বিবর্তনের শিক্ষা
অপার্থিব
বিবর্তনের ধারণার সঠিক উপলব্ধি আমাদেরকে জীবন ও বাস্তব জগত সম্পর্কে এক নতুন শিক্ষা দেয়, এক নতুন চেতনা ও অন্তর্দৃষ্টি লাভে সাহায্য করে। দৈনন্দিন জীবনের অনেক ঘটনা ও অভিজ্ঞতা যা অনেককেই অবাক করে, মনে প্রশ্নের জন্ম দেয়, সবই বিবর্তনের ধারণার বদৌলতে বোঝা সহজ হয়ে যায়, আর কপাল কুচকাতে হয়না। কারণ জীবন ত বিবর্তনেরই সৃষ্টি, বিবর্তনের নিয়মেই গড়া। জীবন মানে মানব গোষ্ঠী বা সমাজ, তার আচার ব্যবহার, সংস্কৃতি ও পারিপার্শ্বিকতা, যা সবই বিবর্তনের ক্রিয়ার ফল। বেশির ভাগটাই বিবর্তনের মূল লক্ষ্য সাধনের প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে, কিন্তু কোন কোনটা মূল লক্ষ্য সাধনের প্রক্রিয়ার অনিবার্য্য উপজাত বা পার্শ্ব ক্রিয়া হিসেবে। বিবর্তনের শিক্ষা বা সত্য যে উপাদেয় হবে এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। বরং তা নিষ্ঠুর সত্য হতে পারে। যাহোক বিবর্তনের দুটো অর্থ বা দিক আছে। এক অর্থে যে নিয়ম বা প্রক্রিয়ার ফলে আজকের সকল প্রাণী এক আদ্য প্রাণরূপ থেকে বর্তমানের রূপ নিয়েছে সেই নিয়মকেই বোঝায়। প্রাকৃতিক নির্বাচন আর পরিব্যক্তি হল বিবর্তনের প্রক্রিয়ার প্রধান উপাদান। আবার যে প্রক্রিয়ায় সেই আদি প্রাণরূপ প্রাণহীন জটিল অণুর দ্বারা সৃষ্টি হয়েছিল তাকেও বিবর্তন বলা হয়। প্রথমোক্তটিকে জৈব বিবর্তন বলা হয় আর দ্বিতীয়োক্তটিকে রাসায়নিক বিবর্তন বলা হয়। বিবর্তনের এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হল যে মানুষ তথা সকল প্রাণী এক প্রাকৃতিক নিয়মের ফলে উদ্ভূত। প্রাকৃতিক নিয়ম পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্র বৈ অন্য কিছু নয়। সরল অণু থেকে যৌগিক বা জটিল অণুর সৃষ্টি যে রাসায়নিক প্রক্রিয়ার দ্বারা সংঘটিত হয় সেটা সুপরিচিত। আর রাসায়ানিক প্রক্রিয়া যে পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়মের পরিণতি সেটাও সুবিদিত। কাজেই প্রাণহীন জটিল অণু থেকে জটিলতর স্বপ্রতিলিপিকারী (Self-Replicating) অণুও (যা কিনা প্রাণের মৌলিক একক হিসেবে গণ্য) যে সেই একই পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়মেই সৃষ্ট তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। বস্তুত জটিল অণু থেকে জটিলতর অণুতে প্রাণের সঞ্চার (স্বপ্রতিলিপিকরণ যার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত) হল বিকাশমান ধর্ম (Emergent Properties ) এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বিকাশমান ধর্মের উদাহরণের কমতি নেই পদার্থবিজ্ঞানে । অনেক চমকপ্রদ বিকাশমান ধর্ম পরিলক্ষিত হয়েছে পরীক্ষাগারে। আমাদের কাছে প্রাণ এক অলৌকিক ধর্ম বলে মনে হতে পারে কিন্তু অন্যান্য চমকপ্রদ বিকাশমান ধর্মের সাথে এর পার্থক্যটা গুণগত নয়, পরিমানগত। সব বিকাশমান ধর্মের এক সাধারণ গুণক হল যে তারা অধিক সংখ্যার দ্বারা গঠিত কোন তন্ত্রের মধ্যকার অসরলরৈখিক মিথোষ্ক্রিয়ার (Non-linear Interaction) দ্বারা উদ্ভূত। প্রাণের সৃষ্টিও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রাণ সৃষ্টির প্রোগ্রাম পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্রেই প্রচ্ছন্ন, যা জটিল অণুর পারস্পরিক প্রক্রিয়ায় প্রকাশ পায় এক বিশেষ অনন্য পরিবেশে যা পৃথিবীর আদিম আবহাওয়ায় বিদ্যমান ছিল। মানুষ যদি পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়মেই সৃষ্ট বিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাহলে এই উপলব্ধি আমাদের আরেকটা শিক্ষা দেয় আর সেটা হল মানুষ এক অতি উন্নত মানের ও জটিল রোবট। মানুষের তাবৎ আচরণ ও স্বভাব এর চূড়ান্ত নিয়ামক পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়ম। গবেষণাগারের রোবট কম্পিউটার প্রোগ্রামের দ্বারা সৃষ্ট ও চালিত । কম্পিউটার প্রোগ্রাম আসলে পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্রেরই এক রূপ। আর মানুষ সৃষ্ট বা চালিত হয় DNA নামক প্রোগ্রামের দ্বারা যা পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্রেরই এক রূপ। তাহলে মানুষ আর পরীক্ষাগারের রোবট এর মধ্য গুণগত পার্থক্য কোথায়? বস্তুত পরীক্ষাগারের রোবট তৈরী হয় মানুষ নামক আর এক রোবটের দ্বারা। দুটোই প্রোগ্রাম এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, দুটো প্রোগ্রাম ভিন্ন বটে তবে চূড়ান্ত বিচারে উভয়ই পদার্থ বিজ্ঞান নামক মহা (Grand) প্রোগ্রামের দুটো রূপ। মানুষকে রোবট ছাড়াও নাচের পুতুল বলাও খুব বাস্তববর্জিত হবে না। পুতুল যেমন দড়ি দ্বারা নাচান হয় মানুষ দ্বারা, মানুষও তেমনি নাচে পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্র নামক দড়ি দ্বারা। দুটো রোবটই বিবর্তনের নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মানুষ রোবটের বিবর্তন লক্ষ লক্ষ বছর ধরে চলছে আর পরীক্ষাগারের রোবটের বিবর্তন কয়েক দশক ধরে চলছে মানুষ নামক আরেক রোবটের দ্বারা। এটা ঠিক যে মানুষ রোবটের মধ্যে কিছু ধর্ম পরিলক্ষিত হয় যেমন প্রেম, ক্রোধ, সৌন্দর্য্যবোধ ইত্যাদি, কিন্তু এই ধর্ম গুলিও এখন বিজ্ঞানীরা যেনেছেন যে সেটাও বিবর্তনের নিয়মে সৃষ্ট মস্তিষ্কের এক বিকাশমান ধর্ম। পরীক্ষাগারের রোবটের মধ্য এই ধর্ম গুলি দেখা না গেলেও এটা ভাবার কোন কারণ নেই যে সুদূর ভবিষ্যতে পরীক্ষাগারের রোবটের জটিলতা এক ক্রান্তিসীমা (Critical Limit) অতিক্রম করলে অনুরূপ কোন বিকাশমান ধর্ম উদ্ভূত হবে না সে রোবটে। ইতিমধ্যেই বেশ কিছু কম্পিউটের বিজ্ঞানী যারা প্রাণের জটিলতা নিয়ে গবেষণা করছেন তারা এই মর্মে ভবিষ্যৎ বাণীও করেছেন। মানুষ যে একটি প্রোগ্রাম চালিত উন্নত রোবাট এই সত্য থেকে আমরা আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি পেতে পারি আর তা হল স্বাধীন ইচ্ছা একটা অধ্যাস মাত্র, এর প্রকৃত কোন অস্তিত্ব নেই। কারণ স্বাধীন ইচ্ছা মানে হল মানুষের দেহ বহির্ভূত কার্যকারণহীন কোন ক্ষমতা যার জন্য একজন মানুষ কোন কিছুর দ্বারা প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রিত না হয়ে কোন কাজ করতে পারে। এটা বস্তুত আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসকেই ঘুরিয়ে বলা। কারণ মানুষের সকল চিন্তা ও কর্মই যদি তার মস্তিষ্কের কোটি কোটি স্নায়ূ কোষের সাথে পরিবেশের ও গচ্ছিত স্মৃতির সাথে এক মিথোষ্ক্রিয়ার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, যা কিনা আবার চূড়ান্ত বিচারে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত তাহলে প্রকৃত স্বাধীন চিন্তার কোন অস্তিত্ব থাকতে পারেনা। এ ব্যাপারে লিবেট (Libet) এর বিখ্যাত পরীক্ষার কথা স্মরণ করতে হয় যার দ্বারা তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে স্বাধীন ইচ্ছা আসলেই এক অলীক ধারণা। বিবর্তনের আর এক শিক্ষা হল নৈতিকতা, মহান আদর্শ ইত্যাদির কোন পরম অর্থ নেই। মানুষ যেহেতু পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়মে সৃষ্ট সেহেতু মানুষের সকল চেতনা, আচরণ ও চিন্তাও বিজ্ঞানের নিয়মেই সৃষ্ট বা নিয়ন্ত্রিত। নৈতিকতা ও আদর্শের ধারণা সৃষ্টিতে মানুষ বিবর্তনের এক নিমিত্ত মাত্র। নৈতিকতা মানূষ প্রজাতির একটা গড় বা পারিসাংখ্যিক বৈশিষ্ট্য। মানুষ ভেদে এর বিরাট তারতম্য দেখা যায়। নৈতিকতা হল বিবর্তনের মূল লক্ষ্যকে (উদ্বর্তন ও পরবর্তী প্রজন্মে বংশাণু র সর্বাধিক বিস্তার) মেটাবার জন্য বিভিন্ন কৌশলের মধ্যে অন্যতম। বিবর্তনের এই মূল লক্ষ্য প্রতিটি মানুষএর মধ্যে তার নিজের স্বার্থের প্রতি সর্বাগ্রে নজর দেয়ার এক তাগিদ বা প্রবৃত্তি সৃষ্টি করে। বিবর্তনের ভাষায় এটাকে স্বার্থপর বংশাণুর (Selfish Gene) প্রভাব বলা হয়। কিন্তু মানুষ যখন সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করতে লাগল তখন সবাই যদি তাদের স্বার্থপর বংশাণুর প্রভাব দ্বারা চালিত হয় তাহলে একসময়ে সে সমাজ ভেঙ্গে পড়বে আর তার ফলে বিবর্তনের যে মূল লক্ষ্য (অর্থাৎ উদ্বর্তন ও পরবর্তী প্রজন্মে বংশাণু র সর্বাধিক বিস্তার ) সেটাই ভেস্তে যাবে। তাই হাজার হাজার বছর ধরে বিবর্তনের ফলে মানুষের মস্তিষ্কে নৈতিকতার এক চেতনার সৃষ্টি হয় যা এই প্রবৃত্তির বিপরীত শক্তি হিসেবে কাজ ক’রে গড়ে একরকম স্থিতিশীলতা আনয়নের চেষ্টা করে। চেতনাহীন প্রাকৃতিক নিয়ম কি করে এই নৈতিক চেতনার জন্ম দিতে পারে এটা নিয়ে অনেকেরই সংশয় থাকতে পারে। আমরা জানি দুটো জলাশয়ের পানির উচ্চতা ভিন্ন হলে উচু জলাশয় থেকে পানি নিচু জলাশয়ে গড়িয়ে পানির উচ্চতা বা চাপের সমতা আনয়নের চেষ্টা করে। আবার বাতাসের চাপ কোন জায়গায় কম হলে চারপাশের বাতাস সেখানে ছুটে এসে চাপের সমতা আনয়নের চেষ্টা করে। তাপাত্রার তারতম্যও এভাবে তাপ সঞ্চালনের মাধ্যমে সমতা লাভ করে। এ সবই ঘটে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম মোতাবেক এন্ট্রপি বাড়াবার লক্ষ্যে। নৈতিকতার বা আদর্শের চেতনা ঠিক তেমনি প্রাকৃতিক নিয়মেই সৃষ্ট। যদিও এটাকে অনেকে স্বর্গপ্রদত্ত বা মানুষের আত্মা নামক এক অস্তিত্বের কারণে বিদ্যমান বলে মনে করেন। অনেকে জোর দিয়ে বলেন যে নৈতিকতা বা আদর্শের ধারণা এক মহান সৃষ্টি, যা বিজ্ঞানের আওতার বাইরে। এই ধারণার অসারতা বিবর্তনের শিক্ষার আলোকে স্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান। মানুষ নিজেই আর সেই সাথে তার সব ধর্মই যদি বিবর্তনের মাধ্যমে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মের মূল কারণে সৃষ্ট, তাহলে নৈতিক চেতনা বা মূল্যবোধ বিজ্ঞানের আওতার বাইরে বলাটা এক অর্থহীন ও অসংগতিপূর্ণ উক্তি নয় কি? মজার কথা এই যে এই ধরণের উক্তি প্রগতিশীল ও বিজ্ঞান সচেতন বলে দাবীদার অনেকের মুখেও শোনা যায়। অনেকে স্বার্থপর বংশাণুর ধারণায় অস্বস্তি বোধ করায় এটাকে ভুল বা লঘু প্রমাণ করার জন্য মানুষের মধ্যে পরার্থতা বা পরোপকারিতার প্রবৃত্তির (Altruism) অস্তিত্বের কথা উল্লেখ করেন। কিন্তু একটু ভাল করে তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে পরার্থতা বা পরোপকারিতার মূল উৎস কিন্তু নিজের মঙ্গল বা সুবিধাই। Altruism কে আমরা যত মহান বলেই ভাবি না কেন বিবর্তনের কাছে এটা বংশাণু সংরক্ষণের আরেকটা পরোক্ষ কৌশল মাত্র। বংশাণুর দ্বারা মানুষ গঠিত, আর বংশাণু স্বার্থপর, কাজেই মানুষের মধ্যে যে কোন গুণ বা ধর্মই, যা মানুষের মস্তিষ্কে উচু বা নীচু (যেমন স্বার্থপরতা বা পরার্থতা) মনে হতে পারে, চূড়ান্ত বিচারে তা বংশাণুর স্বার্থপরতারই একটি বহিঃপ্রকাশ। এই পরার্থতা যাকে বিবর্তনের ভাষায় পারস্পরিক পরার্থতা (Reciprocal Altruism) বলে, তা সকলের সাধারণ সুবিধা প্রদান ক’রে সবার বংশাণু উদ্বর্তনে সহায়তা করে। সকল প্রাণীর মধ্যেই কম বেশি এটা দেখা যায়। গুহাবাসী এক রক্তপায়ী বাদুড়দের মধ্যে এটা খুব সুন্দর ভাবে দেখা যায়। কোন বাদুড় অসুস্থতার জন্য রক্ত সংগ্রহে বের হতে না পারলে তার প্রতিবেশী বাদুড় তার নিজের ভাগ থেকে রক্ত দানঙ্করে অসুস্থ বাদুড়কে, যাতে সেও অনুরূপ উপকার পেতে পারে তার সঙ্কটের সময়। মানুষ তার নিজের আদিম বিবর্তন জনিত প্রবৃত্তির তাগিদে কোন সময় স্বার্থপর হতে পারে, বিশেষ করে যখন স্বার্থপর হওয়াতে তার সন্তান সন্ততির সুবিধা হয়, যার ফলে তার নিজের বংশাণু সংরক্ষণ ও সঞ্চারণে সুবিধা হয়। আবার সেই একই মানুষ অন্যান্য মানুষ (অর্থাৎ অন্য বংশাণুর ) সমষ্টিগত মিথোষ্ক্রিয়ার প্রভাবে পরার্থপরও হতে পারে, যখন তা পরোক্ষভাবে তার বংশাণু সংরক্ষণ বা সঞ্চালনে সহায়ক হয় । বাস্তব জীবনে এর প্রতিফলন দেখা যায়। অনেকেই তাদের আত্মীয় স্বজন ভাই বোনকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপকার ও সাহায্য করে। এই আত্মীয় নির্বাচনের (Kin Selection) মাধ্যমে তাদের বংশাণু বিস্তারে কিছুটা সাহায্য হয় কারণ আত্মীয় স্বজন এর মধ্যে কিছু সাধারণ বংশাণু বিদ্যমান যার উদ্বর্তনে সবারই স্বার্থ জড়িত। আবার বিশেষ অবস্থায় যখন এক বিরাট সুবিধার প্রশ্ন জড়িত (লক্ষ কোটি টাকা বা মূল্যবান জমি জমা ইত্যাদি) তখন সেই একই মানুষ তার আত্মীয় স্বজন ভাই বোনকেও দরকার হলে বঞ্চিত করে বিরাট লাভবান হতে কুন্ঠিত বোধ করে না, কারণ এতে তার সন্তান সন্ততি প্রচুর লাভবান হয় যার পরিণতিতে তার নিজের বংশাণু সংরক্ষণ ও সঞ্চারণ সুনিশ্চিত হয়। এই স্বার্থপর বংশাণুর কারণেই মানুষ সহ সকল প্রাণীর মধ্যে আগ্রাসন দেখা যায়। আগ্রাসনের দ্বারা নিজের ও সন্তান সন্ততির বংশাণুর সুবিধার জন্য অধিকতর রসদ সংগ্রহের চেষ্টায় প্রয়োজনে বল প্রয়োগে বা হটকারিতার দ্বারা অন্যের রসদ কুক্ষিগত করার চেষ্টা করে। এই আগ্রাসনের পরিণতিতে যার শক্তি বেশী সে দুর্বলকে নিয়ন্ত্রণ ও শোষণ করে। এ জন্যই “জোর যার মুল্লুক তার” (Might is Right) কথাটি এত বহুল প্রচলিত। আমরা যতই নৈতিকতার বড় বড় বুলি আওড়াই না কেন চূড়ান্ত বিশ্লেষণে অধিকাংশ মানুষই সম্পদ বা রসদ আহরণকেই প্রাধান্য দেয়। “সততাই সর্বোত্তম পন্থা” (Honesty is the Best Policy) বলা হলেও বাস্তবে দেখা যায় যে কম সম্পত্তিসম্পন্ন সৎ ব্যক্তির চেয়ে বেশী সম্পত্তি সম্পন্ন অসৎ ব্যক্তির দাম বেশী তার বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজনের কাছে। সততাকে অনেক সময় বোকামি বা সরলতা বলে উপহাস ও করা হয়। বর নির্বাচনের সময় সততার চেয়ে সম্পত্তির বিচারই প্রাধান্য পায়। অন্যের রসদ (বা টাকা) ভোগ করার সহজাত প্রবৃত্তি এই স্বার্থপর বংশাণুর কারণেই। আগেই বলেছি যে বিবর্তনের কারণেই এই স্বার্থপর বংশাণুর প্রভাব যাতে লাগামছাড়া না হয়ে যায় তার জন্য নৈতকতার চেতনার সৃষ্টি, যার জন্য অসাধুতাকে খারাপ বলা হয়। তাই অসাধু হিসেবে চিহ্নিত না হয়ে কি করে অন্যের টাকা ভোগ করা যায় তার জন্য নানারকম কৌশল বের করেছে মানুষ, যেমন সাদা অপরাধ (White Collar Crime) যেটা সরাসরি লুঠ বা চুরির মত সহজে সনাক্ত করা যায় না। আরেকটা কৌশল হল মনে মনে ফেরৎ না দেবার উদ্দেশ্য নিয়ে অন্যের টাকা বা রসদ ধার করে ভোগ করা। টাকা ফেরত না দেবার জন্য বিভিন্ন অজুহাত তৈরী করা থাকে, যদি অজুহাত নেহাত দিতেই হয়। নিজের স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য (অর্থাৎ নিজেকে আগে বাচান বা নিজের মঙ্গল করা, প্রয়োজনে অন্যের স্বার্থকে ক্ষুণ্ণ করে হলেও) দেয়াটা একটি বিবর্তনীয় তাগিদ। তাই প্রবাদ আছে “চাচা আপন প্রাণ বাচা” বা “আপনি বাচলে বাপের নাম”, “জান বাচান ফরজ” বা “আত্মরক্ষাই প্রকৃতির প্রথম নিয়ম”(Self-preservation is the first law of nature) ইত্যাদি। অন্যকে ঢাল হিসেবে ব্যহার করে নিজেকে বাচানর চেষ্টা ব ঝুকিপূর্ণ কাজে অন্যকে ঝুকিতে ফেলে ঝুকির লাভটা নিজে ভোগ করার প্রবণতাও দেখা যায় ব্যবহারিক জীবনে। এই কথা বা অভিজ্ঞতা গুলি বহুল প্রচলিত এবং সুপরিচিত হলেও এগুলিকে চারিত্রিক দুর্বলতার লক্ষণ হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু বিবর্তনের শিক্ষা হল এগুলি যারা দৃঢ চরিত্রের অধিকারী বলে পরিচিত তাদের মধ্যেও দেখা যেতে পারে। শুধু মাত্র বিবর্তনের মূল ধারার ব্যতিক্রমী কিছু মানুষের মধ্য এগুলি কোন অবস্থাতেই দেখা যায় না, বিবর্তনের পারিসাংখ্যিক হেরফেরের কারণেই। বিবর্তনের আরও শিক্ষা হল মানুষের অনেক আচরণই অন্য প্রানীর থেকে খুব আলাদা কিছু নয়। এর কারণ মানুষ ও অনেক প্রাণীর অভিন্ন পুর্বসূরী । মানুষের খেলাধূলার প্রতি আগ্রহ সেটাও অনেক প্রাণির মধ্যে দেখা যায়। শত্রুর সাথে সম্ভাব্য মোকাবেলা ও আগ্রাসনের মহড়া দেয়ার আদিম প্রবৃত্তিতেই এর মূল নিহিত। মানুষের মধ্যে আরও কিছু বৈশিষ্ট্য যেমন কদমবুসি করা, নতজানু হয়া এগুলিও ইতর প্রাণীর থেকে পাওয়া। সারমেও বর্গ (Canine Family) ও নেকড়ে পরিবারেও এগুলি দেখা যায়। কোন বিখ্যাত ব্যক্তির সম্বর্ধনার সময় তাকে একটু ছোয়ার জন্য উপস্থিত দর্শকদের আকুল ইচ্ছা আমাদের পূর্বসূরী প্রাইমেট বর্গের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় । কার্ল সেগানের বই “Shadows of Forgotten Ancestors” তে এর সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায়। মানুষের মধ্যে জোটবদ্ধ হয়ে আক্রমণ করা, আক্রমণ প্রতিরোধ করা, সুবিধা আদায় করা (যেমন ইউনিয়ন করা) এই বৈশিষ্ট্যগুলিও প্রাণিকুলে দেখা যায়।
আগেই উল্লেখ করেছি আমাদের সমাজে জামাই নির্বাচনের সময় হবু বরের সহায় সম্পত্তির বিবেচনাই প্রধান্য পায়। সঙ্গী নির্বাচনের (Mate Selection) সার্বজনীন ক্ষেত্রে বিবর্তন বিজ্ঞানীরা কোন বিষয়টি প্রাধান্য পায় সেটি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করেছেন। বলেই রাখি এই প্রাধান্য পাওয়ার বিষয়টি প্রবৃত্তিগত, সচেতন বা সুচিন্তিত ভাবনার দ্বারা নয়। এই প্রাধান্যের বিষয়টি হল বংশাণুগত যোগ্যতা (Genetic Fitness)। আমরা যতই বলি না কেন মেয়েটার চেহারায় কি আসে যায়, ভেতরের গুণ টাই আসল বিচার্য্য কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় ছেলেরা সুন্দর মেয়ে চায় তাইত কথায় বলে আগেত রূপ নেহারি তারপর গুণ বিচারি। এর কারণ হল মেয়েদের যে সব বৈশিষ্ট্যগুলি ছেলেরা সৌন্দর্য্য হিসেবে চিহ্নিত করে সেগুলো মেয়েদের গর্ভধারণ ক্ষমতার মাপকাঠি। এই বৈশিষ্ট্যের মধ্যে আছে কোমর ও নিতম্বের অনুপাত (যত কম তত সুন্দর), সুডৌল পা ইত্যাদি। চেহারায় কি আসে যায়, ভেতরের গুণটাই আসল বিচার্য্য এটা মেয়েদের ছেলে বাছাইয়ের ক্ষেতের অনেকটা সত্যি। তবে তারা ভেতরের গুণ যাচাই করে ছেলেরা তাদের জন্য রসদ সরবরাহ করতে কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে আগ্রহী তা দিয়ে। তাছাড়া মেয়েরাও ছেলেদের পছন্দ করে বংশাণুগত যোগ্যতার চিহ্নধারী বৈশিষ্ট্যের কারণে, যেমন মুখায়বের প্রতিসাম্য, সুন্দর ফিগার ইত্যাদি। এরকম আরেকটি বংশাণুগত যোগ্যতার মাপক হল ছেলেদের গায়ের কোন বিশেষ গন্ধ যা স্বাভাবিক ঘ্রাণতন্তের মাধ্যমে পাওয়া যায়না, এক বিশেষ ঘ্রাণ অংগের (VNO Organ) মাধ্যমে মেয়েরা পায়। তাই এই বংশাণুগত যোগ্যতার ঘ্রাণ সম্পন্ন কোন পুরুষের সান্নিধ্যে আসলে মেয়েরা এক সহজাত আকর্ষণ অনুভব করে। যেটাকে চলতি ভাষায় কেমিস্ট্রি বলে। আর বংশাণুগত যোগ্যতা ছাড়াও ছেলেদের মধ্যে রসদ বা সম্পত্তির প্রতুলতাও এক গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়, যেটা জামাই নির্বাচনের ক্ষেত্রেও উল্লেখ করেছি। প্রাচীন যুগে সাহসী ও বলবান পুরুষের অধিক রসদ সংগ্রহে সক্ষম ছিল। তাই একটি ইংরেজী প্রবাদ আছে “None but the brave deserve the fair” (কেবল সাহসীরাই সুন্দরী মেয়েদের যোগ্য) । এখনও কথাটা অনেকটা সত্য তবে জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতিতে পেশীর বল ছাড়াও বুদ্ধির বলও এখন রসদ সংগ্রহে ভূমিকা রাখে। মেয়েদের আরেটা বংশাণুগত যোগ্যতা হল তারুণ্য। কম বয়সী মেয়েরা বেশী বয়সের মেয়েদের চেয়ে বেশী গর্ভধারণ ক্ষমতা রাখে ও সন্তান প্রসবে কম ঝুকি রাখে। মেয়েদের মাসে একটিমাত্র ডিম্বাণু তৈরী হয় যা পুরুষদের শুক্রাণুর চেয়ে অনেক বড় তাই এর জন্য মেয়েদের অনেক বেশী শক্তি ব্যয় করতে হয় । তাই কম বয়সী মেয়েরা গর্ভধারণে বেশী উপযোগী। পুরুষদের যেহেতু সর্বদা লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্রাকার শুক্রাণু তৈরী হয়ে থাকে তাই সন্তান সৃষ্টিতে বয়স তাদের জন্য তেমন কোন গুণক নয়। তাই কম বয়সী মেয়েদের প্রতি পুরুষেরা এক সহজাত আকর্ষণ বোধ করে। তাই যখন কোন বিখ্যাত বা সমাজবরেণ্য কোন ব্যক্তি তার দীর্ঘদিনের স্ত্রী ও সন্তানদের ত্যাগ করে কম বয়সী কোন তরুণীকে বিয়ে করে ফেলেন তাতে অবাক হবার কিছু নেই, কারণ সেই ব্যক্তি বিবর্তনের জোরাল তাগিদেই চালিত হয়েছেন মাত্র। দ্বিচারিত্বের (Infidelity) ও এক বিবর্তনজণিত তাগিদ আছে মেয়েদের মধ্যে। কাজেই সতী বলে সামাজিকভাবে সুপরিচিত কোন মহিলার অকস্মাৎ দ্বিচারিত্বের ঘটনায় অবাক হবার কিছু নেই। তিনিও সেই প্রাচীণ তাগিদকে রোধ করতে না পেরেই দ্বিচারিত্বে লিপ্ত হয়েছেন মাত্র। এই দ্বিচারিত্বের প্রবৃত্তির প্রজাতি বা প্রাণী বিশেষে হেরফের হয়। পেঙ্গুইন, রাজহাস ইত্যাদির মধ্যে এটা একেবারই অনুপস্থিত।
আবারও স্মরণ করিয়ে দেই বিবর্তনজনিত উপরোল্লেখিত মানব প্রবৃত্তিগুলি পারিসাংখ্যিক ভাবে বা গড় অর্থে সত্য। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। তাই চরম সৎ ব্যক্তি, বিষয় সম্পত্তিতে চরম বৈরাগ্য, অতিশয় রোমান্টিক বা আদর্শিক অনুভূতির দ্বারা প্রেমে পড়ে প্রেমিকা/প্রেমিকার বৈষয়িক প্রাচুর্য বা দৈহিক সৌন্দর্য্যকে উপেক্ষা করা ইত্যাদি একেবারে দুর্লভ নয়। কিন্তু এগুলি নিয়মের ব্যতিক্রম, সঠিকভাবে বলতে গেলে এগুলি বিবর্তনের মূল লক্ষ্য নয়, বরং বিবর্তনের অনিবার্য্য উপজাত।
বিবর্তনের এক কঠিন শীতল শিক্ষা হল জীবনের কোন পরম অর্থ নেই। মানুষ সৃষ্টির কোন আলাদা তাৎপর্য্য নেই। মানুষ ও সকল প্রাণীর সৃষ্টি হয়েছে বিবর্তনের একই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যা হল বংশাণুর (বা ডি এন এ ‘র তথ্যের) সংরক্ষণ ও এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে সঞ্চালন। বিবর্তনের আলোকে সেটাই জীবনের পরম অর্থ। বিবর্তনের নিরীখে তার জীবনই সার্থক ও সফল যে তার বংশাণুর সর্বাধিক বিস্তার ও সঞ্চালন নিশ্চিত করতে পেরেছে। যে আর্নল্ড শোয়ারয্নেগার এর মত পেশীবহুল ও বলীয়ান অথচ কোন সন্তান রেখে যেতে পারনি তার জীবন ক্ষীণকায় লিকলিকে শরীরের কোন ব্যক্তি যে অনেক সন্তান রেখে যেতে পেরেছে তার জীবনের চেয়ে অনেক কম অর্থবহ বা সফল। জীবনের অন্য যে কোন অর্থ বা সফলতার সংজ্ঞা যে যার ইচ্ছে মত বের করতেই পারেন। আমরা সভ্যতা নিয়ে অনেক গর্ব বোধ করতে পারি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব সাফল্যের উচ্ছসিত প্রশংসা করেত পারি, পারি মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব ঘোষণা করে দম্ভোক্তি করতে। কিন্তু এ সবের কোন চূড়ান্ত উদ্দেশ্য নেই, বা থাকলেও মানুষের জানা নেই। সভ্যতা, প্রযুক্তি এ সবই বিবর্তনের উপজাত হিসেবে সৃষ্ট, যেমনটি সৃষ্ট পরমাণু শক্তি যা মানুষ প্রজাতিকে নিমেষের মধ্যে বিলুপ্ত করতে সক্ষম। অথচ এই সম্ভাব্য পারমাণবিক ধ্বংসযজ্ঞের হাত থেকে অনেক “নিম্ন” শ্রেণীর প্রাণী ও ব্যাক্টেরিয়া নিজেদের বাচাতে সক্ষম।
জটিল বক্তব্য। আরও কয়েকবার পড়তে হবে বলে মনে হচ্ছে। লেখককে ধন্যবাদ।