১২ ই ফেব্রুয়ারী : ডারউইন দিবস

অভিজি রায়

আজ ১২ ই ফেব্রুয়ারী। ডারউইন দিবস। কিন্তু এ বছরের ডারউইন দিবস আগের অন্য বছরগুলোর তুলনায় অনেক ব্যতিক্রমী। এ বছরের ১২ই ডিসেম্বর  ডারউইনের জন্মের দ্বিশতবার্ষিকী আর তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘প্রজাতির উদ্ভব’ বা ‘অরিজিন অব স্পিশিজ’-এর প্রকাশের দেড়শত বছর।  ঘটনাক্রমে দিনটা আরো একটা কারনেও ব্যতক্রমী। কাকতালীয় হলেও সত্য, ডারউইন যে বছরের যে দিনটিতে জন্মেছিলেন, সেই বছরের (১৮০৯) একই দিনে জন্মেছিলেন আরেক প্রতিভাধর মানুষ – আব্রাহাম লিঙ্কন।  দুজনের কাজের ক্ষেত্র ছিলো ভিন্ন – একজন খুব নিবিড় গবেষক এবং নিভৃতচারী প্রকৃতিবিদ, আর আরেকজন মহাপ্রতাপশালী রাজনীতিবিদ। কাজ-কর্মে মিল না থাকলেও  একটি বিষয়ে কিন্তু তাদের মিল লক্ষ্যনীয়। লিঙ্কন শারিরীক দাসত্ব প্রথা থেকে আমাদের মুক্তি দিয়েছিলেন, আর ডারউইন আমাদের দিয়েছিলেন চিন্তার দাসত্ব থেকে মুক্তি।

 

বাংলাদেশের অনেকেই ১৪ ফেব্রুয়ারী ভ্যালেন্টাইস ডে’ বা ভালবাসা দিবসের সাথে পরিচিত, কিন্তু তার দু’দিন আগের ডারউইন দিবসের সাথে একদমই নয়। তাই বাঙালী পাঠকদের জন্য ডারউইন দিবসের ইতিহাসটা একটু তুলে ধরা প্রয়োজন মনে করছি।  বিজ্ঞান এবং যুক্তিবাদের সম্মানে প্রতি বছরের ফেব্রুয়ারী মাসের ১২ তারিখে বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী চার্ল ডারউইনের জন্মবার্ষিকীতে বিশ্বজনীনভাবেই ডারউইন দিবস (Darwin Day) পালিত হয়। ক্যালিফোর্নিয়ার প্যালো এল্টোর মানবতাবাদী সম্প্রদায় ১৯৯৫ সালে প্রথম ডারউইন ডে পালন করা শুরু করে এবং এর পর থেকে এটি প্রতি বছর উদযাপিত হতে থাকে বিরামহীনভাবে। বিখ্যাত সংশয়বাদী জীববিজ্ঞানী প্রফেসর মাসিমো পিগলিউসি নিজে উদ্যোগ নিয়ে ১৯৯৬ সালে ইউনিভার্সিটি অব টেনেসিতে ডারউইন দিবস অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন, যা বছর বছর ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হচ্ছে। আজ ডারউইন দিবস উসবের অনুষ্ঠানের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট হচ্ছে www.darwinday.org. আগ্রহীরা অনুষ্ঠানের আয়োজকদের সাথে সংহতি প্রকাশের জন্য এখানে নিবন্ধিকৃত হতে পারেন। এ ছাড়াও ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম, কেম্ব্রিজ িশ্ববিদ্যালয় সহ অনেকেই সারাদিনব্যাপী উসব পালন করছে। ্যাচারাল জিওগ্রাফিক এবং সায়েন্টিফিক আমেরিকানের মত স্বনামধন্য পত্রিকা প্রকাশ করেছে ডারউইন দিবস উপলক্ষে তাদের বিশেষ সংখ্যা।  সেই তুলনায় বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় এই দিনটি নিয়ে উচ্ছ্বাস কিন্তু একদমই কম।

আসলে কিছুদিন আগেও ডারউইন-ডে নিয়ে খোদ্‌ পশ্চিমা বিশ্বেই তেমন কোন মাথা ব্যথা ছিলো না, বেচারা ডারউইনকে নিয়ে এতো এতো ঘটা করে একটি বিশেষ দিনে টানা-হ্যাঁচরা করারও প্রয়োজন ছিলো না বোধ হয় কারো। কিন্তু এ কয় বছরে সারা পৃথিবীতে পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গেছে। অত্যন্ত ধূর্ত নব্য এক ধর্মবাদী আন্দোলন বিজ্ঞানের মুখোশ পরে খোদ বিবর্তনকেই বিজ্ঞানের এলাকা থেকে হটিয়ে দিতে ময়দানে নেমেছে আজ। বিজ্ঞানের বাঘছাল গায়ে জড়ানো মূলতঃ আমেরিকার এই বকধার্মিকেরা আবার নিজেদের তত্ত্বের এক গালভরা নামও খুঁজে পেয়েছে – ‘ইন্টিলিজেন্ট ডিজাইন’ বা আই.ডি। আসলে বাইবেল বা কোরানের ছয়দিনে বিশ্বসৃষ্টি আর নূহের প্লাবনের কেচ্ছা-কাহিনী গিলিয়ে আর বোধ হয় আর জনসাধারণকে ধর্মমুখী করে রাখা যাচ্ছিলো না; জন উইটকম্ব, হেনরী মরিস, ডুয়েন গিশ কিংবা হাল আমলের মরিস বুকাইলি আর হারুন ইয়াহিয়ারা যতই ধর্মগ্রন্থগুলোর আলোকে সৃষ্টিতত্ত্বকে ব্যাখ্যা করতে যতই প্রয়াসী হোন না কেন, অধিকাংশ বিজ্ঞানীদের কাছে সেগুলো সত্তুর বা আশির দশকেই ‘বর্জ্য পন্য’ হিসেবে পরিত্যক্ত হয়েছিলো। শুধু তো বৈজ্ঞানিক মহলেই নয়, রাজনৈতিক মঞ্চেও সৃষ্টিতত্ত্ব হটে গিয়েছিলো যখন আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট ১৯৮৭ সালে এক ঐতিহাসিক রায়ে এই ধরনের ঐশ্বরিক সৃষ্টিতত্ত্বকে ‘বৈজ্ঞানিক নয়’ বরং ‘রিলিজিয়াস ডগমা’ হিসেবে চহ্নিত করে দিলেন। কিন্তু ধর্মবাদীরা এতো সহজে হাল ছাড়বেন কেন! বিবর্তনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য মুলতঃ তখন থেকেই তাদের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো আরেকটু ‘সফিসটিকেটেড’ তত্ত্বের। আর সে প্লাটফর্মটি গড়বার জন্যই যেন আজ মাঠে নেমে পড়েছেন ফিলিপ জনসন, মাইকেল বিহে আর উইলিয়াম ডেম্বস্কি আর তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা। তাদের সঙ্গায়িত আই.ডি নামধারী এই ‘সফিসটিকেটেড’ বিটকেলে তত্ত্বের তেতো আর ঝাঁঝালো গন্ধে বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী তো বটেই, যুক্তিবাদী সচেতন সকল মহলকেই অবশেষে নড়ে চড়ে বসতে হয়েছে, নতুন করে আরেকবার খুঁজে নিতে হয়েছে উনবিংশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠপ্রতিভাধর এক মনীষীকে, নাম চার্লস রবার্ট ডারউইন (১৮০৯-১৮৮২)। বলা যায় এই অন্তর্মুখী চরিত্রের নিপাট ভাল মানুষটিই বাঁচিয়ে দিয়েছেন আমাদের মস্তিষ্কের কোষে কোষে রূপকথা-মিছেকথা গুলো পুরে রাখবার হাত থেকে; নতুন করে তাকাতে সাহায্য করেছে আমাদের চিরচেনা এ জগতের দিকে- শতাব্দী প্রাচীন কেচ্ছা-কাহিনী দিয়ে নয় বরং বৈজ্ঞানিক আর যুক্তিবাদী দৃষ্টি দিয়ে। রিচার্ড ডকিন্স তো প্রায়শঃই বলেন, ডারউইনের বিবর্তনবাদ রঙ্গমঞ্চে আসার আগে কারো পক্ষেই বোধ হয় পরিপূর্ণভাবে সৃষ্টি তত্ত্বকে অস্বীকার করে সত্যিকারের যুক্তিবাদী হওয়া সম্ভব ছিলো না!

 

এক নজরে ডারউইন ও তার বিবর্তন তত্ত্ব

১৮০৯ – ইংল্যান্ডের লন্ডনের কাছে শ্রুসবারিতে ডারউইনের জন্ম।
১৮৩০ – চার্লস লায়েলের “
Principles of Geology” বই‌যের প্রকাশ। এই বই এবং কার্ল লিনিয়াসের “Systema Naturae” দ্বারা ডারউইন প্রভাবিত হয়েছিলেন। এই দুটো বই নির্মাণ করেছিলো ডারউইনের তত্ত্বের আদি ভিত্তি।
১৮৩১ – ডারউইনের  বিখ্যাত বিগল জাহাজে করে বিশ্ব ভ্রমণ।
১৮৩৮ –  ডারউইনের মাথায় প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে ঘটা বিবর্তন তত্ত্বের  উন্মেষ, প্রকাশ হতে লেগেছিলো আরো ২০ বছর ।
১৮৫৯ – “অন দি অরিজিন অফ স্পিসিস” বা ‘প্রজাতির উদ্ভব’ এর আত্মপ্রকাশ।
১৮৬৫ – চেক যাজক গ্রেগর মেন্ডেল বংশগতিবিদ্যার উপর করা গবেষণার প্রকাশ। কিন্তু আরও ৩৫ বছর পর্যন্ত তার গবেষণা স্বীকৃতি পায়নি, ডারউইনও এই গবেষণার কথা জানতেন না।
১৮৭১ – “দ্য ডিসেন্ট অফ ম্যান” বইয়ে ডারউইন মানুষের পূর্বপুরুষ হিসেবে প্রাইমেটদের নাম করেন। এ কারণে তিনি প্রচণ্ড বিতর্কিত হন। তাকে নিয়ে আধা মানুষ-আধা এপের কার্টুন তৈরি করা হয়।
১৮৮২ – ডারউইন মৃত্যুবরণ করেন।
১৯২৫ – “দ্য স্কোপ্‌স মাংকি ট্রায়াল” এর মাধ্যমে স্বর্গীয় সৃষ্টিতত্ত্বকে অস্বীকার করে এমন কোন কিছু স্কুলে পড়ানো যাবে না বলে আইন পাশ করা হয়। জন স্কোপকে স্কুলে বিবর্তন পড়ানোর দায়ে জড়িমানা করা হয়।
১৯৩৬-৪৭ – আধুনিক সংশ্লেষণ পদ্ধতিতে ডারউইনের বিবর্তনবাদকে মেন্ডেলীয় জিনতত্ত্বের সাথে মেলানো হয়। জেনেটিক্সের আলোয় ডারউইন তত্ত্ব আরেকবার শক্ত কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে যায়।
১৯৫৩ – জেম্‌স ডি ওয়াটসন ও ফ্রান্সিস ক্রিক ডিএনএ-র গঠন আবিষ্কার। এর মাধ্যমে বিবর্তনের আণবিক জীববিজ্ঞান অধ্যয়ন শুরু হয়।
বিংশ শতকের মাঝামাঝি – জিন বিশ্লেষণের মাধ্যমে কয়েক হাজার বছর আগেও মানুষের বিবর্তন হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।
১৯৮৯- ‘অফ পান্ডাস এন্ড পিপল’ বইয়ের মাধ্যমে বিবর্তন তত্ত্বের বিকল্প হিসবে ‘ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন’ বা সৃষ্টির বুদ্ধিদীপ্ত অনুকল্পকে পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ। বিবর্তনকে ঠেকাতে ডিস্কোভারি ইন্সটিটিউট গঠন।
১৯৮৭- সুপ্রিমকোর্টে লুজিয়ানার ব্যালেন্স ট্রিটমেন্ট অ্যাক্ট (বিবর্তনের পাশাপাশি সৃশটিতত্ত্বকেও সমান গুরুত্ব দেয়ার প্রস্তাব) আমেরিকার সংবিধানের প্রথম সংশধনীকে লংঘন করে বলে বিচারক রায় দেন।
২০০৫- ডোভারের কোর্টে ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন বা সৃষ্টির বুদ্ধিদীপ্ত অনুকল্পকে স্কুলের পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্তির প্রচেষ্টাকে অসাংবিধানিক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
২০০৯ – এ বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি  প্রকৃতিবিদ ডারউইনের ২০০তম জন্মবার্ষিকী এবং তার সবচেয়ে বিখ্যাত বই ‘প্রজাতির উদ্ভব’-এর ১৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। বিশ্বব্যাপী জাঁকজমকের সাথে এ দিবসটি পালনের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।

 

আসলে পৃথিবীতে খুব কম বৈজ্ঞানিক ধারণাই কিন্তু জনসাধারণের মানসপটে স্থায়ীভাবে বিপ্লব ঘটাতে পেরেছে। পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোপার্নিকাসের সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্ব এমনি বিপ্লবী তত্ত্ব, তেমনি জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ডারউইন আর রাসেল ওয়ালেস প্রস্তাবিত বিবর্তনতত্ত্ব। এই তত্ত্বই আমাদের শিখিয়েছে যে, কোন প্রজাতিই চিরন্তন বা স্থির নয়, বরং আদিম এক কোষী প্রাণী থেকে শুরু করে এক প্রজাতি থেকে পরিবর্তিত হতে হতে আরেক প্রজাতির সৃষ্টি হয়েছে, আর পৃথিবীর সব প্রাণীই আসলে কোটি কোটি বছর ধরে তাদের পুর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হতে হতে এখানে এসে পৌঁছেছে। ডারউইন শুধু এ ধরনের একটি বিপ্লবাত্মক ধারণা প্রস্তাব করেই ক্ষান্ত হননি, বিবর্তনের এই প্রক্রিয়াটি (প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে) কিভাবে কাজ করে তার পদ্ধতিও বর্ণনা করেছেন সবিস্তারে, প্রথমবারের মত ১৮৫৯ সালে ‘প্রজাতির উদ্ভব’ বা ‘অরিজিন অব স্পিশিজ’ বইয়ে। খুব অবাক হতে হয় এই ভেবে, যে সময়টাতে সৃষ্টি রহস্যের সমাধান করতে গিয়ে প্রায় সকল বিজ্ঞানী আর দার্শনিকই সবে ধন নীল-মনি ওই বাইবেলের জেনেসিস অধ্যায়ে মুখ থুবরে পড়ে ছিলেন আর বাইবেলীয় গণনায় ভেবে নিয়েছিলেন পৃথিবীর বয়স সর্বসাকুল্যে মাত্র ৬০০০ বছর আর মানুষ হচ্ছে বিধাতার এক ‘বিশেষ সৃষ্টি’, সে সময়টাতে জন্ম নিয়েও ডারউইনের মাথা থেকে এমনি একটি যুগান্তকারী ধারণা বেরিয়ে এসেছিলো যা শুধু বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিকেই তরান্নিত করেনি, সেই সাথে চাবুক হেনেছিলো আমাদের ঘারে সিন্দাবাদের ভুতের মত সওয়ার হওয়া সমস্ত ধর্মীয় সংস্কারের বুকে। দার্শনিক ডেনিয়েল ডেনেট বিবর্তনতত্ত্বকে ‘ইউনিভার্সাল এসিড’ বা রাজাম্ল  হিসেবে চহ্নিত করেছেন। ইউনিভার্সাল এসিড যেমন তার বিধ্বংসী ক্ষমতায় সকল পদার্থকে পুড়িয়ে-গলিয়ে ছারখার করে দিতে পারে, তেমনি ডারউইনের বিবর্তনবাদী তত্ত্ব সমস্ত প্রথাগত ধর্মীয় ধ্যান ধারণা আর কুসংস্কারকে একেবারে দুর করে দিতে পারে। ‘ডারউইনের বুলডগ’ বলে কথিত বিজ্ঞানী টি এইচ হাক্সলি ডারউইনের ‘প্রজাতির উদ্ভব’ বইটিকে নিউটনের ‘প্রিন্সিপিয়ার’ পর জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী ‘মহাস্ত্র’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন; আবার সেই সাথে আবার দুঃখও করেছিলেন এই ভেবে – ‘এতোই নির্বোধ আমি যে এত সহজ ব্যাপারটা আগে আমার মাথায় আসেনি।’ বিজ্ঞানী আর্নেস্ট মায়ার বলেছেন, ‘ডারউইনিয়ীয় বিপ্লব যে মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ধারণা – এটি যে কারো পক্ষে খন্ডন করা কঠিনই হবে।’ জীববিজ্ঞানী স্টিফেন জে গুল্ড মনে করতেন তাব পশ্চিমা বিশ্বের আধা ডজন বাছা বাছা তত্ত্বের মধ্যে ডারউইনের তত্ত্ব থাকবে শীর্ষস্থানে। আর অধ্যাপক রিচার্ড ডকিন্স তো মনেই করেন যে, শুধু পৃথিবী নয় সমগ্র মহাবিশ্বে কোথাও প্রাণের বিকাশ ঘটলে তা হয়ত ডারউইনীয় পদ্ধতিতেই ঘটবে, কারণ ডারউইনীয় বিবর্তন সম্ভবতঃ একটি ‘সার্বজনীন সত্য’  সমগ্র মহাবিশ্বের প্রেক্ষাপটে ‘সার্বজনীন সত্য’ কিনা তা এখনো প্রমাণিত না হলেও স্বীকার করে নিতেই হবে পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব আর এর নান্দনিক বিকাশকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের চেয়ে ভাল কোন তত্ত্ব এ মুহূর্তে আমাদের হাতে নেই। বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী এবং আধুনিক বিবর্তনবাদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা থিওডসিয়াস ডাবঝানস্কি বলেছেন যে, ‘ ডারুইনীয় বিবর্তনের আলোকে না দেখতে পারলে জীববিজ্ঞানের কোন কিছুরই অর্থ হয় না।’। দার্শনিক ডেনিয়েল ডেনেট এজন্যই বোধ হয় বলেছিলেন, ‘আমাকে যদি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ধারণাটির জন্য কাউকে পুরষ্কৃত করতে বলা হয়, আমি নিউটন, আইনস্টাইনদের কথা মনে রেখেও নির্দ্বিধায় ডারউইনকেই বেছে নেব।’ কাজেই ডারউইন দিবস আমাদের জন্য ডারউইনের দীর্ঘ শশ্রুমন্ডিত মুখচ্ছবির কোন স্তব নয়, বরং তাঁর যুগান্তকারী আবিস্কারের যথাযথ স্বীকৃতি, তাঁর বৈজ্ঞানিক অবদানের প্রতি নির্মোহ আর বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
 

সারা বিশ্বজুড়ে হু জীববিজ্ঞানী, প্রকৃতিবিদ, বিজ্ঞানী, দার্শনিক ছাড়াও বহু প্রগতিশীল, বিজ্ঞানমনস্ক এবং মানবতাবাদী সংগঠন মহাসমারোহে ডারউইন দিবস পালন করছে এবারো।  এই ধারার সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও দিনটিকে পরিচিত করার প্রয়াস নেয়ার উদ্যোগ জরুরী।  অনেক পাঠকেরই মনে আছে  ২০০৬ সালে মুক্তমনার পক্ষ থেকে প্রথম বারের মত যখন ডারউইন দিবসের আয়োজন করা হয়েছিলো, প্রকাশ করা হয়েছিলো ডারউইন ডে উপলক্ষে বিশেষ পৃষ্ঠা,  তা  বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বের মননশীল মানুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশের চারটি দৈনিক ও মাসিক পত্রিকা আমাদের লেখা দিয়ে ডারউইন ডে কে ফিচার করে লেখা প্রকাশ করে। জামার্ন রেডিও বাংলা থেকে আমাদের সাক্ষাকার ধারণ করা হয়। ইনটারনেশনাল ডারউইন ডে উদযাপন কমিটির প্রেসিডেন্ট আর ভাইস প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে আমরা চিঠি পাই, যেখানে তারা আমাদের তৈরি ডারউইন-ডে পেইজটিকে একটি ‘টেম্পলেট’ হিসেবে গ্রহণ করতে চেয়েছেন। এগুলো আমাদের শুধু নয়, মুক্তমনার সকল আনুরাগী পাঠক-পাঠিকাদের জন্য এক বিরাট গৌরবের ব্যাপার। আমরা আশা করছি এ বছরের (২০০৯)  ডারউইন দিবসের উদ্যোগ অতীতের সকল প্রাপ্তিকে ছাড়িয়ে যাবে।  ডারউইন দিবস উপলক্ষ্য বাংলাদেশেও বেশ কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। বিজ্ঞান চেতনা পরিষদ বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠান এবং ওয়ার্কশপ শুরু করেছে করছে।  শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ এবং মুক্তমনার ব্যানারে র‌্যালীর আয়োজন করা হয়েছে। এর নেতৃত্বে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এবং লেখক ড. অজয় রায়। এছাড়া  পেশাদার বিজ্ঞান-বক্তা আসিফের উদ্যোগেও  ডিসকাশন প্রজেক্টের অনুষ্ঠান হচ্ছে।  এগুলোর আয়োজন ঘোর অমানিষার মধ্যেও আমাদের আশা জাগায়।


আয়োজনে, আহ্বানে, আপ্যায়নে, অভিনবত্বে সব মিলিয়ে ডারউইন ডে আমাদের জন্য যেন এক ‘আবির্ভাব’। এ আবির্ভাব যেন ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার আর গোঁড়ামীর বিরুদ্ধে এক পুষ্পিত, মুকুলিত সেক্যুলার উ
সবের- যে উসব আকাশের কল্পিত রথের ঘোড়া থেকে মুখ সরিয়ে আমাদের নিয়ে আসে বাস্তব জগতে, নিয়ে আসে মাটির কাছাকাছি, আর পরিচয় করিয়ে দেয় ভুলে যাওয়া মাটির অকৃত্রিম সেঁদো গন্ধের সাথে।

ডারউইন দিবস উপলক্ষে সবাইকে শুভেচ্ছা জানাই।

অভিজি রায়
১২ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯


. অভিজি রায়, পেশায় প্রকৌশলী; মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক; ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ ও ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজগ্রন্থের লেখক সর্বশেষ প্রকাশিত সম্পাদিত গ্রন্থ – ‘স্বতন্ত্র ভাবনা’। সম্প্রতি বিজ্ঞান ও ধর্ম : সংঘাত নাকি সমন্বয়? শীর্ষক গ্রন্থ সম্পাদনার কাজে নিয়োজিত।  ইমেইল : [email protected]