প্রতি মাসের শেষ বৃহস্পতিবার আমরা আমাদের দার্শনিক ক্ষুধা মেটানোর জন্য যে বচসায় বসি, তার নাম ‘মেইকিং মাইন্ড রিডিং গ্রুপ’। আমরা কয়েকজন কম্পিউটার বিজ্ঞান এবং মনোবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র, পিডিএফ (পোস্ট ডক্টরাল ফেলো) এবং প্রফেসর মিলে কোনো একটি বই ধার্য করি পড়ার জন্য।

আজ শুক্রবার, আজ আমাদের বিশেষ সভা। একটি বই, যার উপর গত মাসে আলোচনা হয়ে গেছে (এবং আমি বিশেষ কারণে সে আলোচনায় অংশগ্রহণ করিনি), আজ আলোচনা হবে কিভাবে সে বইটির ধারণাগুলো আমাদের কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার গবেষণায় সাহায্য করতে পারে।

বইয়ের নাম – ‘দ্য মেইটিং মাইন্ড: হাউ সেক্সুঅল চয়েস শেইপ্ড দ্য ইভলুশন অব হিউম্যান নেচার’ (বলা যায়, সঙ্গমোদ্যত মন বা যৌন নির্বাচন দ্বারা চালিত মানবিক বিবর্তন)। লেখক জেফরি মিলার, বিবর্তনতাত্ত্বিক মনোবিজ্ঞানী। আগেই বলে রাখছি, বইটির কোনো সমালোচনা এখানে লিখছি না। সেটা করতে হলে বইটি আগে ভালো করে পড়তে হবে। কিন্তু প্রথম থেকেই আমি বইটি পড়তে চাই নি। বইটির বক্তব্য, এমন নয় যে আমার বিশ্বাস হয় নি, তবে বই আকারে পড়ার মতো আনন্দদায়ক মনে হয় নি।

সঙ্গমোদ্যত মন বা যৌন নির্বাচন দ্বারা চালিত মানবিক বিবর্তন
বইটির ধারণাটি আপাতদৃষ্টিতে অনেকটা এরকম – আমাদের চারপাশের অনেককিছুর বিবর্তনগত ব্যাখ্যায় আমরা সচরাচর প্রাকৃতিক নির্বাচনের দ্বারস্থ হই। প্রাকৃতিক নির্বাচন টিকে থাকতে সাহায্য করে এমন সব বৈশিষ্টগুলোকে প্রাধান্য দেয়। কিন্তু আমরা প্রাণীকূলে অনেক উদাহরণ পেয়ে থাকি যেগুলোকে দৃশ্যত টিকে থাকতে সহায়ক বৈশিষ্ট্য বলা যায় না। যেমন ময়ূরের পেখম। ময়ূরের পেখম ময়ূরকে টিকে থাকতে কিভাবে সাহায্য করতে পারে তা স্পষ্ট নয়। বরং, এতো বড় পুচ্ছ নিয়ে চলাফেরা করা ময়ূরের জন্য কষ্টকর। তার বর্ণীল এই পালকরাজি শিকারিকেও অতি সহজে আকৃষ্ট করতে পারে।

তথাপি, ময়ূরের মাঝে এই বৈশিষ্ট্য বিবর্তিত হয়েছে। এর ব্যাখ্যা হলো বিবর্তনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চালক – যৌন নির্বাচন। প্রকৃতপক্ষে, ময়ূরের বিস্তৃত পালকরাজির প্রতি ময়ূরীর রয়েছে বিশেষ দূর্বলতা। যে ময়ূরের পেখম ময়ূরীর চোখে যত সুন্দর, তাকে যৌনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। ফলে আমরা ময়ূরের মাঝে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে বৈশিষ্ট্যটি দেখতে পাই, তা টিকে থাকতে সহায়ক কোনো বৈশিষ্ট্য নয়, বরং তা হলো সঙ্গী বিচারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানদন্ড।

তবে, যৌন নির্বাচনের ধারণা নতুন নয়। বিবর্তনতত্ত্বের জনক স্বয়ং ডারউইন এই ধারণা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। তাহলে মিলার সাহেব নতুন কি উপস্থাপন করতে চাচ্ছেন? তিনি বলতে চাচ্ছেন, মানুষ এবং মানব-সভ্যতার অনেক বৈশিষ্ট্য, যেমন – কবিতা, চিত্রকর্ম, নৈতিকতা, ধর্ম, এগুলোর ব্যাখ্যায় প্রাকৃতিক নির্বাচন দুর্বল। টিকে থাকতে এগুলো কিভাবে সাহায্য করে সে ব্যাখ্যা দিতে গেলে তা অনেকটা জোর করে চাপানো মনে হয়। তাই আজকাল এই ধারণার চল হয়েছে যে, মানুষের বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক এই অজস্র বৈশিষ্ট্য আসলে উপজাতমাত্র, অর্থাৎ ফাও হিসেবে এসেছে। অনেকটা দেয়ালচিত্রের মতো। মানুষের চিত্রকর্মের জন্য দেয়াল তৈরী হয় না। চিত্রকর্ম না থাকলেও দেয়ালগুলো থাকতে। সম্পূর্ণ ভিন্ন উদ্দেশ্যে তৈরী দেয়ালে নেহায়েত জায়গা রয়েছে বলে অতিরিক্ত হিসেবে স্থান করে নিয়েছে চিত্রকর্ম।

মিলার সাহেব বলছেন, মানুষের এত গুরুত্বপূর্ণ, পরিচায়ক বৈশিষ্ট্যগুলোকে কেবল উপজাত হিসেবে চালিয়ে দেয়াটা একটি দুর্বল ব্যাখ্যা। তিনি বলতে চাচ্ছে, আমরা এগুলোর ব্যাখ্যায় যৌন নির্বাচনের দারস্থ হতে পারি। কবি কবিতা এজন্য লেখে না যে কবিতাবোধ তার পূর্বপুরুষের মস্তিষ্কে দেয়ালচিত্রের মতো শৈল্পিক অতিরিক্ত হিসেবে জায়গা করে নিয়েছিলো। বরং একারণে লিখে যে মানুষ সঙ্গী হিসেবে কাব্যরসিককে অধিকতর পছন্দ করে।

আমি বহুদিন যাবত উপজাত তত্ত্বের প্রতি অনুরক্ত। কিন্তু যৌন নির্বাচনগত ব্যাখ্যা আমার কাছে আরো মোক্ষম মনে হয়েছে। তবে বই জুড়ে পাতার পর পাতা যৌন নির্বাচনের সপক্ষে প্রমাণ আর দীর্ঘ বর্ণনা থাকার সম্ভাবনার কথা চিন্তা করতেই আমার কাছে বইটি পড়ার ব্যাপারটি বিরক্তিকর ঠেকলো। আর নতুন খেলনা পেলে শিশু যেমন করে, নতুন পাওয়া ধারণা নিয়ে দার্শনিকরাও অনেকটা তেমনই করেন। তখন ক্ষণিকের জন্য জগতটা ওটাকে ঘিরে প্রদক্ষিণ করতে থাকে। সকল কিছুই ওই খেলনা দিয়ে রাজত্ব করতে চায় সে। অন্তত এমন অভিজ্ঞতা আমার আগে হয়েছে বেশ কিছু বই পড়তে গিয়ে। তাই আমি সন্দেহ করেছি, মিলার সাহেবও যৌন নির্বাচনের ধারণাটা এক এক করে মানুষের সকল জটিল আচার আচরণ ও বৈশিষ্ট্যের ব্যাখ্যায় ব্যবহার করে থাকবেন বই জুড়ে। মানুষের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মের পেছনে সঙ্গম করতে চাওয়ার প্রেরণা দেখতে পাওয়াটা আমার কাছে যথেষ্ট বিরক্তিকর হবে ভেবে বইটি পড়া থেকে বিরত থেকেছি।

কিন্তু টনক নড়ে গেলো, যখন ইমেইল এলো যে, ডেইল বইটির ধারণাগুলো কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার প্রজেক্টগুলোতে প্রয়োগ করার উপায় নিয়ে চিন্তা করছেন এবং এ নিয়ে আমাদের সাথে আলোচনা করতে চান। ডেইলই বইটি পড়ার প্রথম প্রস্তাব করেছিলেন। ডেইল কম্পিউটার বিজ্ঞানের প্রফেসর। মূলত একজন গণিতবিদ। বইটি পড়ার সময় ওনার স্ত্রী ব্যাপক কৌতুহল এবং উৎকন্ঠা নিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, ‘মেইটিং মাইন্ড’ বইটি কি নিয়ে? তিনি নানা উপায়ে ব্যাখ্যা করে তার স্ত্রীর উৎকন্ঠা দূর করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

পাঠসভা
ডেইল যখন বইটি পড়ার জন্য আমাদের কাছে বিজ্ঞাপন করছিলেন, তখন বুঝতে পারিনি তিনি যে বইটির ধারণাগুলো কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার প্রজেক্টে প্রয়োগ করার পরিকল্পনা করবেন। তাই যে বইখানা পড়তে চাই নি, সেটাই এখন লাইব্রেরি থেকে নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়া শুরু করতে হলে। কিন্তু বইটি ইস্যু করেছি সভার একদিন আগে, অন্যান্য কাজের চাপে কয়েক পাতার বেশি পড়া হলো না। তথাপি, সভায় বসতে সমস্যা হলো না। আমার পূর্বধারণা মতই, সব আলোচনা আমার বোঝার মধ্য দিয়েই গেলো।

ডেইল বইটি পরে যে রীতিমতো আলোড়িত বোঝা যাচ্ছে। মানুষের এতসব সৃষ্টিশীলতার যে গুরুভার জন্মস্থান মস্তিষ্ক, তা নিতান্তই টিকে থাকার তাগিদে গড়ে উঠেছে মেনে নেয়া কঠিন। প্রাকৃতিক নির্বাচন সে তুলনায় অনেক ধীর গতির। জৈবিক বিবর্তন (বিশেষত প্রাকৃতিক নির্বাচন) দ্বারা অনুপ্রাণিত – জেনেটিক এলগরিদম যা কম্পিউটার বিজ্ঞানে অপ্টিমাইজেসন সমস্যায় (এমন সমস্যা যেখানে প্রণালীবদ্ধভাবে বিভিন্ন ইনপুট মান প্রদান করে কোনো বিশেষ গাণিতিক ফাংশনের কাঙ্খিত, যেমন – সর্বোচ্চ বা সর্বনিম্ন, আউটপুট মান পাবার চেষ্টা করা হয়) ব্যবহৃত হয়। এটির ব্যবহারেও দেখা যায়, খুটিনাটি চাল ব্যবহার ছাড়া কোনো সমস্যা সমাধানে এটি কি পরিমাণ ধীরগতি হতে পারে।

জেনেটিক এলগরিদমে আমি বিশেষজ্ঞ নই। ব্যাচেলর থিসিসে নিউরাল নেটওয়ার্কের নিউরনের সংখ্যা এবং বিভিন্ন নিউরনের মাঝে যোগাযোগের মাত্রা নির্ধারণের জন্য জেনেটিক এলগরিদম ব্যবহার করেছিলাম। নিউরাল নেটওয়ার্কের এই ‘নেটওয়ার্ক’ গঠনের অন্যান্য উপায়গুলো ব্যাপকভাবে সীমাবদ্ধ। জেনেটিক এলগরিদমের কার্যপ্রণালী প্রকৃতি দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং অনেকটা গুঢ় দেখে অনেকের বিশ্বাস, হয়তো নিউরনের নেটওয়ার্ক গঠনে এটি জাদুর মতো চমৎকার কাজ করবে। তথাপি, নব্বইয়ের দশকে এর উপর যথেষ্ট চেষ্টা-চরিত্র করে বিজ্ঞানীরা ত্যক্ত। জেনেটিক এলগরিদমকে নতুন একটি উপায়ে প্রয়োগ করতে গিয়ে আমিও সমর্থ হয়েছিলাম তাদের সেই বিরক্তি উপলব্ধি করতে।

ডেইল জেনেটিক এলগরিদমের উপর করেছিলেন তার মাস্টার্সের থিসিস। তার বিরক্তি তাই আমার চেয়েও ঢের বেশি। বইটি পড়ে তিনি এখন পুনরুজ্জীবিত। মানুষের এই বিশাল মস্তিষ্ক এতো দ্রুত বিবর্তিত হবার ব্যাখ্যা তিনি খুঁজে পেয়েছেন যৌন নির্বাচনে। তিনি ভাবছেন বিবর্তনে সঙ্গীর সাথে সংগম টিকে থাকার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর এটা তিনি রীতিমতো সিমুলেশন করে সাক্ষ্যপ্রমাণ নিয়ে আজকের সভায় হাজির হয়েছেন।

সিমুলেশন এ তিনি দু’ ধরণের জেনেটিক এলগরিদম ব্যবহার করেছেন। একটিতে সঙ্গী বাছাই হয় সত্তার টিকে থাকার ক্ষমতাকে বিচার করে, আর অন্যটিতে তা করা হয় সত্তার সঙ্গী বাছাইয়ের নিজস্ব পছন্দের সাথে অন্য সত্তার কতটা মিল, তার ভিত্তিতে। অর্থাৎ একটিতে ব্যবহৃত হয়েছে প্রাকৃতিক নির্বাচন, আর অন্যটিতে যৌন নির্বাচন। তিনি দুটিকে তুলনা করেছেন, একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রজন্মের পর প্রথম প্রজন্মের থেকে শেষ প্রজন্মটি কতটা বিচিত্র, সেই মাপকাঠিতে। প্রতিটি সত্তাকে একেকটি বিটশ্রেণী দ্বারা প্রতিনিধিত্ব করায় বৈচিত্র্য পরিমাপ তেমন কঠিন কোনো ব্যাপার হয় নি।

ফলাফল হলো, প্রাকৃতিক নির্বাচনের তুলনায় ‘রান এওয়ে প্রসেস’ – যৌন নির্বাচন দ্বারা চালিত জেনেটিক এলগরিদমটির বৈচিত্র্য অতিরিক্ত রকম বেশি! অর্থাৎ যৌন নির্বাচন বিবর্তনকে অধিক গতিশীল করেছে।

ডেইল আলোড়িত, ডেইল উদ্বেলিত। ধীরগতির জেনেটিক এলগরিদমের কাঙ্ক্ষিত সেই গতি পাওয়া গেছে, জৈবিক বিবর্তনের অনেক প্রশ্নের উত্তরও তার কাছে এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তার আনন্দ এবং উৎসাহে আমরাও আনন্দিত। এমন আনন্দ দেখতেও ভালো লাগে। আমি ভাবলাম, আমাদের বুদ্ধিমত্তা বিবর্তিত হবার পেছনে যৌন নির্বাচনের দান সর্বাধিক এমন ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, এখন কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা তৈরিতে সে হাতিয়ার কিভাবে কাজে লাগানো যায় সেদিকে তিনি ইঙ্গিত দিবেন। অন্তত সভার আলোচ্যসূচি তাই ছিলো। কিন্তু সবার বিস্ময়ের খোরাক হয়ে তিনি ব্যাপারটাকে নিয়ে গেলেন অন্য মাত্রায়।

তিনি দাবি করতে থাকলেন, বিজ্ঞানীদের ‘নিরপেক্ষ’ গবেষণাও চটকদার কিছু করার প্রেরণা বা ‘কুল ফ্যাক্টর’ দ্বারা চালিত হয়। এবং হয়তো, অনেক সৃষ্টিশীলতার প্রেরণা বা উৎস এই রান এওয়ে প্রসেস থেকেই আসে, যা নিরাবেগ গবেষণা থেকে আসা হয়তো অসম্ভব। এবং তার কথাবার্তায় মনে হলো তিনি যেনো আমাদের অনেকটা ফ্যাশন সচেতন হয়ে সৃষ্টিশীলতার সম্ভাবনা বাড়ানোর প্রস্তাব দিলেন এবং অনেকটাই ব্যাপারটা নিয়ে বিভ্রান্ত থাকলেন।

একে একে অন্যরা তার সপক্ষে বলা শুরু করলেন। একজন পিডিএফ বললেন, ডেইলের সিমুলেশন থেকে আমরা যেমনটা সাক্ষ্যপ্রমাণ পাচ্ছি, তাতে এমন বলাটা খুব ভুল হবে না যে, বিবর্তন যেহেতু যৌন নির্বাচন ব্যবহার করে এতটা কৃতকার্য হয়েছে, আমরাও আমাদের বিভিন্ন লক্ষ্যে এর ব্যবহার করতে পারি। আর ‘জটিল লাগছে’ এমন জিনিসের প্রতি দুর্বলতা দ্বারা প্রভাবিত হওয়াটা বিজ্ঞানীদের মাঝে অসম্ভব নয়। একজন গণিতবিদের প্রেরণার একটি অংশও হতেই পারে এটা বলতে পারা যে, ‘তোমার সমীকরণ আমারটার চেয়ে ছোট!’

আহ, কোথায় যাই, কেবল ফ্রয়েডকে নাম ধরে কীর্তন করা বাকি!

বীরের আগমন
রিচার্ড এতক্ষণ নীরব ছিলেন। মহামতি রিচার্ড হলেন থমকে যাওয়া কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার গবেষণায় সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল চিন্তাচেতনাগুলোর নায়ক। এবার তিনি সরব হলেন ডেইলকে বিরোধিতা করে। বললেন, ‘তোমরা যেটা করছো, এটাকে বলে প্রকৃতিবাদী প্রমাদ বা ন্যাচারালিস্টিক ফ্যালাসি। প্রকৃতি কোনো কিছু যেভাবে করছে, সেটাকেই যখন কোনো কিছু করার উত্তম উপায় বলে বিশ্বাস করা হয়, তখন তাকে বলে প্রকৃতিবাদী প্রমাদ। আর তোমরা সেটা করছ।’

হুমম, প্রকৃতি যেটা করছে, সেটাই ভালো-মন্দের ধ্রুব মানদন্ড নাও হতে পারে। কিন্তু, রিচ কি বলতে চাচ্ছে প্রকৃতি বা বিবর্তন সবচেয়ে উত্তম উপায়টি অবলম্বন করছে না? এই প্রশ্ন করায় রিচ উত্তর করলেন, প্রশ্নটা ভালোর নয়। ভালো-মন্দ আপেক্ষিক, নির্ভর করে লক্ষ্যের উপর। আর লক্ষ্য একটি স্বাধীন চলক। আমার লক্ষ্য বা আমার গবেষণার লক্ষ্যে বিবর্তনের লক্ষ্যের হিস্যা থাকাটা জরুরি নয়।

আমি বললাম, ‘কিন্তু আমাদের মানসিকতাটা অনেকটা এরকম, আমরা যেহেতু বিবর্তনের ফল, বিজ্ঞান যেহেতু বিবর্তনের ফসল, আমাদের কিংবা বিজ্ঞানের লক্ষ্য তাই সমীকৃত হওয়া উচিত বিবর্তনের সাথে।’

‘এবং এটাই প্রমাদ।’ রিচ বললেন। ‘লক্ষ্য একটি স্বাধীন চলক। আমার লক্ষ্য তোমার চেয়ে ভিন্ন। এবং আমরা আমাদের লক্ষ্য পরিবর্তন করতে পারি। এবং তা অর্জন করতে পারি। আর আমাদের নিজস্ব লক্ষ্য অর্জনের প্রচেষ্টা পারে প্রকৃতির আপাত প্রতীয়মান ‘লক্ষ্যের’ গতিপথকে পরিবর্তিত করতে।’

আমরা কৃত্তিম মন তৈরী করতে চাই। মনের বৈশিষ্ট্য হলো তার লক্ষ্য থাকে, যা সে পরিবর্তন করতে পারে। কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা তৈরির এই অভিযাত্রায় আমাদের সফলতার মাপকাঠি হলো এমন একটি প্রোগ্রাম লিখতে পারা, যা প্রদত্ত যেকোনো লক্ষ্যবস্তু অর্জনের চেষ্টায় আনাড়ি থেকে দক্ষ হয়ে উঠতে পারে। এখন সে লক্ষ্য বিবর্তনের লক্ষ্যের সাথে সমীকৃত হওয়াটা জরুরি নয়!

‘লক্ষ্যের সাথে বুদ্ধিমত্তার সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক তা অর্জনের ক্ষমতার সাথে। লক্ষ্য যে কোনো কিছু হতে পারে।’ সভা সমাপ্তির ইংগিত-সূচকভাবে হেসে রিচ বললেন, ‘আমি তো বারবার বলেছি, লক্ষ্য একটি স্বাধীন চলক।’

তবে সভা তখনি শেষ হয়ে যায় নি। ডেইলের শেষ উৎসাহটুকু চুপসে যাওয়া দেখা পর্যন্ত সভা চলেছে। আবার নতুন করে চিন্তা করার শপথ নিয়ে সভা শেষ করেছেন ডেইল। আর রিচার্ড সভাঘর ছেড়েছেন সম্ভবত এ বিষয় নিয়ে আর চিন্তা না করার শপথ নিয়ে।