আমরা ছুটছি। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছি। পৃথিবীর সব মানুষই ছুটছে। প্রবলবেগে ছুটছে। চোখবাঁধা অশ্বের মত। কেউ ছুটছে অবুর্দ কোটি অর্থের সন্ধানে, কেউ কোনও অচিনপুরের গুপ্তধনের। কেউ খোঁজে মণিমুক্তা জহরত, কেউ বা খোঁজে অলীকদেশের স্বপ্নপুরী।
কেউ ছুটছে সম্মুখে। কেউ পশ্চাতে। সম্মুখ কোথায় ? পশ্চাতই বা কোথায় ? সম্মুখ আর পশ্চাতের জ্ঞান হারিয়ে ফেলছি আমরা। আমরা, এই আধুনিক যুগের আধুনিক মানুষ। শুধু ছুটছি। ছোটার লক্ষ্যে ছুটছি না, ছোটার নেশায় ছুটছি। আধুনিক মানুষ নেশাগ্রস্ত মানুষ।
বিজ্ঞান পৃথিবীকে আলো দিতে চেয়েছিল, সাথে সাথে প্রযুক্তিও। মানুষ প্রযুক্তিটা গ্রহণ করেছে, আলোটাকে করেনি। প্রযুক্তি এনেছে প্রাচুর্য। এনেছে সম্পদ। মানুষ সম্পদের দিকে ছুটছে। অধিকতর সম্পদ, অধিকতর সমৃদ্ধি। অধিকতর গতিজাত প্রাচুর্যের পথে। প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছে অত্যাশ্চর্য যন্ত্র, গতির যন্ত্র, যোগাযোগের যন্ত্র। বেতার তরঙ্গে, বায়ুতরঙ্গে সংযুক্ত করেছে দেশ গ্রাম মাটি ও মানুষ। দেশগ্রাম সংযুক্ত হয়েছে বটে, মানুষ হয়নি। মানুষ যোগাযোগের যন্ত্র ব্যবহার করেছে যোগাযোগ ছিন্ন করতে। একসময় দুই দেশে দুই জাতিতে যোগাযোগ ছিল দুরূহ, কিন্তু যোগাযোগের আকাংক্ষা ছিল অদম্য। যোগাযোগের যন্ত্র হাতে পাওয়ার পর আকাংক্ষা জেগেছে বিচ্ছিন্নতার। মানুষ আগে ছুটত পরস্পরের কাছে, এখন ছুটছে পরস্পরের কাছ থেকে। এরকম কি হওয়ার কথা ছিল ?
পুরাকালে বিগ্রহ ছিল অনেক। আগ্রাসন, আক্রমণ, সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, হত্যা, গণহত্যা, যুদ্ধ, ধর্মযুদ্ধ – এগুলোকে একসাথে করে যে জিনিস দাঁড়ায় তার নাম মধ্যযুগ। সেযুগে দাসত্ব ছিল, নারীনিপীড়ন ছিল, ছিল অবর্ণনীয় অত্যাচার। ছিল নরবলি, নারীদাহ ; এমনকি নরখাদকও ছিল কোন কোন জায়গায়। যা ছিল না তখন তা হল যন্ত্র। যদিও বা ছিল কিছু ইউরোপীয় সমাজে, যন্ত্রের আধিপত্য বিস্তার হতে শুরু করেনি আধুনিক যুগের সূচনা হবার আগ পর্যন্ত। আধুনিক যুগ বলতে গেলে ইউরোপেরই সৃষ্টি। মধ্যযুগের যবনিকা তুলে নতুনদিনের আলোকধারাকে বরণ করতে যতটা সক্ষম হয়েছিল ইউরোপ ততটা সক্ষম হয়নি বাইরের পৃথিবী। আধুনিক বিজ্ঞান প্রম অঙ্কুরিত হয় ইউরোপের নানাদেশের নানা গবেষণাকেন্দ্রে, পরে তার শাখাপ্রশাখা নানাদিকে বিস্তারিত হয়। বিজ্ঞানের সাথে বুদ্ধি, অন্তর্জ্ঞান ও দর্শনচিন্তা সংমিশ্রিত হয়ে গড়ে ওঠে এক অপরূপ নতুন সভ্যতা। তাদের সেই যাত্রা আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে একত্রিত হয়ে তীব্রগতি অর্জন করে বিংশ শতাব্দীর সায়াহ্নকালে। তারা গ্রহগ্রহান্তরে ভ্রমণ করবার আশ্চর্য শূন্যযান আবিষ্কার করে, দূরদূরান্তের আলোকরশ্মি আহরণ করে আদি সৃষ্টির গূঢ়তম রহস্য উদ্ঘাটন করতে সচেষ্ট হয়। তারা মহাশূন্যের নিভৃতলোকে সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হয় মানবজাতির এক বিকল্প বাসালয়। মানুষের জয়যাত্রা ভূলোক দ্যুলোক অতিক্রম করে মহাদিগন্তের পথে ধাবিত হয়।
কিন্তু। কিন্তু এই গতির উন্মাদনায় কোথায় আর কখন যে খানিক ছন্দপতন হতে শুরু করেছিল কেউ বুঝি তা খেয়াল করেনি। আধুনিক যন্ত্র আমাদের চলতে শিখিয়েছে, থামতে শেখায়নি। থেমে থেমে দম নিতে শেখায়নি। শেখায়নি বাগানের বেঞ্চিতে বসে ভাবতে একবার, কোথায় চলেছে এই অন্ধ কাফেলা, কোথায় এই যাত্রার শেষ। আধুনিক প্রযুক্তি ‘কৃত্রিম বুদ্ধি’ তৈরি করতে পারছে গবেষণাঘরে, কিন্তু পথের মানুষকে শেখায়নি কেমন করে তার নিজের সহজাত বুদ্ধিকে ব্যবহার করতে হয় প্রজ্ঞার সাথে। প্রজ্ঞা, বিবেক, বিবেচনা, দূরদৃষ্টি, অন্তর্দৃষ্টি, আত্মদর্শন, এগুলোর কি সত্যি কোন অর্থ আছে এযুগে ? অথচ দেখুন, মধ্যযুগ কিন্তু অবলুপ্ত হয়নি সবজায়গায়। বরং অনেক দেশে নতুন উদ্দীপনায় প্রত্যাবর্তনের আয়োজন করছে। মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যযুগ তো বলতে গেলে কখনোই দূর হয়নি। পাকিস্তানের নগরকেন্দ্রিক কিছু সমাজকে বাদ দিলে বাকিটা তো এখনো অন্ধকার। কার্যত তারা আজো গুহাবাসী আদিমানব, আফগানিস্তান আর উজবেকিস্তানের মত। ধর্ম তাদের কাছে আলোকবর্তিকা হয়ে আসেনি, এসেছে বর্বরতা আর পাশবিকতার হাতিয়ার হয়ে। মধ্যযুগকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে আরো অনেক দেশে। আমাদের বাংলাদেশে তো বটেই, ভারতের মত আধুনিক উনড়বতিশীল দেশেও। প্রযুক্তি যুগের আগে, ভারতের ইতিহাসে, উগ্র ‘হিন্দুত্ববাদ’ নামক কোনও ন্যক্কারজনক বস্তুর নাম শোনা যায়নি। এখন তার ভয়াবহ মূর্তি সর্বত্র বিরাজমান। এমনটি হওয়ার কথা ছিল না, কিন্তু হচ্ছে। কেন হচ্ছে তা নিয়ে ভাবা দরকার। সম্ভবত প্রযুক্তির তীব্র গতির সঙ্গে পথের মানুষ তাল মেলাতে পারছে না বলে। সম্ভবত প্রযুক্তির পণ্যদ্রব্যে মানুষ যতই আসক্ত হয়ে পড়ছে বিজ্ঞানের আলো থেকে ততই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। এর কি কোনও সমাধান আছে ? আছে, অবশ্যই আছে। শিক্ষা। ব্যাপক, ব্যাপক শিক্ষা। যে-কোনরকম শিক্ষা নয়, আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত, মুক্তমনা ও উদারনীতিক শিক্ষা। প্রতিটি মানুষ শিক্ষিত হোক, তাহলেই তারা শিক্ষিতদের মত ভাবতে শিখবে।
অটোয়া
মার্চ ২৯, ২০০৯
মুক্তিসন ৩৮
[…] সম্মুখকোনদিকে? […]
আমার সবসময়ে মনে হয়েছে যে মানুষ সভ্যতার ভুল ব্যাখ্যা করেছে যুগে যুগে।
ধর্মের মত (তুলনা অর্থে নয়) বিজ্ঞানকেও কিছু মানুষ নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে সবার কাছে এর সুফল পৌঁছাবার পথে বিরাট বাঁধার সৃষ্টি করেছে। সত্যি শিক্ষাই একমাত্র পথ। কিন্ত আমরা রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে শিক্ষার সুষম বন্টন কতোটা আশা করতে পারি?
আমাদের আসলে ভেবে বের করা উচিত আমরা নিজেরা এর জন্য কি করতে পারি।
এই সুখপাঠ্য সাম্প্রতিক বিষয় অবলম্বনে প্রবন্ধের জন্যে ধন্যবাদ মীজান রহমান ! কিন্তু না ডঃ রহমান , আমার মনে হয় ঐ শিখ্খা শব্দের আগেপরে কোন বিশেষ বিশেষন যুক্ত হওয়া প্রয়োজন ! অথবা বিশেষ বিধৃতি মুলক কিছু যেমন সু, স্ব, আত্ম ইত্যাদি ! নইলে দেখুন এমন বিপাকে কাউকে পড়তে হবে কেনো?
ধরুন, ভদ্রলোক আমার ঘরে অতিথি । তিনি শিক্খাগত যোগ্যতার মাপকাঠিতে সর্বশেষ সীমায়্। একজন উচ্চমার্গের গবেষক এবং শিক্খাবিদ-ও বটে। আমি তাকে ডিনারের আমন্ত্রন জানালাম। তিনি তা গ্রহন-ও করলেন। খেতে বসে তিনি জানতে চাইলেন যে চিকেনটা আমি স্থানীয় বাজার থেকে কিনেছি কিনা, মাথা নেড়ে সায় দিলে উনি তা খাবেননা বলে জানালেন, মাটন তো উনি ছুঁলেন-ই না । ঘরে বানানো মিষ্টান্ন খেলেন কিন্তু শপিংমল থেকে কেনা ফ্রুটজুস খেলেন না। স্বভাবতঃই একসাথে খেতে বসে আমার-ও খেয়ে তৃপ্তি হলোনা।
কারণ জানতে চাইলে বললেন, “আপনি জ্যান্ত মুরগী কিনে এনে জবেহ করলে খেতাম। কিন্তু যেটা আপনি রান্না করেছেন ওটা হালাল নয়। আর ঐ যে ফ্রুটজুস, ওটাতে প্রিজারভেটিভ হিসেবে কি আছে জানেন? আ্যলকোহল ছাড়াতো কোন প্রিজারভেটিভ হয়না তাইনা?” আমি সম্মতি সূচক মাথা নাড়লে উনি বললেন, “এজন্যে খাইনি”। সব শেষে তাকে দিলুম জল এক গ্লাস খেতে, দাঁড়িয়ে ছিলেন ডাইনিং টেবিল থেকে একটু দূরে, ওখানেই হাঁটু গেঁড়ে বসে পরলেন তিনি। তারপর খেলেন জল! আমি বললাম আগে বললে আমি অনুরূপ ব্যবস্থা নিতে চেষ্টা করতাম। উনি উত্তরে বললেন “আমি ধারনা করিনি যে আপনারা এগুলো খান”!
উপরের ঘটনাটি দখ্খিন কোরিয়ার একটি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের! এখানে এই হারাম-হালালের কবলে পড়ে অনেকেই হাবুডুবু খাচ্ছেন! কি এসবের ব্যাখ্খা, আমার জানা নেই। বিষয়টা রুচির হতে পারে, অথবা হতে পারে সংস্কার! তা সে যাই হোক, শিখ্খার সাথে সাথে এসবের ও তো একটা পরিমিতিবোধ এবং প্রায়োগিক ব্যাবধান গড়ে উঠা উচিৎ। বিশেষ করে কতোটুকু সুদৃশ্য এবং মানানসই আর কতোটুকুইবা সহজলভ্য এটুকু বিবেচনায় নিয়ে।
@Keshab K. Adhikary,
আমার মনে হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সংস্কার। কারন ম্যাকডোনালসের ফিলএ ও ফিশ খেতে প্রব্লেম নেই, মিটেই যত সমস্যা! আমার বন্ধু রাতের বেলা আমার সাথে বসে গেলাশের পর গেলাস মদ গিলে সকালে ঘুম থেকে উঠে বলে চ জুমার নামাজ পড়তে যাই! নৈতিকতার বালাইতো দেখিনা কোথাও, বিশেষ করে যুব সমাজের মধ্যে। সবাই ডুবে আছে আইফোন আর সনি ভাইওতে। সমাজ, মানুষ, নৈতিকতা এসব নিয়ে ভাববার সময় কই? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বিজ্ঞান দিলো বেগ কেড়ে নিলো আবেগ।
@suman,
At my institute the people from Bangladesh do not eat chicken sandwich, chicken wrap etc. When we go to restaurents then also they do not take any chicken or meat (beef). Halal haram etc. Leading a complete halal life can be good for peace.
খুবই ভাল লাগলো মীজান রহমানের চিন্তা জাগানিয়া লেখাটি। সভ্যতা আসলে কোথায় চলেছে ভাবার সময় ও আমরা হারিয়ে ফেলেছি। আপনার মত আমিও বিশ্বাস করি সচেতনতা ও প্রজ্ঞার মাধ্যমেই মানব জাতি এই সংকট মোকাবেলা করতে পারে।শুধু শিক্ষা শব্দটি যথাযথ অর্থ প্রকাশ করেনা। এখন প্রযুক্তি শিক্ষাকে অনেক বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়। ফল হিসেবে প্রযুক্তিশিক্ষিতদের মধ্যে এমন একটি অংশ দেখা যায় যারা মানুষ হিসেবে নিতান্ত অন্ধকারাচ্ছন্ন। আপনার সাথে সুর মিলিয়ে বলতে চাই আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত, মুক্তমনা ও উদারনীতিক শিক্ষা সবার জন্যচালু হোক।