খালেদা জিয়ার জন্মদিন ও বিবর্তনবাদ
সগীর আলী খাঁন
বিজ্ঞানীরা চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদকে গত মিলেনিয়ামের সর্বশ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক থিওরী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এমনকি আইনষ্টাইনের সুবিখ্যাত রিলেটিভিটির সুত্রও হেরে গেছে বিবর্তনবাদের কাছে। বিখ্যাত এই থিওরীর মুল প্রতিপাদ্য হচ্ছে – ‘গ্রহ-নক্ষত্র-তারকাপুঞ্জ-জড়-জীব-ধর্ম-সমাজ এক কথায় এই বিশ্বব্রম্মান্ডের সবকিছু প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। সৃষ্টির আদ্যিকাল থেকে এই বিবর্তন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এবং একটি অব্যাহত প্রক্রিয়া হিসেবে এখনও তা চলছে, ভবিষ্যতেও চলবে। প্রকৃতির এই অমোঘ নিয়মের সাথে যে যতো বেশী খাপ খাইয়ে চলতে পারবে, সে টিকে থাকবে, যে পারবে না সে বিলুপ্ত হবে। মনুষ্য সমাজও এই বিবর্তনের ধারা থেকে মুক্ত নয়। রাজনীতি যেহেতু মানব সমাজেরই একটি সক্রিয় আচরণ, সুতরাং রাজনীতিতেও অবধারিতভাবে এই প্রাকৃতিক নিয়মের প্রভাব পড়বে – এটিই স্বাভাবিক। তবে দুঃখের বিষয়, ডারউইনের এই চমৎকার থিওরীটি বাংলাদেশের পলিমাটির রস খেয়ে কেমন যেন পাল্টে গেছে। পাঠক, লক্ষ্য করুন- পঞ্চাশ ষাট দশকের রাজনীতির সাথে বর্তমান কালের রাজনীতির কতোই না প্রভেদ। সেকালের রাজনীতিবিদরা সারাজীবন রাজনীতি করে নিঃস্ব হতেন, বর্তমানকালের রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করে নিঃস্ব অবস্থা হতে রাতারাতি কোটিপতি বনে যান। এর নাম নাকি আর্থ-রাজনৈতিক বিবর্তন। এদেশে বিবর্তন প্রসেসের সাথে সবচেয়ে বেশী অভিযোজন করতে পেরেছে বিএনপি নামক দলটি। বিএনপি’র প্রধান প্রতিদ্বন্ধী আওয়ামী লীগ এক্ষেত্রে হাজার যোজন পেছনে। কীভাবে?
নীচের পয়েন্টগুলি বিবেচনা করে দেখুনঃ
১- বিবর্তনবাদের বাংলাদেশ-মডেলে সবচেয়ে বেশী ফায়দা নিয়েছে বিএনপি’র চেয়ার-পার্সন আপোষহীন দেশনেত্রী ম্যাডাম খালেদা জিয়ার জন্ম তারিখটি। তার জন্মতারিখ আসলে কোনটি? তার জন্মদাতা জনাব ইসকান্দার মিয়ার ভাষ্যমতে তার কনিষ্ঠা কন্যা বেগম খালেদা খানম ওরফে পুতুলের জন্ম হয়েছিল ১৯৪৫ সালের ৫ই সেপ্টেম্বার, যেদিন ২য় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছিল ঠিক সেদিন (পাঠক মনে রাখবেন, মহামানব বা মহামানবীদের জন্ম সাধারনত বিশেষ দিনে হয়। চেরাগ আলী ছগিরালিদের মতো সবদিনে হয় না। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে ধরাধামে শান্তি আসল যেদিন, সেদিনটি নিঃসন্দেহে ম্যাডাম জিয়া নামক মহামানবীর জন্মগ্রহনের সবচেয়ে উপযুক্ত দিন)। কে কবে জন্ম নিয়েছে, তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত স্বাক্ষী হচ্ছে বাপ-মা। সুতরাং ম্যাডামের প্রথম জন্মতারিখ যে সেপ্টেম্বার মাসে তাতে কেউ সন্দেহ পোষণ করবেন না আশা করি, যদিও রাজনৈতিক বিবর্তনের ফলে এই তারিখটি যে কোন সময় পরিবর্তনের হক্ রাখে।
২- এর পরের দৃশ্যটি ১৯৫৪ সালের, যেদিন তার পিতৃদেব তাকে দিনাজপুর সরকারী বিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেনীতে ভর্তি করান। ম্যাডামের বয়েস তখন মাত্র নয় বছর, নাক দিয়ে সিনকি ঝরা বয়স। সেখানেও সিকান্দার মিয়া মেয়ের জন্ম তারিখ লিপিবদ্ধ করান ৫ই সেপ্টেম্বার, তবে জন্মসালটা এক বছর কমিয়ে ১৯৪৬ সালে নিয়ে আসেন। আমাদের সমাজে এ এক প্রচলিত প্র্যাক্টিস, আমরা সবাই স্কুলের কাগজপত্রে বয়েস দু’এক বছর কমিয়ে দেই। লক্ষ্য করুন, এই পর্বে বিবর্তনের হার খুব বেশী নয়, নয় বছরে মাত্র এক বছর। তবে জন্মের মাসটিতে বিবর্তনের কোন ছোয়া লাগেনি, সেপ্টেম্বারের ৫ তারিখেই স্থির আছে সেটি।
৩- পরবর্তী পর্ব ১৯৭৮ সালের ১লা এপ্রিল, ম্যাডামের বয়েস তখন তিরিশের উপরে। জিয়াউর রহমানের সহধর্মিনী বেগম খালেদা খানম ঐদিন নিজের স্বাক্ষরে পাশপোর্টের আবেদন করেন। উক্ত আবেদনপত্রেও তিনি তার জন্ম তারিখ উল্লেখ করেন সেপ্টেম্বার, ১৯৪৬। লক্ষনীয়, এখন পর্য্যন্ত তার জন্মতারিখটি খুব বেশী বিবর্তনের শিকার হয়নি। কারণ সে সময় তিনি ছিলেন নিতান্তই একজন গৃহবধূ, রাজনৈতিক বিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা ছিল না বললেই চলে।
৪- ১৯৯০ সালে এরশাদকে হটিয়ে আপোষহীন খেতাব অর্জন করেন ম্যাডাম এবং সেই খেতাবের লেজ ধরে একানব্বুইতে বাংলাদেশের সিংহাসনে আরোহন করেন। আর তখন থেকেই শুরু হয় বিবর্তনের নবতর পর্য্যায়, বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় যাকে বলা যায় বিবর্তনের উল্লম্ফন পর্ব (ইনফ্লেমেটরি ষ্টেজ)। সরকারী প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তার জন্মমাস এক মাস পিছিয়ে আনা হয়, সেপ্টেম্বার থেকে আগষ্টে। এই পর্য্যায়ে তার জন্মতারিখ নির্ধারণ করা হয় ১৯শে আগষ্ট, ১৯৪৫। এর কিছুদিন পর আরেকটি ঘোষণার মাধ্যমে তার জন্মতারিখ আরও ৪দিন পিছিয়ে এনে ১৫ই আগষ্ট ধার্য্য করা হয়। তবে ৯৬ সাল পর্য্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে এই বার্থডে’ পালনের কালচার শুরু করা হয়নি। ছিয়ানব্বুইতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেয়ে পনেরই আগষ্টকে রাষ্ট্রীয় শোকদিবস ঘোষণা করার পর থেকে নেত্রীর ‘জনমদিন’ পালনের কালচার শুরু করে বিএনপি। সেই থেকে আজ পর্য্যন্ত তাঁর জন্মদিন আর বিবর্তিত হয়নি, বাকশালীরা কাঙালি ভোজন আর দোয়া-দরুদ পরে শোক পালন করে, জাতীয়তাবাদীরা হাসিমুখে কেক কেটে উল্লাস প্রকাশ করে।
ট্র্যাজেডি হলো- যে শোকাবহ ঘটনাকে ব্যঙ্গ করতে জন্মতারিখের এই বিবর্তন, পরিমাপের দিক থেকে তা কারবালার ঘটনাকেও হার মানায়। কারবালাতে আর যাই হোক ছয় বছরের নিস্পাপ শিশু কিংবা নয় মাসের গর্ভবতী নারীকে বেয়োনেট চার্জ করে হত্যা করা হয়নি। একাত্তরে ম্যাডাম পাকিস্তানি মেজর জামশেদের বাসায় গৃহবন্দী ছিলেন, জিয়ার ভাষায় “আন্ডার ইউর কাষ্টডি”। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জিয়া তাকে গ্রহণ করতে চাননি। শেখ মুজিবের উদার হস্তক্ষেপের ফলেই ম্যাডামের সংসার টিকে যায় তখন। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই যে ১৫ই আগষ্ট সত্যিই ম্যাডামের জন্মদিন, তবুও পিতৃতুল্য একজন লোকের পরিবারের এমন শোকাবহ ঘটনাটিকে সম্মান জানিয়ে তিনি কি নিজের জন্মদিন পালন থেকে বিরত থাকতে পারতেন না? অবশ্যই পারতেন এবং রাজনৈতিকভাবে সেটাই হতো শোভনীয় কাজ। কিন্তু বিএনপি নামক দলটির নেতাকর্মীরা রাজনৈতিক শোভনতার দৃষ্টান্ত রাখবে তা বোধহয় একেবারেই অসম্ভব একটি আশা; বরং উল্টো কাজটি করবে ধরেই নেয়া যায়। নইলে দেখুন না, যে মেজর জামশেদ নয় মাস তাকে বাসায় আটকে রাখলো- চুরানব্বুই সালে তিনি মারা গেলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ম্যাডাম খালেদা জিয়া রাষ্ট্রীয় প্রটোকল ভেঙে শোকবানী পাঠালেন! আর যে লোকটির হস্তক্ষেপে তার সংসার টিকে গেলো- তার মৃত্যুদিনে তিনি হাসিমুখে কেক কেটে জন্মদিন পালন করেন!
মাস কয়েক আগে বিএনপির সেকেন্ড-ইন-কমান্ড খঃ দেলোয়ার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগকে। স্বভাবতই তার ডাকে সাড়া দেয়নি আওয়ামী লীগ। যে দলের নেতানেত্রীরা বঙ্গবন্ধু-হত্যার ঘটনাকে ব্যাঙ্গ করে আনুষ্ঠানিকভাবে উল্লাস প্রকাশ করে, আহসানউল্লাহ মাষ্টার কিবরিয়া হত্যাকে দলীয় কোন্দলের জের হিসেবে প্রচার করে তদন্ত ধামাচাপা দেয়, এমনকি একুশে আগষ্টের মতো বড়ো মাপের একটি সন্ত্রাসী ঘটনাকে আড়াল করতে জজমিয়া নাটক সাজায়- সেই দলের সাথে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে যাওয়ার আহ্বানে সাড়া দেয়া কীভাবে সম্ভব? নব্বুইতে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগের পক্ষে বিএনপি’র সাথে হাত মেলানো সম্ভব হয়েছিল, কারণ ম্যাডাম জিয়ার বিএনপি তখন পর্য্যন্ত নিজামি সাহেবের পক্ষপুটে আশ্রয় নিয়ে আওয়ামী নিধনের সর্বাত্মক মিশনে আত্মনিয়োগ করেনি। কিন্তু ২০০১-২০০৬ সালের বিএনপি’র চেহারা স¤পূর্ণ ভিন্ন। সে এখন আর আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বলে মনে করে না, রাজনৈতিক শত্র“ বলে মনে করে। উপরের উদাহরণগুলো তার সুস্পষ্ট প্রমান। শত্র“র সাথে সহযোগীতা করা আর যাই হোক আওয়ামী লীগের মতো পোড় খাওয়া একটি দল সমর্থন করতে পারে না। এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয়ের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আওয়ামী লীগকে সমূলে বিনাশ করতে বিএনপি অসংখ্য প্রচেষ্টা চালিয়েছে, কিন্তু বিএনপি’র নেতানেত্রীদেরকে ধ্বংস করতে আওয়ামী শিবির কোন ষড়যন্ত্র করেছে এমন একটিমাত্র উদাহরণও খুজে পাওয়া যাবে না।
দেশ আজ সুস্পষ্ট দু’ভাগে বিভক্ত, এক পক্ষ আরেক পক্ষের মুখ দেখতে চায় না। যে পর্য্যন্ত দেশের প্রধানতম দুই দলের মধ্যে মিনিমাম সৌজন্যবোধ ন্যুনতম সহযোগীতার পরিবেশ সৃষ্টি না হবে সে পর্য্যন্ত দেশ এগুতে পারে না; একানব্বুই থেকে দু’হাজার এক সালের পনের বছরে সে প্রমান দেশবাসী পেয়েছে। প্রশ্ন হলো- এই সংঘাতময় অসহনীয় পরিবেশ সৃষ্টির দায়ভাগ কার? বিএনপি যদি এই নোংড়া রাজনৈতিক কালচার থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, তবেই কেবল দু’দলের মধ্যে সহযোগীতার আবহ সৃষ্টি হওয়া সম্ভব- বর্তমান প্রেক্ষাপটে যা একেবারেই আকাশকুসুম স্বপ্ন বলে মনে হয়। আর তাই যদি হয়, আগামি বছরের প্রথমার্ধে বর্তমান সরকারের বিদায়ের পর ভবিষ্যতে কোন্ ভরসা অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্যে।
খুব সম্ভবত আল্লাহ ভরসা।
সগিরালি খান
ভাটপাড়া, পোষ্ট-পিএটিসি
সাভার – ঢাকা
খাণ সগিরালী ভাইজান , যুক্তিযুক্ত এলেখাটির জন্য !
ভবিষৎ এ আরো এ ধরনের লেখা আশা করছি ৷
জাতি উপকৃত হবে ৷
ভাই সেইরকম!
সগীর আলী খাঁনের লেখাটি তথ্যসমৃদ্ধ। তবে ১৫ আগস্টে খালেদা জিয়ার জন্মদিন্ন পালনের ব্যাপারটি একধরণের বিকৃতি – সামাজিক বিবর্তন নয়।
ছগিরালী ভাই, ম্যাডামের দুষটাই দেখলেন,তার জামাইরটা দেখলেন না। জিয়া তখন যা পারেন নাই বা সাহসে কুলিয়ে উঠে নাই,গোলমী-নিজামীর দোয়াই তা এখন অতি সহজ। ডারউইন এর থিউরি নিজামীদের চেয়ে ভাল আর কে বুঝে?
🙂 :-)) 😀 :laugh: :rotfl: 🙁 :-(( 😉 :-* 😛 O:-) :-X :reallyangry: 😕 😐 :-/ :chic: 😎 :nerd: :silly: :X-P: :razzmad: :evilgrin: :mean: :pissedoff: :kissed: :kissblow: :kissing: :lashes: :cute: :blush: :beauty: :shame: :pain: :beatup: :shy: :talktothehand: :loser: 🙄 :disdain: :smug: :wilt: :sidefrown: :weep: 😥 :teeth: :shout: :curse: :reallypissed: :heh: :smirk: :snicker: :giggle: :inlove: :drool: 😮 😯 :sick: :suspense: :tremble: :dazed: :hypnotized: :footmouth: :-$ :quiet: :shutmouth: :doh: :idk: ?:-) :lying: :struggle: :sweat: :stop: :bye: