জীবন নামক পরীক্ষা অথবা জীবনের উদ্দেশ্য

পৃথিবী

ধর্মীয় কেতাবকে ঘুরিয়ে-পেচিয়ে-কাটাছেড়া করে না হয় বিজ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা যায়, কিন্তু জীবনের উদ্দেশ্য কি ধর্ম ব্যাখ্যা করতে পারে? ধার্মিকরা(যাদের দিনকাল ভাল যাচ্ছে না) প্রায়ই বলেন জীবনটা স্রেফ পরীক্ষা ছাড়া কিছুই নয়, এই পরীক্ষাটি ভালমত দিতে পারলে পরকালে রয়েছে অশেষ শান্তি। এই যাদুমন্ত্র শুধু নিরাশ ব্যক্তিবর্গ নয়, ধর্মজীবিরাও ব্যবহার করে থাকেন কারণ গরীব, দুঃখী মানুষকে দলে ঢোকানোর এটিই সবচেয়ে সহজ ও কার্যকরী পন্থা।

এখানে একটা প্রশ্ন আসে, একেকজনের কাছে জীবন নামক পরীক্ষাটি একেকরকম কেন? নবম শ্রেণীর বিজ্ঞান শাখার ছাত্রকে তো কখনও চতুর্থ শ্রেণীর সমাজের প্রশ্নপত্র দেওয়া হয়না, তেমনি উচ্চমাধ্যমিক স্তরের মানবিক শাখার ছাত্রদের তো কখনও মাস্টার্স লেভেলের পদার্থবিজ্ঞানের প্রশ্নপত্র দেওয়া হয় না। মানুষ অনেক ভাবনা-চিন্তা করেই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরী করে। অথচ ঈশ্বর দেখি প্রশ্নপত্র তৈরী করে দিয়েই খালাস, তিনি একটুও খেয়াল করে দেখলেন না সব মানুষ একই পরীক্ষা দিচ্ছে কিনা। সমাজে যারা উচ্চবিত্ত শ্রেনীর পরিবারে জন্মগ্রহন করে, তাদের জন্য জীবনসংগ্রাম হয় অনেক সোজা। তারা কেউই সাধারনত নিম্মবিত্ত শ্রেনীতে নেমে আসে না। অথচ নিম্মবিত্ত শ্রেনীতে যে শিশু জন্ম নেয়, জন্ম নেওয়াই হয়ে দাঁড়ায় তার আজন্ম পাপ। বিত্তবৈভব লাভের সম্ভাবনা তার জন্য খুবই ক্ষীন, মৌলিক অধিকারের জন্য যুদ্ধ করতে করতে একসময় তার প্রাণপ্রদীপ নিভে যায়। ৫ ওয়াক্ত নামায, কোরান তেলাওয়াত, রোজা, যাকাত, হজ্ব করার সময়/সামর্থ্য তার হাতে থাকে না। হয়ত তার ইচ্ছে থাকে, কিন্তু সময় থাকে না। অল্প কথায় বলতে গেলে বিনা প্রস্তুতিতে তাকে পরীক্ষা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। পরীক্ষায় সে কত নম্বর(সওয়াব) পাবে? প্রতি বছর যে ব্যক্তি হজ্ব করে এবং যার হাতে ইসলামের পাঁচ স্তম্ভগুলো মেনে চলার মত অঢেল সময় আছে, নিশ্চয় তার চেয়ে বেশি নম্বর অথবা সওয়াব পাবে না? কোনমতে যদি সে স্বর্গে আসন লাভ করতেও পারে, নিশ্চয়ই সে অতি উচ্চ আসন পাবে না? এখন কেউ কেউ বলতে পারেন, “গরীব, দুঃখীদের জন্য আল্লাহ একটু ঢিলে দিবেন”। এখানেও তো সমস্যা রয়ে যায়, আমরা তো পরীক্ষায় কখনও বিত্তবৈভবের ভিত্তিতে ছাত্র-ছাত্রীদের মূল্যায়ন করি না। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে যে ছাত্র মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয় আর যে ছাত্র সারাদিন রিকসা চালিয়ে রাতের বেলা মোমবাতির আলোয় পড়াশুনা করে, তাদেরকে একইভাবে মূল্যায়ন করা হয়(বাস্তবতা হয়ত ভিন্ন, কিন্তু আসলে তো এমনই হওয়া উচিত)। গরীব বলে বেশি সুবিধা দেওয়া আর ধনী বলে বেশি কঠোর হলে ঈশ্বরের এই পরীক্ষা মোটেও সুষ্ঠু হবে না। অমুসলমানদের প্রশ্নটাও বিবেচনায় নেওয়া উচিত, কিন্তু অমুসলমানরা বেহেস্তে যেতে পারবে কিনা এ নিয়ে বহু বিতর্ক থাকায় সেই প্রসঙ্গে আর গেলাম না।

আরেকটা বিষয় বিবেচ্য যে মক্কা-মদীনায় যারা থাকে, তাদের জন্য জীবন নামক পরীক্ষাটা অতি সহজ। বিশেষ করে যারা হেটে হেটে কাবা কিংবা মসজিদে নববীতে সালাত আদায় করতে যান, তারা তো বলতে গেলে বই খুলে পরীক্ষা দিচ্ছেন! মুসলমানরা সবাই একবাক্যে স্বীকার করে মসজিদে নববীতে সালাত আদায় করলে সাধারণ সালাতের চেয়ে বেশি সওয়াব আদায় করা যায়। কাবা শরীফে সালাত আদায় করলে সওয়াব হয় আরও বেশি। তার উপর রমজান মাসে ওমরাহ করলে সওয়াব হয় একাধিক হজ্বের সমান। বিদায়ী জুমার নামাযটা কাবা কিংবা মসজিদে নববীতে আদায় করলে কত সওয়াব পাওয়া যাবে, সেই সমীকরণ বের করার দায়িত্ব পাঠকের হাতে ছেড়ে দিলাম। বলাই বাহুল্য, মক্কার একজন বাসিন্দা আর বাংলাদেশের অজপাড়াগাঁয়ের কোন অখ্যাত মসজিদের ইমাম পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়লেও মক্কাবাসীর সওয়াব বেশি হবে। অতঃপর, সে স্বর্গলাভের দৌড়ে এগিয়ে থাকবে। আল্লাহ যদি কাউকে বিশেষ বিবেচনায় বেশি সওয়াব দেন, তাহলে অনিয়ম হবে। আল্লাহ যদি সবাইকে তাদের প্রাপ্য সওয়াব দেন, তাহলেও কিছু কিছু মানুষ সবসময় প্রতিযোগীতায় এগিয়ে থাকবে। অথচ এই প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করার সুযোগ সবাইকেই সমানভাবে দেওয়া উচিত ছিল।

ইসলাম ধর্মে নবী-রসূল বাদ দিলে সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি বোধহয় একজন শহীদ। আল্লাহর পথে যুদ্ধ করার নিয়ত অনেকেরই থাকে, কিন্তু সবাই কি যুদ্ধে যাওয়ার যোগ্যতা রাখে? ধরুন, দেশে একটা ইসলামি জিহাদ অনুষ্ঠিত হল। সেই যুদ্ধে শক্ত-সমর্থ সব মুসলমান যোগদান করল, কিন্তু একজন বৃ্দ্ধ শাহাদাত গ্রহন করতে প্রস্তুত থাকলেও স্বাস্থ্যের কারণে যুদ্ধে অংশগ্রহন করতে পারল না। সেই যুদ্ধে কয়েকজন যুবক শহীদ হল। তারা তো শহীদ হয়ে বলতে গেলে চিরতরে বেঁচে গেলেন, তাদের জন্য স্বর্গ অবধারিত। কিন্তু বৃ্দ্ধটি কি দোষ করল? তার নিয়তও তো একইরকম শক্ত ছিল। এখন কেউ যদি বলে যে আল্লাহ বৃ্দ্ধটিকে শহীদের সমান সওয়াব দিবেন, তাহলেও সমস্যা আছে। প্রথমত, জীবন নামক পরীক্ষায় যখনই আল্লাহ কাউকে বিশেষ বিবেচনায় নম্বর দিতে যাবেন তখনই তিনি অনিয়ম করে বসবেন। দ্বিতীয়ত, শহীদের সমান সওয়াব পাওয়ার পরও কিন্তু বৃ্দ্ধ মৃত্যুবরণ করেননি। তিনি যতদিন বেঁচে থাকবেন, ততদিন এবাদত-বন্দেগী করে আরও সওয়াব কামাতে পারবেন। এদিক দিয়ে বেচারা শহীদরা দুর্ভাগ্যবান, তাদের জন্য তো বাড়তি সওয়াব কামানোর ফুরসত নেই!

আসলে জীবনকে একটি পরীক্ষা হিসেবে অভিহিত করলে প্রথমেই যে প্রশ্নটি আসে, তা হল- আল্লাহ তো ভবিষ্যত দেখতে পারেন, তাহলে এই পরীক্ষা নেওয়াটা অনর্থক না? এই প্রশ্নের জবাবে সর্বোৎকৃ্ষ্ট যে উত্তর হতে পারে তা হল “যাতে শেষ বিচারের দিন কেউ আল্লাহর কাছে অবিচারের অভিযোগ তুলতে না পারে”। ব্যাটার ধৃষ্টতা দেখুন, সৃষ্টিকর্তার বিচারবুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন! আসলে জীবনকে রঙ্গিন করতে বিশ্বাসীরা যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা দেখলে খুব মায়া লাগে। সবাই মনে করে, “জীবন যেহেতু আছে, নিশ্চয়ই জীবনের একটা উদ্দেশ্যও আছে!”। আমরা আসলে ভুলে যাই যে উদ্দেশ্য শূন্য থেকে সৃষ্ট হয় না, আমরা নিজেরাই নিজেদের উদ্দেশ্য এবং গন্তব্য সৃষ্টি করে নিই। আপনি কি বর্তমানে উদ্দেশ্যহীনতায় ভুগছেন? এক কাজ করেন, এমন কোন ব্যক্তির জন্য অর্থ জোগাড় করেন যে তার চিকিৎসার ব্যয় জোগাড় করতে পারছে না। এই মুহুর্তে আমার একজন ঢাকা মেডিকেলের ছাত্রীর কথা মনে পড়ছে যে ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত, চিকিৎসার জন্য ৭০ লাখ টাকা লাগবে। মেয়েটি দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে, জীবনের কিছু দেখতে পাওয়ার আগেই তার মৃত্যু ঘটতে যাচ্ছে। তাকে জীবনের স্বাদ আস্বাদন করতে সাহায্য করুন। সারা জীবন এবাদত-বন্দেগী করে হয়ত বেহেস্ত লাভ করতে পারবেন, কিন্তু একটা মানুষের অমূল্য প্রাণও আপনি রক্ষা করতে পারবেন না। মানবসেবাকে যদি যুতসই উদ্দেশ্য মনে না হয়, তবে আপনার ব্যক্তিগত চাহিদা পূরণের চেষ্টা করে দেখতে পারেন। ব্যক্তিগতভাবে আমার জীবনের বর্তমান উদ্দেশ্য হল দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান অস্তিমান সবকিছুর জন্মরহস্য মৃত্যুর আগে জেনে যাওয়া। আমি হয়ত কখনওই এই গন্তব্যে পৌছুতে পারব না, কিন্তু আমি তো অন্তত বুক ফুলিয়ে বলতে পারি আমার একটি গন্তব্য আছে!

আসলে মহাবিশ্বের সৌন্দর্য্য উপলদ্ধি করার জন্য কোন ধর্মীয় চশমা লাগে না, কোন সৃষ্টিকর্তা ছাড়াই কিভাবে এই জগতসংসার গড়ে উঠেছে তা নিয়ে একটু চিন্তা করলেই এর সৌন্দর্য্য দেখা যায়। অনিকেত প্রান্তরে যদি একটা ফুল স্বতন্ত্রভাবে জন্ম নেয়, তবে তার মধ্যে একটু অন্যরকম সৌন্দর্য্য পরিলক্ষিত হয়। তবে ওই ফুলটি যদি কেউ ইচ্ছেকৃ্তভাবে রোপন করে, আমি তার মধ্যে কোন বিশেষত্ব দেখি না।

                      —-০—-