আজ থেকে প্রায় ১৪০ বছর আগে অর্থাৎ, উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে জার্মানির দুই গণিতবিদ “অনুরূপ মানচিত্রায়ন” (conformal mapping) করার জন্য একটি সূত্র প্রণয়ন করেছিলেন। জার্মান গণিতবিদদ্বয়ের নাম “হেরমান শোয়ার্জ” ও “এলভিন ব্রুনো ক্রিস্টোফেল”। তাদের নামানুসারে এই সূত্রকে “শোয়ার্জ-ক্রিস্টোফেল সূত্র” বলা হয় এবং এই সূত্রের মাধ্যমে যে অনুরূপ মানচিত্রায়ন করা হয় তার নাম দেয়া হয় “শোয়ার্জ-ক্রিস্টোফেল রুপান্তর”। কিন্তু, বহু পুরনো এই সূত্রের মূল সমস্যা ছিল নিয়মিত ও সুষম বস্তুর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা গেলেও অসম বস্তুর ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ করা সম্ভব ছিল না। ২০০৭ সালে ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের ফলিত গণিত বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড্যারেন ক্রাউডি একটি নতুন অংশ সংযোজনের মাধ্যমে শোয়ার্জ-ক্রিস্টোফেল সূত্রের সীমাবদ্ধতা দূর করেছেন। এভাবেই ১৪০ বছরের পুরনো এক গাণিতিক সমস্যার সমাধান হয়েছে। এখন যেকোন ধরণের বস্তুর ক্ষেত্রে অনুরূপ মানচিত্রায়ন প্রয়োগ করা যাবে। ডঃ ক্রাউডি তার গবেষণাপত্রটি “কেমব্রিজ ফিলোসফিক্যাল সোসাইটি”-র মার্চ-জুন ২০০৭ সংখ্যায় প্রকাশ করেছেন।
নিছক সংবাদের পাশাপাশি বিষয়টা স্থূলভাবে বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে। এর জন্যই প্রথমেই বুঝতে হবে অনুরূপ মানচিত্রায়ন কি। শব্দটি থেকেই বোঝা যাচ্ছে, একটি মানচিত্রের অনুরূপ আরেকটি মানচিত্র প্রস্তুত করার নাম অনুরূপ মানচিত্রায়ন। ব্যবহারিক দিক দিয়ে বললে, জুকোভ্স্কি রুপান্তরের কথা ধরা যায়। বিজ্ঞানী নিকোলাই জুকোভ্স্কি একটি সিলিন্ডারের মানচিত্রকে একটি বায়ুতবকের (Airfoil) মানচিত্রে রুপান্তরিত করেছিলেন। অন্য কথায়, তিনি এমন একটি বায়ুতবকের নকশা করেছিলেন যা প্রবাহ ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন বিন্দুতে চাপ ও প্রবাহ বেগের দিক দিয়ে একটি সিলিন্ডারের অনুরূপ। জটিল চলক ব্যবহার করে এই গাণিতিক সমস্যাটি সমাধান করেছিলেন তিনি। নিচের চিত্রে বিষয়টি বোঝানো হয়েছে।
এবার যদি গাণিতিক দিক দিয়ে চিন্তা করি তাহলে অনুরূপ মানচিত্রকে বলতে হবে নিছক একটি অপেক্ষক তথা ফাংশন। ধরলাম w একটি মানচিত্র বা অপেক্ষক। তাহলে:
w = f(z)
এখন z এর মান যদি পরিবর্তন করি তাহলে w এর মানও পরিবর্তিত হবে। আরও ধরে নেই, w দ্বারা নিচের চিত্রের মত একটি ছককে নির্দেশ করে। এখন w তখনই অনুরূপ মানচিত্র হবে যখন z পরিবর্তিত হলেও w এর বিভিন্ন বক্রের মধ্যবর্তী কোণের মান এবং তাদের দিক পরিবর্তিত হবে না। যতই ক্ষুদ্র ছক নেই না কেন মূল ছকের বিভিন্ন রেখার মধ্যবর্তী কোণ এবং তাদের দিক ও আকৃতি কখনই পরিবর্তিত হবে না। তবে আকার পরিবর্তিত হতে পারে।
পাশের চিত্রে যে বিষয়টি জ্যামিতিক ছকে দেখানো হয়েছে সেটাই আগে বায়ুতবক দিয়ে দেখানো হয়েছিল। আগেরটিতে বিষয়টির ব্যবহারিক রূপ দেখানো হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য আমাদের নকশাটাই মুখ্য। অনুরূপ মানচিত্র তৈরী করার পর সে অনুযায়ী বিভিন্ন একই আকৃতি ও সন্নিবেশ কোণ কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন আকারের বস্তু তৈরী করা সম্ভব।
প্রথমে বায়ুতবকের যে অনুরূপ মানচিত্রায়ন দেখানো হয়েছে তা ব্যবহারিক ক্ষেত্রে অনেক কাজে লাগে। কারণ বায়ুতবক মানে হচ্ছে বিমানের পাখা, নৌকার পাল ইত্যাদি। এগুলোর নকশা করতে গিয়ে ব্যবহারটা হতে পারে এমন, সিলিন্ডারের জন্য প্রবাহ ও চাপের সমীকরণ আমাদের জানা আছে। সেটাকেই যদি শুধু বায়ুতবকের জন্য করে নেয়া যায় তাহলেই বিভিন্ন জিনিসের নকশা অনেক সহজসাধ্য হয়ে পড়ে। তাই বিমানের নকশা করতে গিয়ে সবচেয়ে কাজে লাগতো এটি।
কিন্তু উপরের চিত্র থেকেই কিন্তু বোঝা যাচ্ছে, এই সূত্র কার্যকর হওয়ার জন্য পরীক্ষণীয় বস্তুকে কতোটা সুষম ও নিয়মিত হতে হবে। এই সমস্যার কারণেই এতোদিন আরও অনেক ক্ষেত্রে সূত্রটি ব্যবহার করা যেতো না। তাই ডঃ ক্রাউডির আবিষ্কারটি হবে যুগান্তকারী। যেকোন ধরণের বস্তুর নকশাকে মানচিত্রায়নের মাধ্যমে অন্য বস্তুর নকশায় পরিণত করা যাবে। তারপর কেবল বাকি থাকবে নকশা মতো জিনিসটা তৈরী করা। অ্যারোনটিক্সে জটিল পাখার নকশা করার সময় বায়ুপ্রবাহের জন্য যে নকশা করতে হয় তাতে নতুন এই সূত্রের ব্যাপক প্রয়োগ সম্ভব। এছাড়া মানুষের মস্তিষ্কে “গ্রে মেটার” নামের যে জটিল অংশটি আছে তার গঠন বুঝতেও নাকি ব্যবহার করা যাবে এই বর্ধিত তত্ত্ব। আরও অনেক দিগন্তই উন্মোচন করবে অনুরূপ মানচিত্রায়নের এই নতুন তত্ত্ব, প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীদের কাজ হবে নিজেদের প্রয়োজনমতো তা সাজিয়ে নেয়া।
তাই ১৪০ বছর বয়সী গাণিতিক সমস্যাটি এখন আর নেই। বার্ধক্যজনিত মৃত্যুই বলা যেতে পারে একে। আহা! বড় ভালো লোক ছিল।
Leave A Comment