অজানা একাত্তর
হাসান মাহমুদ
১৯৬৭ সাল। কাঁচা সোনা রঙ্গের কটা বেড়াল-চোখ সুঠাম সুদর্শন তরুণ আনোয়ার শাহিদ খান। যেন বলিউডের নায়ক ভুল করে ইÏটারউইং স্কলারশীপ নিয়ে লাহোর থেকে ফিজিক্স-এ অনার্স পড়তে এসেছে। কাব্যময় সংবেদনশীল মন, শের শায়েরী আর গজলের আধার। থাকত ফজলুল হক হলে। আমিও থাকি সেখানেই। কি করে যেন বন্ধুত্ব হল নিবিড়, নিবিড় থেকে নিবিড়তর। খেয়াল করতাম অনুসন্ধিৎসু চোখে সে নিরীক্ষণ করছে আমাদের ওপরে পশ্চিমের নিপীড়ন আর শোষণ। কাছে থেকে থেকে দেখে দেখে আনোয়ার বুঝতে পারছে কেন ওদের এত উন্নতি আর আমাদের এত অবনতি, কেন আমাদের ছয় দফা। তার শের-শায়েরীর কাব্যিক মন ঠিকই ধরেছে ইসলামের নামে পাকিস্তানী রাজনীতির বিভৎস ঠকবাজী। স্বচক্ষে সে দেখল পঁচিশে মার্চে হঠাৎ নিরস্ত্র জনতার ওপরে সামরিক বাহিনীর অবিশ্রান্ত গোলাবর্ষন গণহত্যা গণধর্ষন, সময়ের জঠরে তখন জন্ম-যন্ত্রণায় নড়ে উঠছে পাকিস্তানের মাটিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অবিশ্বাস্য ভ্রূণ।
বাজপাখীর আক্রমণে মুরগীর বাচ্চার মতন ছিটকে উঠে শহর ছুটল গ্রাম-জননীর সুবিশাল আশ্রয়ে, জননীও আগ্রহী হাত বাড়িয়ে কোটি সন্তানকে তুলে নিল তার সস্নেহ কোলে। কিন্তু আনোয়ার যাবে কোথায়? এখানে তো ওর কেউ নেই, দেশটা ওর চেনাও নেই। এক বন্ধুর সাথে কোনমতে রাজশাহী পৌঁছুল আনোয়ার, তারপরে ঘাতক সৈন্যদলের ধাক্কায় সবাই সীমানা পেরিয়ে ভারতের মুর্শিদাবাদে শরণার্থী শিবির। মে মাসে সেনাপ্রহরায় রাজশাহী- ঢাকা এবং জুনে সটান লাহোরে বাবা-মায়ের কোলে।
তারপর। বাংলাদেশের জীবন-মরণ মুক্তিযুদ্ধের অজানা অধ্যায় শুরু হল পাকিস্তানেও। পশ্চিমা প্রাসাদ-ষড়যন্ত্রের পঁচিশ বছরের ঠকবাজী ও একাত্তরের গণহত্যা-গণধর্ষণের ওপর আনোয়ারের চাক্ষুষ নিবন্ধ ছাপা হচ্ছ্রে ‘‘পদ্মা সুরখ হ্যায়’’ (রক্তাক্ত পদ্মা) নামে, – প্রতিদিন একসাথে লাহোরের দৈনিক মুসাওয়াত ও করাচীর দৈনিক ডন’-এর গুজরাটি সংস্করণে। হৈ হৈ পড়ে গেল দেশে। জামাতিরা সগর্জনে ছুটল ভারতের দালাল ঘোষণায় বাড়ী জ্বালিয়ে ওকে কতল করতে। ছুটে এল পুলিশ আর গোয়েন্দা, নিজদেশে পরবাসী আনোয়ার লুকিয়ে গেল আ¨ারগ্রাউ¨ে।
আনোয়ারের এই নিঃসঙ্গ সংগ্রাম বুঝতে কল্পনাশক্তি দরকার। আমাদের তবু দেশ ছিল গ্রাম ছিল, স্বাধীন বাংলা সরকার ছিল বেতার ছিল, চারদিকে সংগ্রামী জাতি আর মুক্তিযোদ্ধারা ছিল, আন্তর্জাতিক সমর্থন ছিল, শেষ সম্বল হিসেবে ভারতে আশ্রয় ছিল, ওর কি ছিল চতুর্দিকে অগণিত শত্রু ছাড়া? আকস্মিক আক্রান্ত হয়ে আমাদের তো যুদ্ধ ছাড়া উপায় ছিলনা, কিন্তু ওকে তো কেউ বাধ্য করেনি স্বজাতিরই বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে নামতে! এমনকি আমাদের সাথে ওর তো যোগাযোগও ছিলনা! বাবা-মা ভাইবোন থেকে দুরে লুকিয়ে বাঁচা – চাকরী নেই উপার্জন নেই খাবার নেই থাকার জায়গা নেই – জাতির সামনে পঁচিশ বছরের ষড়যন্ত্র তুলে ধরা, হিংস্র সরকারের গণহত্যা-গণধর্ষণ তুলে ধরা, একে আমি ‘‘পাকিস্তানের মাটিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’’ বলব না তো কি বলব?
এ হল লাহোর। আর করাচীর মখ্দুম?
একাত্তরের প্রথম দিকে জাহিদ মখদুম করাচীর তুখোড় ছাত্রনেতা। নির্বাচন শেষ হয়েছে, সারা পাকিস্তানে মেজরিটি জিতেছে বাঙ্গালীর আওয়ামী লীগ। আমাদের বিজয়ের বিরুদ্ধে ভুট্টো-ইয়াহিয়ার ষড়যন্ত্র টের পেয়েই সে ছাত্রসমাজকে নিয়ে যুদ্ধে নামল। দিনরাত মিটিং-মিছিলে, শ্লোগানে-হুংকারে, দেয়ালে দেয়ালে হাজারো পোষ্টারে, সংসদের সামনে বিক্ষোভে আর চীৎকারে কাঁপিয়ে তুলল করাচী। একের পর এক বিদ্রোহী নিবন্ধ লিখতে লাগল সিন্ধী দৈনিক ‘‘ইবারত’’-এ। খুনে সেনা-সরকারের মুখের ওপরে ছুঁড়ে দিল তার বক্তব্য, – ‘‘জনগণের পয়সায় তোমাদের হাতে অস্ত্র দেয়া হয়েছে দেশ-শাসন করার জন্য নয়। নির্বাচনে পুর্ব পাকিস্তান জিতেছে, লক্ষ্মী ছেলের মতো তাদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে ব্যারাকে ফিরে যাও।’’ প্রমাদ গুনল ভুট্টো, প্রমাদ গুনল সরকার। এদিকে শুরু হয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পাল্টা আক্রমণ, ধীরে ধীরে কাদায় পড়ছে নাপাক বাহিনী আর দেশী মীরজাফরের দল। ওদিকে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ল মখদুম। তারপর লারকানা, জেকোবাবাদ, শুক্কুর আর হায়দ্রাবাদ কারাগারে তার শরীরের ওপর নেমে এল কেয়ামত। স্বীকার করো তুমি ভারতের গুপ্তচর, টাকাপয়সার লেনদেন আছে। স্বীকার করো তোমার সাথে বাংলার ‘‘মুক্তি’’-দের গোপন যোগসুত্র আছে। লোহার রডের প্রহার, ইলেক্ট্রিক শক্, অন্ধকার সলিটারি কনফাইনমেÏেট ঘুমহীন, কখনো খাবারহীন পানিহীন বন্দী জাহিদ মখদুম। কতদিন? মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়মাসের পরেও কিছুদিন। ‘‘ভুল করেছি’’-র মুচলেকা সই করলেই তাকে ছেড়ে দেয়া হত – তবু তার উঁচু সে মাথা সে কখনো নোয়ায় নি।
একেও আমি ‘‘পাকিস্তানের মাটিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’’ বলব না তো কি বলব?
‘‘মানুষের মন চায় মানুষেরই মন’’ – কবিগুরু। তাইতো আন্তর্জাতিক সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে এতো দেয়া নেয়া, তাইতো বম্বের সিনেমায় অভিনয় করেন পাকিস্তানী সালমা আগা, ‘‘শত্রুর দেশে’’ কনসার্ট করেন মেহদি হাসান আর তাঁর সম্পর্কে সে দেশের উচ্চতমা পদ্মশ্রী বলেন – ‘‘উন্কা গলে মে ভগওয়ান ঝরতা হ্যায়’’ (‘‘উনার কণ্ঠেরষ্টা উৎসারিত হন’’ – লতা মুঙ্গেশকর) । তাইতো আমাদের মুক্তিযুদ্ধে জর্জ হ্যারিসন গানে গানে টাকা তোলেন, ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের মন্ত্রণাসভা বসে এলিফ্যাÏট রোডে মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র বিদেশী বীরপ্রতীক উপাধিপ্রাপ্ত বাটা’র ম্যানেজার অডারল্যা¨ সাহেবের বাসায়। তাইতো বাংলার গায়ক সুমন চট্যার্জী সুদুর নিকারাগুয়া’র স্যান্দিনিস্তা গণযুদ্ধে জীবনের ঝুঁকি নেয় উদ্যত বন্দুক হাতে, রবিশংকরের সেতারে ক্যারিবিয়ান পল্লীসংগীত আর পশ্চিমা কর্ড, হলিউডের ছবিতে জাকির হূসেন আর চীনা ভাষায় গেয়ে ওঠেন বাঙ্গালীনি সাবিনা ইয়াসমিন। এত আগুনের মধ্যেও পুরষ্কারপ্রাপ্ত ইসরাইলী ডিরেক্টর অ্যামস্ গিতাই-এর ছবিতে অভিনয় করেন পুরষ্কারপ্রাপ্ত প্যালেষ্টাইনী অভিনেতা ইউসুফ আবু ওয়ার্দা, ইসরাইল-প্যালেষ্টাইনের নাট্যকর্মীরা একসাথে নাটক করেন। তাইতো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মুসলিম ‘‘বৌদি’’ আর হিন্দু ‘‘মা’’য়ের সÞমরক্ষায় বুকের রক্ত ঢেলে হিন্দু আর মুসলিম যুবক ইতিহাসে রেখে যায় মহামিলনের আর্ত আহ্বান।
এরই নাম মানবতার শক্তি। তাই তো ইতিহাসের প্রতিটি বার্লিন-প্রাচীর এত ভঙ্গুর, এত ক্ষণস্থায়ী। এপারে এক ফোঁটা রক্তের পাশাপাশি ওপারে এক ফোঁটা অশ্রু গড়ায় এটা ইতিহাসের সত্য – তা সে বার্লিনই হোক, ইংল্যা¨-আয়ার্ল্যা¨ই হোক, বিভক্ত বাংলা-পাঞ্জাব-কাশ্মীরই হোক, ইসরাইল-প্যালেষ্টাইনই হোক বা পাকিস্তান-বাংলাদেশই হোক।
পিন্ডির অলিগলির ঠেলাগাড়ীতে ফল-সব্জী নিয়ে যে ঘর্মাক্ত লোকটা হাঁক দিয়ে বিক্রী করে বেড়ায় সে আমাদের শত্রু নয়। কোহাটের পাহাড়ে যে লোকটা পাথর ভাঙ্গে, যে নারীরা বাচ্চার হাত ধরে ঝিলাম-চেনাব-বিয়াস-শতদ্রু আর সিন্ধু থেকে কাঁখে কলসভরা পানি টানে তারা আমাদের শত্রু নয়, শত্রু নয় করাচীর রাজনৈতিক উষ্কানীতে যে তরুণকে খুঁচিয়ে খুন করা হল তার বাবা-মা। পাকিস্তানের মসজিদে নামাজে ব্রাশ ফায়ারে যারা রক্তাক্ত মরে পড়ে থাকে তাদের সাথে আমাদের নয়শ’ কুড়িটি বধ্যভুমির তফাৎ সামান্যই। আমাদের সবার শত্রু এক, এবং সেই পাকিস্তানী ও বাংলাদেশী পিশাচরা কারা তা এদিকে আমরাও জানি ওদিকে আনোয়ার-মখদুমরাও জানে।
এ দানবকে পরাস্ত করা অত্যন্ত কঠিন। আজ যখন দানবের হাতে আছে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মানবের সংগ্রামও তাই আন্তর্জাতিক না হয়ে উপায় নেই। সুদুর নিউজিল্যা¨ের এডম¨ হিলারি’র সাথে সুদুর নেপালের তেনজিং নোরপে’র মিলন ছাড়া এ দুর্গম হিমালয়-বিজয় অসম্ভব। সুদুর পর্তুগালের ভাস্কো-ডা গামা’র সাথে সুদুর ইয়েমেনী সমুদ্র-এক্সপার্ট আবদুল মজিদের মিলন ছাড়া এ দুর্দান্ত সমুদ্র-বিজয় অসম্ভব।
অগ্নিবীণার অদম্য বাদক! অসাধ্যসাধনের দুর্দম সাধক! বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সম্মান তোমাদের কপালে জটেনি কিন্তু তোমাদের প্রতি এই গর্বিত বাংলাদেশীর লক্ষ সালাম।
—–
আনোয়ার, মখদুম ভালো আছে, আমার সাথে ফোনে কথা হয় এখনো। মিঃ জাষ্টিস জাহিদ মুখদুম এখন ক্যানাডার কোর্টে আলুচেরা-চোখে গম্ভীর বিচারক, আনোয়ার করাচী ষ্টিল মিলে চাকরী থেকে অবসর নিয়েছে। শুধু ওরাই নয়, খুঁজলে কাশ্মীরের হাশিম আর আশরাফ, করাচীর গোলাম মুহাম্মদ ল’ুন কিংবা মকবুল বাট-এর মতো অনেক নামই পাওয়া যাবে।
***
হাসান মাহমুদ – শারিয়া ও ইসলামিক ল, মুসলিম ক্যানাডিয়ান কংগ্রেসের ডিরেক্টর। মুক্তমনার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। প্রকাশিত বই – আল ভোদরের দেশ, শারিয়া কি, শারিয়া কেন, ইসলাম, শারিয়া ও রাজনীতি, থ্রেট অব পলিটিকাল ইসলাম (ইংরেজী)। ইমেইল – [email protected]
বিপ্লব ভাইয়ের মন্তব্যটা চরম সত্য। মার্ক্সবাদীরা মার্ক্সবাদ নিয়ে টানাটানি করে,লেনিনবাদীরা লেনিনবাদ নিয়ে। তারা শুধু বড় বড় বুলি আওড়ান। কিন্তু বোঝার চেস্টা করেননা যে এটা মার্ক্সের জার্মানি বা লেনিনের রাশিয়া না। লেনিন যেমন সমাজতন্ত্রকে তার দেশের মানুষের সিস্টেম অনুযায়ী পরিবর্তিত করে লেনিনবাদ সৃস্টি করেছেন,আমাদেরকেও সব তন্ত্র বা মতাদর্শকে আমাদের দেশের মানুষের বোঝার সুবিদার্থে সেভাবে পরিবর্ত্ন করতে হবে।
তবে সেদিন ডারউইনের’প্রজাতির উদ্ভব’ বইটার ভুমিকা পড়তে গিয়ে একটা মজার উক্তি পেলাম,” আজকাল মার্ক্সবাদীরা মার্ক্স পরেননা,আর ডারউইনবাদীরা ডারউইনকে এড়িয়ে যান”
উক্তির বক্তার নাম আমার মনে নেই। তবে এটাই বাস্তব সত্য।
সবশেষে আবার বলি,”সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই”
প্রিয় হাসান ভাই,চমৎকার লেখাটি আমাদের চিন্তার দুয়ার খুলবে।সা্ধীনতাকামী ও মুক্তিকামী এবং সংস্কতি ও মুক্ত-মনাদের যে কোনো দেশ-কাল নেই এ লেখাটি তার-ই সা্ক্ষ্য বহন করে।সময়ের স্রোতে এরা এক ও অভিন্ন ।অনেক শুভেছছা রলো।
মামুন,
সুইডেন।
আপনার লেখাটা খুব ভালো লাগল। গান্ধীকে নিয়ে আমার লেটেস্ট লেখাটা লিখতে গিয়ে আপনার এই লেখাটা অনেক বার পড়লাম। আসলে মানুষ পতিত হয় না-পতিত হয় সিস্টেম-আউটডেটেড হয় আদর্শ। অথচ আমরা উলটো কাজ করি-আমরা মানুষকে পতিত করি, আদর্শবাদকে মাথাই তুলে নাচি। মানুষে মানুষে বিভেদ ঘোচাতে এই ধরনের আরো লাখো লাখো লেখা লাগবে।
লেখাটা আগেও একবার পড়েছিলাম। আবারো পড়লাম।
অসামান্য লেখা। এ ডকুমেন্টগুলো রাখা জরুরী – আমাদের নিজেদের স্বার্থেই।