এই ব্যাপারটি লিখতে গিয়ে দেখছি- ঠিক গুছিয়ে লেখতে পারছি না। আসলে ছোটবেলাটা জুড়ে বিভিন্ন ঘটনা, বিভিন্ন বিষয়, বিভিন্ন প্রশ্ন এর মিলিত প্রভাবেই আমার অবিশ্বাসের সূত্রপাত- এবং লিখতে গিয়ে বুঝছি এটা অবশ্যই সরল রৈখিক নয়। বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন ঘটনাকে তাই আনতেই হচ্ছে, আর সেগুলো যেহেতু ধারাবাহিক নয়- তাই সেগুলোকে গুছানোর দায়িত্ব পাঠকের হাতে ছেড়ে দেয়া ছাড়া কোন উপায়ও দেখছি না।
ক্লাস থ্রি’র দিকের ঘটনা। পাড়ার মসজিদে ইমাম হুজুর আসরের নামাজের পরে আরবী শেখান। অনেক পিচ্চি-পাচ্চার সাথে আমিও গেলাম। যদিও তখন আমি কায়দা শেষ করে আমপাড়া পড়া শিখেছি, তথাপি সবার সাথে কোরাস করে আলিফ যাবর আ, বা যাবর বা…. এসব পড়তে লাগলাম। যেহেতু পারি- সেহেতু একটু হালকা ভাব ছিল- বসে বসে মাঝে মধ্যে দুষ্টামিও করতাম। এখানে দুটি ঘটনা ঘটে। একটি হলো- প্রথমদিনই আমার নাম শুনে হুজুর জানান দেন যে, এই হিন্দু নাম রাখা চলবে না। শেষ বিচারের দিনে বেহেশতে যাবার শেষ উপায় হলো একটা মুসলমানী নাম, আরবী নাম। আমার নাম পাল্টে তিনি করে দিলেন কবির হাসান। দ্বিতীয় ঘটনা হলো- একদিন পেশ সম্পর্কে পড়াচ্ছিলেন, তো গাইন পেশ হয় “গু”। হুট করে মাথায় আসলো- “গু”। আমি আশপাশের বাচ্চাদের গিয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম গাইন পেশ কি হয়? জবাবে যখন বলছে- “গু” , তখন আমার কি ব্যাপক হাসি। কিন্তু সমস্যা হলো- একজন হঠাৎ করেই হুজুরকে জানিয়ে দেয়, এবং হুজুর প্রচণ্ড রুষ্ট হোন। আরবী ভাষা হলো আল্লাহর ভাষা- সেই ভাষাকে নিয়ে মশকরা! আমাকে দারুন বকা-ঝকা করেন, অনেকগুলো ছেলে-মেয়ের মাঝে খুব অপমান করেন। সেদিন থেকে আর ওখানে যেতে পারিনি।
ঘটনাটি মাথায় থেকে যায়। আল্লাহর প্রতি, আরবী ভাষার প্রতি তখন আমার আসলেই খুব শ্রদ্ধা ছিল; কিছুদিন পরে কোরআন পড়া শিখতে হবে- এমন তাগিদ বোধ করতাম। আমি বুঝতেই পারিনি- গাইন পেশ গু- এটা নিয়ে হাসলে যে আল্লাহ বা আরবী ভাষাকে মশকরা করা হয়! আমি সেরকম মশকরা করার কথা তখন কল্পনাও করতে পারতাম না, সেরকম সাহস আমার ছিলই না।
ঐ বয়সে এই ঘটনা আমার মনের মধ্যে ভালো প্রভাব ফেলে, অনেক দিনই সেই ঘটনার কথা মনে পড়তো, ভাবতাম এবং একসময় এটা মনে হতে লাগলো যে, আরবী ভাষা তো একটা ভাষা বিশেষ, ভাষা ছাড়া কিছুই না- এবং এই ভাষা দিয়ে “গু”-ও লেখা যায়। অনেক পরে যখন দেখলাম আরবী ভাষাতেও গালিগালাজ আছে, অমুক-তমুকের বাচ্চা- বেশ্যা, বিভিন্ন গালিমূলক অঙ্গবিশেষ…. এসবের প্রচলনও আছে; তখন সেই ছোটবেলাকার কথা মনে পড়লে দারুন হাসি পেয়েছিল।
আর, নামের বিষয়টি তো খুব সাধারণ ঘটনা। নাম শোনার পরে- আমি হিন্দু না মুসলমান এই প্রশ্ন এখনো শুনি। ছোটবেলায় স্কুলে এক স্যারকে মুহম্মদ সহকারে আমার নামটি বলায় তিনি জানিয়ে দিলেন- আমার নাম নাকি মুসলমান- হিন্দু এবং খৃস্টান নামের সমাহার। আরেক স্যার আমার বাবার নাম শুনলেন, এটি নির্ভেজাল আরবী নাম। শুনে রায় দিলেন- আমার দাদা তো ভালোই ছিলেন- কিন্তু বাবার মাথায় এমন ভূত চাপলো কি করে? কিশোর বয়সে এসব কিছুই হজম করে যেতে হয়েছে- যদিও তখনও আমি আস্তিক এবং মোটামুটি নিয়মিত নামাজ-রোযা পালনের চেষ্টা করি।
একটা সুবিধা অবশ্য ছিল- সেটা হলো বাবা-মা’র কাছ থেকে একটা জিনিস পেয়েছিলাম- সেটা হলো আমার বাংলা নাম নিয়ে গর্ব। নিজের ভাষায় নাম- কতজনের আছে? আর এটাই আমাকে টিকিয়ে দিল ও নতুন অনেকগুলো প্রশ্নের মুখোমুখি করে দিল।
: বাংলা ভাষা কেন শুধু হিন্দুর ভাষা হতে যাবে? প্রিন্স- ডলার প্রভৃতি ইংরেজী নাম বা উর্দু-ফারসী নাম রাখলে তো তাকে কেউ বলছে না যে আরবি নাম রাখো?
অনেক কিছু মুখ বুজে সহ্য করে গেলেও একটা সময় তর্ক করা আরম্ভ করে দেই। স্যার গোত্রের নয় বা সমবয়সী এমনদের সাথে। ভাষা নিয়ে তর্ক করতে গিয়ে একসময় দেখি যুক্তি করছি: “আরবী তো আমরা বুঝিনা- ফলে নাবুঝে সেটা আউরিয়ে কিভাব আল্লাহর ইবাদত সম্ভব?” তখন থেকে শুরু- নামাজ রোযার নিয়্যত, বিভিন্ন দোআ আরবীর পরিবর্তে বাংলায় পড়া (যদিও নামাজে সুরা আরবীতেই পড়তাম- তারপরেও মনে হতো এটাও বাংলায় পড়লে সমস্যা কি?- এ ব্যাপারে অবশ্য হুজুরদের সমর্থন পাইনি)। এক সময় দেখা গেল- কোরআন খতম দেয়ার আগের সেই উত্তেজনা- আগ্রহ উবে গেল, ৫/৬ পারা শেষ করেছি এরকম অবস্থায় কোরআন পড়া বন্ধ করে দেই; বাংলা কোরআন যোগাড় করি এবং বাংলায় পড়তে থাকি। (আগে সুর করে এবং সহী করে পড়ার ব্যাপারে আমার বিশেষ সুনাম ছিল এবং আমি এতবার কোরআন খতম দিয়েছি- এটা প্রশংসা সহকারে প্রচার করা হতো- ফলে রোযার মাস এলে এই খতমের প্রতি বিশেষ আগ্রহ তো জাগতোই)।
এই বাংলায় কোরআন পড়াটা আমার পক্ষে অনেক সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ করে দেয়।
চলবে
প্রথম মন্তব্যকারির সাথে একমত। লেখা আরও বড় করিতে হইবেক। 🙂
এখনই মন্তব্য করা যাচ্ছে না!
To the Author,
Please tell your Bengali name. Since all this started with your name. Thanks. Enlighten us.
জীবনের এই অভিজ্ঞতাগুলো খুবই প্রয়োজনীয়। ধন্যবাদ এরকম একটি সিরিজ শুরু করার জন্য।
আমার জন্যও একই কথা প্রযোজ্য। আমি অনেকদিন ছাত্রশিবিরের সাথে জড়িত ছিলাম। শিবির তো ক্যাডারভিত্তিক সংগঠন। কুরআন-হাদিস-ইসলামী সাহিত্য নিয়মিত পড়তে হয়, এবং সেটার উপর পরীক্ষা হয়। পরীক্ষায় পাশ করলে এবং আমল-আখলাক ঠিক থাকলেই পরবর্তী শ্রেণীতে উন্নীত করা হয়। সেই সূত্রেই কুরআনের বঙ্গানুবাদ ও তাফসির পড়ার সূচনা। আমার পড়া প্রথম তাফসির ছিল “মা’আরেফুল কুরআন” আর দ্বিতীয় হল মাওলানা মওদুদীর “তাফহিমুল কুরআন”। সত্যি কথা বলি, সে সময় তাফহিমুল কুরআন পড়ে মুগ্ধ হতাম।
সহজ-সরল তাফসিরের পাশাপাশি যখন রাজনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পড়া শুরু করলাম তখনই ঝামেলা বাঁধলো। তাফহিমুল কুরআনে অনেক রাজনৈতিক ব্যাখ্যা ছিল। আর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার জন্য তো নুরুল ইসলাম, জাকারিয়া কামালরা ছিলেনই। এসব পড়েই চিন্তাঝড়ের সূচনা।
লেখা আখারে যুদি আর এখটু বোড়ো ঐতো, ফড়িয়া সুখ পাইতাম।