একখন্ড বস্ত্র মানবিক

ইরতিশাদ আহমদ


asadshaheed1

 

তিরিশে ডিসেম্বর, ঊনিশশো আটষট্টি। দৈনিক পাকিস্তানের বার্তা সম্পাদক নির্মল সেন বসে আছেন তাঁর টেবিলে। রাত হয়েছে, এগারোটার কাছাকাছি। এক অপরিচিত যুবক এসে ঢুকলেন। মাথায় পট্টি বাঁধা। যুবক উত্তেজিত। বললেন শিবপুর থেকে এসেছেন। একটা সংবাদ দিতে, পরদিন যাতে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বর্ণনা দিলেন ঘটনার, হাট-হরতালের, পুলিশের হামলার। মওলানা ভাসানীর ডাকে কৃষক সমিতি শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালনের ডাক দিয়েছিল ঊনত্রিশে ডিসেম্বর। হাট-বাজার, দোকান-পাট বন্ধ রাখা হয়েছিল সেদিন। পুলিশ লাঠি-বন্দুক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে কৃষক সমাবেশের ওপরে।

 

নির্মল সেনের নির্বিকার-নিস্পৃহ ভাব দেখে যুবক মরিয়া। বিশ্বাস হচ্ছে না? তবে দেখুন বলে মাথার পট্টি খুলে ফেললেন। মাথায় রক্তের চাপ চাপ দাগ সুস্পষ্ট। কিন্তু তাতে কি! খবর ছাপানো যায় নি।

 

নির্মল সেনের অকপট স্বীকারোক্তি। সরকারের রোষানলে পড়ার ভয়ে কোন পত্রিকাই তখন সে খবর ছাপাতো না। তিনিও ছাপান নি।

 

কে জানতো এই যুবক মাত্র সপ্তাহ তিনেক পরেই আবার আসবেন পত্রিকার অফিসে। খবর দিতে নয়, খবর হয়ে। আর এইবার তাঁকে উপেক্ষা করতে পারবে না কোন সংবাদপত্র।

 

 

আমি আসাদের কথা বলছি। হ্যাঁ, সেদিনের সেই মাথায় পট্টি বাঁধা যুবকের নাম ছিল আসাদ, আসাদুজ্জামান। তাঁর নামেই প্রতি বছর বাংলাদেশে বিশে জানুয়ারী পালিত হয় আসাদ দিবস। মোহাম্মদপুরের আসাদ গেট ধারণ করে আছে তাঁরই নাম।

 

আসাদ ছাত্র ছিলেন। বামপন্থী ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। অনেক ছাত্রই তখন বামপন্থী রাজনীতিতে জড়িয়েছিল। অনেকের কাছে বাম রাজনীতি করা ছিল একধরনের ফ্যাশন। আসাদ সেই ধারার ছাত্র রাজনীতিক ছিলেন না। অনেকের মতো আসাদ শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনেই নিজেকে আবদ্ধ রাখেন নি। জড়িয়েছিলেন কৃষক সংগঠনের সাথে, নিজের এলাকায়, শিবপুরেরে হাতিরদিয়ায়, মনোহরদিতে। আত্মনিয়োগ করেছিলেন কৃষকদের সংগঠিত করার কাজে। কৃষকের অর্থনৈতিক মুক্তির মাধ্যমেই আসবে জনগণের সার্বিক মুক্তি, তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল । সমাজতন্ত্রে তাই ছিল অবিচল আস্থা। আসাদের পছন্দের শ্লোগান ছিল মুক্তির মন্ত্র, জনগণতন্ত্র আর জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো কৃষকের মনে চেতনার আগুন জ্বালাতে চেয়েছিলেন। মনে করেছিলেন, অন্য কোন কাজের চেয়ে এই কাজটাই বেশি দরকারী ।

 

আসাদ রাজনীতি করাটাকে দায়িত্ব মনে করতেন। তাই তাঁর দলে নেতৃস্থানীয় ছিলেন, দলের সংগঠক ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ)-এর ঢাকা হল শাখার সভাপতি ছিলেন। পেছনের সারিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার মানুষ ছিলেন না আসাদ। তাঁর ভুমিকা ছিল উদ্যোক্তার, আয়োজকের। মিছিলে তাই তিনি সম্মুখেই থাকতেন। সেদিনও ছিলেন। ঊনসত্তরের বিশে জানুয়ারী ছিল দিনটি। এক পুলিশ অফিসার খুব কাছে থেকে আসাদের বুকে পিস্তলের গুলি ছোঁড়েন।

 

ইতিহাসে এম,এ পাশ করেছিলেন। ফলাফল আশানুরূপ না হওয়ায় দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আর ভর্তি হয়েছিলেন আইন কলেজে। একটা চাকরী নিয়ে বিয়ে থা করে সংসারী হয়ে যাওয়াটা বিচিত্র কিছু ছিল না আসাদের মতো এক যুবকের পক্ষে ওই বয়সে। কিন্তু আসাদের স্বপ্ন ছিল একটু অন্যরকম। তিনি স্বপ্ন দেখতেন শ্রেণীহীন, শোষনহীন, সামজিক ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার। আসাদ মৃত্যুর আগেই তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার কাজে।

 

ঊনসত্তরের জানুয়ারী; পূর্ব বাংলা অগ্নিগর্ভ। ছাত্রদের এগার দফা তখন সমগ্র জনগণের প্রাণের দাবীতে পরিণত হয়েছে। ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে আইয়ুব-মোনায়েমের সরকার দিশাহারা। জানুয়ারীর সতের তারিখে পুলিশ, ইপি আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে ছাত্রদের মারধর করে। প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সারা পূর্ব বাংলায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালনের আহবান জানায় জানুয়ারীর বিশ তারিখে। ঢাকা হলের (এখনকার শহীদুল্লাহ হল) সামনে আসাদ ছিলেন মিছিলের নেতৃত্বে। হলের সীমানার মধ্যে মিছিলটাকে নিয়ে ঢোকার মুখেই গুলি চালান আসাদকে লক্ষ্য করে পুলিশের বীর অফিসার।

 

আসাদ মারা যান ঘটনাস্থলেই। তাঁর মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। সারাদেশে নেমে আসে শোকের ছায়া। স্বতস্ফূর্ত শোক মিছিল বের করেন ছাত্র-ছাত্রীরা। মেসবাহ কামাল এই মিছিলটি সম্পর্কে লিখেছেন –

মিছিলটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যাল সেন্টার হয়ে পাবলিক লাইব্রেরির মোড় ও বাংলা একাডেমীর সামনে দিয়ে হাইকোর্টের কাছাকাছি এলে কয়েকশত ইপি আর রাইফেল উঁচিয়ে মিছিলের পথ রোধ করে দাঁড়ায়। মিছিলের পুরোভাগে কালো পতাকা বহন করছিলেন একজন ছাত্রী। তিনি ধীর ও শান্ত কিন্তু অবিচল পদক্ষেপে ইপি আর-এর তাক করা রাইফেলের ব্যুহ ভেদ করে মিছিলটিকে এগিয়ে নিয়ে যান

 

পরদিন একুশে জানুয়ারী ঢাকা শহরে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। পুলিশ, ইপি আর-এর গুলি বেয়নেট উপেক্ষা করে সেদিন রাস্তায় নেমে আসেন সর্বস্তরের জনগণ, জারীকৃত ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে। শহীদ আসাদের গায়েবী জানাজা অনুষ্ঠিত হয় পল্টন ময়দানে লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে। জানাজা শেষে আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে মিছিল বের হয়। কবি শামসুর রাহমান দেখেছিলেন সেই মিছিল। আর রচনা করেছিলেন তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটা কবিতা।

 

আসাদের শার্ট

শামসুর রাহমান

গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের
জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট
উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।

বোন তার ভায়ের অম্লান শার্টে দিয়েছে লাগিয়ে
নক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম কখনো
হৃদয়ের সোনালি তন্তুর সূক্ষ্মতায়
বর্ষীয়সী জননী সে-শার্ট
উঠোনের রৌদ্রে দিয়েছেন মেলে কতদিন স্নেহের বিন্যাসে।

ডালিম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর-শোভিত
মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট
শহরের প্রধান সড়কে
কারখানার চিমনি-চূড়োয়
গমগমে এ্যভেন্যুর আনাচে কানাচে
উড়ছে, উড়ছে অবিরাম
আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে,
চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায়।

আমাদের দুর্বলতা,ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক ;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।

 

বিশে জানুয়ারী, ২০১০।

 

তথ্যসূত্র –

মেসবাহ কামাল, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, শহীদ আসাদ ও শ্রেণী-রাজনীতি প্রসঙ্গ, দ্বিতীয় সংস্করণ, ২০০৭, শ্রাবণ প্রকাশনী, ঢাকা।