প্রায় এক দশক হতে চললো, কিন্তু মনে হয় যেন এই তো সেদিনের ঘটনা! বিংশ শতাব্দীর এক্কেবারে প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমরা প্রথমবারের মত জানতে যাচ্ছি আমাদের নিজেদের শরীরের একান্ত গভীরে কোষগুলোর মধ্যে জিন বা বংশগতির এককের সংখ্যা কত! বিখ্যাত মনস্তত্ববিদ এরিক ফ্রম বোধ হয় ঠিকই বলেছিলেন, মানুষই একমাত্র প্রানী যার কাছে নিজের অস্তিত্বটাই যেন একটা বড় সমস্যা এবং সে নিরন্তর তার উত্তরও খুঁজে চলেছে।

এত বুদ্ধিমান প্রানী আমরা, এত জটিল মস্তিষ্কের গড়ন, আমাদের মধ্যে যেরকম বুদ্ধিমত্তার ছড়াছড়ি, আর কোন প্রাণীতেই বা তা দেখা যায়? আমরা মানুষ – কি না করতে পারি! এই পৃথিবীর বুকে আমাদের মত অতুলনীয় বুদ্ধিমান প্রানীর জিনোমের সাথে আর কোন প্রানীর জিনোমের তুলনা হয় নাকি? এত জটিল একটা প্রানীর বিকাশ তো আর যা তা কথা নয়। বিবর্তনের ধারায় জীব যত জটিল থেকে জটিলতর আকৃতি এবং বুদ্ধিমত্তার অধিকারী হবে তার জিনের সংখ্যাও তো ততই বেশী হতে হবে! একটা সামান্য গোল কৃমির (norhabditis elegans) যদি ১৯,৫০০ জিন থাকে, সামান্য ফ্রুট ফ্লাই এর ১৩,৭০০ আর ওই ফালতু ধেরে ইঁদুরের জিনের সংখ্যা যদি হয় ৩০,০০০ হয় তাহলে আমাদের তো তার চেয়ে বহুগুণ বেশী জিন থাকতেই হবে। আমাদের দেহে প্রায় এক লাখের মত প্রোটিন তৈরি হয়, প্রত্যেকটা প্রোটিন তৈরির পিছনে যদি একটা করেও জিন থাকে তাহলেই তো কেল্লাফতে, আমাদের ক্রমোজমে জিনের সংখ্যা চোখ বন্ধ করেই এক লাখ ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা।

আসল কাজটা ১৯৯০ সালে শুরু হলেও সেই আশির দশকের প্রথম থেকেই মানুষের জিনোম সংশ্লষণ নিয়ে হইচই শোনা যাচ্ছিল। বিজ্ঞানীদের মধ্যে জল্পনাকল্পনারও যেন শেষ নেই, এমনকি বাজী ধরাধরিও চলেছে। প্রাথমিক অনুকল্প অনুযায়ী সবাই তো মোটামুটিভাবে নিশ্চিত যে, মানুষের জিনোমে কম করে হলেও এক লাখ বিশ হাজারের মত জিন থাকতে হবে। এর চেয়ে কম জিন দিয়ে তো মানব শরীরের জটিল অংগ প্রত্যংগের গঠনই সম্ভব হওয়ার কথা নয়, সেখানে জটিল মস্তিষ্ক বা স্নায়বিক কাজকর্মগুলো তো বহুদুরের কথা। শুধু প্রাচীন ধর্মবেত্তা আর চিন্তাবিদেরাই যে মানুষকে আর সব প্রানী থেকে আলাদা করে ‘সর্বশ্রেষ্ট সৃষ্টি’ র বেদীতে বসিয়েছিলেন তাই তো নয়, এই আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের যুগে আমরাই বা কম কি? মানুষের মত এত ‘উন্নত’ প্রানীর জিনের সংখ্যা তো লাখ ছাড়িয়ে যেতেই হবে! পার্থক্য শুধু এই যে, প্রাচীণকালে ওনারা বিশ্বাসের রঙ্গীন ফানুসের উপর ভর করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন আর আমরা বিংশ শতাব্দীর প্রান্তে এসে অভূতপূর্ব বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়েও একই ধারার ভুলগুলো করে বসি। হাজার হাজার বছরের লালন করা ঔদ্ধত্য( নাকি অজ্ঞানতা) বলে না কথা, ধোপার পাটায় ধুয়ে মুছে সাফ হতেও তো সময় লাগারই কথা।

সে যাই হোক, ২০০০ সালে জিনোম প্রজেক্টের বিজ্ঞানীরা ডি এন এর নিউক্লিওটাইডের সংশ্লেষণের কাজ প্রায় গুটিয়ে আনতে শুরু করেন। বহুদিনের সাধণার ফসল -বের হল মানুষের জিনোম সংশ্লেষণের প্রথম খসরা রিপোর্ট। সামনে এক পরম বিস্ময় অপেক্ষা করছিল বিজ্ঞানিদের জন্য! এক ধরণের হতাশা মেশানো বিস্ময় নিয়ে জানতে পারলাম যে আমাদের এবং ইঁদুরের জিনের সংখ্যা প্রায় সমান। ৩০-৩৫ হাজারের বেশী প্রোটিন তৈরির জিন নেই মানুষের কোষে! তখন থেকে শুরু করে পরবর্তীতে কয়েক বছরে বহুবারই এই সংখ্যাটা ঘষামাজা করতে হয়েছে – নাহ উপরে দিকে নয়, ক্রমশঃ নিচের দিকেই নেমে গেছে এই সংখ্যাটা। ১৩ বছরের গবষণার পর ২০০৩ সালে যখন চূড়ান্ত রিপোর্টটা বের হল তখন ইতোমধ্যেই সেই সংখ্যাটা এসে দাঁড়িয়েছে ২০-২৫ হাজারে। তার মানে কি আমাদের জিনের সংখ্যা ওই সামান্য ইদুরের চেয়েও কম? তাই বা সম্ভব কিভাবে?

শুধু তো জিনোম প্রজেক্টের বিজ্ঞানীরাই যে এ ধরণের বিস্ময়কর ফলাফল পাচ্ছিলেন তা তো নয়, অনুজীববিদ্যার বিভিন্ন শাখার বিভিন্ন গবেষণাও সবাইকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। যেমন ধরুন, মানুষ আর শিম্পাঞ্জীর জিনোম ৯৮-৯৯ ভাগই মিলে যায় -এ থেকে বহু আকাঙ্খিত এক প্রশ্নের উত্তর পেলেও, সেটা থেকে যে আরেক বিড়ম্বনার সৃষ্টি হচ্ছে তার উত্তর তো আর দেওয়া যাচ্ছিল না খুব সহজে। বুঝলাম, এতে করে প্রমাণ হয় যে, শিম্পাঞ্জিরা আমাদের সবচেয়ে কাছের আত্মীয়, তাদের আর আমাদের সাধারণ পূর্বপুরুষ না হয় একই ছিল! কিন্তু, জিনের সবকিছুই যদি এতই এক হবে তাহলে শিম্পাঞ্জীর সাথে মানুষের এতটা পার্থক্য এল কোথা থেকে? মাত্র এক থেকে দেড় ভাগ পার্থক্য কি করে গঠনে আকারে বুদ্ধিমত্তায় এতটা পার্থক্যের কারণ হতে পারে? কিংবা ধরুন এক প্রজাতি থেকে আরেক প্রজাতি তৈরি হতে যদি এত কাড়িকাড়ি নতুন জিনের প্রয়োজন হয় তাহলে তাইই বা তৈরি হচ্ছিল কোথা থেকে? এই কোটি কোটি নতুন প্রজাতির বিবর্তনের পিছনে তাহলে কত নতুন জিনের দরকার হল? একেক জীব কেন দেখতে একেরকম, আকারে এবং গঠনে এত প্রকারণ এল কোথা থেকে? আবার ধরুন, নিষিক্ত ডিম্বাণু বা একটা মাত্র কোষ থেকে শুরু হয় আমাদের জীবনযাত্রা। তারপর কয়েক দিন, সপ্তাহ বা মাসের ব্যবধানে কি করে অযুত-লক্ষ-কোটি কোষের সমন্বয়ে জটিল সব অংগ-প্রত্যংগ বিশিষ্ট জীবের উৎপত্তি ঘটে সেখান থেকে? ভ্রূণের এই বিকাশের সাথে প্রাণের বিবর্তনের সম্পর্কটাই বা কি?

ডারউইন এবং টি এইচ হাক্সলী কিন্তু ঠিকই বুঝেছিলেন যে, বিবর্তনের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে এই ভ্রুণতত্ত্বের মাঝেই, এর মধ্যেই পাওয়া সম্ভব এই প্রশ্নগুলোর উত্তর। বিভিন্ন লেখায় এবং বইএ সে কথা উল্লেখও করেছেন। কিন্তু কিভাবে একটা নিষিক্ত ডিম্বানু থেকে এত জটিল সব প্রানীর উদ্ভব হয় সেটা বোঝার জন্য বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির যে অগ্রসরতা প্রয়োজন তা জীববিজ্ঞানীদের হাতে ছিল না। তার ফলে ভ্রুণতত্ত্ব জীববিজ্ঞানীদের কাছে ব্ল্যাকবক্স হয়েই ছিল গত প্রায় দেড়শ বছর।

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বিজ্ঞানীরা হাবুডুবু খাচ্ছিলেন ডারউইনের দেওয়া বিবর্তন তত্ত্বের সাথে নব্য-আবিষ্কৃত বংশগতিবিদ্যার সমন্বয় করতে। তখনো জিনের আবিষ্কার না হওয়ার ডারউইন জীবদ্দশায় অর্জিত বৈশিষ্ট্যগুলো কিভাবে পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চালিত হয় এবং প্রকারণ (Variation) আসলেই কিভাবে ঘটে তার ব্যাখ্যা করতে পারেন নি।

এ নিয়ে মেন্ডেলের কাজ যখন পুনরাবিষ্কৃত হয় ১৯০৫ সালে, তখন তা থেকে প্রকারণের ব্যাখ্যা দেওয়া গেলেও গোল বাঁধলো আরেক জায়গায়। পরিবর্তন এবং প্রকারণ যদি এত ক্ষুদ্র জিনের লেভেলেই ঘটবে তাহলে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে এত বৃহত্তর স্কেলে প্রাণের বিবর্তন এবং প্রজাতির উদ্ভব ঘটছে কিভাবে। একেক বিজ্ঞানী বিবর্তনকে একেক দিক থেকে ব্যখ্যা করতে শুরু করলেন, ফসিলেবিদেরা বিস্তৃত ভূতাত্ত্বিক সময়ের পরিধিতে প্রজাতির বিবর্তনে মেতে রইলেন, সিষ্টেমেটিষ্টরা বিভিন্ন প্রজাতির প্রকৃতি এবং প্রজাতি তৈরির প্রক্রিয়ায় মনোনিবেশ করলেন, আবার ওদিকে জেনেটিস্টরা কাজ শুরু করলেন প্রজাতির ভিতরে প্রকারণ এবং জিনের প্রভাব নিয়ে। তারপর চল্লিশের দশকে এসে এদের সমন্বয় ঘটলো মর্ডান সিন্থেসিস বা আধুনিক সংশ্লেষণের মাধ্যমে। দু’টো প্রধান ধারণার সমন্বয় ঘটে এসময়ঃ

১) প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় ছোট ছোট জেনেটিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যে প্রকারণের উৎপত্তি ঘটে তাকে খুব সহজেই ধীর প্রক্রিয়ায় ঘটতে থাকা বিবর্তনতত্ত্বের মাধ্যমে ব্যখ্যা করা সম্ভব, এবং
২) দীর্ঘ সময়ের বিস্তৃতিতে ঘটা এই একই বিবর্তনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই এক প্রজাতি থেকে আরেক প্রজাতি বা এক শ্রেণী থেকে আরেক শ্রেণীতে বেশ বড় স্কেলের বিবর্তনও ঘটে থাকে। গত শতাব্দীর বাকীটা সময় ধরে এই আধুনিক সংশ্লেষণী তত্ত্বই জৈববিবর্তনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে এসেছে [1]।

এখন ফাস্ট ফরওয়ার্ডের বোতামটা টিপে প্রায় ৫-৬ দশক সামনে চলে এসে, এখনকার অবস্থান থেকে, যদি আধুনিক সংশ্লেষণকে বিচার করতে চাই, তাহলে বলতেই হয় যে, সেই সময়ে এটাই সবচেয়ে ‘আধুনিক’ তত্ত্ব হলেও আজ একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এর সীমাবদ্ধতাটা আসলে চোখে পড়ার মতই। আমরা এ তত্ত্ব থেকে জানতে পারি যে প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় বিবর্তন ঘটছে, আকারে গঠনে বদলে যাচ্ছে প্রাণী, উৎপত্তি ঘটছে নতুন নতুন প্রজাতির। কিন্তু আকারে, গঠনে এই পরিবর্তন ঘটছে কিভাবে? নিষিক্ত ডিম্বানুর একটি কোষ থেকে পূর্ণাংগ একটি জীবে পরিণত হতে যে আকার বা গঠণগুলোর বিকাশ ঘটে তার উৎপত্তি ঘটছে কিভাবে? ভ্রূণাবস্থায়, কোন জিনগুলোর সক্রিয় পরিচালনায় ঘটে চলেছে অত্যাশ্চার্য এই বিকাশের নাটক? অর্থাৎ বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় ‘কি ঘটছে’ তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ না থাকলেও ‘কিভাবে ঘটছে’ তা কিন্তু রহস্যের বেড়জালেই আটকে ছিল এতদিন।

 ছবি – সব জীবই একটি মাত্র কোষ থেকে শুরু করে তাদের জীবনের বিকাশ ঘটায়। এখানে ইঁদুরের নিষিক্ত ডিম্বানুর বিকাশ দেখানো হয়েছে।

নাহ, এই অজানা প্রশ্নগুলো আর অজানা নেই জীববিজ্ঞানীদের কাছে। ব্ল্যাকবক্সের রুদ্ধদ্বারগুলো একটা একটা করে খুলে পড়তে শুরু করেছে। গত দুই-তিন দশকে সৃষ্টিতত্ত্ববাদী এবং ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের প্রবক্তাদের সাথে তর্কাতর্কিতে আমরা টেরই পাইনি যে নীরবে কি এক বিশাল বিপ্লব ঘটে গেছে জীববিজ্ঞানের গবেষণাগারগুলোতে। সত্যি কথা বলতে কি জীববিজ্ঞানের যেন এক গুণগত উল্লম্ফন ঘটে গেছে এরই মধ্যে। বিবর্তন ‘ঠিক কি বেঠিক’ সে তাত্ত্বিক স্তর পার হয়ে আমরা যে প্রায়োগিক বিবর্তনীয় বিজ্ঞানের পর্যায়ে পৌঁছে গেছি তা বুঝতেও পারিনি বিবর্তন-বিরোধীদের সাথে অন্তহীন তর্ক-বিতর্কের ডামাডোলে। কিন্তু সত্তরের দশকের শেষ থেকেই আনবিক জীববিজ্ঞান এবং জেনেটিক্সের বিভিন্ন শাখায় প্রযুক্তিগত দিক থেকে অভাবনীয় উন্নতি ঘটতে শুরু করে। তার সাথে যুক্ত হয় কম্পিউটার প্রযুক্তির বিকাশ, আর এখান থেকেই বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মত যে কোন জীবকে তার জেনেটিক লেভেলে বিস্তারিতভাবে দেখতে এবং গবেষণা করতে শুরু করেন।

বিজ্ঞানীরা এখন গবেষণাগারে যে পরীক্ষা নিরীক্ষাগুলো করে চলেছেন তা শুধু কল্পবিজ্ঞানের সীমানার চার দেওয়ালে বন্দী ছিল এতদিন। কার্টুনের সেই মিউট্যান্ট নিনজা টারটেলের মত এখন মিউট্যান্ট ফলের মাছি তৈরি হচ্ছে গবেষণাগারে, ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের মত ফ্র্যঙ্কেনমাছিগুলোর গল্প যেন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীকেও হার মানায়।ধরুন, একটা জিনের এদিক ওদিক করে মাছির মাথা থেকে শুড়ের বদলে দু’টো পা বের করে দিলেন, একটা মাত্র জিনের মিউটেশন থেকে তার এক জোড়া পাখার বদলে চার, ছয় বা অগুন্তি পাখা যোগ করে দেওয়া হল, কিংবা পাখাগুলো এক্কেবারে উবেই গেল। একটা মাত্র জিনের রদবদলের ফলে যদি এরকম নাটকীয় পরিবর্তন সম্ভব হয় তাহলে তো প্রশ্ন জাগে, এই জিনগুলো আসলে কি, এদের আসলে কাজ কি? কিংবা ধরুন ইঁদুরের চোখের জিনটাকে ( একই জিন কিন্তু মানুষের মধ্যেও আছে) মাছির ভ্রূণের মধ্যে প্রতিস্থাপন করা হল, দেখা গেল যে, সেখানে দিব্যি ইঁদুরের নয় বরং মাছির চোখের টিসু তৈরি হয়ে যাচ্ছে।…… নাহ অলৌকিক কোন গল্পের বই থেকে তুলে দেওয়া নয় উপরের কথাগুলো, কোন কল্পবিজ্ঞানের বই থেকে এই লাইনগুলো তুলে দেইনি। ডিসকভার ম্যাগজিনের (ফেব্রুয়ারি ২০০৯ সংখ্যায়) এক সাক্ষাৎকারে হাল আমলের বিখ্যাত আমেরিকান বিজ্ঞানী ডঃ শন ক্যারল জীববিজ্ঞানের অন্যতম নতুন শাখা ‘এভ্যুলেশনারী ডেভেলপমেন্টাল বায়োলজী’ বা সংক্ষেপে ‘এভু ডেভু’ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এই কথাগুলো বলেছিলেন [2]।

শুধু তো তাই নয়, বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে দেখছেন, হাত, পা, শুড়, শিং, অর্থাৎ, বিভিন্ন প্রাণীর শরীর থেকে যে অংগ প্রত্যঙ্গগুলো বাইরের দিকে উদ্গত হয় তার সবগুলোর পিছনে একই সাধারণ জিনের হাত রয়েছে। ৭০-৮০ এর দশকে জেনেটিক্সের আলোয় যতই আমরা আমাদের কোষের অভ্যন্তরের সুক্ষ্ম গঠণ এবং কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলাম ততই যেন হা হয়ে থাকার পালা শুরু হল। বিজ্ঞানীরা চরম বিস্ময়ে দেখতে থাকলেন যে, প্রকৃতিতে এত পার্থক্য, এত জৈব-বৈচিত্রকে এক্কাবারে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বারবার একই ফলাফল চোখে সামনে ফুটে উঠছে – শুধু মানুষে আর শিম্পঞ্জীতেই নয়, ইঁদুর থেকে শুরু করে পাখী, প্রজাপতি, ফলের মাছি এমনকি ব্যাক্টেরিয়া – সবার মধ্যেই অকল্পনীয় রকমের জেনেটিক সাদৃশ্য বিদ্যমান!

আর এই গবেষণাগুলোর হাত ধরেই গত ২০-৩০ বছরে জীববিজ্ঞানের এই নতুন শাখার সৃষ্টি হয়েছে – বিবর্তনীয় বিকাশমান জীববিজ্ঞান (Evolutionary Developmental Biology) বা সংক্ষেপে এভু ডেভু [3]। জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মেলবন্ধনে সৃষ্টি হয়েছে এই শাখাটি। আজকে একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে বিবর্তন নিয়ে লিখতে বা পড়তে গেলে এভু ডেভুকে এড়িয়ে যাওয়ার কোন উপায় নেই। ১৫০ বছরের দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ‘হ্যান্ডসেক’ ঘটেছে ভ্রূণতত্ত্বের সাথে জীববিজ্ঞানের ভিত্তি বিবর্তনতত্ত্বের। আর তাকে কার্যকরী রূপ দেওয়ার পিছনে অবদান রাখছে ফসিলবিদ্যা, প্রাণরসায়ন, আনবিক জীববিজ্ঞান, জেনেটিক্স থেকে শুরু করে কম্পিউটার প্রযুক্তি পর্যন্ত অত্যাধুনিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখাগুলো। এর বিভিন্ন কাজ এবং অত্যাশ্চার্য সব গবেষণার ফলফলগুলোর ভিতরে ঢোকার আগে, এভু ডেভুর সংজ্ঞাটা কি দাঁড়াচ্ছে, সেটা চট করে তাহলে একবার দেখে নেওয়া যাক।

ছবি- ডিস্টাল লেস নামক একটি মাত্র জিন সামুদ্রিক পোকা থেকে শুরু করে ইঁদুর এমনকি মানুষের প্রত্যংগের গঠনের জন্য দায়ী। এই ধরণের ‘মাস্টার টুলকিট’ জিনগুলোর আবিস্কার প্রানীজগতের বিবর্তন সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের আবার নতুন করে ভাবতে শেখাচ্ছে। ছবিতে মানুষের সতের দিন  বয়সী একটি ভ্রুণ দেখানো হয়েছে।

আমরা বিবর্তনতত্ত্ব থেকে জানি যে সময়ের সাথে জীবের আকারে গঠনে ক্রমাগতভাবে পরিবর্তন ঘটে চলেছে আর তা থেকেই উদ্ভব ঘটছে বিভিন্ন প্রজাতির। এখন ভ্রূণতত্ত্ব থেকে আমরা প্রথম বারের মত দেখতে পারছি জীবের গঠনের পিছনে কোন প্রক্রিয়াগুলো কাজ করছে। আমরা এখন ভ্রূণের বিকাশের বিভিন্ন স্তরে ডিএনএ র নিউক্লিক এসিড বেসের উপর কাজ করে দেখাতে পারছি যে, কোন জিনের কারণে কোন গঠনের জন্ম হচ্ছে। এখানে দুই একটা বেস বদলে দিলে পা টা লম্বা হয়ে যাচ্ছে, ওই জিনের এখানে কয়েকটা বেস বদলে দিলে পায়ের বদলে শুড় গজিয়ে যাচ্ছে, জিনের কোন জায়গাটায় বদলে দিলে পায়ের বদলে শুধু হাতই জন্মাচ্ছে না, একই জিন থেকে গজিয়ে যাচ্ছে মানুষের হাত, বাদুরের পাখা, সিলের তাড়নী! আর এটাই তো হচ্ছে বিবর্তনের ভিত্তি, সময়ের সাথে সাথে ডিএনএর পরিবর্তন। একটা জীব পূর্ণাংগ রূপ ধারণ করার পর তার দেহে এই পরিবর্তনগুলো ঘটে না, তাই এই পরীক্ষাগুলো কোন পূর্ণবিকশিত জীবের দেহকোষে করা সম্ভব নয়। এই প্রথমবারের মত আমারা এগুলো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, এগুলোকে নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে পারছি – আর আবারও নতুন করে, নতুন আঙ্গিকে, নতুন জ্ঞানের আলোয় প্রথমবারের মত গবেষণাগারে আমাদের চোখের সামনে প্রমাণিত হচ্ছে বিবর্তনতত্ত্ব। ভ্রূণের বিকাশ আর তার আলোর বিবর্তনের প্রক্রিয়ার সমন্বয়েই গড়ে উঠেছে এই বিবর্তনীয় বিকাশমান জীববিজ্ঞান বা এভু ডেভু।

চলবে…

এর পরের পর্বে এভু ডেভু কিভাবে বিবর্তন সম্পর্কে আমাদের পুরনো ধারণাগুলোকে ভেঙ্গেচুড়ে গুণগতভাবে এক নতুন স্তরে নিয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছা রইলো।

:line:

তথ্যসূত্র

1) Carroll S, 2005, Making of the Fittest. W.W. Norton & Company.
2) http://discovermagazine.com/2009/mar/19-dna-agrees-with-all-the-other-science-darwin-was-right
3) যুক্তি, সংখ্যা ৩, জানুয়ারি ২০১০, শন ক্যারলের সাথে সাক্ষাকারঃ ডি এন এ এবং অন্যান্য বিজ্ঞান প্রমাণ করছে যে ডারউইন সঠিক ছিল।