জীবনানন্দ দাশের ‘মিশর’ কবিতাটির ইংরেজী অনুবাদ
জাফর উল্লাহ
কবি জীবনানন্দের যখন ভরা যৌবন, তখন তিনি তাঁর ‘মিশর’ কবিতাটি রচনা করেন। পরিশেষে তিনি কবিতাটি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ এ জুড়ে দেন। ‘ঝরাপালক’ শব্দটির ইংরেজী রূপ হচ্ছে ‘Fallen Feather’. খুব সম্ভব কবি ইংরেজীর ছাত্র ছিলেন বলে ইংরেজী এই ফ্রেজের সাথে সম্যক পরিচিতি ছিল তাঁর। এই ‘মিশর’ কবিতায় তিনি গ্রীক্ ও ইজিপ্শিয়ান মিথোলোজীর অনেক নাম উল্লেখ করেছেন। ১৯২০ দশকে বাংলা কবিতায় প্রাচ্যের কিংবদন্তি থেকে নেয়া এত নাম আর অন্য কোথাও দেয়া হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। সে’ জন্য এই ‘মিশর’ কবিতাটি মর্ডান গোত্রে ফেলা যায়। দ্বিতীয় লাইনে কবি “অরাল ঠোঁটের আলাপ” শব্দাবলী যখন লিখেন তখন আমি “অরাল” শব্দটি নিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাই। পরে অবশ্য বুঝতে দেরী হয়নি যে কবি ইংরেজী শব্দ “aural” জুড়ে দিয়েছেন এই কবিতায়। বাংলা কবিতায় ইংরেজী শব্দ এ’রকম ‘বোল্ড’ ব্যবহার এই বুঝি প্রথম! সুপ্রাচীন মিশর দেশ ও তার রূপকথা নিয়ে এই কবিতাটি লিখা। তবে ভারতের রূপকথা থেকে কবি অনেক উপমা ব্যবহার করে কবিতাটির অশেষ শ্রী-বৃদ্ধি করেছেন।
এই ‘মিশর’ কবিতাটির ইংরেজী অনুবাদ করা যতটুকু সহজ হবে বলে আমি মনে করেছিলাম আসলে হয়েছে তার বিপরীত! পৃথিবীর আর অন্য প্রাচীন সিভিলাইজেশন ও মিথোলজী থেকে যে দুই বাঙালী কবি অঢেল মেটাফর ও সিমিলি ব্যবহার করেছেন তাঁরা হছেন বিষ্ণু দে ও জীবনানন্দ দাশ। কি আশ্চর্য ! দু’জনই ছিলেন ইংরেজীর ছাত্র। বিষ্ণু দের কবিতা সুপাঠ্য তবে দুর্বোধ্য। মহাভারত ও গ্রীক্ মিথোলজী থেকে উপমা ব্যবহার করে বাংলা কবিতার মান তিনি উন্নয়ন করেছেন বটে, তবে সাধারণ পাঠক সেগুলোর রস উদ্ঘাটন করতে অসমর্থ হয়েছে।
এই মিশর কবিতায় জীবনানন্দ ছন্দ ব্যবহার করেছেন। পরবর্তী কালে তিনি আমিত্রাক্ষর ছন্দে কবিতা লিখেছিলেন অঢেল।
এই কবিতায় কবি মিশরের ফেলে আসা দিনগুলোর কথাই লিখেছেন। সে দিনগুলো তো আর ফেরৎ আসবে না? এটিই বোধ তাঁকে পীড়া দিচ্ছে। জীবনানন্দকে আমি বলি মৃত ও মৃত্যুর কবি। পুরোনো সব কিছু যে গুলো ধ্বংশপ্রাপ্ত হয়েছে সেগুলোর প্রতি তাঁর প্রবল আকর্ষণ!
জীবনানন্দ দাশের ‘মিশর’ কবিতাটি পড়ে দেখুন – হয়ত বা ভালই লাগবে।
—————-
মিশর
জীবনানন্দ দাশ
[‘ঝরা পালক’ কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া একটি কবিতা ]
‘মমী’র দেহ বালুর তিমির জাদুর ঘরে লীন, –
‘স্ফীঙ্কস্’ – দানবীর অরাল ঠোঁটের আলাপ আজি চুপ !
ঝাঁ-ঝাঁ মরুর ‘লু’ইয়ের ‘ফুঁ’য়ে হচ্ছে বিলীন-ক্ষীণ
মিশর দেশের কাফন পাহাড় – পিরামিডের স্তূপ !
নিভে গেছে ‘ঈশিশি’রি বেদীর থেকে ধূমা,
জুড়িয়ে গেছে লকলকে সেই রক্তজিভার চুমা !
এদ্দিনেতে ফুরিয়ে গেছে কুমারীপূজার ঘটা,
দুলছে মরুমশান-শিরে মহাকালের জটা !
ঘুমন্তদের কানে-কানে কয় সে, – ‘ঘুমা, – ঘুমা’ !
ঘুমিয়ে গেছে বালুর তলে ফ্যারাও, – ফ্যারাও-ছেলে, –
তাদের বুকে যাচ্ছে আকাশ বর্শা ঠেলে-ঠেলে !
হাওয়ার সেতার দেয় ফুঁপিয়ে ‘মেম্ননে’রি বুক,
ডুবে গেছে মিশররবি, – বিরাট ‘বেলে’র ভুখ
জিহবা দিয়ে জঠর দিয়ে গেছে তোমায় জ্বেলে !
পিরামিডের পাশাপাশি লালচে বালুর কাছে
স্থবির মরণ-ঘুমের ঘোরে মিশর শুয়ে আছে !
সোনার কাঠি নেই কি তাহার ? জাগবে না কি আর !
মৃত্যু, – সে কি শেষের কথা ? – শেষ কি শবাধার ?
সবাই কি গো ঢালাই হবে চিতার কালির ছাঁচে !
নীলার ঘোলা জলের দোলায় লাফায় কালো সাপ।
কুমীরগুলোর খুলির খিলান, – করাত দাঁতের খাপ
ঊর্ধ্বমুখে রৌদ্র পোহায়; – ঘুমপাড়ানির ঘুম
হানছে আঘাত, – আকাশ-বাতাস হচ্ছে যেন গুম !
ঘুমের থেকে উপচে পড়ে মৃতের মনস্তাপ !
নীলা, নীলা, – ধুকধুকিয়ে মিশরকবর-পারে
রইলে জেগে বোবা বুকের বিকল হাহাকারে ।
লাল আলেয়ার খেয়া ভাসায় ‘রামেসেসে’র দেশ !
অতীত অভিশাপের নিশা এলিয়ে এলোকেশ
নিভিয়ে দেছে দেউটি তোমার দেউল-কিনারে !
কলসি কোলে নীলনদেতে যেতেছে ওই নারী,
ওই পথেতে চলতে আছে নিগ্রো সারি-সারি;
ইয়াঙ্কি ওই, – ওই য়ুরোপী, – চীনে-তাতার-মুর
তোমার বুকের পাঁজর দলে টলতেছে হুড়মুড়, –
ফেনিয়ে তুলে খুনখারাবী, – খেলাপ, – খবরদারি !
দিনের আলো ঝিমিয়ে গেলো, – আকাশে ওই চাঁদ !
– চপল হাওয়ায় কাঁকন কাঁদায় নীলনদেরই বাঁধ !
মিশর-ছুঁড়ি গাইছে মিঠা শুঁড়িখানার সুরে
বালুর খাতে, প্রিয়ের সাথে – খেজুরবনে দূরে !
আফ্রিকা এই, এই যে মিশর – জাদুর এ যে ফাঁদ !
‘ওয়েসিসে’র ঠাণ্ডা ছায়ায় চৈতিচাঁদের তলে
মিশরবালার বাঁশির গলা কিসের কথা বলে !
চলছে বালুর চড়াই ভেঙে উটের পরে উট –
এই যে মিশর – আফ্রিকার এই কুহকপাখাপুট !
– কি এক মোহ এই হাওয়াতে – এই দরিয়ার জলে !
শীতল পিরামিডের মাথা, – ‘গীজে’র মুরতি
অঙ্কবিহীন যুগসমাধির মূক মমতা মথি
আবার যেন তাকায় অদূর উদয়গিরির পানে !
‘মেম্ননে’র ওই কন্ঠ ভরে চারণ-বীণার গানে !
আবার জাগে ঝাণ্ডাঝালর, – জ্যান্ত আলোর জ্যোতি !
—————
Egypt
Jibanananda Das
[From “Jhora Palok” (Fallen Feathers) collection of poems published in 1927]
In the darkness of museum Mummy’s body had vanished, –
words from demoness sphinx’s aural leaps is hushed today.
Like a heap of pyramid Egypt’s prodigious volume of shroud –
faded away by blowing wind of simoom!
The incense from altar of Isis is quenched,
The kiss of blood smeared and lolled tongue had subsided!
By now, the offering of maiden to god had all but vanished,
The desert crematorium sways – on the head Siva’s matted hair!
He whispers to slumbering ones – sleep, – sleep!
Pharaoh and his son in deep slumber underneath the sand,
The firmament piercing their chest like lunging lance!
Hearing melody from windblown sitar Memnon’s heart sobs,
Egypt’s sun had set, the giant belle’s thirsty tongue
and hungry stomach scorched Egypt’s soul!
Still like death’s eternal sleep,
Egypt in deep slumber!
Doesn’t she have a golden key? Isn’t she gonna wake up?
Death, – Is it the finality? No sepulcher?
Will everyone face the charcoal of cremation?
Black serpents cresting the Nile’s waves of muddy waters.
Crocs with their arched head and gaping mouth
filled with sharp teeth, sunbathing, lullaby-laden sleep
striking hard, – the sky and wind about to be absconding!
From sleep oozes out lamentation of dead.
Oh, Nile, Nile, throbbingly you hug the moribund Egypt
You remain awake as your crippled heart wails!
A ferry of red delusion is set adrift in Rameses’ land!
The past, with dark curse, disheveled and unkempt hair,
came to quench the lamp that is near your shrine!
Carrying earthen pitcher that woman heading for the Nile,
A cavalcade of Ebony men and women treading the same path:
I can see Yankees, Europeans, Chinese, Tatars, Moors too
Stepping over your ribcage, they all are stampeding–
Bloodletting, murder, violation, forced custody galore!
Daylight diminishes, – moon is on the sky!
Levee on the Nile hears sad sound of bangles and cries!
Egyptian maiden belts out a sweet tune suitable for bar
on the sandbar, with her man, over yonder in the palm grove!
This is Africa, this is Egypt, – a sorcerer’s trap!
An oasis’s cool shadow in a moonlit vernal night
Egyptian maiden, what she talks all about?
Multitudes of camels climb the uphill sand dune –
This is Egypt – Africa’s land of black magic!
– what a bewitchment brings this breeze – this river water!
The cold head of Pyramid houses spotless statue of Giza
– churning affectionate love of sepulcher of that bygone age,
It gazes again towards eastern mountain!
Memnon sings the tune of holy minstrel!
Sequined flags are hoisted again, – lively light aglow!
[Translated by Jaffor Ullah]
@ ফরিদ,
সত্যি বলতে কি এটি একটি ‘থেংক্স-লেস্ জব্’। জীবনানন্দের কবিতার অনুবাদ হরদমই তো হচ্ছে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনটন সিলি ছাড়াও আরো অনেকে যেমন ফায়জুল লতিফ চৌধুরী, লুনা রুশদী, ঢাবির ডঃ ফকরুল আলম, কোলকাতার অনুপম বানার্জী এরা সব জীঃ দাঃ এর কবিতা অনুবাদ করেছেন ও করছেন। কবির ‘টপ ফোর্টি’ কবিতার অনুবাদই বেশী হয়েছে। সেই কারণে আমি কবির অগ্রন্থিত কবিতার অনুবাদে বেশী আগ্রহী। বই বের করার ইচ্ছে মোটেই নেই। তবে এরই মধ্য আমার অনুবাদিত কবিতা আন্তর্জালের অনেক জায়গায় স্থান পেয়েছে। মুক্ত-মনা ফোরামে আমি সবগুলো অনুবাদ করা কবিতা ছেপেছি। আমি থেকে থেকে গ্রাম বাংলার এই কবির কিছু কবিতার অনুবাদ করবো সে’ আশা রাখছি। ধন্যবাদ আপনাকে মন্তব্য রাখার জন্যে।
দারুণ কাজ করছেন আপনি জাফর ভাই। কবিতার অনুবাদ তার রস বিনষ্ট না করে করা কতখানি কঠিন তা যারা করেছে তারাই জানে।
আপনার ইংরেজী অনুবাদগুলো নিয়ে কী কোন বই বের করার ইচ্ছা আছে নাকি? তাহলে ইংরেজী ভাষাভাষীরাও জীবনানন্দের স্বাদ পেতো।