একখন্ড বস্ত্র মানবিক
ইরতিশাদ আহমদ
তিরিশে ডিসেম্বর, ঊনিশশো আটষট্টি। দৈনিক পাকিস্তানের বার্তা সম্পাদক নির্মল সেন বসে আছেন তাঁর টেবিলে। রাত হয়েছে, এগারোটার কাছাকাছি। এক অপরিচিত যুবক এসে ঢুকলেন। মাথায় পট্টি বাঁধা। যুবক উত্তেজিত। বললেন শিবপুর থেকে এসেছেন। একটা সংবাদ দিতে, পরদিন যাতে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বর্ণনা দিলেন ঘটনার, হাট-হরতালের, পুলিশের হামলার। মওলানা ভাসানীর ডাকে কৃষক সমিতি শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালনের ডাক দিয়েছিল ঊনত্রিশে ডিসেম্বর। হাট-বাজার, দোকান-পাট বন্ধ রাখা হয়েছিল সেদিন। পুলিশ লাঠি-বন্দুক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে কৃষক সমাবেশের ওপরে।
নির্মল সেনের নির্বিকার-নিস্পৃহ ভাব দেখে যুবক মরিয়া। “বিশ্বাস হচ্ছে না? তবে দেখুন”। বলে মাথার পট্টি খুলে ফেললেন। মাথায় রক্তের চাপ চাপ দাগ সুস্পষ্ট। কিন্তু তাতে কি! খবর ছাপানো যায় নি।
নির্মল সেনের অকপট স্বীকারোক্তি। সরকারের রোষানলে পড়ার ভয়ে কোন পত্রিকাই তখন সে খবর ছাপাতো না। তিনিও ছাপান নি।
কে জানতো এই যুবক মাত্র সপ্তাহ তিনেক পরেই আবার আসবেন পত্রিকার অফিসে। খবর দিতে নয়, খবর হয়ে। আর এইবার তাঁকে উপেক্ষা করতে পারবে না কোন সংবাদপত্র।
আমি আসাদের কথা বলছি। হ্যাঁ, সেদিনের সেই মাথায় পট্টি বাঁধা যুবকের নাম ছিল আসাদ, আসাদুজ্জামান। তাঁর নামেই প্রতি বছর বাংলাদেশে বিশে জানুয়ারী পালিত হয় আসাদ দিবস। মোহাম্মদপুরের আসাদ গেট ধারণ করে আছে তাঁরই নাম।
আসাদ ছাত্র ছিলেন। বামপন্থী ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। অনেক ছাত্রই তখন বামপন্থী রাজনীতিতে জড়িয়েছিল। অনেকের কাছে বাম রাজনীতি করা ছিল একধরনের ফ্যাশন। আসাদ সেই ধারার ছাত্র রাজনীতিক ছিলেন না। অনেকের মতো আসাদ শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনেই নিজেকে আবদ্ধ রাখেন নি। জড়িয়েছিলেন কৃষক সংগঠনের সাথে, নিজের এলাকায়, শিবপুরেরে হাতিরদিয়ায়, মনোহরদিতে। আত্মনিয়োগ করেছিলেন কৃষকদের সংগঠিত করার কাজে। কৃষকের অর্থনৈতিক মুক্তির মাধ্যমেই আসবে জনগণের সার্বিক মুক্তি, তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল । সমাজতন্ত্রে তাই ছিল অবিচল আস্থা। আসাদের পছন্দের শ্লোগান ছিল ‘মুক্তির মন্ত্র, জনগণতন্ত্র’ আর ‘জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো’। কৃষকের মনে চেতনার আগুন জ্বালাতে চেয়েছিলেন। মনে করেছিলেন, অন্য কোন কাজের চেয়ে এই কাজটাই বেশি দরকারী ।
আসাদ রাজনীতি করাটাকে দায়িত্ব মনে করতেন। তাই তাঁর দলে নেতৃস্থানীয় ছিলেন, দলের সংগঠক ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ)-এর ঢাকা হল শাখার সভাপতি ছিলেন। পেছনের সারিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার মানুষ ছিলেন না আসাদ। তাঁর ভুমিকা ছিল উদ্যোক্তার, আয়োজকের। মিছিলে তাই তিনি সম্মুখেই থাকতেন। সেদিনও ছিলেন। ঊনসত্তরের বিশে জানুয়ারী ছিল দিনটি। এক পুলিশ অফিসার খুব কাছে থেকে আসাদের বুকে পিস্তলের গুলি ছোঁড়েন।
ইতিহাসে এম,এ পাশ করেছিলেন। ফলাফল আশানুরূপ না হওয়ায় দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আর ভর্তি হয়েছিলেন আইন কলেজে। একটা চাকরী নিয়ে বিয়ে থা করে সংসারী হয়ে যাওয়াটা বিচিত্র কিছু ছিল না আসাদের মতো এক যুবকের পক্ষে ওই বয়সে। কিন্তু আসাদের স্বপ্ন ছিল একটু অন্যরকম। তিনি স্বপ্ন দেখতেন শ্রেণীহীন, শোষনহীন, সামজিক ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার। আসাদ মৃত্যুর আগেই তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার কাজে।
ঊনসত্তরের জানুয়ারী; পূর্ব বাংলা অগ্নিগর্ভ। ছাত্রদের এগার দফা তখন সমগ্র জনগণের প্রাণের দাবীতে পরিণত হয়েছে। ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে আইয়ুব-মোনায়েমের সরকার দিশাহারা। জানুয়ারীর সতের তারিখে পুলিশ, ইপি আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে ছাত্রদের মারধর করে। প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সারা পূর্ব বাংলায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালনের আহবান জানায় জানুয়ারীর বিশ তারিখে। ঢাকা হলের (এখনকার শহীদুল্লাহ হল) সামনে আসাদ ছিলেন মিছিলের নেতৃত্বে। হলের সীমানার মধ্যে মিছিলটাকে নিয়ে ঢোকার মুখেই গুলি চালান আসাদকে লক্ষ্য করে পুলিশের ‘বীর’ অফিসার।
আসাদ মারা যান ঘটনাস্থলেই। তাঁর মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। সারাদেশে নেমে আসে শোকের ছায়া। স্বতস্ফূর্ত শোক মিছিল বের করেন ছাত্র-ছাত্রীরা। মেসবাহ কামাল১ এই মিছিলটি সম্পর্কে লিখেছেন –
“মিছিলটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যাল সেন্টার হয়ে পাবলিক লাইব্রেরির মোড় ও বাংলা একাডেমীর সামনে দিয়ে হাইকোর্টের কাছাকাছি এলে কয়েকশত ইপি আর রাইফেল উঁচিয়ে মিছিলের পথ রোধ করে দাঁড়ায়। মিছিলের পুরোভাগে কালো পতাকা বহন করছিলেন একজন ছাত্রী। তিনি ধীর ও শান্ত কিন্তু অবিচল পদক্ষেপে ইপি আর-এর তাক করা রাইফেলের ব্যুহ ভেদ করে মিছিলটিকে এগিয়ে নিয়ে যান”।
পরদিন একুশে জানুয়ারী ঢাকা শহরে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। পুলিশ, ইপি আর-এর গুলি বেয়নেট উপেক্ষা করে সেদিন রাস্তায় নেমে আসেন সর্বস্তরের জনগণ, জারীকৃত ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে। শহীদ আসাদের গায়েবী জানাজা অনুষ্ঠিত হয় পল্টন ময়দানে লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে। জানাজা শেষে আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে মিছিল বের হয়। কবি শামসুর রাহমান দেখেছিলেন সেই মিছিল। আর রচনা করেছিলেন তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটা কবিতা।
আসাদের শার্ট
শামসুর রাহমান
গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের
জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট
উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।
বোন তার ভায়ের অম্লান শার্টে দিয়েছে লাগিয়ে
নক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম কখনো
হৃদয়ের সোনালি তন্তুর সূক্ষ্মতায়
বর্ষীয়সী জননী সে-শার্ট
উঠোনের রৌদ্রে দিয়েছেন মেলে কতদিন স্নেহের বিন্যাসে।
ডালিম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর-শোভিত
মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট
শহরের প্রধান সড়কে
কারখানার চিমনি-চূড়োয়
গমগমে এ্যভেন্যুর আনাচে কানাচে
উড়ছে, উড়ছে অবিরাম
আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে,
চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায়।
আমাদের দুর্বলতা,ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক ;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।
বিশে জানুয়ারী, ২০১০।
তথ্যসূত্র –
১মেসবাহ কামাল, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, শহীদ আসাদ ও শ্রেণী-রাজনীতি প্রসঙ্গ, দ্বিতীয় সংস্করণ, ২০০৭, শ্রাবণ প্রকাশনী, ঢাকা।
ইরতিশাদ,
অনেক ধন্যবাদ লেখাটি উদ্ধৃত করার জন্য। নাহ, লিঙ্ক দুটি আগে দেখিনি। ছবিটা দেখেছিলাম আগেই।
৭১ নিয়ে ঘাটাঘাটি করে আর ৬৯ তেমন করে ঘাটা হয়নি।
আসাদ মতিউরের কথা মনে হলে একই সাথে চোখের সামনে ভেসে ওঠে এযুগের ছাত্রনেতাদের। মনে হয় একই দিনে শহীদ আসাদের শাহাদাত বরন, আবার অন্য দিকে ঢাঃবিঃ তে সোনার ছেলেদের কি নয়নাভিরাম অস্ত্রের মহড়া। আহজার মল্লিক আশ্রয়হীন হলে কি হবে, এসব সোনার ছেলেমেয়েরা এখনই কেউ কেউ মনে হয় কোটিপতি।
ডঃ জোহা সম্পর্কেও আরেকটু পড়া দরকার।
শহীদ আসাদের আত্মত্যাগের দিন স্মরণে রেখে এরকম একটি অসাধারণ মানবিক লেখা আমাদের উপহার দেবার জন্য ইরতিশাদ ভাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
সাধারণত গণ-আন্দোলনে যারা শহীদ হন তারা দূর থেকে পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলিতে মারা যান। শহীদ আসাদের ক্ষেত্রে কিন্তু তা হয়নি। একজন পুলিশ অফিসার খুব কাছে থেকে ঠান্ডা মাথায় পিস্তল দিয়ে আসাদকে গুলি করেছিল।
ক্যাথেরীনা আসাদ গেটের কথা বলেছে, আসাদ এভিন্যুর কথা বলেছে। মোহাম্মদপুরের আসাদ গেটের পাশ দিয়ে যারা যাতায়াত করেন, তারা কখনো খেয়াল করেছেন কিনা জানি না, ওই গেটে উর্দুতে কী সব যেন লেখা আছে। বাংলায় কিছুই নেই। আমি দেশ ছাড়ার আগ পর্যন্তও ওটা দেখেছি। এখনো উর্দুতেই আছে কিনা জানি না। কারোরই সময় হয়নি ওটাকে পালটে বাংলায় করে দেবার। এর থেকে বড় অপমান দেশের জন্য জীবন দেয়া একজন শহীদের কাছে আর কী হতে পারে।
আসাদের সাথে সাথে ওই আন্দোলনেই আরো একজন প্রাণ দিয়েছিল, যে হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমে ক্রমে বিস্মৃতির অতলে। ২৪ শে জানুয়ারী গণ-আন্দোলনকারী জনতার মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ। পুলিশের সেই গুলিতে নিহত হন নবকুমার ইনস্টিট্যুটের দশম শ্রেণীর ছাত্র মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সের কিশোর মতিউর।
আসাদ এবং মতিউরদের মত আরো অসংখ্য সূর্য সৈনিকদের জন্য রইলো একবুক ভালবাসা।
@ফরিদ আহমেদ,
ধন্যবাদ। শহীদ মতিউরের কথা উল্লেখ না করলে আসাদের কাহিনী অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আসাদের মৃত্যুর প্রতিবাদ করতে গিয়ে কিশোর মতিউর প্রাণ দিয়েছিল আরো অনেকের সাথে।
@ইরতিশাদ,
হ্যা, কাল থেকেই ওনার কথাই ভাবছিলাম।
লিখে ফেলেন না শহীদ মতিউরকে নিয়ে কিছু।
উনি তো মনে হয় নিতান্তই স্কুলের বালক ছিলেন, নবকুমার ইনষ্টিটিউটের নবম শ্রেনীর ছাত্র ছিলেন।
@আদিল মাহমুদ,
ধন্যবাদ, অনুরোধের জন্য। আমি দুঃখিত, শহীদ মতিউরের ওপরে পূর্ণাঙ্গ একটা লেখা তৈরী করার মতো তথ্য-উপাত্ত আমার কাছে নেই।
নীচে, ইন্টারনেটে পাওয়া ডঃ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর এই লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি –
“জানুয়ারির চব্বিশ তারিখটিকে গণঅভ্যুত্থানের দিন বলে চিহ্নিত করা হয়। কারণ আছে। ওই দিন যা ঘটে তা তুলনা বিরহিত। সেদিন হরতাল ছিল। হাজার হাজার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসে জড়ো হয়েছিল সচিবালয়ের সামনে। চতুর্দিক থেকে তারা এসেছে। সেনাবাহিনী মোতায়েন ছিল। ছাত্র নয়, সাধারণ মানুষই ছিল প্রধান অংশ। নারায়ণগঞ্জ, ডেমরা, টঙ্গী থেকে শ্রমিকরাও রওনা দিয়েছিল। তাদের আসতে দেয়া হয়নি। মাঝপথে থামিয়ে দেয়া হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি সকল কর্মচারী রাস্তায় নেমে এসেছেন। ওয়াপ্দার অবাঙালি চেয়ারম্যান ছিলেন মাদানী, যাঁর মেয়ে তখন আমাদের বিভাগের ছাত্রী, কর্মচারীদের চাপে তিনিও মিছিলে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ক্ষিপ্ত হানাদার সৈন্যরা বেপরোয়া গুলি ছোড়ে, তাতে রুস্তম আলী ও মতিউর রহমান মল্লিক নামে দু’জন ছাত্র নিহত হয়। সব মিলিয়ে সাতজন শহীদ হন।
মতিউর ছিল ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউটের দশম শ্রেণীর ছাত্র। সেদিন সে ছিল একটি মিছিলের সামনে। সেখানেই তাকে গুলি করা হয়। জনতাকে নেতৃত্ব দেবেন এমন কেউ তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। শেখ মুজিবুর রহমান জেলে, মওলানা ভাসানী ঢাকার বাইরে। জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে যা করবার করেছে। তারা নানা রকমের পোস্টার ও ব্যানার নিয়ে এসেছিল। একাংশ সেক্রেটারিয়েট ভবনও আক্রমণ করে। তারা আইউব খান ও মোনেম খানের কুশপুত্তলিকা নিয়ে এসেছিল, লাঠি ও জুতো দিয়ে যেগুলোকে বেদম পেটানো হয়েছে। তখনকার সরকারি পত্রিকা ‘দৈনিক পাকিস্তান’ ও ‘ মর্নিং নিউজ’ অফিসের উল্টো দিকে আইউব খানের দলের একজন এমএন এ’র, যার নাম ছিল লস্কর, তার একটি পেট্টোল পাম্প ছিল। সেটিতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অগ্নিসংযোগের আগে পেট্রোল বের করে নিয়ে পত্রিকা দু’টির ভবনে আগুন লাগানো হয়েছিল। জনতা কী করবে ঠিক করতে পারছিল না। তারা আক্রমণ করেছিল পরীবাগে খাজা শাহাবুদ্দিনের বাড়িতেও।
বিশাল একটি মিছিল চলে এসেছিল তখনকার ইকবাল হলের মাঠে। ইকবাল হলের মাঠেই তখন এ ধরনের সমাবেশ হতো। মিছিলের সামনে ছিল মতিউর ও রুস্তমের লাশ। মাঠে ওই দু’জনের জানাজা হয়। তাতে হাজার মানুষ যোগদান করেন। মতিউরের পিতা আজহার আলী মল্লিক ছিলেন একটি সরকারি ব্যাংকের কর্মচারী। জানাজায় তিনি নিজে অংশ নেন এবং ধরা গলায় বলেন, ‘আমার এক মতিউর চলে গেছে কিন্তু আজ আমি লক্ষ মতিউরকে পেয়েছি।’ তাঁর এই উক্তি তখন মুখে মুখে প্রচার পেয়েছিল এবং তখনকার মানুষদের এখনো তা মনে থাকার কথা। তারপরে দেশ স্বাধীন হয়েছে, মতিউরের পিতা আজহার আলী মল্লিক সে স্বাধীনতা দেখেছেন, কিন্তু সরকারি কর্মচারী হিসেবে অবসর গ্রহণ করার পর ঢাকা শহরে তিনি থাকার মতো কোনো জায়গা খুঁজে পাননি। স্বাধীনতা যে জনগণের জন্য মুক্তি আনেনি তার বহু প্রমাণ আছে, আজহার আলী মল্লিকের আশ্রয়হীনতা তার আরও একটি প্রমাণ বটে। যে সামাজিক বিপ্লবের স্বপ্ন মানুষ ঊনসত্তরে এবং পরে একাত্তরে মানুষ দেখেছিল এবং যার জন্য সংগ্রাম করেছিল সেটি বাস্তবায়িত হয়নি; বরং পুঁজিবাদের বিকাশের জন্য যে পথটি পাকিস্তানে তৈরি হচ্ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে সেটিই প্রশস্ততর হচ্ছিল। সেই প্রশস্ত পথের দু’ধারে আজহার আলী মল্লিকদের ছিটকে পড়ারই কথা ছিল এবং তাঁরা সেটা পড়েছিলেনও। আজহার আলী মল্লিক শুনেছি পশ্চিমবঙ্গ থেকে উদ্বান্তু হয়ে এসেছিলেন, পূর্ববঙ্গেও তিনি উদ্বাস্তুই রয়ে গেলেন। যেমন রয়ে গেছে পূর্ববঙ্গের লাখ লাখ মানুষ।”
আরো দুটো লিঙ্ক দিচ্ছি, আপনি খুব সম্ভবত আগেই দেখেছেন, যারা দেখেন নি তাদের কাছে আশা করি পূনরাবৃত্তি মনে হবে না।
এক
দুই
জনশ্রুতি আছে সেদিন জনসভায় জড়ো হয়েছিল হাজার দশেক ছাত্র জনতা। জনসভা শেষে বারটা নাগাদ মিছিল এগিয়ে যাচ্ছিলো, পুলিশ সেই মিছিলে তান্ডব চালায় । সেদিনের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের একজন সদস্য কাজী শাহাবুদ্দীন শাহাজাহান এর ভাষ্য অনুযায়ী আসাদের গুলিবৃদ্ধ দেহটা মাটিতে পড়ে ছিলো, মনে হয় যেন মৃত্যর সময়ে দু হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সতীর্থদের দিকে।
আমরা আসাদের সে বাড়ানো হাত আজো ধরতে পারি নি। মিছিলের পুরোভাগে একদিন আসাদের যে হাত মানুষের মুক্তির মন্ত্রে উত্থিত ছিলো, মুক্তি পাগল মানুষের হাতে রেখেছিলো বিশ্বাসী যোদ্ধার শাণিত হাত, যে হাত শস্যহীন সময়ে গড়ে তুলেছিলো সর্বহারা মানুষের জন্যে সান্ধ্য বিদ্যালয়। আমরা সে হাত ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছি।
আমাদের আবেগের গভীরতা কম, তীব্রতা বেশী। বোধ করি সে কারনেই আসাদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আয়ুব গেটের নাম পরিবর্তন করে আসাদ গেইট হয়েছিলো, আয়ুব এভিনিয়ু হয়েছিলো আসাদ এভিনিয়ু। কিন্তু তার পর? আবার সেই মেঠেল গতরের দেহাতী শরীরের একই বঞ্চনার করুণ কাহিনী ।
ধন্যবাদ ডঃ ইরতিশাদকে তার মর্মগ্রাহী লেখায় মনে করিয়ে দেবার জন্যে যে একদা মানুষ স্পর্ধিত হয়েছিলো, একদা কিছু মানুষের হৃদয়ের খাঁচায় স্পন্দন জেগেছিলো।
@কেয়া রোজারিও,
ধন্যবাদ, গুরুত্বপূর্ণ সংযোজনের জন্য। আসাদ ডায়েরি লিখতেন, মারা যাবার পর আজাদ পত্রিকায় তাঁর ডায়েরি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। আমি পড়েছিলাম। কিছুই তেমন মনে নেই। শুধু এটুকু মনে আছে তাঁর অঞ্চলের কৃষকেরা আসাদকে তাদের পরিবারের একজন মনে করতো। তাঁদের ঘরে ছিল আসাদের অবারিত যাতায়াত। তাদের ঘরেই ভাত খেতো।
হতাশার এই করুণ কাহিনীকে পেছনে ফেলে মানুষ আবার স্পর্ধিত হবে, আসাদ-মতিউরেরা সেই আশাই জাগিয়ে রাখে।
ইরতিশাদ ভাই,
অনেক ধন্যবাদ লেখাটার জন্য। অনেক শুনেছি আসাদের কথা, কন্তু বিস্তারিত কিছু পড়িনি কোথাও। আপনি আরও বেশী করে লিখলে খুশী হব।
@বন্যা আহমেদ,
ধন্যবাদ, মন্তব্যের জন্য। আসাদের জীবন নিয়ে তাঁর বন্ধু-বান্ধবেরা লিখেছেন নিশ্চয়ই। সবকিছু যোগাড় করে গুছিয়ে লেখাটাই একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। শুভেচ্ছা রইলো।
পথিক কে ধন্যবাদ
@ইরতিশাদ,খুবই মর্মস্পর্শী লেখা।চোখে জল এনে দিতে চায়।
দিনোপযোগী পোস্ট।
শুরুটা দুর্দান্ত হয়েছে। আর পুরো লেখাটাই মমতায় ভরা। এমন দিনে আসাদকে স্মরণ করায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
ইরতিশাদ ভাইয়ের কলম (থুরি কিবোর্ড) থেকে আরো এ ধরণের লেখা বেরিয়ে আসুক।
@অভিজিৎ,
ধন্যবাদ। দেরীতে হলেও ইংরেজী নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। বাংলাদেশে কেমন কাটলো?
একমত, অত্যন্ত মর্মস্পর্শী লেখা।
শহীদ আসাদের জীবনি আরেকটু বিস্তারিত জানালে ভাল হত।
আসাদের গুলিবিদ্ধ হবার ও তার রক্তমাখা লাশ নিয়ে মিছিলের ছবি পাবেন এখানে।
তবে সাংবাদিক নির্মল সেনকে অত্যন্ত সাহসী মানুষ বলেই জানতাম। সত্য বলতে বাংলাদেশের চেনা পরিচিত বিরল যে দুয়েকজনকে শ্রদ্ধা হয় তার মধ্যে তিনি একজন। তিনিও তাহলে কখনো কখনো আপস করেছিলেন।
@আদিল মাহমুদ,
ধন্যবাদ। আসাদের মৃত্যুকে নিয়েই এই লেখাটা। জীবনী বারান্তরে, যদি পারি।
আপনার মন্তব্য পড়ে মনে হচ্ছে আমার লেখায় নির্মল সেনকে বোধহয় একটু ভুল বোঝার অবকাশ রয়ে গেছে। সরকারী মালিকানাধীন পত্রিকায় আইয়ুবী স্বৈরাচারের আমলে চাকুরী করতেন তিনি। কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের খবর ছাপানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তাঁর ছিল না। আর তিনি জানতেন সে অনুমতি পাওয়া যাবে না। তাই খবরটা না ছাপিয়ে তিনি আপোস করেছিলেন বললে, একটু অবিচার করা হয় তাঁর প্রতি। এই ঘটনাটার কথা নির্মল সেন তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই ‘আমার জবানবন্দী’-তে উল্লেখ করেছেন। বইটা পড়ে আমি নির্মল সেন-এর প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত হয়েছি। রাজনীতিতে এবং সাংবাদিকতায় তাঁর সততা, সাহস এবং ত্যাগের কাহিনী কিংবদন্তী হয়ে থাকবে।
@ইরতিশাদ,
ধণ্যবাদ আপনার জবাবের জন্য। আসাদের জীবনী লিখতে পারলে তা হবে সত্য সত্যই একটি অনন্য জিনিস। অপেক্ষায় থাকলাম।
নির্মল সেনের ব্যাপারটা এখন বুঝতে পারলাম। আসলেই ওনার মতন মানুষের কথা মনে হলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যায়। নীতিবান হলে যা হয়, ওনারও মনে হয় তাই হয়েছে। ক’বছর আগে কাগজে পড়েছিলাম যে ওনার দূরারোগ্য ব্যাধি হয়েছে, অর্থাভাবে ভাল চিকিতসা হচ্ছে না।
@ইরতিশাদ,খুবই মর্মস্পর্শী লেখা।চোখে জল এনে দিতে চায়। :yes: :rose:
ধন্যবাদ, পথিক।