[মডারেটরের নোট – দিগন্ত সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এই সিরিজের প্রথম তিনটি পর্ব আমাদের ডারউইন দিবস ২০০৯ ই-সংকলনে প্রকাশিত হয়েছিলো। শেষপর্বটি আজ প্রকাশিত হল। ডারউইন দিবসে প্রকাশিত প্রবন্ধগুল থেকে নির্বাচিত কিছু প্রবন্ধ নিয়ে (এবং সেই সাথে বাংলাদেশ থেকে আরো কিছু প্রবন্ধ সংযোজন করে) একটি স্মারকগ্রন্থ বাংলাদেশ থেকে প্রকাশ করার চিন্তাভাবনা চলছে। এর দায়িত্বে রয়েছেন অনন্ত বিজয় দাস। এ প্রসঙ্গে পাঠকদের মতামত কাম্য। ]
পূর্ববর্তী পর্বের পর …
এবার আবার ফিরে যাওয়া যাক বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে। জীবনের ধারক ও বাহক ডি-এন-এর গঠন কাঠামো জানার জন্য তখন বিজ্ঞানীরা মরিয়া হয়ে ঊঠছেন। এই সময়েই আরো এক বিজ্ঞানী, হয়ত শ্রোডিংগারের বই না পড়েই রসায়ন থেকে সরে এসে জীববিজ্ঞানে গবেষণা শুরু করেন। তিনি হলেন লিনাস পাউলিং। এই পাউলিং হলেন দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি একাধিকবার নোবেল পুরষ্কার পান, মারি কুরীর পরে। আর পাউলিং হলেন একমাত্র – যিনি উভয়ক্ষেত্রেই এককভাবে পুরষ্কারটা পান। প্রথমবার রসায়নে, দ্বিতীয়বার শান্তিতে। যাহোক, পাউলিং জীববিজ্ঞানে এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফির যুগান্তকারী ব্যবহার শুরু করেন। যে কোনো অণুর গঠন-প্রকৃতি জানার জন্য তার ক্রিস্টালের মধ্যে দিয়ে এক্স-রে প্রবাহ পাঠানো হত। এর ফলে কিছুটা এক্স-রে চারদিকে বিচ্ছুরিত হত, বাকিটা নির্বিঘ্নে অণু অতিক্রম করে যেত। এই বিচ্ছুরণের প্রকৃতি থেকে সরল যে কোনো অণুর গঠন আঁচ করা যেত। কিন্তু জটিল অণুর ক্ষেত্রে এই নীতি ততটা ভাল কাজ করত না। তা সত্ত্বেও উনি রক্তে উপস্থিত প্রোটিন হিমোগ্লোবিন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখালেন অক্সিজেনের উপস্থিতির কারণে হিমোগ্লোবিনের গঠনের পরিবর্তন ঘটে। এর পরে উনি সামগ্রিক ভাবে প্রোটিনের গঠন নিয়ে গবেষণায় এলেন। দীর্ঘ এগার বছরের প্রচেষ্টায় উনি সমর্থ হলেন প্রোটিনের রাসায়নিক গঠন নির্ধারণে। ১৯৫১ সালে, তার হিমোগ্লোবিন নিয়ে গবেষণার শেষ ফলাফল হিসাবে উনি দেখান যে প্রোটিন অণুতে অ্যামাইনো অ্যাসিড মূলকগুলো আলফা হেলিক্স বা বিটা শিটের আকারে সজ্জিত থাকে। এই আবিষ্কার জৈব যৌগের গঠন সংক্রান্ত গবেষণাকে একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেল।
ঠিক কিভাবে উনি এই আবিষ্কারটি করলেন? পাউলিং-এর নিজের কথায় –
“১৯৪৮ সালে আমি যখন লন্ডনে অক্সফোর্ডের অধ্যাপক ছিলাম, একদিন আমার খুব ঠান্ডা লেগেছিল। এখনকার মত তো ভিটামিন সি খেয়ে সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভব ছিল না, তাই দুয়েকদিন আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে সায়েন্স ফিকশন আর ডিটেকটিভ গল্পের বই পড়ে সময় কাটালাম। তারপরে বিরক্ত হয়ে ভাবলাম আলফা হেলিক্সটা এবার আবিষ্কার করেই ফেলা যাক। … যাহোক আমি একটা কাগজের টুকরো নিলাম আর তাতে ভেবেচিন্তে পলিপেপ্টাইড শৃঙ্খলার একটা ছবি আঁকলাম – যাতে দূরত্ব আর কোণগুলো মোটামুটি ঠিকঠাক। একটা মাত্র কোণের মাপ সঠিক ছিল না। আমার কাছে এই কাগজের টুকরোটা এখনও আছে। … আমি কাগজটা ভাঁজ করে মেলাতে চেষ্টা করলাম। কয়েকবারের চেষ্টায় কয়েকটা বিফল ভাঁজের পর দেখলাম ১১০ ডিগ্রিতে ব্যাপারটার একটা সমাধান আছে। এর ফলে সব ভাঁজগুলো জুড়লে N-C-H-O বন্ধনী গঠিত হয় N-H বন্ধনী আর C=O বন্ধনী দিয়ে।”
এতটাই প্রতিভাবান বিজ্ঞানী ছিলেন পাউলিং যে তার অবসর সময়ে সমাধান করা ধাঁধাও আমাদের বিস্মিত করে। কিন্তু এই পাউলিং-এর প্রস্তাবিত ডি-এন-এর গঠন ধোপে টেঁকে নি। উনি একই ভাবে ধাঁধার সমাধানের মত করে গঠনের মডেল তৈরীর চেষ্টা করেন। আগেই বলেছি বিজ্ঞানে অবিসংবাদিত ব্যক্তিত্ব বলে কেউ হয় না। তাই এই দুবার নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীকেও তার প্রস্তাবিত গঠনের ভুল সংশোধনে ব্যস্ত থাকতে হল। ১৯৫৩ সালে তার প্রস্তাবিত ডি-এন-এর গঠনে উনি বলেন যে A,T,C,G – এই মূল উপাদানগুলো একে অপরের সাথে হাইড্রোজেন বন্ধনে জড়িত। কিন্তু সেক্ষেত্রে ডি-এন-এ কে তো আর অ্যাসিডই বলা চলে না, আর কোষের মধ্যে টিঁকে থাকতে গেলে কোষকে সামগ্রিকভাবে অ্যাসিডিক হতে হয়। তাই তার প্রস্তাব গৃহীত হল না। কিন্তু ডি-এন-এ বিষয়ে তার এই উৎসাহ আটলান্টিকের উল্টোদিকে একটা প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরী করে দিয়েছিল। ওরা আগে পারে না আমরা আগে – এই প্রতিযোগিতা থেকেই ডি-এন-এ আবিষ্কারের জন্য মরিয়া বিজ্ঞানীরা অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিলেন।
আটলান্টিকের উল্টোদিকে বিজ্ঞানীদের নেতৃত্বে ছিলেন স্যার লরেন্স ব্র্যাগ – ১৯১৫ সালের নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী ও এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফির আবিষ্কারক। প্রোটিনের গঠনের আবিষ্কারের সময় তারই বের করা প্রযুক্তি দিয়ে তার চেয়ে আগে গঠন কাঠামো বের করে ফেলল একজন আমেরিকান বিজ্ঞানী – এই ব্যাপারটা তার যেন সহ্য হয় নি। তার ওপর তিনি নিজেও ক্যাভেন্ডিস ল্যাবরেটরিতে ওই একই বিষয়ে গবেষণা করছিলেন – আর তার পেপারটা একটুর জন্য মূল আবিষ্কারের শিরোপা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তিনি এবার কোমর বেঁধে শুরু করলেন ডি-এন-এর গঠন কাঠামো আবিষ্কারে প্রচেষ্টা। তার এই উৎসাহে সঙ্গী ছিলেন আরো কিছু বিজ্ঞানী – যেমন মরিস উইল্কিন্স, জেমস ওয়াটসন, ফ্রান্সিস ক্রিক ও রোজেলিন্ড ফ্রাঙ্কলিন।
এই চারজনের নাম এক নিশ্বাসে বলে ফেললাম বটে কিন্তু এরা প্রত্যেকে যে কত বড় মাপের একটা আবিষ্কার করে গেছেন সেটা চট করে বলে বোঝানো হয়ত সম্ভব নয়। তবে এটা বলা সম্ভব, মানবজাতি এদের আবিষ্কৃত বিষয়কে এখন থেকে অন্তত কয়েকশ’ বছর পর পর্যন্ত মনে রাখবে, যেমন মনে রেখেছে আইস্যাক নিউটন বা অ্যালবার্ট আইন্সটাইনকে। এদের সাথে পরিচিত হওয়া যেকোনো বিজ্ঞানপ্রেমীর জন্যই জরুরী। লন্ডনের কিংস কলেজে এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি নিয়ে গবেষণা করতেন রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন আর মরিস উইলকিন্স, অন্যদিকে কেমব্রিজের স্বনামধন্য ক্যাভেন্ডিস ল্যাবরেটরিতে ডিএনএর সম্ভাব্য গঠন ব্যাখ্যা করতে মডেল তৈরীতে ব্যস্ত থাকতেন জেমস ওয়াটসন আর ফ্রান্সিস ক্রিক ।
নিউজিল্যান্ডে জন্মানো উইলকিন্সের কথা আগেই বলেছি, বাকিদের কথাও বাদ রাখব না। এদের মধ্যে সবথেকে প্রতিভাবান বিজ্ঞানী হিসাবে যাকে মনে করা হয় তিনি হলেন ফ্রান্সিস ক্রিক। ইনি কাজ করতেন মেডিক্যাল রিসার্চ ইউনিটে, ম্যাক্স পেরুজের অধীনে। মজার কথা, এই ব্রিটিশ বিজ্ঞানী প্রথম জীবনে পদার্থবিদ ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কাজ করতেন ব্রিটিশ নৌবাহিনীর বিজ্ঞানী হিসাবে। আরো অনেক বিজ্ঞানীর মতই বিশ্বযুদ্ধের শেষে উনিও পদার্থবিদ্যা ছেড়ে জীববিজ্ঞানে আসেন শ্রোডিংগারের বই পড়ে। ১৯৪৭ সালে উনি প্রথম জীববিজ্ঞানে আসার পরে উনি প্রথম কয়েকবছর শুধু এক্স-রে ডিফ্রাকশন, জৈবরসায়ন আর জীববিজ্ঞানের কয়েকটি মূল টেক্সটবুক পড়েই সময় কাটান। ক্যাভেন্ডিশেই ১৯৫১ সালে তার আলাপ হয় আরেক জীববিজ্ঞানী জেমস ওয়াটসনের সাথে, তখন ওয়াটসনের বয়স মাত্র ২৩। জেমস ওয়াটসনই ছিলেন এদের মধ্যে একমাত্র আমেরিকান। শিকাগোর এক ব্যবসায়ী ঘরের ছেলে ওয়াটসন কিন্তু ছিলেন জীববিজ্ঞানী – আর তার গবেষণার বিষয় ছিল ফাজ ভাইরাস আর ব্যাকটেরিয়া। কোপেনহেগেনে পোস্ট ডক্টরাল প্রোজেক্টে কাজ করার সময়ই নেপলসে এক সিম্পোসিয়ামে তার আলাপ হয় উইলকিন্সের সাথে। উইলকিন্সের দেখানো ডিএনএর এক্সরে ডিফ্রাকশন প্যাটার্নের ছবিই তাকে প্রবুদ্ধ করেছিল ১৯৫১ সালে লন্ডনে ক্যাভেন্ডিশে যোগ দিতে – প্রথমে মায়োগ্লোবিন নিয়ে গবেষণায়, পরে ডিএনএ। এদের থেকে কিছুটা আলাদা প্রকৃতির ছিলেন রোজেলিন্ড। ব্রিটিশ ইহুদী পরিবারে জন্মানো এই বিজ্ঞানীও ১৯৫১তেই কিংস কলেজে যোগ দেন জন রান্ডালের অধীনে – প্রোটিনের এক্সরে ডিফ্রাকশন প্যাটার্ন নিয়ে গবেষণা করতে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই পাউলিং প্রোটিনের গঠন সম্পর্কিত আবিষ্কার করে ফেলায় উনিও ডিএনএ নিয়ে গবেষণায় যোগ দেন।
ওয়াটসনের লেখা বইতে উনি ফ্রান্সিস ক্রিকের কোনো প্রশংসাই বাকি রাখেননি। ওয়াটসনের লেখা থেকে জানা যায় ক্রিক ছোটোবেলা থেকেই অসংখ্য প্রশ্ন করতেন দেখে ওনাকে একটা এন্সাইক্লোপিডিয়া কিনে দেওয়া হয়েছিল। ডিএনএ নামে একটি বইত উনি ক্রিক সম্পর্কে লিখছেন –
“উনি ছিলেন বাক্যবাগীশ, যেকোনো আলোচনায় বক্তব্য রাখতে ভালবাসতেন। ক্যাভেন্ডিশের হলঘরে প্রায়ই তার অট্টহাসির প্রতিধ্বনি শোনা যেত। মাসে অন্তত একবার করে উনি নতুন কিছু না কিছু আইডিয়া বের করতেন আর সেই আইডিয়া দীর্ঘ সময় ধরে কোনো না কোনো উৎসাহীকে বোঝাতেন।”
উল্টোদিকে রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিনের বিবরণে ওয়াটসন এতটা উদার ছিলেন না।
“উনি (রোজালিন্ড) ছিলেন যুক্তিবাদী ও সব কাজেই নিখুঁত। আর সব ক্ষেত্রেই উনি নিজের মতে দৃঢ় – এমনকি নিজের রিসার্চ গাইড রোনাল্ড নরিসকে (পরবর্তীকালে নোবেল বিজেতা) গাধা বলে আখ্যায়িত করতেও তার মুখে বাধে নি।”
১৯৬৮ সালে প্রকাশিত “ডাবল হেলিক্স” বইতে উনি আবার আবিষ্কারের ইতিহাসের সাথে সাথে “রোজি”-কে নিয়ে কিংস কলেজে টানাপোড়েনের বিবরণও দিয়েছেন।
যাই হোক, কিংস কলেজে উইলকিন্স আর রোজালিন্ড মিলে শুরু করেন এক্সরে ক্রিস্টালোগ্রাফির কাজ, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তাদের সম্পর্কের মধ্যে সমস্যা শুরু হয়। রোজালিন্ড যেমন ছিলেন তথ্য-সন্ধিৎসু, উইলকিন্স ছিলেন ঠিক উলটো। উনি কাল্পনিক মডেল বানিয়ে প্রাপ্ত তথ্যের সাথে মেলাতে চেষ্টা করতেন। ডাবল হেলিক্স আবিষ্কারের আসল কাহিনী শুরু হয় ১৯৫২ সালে, রোজালিন্ডের সেমিনারের মধ্যে দিয়ে। আর এই সেমিনারের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ ওয়াটসনের মুখে শুনেই নতুন উদ্যমে ডিএনএর খসড়া ছবি আঁকা শুরু করেন ক্রিক। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া এক্সরে ছবি দেখে ও তার সাথে প্রাপ্ত ঘনত্ব ও আকৃতির সাদৃশ্য থেকে ক্রিক প্রস্তাব করলেন ডিএনএর প্রথম মডেল। এই মডেলের কেন্দ্রস্থলে তিনটি শৃঙ্খলা ছিল, আর তারা সংযুক্ত ছিল হাইড্রোজেন বন্ধনী দিয়ে। আর সেদিন সন্ধ্যায় ক্রিক ফোন করে উইলকিন্সকে জানালেন তার এই প্রচেষ্টার কথা।
পরের দিনই চলে এলেন উইলকিন্স, রোজালিন্ডকে নিয়ে। কিন্তু দুই অভিজ্ঞের কাছে মডেলের ত্রুটি বেশী সময় চাপা থাকল না। সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করে রোজালিন্ড দেখিয়ে দিলেন যে শৃঙ্খলা যে কটিই হোক না কেন, তারা থাকবে বাইরের দিকেই। কারণ, এক্সরেতে ডিএনএ ক্রিস্টালের মধ্যে যে জলের অণু দেখা গেছে, তা ওই শৃঙ্খলার মাঝেই অবস্থান করতে বাধ্য। এভাবে, তার প্রথম দফার ক্রিস্টালোগ্রাফির ছবির ব্যাখ্যাই প্রথমবারের মত ক্রিক আর ওয়াটসনকে ভাবতে শেখায় যে A,T,C,G মূলকগুলো ডিএনএর গঠনের ভেতরের দিকে আছে, মূল কাঠামো আছে বাইরের দিকে। এর আগে অবধি সব পাউলিং আর ওয়াটসন-ক্রিক সহ সব বিজ্ঞানীই এর উল্টোটাই ভেবে আসছিলেন। কিন্তু এই আলোচনার ফল হল সুদূরপ্রসারী। একদিকে রোজালিন্ড এরকম আবোলতাবোল মনগড়া ছবি আঁকাকে একেবারেই পাত্তা দিতে চাইলেন না।, ওনার বক্তব্য ছিল – আগে তথ্য-সংগ্রহ, পরে তা থেকে মডেল। ওয়াটসন-ক্রিক চাইলেন তার উলটো। এই সময়েই লরেন্স ব্র্যাগ, সে সময়ে ক্যাভেন্ডিশে সর্বোচ্চ পদে আসীন, হয়ত বিরক্ত হয়েই ঘোষণা করলেন যে ওয়াটসন-ক্রিক আর ডিএনএ নিয়ে কাজ করবেন না। ডিএনএর কাজ দেখবে কিংস কলেজ – মানে উইলকিন্স আর রোজালিন্ড। বিফল মনোরথে তখনকার মত গবেষণা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হলেন ওয়াটসন আর ক্রিক।
এদিকে তখন আটলান্টিকের ওপারের সাথে দ্বন্দও আস্তে আস্তে জমে উঠেছে। পাউলিং চেয়ে পাঠালেন ডিএনএর এক্সরে ডিফ্রাকশনের ছবি, উইলকিন্সের কাছে। কিন্তু কোনো ছুতোয় উইলকিন্স এড়িয়ে গেলেন। হয়ত গুরুত্ব না বুঝেই পাউলিং আর এ নিয়ে অগ্রসর হলেন না। ইচ্ছা করলেই উনি ক্যালটেকে তখন এক্সরে ডিফ্রাকশনের ছবি বের করে নিতে পারতেন। বলা হয় লরেন্স ব্র্যাগ নিজের প্রতিদ্বন্দীর থেকে এক ধাপ আগে থাকার জন্যই পাউলিংকে ছবি পাঠাননি।
যাহোক, এ সময়েই একটা যুগান্তকারী আবিষ্কার এই ডিএনএর গঠন উন্মোচনে ব্যস্ত বিজ্ঞানীদের কাজকে প্রভাবিত করে। সেটা হল অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী এরুইন শ্যার্গাফের পরীক্ষা। আলট্রাভায়োলেট স্পেক্ট্রোফটোমিটার যন্ত্রে পরীক্ষা করে উনি দেখালেন যে ডিএনএতে A আর T প্রায় সমপরিমাণে থাকবে, অন্যদিকে একই ভাবে প্রায় সমপরিমাণে থাকবে C আর G। এদের মধ্যে G আর C এর পরিমাণ কিছুটা কম। এই ১:১ এর সূত্রকেই বলা হয় শার্গাফের সূত্র। এই সুত্রের আগে পর্যন্ত সব বিজ্ঞানীই ভেবে আসছিলেন যে এই মূলকগুলো হয়ত সমপরিমাণেই আছে। কিন্তু শার্গাফের পরীক্ষা ও প্রমাণ তাদের নতুন ভাবনাচিন্তা করতে বাধ্য করল।
কিংস কলেজে কিন্তু একনিষ্ঠ সাধিকা রোজেলিন্ড তখনও ক্রিস্টালোগ্রাফি নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন – যদি কোনোভাবে আরো স্পষ্ট ছবি পাওয়া যায় এক্সরে থেকে। উনি দেখলেন ডিএনএ মূলত দুটো রূপে পাওয়া যায় – যাদের উনি নাম দিলেন এ আর বি আকার। এ আকারের ডিএনএ হল আর্দ্র – লম্বা আর সরু সরু। বি আকারেরটি হল শুষ্ক, মোটা আর বেঁটে। রোজালিন্ড গবেষণা চালিয়ে গেলেন বি আকারের ডিএনএর ওপর, আর উইলকিন্স শুরু করলেন এ আকারের ওপর। অসীম ধৈর্য নিয়ে দিনরাত খেটে রোজালিন্ড একের পর এক অসাধারণ এক্সরে ছবি বের করলেন ডিএনএর। এর জন্য তিনি দীর্ঘসময় টানা পর্যবেক্ষণে রেখে ডিএনএ ক্রিস্টালকে ধীরে ধীরে গরম বা ঠান্ডা, আর্দ্র বা শুষ্ক করতেন। ফলস্বরূপ উনি একটা এমন এক্সরে ডিফ্র্যাকশন প্যাটার্নের ছবি পান যেটা এককথায় অতুলনীয়।
আটলান্টিকের ওপারে পাউলিং তখন সদ্য ডিএনএর একটা মডেল প্রস্তাব করেছেন। বিপদ বুঝে কিংস কলেজের সব বিজ্ঞানীদের একত্র করে ডিএনএর কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্যোগ নিলেন পেরুজ। উনি প্রথমেই সব তথ্য একত্রীভূত করতে শুরু করলেন। ফলশ্রুতিতে, রোজালিন্ডের এই ৫১ নম্বর ছবি অপ্রকাশিত অবস্থায় তার অজ্ঞাতেই তার ছাত্র গসলিং-এর হাত থেকে এসে পড়ে উইলকিন্সের হাতে। ডাবল হেলিক্স আবিষ্কারে এটাই সবথেকে বিতর্কিত অধ্যায়। এমনটাও শোনা যায় যে উইলকিন্স নাকি রোজালিন্ডের ড্রয়ার থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন এই ছবি। যদিও এরকম ঘটনা প্রমাণযোগ্য নয়, তাও অনেককাল পরে উইলকিন্সের বক্তব্য থেকেও বোঝা যায় বিতর্কের ঝাঁঝ –
“হয়ত আমার অনুমতি নিয়েই করা উচিত ছিল। অনেকেই বলে থাকেন যে আমি এটা খুবই অন্যায় করেছি – কথাটা হয়ত ঠিকই। সব কিছু স্বাভাবিক থাকলে হয়ত অনুমতি নেবার ব্যাপারটা আসতই না, তবুও … ছবিটা হাতে নিয়েই আমি বুঝতে পারলাম এই হেলিক্সের মত পেঁচানো শৃঙ্খলা আছে এতে। আমি উত্তেজিত হয়ে জিমকে (জেমস ওয়াটসন) বললাম – ‘এই দেখ এখানে একটা হেলিক্স, আর এই গাধা মহিলা চোখে এটাও দেখতে পায় না'”।
লেখাটা প্রকাশের সময় রোজেলিন্ড বেঁচে থাকলে এত সহজে ব্যাপারটা নিয়ে লেখা বা আলোচনা সম্ভব হত কিনা জানি না, তবে কিসের ভিত্তিতেই বা উইলকিন্স ভেবে নিলেন যে রোজালিন্ড হেলিক্স বুঝতে পারছেন না, যেখানে কয়েকদিন আগেই উনি সহকারীদের একটা মস্তবড় ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন? সমগ্র আবিষ্কারের ইতিহাসে এই ছোটো একটা কলঙ্কময় অধ্যায় কি এড়ানো যেত না?
যাহোক, ওয়াটসন আর ক্রিকের হাতে আসা বি আকারের ছবির কথা ক্যাভেন্ডিশে ভেসে আসতেই ব্র্যাগ বুঝতে পারলেন আবার এদের দরকার পড়বে ডিএনএ গবেষণায়। সাথে সাথেই ওয়াটসন-ক্রিককেও আবার তাদের পুরোনো কাজে ফেরানো হল। এইবারে সমস্যাটা থাকে জ্যামিতির। হাতে আছে হেলিক্স আর চারটে মূলক -তাদের একটা গঠন কাঠামোয় ফিট করাতে হবে। ঘনত্ব পরিমাপ থেকে এতদিনে ওয়াটসনের ধারণা হয়েছিল হেলিক্সের সংখ্যা দুই। তাছাড়া কোষ বিভাজনের সময় ক্রোমোজমেরা দুভাগে বিভক্ত হয়েই থাকে – তিন ভাগে নয়। এই দুই তথ্য কাজে লাগিয়ে চলল পূর্ণোদ্যমে আবার মডেল তৈরীর কাজ।
প্রায় একই সময়ে – ১৯৫৩, ফেব্রুয়ারী ২৩এর রোজালিন্ডের ডায়রী থেকে জানা যায় যে উনি তখন স্থিরনিশ্চিত হয়ে গেছেন দুটো হেলিক্সের ব্যাপারে, শুধু তার বেস-পেয়ারটাই খুঁজে পাওয়া বাকি। হয়ত আরেক সপ্তাহের মধ্যে উনি সেটাও খুঁজে বের করে ফেলতে পারতেন।
কিন্তু ভাগ্য বিমুখ, ওয়াটসন ক্রিকই শেষ হাসি হাসলেন। ২৮শে ফেব্রুয়ারির সকালে সব কিছু এক বিন্দুতে এসে মিশল। ওয়াটসনের কার্ডবোর্ডের মডেল পূর্ণ হল। পাওয়া গেল হাইড্রোজেন বন্ধনী যা A-T আর C-Gকে (বেস-পেয়ার) আবদ্ধ করে রাখবে। তৈরী হল দুপাশের দুটো হেলিক্স – সুগার ফসফেটের। এটা ছিল বিজ্ঞানের সাধনায় মানুষের অগ্রগতির একটা বিরাট পদক্ষেপ – বুঝতে ভুল করেননি ওয়াটসন-ক্রিক। মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে বিস্ময়ে দেখছিলেন যে সব কিছুই হুবহু মিলে যাচ্ছে – দুটো শৃঙ্খলা কোষ বিভাজনের সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আর একটার ছাঁচে ফেলে তৈরী হয় অন্যটা। এ ভাবেই একটা থেকে দুটো ক্রোমোজম। ওয়াটসন-ক্রিক এই সাফল্য পেয়েছিলেন কারণ বাকি অনেকেই আগেভাগে ভেবে রেখেছিলেন যে এই অণু অনেক জটিল কিছু হবে – আগে কিছু প্রোটিনের কাঠামো উদ্ধার করে তারপরে এতে হাত দেবেন। আর পাউলিং-এর মত প্রতিভাবানেরা নিয়েছিলেন শর্টকাট। আর সবশেষে আছে রোজালিন্ডের ছবি। কোনোওটিও এর মধ্যে একে অন্যের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর ছিল না।
কিছুদিন ধরে বিভিন্ন বিজ্ঞানীমহলে নিজেদের কার্ডবোর্ডের মডেল দেখিয়ে বেড়ানোর পরে নেচার পত্রিকায় লেখাটা পাঠালেন ওয়াটসন-ক্রিক। লেখা প্রকাশিত হল তিন সপ্তাহ পর – ২৫শে এপ্রিল । পেপারে তারা উইলকিন্সের নামও দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু “যথেষ্ট” অবদান নেই বলে উইলকিন্স নিজেই সরে যান। আর মার্চে ভগ্নমনোরথ রোজেলিন্ড তার পেপার লিখলেন। তাতে উনি সেই ৫১ নম্বর ছবি দিলেন আর লেখা শেষ করলেন এই বলে –
“এভাবে আমাদের প্রাপ্ত ফলাফল ওয়াটসন আর ক্রিকের মডেলের সাথে মিলে যাচ্ছে।”
ভাগ্যের পরিহাসে, কে কার সাথে মেলার কথা – আর ঘটল তার উল্টোটাই। ছবি দেখে মডেল মিলিয়েছিলেন ওয়াটসন-ক্রিক, লেখা বেরোলো উলটো। একেই কি বলে নিয়তি?
ডিএনএর মডেল তো বানানো হল, কিন্তু সেই মডেল যে ঠিক তা কি ভাবে বোঝা যেতে পারে? অণুবীক্ষণ যন্ত্রে দেখে তো বোঝা সম্ভব নয়, আর কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়াতেও ধরা পড়বে না ডিএনএর গঠন। আর এক্সরে ডিফ্রাকশন ব্যবহার করে এমন ছবি তো পাওয়াই প্রায় অসম্ভব যাতে নিশ্চিত করে বলা যায় যে ডিএনএ দুটো তন্তু পেঁচিয়ে তৈরী। এদিকে ম্যাক্স ডেলব্রুকের মত বিজ্ঞানী চট করে মানতে চাইলেন না ওয়াটসন ক্রিকের মডেল। অন্য অনেকেই এই মডেল কে প্রমাণ হিসাবে না নিয়ে একে হাইপোথিসিস বা অনুকল্প হিসাবে নিয়েই এগোতে বললেন। কিন্তু কি ভাবে প্রমাণ করা সম্ভব ডিএনএর গঠনপ্রণালী?
বিজ্ঞানে প্রমাণ যে সবসময় চোখে দেখেই হয় তার কোনো মানে নেই। পরোক্ষ প্রমাণ বিজ্ঞানে একটা অসাধারণ সংযজন। এতে চোখে না দেখেও কিছু পরীক্ষা করে বাকি প্রতিদ্বন্দী গঠনকে এলিমিনেট করে মূল প্রমাণে পৌঁছন সম্ভব। এর জন্য ভেবে চিন্তে নতুন নতুন পরীক্ষা খুঁজে বের করতে হয়। আধুনিক বিজ্ঞানে অধিকাংশ প্রমাণই পরোক্ষে হয়, কারণ মানুষ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের সীমায় প্রায় পৌঁছে গেছে। পরমাণুর কণিকা, বিগ ব্যাং বা ব্ল্যাক হোল – এদের কারোর বিষয়েই চোখে দেখা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। এখানেও সেই একই রকম ঘটল। ওয়াটসন-ক্রিকের মডেলের বৈশিষ্ট্য থেকে বোঝা যায় যে কোষ বিভাজনের সময় ডিএনএর দুটো পৃথক শৃঙ্খলার ছাঁচে পড়ে আবার দুটো নতুন ডিএনএ শৃঙ্খলা তৈরী হবে। যদি এই ঘটনার প্রমাণ আনা যায়, তাহলেই প্রমাণ করা সম্ভব হবে ডিএনএর গঠনের।
লিনাস পাউলিং-এর ছাত্র শিকাগোর আরেক সন্তান ম্যাথু মেসেলসন এগিয়ে এলেন পরীক্ষা করে দেখার জন্য, আর তার সঙ্গী হলেন ফ্রাঙ্কলিন স্টাল । ১৯৫৪ সালে, ম্যাসাচুসেটসের মেরিন বায়োলজিকাল ল্যাবরেটরিতে জেমস ওয়াটসনের নির্দেশনায় তারা তাদের প্রজেক্ট শুরু করলেন। তারা ব্যবহার করলেন সেন্ট্রিফিউজ নামের একটা যন্ত্র। যন্ত্রটা খুবই সাধারণ, একটা টিউবে বিভিন্ন তরল আর তাতে মিশে থাকা বস্তুকে নিয়ে বনবন করে ঘোরালে ভারী বস্ত বাইরের দিকে গিয়ে বেশী হারে জমা হয়, আর হালকা বস্তু ওপরের দিকে থেকে যায়। দুধ থেকে মাখন বের করতে ডেয়ারী শিল্পেও এটি ব্যবহৃত হয়।
যা হোক, মেসেলসন আর স্টাল ই-কোলাই নামক এক পরিচিত প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার নমুনা নিলেন(ছবি)। এবার তাকে ভারী নাইট্রোজেনের (15N) পরিবেশের মধ্যে অনেক প্রজন্ম বংশবৃদ্ধি করতে দিলেন। সাধারণ নাইট্রোজেনের(14N) তুলনায় এটা ভারী। আবার, নাইট্রোজেন ডিএনএর গঠনে একটা অপরিহার্য মৌল। তাই অনেক প্রজন্মের পরে পাওয়া ই-কোলাই নমুনার প্রায় সমস্ত ডিএনএর মধ্যেই তখন ভারী নাইট্রোজেন ঢুকে পড়েছে। এই নমুনার কিছুটা সংগ্রহ করে রাখা হল, নাম দেওয়া হল প্রজন্ম ০। এর পরে সাধারণ নাইট্রোজেনের পরিবেশে বাড়তে দেওয়া হল বাকি নমুনাকে। কিছুক্ষণ পরে পরে তা থেকে কিছুটা করে নমুনা সংগ্রহ করে রাখা হল। এই প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে প্রতি ২০ মিনিট পরে একটি নতুন প্রজন্মের সৃষ্টি হয়, যাতে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা দ্বিগুণিত হয়। সুতরাং, সেইমত নামকরণ করা হল নমুনাগুলোর – প্রজন্ম ০.৩, ০.৭, ১.০, ১.৯, ২.৫, ৩.০ ইত্যাদি। এবার এই নমুনাকে চালান করে দেওয়া হল সেন্ট্রিফিউজে সিজিয়াম ক্লোরাইডের সাথে মিশিয়ে। সিজিয়াম ক্লোরাইড তরলের ঘনত্ব একেবারে সাধারণ ডিএনএর ঘনত্বের সমান। এবার সেন্ট্রিফিউজের স্তর থেকে দেখা গেল, প্রজন্ম ০-এর তুলনায় হাল্কা হয়ে যাচ্ছে পরবর্তী নমুনাগুলো। শুধু তাই নয়, প্রথম প্রজন্মে কিছুটা হাল্কা হয়ে যাবার পরে দ্বিতীয় প্রজন্ম থেকে দুটো ভিন্ন স্তরে জমা হচ্ছে প্রায় সমপরিমাণ ডিএনএর নমুনা, যার মানে এর মধ্যে ভিন্ন ঘনত্বের নমুনা আধাআধি করে মিশ্রিত আছে। আরো যত প্রজন্ম এগোতে থাকে, স্তরের সংখ্যা বাড়ে না কিন্তু হাল্কার স্তরটায় বেশী নমুনা জমা হয়। (ছবি)
সামগ্রিক ভাবে হাল্কা নাইট্রোজেনের উপস্থিতি বাড়তে থাকায় তাদের ওজন কমে চলেছে এটা নাহয় বোঝা গেল, কিন্তু বিভিন্ন স্তর সৃষ্টির কারণ কি? প্রথম প্রজন্মের ডিএনএ তন্তুগুলো সবই ছিল ভারী। ধরা যাক তন্তু ছিল ১০০টা, মানে ডিএনএ ৫০টা। কিন্তু পরের প্রজন্ম গঠন হবার সময়ে নতুন যে তন্তু তৈরী হয়েছে সেটা হল সাধারণ নাইট্রোজেনের তৈরী, তাই এখন সবার মধ্যেই ৫০% সাধারণ আর বাকি ৫০% ভারী তন্তু – কারণ নতুন আরো ১০০টা হাল্কা তন্তু সংশ্লেষিত হবে। তৃতীয় প্রজন্মের ডিএনএ গুলো থেকেই প্রথম স্তর সৃষ্টি। কারণ এবার নতুন তন্তুগুলো (নতুন ২০০টা) সবই সাধারণ নাইট্রোজেনের হলেও পুরোনো তন্তুগুলোর(পুরনো ২০০টা) মধ্যে যে অর্ধেক হাল্কা(১০০টা) আর অর্ধেক ভারী(১০০টা) তন্তু ছিলই। তাই, সবে মিলে, অর্ধেক ডিএনএর উভয় তন্তুই হাল্কা, আর বাকি অর্ধেকের কিছু হাল্কা আর কিছু ভারী। সব মিলিয়ে ৪০০টা তন্তুর মধ্যে ৭৫% এর উভয় তন্তুই হাল্কা(৩০০টা)। এরো পরের প্রজন্মে যখন ৮০০টা তন্তু হয়ে যাবে, মানে আর নতুন ৪০০টা হাল্কা তন্তু নতুন সংশ্লেষিত হবে – তখন ১২.৫% ডিএনএর (১০০টাই থাকবে) মধ্যে হবে মিশ্র ঘনত্ব আর বাকি ৮৮.৫%এর (মোট ৭০০টা) মধ্যে হবে সাধারণ ঘনত্ব। এভাবে ভারী ডিএনএর অনুপাত প্রজন্মের পর প্রজন্মে কমতেই থাকবে। সুতরাং প্রমাণিত হল ওয়াটসন-ক্রিকের মডেল। নোবেল পুরস্কার না পেলেও যে অবদান মেসেলসন আর স্টাল রেখে গেলেন পরোক্ষ প্রমাণের ধারণা চালু করে, তা এককথায় যুগান্তকারী। অন্যদিকে, মডেল নিয়ে বিতর্কেরও অবসান ঘটল। এই পরীক্ষাটাকে জীববিজ্ঞানের ইতিহাসে “সবথেকে সুন্দর পরীক্ষা” বলে আখ্যায়িত করা হয় – সত্যি এটা ছিল এক যুগান্তকারী অথচ খুবই সাধারণ পরীক্ষা। তবে, বৈজ্ঞানিক বিতর্কের এখানেই অবসান ঘটেনি। নেচারে প্রকাশিত পেপারে আর প্রথম বানানো মডেলে বেস পেয়ারগুলোকে দুটো হাইড্রোজেন বন্ধনী দিয়ে আবদ্ধ বলে দেখানো হয়েছিল। অনেকে পাত্তা না দিলেও তা চোখ এড়ায়নি পাউলিং-এর। তিনি আরেকটি পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করেন হাইড্রোজেন বন্ধনীর সংখ্যা। এ নিয়ে পাউলিং এমনকি ব্যক্তিগত চিঠিও লেখেন ওয়াটসন-ক্রিককে – তাদের ভুল শুধরে নেবার জন্য। (সুন্দর অ্যানিমেশনের মাধ্যমে এই সাইটে পরীক্ষাটা বোঝানো আছে)
মুলত এই আবিষ্কারের কল্যাণে ওয়াটসন, ক্রিক আর উইলকিন্স একসাথে নোবেল পুরস্কার পেলেন ১৯৬২ সালে। ততদিনে অকালপ্রয়াত হয়েছেন আরেক স্থপতি – রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন। মাত্র ৩৭ বছর বয়সে ক্যান্সারে মারা যান তিনি, ১৯৫৮ সালে। ওয়াটসনের কথায় –
“নোবেল পুরস্কারের অলিখিত নিয়ম হল একসাথে তিনজনের বেশী প্রাপককে বিবেচনা করা হয় না। ফ্রাঙ্কলিন বেঁচে থাকলে তাকে না উইলকিন্সকে নোবেল দেওয়া হবে – তা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হতই। নোবেল কমিটি হয়ত তাদের দুজনকে যুগ্মভাবে রসায়নে নোবেল দিতে পারতেন। তার জায়গায় রসায়নের নোবেল গেল একই ইন্সটিটিউটের ম্যাক্স পেরুজ আর জন কেন্ড্রুর কাছে – মায়োগ্লোবিন আর হিমোগ্লোবিনের গঠন কাঠামো ব্যাখ্যা করার জন্য। যে কাজের জন্য প্রথমে আমি আর ফ্রান্সিস (ক্রিক) কাজ শুরু করেছিলাম”।
আরো একজন এদের নোবেল-প্রাপ্তিতে অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন – এরুইন শার্গাফ। শার্গাফের সূত্র ছাড়া এই মডেল আবিষ্কার করা একরকম অসম্ভবই ছিল। কিন্তু, নোবেল পুরষ্কার না দিয়ে তাকে শুধু “সম্মানীয় উল্লেখ” নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। কিছুদিনের মধ্যেই বিরক্ত শার্গাফ গবেষণা ছেড়ে দিলেন, আর বিশ্ব জুড়ে বিজ্ঞানীদের এই বঞ্চনা চিঠি লেখা শুরু করেন। আর অভিযোগ হবেই না বা কেন, যেখানে উইলকিন্সের অবদান ছিল শুধু ৫১ নম্বর ছবিটা ওয়াটসন-ক্রিককে দেখানোর মধ্যেই, সেখানে তিনি তো জলজ্যান্ত একটা সূত্রই আবিষ্কার করেছেন। ঘটনা হল, যুদ্ধক্ষেত্রের জিতলে যেমন রাজারই গৌরব, তেমনই বিজ্ঞানীমহলে আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেওয়া হয় পিরামিডের ওপরের কয়েকজন পেপার পাবলিশারকে। তাদের গবেষণা যাদের সূত্র দিয়ে পরিচালিত হয়েছে তারা থেকে যান অবহেলার অন্ধকারেই। এখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটে নি।
তবে রোজালিন্ডকে নিয়ে বিতর্ক উসকে দিয়েছিলেন ওয়াটসন নিজেই। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত বই দ্য ডাবল হেলিক্সে উনি রোজেলিন্ডকে উইলকিন্সের এক সাধারণ সহকারী হিসাবে দেখিয়েছেন, যিনি কথায় কথায় রেগে যেতেন আর সহকর্মীদের আজেবাজে কথা শোনাতেন। আর বিজ্ঞানী হিসাবে তার অবদানকে খাটো করার সমূহ প্রচেষ্টা করেছেন। কিন্তু এতেই হিতে বিপরীত ঘটে। উইলকিন্স আর ক্রিক উভয়েই এর প্রতিবাদ করেন। পরবর্তীতে তার লেখায় আর অতটা রোজালিন্ড-বিদ্বেষ পাওয়া যায় না, তাহলেও সামগ্রিক ভাবে রোজালিন্ডের অবদানের কথা এই তিন বিজ্ঞানী একরকম উল্লেখই করেন না।
এইসব প্রশ্নই উঠে আসে ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত অ্যান সায়েরের লেখা রোজালিন্ডের জীবনীতে। তিনি প্রশ্ন করেন, যখন তথ্য চুরিই করা হল, তখন ওয়াটসন ক্রিকের পেপারে কেন দেওয়া হল না রোজালিন্ডের নাম? রোজালিন্ডের ওই ছবি ছাড়া কি আবিষ্কার হত ডাবল হেলিক্স? নোবেল পুরষ্কার প্রাপক হিসাবে ওয়াটসন আর ক্রিকের যোগ্যতা নিয়ে কারো সংশয় নেই। কারণ নোবেল দেওয়া হয়েছিল “ডিএনএর সঠিক গঠন ও জীবের মধ্যে তথ্যপ্রবাহে এর ভূমিকা” আবিষ্কারের জন্য। এর মধ্যে দ্বিতীয় পর্বটা শুরু হয়েছিল রোজালিন্ডের সাহায্য ছাড়াই, ডাবল হেলিক্স আবিষ্কারের পরেই। এই জেনেটিক কোড নিয়ে কাজ করার সময় তাদের ৫৯টা পাবলিকেশনে কোনোটিতেই রোজালিন্ডের কোনো উল্লেখ ছিল না, অথচ এরা সকলেই ভাইরাস নিয়ে কাজ করতেন। এমনকি তিনজনের নোবেল লেকচারেও কোনোভাবেই রোজালিন্ডের নাম আসে নি। ওয়াটসন-ক্রিক দায়সারা ভাবে পরে জানান যে সহকর্মী হিসাবে উইলকিন্সকেই এই দায়িত্ব দিয়েছিলেন – কিন্তু উইলকিন্সের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক খারাপ হবার কারণে উনি আর ওই পথে হাঁটেননি।
আবিষ্কারের গুরুত্বের মতই আবিষ্কারের পদ্ধতিও এই ডাবল হেলিক্সকে যুগান্তকারী এক তালিকায় স্থান এনে দিয়েছে। কদিন আগেও এক প্রোথিতযশা বিজ্ঞানী বিবিসিতে সাক্ষাতকার দিতে গিয়ে বলেন “ওয়াটসন-ক্রিকের পেপারটা পাবলিশ হয়েছিল একটাও পরীক্ষা না করেই” – অথচ সেই পেপারই কত গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। আর বিজ্ঞানচর্চায় একসাথে মিলে কাজ করার গুরুত্বটা এই আবিষ্কার থেকে আবারো বোঝা যায়। দুই ভিন্ন মেরুর জ্ঞানসম্পন্ন অনুসন্ধিৎসু বিজ্ঞানী যে একসাথে মিলে কতটা এগিয়ে যেতে পারেন, তা জানা যায় ক্রিকের কথায় –
“বিজ্ঞানীমহলে প্রচলিত ধারণা হল জিম জীববিজ্ঞানের কাজটা করেছিল আর আমি করেছিলাম ক্রিস্টালোগ্রাফীর কাজটা। এটা একেবারেই ঠিক নয়। তন্তুর রেপ্লিকেশনের ধারণাটা ছিল আমার, যা আদপে জীববিজ্ঞানের আওতায় পড়ে। আর বেস-পেয়ারিং এর ধারণা হল ওয়াটসনের, যা সাধারণভাবে ক্রিস্টালোগ্রাফি থেকেই আসার কথা।”
আবিষ্কারের কুড়ি বছর পরে বিবিসির সাথে সাক্ষাতকারে (ভিডিও ক্লিপ) ক্রিককে জিজ্ঞাসা করা হয় – আপনি কি মনে করেন আপনি আবিষ্কারে ভাগ্যের সহায়তা পেয়েছিলেন? ক্রিকের উত্তরটা সুন্দর –
“আমরা সত্যিই খুব ভাগ্যবান ছিলাম, খুব একটা চিন্তাভাবনাও করতে হয় নি আমাদের। তবে আমি মনে করি আমরা দুটো বিশেষ কারণে ভাগ্যের সহায়তা পেয়েছিলাম। প্রথমতঃ, আমরা একদম ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় বসে সমস্যাটা সমাধানের চেষ্টা করছিলাম। আর আমরা একসাথে কাজ করছিলেম – একজন যেই মাত্র পথ থেকে সরে গেছে, তখনই অন্যজনে তাকে পথে ফিরিয়ে এনেছে।”
দিগন্ত সরকার, পেশায় কম্পিউটার প্রকৌশলী, মূল আগ্রহ বিজ্ঞান-সংক্রান্ত লেখায়। অর্থনীতি, রাজনীতি বা অন্যান্য বিষয়েও লিখে থাকেন। মুক্তমনার নিবেদিতপ্রাণ সদস্য। বর্তমান নিবাস সিয়াটেল, আমেরিকা। ইমেইল – [email protected]
দিগন্ত, তোমার লেখার ফ্যান আমি অনেকদিন থেকেই, তবে এ লেখাটা কিন্তু অন্য সবগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। এটাই কি করে শেষ পর্ব হয়ঃ) গত ৫০ বছরে evolutionary biology and developmental biology যে বিশাল অগ্রগতি ঘটেছে তা নিয়ে একটা সিরিজ শুরু করে দাও, তাহলে দিব্যি একটা বই হিসেবে বের কররে ফেলা যাবে। বাংলায় এধরনের বইএর বড়ই অভাব, প্রকাশকেরা ঘুরতেছে, লেখক পায় না।
@বন্যাদি,
আমার লেখার পরিকল্পনা এরকমই ছিল। কিন্তু এর পরের পর্ব লিখতে গিয়ে দেখলাম বিষয়টা বিজ্ঞানের বড় গভীরে ঢুকে যাচ্ছে আর গল্প থাকছে না। লেখা টেক্সটবুক বা উইকির মত হয়ে যাচ্ছে। সেজন্য আমি কিছু টুকরো টুকরো গল্প সংগ্রহের চেষ্টায় ছিলাম। কিছু গল্প সংগ্রহও করেছিলাম। আপাতত চাকরি বাঁচানোর সংগ্রামে সেসব পরিকল্পনা হিমঘরে। আশা রাখি সামনের মাসে পরিকল্পনা হিমঘর থেকে বেরোবে আর আমি এর পরের বিষয় বায়োটেকনলজি নিয়ে কয়েক কলম লিখতে পারব।
পড়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।
আমার প্রাণের উৎপত্তি নিয়ে ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে’ আর বন্যা যখন ‘বিবর্তনের পথ ধরে‘ বইগুলো যখন বাজারে বেরুলো তখন আমার একটাই খেদ ছিলো – ডারউইন পরবর্তী বিবর্তনবাদের বিশেষতঃ জেনেটিক্সের ব্যাপারগুলো আমরা বিস্তৃতভাবে লিখতে পারিনি। ডারউইনের পরে জেনেটিক্সের গবেষনা কিন্তু অনেক অনেক এগিয়েছে। এগুলো উল্লেখ না করলে বিবর্তনের চ্যাপ্টার আসলে অসম্পুর্ণই থেকে যায়। দিগন্তের এই মহামূল্যবান সিরিজটি আমাদের সেই আক্ষেপ ঘোচাঁবে। দিগন্তের এই সিরিজটি শুধু অনবদ্যই নয়, আমার মতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের পরিকল্পণা আছে মানব বিবর্তন নিয়ে একটা পূর্ণাংগ বই লেখার (বন্যা এ নিয়ে কিছুটা কাজ শুরু করেছে), আর অনন্তের স্মারক গ্রন্থে বিবর্তনের আধুনিক বিষয়গুলোর উল্লেখ থাকবে বলে আশা করছি।
দিগন্ত সরকার,
সত্যি, দারুন লিখেছেন! আমার এবং আমার ছাত্রদের কাজে লাগবে নিঃসন্দেহে! খুব খেটেছেন। আপনার এই এফোর্ট এর জন্যে অভিনন্দন রইলো।
দিগন্ত, দারুণ খেটে লিখেছেন লেখাটা। খুবই ভালো লেগেছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের সমাহার ঘটিয়েছেন -গবেষণায় কাজে লাগবে অনেকেরই। বাংলায় এধরণের রচনা দুষ্প্রাপ্য – তাই পাঠকদের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
“পাউলিং-এর নিজের কথায় –
“১৯৪৮ সালে আমি যখন লন্ডনে অক্সফোর্ডের অধ্যাপক ছিলাম, একদিন আমার খুব ঠান্ডা লেগেছিল।
…”
দিগন্ত, আপনি এটা কোথায় পেয়েছেনম জানাবেন কি? কারণ, অক্সফোর্ড লন্ডনে নয় । (অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় অক্সফোর্ড shire-এ । উনি কি আসলেই এটা লিখেছেন ? কোন রেফারেনন্স না দেয়াতে চেক করটে পারলাম না ।
আর, আমার জানা মতে Linus এর উচ্চারণ লাইনাস ।
@Ahmed Rana,
আমারই ভুল হয়েছে – “লন্ডনে”-টা বাদ দিয়ে পড়ুন। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ভুলটা ধরিয়ে দেবার জন্য …
রেফারেন্স লিঙ্কটাও পরিবর্তন হয়েছে। বক্তব্যটা আসলে এখানে পাবেন
এখানে বক্তব্যের ভিডিও আর ট্রান্সক্রিপ্ট – দুইই আছে।