গত বুধবার দুপুর তিনটে। ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে কিছু সিমুলেশন চালাচ্ছি-হঠাৎ আমার রুমমেট ক্রিস মুখ লাল করে ত্রস্ত্র অবস্থায় ঘরে ঢুকে হাঁপাতে লাগল। কি ব্যাপার জিজ্ঞেস করার আগেই ওই বলে দিল-লে-অফ গোইং অন ম্যান! আই ডন্ট নো! আমি আছি-না নেই! আমার বুকটাও ধরাস করে উঠল। চেয়ারটাই আরেকটু চেপে বসলাম-ওটা আছে- কি নেই বোঝার জন্যে।
ব্যাস ওই টুকুই। আমি লে-অফের ব্যাপারে এখন যথেষ্ঠ ভেটেরান। ২০০১ সালের অক্টবর মাসে প্রথম ছোট্ট অভিজ্ঞতা। নিউজার্সিতে একটা স্টার্ট-আপে কাজ করতাম। হঠাৎ একদিন এসে শুনলাম কাল সাতজনকে লে অফ করেছে। তখন কোম্পানিতে সাকুল্যে ৬০জন। পরের দিন আর তাদের দেখা নেই। সেটা মাইল্ড শক। তবুও যাদের তাড়ানো হয়েছিল-এখানে ভদ্র ভাষায় বলে লেট গো-মানে তাদের যাওয়ার অনুমতি দিলাম (!)-তাদের কর্মদক্ষতা প্রশ্নাতীত ছিল না। তাই ভাবলাম আমেরিকাতে এরকম হয়ে থাকে।
জীবনের প্রথম শকিং অভিজ্ঞতা ২০০২ সালের এপ্রিল মাসে। তখন টেলিকম মন্দা গভীরে গভীরতম। প্রতিদিন দুচারটে করে কোম্পানী বন্ধ হচ্ছে। হঠাৎ দুপুরে হিউম্যান রিসোর্স ডিপার্টমেন্ট থেকে মেইল। সি ই ও ক্যাফেটেরিয়াতে মিটিং ডেকেছেন। জানানো হল ৪০% লোক ছাঁটাই হচ্ছে-১০% মাইনে কমছে। কারন দ্বিতীয় রাউণ্ড ফান্ডিং পাওয়া যায় নি। তোমরা ম্যানেজারের কাছে গিয়ে জেনে নাও কে আছ-কে গেছ!
হঠাৎ মনে হল পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেছে। মিটিং ভাঙার সময় অবশ্য আমার ম্যানেজার চাইনিজ মহিলা স্যু জাং জানিয়ে গেল তুমি আছ। তুমি ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দাও। আমার পাশের ঘরটা ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজ্যারের। তার ঘরে লোকে আসছে -যাচ্ছে। তারপর নিজের ডেস্ক পরিস্কার করে এক ঘন্টাতেই সেই কোম্পানীর ক্যারিয়ার শেষ। আমাদের গ্রুপের ছজন এর মধ্যে পাঁচজনকেই ফায়ার করা হয়েছিল। আমি কেন বেঁচেছিলাম জানি না। তবে সেইদিন রাত্রে এসে খেতে পারি নি। ঘুমাতে পারি নি। দেহটা বারবার কেঁপে উঠেছে বিছানায়। এতদিন যাদের সাথে কাজ করলাম তাদের কেও নেই। এর পরেও সেই কোম্পানীতে ৩-৪ রাউন্ড লেঅফ হয়েছে-তখন আমি সিজনড। আর গায়ে লাগত না!
২০০৪-২০০৭ পর্যন্ত আমেরিকার ধার-করা অর্থনীতি ভালোই চলেছে। ফলে মাস লে অফ দেখতে হয় নি। আবার সেই দিনগুলো ঘুরে এল প্রথমে গত বছর অক্টবরে। বহুজাতিক কোম্পানীতে যেমন হয়। টেলিকনফরান্সে মিটিং চলছে। রাও বলে একটি ম্যানেজার ছিল। সেই মিটিংটা ডেকেছিল। হঠাৎ বললো সরি ম্যান- আম লেইড অফ! আই ক্যান্ট কন্টিনিউ! তাকি নাকি তার ম্যানেজার এই মাত্র টেক্সট ম্যাসেজ করে জানিয়েছে।
কি বিচিত্র এই আমেরিকান জীবন। আগে প্রোডাকশনে যখন কাজ করতাম-নীচু তলার লোকগুলোর সাথে মেশার অবাধ সুযোগ ছিল। রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্টে সবাই পি এইচ ডি বলে-সেই সুযোগ মেলে না। এক মেকানিক মুখ গোমরা করে লাঞ্চে বসে থাকত। জিজ্ঞেস করলাম কি ব্যাপার? না চাকরীর সাথে সাথে সুন্দরী বৌটিও পালিয়েছে। এটাই আমেরিকান জীবন। অনিত্য চাকরী-অনিত্য বৌ! সবই ধণতন্ত্রের মায়া বা মমতা।
গতকালই রুপেশকে ফোন করলাম। পরশু যাদের ঘারে কোপ পড়েছে ও তাদের একজন। আমার সাথেই কাজ করত। বস ঘরে ডাকল। সাথে হিউম্যান রিসোর্স ডিপার্টমেন্টের প্রতিনিধি। তাকে জানানো হল, অর্থনৈতিক কারনে আর তাকে রাখা যাচ্ছে না! আর একঘন্টার মধ্যে ডেস্ক পরিস্কার করে, নোটবুক পরিস্কার করে, সিকিউরিটি ব্যাচ জমা দিয়ে বেড়িয়ে যেতে হবে চিরতরে। কর্মদক্ষতার প্রশ্ন এখানে নেই-ও আমেরিকার অন্যতম সেরা ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যালটেকের পি এইচ ডি। তাতে কি? ওর প্রজেক্টটা অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয় আর! কি অবাক ব্যাপার! এই ছেলেটাই গত শনি-রবিবারে অহরাত্র পরিশ্রম করে সিস্টেম থেকে একটা বাগ তাড়িয়েছে-ডেডলাইনের তাড়া! কোম্পানীর জন্যে ডেডিকেশন আর কোনদিন দেখাবে বলে মনে হয় না। আমি আমেরিকাতে দেখেছি-এখানে সবাই পেশাদারি ভাবে কাজ করে। কাজের সাথে এটাচমেন্ট খুব কম থাকে। এখন বুঝি কেন। কেনই বা করবে!
আমি আর ক্রিস আলোচনা করছিলাম। ও বার বার বলতে লাগল এই রুদলেস কর্পরেট জীবন অর্থহীন। এইভাবে জীবনে বাঁচা যায় না। বেশ রাগের স্বরেই বলছিল। আমি অবশ্য শান্ত। কারন আমি জানি উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকেই শ্রমিক শ্রেনী ক্রিসের কথাটাই বলেছে। শ্রমিক শ্রেনীর সেই দুর্দশার কথা মার্ক্স এবং এঙ্গেলেসের রচনায় বারবার এসেছে। হিটলারের মেইন ক্যাম্পেও এসেছে। মুশোলিনীর ফ্যাসিবাদ বা ন্যাশানাল স্যোশালিজমেও এই একই কথার প্রতিধ্বনি। কারন রিশেসন এবং তার জন্যে শ্রমিক শ্রেনীর কাজ হারানো নতুন কিছু নয়-এই রকম সাইকেল বারে বারে এসেছে। শ্রমিকরা বারে বারে ক্ষোভে ফেটে পড়েছে-এবং মার্কেট ফিরলে-আবার কাজে ফিরেও গেছে। দুদিন বাদে ক্রীসও শান্ত-যেন এমন হয়েই থাকে। শ্রমিকদের ক্ষোভ এই ভাবেই হারিয়ে গেছে।
(২)
উনবিংশ শতাব্দির প্রথম দিক। ইউরোপে ধনতন্ত্রের স্বর্ণযুগ। শিল্প বিপ্লব এবং স্টিম ইঞ্জিনের চাকায় অভাবনীয় গতিতে বাড়তে থাকে উৎপাদন এবং জনগনের জীবন যাত্রার মান। কিন্ত এর সাথে সাথেই যৌথ পরিবার ও প্রাচীন কমিউনিটি ভেঙে গেল। ভেঙে গেল চিরচারিত সামাজিক ভাবে বেঁচে থাকার স্বাশ্বত মুল্যবোধ এবং পদ্ধতিগুলো। ধনতন্ত্রে মানুষ পেল আরো বেশী ব্যাক্তি স্বাধীনতা। রক্ষনশীল সমাজ থেকে মুক্তি। কিন্ত উলটো দিকটা হচ্ছে-মানুষ সমাজ এবং বৃহত্তর পরিবার থেকে আরো বেশী বিচ্ছিন্ন । এর মধ্যেই মালিক শ্রেনীর হাতে বিপুল অর্থ জমা হওয়া শুরু হয় এবং শ্রমিক শ্রেনীর দুর্দশার সীমা থাকে না।
এই পরিস্থিতিতেই মার্ক্স এবং এঙ্গেলেস আশার আলো শোনালেন। পুজিবাদ যে সিস্টেম তৈরী করছে-তা টিকবে না। মালিক-শ্রমিক দ্বন্দের কারনেই ভেঙে পড়বে। সমাজতন্ত্র আসবে। আপনা-আপনিই আসবে-সমাজ বিবর্তনের ইতিহাস মেনে। শোষিত নিপীড়িত মানুষের কাছে দৈববাণীর মর্যাদা পেল তার অমৃত বচন।
১৮৮০ সাল পর্যন্ত সবাই অগাধ আস্থা রেখেছে মার্ক্সের তত্ত্বে। নিদারুন প্রতীক্ষার প্রহর গোনা- কবে শ্রমিক শ্রেনীর বিদ্রোহ এবং ধণতান্ত্রিক সমাজের আভ্যন্তরীন দ্বন্দের জন্যে সমাজতন্ত্র এসে সবাইকে মুক্তি দেবে!
সেরকম কিছু যখন হল না। পুজিবাদ প্রতিটা রিশেসন সাইকেল কেটে বেড়িয়ে আসছিল নতুন কোন কোন আবিস্কার বা যুদ্ধের মাধ্যমে। কিছু কিছু সমাজতন্ত্রী মার্ক্সীয় তত্ত্বের ভিত্তিকেই প্রশ্ন করতে লাগলেন। মার্ক্সীয় তত্ত্ব অনুযায়ী সমাজ পরিবর্ত্তনের চালিকা শক্তি-উৎপাদন ব্যাবস্থার পরিবর্ত্তন। উৎপাদন ব্যাবস্থার পরিবর্ত্তনের মধ্যে দিয়েই সমাজের পরিবর্ত্তন সুচিত হওয়ার কথা। সেটা হচ্ছিল। তবে পুজিবাদ আরো উন্নততর পুজিবাদের পথে এগিয়ছে প্রযুক্তি এবং শ্রমিকদের সুবিধা বাড়িয়ে। ফলে ক্রাইসিস থেকে বিপ্লব আসে নি-উন্নততর পুঁজিবাদ এসেছে মাত্র। এডুয়ার্ড বার্নস্টেইনের মতন কিছু সমাজতন্ত্রী বললেন বিপ্লব টিপ্লব হবে না। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই শ্রমিক শ্রেনী সরকারকে চাপ দিয়ে শ্রমিক সুরক্ষা আইনগুলি রাষ্ট্রে আনবে। বিপ্লব না সংস্কার এই নিয়ে ১৮৮১ সাল থেকেই সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে বিতর্ক চলছে। ১৯০০ সালে রোজা লুক্সেমবার্গ বার্নস্টেইনের তত্ত্বকে খারিজ করার অভিপ্রায়ে লিখলেন-স্বতস্কুর্ত বিপ্লবের তত্ত্ব। ১৮৮৯ সালের দ্বিতীয় ইন্টারন্যাশানাল থেকেই অবশ্য এই বিবাদ সামনে চলে এসেছে।
এর পরেও অনেক গল্প আছে। রাশিয়াতে স্যোশ্যাল ডেমোক্রাট বনাম বলশেভিকদের গৃহযুদ্ধ শুরু হয় ১৯১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে। লেনিন ভোটে হেরে গিয়ে কনস্টিটুয়েন্সি এসেম্বলী ধ্বংস করলেন এবং রাশিয়াতে লাল সন্ত্রাস নেমে এল। রাশিয়ান সিক্রেট পুলিশ ১৯১৮ সালে ৬০০ জন বিখ্যাত স্যোশাল ডেমোক্রাটকে হত্যা করে ‘রাশিয়ান বিপ্লব’ ঘটাইল। বিপ্লবী ফ্যাকশন রাশিয়াতে জয়লাভ করিল!
অন্যদেশে এর ফল হয়েছে হিতে বিপরীত। ১৯১৭ সালের আগে জার্মানী, ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডে বিপ্লবী তত্ত্বের সাপোর্টার ছিল অনেক বেশী। ১৯১৭ সাল থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত, লাল সন্ত্রাসে যেভাবে কৃষকহত্যা এবং জোর করে ফসল দখল করার অত্যাচার চলে-তার সংবাদ গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়তেই বিপ্লবী গোষ্ঠি ইউরোপের অন্যত্র দুর্বল হয়। ভারতের কমিনিউস্ট আন্দোলন ও এই ভাবেই দুর্বল হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে কমিনিউস্টরা ক্ষমতায় আসতে, ভারতের অন্য রাজ্যে কমিনিউস্ট পার্টির যে বিশাল ডেডিকেটেড বেস ছিল-তা দ্রুত লুপ্ত হতে থাকে। কারন কমিনিউস্টদের হাতে পশ্চিম বঙ্গের দুর্দশা দেখে সেই সব কমিনিউস্ট কর্মীদের মোহভঙ্গ হয়। ইউরোপে এই সময়টা ছিল ১৯১৭ থেকে ১৯২০ সাল। বলশেভিক বিপ্লবের নামে যেভাবে শ্রমিক এবং কৃষকরা অত্যাচারিত হয় এবং লেনিন যেভাবে গণহত্যা চালান, ফ্রান্স, জার্মানী এবং ইংল্যান্ডে বিপ্লবে বিশ্বাসী গোষ্ঠির পালে হাওয়া ঊবে যায়। রোজা লুক্সেমবার্গ স্পার্টকাস লীগ নামে বিপ্লবী পার্টি তৈরী করে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ্বত্তোর
জার্মানীতে বিপ্লব সংগঠিত করতে গিয়ে বেঘোরে মারা পড়লেন। পেছনে জন সমর্থন ছিল না। কর্মহীন শ্রমিক শ্রেনী ক্রুদ্ধ ছিল সন্দেহ নেই-কিন্ত রাশিয়াতে কমিনিউস্টদের অত্যাচার নিয়েও তারা অবহিত ছিল। এতেব কমিনিউস্ট পার্টি সেখানে জনপ্রিয়তা পেল না।
সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে এই বিভেদ এবং রাশিয়ান বিপ্লবের মোহভঙ্গের জন্যে উত্থান হয় জাতীয়তাবাদি শক্তির। আসল কারনটা সেই ধণতন্ত্রে শ্রমিক শ্রেনীর দুরাবস্থা। এবং তা দূর করতে সমাজতন্ত্রের ব্যার্থতা। কমিনিউস্টদের ব্যার্থতাকে কাজে লাগিয়ে ১৯২১ সালে হিটলারের উত্থান। জাতীয়তাবাদ এবং সমাজতন্ত্রের মিশ্রনে, আমেরিকা, ফ্রান্সকে জার্মানীর শত্রু বানিয়ে-শ্রমিক শ্রেনীকে আশা দেখাতে লাগলেন। শ্রমিক শ্রেনীর দাবি মেটাতে হিটলার সম্পূর্ণ সফল। ১৯৩৩ সালে জার্মানীতে বেকারত্বের সংখ্যা ছিল ৩৩%। ১৯৩৬ সালে বেকারত্ব থাকলই না। মুসোলীনিও একই ম্যাজিক দেখালেন। ইতিহাসের এই সময়টাতে পৃথিবীর সবদেশে জাতিয়তাবাদি শক্তির উত্থান হয়েছে। ধনতন্ত্রে মানুষকে যেভাবে সমাজ থেকে, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়-তার প্রতিবাদি ধারনা থেকেই জাতিয়তাবাদের জন্ম। জাতিয়তাবাদ ধনতন্ত্রের জন্যে ক্ষতিকারক। কারন পুঁজির দেশ থাকতে পারে না-তাহলে পুঁজির বৃদ্ধি আটকে যাবে। ঠিক এই সময়েই হিন্দু মহাসভাও ভারতে সক্রিয় হয়। রাষ্ট্রীয় সমাজ সেবক সংঘের প্রতিষ্ঠার পেছনে সেই হিটলারি সাফল্য।
হিটলার এবং মুসোলিনীর বিভৎস মুখোস খসে পড়তে জাতিয়তাবাদী চিন্তাও মুখ থুবরে পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্ত্তী সময়ে। ফলে ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত কেইনসিয়ান অর্থনীতির মাধ্যমে গনতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র সব দেশেই গ্রহীত হয়। ভারতে নেহেরু তথা কংগ্রেসও গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের পথেই দেশকে চালনা করে। কিন্ত ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক নির্ভর অর্থনীতি সমস্যার সম্মুখীন না হলেও-বৃদ্ধি হচ্ছিল শম্বুক গতিতে। ফলে একটু একটু করে উদার নীতি চালু করা হল বৃটেনে এবং আমেরিকায়। যেটাকে এখন থ্যাচারিজম বা রেগনিজম বলে। প্রথম প্রথম ফল হল দুর্দান্ত। অর্থনীতি বাড়তে লাগল দ্রুতগতিতে। কারন প্রযুক্তির ডিরেগুলেশনের ফলে ইলেকট্রনিক চীপ, কম্পুটার, লেজার, ইন্টারনেট, অপটিক্যাল ফাইবার-সব কিছুর রুদ্ধশ্বাস উত্থান হল এই উদার বাজারনীতির ফলস্বরূপ।
কিন্ত ফাটকাবাজরা কি আর বসে থাকে? শেয়ার মার্কেটের উর্ধগতিকে কাজে লাগিয়ে তারাও বাড়ি থেকে শুরু করে সমস্ত বাজারের দাম নিয়ন্ত্রন করা শুরু করে। ব্যপারটা হল এই রকম । আমেরিকাতে ২০০১ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমেছে-ইনফ্লেশন এডজ়াস্টেড ইনকাম কমেছে-অথচ বাড়ির দাম বেড়েছে তিনগুন। সম্পুর্ন ফাটকাবাজি। ডিরেগুলেটেড মার্কেট-এতেব এক্সপার্টদের অবজ্ঞা করে বাজারকে মুক্তই রাখা হল। বোনাসের লোভে ব্যাঙ্কের সি ই ও থেকে ম্যানেজমেন্টের সবাই-ব্যাঙ্কটাকেই ল্যাম্পপোস্টে ঝুলিয়ে দিলেন স্পেকুলেশন টাকা খাওয়ার লোভে।
আসলে ব্যাপারটা এই রকম। উৎপাদন না বাড়লে ত বাড়তি টাকার মূল্য নেই। এবার উৎপাদনে কি যায় আস? আসল ব্যাপারত লাভ। ফলে একই উৎপাদনে লোককে টাকা ধার দিয়ে , উৎপাদিত দ্রব্য-যেমন ধরুন বাড়ির দাম কৃত্রিম ভাবে বাড়ানো হল।
না আমেরিকার জনগনের কিছু লাভ হয় নি এতে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য এমনকি খাদ্যেও আমেরিকা পৃথিবীর কাছে পিছু হটেছে।
আসলে হয়েছে কি-১৯৮০ সাল থেকেই পৃথিবীতে জাতিয়তাবাদ এবং ধর্মের ককটেলের আবার উত্থান হতে থাকে নানান রক্ষনশীল পার্টিগুলির মাধ্যমে। একই সাথে রেগন, থ্যাচার এবং ভারতে বিজেপির উত্থান কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। গণতন্ত্রে কোন পার্টি ধণতান্ত্রিক হতে পারে না। কারন ভোটার সবাই শ্রমিক শ্রেনীর। ফলে জনগন সব সময় এই ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে। গণতন্ত্র ঠিক ঠাক চললে মালিক শ্রেনীর অস্তিত্ব থাকারই কথা না।
তাহলে ধনতান্ত্রিক শোষন কি করে বজায় রাখা যায়? এই ক্ষেত্রে মানুষের কিছু আদিম প্রবৃত্তি-যেমন দেশ এবং ধর্মের প্রতি টান-যা আদতেই সামাজিক পরিচয়বোধের সংকট-সেই আইডেন্টি-আমি আমেরিকান এবং খ্রীষ্ঠান-আমি ভারতীয় এবং হিন্দু-এই সব পরিচয়বোধ কাজে লাগিয়ে এবার জাতিয়তাবাদ ফিরে এলো ধনতন্ত্রের বিরোধিতা করে নয়-হাত ধরে। উল্লেখ্য হিটলার এবং মুসোলীনিকে মালিক শ্রেনী সহায়তা করলেও হিটলারের মেইন ক্যাম্পে শোষিত শ্রমিকের দুঃখের কথা ছত্রে ছত্রে । তার জন্যে হিটলার ধণতন্ত্রকেই দায়ী করেন। নাজি জার্মানীতে উৎপাদিত দ্রব্যের দাম, শ্রমিকদের মাইনা-সবকিছুই রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রন করত। এবার ১৯৮০ সালের জাতিয়তাবাদের উত্থান হয়েছে সম্পূর্ণ অন্য পটভূমিকায়। সেটা হচ্ছে সব দেশে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র দ্রুত উন্নতি করতে বা অর্থনীতিকে সচল করতে ব্যার্থ হয়ে এক সমাজতন্ত্র বিরোধি প্ল্যাটফর্ম তৈরী করে। ধণতন্ত্র নিজেত কোনদিন একাকী গণতন্ত্রে ঢুকতে পারে না। মালিক শ্রেণীকে ভোটাররা পছন্দ করে? ফলে ধর্ম এবং জাতীয়তাবাদের সুড়সুরি দিয়ে ঢুকে গেল উদার বাজার অর্থনীতি। সেটাই রেগনিজম বা থ্যাচারিজম।
১৯৯১ সালে সোভিয়েতের পতনে কমিনিউজমের বিভৎস ঘৃণিত ইতিহাস আমরা জানতে পারি। এর সাথে পৃথিবীর নানান দেশে স্যোশাল ডেমোক্রাটদের নতুন চিন্তাভাবনার অভাব এবং দুর্নীতি, মানুষের প্রত্যাশা মেটাতে ব্যার্থ হয়। ফলে সমাজতন্ত্র বিরোধি ক্ষেত্র প্রস্তুত ছিল। জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মের ঘৃণ্য সুড়সুরির মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে, উদার অর্থনীতিকে বল্গাহীন গতিতে চালিয়ে দিলেন রেগান এবং থ্যাচার। স্যোশাল ডেমোক্রাটদের এই রথ থামানো সম্ভব ছিল না। ১৯৯০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত মুক্তবাজার অর্থনীতি নতুন প্রযুক্তির ঘারে চেপে দ্রুত গতিতে বাজার এবং অর্থনীতির বৃদ্ধি করতে থাকে। সেই শ্রোতের বিপরীতে হাঁটা ডান, বাম, মধ্যম -সবার পক্ষেই ছিল অসম্ভব। নিও লিব্যারালিজম আইস ল্যান্ডের মতন একটা ইউরোপের গরীবদেশকে সবথেকে উন্নত দেশে পরিণত করে। আজকে অবশ্য তাদের ব্যাঙ্ক ফেইলড। তারা যে তিমিরে ছিল-মানে মাছ ধরছিল-আবার মাছ ধরাতেই ফিরে গেছে!
অর্থাৎ কমিনিউজম এবং গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ব্যার্থতা যে শুন্যতা সৃষ্টি করে-তার ফাঁক দিয়েই এই উদার অর্থনীতি বা মুক্তবাজার অর্থনীতির উত্থান এবং প্রথমের দিকে চমকপ্রদ সাফল্য। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সাফল্য অভাবনীয়। কিন্ত এর মধ্যেই ফাটকাবাজরা মার্কেট এবং রাজনীতির সম্পুর্ন দখল নিয়েছে জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মের সুরসুরি দিয়ে-অথবা স্যোসাল ডেমোক্রাটদের দুর্নীতির সুযোগ নিয়ে। ফলে আজকের এই মন্দা।
প্রতি মাসে একমিলিয়ান আমেরিকান চাকরি হারাচ্ছেন।
(৪)
তাহলে সামনের পথ কি?
কমিনিউজমে গণতন্ত্রের অভাব মানুষকে পশুতের স্তরে নামিয়ে নিয়ে যায়। ওটা ফ্যাসিজমের আরেকটা সুগারকোট ।
জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় জাতিয়তাবাদ –ধণতান্ত্রিক মালিক শ্রেনীর প্রক্সি।
গনতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র অর্থনীতির বৃদ্ধি এবং চাকরী সৃষ্টিতে অক্ষম। নতুন প্রযুক্তির আমদানীতে ব্যার্থ।
সবই দেখা যাচ্ছে পরীক্ষিত ভাবে ব্যার্থ। তবুও এর মধ্যে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে অর্থনীতিতে ধীরগতিতে উন্নয়ন হলেও-মানুষের জীবন সব থেকে বেশী সুরক্ষিত থেকেছে। মানুষ উদার অর্থনীতিতে যত বড়লোক হয়েছে-সেরকম কিছু হয় নি-কিন্ত চাকরী, জীবনযাত্রা ও বাকস্বাধীনতা অক্ষত থেকেছে।
অর্থাৎ আমরা যদি এখন নতুন পথের সন্ধান করতে চাই-তাহলে আমাদের চাহিদা গুলোকে সামনে রেখেই এগোতে হবে। তত্ত্ব ধরে এগোলে কিছুই হবে না।
সেটা মোটামুটি এই
- চাকরী এবং জীবিকার সুরক্ষা। পেনশনের সুরক্ষা।
- বাজারমুখী নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনকে চালু রাখা। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে সোভিয়েত কি প্রযুক্তিতে পিছিয়ে ছিল? হ্যাঁ মানুষ মারার প্রযুক্তিতে সোভিয়েত এগিয়ে ছিল বটে-কিন্ত ঔষধ, ইলেকট্রনিক্স, কম্পুঊটার-যা মানুষের কাজে আসে-তাতে সোভিয়েত ইউনিয়ান ডাঁহা ফেল করেছে।
অর্থাৎ দুটো জিনিস খুবী গুরুত্বপূর্ন। প্রথমটা হচ্ছে বাজারের বৃদ্ধি হয়-এমন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন। এবং দ্বিতীয়টা হচ্ছে সামাজিক সুরক্ষা। এর মেলবন্ধনেই কেবল নতুন পথের সন্ধান মিলবে।
এটাকেই তৃতীয় পথ বলা হচ্ছে। বিল ক্লিনটন, টনি ব্লেয়ার এই পথের শুরু করেন। ওবামা এখন বাধ্য হচ্ছেন এই পথে হাঁটতে। একদিকে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে ব্যাপক রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ করে শক্তি, খাদ্য ইত্যাদির সমস্যা মেটানো। উৎপাদন বৃদ্ধি করা। চাকরী বাড়ানো নতুন প্রযুক্তি ক্ষেত্র খুলে দিয়ে। অন্যদিকে বাজারের ওপরে বিশেষত ফাইন্যান্স এবং ব্যাঙ্কিংকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রনে আনা। কারন এদের মুক্তবাজারের নামে ছেরে দিলে-এরা দেশের অর্থনীতিতে আবার লাল-বাতি জ্বালাবে। ভুগবে সাধারন লোক। তাই ফাইনান্সিয়াল মার্কেট রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রনে থাকা দরকার। অবশ্য রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রনে ব্যাক্তিগত উদ্যোগে কোন ক্ষতি নেই। যদিও এটা এখনো আছে। কিন্ত আইনগুলো মানা হয় না। প্রযুক্তি ক্ষেত্রে আবার রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রন শিথিল করতে হবে। কারন সেখানে লাল ফিতের বাঁধনে, নতুন প্রযুক্তি আসা ব্যাহত হবে। এখানে সরকারের কাজ শুধু টাকা জোগানোর। বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিল্প সংস্থাগুলি যৌথভাবে এই কাজ করবে।
অর্থাৎ এখানে প্রকারন্তারে মার্ক্সকে মেনে নেওয়া হল। উৎপাদনের পদ্ধতিই যে সমাজের চালিকা শক্তি-সেটাকেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে এই তৃতীয় পথে। বার্নস্টাইন বা রোজা লুক্সেমবার্গ-কারুর কথাকেই মানা হল না-স্বতস্ফুর্ত বিপ্লব বা শুধু রাজনৈতিক সংস্কার-এর কোনটাই মানুষকে উন্নততর সমাজ দিতে পারে না। এগুলো পরীক্ষিত সত্য। কিন্তু এখানে মানা হচ্ছে প্রযুক্তি, বিজ্ঞানমুখী শিক্ষা এবং সাধারন মানুষের মধ্যে তার ব্যাপক ব্যাবহার আসল সমাজবিপ্লব আনে।
আমি ওবামার সেই তৃতীয় পথের দিকেই তাকিয়ে আছি।
সবাই কি একই অসুবিধা ভোগ করছেন? ফন্ট নিয়ে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার চেষ্টা করছি। আগে আমাদের সাইটের ডিফল্ট ফন্ট হিসবে রূপালী ব্যবহার করতাম। ওটা ব্যবহার করেই ইওটি ফাইল তৈরি করা হয়েছিলো। কিন্তু রূপালীর ইংরেজী অক্ষরগুলো এবরো থেবরো আসে। অনেক পিসিতে দেখাই যায় না। স্কয়ার স্কয়ার ব্লক আসে কেবল। সেজন্য অন্য ফন্ট-এর দিকে ঝুঁকতে হচ্ছে। এবারের ফন্ট সোলায়মানলিপি। ফন্ট টা নাকি হট! অনেক ব্লগ সাইটেই ব্যবহার করা হচ্ছে। তাই এই ফন্ট নিয়ে গুঁতোগুঁতি। দেখা যাক কি আছে কপালে!
আর যারা ফন্ট দেখতে পাচ্ছেন না, তারা এই লিঙ্ক থেকে রূপালী আর সোলায়মান লিপি ডাউনলোড করে নিন। এছাড়া এই লিঙ্ক থেকে কম্পলেক্স স্ক্রিপ্ট রান করুন।
পড়া যাচ্ছেনা। লেখা অস্পষ্ট দেখছি। সাহায্য চাই।
তবে বলে রাখি, আমার চোখে কোন সমস্যা নেই।
There is no shortage of people filled with natioanal pride in every country and nation. Didn’t you ever sing D L Roy’s “সকল দেশের সেরা—”
দেশপ্রেম, ধর্মপ্রেম, জাতিপ্রেম-এইসব প্রেমিকদের নিয়ে আমি আজকাল বড়ই ভীত।
To Mr.Biplab,
Its a nice article and thorough analysis. But I still think many Americans are not aware of the reality of the world, they are still snobbish (or, arrogant) under the surface. They are in a denial mode. What is your opinion in this regard. When I was a student in USA, I used to visit a nearby bar/pub and used to play pool. Army People from the nearby military camp also used to come. One day, the army person told me , America rules the world etc etc. What do you think. Thanks for the indepth analysis.