সুন্দর হে সুন্দর
আমার পাঠকদের অনেকেই জিজ্ঞেস করেছেন আমি অঙ্কের লোক হয়ে সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলাম কেমন করে। আমি বলি, দু’টোকেই ভালবাসি বলে। একটি আমার বৈধ প্রেম, আরেকটি পরকীয়া। কোনটা কি তা আমি ঠিক করে উঠতে পারিনি এখনো।
আসলে অঙ্ক আর সাহিত্যের মাঝে মৌলিক বিরোধ কোথায় ?
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের এক অধ্যাপকের সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল একবার, সাঁতারের পুলে গিয়ে। কথায় কথায় উনি বললেন, জানেন, ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে কিন্তু অঙ্কের একটা সূক্ষ্ম মিল আছে। আমি তাঁর মন্তব্যকে লুফে নিয়ে বোকার মত বলে ফেললাম, অবশ্যই আছে। আমরা দু’জনই প্যাটার্ণ খুঁজি। দু’টিতেই ছন্দ আর প্রতিসাম্যের সন্ধিৎসা আছে।
অনেকদিন আগের কথা সেটা, যখন আমার লেখালেখির জীবন শুরু হয়নি। তখন হয়ত না বুঝেই বলেছিলাম কথাগুলো, আন্দাজে গুল মারা যাকে বলে। … ( এরপর পড়ুন এখানে )
ড. মীজান রহমান, কানাডার অটোয়ায় বসবাসরত গণিতের অধ্যাপক। পঞ্চাশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষকতা করেছেন বেশ ক’বছর। বিশ্লেষনধর্মী প্রবন্ধকার হিসেবেও সুপরিচিত। প্রকাশিত গ্রন্থ সাতটি, সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ ‘দুর্যোগের পূর্বাভাস’ (২০০৭)।
ভাষা,সাহিত্য,কলা,স্হ্াপত্য বিজ্ঞান,সমাজ বিজ্ঞান,রাষ্ট বিজ্ঞান সহ জীবন,জগ্ৎ,মহাবিশ্বকে বা্হির ও আভ্যন্তরিন যেভাবে-ই বিচার-বিশ্লেষন করা হউক না কেন তাকে কি অংকের হিসাবের বাইরে রেখে হিসাব করা যায়,যায় না।সব বিভাগ আজ এক একটি প্রতিষঠানে বিকশিত হলেও অংকের হিসাব ছাড়া কোনো বিভাগ-ই বিকশিত হওয়া কঠিন।যে ব্যাক্তি ও জাতি যত অংক বেশি বুঝে সে জাতি তত বেশি সময়ের গতিতে অগ্্রসর।
মিজান ভাই এর লেখা মানেই সব কিছু কে বহির ও ভিতরের সব জিনিষ কে অংকের মতো কঠিন জিনিষ কে দিয়ে সুনদর করে সাজানো। এই সাজানো-কেই বলা হয় সৌন্দর্য।অনেক শুভেছছা রলো।
আমি নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই কিছু লিখি।
প্রথমত গণিতকে আমি ভাষা হিসাবেই দেখি। তাই গণিতে সৌন্দর্য্যের সাথে ভাষাগত সৌন্দর্য্যের মিল ই আমি দেখি। পেশাগত জীবনে আমাকে অনেকটা সময় অঙ্ক নিয়েই কাটাতে হয়-কোন সন্দেহ নেই যেকোন সিস্টেমকে প্রকাশ করার সেরা ভাষা হচ্ছে অঙ্ক-সেটা আরো মজার যখন পরীক্ষা করার আগেই কিছু ভবিষ্যত বাণী করা যায়। সেই দিক দিয়ে দেখলে
অঙ্কটা মাইক্রোস্কোপের বা টেলিস্কোপের কাজ করে। অজানা সৌন্দর্য্যকে, আমাদের সামনে তুলে ধরে। পরে সেটাই পরীক্ষা করা হয়।
মীজান রহমানের সুন্দর প্রবন্ধটি আমাকে দারুনভাবে ভাবিয়েছে। সাহিত্য এবং বিজ্ঞানের মেলবন্ধন নিয়ে আমি নিজেও খুব উৎসুক। অপার্থিবের একটি চমৎকার প্রবন্ধ মুক্তমনায় আছে এ নিয়ে – ‘বিজ্ঞান, শিল্প ও নন্দন তত্ত্ব’। আমার মনে হয় লেখাটি অপার্থিবের অন্যতম সেরা লেখাগুলোর একটি।
আমি লেখাটা থেকে মজার কিছু পয়েন্ট উল্লেখ করি –
কীট্স্ নাকি নিউটনের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করেছিলেন যে আলোকের সূত্রের দ্বারা রংধনুর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি রংধনুর সৌন্দর্যকেই ক্ষুন্ন করেছেন। অথচ কীট্স্ই আবার অন্য এক প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে ‘সত্যই সৌন্দর্য্য’।
আরেকবার, পদার্থবিদ ফাইনম্যানকে তাঁর এক শিল্পী বন্ধু হাতে একটা ফুল ধরে তাঁর দিকে তাক করে বলেন,
এর উত্তরে ফাইনম্যান বলেছিলেন যে একজন শিল্পী ফুলে যে সৌন্দর্য দেখতে পান, তিনিও সেই একই সৌন্দর্য দেখতে পান, কিন্তু উপরন্তু তিনি ফুলের ভেতরকার সৌন্দর্যকেও দেখতে পান, যেমন কি ভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোষ দ্বারা ফুলের পাপড়ি গঠিত হয়, কিভাবে বৈবর্তনিক উপযোজনের কারণে কীটপতঙ্গকে আকর্ষণ করার জন্য ফুলের সুন্দর রঙ্গের সৃষ্টি হয়েছে, এই সব, যা থেকে তাঁর শিল্পী বন্ধু বঞ্চিত।
আসলে ঐতিহাসিকভাবে অনেক কবি এবং সাহিত্যিকদের মাঝে একটা বাঁধা ধারণা ছিল যে বিজ্ঞান ও কলা বা সাহিত্য পরস্পর বিরোধী। আমি আসলে মীজান রহমানের মতই বিজ্ঞানকে একটি অনুপম কবিতার চেয়ে কম সৌন্দর্যময় মনে করি না।
এ প্রসঙ্গে ১৯৫৯ সালে কেম্ব্রিজে বিজ্ঞানী এবং সাহিত্যিক সি পি স্নো’র The Two culture বা দুই সংস্কৃতি শীর্ষক রীড বক্তৃতা বিশ্বব্যাপী সৃজনশীল মানুষের মধ্যে দারুইন ঝড় তুলেছিলো। স্নো কেম্ব্রিজে দুই সংস্কৃতির প্রসঙ্গগ তোলেন তার রিড বক্তৃতায়। তিনি বলেন, মানবিক সংস্কৃতি আর বিজ্ঞান সংস্কৃতির মধ্যে বিরাট ব্যবধান তৈরি হচ্ছে যা মানবিক সংস্কৃতির ধারকদের জন্য সমূহ ক্ষতির। কারণ বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিস্কার আর উদ্ভাবণ, যা আমাদের বিশ্ববোধের গভীরে কাজ করছে, সে সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে যাচ্ছে সাহিত্যিক মহল। তিনি উল্লেখ করেন, ‘তাপ বলবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র না জানা’ এবং ‘শেক্সপিয়রের কোন লেখা না পড়া’ সভ্যতার বিচারে তুল্যমূল্যের। ভর /ত্বরণ কি? আর তুমি কি রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ পড়েছ – জিজ্ঞাসা করা অনেকটা একই ।
আমার মতে, সাহিত্য সৃজনশীল আর বিজ্ঞান অসৃজনশীল এবং যান্ত্রিক – এ ধরনের বিভেদ করে জ্ঞানকে বিচ্ছিন্ন করার যে কোন প্রইয়াসই আসলে চূড়ান্ত বিচারে অসৃজনশীল।