওয়া উচিৎ যেভাবে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুল চান, তারা যা বলেন, তাতেই সকল মানুষের ইহকাল ও পরকালের মঙ্গল। আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলের বাণী ও নির্দেশের উপর সন্দেহ বা প্রশ্ন করা নিজেকে কাফির ঘোষনা দেয়ার শামিল। পরের মাসে ঐ ছাত্রদের একজন সাথী বাংলাদেশ থেকে আসার সময় আমার জন্যে নিয়ে এলেন আরজ আলী মাতুব্বরের ‘’সত্যের সন্ধানে’’ বইটি। সম্পূর্ণ বইটি পড়ে আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম, এতোদিন বৃথাই আমি আল্লাহর সন্ধান করেছি, তার কাছে প্রার্থনা করেছি, তাকে অভিশাপ দিয়েছি, সে তো আসলেই নেই।

এবার আমার মনে প্রশ্ন জাগে, কে সেই ধূর্ত-বাটপার যে সর্বপ্রথম ধর্মের বা আল্লাহর কন্সেপ্ট তৈরী করেছিল? এই ঢাহা মিথ্যা, বিশ্বজুড়ে প্রচার ও বিস্তারই বা হলো কী করে? গ্রীক, মিশরীয় ও পারস্য সভ্যতার আলোয় উদ্ভাসিত পৃথিবীতে, মাত্র দেড়হাজার বছর পূর্বে মুহাম্মদ কী ভাবে এতোবড় প্রতারণা করতে পারলেন, তার সফলতার চাবিকাঠিটা কী? সোজাভাবে উত্তরটা পেয়েছি Karl Marx, আর Bertrand Russell এর কাছে। Capital আর Power, অর্থ এবং শক্তি। জগতের সকল মঙ্গল-অমঙ্গল, ঝগড়া-বিবাদ, ব্যর্থতা-সফলতা, ‘অর্থকে না শক্তিকে কেন্দ্র করে’ এ নিয়ে উইনিভার্সিটিতে টিম ওয়ার্ক বা গ্রুপ ওয়ার্কে তর্ক বিতর্ক করেছি, আমি সব সময়েই অর্থের পক্ষে ছিলাম। প্রমাণটা পেয়েছি মুহাম্মদের ইসলাম বিস্তারের ইতিহাস পর্যালোচনা করে। ঢাকার ছাত্রদের ল্যান্ডলর্ড ইরাণী ভদ্রলোকের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম, আরবেরা (খলিফা আবু বকর (রাঃ), ওমর (রাঃ) ও উসমান (রাঃ) এর শাসনামলে) কি ভাবে পার্সীয়ানদের হাজার বছরের সনাতন কৃষ্টি ধ্বংস করেছিল। তিনি বলেন, শিয়ারা বিশ্বাস করেন, কিয়ামতের দিনে ব্যভিচারিণী আয়েশার (রাঃ) বিচার অবশ্যই হবে। এবার আমি ধর্মের উল্টো পৃষ্ঠা দেখার লক্ষ্যে, লাইব্রেরী আর ইন্টারনেটে অনেক দৌড়াদৌড়ি করে যা পেলাম, তা কারো কাছে বলার মানুষ খুঁজছিলাম। একজনকে পেয়েও গেলাম। একদিন হঠাৎ আমার এই বন্ধু, ‘মুক্তমনা’ ওয়েব সাইটের ঠিকানা দিলেন। এখানে এসে দেখি, একজন নয়, আমার কথা সারা বিশ্বকে শুনানোর জন্যে তারা ব্যবস্থা করে রেখেছেন। সেখানেও পেলাম অনেক অজানা তথ্য। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলেন বেশ কয়েকজন মুক্তমনা। লিখা হলো একটি বই, ‘যে সত্য বলা হয়নি’। সে বইটি লিখার, আর আমার অবিশ্বাসের সুত্রপাত কী ভাবে হয়েছিল, সেই ‘না বলা কিছু কথা’ আজ বলে দিলাম।

আকাশ মালিক
ফেব্রুয়ারী ২০১০।