মাসুদ হাসান উজ্জ্বলের কফি হাউজ

নৃপেন্দ্র নাথ সরকার

 

মান্নাদের কফি হাউজের গান থেকে মাসুদ হাসানের ধারাবাহিক নাটক কফি হাউজ নাকি মাসুদ হাসানের কফি হাউজ নাটকে অনুপ্রানিত হয়েই মান্না দে কফি হাউজ গানটি গেয়েছেন? মান্নাদে এবং মাসুদ হাসানের সময়কাল সমন্ধে ধারনা না থাকলে দ্বিতীয়টিই ভাবা স্বাভাবিক হতে পারত। মান্নাদের বিখ্যাত গানটি এরকম

কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই

কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেল গুলো সেই।

নিখিলেশ প্যারিসে, মইদুল ঢাকাতে

নেই তারা আজ কোন খবরে।

গ্র্যান্ডের গিটারিস্ট গোয়ানিজ ডিসুজা

ঘুমিয়ে আছে যে আজ কবরে।

কাকে যেন ভালবেসে আঘাত পেয়ে যে শেষে

পাগলা গারদে আছে রমা রায়।

অমলটা ধূকছে দুরন্ত ক্যান্সারে

জীবন করেনি তাকে ক্ষমা হায়।

সুজাতাই আজ শুধু সব চেয়ে সুখে আছে

শুনেছি তো লাখপতি স্বামী তার

হীরে আর জহরেতে আগাগোরা মোড়া সে

গাড়ী বাড়ী সব কিছু দামী তার।

আর্ট কলেজের ছেলে নিখিলেশ স্যান্যাল

বিজ্ঞাপনের ছবি আঁকত

আর চোখ ভরা কথা নিয়ে নির্বাক শ্রোতা হয়ে

ডিসুজাটা বসে শুধু থাকত।

একটা টেবিলে সেই তিন চার ঘন্টা

চারমিনার ঠোটে চলত।

কখনো বিষনু দে, কখনো যামিণী রায়

এই নিয়ে তর্কটা চলত।

রোদ-ঝড় বৃস্টিতে যেখানেই যে থাকুক

কাজ সেরে ঠিক এসে জুটতাম।

চারটেতে শুরু করে জমিয়ে আড্ডা মেরে

সাড়ে সাতটায় ঠিক উঠতাম।

কবি কবি চেহারা কাঁধেতে ঝুলানো ব্যাগ

মুছে যাবে অমলের নামটা।

একটা কবিতা তার হল না কোথাও ছাপা

পেল না সে প্রতিভার দামটা।

অফিসের সোসালে ম্যানেজার নাটকে

রমা রায় অভিনয় করত।

কাগজের রিপোর্টার মইদুল এসে রোজ

কি লিখেছে এসে তাই তাই শুধু পড়ত।

সেই সাত জন নেই আজ

টেবিলটা তবু আছে সাত টপে আলা

আজও খালি নেই।

একই সেই বাগান আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি

শুধু সেই সেদিনের মালী নেই।

কত স্বপ্নের রোদ উঠে এই কফি হাউজে

কত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায়।

কত জন এলো গেলো কত জনই আসবে

কফি হাউজটা শুধু থেকে যায়।

 

মাসুদ হাসান উজ্জ্বল মাত্র ছয় মিনিটের গানটি নিয়ে ছাব্বিশ পর্বের একটি অসাধারন ধারাবাহিক নাটক সৃষ্টি করেছেন। ডঃ হুমায়ূন আজাদের একটি প্রবচন এরকম, “বিভূতিভূষনের পথের পাঁচালীর পাশে সত্যজিতের চলচ্চিত্রটি খুবই শোচনীয় বস্তু, ওটি তৈরী না হলেও ক্ষতি ছিলো না; কিন্তু বিভূতি ভূষন যদি পথের পাঁচালী না লিখতেন, তাহলে ক্ষতি হতো সভ্যতার।” বেঁচে থাকলে ডঃ আজাদ কফি হাউজ গান এবং নাটক সমন্ধে কি বলতেন জানিনা। নাটকটিকে ছোট করে নিশ্চয় কিছু বলতেন না। আমি জানি, মান্নাদের এটি একটি অসাধারন গান। যুগ যুগ ধরে মানুষ শুনছে। আরও শুনবে। আমার মত হয়ত কিছু লোক নাটকটি দেখেছে। টেলিভিশনের পর্দায় এসেছে; তারপর চলে গেছে। কেউ কোনদিনই হয়তো আর নতুন করে দেখবে না। বাটন টিপলেই গান শোনা যায়। কিন্তু মনে পড়লেই নাটক দেখা সম্ভব নয়। নানা রকম প্রস্তুতি পর্ব শেষে একটি নাটক দেখা যায়।

 

আমি মান্নাদের গানটিকে ছোট করতে চাই না। বরং নাটকটি দেখার পরে গানটির ভাবার্থ নতুন করে আবিষ্কার করতে সমর্থ হয়েছি। বারবারই মনে হচ্ছে, ছয় মিনিটে মান্নাদে যা বলে শেষ করতে পারেননি মাসুদ হাসান ছাব্বিশ পর্বে তা সম্পন্ন করেছেন। সম্পূর্ন করেননি। এটি মানব প্রজাতির গল্প। এর কোন শেষ নেই। মান্নাদে তাঁর সুর দিয়ে এই গল্পের ভাব দিয়েছেন আর মাসুদ হাসান নিপূণ হাতে এর রূপ দিয়েছেন।

 

বিভূতি ভূষন বন্দোপাধ্যায় পথের পাঁচালীতে মানব প্রজাতির জীবনবৃত্ত রচনা করেছেন; সত্যজিত রায় তাই চিত্রায়িত করে প্রশংসিত হয়েছেন। যে রেশমী কাপড় পরিধান করে আমরা আমাদের সৌন্দর্য বর্দ্ধন করি তার মূলে থাকে রেশম গুটি পোকা। এরা সারাজীবন দেহ নিঃসৃত রস দিয়ে সূতা কাটে। একদিন শিশু পোকার জন্ম দিয়ে এদের জীবন অবসান ঘটে। শিশু পোকাটিও সারা জীবন তাইই করে। প্রতিটি প্রানীর জীবনের একই খেলা এবং পরিণতি। মানুষের জীবনে আনন্দ আছে, বিষাদ আছে; আছে ভাল থাকার তাগিদ। সব শেষে আছে মৃত্যু। অনাদি কাল থেকে এই চক্রাকার খেলা চলছে। হাসান মাসুদ এই সত্যটি আরও সুন্দর করে চিত্রায়িত করেছেন তাঁর ছাব্বিশ পর্বের ‘কফি হাউজ’ নাটকে। হাল্কা করে দেখলে বাংলাদেশের ভাল নাটকগুলির মধ্যে এটি আর একটি অত্যন্ত ভাল সফল বিনোদনমুলক নাটক। একটু খেয়াল করলেই নাটকটি আমাদের জীবন সমন্ধে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করে। ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত আমরা সবাই একই নৌকার যাত্রী, কত কল্পনা, বিনিদ্র-রজনী, সফলতার জন্য রাত্রি-দিন কত প্রচেষ্টা। আসলে দুয়ে-দুয়ে চার মিলুক না মিলুক, সৃস্টির শুরু থেকে জীবন চলছে গুটি পোকার মত।

 

নাটকটি যেন শাখাওয়াত আল মামুনের “আজিজ মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা ১০০০” এর আদলে তৈরী। খানা-খন্দ, রাস্তা বা পার্কে ভাংগা জংলা, যত্র-তত্র সময়ে-অসময়ে যে যখন আসছে তখন তাকে নিয়েই নাটকের দৃশ্য চিত্রায়িত হয়েছে। মাসুদ হাসান কয়েকটি নতুন চরিত্র সংযোজন করেছেন। আড্ডার ফসল হিসেবে তরুন-তরুনীদের মনের গভীরে শাশ্বত অনুরাগের সৃষ্টি হয়েছে। সময় সময়ের মত চলেছে। অনুরাগে নতুন সমীকরণ যোগ হয়েছে। কফি হাউজের আড্ডায় ধ্বস নেমেছে। অমলের কবিতা কেউ ছাপল না। আয় নেই; আড্ডায় পেট ভরে না। রুগ্ন বাবার চিকিতসা হয় না। গাছতলায় মন দেয়া মেয়েটি একদিন নিখিলেশকে ছেড়ে চলে গেল। মন ভাল নেই। একদিন বৃত্তি নিয়ে নিখিলেশ পাড়ি জমাল প্যারিসে। রমার ছেলে বন্ধুটি ওকে প্রবঞ্চনা করল। ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্য হারাল। তারপর একদিন তার জায়গা হল পাগলা গারদে। ডিসুজার গীটারে মুগ্ধ বিস্ময়ে চোখে চোখ রেখে বসে থাকত সুজাতা। মা-বাবার চাপে বাবার বন্ধুকে বিয়ে করে একদিন অস্ট্রেলিয়া চলে গেল। দিন আসে, যায়। দুর্ঘটনায় একদিন ডিসুজ়ার অকাল মৃত্যু হল।

 

“হীরে আর জহরেতে আগাগোরা মোড়া সে” কিন্তু সুজাতার সমুদ্রের গভীর অন্তরে স্থায়ীভাবে বাস করে গিটারিষ্ট ডিসুজা। ছয় বছর পরে দেশে একদিন বেড়াতে এল সুজাতা। গাছ তলায় প্রেম করা আর ছবি আঁকা সব আগের মতই চলছে। শুধু নেই নিখিলেশ, ডিসুজা আর সুজাতা। সুজাতার এখানে কোন স্থান নেই। কেউ তাকে চেনে না। গাছের দিকে, পাতার দিকে নিমিলেশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। নতুন ছেলেমেয়েদের আসা যাওয়া দেখে। পা টেনে টেনে এক সময় কফি হাউজে প্রবেশ করে। টেবিলটায় আড্ডা চলছে। সুজাতা এদের কাউকে চেনে না। কেউ তাকে বসতে বলে না। রতন ওকে চিনতে পারে্। রতনই সুজাতাকে বলে, ডিসুজা মামা আর নেই। সুজাতার ভিতর জগতটা হু হু করে কেঁদে উঠে। কিন্তু চোখে এক ফোটা জল নেই।

 

বেশীর ভাগ অভিনেতা-অভিনেত্রীই নতুন। অথচ এদের অভিনয় নৈপূণ্য অসাধারন। মনে হয় না যে এরা কেউ অভিনয় করছে। সব মিলিয়ে মনে হয় যেন খন্ড খন্ড চিত্র এক সাথে গাথা একটি সত্য ঘটনা। আসলে মাসুদ হাসান কি নাট্যকার নাকি শুধুই মূল ভাবনাকারী এবং পরিচালক। নতুন প্রজন্মের এই সব দক্ষ শিল্পীরা বার বার প্রমান করছে তারাই যেন আসল নাট্যকার। অনেক গুলো নাট্যকার মিলেই যেন একটি নাটকের তৈরী।

 

দেবদাস উপন্যাসের প্রথম চলচ্চিত্র উদবোধনী অনুষ্ঠানে শরতবাবু আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। আবেগ-আপ্লুত হয়ে পরিচালককে বলেছিলেন, “আমি যা করতে পারিনি, আপনি তা করেছেন।” আমার জানতে ইচ্ছে করে, মাসুদ হাসানের কফি হাউজ দেখে মান্না দের অভিব্যক্তি। মাসুদ হাসান আপনাকে আমার নমস্কার।

 

স্বাধীনতা-পূর্ব এবং পরবর্তী আন্দোলন মিলিয়ে দীর্ঘ আট বছর লাগে আন্ডার-গ্র্যাডুয়েট ডিগ্রী শেষ করতে। তাস খেলা আর আড্ডার ফাঁকে পড়াশুনা। দীর্ঘ আট বছর। একদিন ছাত্রাবাস ছেড়ে চলে যেতে হবে কেউ ভাবতাম না। ননীগোপাল, হরিপদরা একে একে চাকুরী নিয়ে চলে গেল। বোধগম্য হয়নি যে এরা চিরদিনের জন্যই চলে গেল। দুদিনের জন্য বাড়িতে গেছে আর কি! নীচের ক্লাশের ছাত্ররা রুম গুলো একে একে দখল করে নিল। দীর্ঘ বছর পরে, ২০০৭ সালে বাংলাদেশ কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ে নেমেই নিয়ে ঈশা খান হলে যাই। সাথে আমার ২১ বছরের ছেলে। লোহার গেটের সুড়ংগ দিয়ে মাথা ও পা ঢুকিয়ে হলে প্রবেশ করলাম। ইট-কাঠ ছাড়া আগের আর কিছুই নেই। প্রতিটি রুমের নাম করন হয়েছে – পদ্মা, যমুনা, মেঘনা। হলের পিয়নটা আমাকে চিনতে পারল। সাথে সাথে নামটাও আমার মনে পড়ল। জয়নাল। তখন সে কাগজ বিলি করত। কোলাকুলি বিনিময় হল। জয়নালের চোখ অশ্রুশিক্ত মনে হল। ছাত্রদের ফ্লোরফিস্ট হচ্ছে। জয়নালের সাথে কোলাকলি করতে দেখে ছেলে গুলো অবাক। চোখ-কান খাড়া করে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষন। আমি ওদের সাথে কথা বললাম। ফিস্ট বাদ দিয়ে ওরা আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ১৬ নম্বর রুমের নাম হয়েছে – যমুনা। জানলা দিয়ে বাইরে তাঁকিয়ে থাকলাম। খেলার মাঠ, তারপর ব্রহ্মপুত্র নদের ঢাল ঘেঁসে আগের সেই কাঁচা বাড়ী, তারপর বালুচর, দুরে নদের গভীরে আঁকাবাঁকা খানিকটা জলের ধারা। জানালা দিয়ে এখনও চড়ুই পাখি ঢুকে; ঘুলঘুলিতে বাসা বেঁধে এখনও আগের মত বিরক্ত করে। আমার সিটটিতে বসে ছেলেকে নিয়ে ছবি তুললাম। তোষকের নীচে তক্তা ছিদ্র করে একটি বেড সুইচ বসিয়েছিলাম। দেখতে চাইলাম। কিন্তু সেই ছিদ্রটি নেই। এটি আমার সেই খাটটি নয়। এই রুমে আমার কোন স্থান নেই। ছেলে গুলো নেহাতই ভাল, তাই ঢুকতে দিয়েছে। না দিলেও আমার কিছু করার ছিল না।

 

পরে এবছর ১লা জানুয়ারী, ২০০৯, ঢাকাতে নিতাইর বাসায় মিলনসভা হল। ননীগোপাল, হরিপদরা এল। কারও এক মাস চাকুরী আছে, কেউবা অবসরে। অনেককেই সনাক্ত করতে পারিনি। নতুন করে পুরানদের সাথে পরিচয় হল। জয়নালের মত অনেকেরই চোখ অশ্রুশিক্ত হল।

 

শরতবাবুর দেবদাস বারবার চিত্রায়িত হয়েছে নতুন রূপে। পাত্রপাত্রী বদলেছে। গল্প বদলায়নি। আমরা হারিয়ে যাই। নতুনরা আসে। গল্প বদলায় না।

 

২৩ আগস্ট ২০০৯।