ঈশ্বর কী আছে? ক্রেইগ-ফ্লু বিতর্ক

 

ফরিদ আহমেদ

 

পর্ব

 

পর্ব

 

প্রফেসর ক্রেইগের সূচনা বক্তব্যের বাকী অংশ

 

 

. মানব সমাজের নৈর্ব্যক্তিক নৈতিক মূল্যবোধ

 

অনেক আস্তিক এবং নাস্তিক এই বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, ঈশ্বর না থাকলে মানুষের নৈর্ব্যক্তিক নৈতিক মূল্যবোধও থাকতো না।  রাসেল যেমন বলেছেন,

 

ব্যক্তির নৈতিকতা তৈরি হয় তার উপর সম্প্রদায়ের চাপ থেকে। মানুষ……..সবসময় সহজাতভাবে উপলব্ধি করে না যে কোনটা তার সমাজের জন্য উপকারী। ব্যক্তি স্বার্থপরভাবে কাজ করতে পারে এই দুঃশ্চিন্তা থেকেই সমাজ মূলত ব্যক্তির স্বার্থকে সমাজের স্বার্থের সাথে সুগ্রন্থিত করার জন্য অসংখ্য পদক্ষেপ উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে একটা হচ্ছে………নৈতিকতা।

 

ইউনিভার্সিটি অব গুয়েলফ এর দার্শনিক বিজ্ঞানী মাইকেল রুজ (Michael Ruse) রাসেলের বক্তব্যের সাথে একমত হয়েছেন। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন এভাবেঃ

 

হাত, পা বা দাঁতের চেয়ে নৈতিকতা কম জৈবিক অভিযোজন নয়………। নৈতিকতাকে নৈর্ব্যক্তিক ভাবাটা পুরোপুরিই অলীক ভাবনা……….। কেউ যখন বলে যে, প্রতিবেশীকে নিজের মত করেই ভালবাসো আমি তখন তাকে বাহবা দেই। তারা মনে করে যে, তারা নিজেদের সীমারেখার উর্ধ্বে উঠতে পেরেছে………তা সত্ত্বেও………..ওই ধরনের বক্তব্য সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। নৈতিকতা শুধুমাত্র অস্তিত্ব বজায় রাখা এবং বংশবৃদ্ধির একটা সহায়ক শক্তি মাত্র………নৈতিকতার এর চেয়ে বেশি অন্য কোন অর্থ খুঁজতে যাওয়া বিভ্রম ছাড়া আর কিছু নয়………..

 

ঈশ্বরের মৃত্যু ঘোষণাকারী ঊনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত নাস্তিক ফ্রিয়েড্রিক নিৎশে ( Friedrich Nietzsche) উপলব্ধি করেছিলেন যে, ঈশ্বরের মৃত্যু মানে জীবনের সব অর্থ এবং মূল্যবোধের ধ্বংস। আমি মনে করি যে, ফ্রিয়েড্রিক নিৎশে  তার এই ধারণাঅভ্রান্ত ছিলেন।

 

আমাদের এখানে অবশ্য খুব খেয়াল করা প্রয়োজন  নৈতিক জীবন যাপনের জন্য আমাদেরকে কি অবশ্যই ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে হবে? বিষয়টা এখানে কিন্তু সেরকম না।  আমি বলছি না যে, তা করতে হবে। আমরা কি ঈশ্বরে বিশ্বাস না করে নৈতিক মূল্যবোধকে স্বীকৃতি দিতে পারি? প্রশ্ন সেটাও না। আমি মনে করি যে, আমরা তা পারি। বরং প্রশ্ন হচ্ছে যে, ঈশ্বর যদি না থাকতো তবে সেক্ষেত্রে নৈতিক মূল্যবোধ বলে আদৌ কিছু থাকতো কিনা?

 

রাসেল এবং রুজের মত আমিও ভাবার কোন কারণ দেখি না যে, ঈশ্বরের অনুপস্থিতিতে মানুষের তৈরি সামাজিক নৈতিকতা নৈর্ব্যক্তিক হত। ঈশ্বর যদি নাই থাকে তাহলে আর মানুষের বিশেষ গুরুত্ব বলে কি কিছু থাকে? বৈরী এবং চৈতন্যহীন মহাবিশ্বের কোথাও হারিয়ে যাওয়া ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধূলিকণা থেকে প্রাকৃতিক দূর্ঘটনার উপজাত হিসাবে তুলনামূলকভাবে অতিসম্প্রতি বিকাশ হয়েছে মানুষের। এবং খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগতভাবে তারা বিলোপ হয়ে যাবে। নাস্তিকতার দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছু কার্যকলাপ যেমন ধরুন ধর্ষণ- সামাজিকভাবে উপকারক নয় বিধায় মানব সমাজ বিকাশের সাথে সাথে নিষিদ্ধ হিসাবে গন্য হয়েছে। কিন্তু এতে প্রমাণ হয় না যে, ধর্ষণ আসলেই অন্যায় কিছু। নাস্তিকতার দৃষ্টিতে আপনি কাউকে ধর্ষণ করলেও সেটা অনৈতিক নয়। কাজেই, আমাদের বিবেকের উপর চেপে বসা চরম ন্যায় বা অন্যায় বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব ঈশ্বর ছাড়া হতে পারে না। 

 

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, নৈর্ব্যক্তিক মূল্যবোধ আমাদের সমাজে বিদ্যমান রয়েছে এবং আমি বিশ্বাস করি, অন্তরের গভীর থেকেই আমরা সবাই সেটা জানি। বস্তুজগতের নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতার চেয়ে মূল্যবোধের নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করার খুব বেশি কারণ নেই। ধর্ষণ, নিষ্ঠুরতা, শিশু নির্যাতন শুধুমাত্র সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য আচরণই নয়। এগুলো নৈতিকভাবে ঘৃণ্য কাজ। কিছু কিছু জিনিষ সত্যি সত্যিই অন্যায়। একইভাবে, ভালবাসা, সমতা এবং আত্মত্যাগ সত্যি সত্যিই মহৎ কাজ।

 

তৃতীয় বিবেচনাকে আমরা নিম্নোক্তভাবে সারসংক্ষেপ করতে পারিঃ

 

1. ঈশ্বরের অস্তিত্ব না থাকলে নৈর্ব্যক্তিক মূল্যবোধও থাকতে পারে না।

2. মানব সমাজে নৈর্ব্যক্তিক মূল্যবোধ রয়েছে।

3. কাজেই ঈশ্বরেরও অস্তিত্ব রয়েছে।

 

. যীশুর জীবন, মৃত্যু এবং পুনরুত্থানের বিষয়ে কিছু ঐতিহাসিক তথ্যঃ

 

ঐতিহাসিক চরিত্র নাজারেথের যীশু ছিলেন অসামান্য ব্যক্তি। নিউ টেস্টামেন্টের সমালোচকরা একমত হয়েছেন যে, ঐতিহাসিক চরিত্র যীশু দৃশ্যপটে হাজির হয়েছিলেন নজীরবিহীন স্বর্গীয় ক্ষমতা নিয়ে ঈশ্বরের অবস্থানে দাঁড়িয়েছিলেন প্রবল ক্ষমতা নিয়ে। তিনি দাবি করেছিলেন যে, তার মধ্যেই ঈশ্বর রাজ্য উপস্থিত হয়েছে এবং তার দৃশ্যমান প্রমাণস্বরূপ তিনি অসংখ্য অলোকিক ঘটনা ঘটিয়েছেন এবং বহু নিরাময় সাধন করেছেন। তবে এ সমস্ত অলৌকিক ঘটনাসমূহ নয় বরং তার দাবির স্বপক্ষের সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে মৃত্যুর পর তার ফিরে আসা বা পুনরুত্থান। যদি যীশুর পুনরুত্থান সত্যি ঘটে থাকে তবে সেটা একটা অসাধারণ অলৌকিক ঘটনা এবং এই অলৌকিক ঘটনাই হচ্ছে ঈশ্বরের অস্তিত্ব থাকার প্রমাণ।

 

যদিও বেশিরভাগ লোকই মনে করে থাকেন যে, যীশুর পুনরুত্থানকে ধর্মীয় বিশ্বাস থেকেই বিশ্বাস করতে হবে বা করতে হবে না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, বেশিরভাগ নিউ টেস্টামেন্ট ঐতিহাসিকদের দ্বারা স্বীকৃত তিনটা প্রতিষ্ঠিত প্রমাণ রয়েছে এর স্বপক্ষে। আমি মনে করি এগুলো যীশুর পুনরুত্থানকে খুব ভালভাবে ব্যাখ্যা করেছে।

 

·        প্রমাণ:  যীশুর ক্রুশবিদ্ধের পর রোববারে একদল মহিলা দেখতে পান যে তার সমাধি খালি পড়ে আছে। পুনরুত্থানের উপর বিশেষজ্ঞ অস্ট্রিয়ান পণ্ডিত জ্যাকব ক্রেমারের ( Jacob Kremer) মতে, এখন পর্যন্ত বেশিরভাগ পন্ডিতেরা বাইবেলে বর্ণিত খালি সমাধির বিশ্বাসযোগ্যতাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থণ করেন

·        প্রমাণ: মৃত্যুর পর ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি এবং দলের লোকেরা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে যীশুকে জীবিত অবস্থায় দেখেছেন। প্রখ্যাত নিউ টেস্টামেন্ট সমালোচক জার্মান গার্ড লুডেম্যানের ( Gerd Ludemann ) মতে, এটাকে ঐতিহাসিক সত্য বলেই মেনে নিতে হবে যে……… যীশুর মৃত্যুর পর তার অনুসারীরা তার দেখা পেয়েছে যেখানে তিনি পুনরুত্থিত খ্রীষ্ট হিসাবে তাদের সামনে এসেছেন। যীশুর এই পুনরুত্থান শুধু বিশ্বাসীরাই দেখেছে তা কিন্তু নয়। অবিশ্বাসী, সংশয়বাদী এবং তার শত্রুরাও তা অবলোকন করেছে

·        প্রমাণ: আদি অনুসারীরা হঠা করেই যীশুর পুনরুত্থানে বিশ্বাসী হয়ে উঠলো যদিও এ সংক্রান্ত তাদের পূর্ববিশ্বাস সম্পূর্ণ বিপরীত ধরনের ছিল। মুসার পুনরুত্থান তো দূরের কথা তার মৃত্যুতেও বিশ্বাস নেই ইহুদীদের। ইহুদীদের পরলোকে বিশ্বাস কেয়ামতের আগে কারো পুনরুত্থানের সব উপায়কে বাতিল করে দেয়। তা সত্ত্বেও আদি অনুসারীরা হঠা করেই যীশুর পুনরুত্থানে এমনই শক্তিশালীভাবে বিশ্বাস স্থাপন করে যে, সেই বিশ্বাসের জন্য মৃত্যুকে বেছে নিতেও তারা ইচ্ছুক ছিল। নিউ টেস্টামেন্টের পণ্ডিত ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের লিউক জনসন ( Luke Johnson ) বলেছেন যে, প্রাথমিক ক্রিশ্চিয়ানিটি আন্দোলন যে রকম ছিল তা তৈরি করার জন্য কোন ধরনের শক্তিশালী, রুপান্তরিক অভিজ্ঞতার প্রয়োজন ছিল  ব্রিটিশ পণ্ডিত এন, টি, রাইট ( N. T. Wright) উপসংহার টেনেছেন এভাবে, একারণেই একজন ঐতিহাসিক হিসাবে সমাধি খালি করে যীশুর পুনরুত্থান ছাড়া খ্রীষ্ট ধর্মের প্রারম্ভিক বিকাশকে কোনভাবেই ব্যাখ্যা করতে পারি না

 

. ঈশ্বরের মাঙ্গলিক উপস্থিতি

 

এটা আসলে ঈশ্বরের অস্তিত্বের স্বপক্ষের কোন যুক্তি না। বরং এই যুক্তি দাবী করে যে, আপনি ঈশ্বরের মাঙ্গলিক অভিজ্ঞতার ফলে যুক্তিতর্ককে একপাশে সরিয়ে রেখেই জেনে যেতে পারেন যে ঈশ্বর বিদ্যমান। এভাবেই বাইবেলের মানুষেরা ঈশ্বরকে জানতো। প্রফেসর জন হিক ( John Hick ) একে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবেঃ

 

তারা ঈশ্বরকে জানতো গতিশীল এক ইচ্ছাশক্তি হিসাবে যা তাদের নিজস্ব ইচ্ছাশক্তির সাথে মিথস্ক্রিয়া করতো। এই ইচ্ছাশক্তি ছিল নিদারুণ বাস্তবতা যাকে চিহ্নিত করা হত ধ্বংসাত্মক ঝড় এবং জীবন-প্রদানকারী রোদ্দুর হিসাবে………. তাদের কাছে ঈশ্বর মস্তিষ্কের গৃহীত কোন ধারণা ছিল না, বরং তা ছিল এক পরীক্ষামূলক বাস্তবতা যা তাদের জীবনকে করে তুলেছিল তাপর্যমণ্ডিত।

 

এটাই যদি ঘটনা হয়ে থাকে, তাহলে বলতেই হবে যে ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ ঈশ্বরের দিক থেকে আপনার মনযোগ সরিয়ে দেয়ার সমস্যা মধ্যে রয়ে গেছে। আপনি যদি আন্তরিকভাবে ঈশ্বরকে খুঁজে থাকেন, তাহলে ঈশ্বর নিজেই তার অস্তিত্বের প্রমাণ আপনার কাছে হাজির করবে। বাইবেল প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, ঈশ্বরের দিকে অগ্রসর হও, দেখবে ঈশ্বর তোমার আরো কাছে এসে দাঁড়াবে। বাইরের প্রমাণের দিকে আমরা এতো বেশি মনযোগ দেব না যে, যাতে করে আমাদের হৃদয়ের মাঝে ঈশ্বর যে কথা বলছেন তা শুনতে ব্যর্থ হবো। যারা সেই কণ্ঠ শুনতে পায় তাদের মনভূমিতে, তাদের জীবনে ঈশ্বর বাস্তবতা হয়ে আসে।

 

উপসংহারে বলবো যে, আমরা এমন কোন যুক্তিতর্ক পাইনি যা প্রমাণ করে যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই। বরং আমরা পাঁচটা যুক্তি দেখেছি যা থেকে বলতে পারি যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব রয়েছে। এই যুক্তিগুলো সম্মিলিতভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্বের স্বপক্ষে শক্তিশালী এবং সম্মিলিত সমর্থন গড়ে তোলে এবং সে কারণেই আমি মনে করি যে, আস্তিকতা নাস্তিকতার চেয়ে অধিকতর যুক্তিসঙ্গত বিশ্ব-দৃষ্টিভঙ্গি।