আমরা মানব বিবর্তনের কথা শুরু করেছি নিয়ানডার্থালদের দিয়ে। তবে সূচনার মূল উদ্দেশ্য কিন্তু নিয়ানডার্থালদের পরিচয় করিয়ে দেয়া ছিল না। কিভাবে ফসিল সংগ্রহ করা হয় এবং ফসিল থেকে পাওয়া তথ্য কিভাবে একটি প্রজাতির দৈহিক গঠন, খাদ্যাভ্যাস, শিকার পদ্ধতি, মায়া-মমতা বা প্রতিযোগিতা সম্পর্কে আমাদের সম্যক ধারণা দেয় সেটা দেখানোই ছিল আসল লক্ষ্য। এবার আমরা নিয়ানডার্থালদের সার্বিক আলোচনায় প্রবেশ করব। প্রশ্ন জাগতে পারে, এদের দিয়েই শুরু করছি কেন বা মানুষ এবং তার নিকট পূর্বপুরুষদের এত সব প্রজাতি থাকতে শুধু নিয়ানডার্থাল নিয়ে এত কথা কেন।

প্রথম প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, মানব বিবর্তনের ইতিহাস বর্ণনার ক্ষেত্রে আমাদের পরিকল্পনা হচ্ছে নিকট অতীত থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে পেছনের দিকে যাওয়া। কিন্তু সেক্ষেত্রেও তো Homo floresiensis দিয়ে শুরু করা উচিত ছিল। কারণ ফসিল রেকর্ড বলে, হোমো গণের প্রজাতিগুলোর মধ্যে তারা সবার পরে বিলুপ্ত হয়েছে, আনুমানিক ১২,০০০ বছর পূর্বে। এর পরেই সবচেয়ে নিকট অতীতে বিলুপ্তি ঘটেছে নিয়ানডার্থালদের, প্রায় ২৮,০০০ বছর পূর্বে। বোঝাই যাচ্ছে, আমরা শুরুতেই নিজেদের তৈরি নিয়ম ভেঙেছি। এর কারণ নিয়ানডার্থালদের সাথে আদিম-আধুনিক মানুষদের সরাসরি সংঘর্ষের গল্প দিয়ে শুরু করার লোভটা সামলাতে পারছিলাম না। এই গল্পের কথা ভেবে আশাকরি পাঠক অনিয়মিত সূচনাটিকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আর একবার যখন শুরু করে দিয়েছি তখন নিয়ানডার্থাল শেষ না করে অন্য কিছুতে হাত দেয়াতেও মন সায় দিচ্ছিল না। নিয়ানডার্থালদের কথা শেষ করার পর আমরা সম্পূর্ণ নিয়ম মেনেই পেছাবো।

দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, প্রথমত, নিয়ানডার্থালদের অনেক ফসিল পাওয়া যাওয়ায় তাদের সম্পর্কে আমরা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি জানি। দ্বিতীয়ত, দেহ-সৌষ্ঠ্যবের দিক দিয়ে একটু প্রাচীন তথা আর্কায়িক হলেও বুদ্ধিমত্তা, সমাজ-কাঠামো, আবেগ-অনুভূতির দিক দিয়ে তারা আমাদের মতই ছিল। কোন কোন দিক দিয়ে হয়ত তারা আমাদের চেয়েও এগিয়ে ছিল। উল্লেখ্য, তাদের কারো কারো মস্তিষ্কের আয়তন ছিল আমাদের চেয়ে বেশি। তৃতীয়ত, ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় ২ লক্ষ বছর যাবৎ নিয়ানডার্থালরা রাজত্ব করেছে। আনুমানিক ১ লক্ষ বছর পূর্বে আদিম-আধুনিক মানুষেরা আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে পড়ে। ৪০ থেকে ৫০ হাজার বছর পূর্বে তাদের সাথে দেখা হয় নিয়ানডার্থালদের। ভাবতেই অবাক লাগে পৃথিবীর বুকেই আমাদের মত বুদ্ধিমান আরেকটি প্রজাতির সাথে আমরা একসাথে প্রায় ৩০,০০০ বছর পার করেছিলাম। আর প্রাথমিক আলোচনায় নিশ্চয়ই বোঝা গেছে যে, নিয়ানডার্থাল প্রজাতির সার্বিক বিলুপ্তিতে আমাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা থাকাটা মোটেও অসম্ভব নয়। চতুর্থত, হোমো গণের প্রজাতিগুলোর মধ্যে একমাত্র নিয়ানডার্থালদেরই পুরো জিন সিকোয়েন্স বের করা সম্ভব হয়েছে।

এখন নিয়ানডার্থালদের যে আলোচনা শুরু করতে যাচ্ছি তা পড়লে অবশ্য মনে হতে পারে তৃতীয় কারণটাই মুখ্য। কারণ এই আলোচনার মূল বিষয়বস্তু হবে আমাদের সাথে নিয়ানডার্থালদের তুলনা এবং তাদের বিলুপ্তি। তবে শুরু করা যাক।

মানব বিবর্তনের সিংহভাগ ঘটেছে আফ্রিকা মহাদেশে। এখানেই প্রায় ২৩ লক্ষ বছর পূর্বে হোমো গণের অন্তর্ভুক্ত প্রজাতিগুলোর উদ্ভব ঘটেছিল। প্রায় ১৭ লক্ষ বছর পূর্বে Homo ergaster প্রজাতিটি আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে পড়েছিল। ‘Old Out of Africa’ (OOOA) নামে পরিচিত এই বহির্গমনের ঘটনাই যে মানুষের প্রথম বিশ্ব অধিকারের প্রচেষ্টা তা নিয়ে প্রায় কারোই সন্দেহ নেই। বলাই বাহুল্য এই প্রচেষ্টা কেউ তখন সজ্ঞানে করে নি। আফ্রিকা থেকে বহির্গমন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আমরা পরের অধ্যায়ে শুনব। আপাতত কেবল এর সাথে নিয়ানডার্থালদের উদ্ভবের সংশ্লিষ্টতা বিচার করছি।

আফ্রিকাত্যাগী Homo ergaster দের থেকে প্রায় ৯ লক্ষ বছর পূর্বে যে প্রজাতিগুলোর জন্ম হয়েছিল তাদের সাধারণ নাম হচ্ছে আর্কায়িক (Archaic) মানব। হোমো এরগ্যাস্টার দের মধ্যে যারা ইউরোপে বসতি করেছিল তাদের উত্তরসূরী আর্কায়িক প্রজাতিটির নাম হচ্ছে Homo heidelbergensis. জার্মানির হাইডেলবার্গে এদের ফসিল পাওয়া গেছে বলেই এমন নাম। এতক্ষণে নিশ্চয়ই কারো বুঝতে বাকি নেই যে আমি হাইডেলবার্গ মানব নামের আর্কায়িক দেরকেই নিয়ানডার্থালদের সরাসরি পূর্বপুরুষ বলতে চাচ্ছি? কতটুকু নিশ্চয়তার সাথে এই কথা বলা যায় হাইডেলবার্গদের নিয়ে আলোচনার সময়ই সে প্রসঙ্গ আসবে। পরের অধ্যায়েই সব আর্কায়িক এবং আফ্রিকা থেকে বহির্গমন নিয়ে বিস্তারিত থাকবে। এখন মূল বিষয়ে প্রবেশের সুবিধার্থে ‘Young out of Africa’ (YOOA) নিয়েও দুয়েক কথা বলে নিচ্ছি।

১৭ লক্ষ বছর পূর্বে যে মানুষেরা ইউরেশিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল তাদের থেকে কিন্তু Homo sapiens তথা আমাদের জন্ম হয়নি। আফ্রিকার হোমো দের থেকেই আমরা বিবর্তিত হয়ে পরে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছি। এই ছড়িয়ে পড়াটা প্রকটভাবে ঘটেছে ১ লক্ষ বছর পূর্বে। এ সময় যারা আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে ইউরোপ এবং এশিয়ায় বসতি করেছিল তাদেরকেই আদিম-আধুনিক মানুষ (Early modern human) বলা হয়। এদের সাথেই আনুমানিক ৫০,০০০ বছর পূর্ব থেকে নিয়ানডার্থালদের সরাসরি সংযোগ ঘটেছে। আদিম-আধুনিক মানুষেরা দৈহিকভাবে হুবহু আমাদের মত হলেও সমাজ-সাংস্কৃতিক দিক থেকে বেশ পিছিয়ে ছিল। এজন্যই নামের আগে ‘আদিম’ শব্দটি যোগ করা। নিয়ানডার্থালদের সাথে তুলনা করব এদেরই, যারা আমাদের সরাসরি পূর্বপুরুষ। এর মধ্যে ভুলে গেলে চলবে না যে, আমরা দুটি প্রজাতি একই পূর্বপুরুষ তথা আর্কায়িক দের থেকে বিবর্তিত হয়েছি। সে হিসেবে তারা আমাদের খুব নিকট আত্মীয়।[১]

নিয়ানডার্থালদের ফসিলের মাধ্যমেই প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের একটি পৃথক শাখা হিসেবে জীবাশ্ম-নৃবিজ্ঞানের যাত্রা শুরু হয়েছিল। এদের প্রথম ফসিল পাওয়া গিয়েছিল ১৮৫৬ সালে, জার্মানির নিয়ানডার উপত্যকায়। এই উপত্যকার নাম থেকেই নিয়ানডার্থাল নামটি এসেছে। প্রথম ফসিল দেখে এটা বুঝতে কারো বাকি ছিল না যে, নিয়ানডার্থালরা মানুষের চেয়ে অনেক আলাদা এবং নিঃসন্দেহে একটি আলাদা প্রজাতি। তখনই Homo neanderthalensis নামের উৎপত্তি। ১৮৫৬ সালে এই স্থান থেকে কেবল মাথার খুলি এবং বাহুর হাড় পাওয়া গিয়েছিল।[২] খুলিতে ভ্রুর কাঠামোটি খুব উন্নত এবং বাহুর হাড়গুলো খুব শক্তপোক্ত থাকার কারণেই মানুষের চেয়ে তাদের অনেক আলাদা মনে হয়েছিল। তবে এদের প্রথম প্রায় পূর্ণাঙ্গ ফসিল পাওয়া গিয়েছিল ১৯০৮ সালে, ফ্রান্সের La Chapelle গুহায়। ফসিলটির নাম La Chapelle-aux-Saints 1 যা ” The Old Man of La Chapelle” নামে বহুল পরিচিত। এই ফসিল দেখে নিয়ানডার মানব থেকে পাওয়া ধারণাটি আরো পোক্ত হয়েছিল বিজ্ঞানীদের, অধিকাংশই মনে করছিলেন এরা আধুনিক মানুষের চেয়ে অনেক পশ্চাৎপদ, বর্বর এবং বুনো একটি প্রজাতি। বলা যায় নিয়ানডার্থালদেরকেই অসভ্য, বর্বর এবং আর্কায়িক মানবের প্রতিভূ হিসেবে দেখার একটি প্রবণতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। যা মানবিক নয় তাকেই নিয়ানডার্থালদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখা হচ্ছিল।[৩]

1(La Chapelle-aux-Saints 1 এর ফসিল, এখনও উত্তোলন করা হয়নি)

কিন্তু কয়েক দশক পর এই বুড়ো মানবের ফসিল আরও সূক্ষ্ণভাবে বিশ্লেষণের পর বিজ্ঞানীদের ভুল ভাঙতে শুরু করে। একটু শক্তপোক্ত হাড়গোড় দেখেই নিয়ানডার্থালদেরকে বুনো বলে দেয়াটা যে কত বড় ভুল ছিল বুঝতে পারেন অনেকে। দেখা যায়, চলাফেরা এবং আচার-অভ্যাসের দিক থেকে তারা ঠিক আমাদের মতই ছিল। তবে আমাদের চেয়ে তাদের দেহের কাঠামো বেশ শক্তপোক্ত এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। এর কারণ হিসেবে তৎকালীন ইউরোপের শীতল আবহাওয়াকে দায়ী করা হচ্ছে। শীতল পরিবেশের সাথে অভিযোজন করতে গিয়েই এ দশা হয়েছিল তাদের। অবশ্যই এ দশা তারা নিজেরা করেনি, প্রাকৃতিক নির্বাচনই যথারীতি অন্ধ চালিকাশক্তি ছিল। আর তাদের এই গঠনকে আমাদের চেয়ে বর্বর ভাবারও কোন কারণ নেই- যার পরিবেশ যেমন তার দেহের কাঠামো তেমন হওয়াটাই তো সভ্য-স্বাভাবিক। নিয়ানডার্থালদের সাথে আমাদের পার্থক্যটা কোথায় এবং তার কারণই বা কি সে সম্পর্কে একটু বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক এবার।

গায়ে-গতরে নিয়ানডার্থালরা আমাদের চেয়ে শক্তিশালী ছিল। যে বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের এ শক্তি যুগিয়েছে তার অনেকগুলোই বিবর্তিত হয়েছে তৎকালীন ইউরোপের শীতল আবহাওয়ার কারণে। উল্লেখ্য, নিয়ানডার্থালদের উদ্ভব ঘটেছিল শেষ তুষার যুগ শুরু হওয়ার পর, আবার বিলুপ্তিও ঘটেছে সেই তুষার যুগ শেষ হওয়ার আগে। তার মানে পুরোটা সময় তারা খুব শীতল পরিবেশে জীবন যাপন করেছে। এই শীতল পরিবেশের সাথে অভিযোজনই সম্ভবত তাদের ভারিক্কি শরীরের বিবর্তনের কারণ। শরীর ভারিক্কি হলে প্রতি একক আয়তনে দেহের পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল কম হয়, যার ফলে তারা দেহের ভেতরে বেশি তাপ সংরক্ষণ করতে পারে। নিয়ানডার্থালদের বক্ষপিঞ্জর অনেক চওড়া ও বড়, কাঁধ চওড়া, নিতম্ব চওড়া, হাড়গুলো মোটা মোটা। তাদের মস্তিষ্কের আয়তন গড়ে আমাদের চেয়ে বেশি ছিল, এটাও শীতল পরিবেশের কারণে হতে পারে। শীতল পরিবেশে উচ্চ মাত্রার বিপাক ক্রিয়ার জন্য বড় মস্তিষ্কের প্রয়োজন পড়ে। এই একই ব্যাপার ঘটেছে বর্তমান পৃথিবীর ইনুইট গোষ্ঠীর মানুষদের ক্ষেত্রে। আলাস্কা, কানাডা, এবং গ্রিনল্যান্ডের শীতল আর্কটিক অঞ্চলে বসবাসকারী এই গোষ্ঠীর মানুষদের মস্তিষ্কের গড় আয়তন বর্তমানে পৃথিবীর অন্য সব মানুষের চেয়ে বেশি। এছাড়া নিয়ানডার্থালদের সামনের দিকের দাঁতগুলো যে কারণে বেশ বড় বড় ছিল সেই একই কারণেই হয়ত বর্তমানে ইনুইটদের সামনের দাঁতও বড় বড়। ইনুইটরা দাঁতকে অনেক কিছু কামড়াতে ব্যবহার করে, নিয়ানডার্থালরাও বোধহয় এমন কিছু করত।

2(ইনুইট গোত্রের একজন নারী, বড় মস্তিষ্ক ও দাঁত যাদের বৈশিষ্ট্য)

তাদের সাথে আমাদের আরেকটি বড় পার্থক্য হচ্ছে, তাদের হাতের দৈর্ঘ্য আমাদের থেকে বেশ কম। এর কারণ পাওয়া যেতে পারে জিন-সংস্কৃতি সহ-বিবর্তনের মাঝে। যে ধরণের অস্ত্র দিয়ে তারা শিকার করতো সেটা তাদের সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু সেই অস্ত্র ব্যবহারের কারণে অনেকদিনের ব্যবধানে তাদের হাতের দৈর্ঘ্যে যে পরিবর্তন এসেছে সেটা জিনগত ব্যাপার। এজন্যই একে জিন-সংস্কৃতি সহবিবর্তন বলা হচ্ছে। আগেই বলেছি, নিয়ানডার্থালদের অস্ত্রগুলো ছিল অনেক ভারী যেগুলো দিয়ে তারা খুব কাছ থেকে শিকার করতো। নিক্ষেপের বদলে বর্শার মুহুর্মুহু আঘাতে জর্জরিত করার মাধ্যমে শিকার কাবু করত। তো এ ধরণের অস্ত্র ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন ছোট কিন্তু মোটা ও শক্ত-সমর্থ হাত। সে ধরণের হাত যাদের ছিল তারাই প্রাকৃতিক নির্বাচনে টিকে গেছে।[৪]

নিয়ানডার্থালরা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পর ইউরোপে যে আধুনিক মানুষেরা রাজত্ব করেছে তারা ক্রো-ম্যাগনন নামে পরিচিত। এটা কিন্তু কোন প্রজাতির নাম নয়, ইউরোপে সেই সময়ে বসবাসকারী হোমো স্যাপিয়েন্স দেরকেই ক্রো-ম্যাগনন নামে ডাকা হয় কেবল। তবে আমরা এখনই ক্রো-ম্যাগননদের আলোচনায় প্রবেশ করব না। বরং যেই প্যালিওলিথিক ট্র্যাজেডির গল্প দিয়ে শুরু করেছিলাম সেই ট্র্যাজেডির বাস্তব-কথন আরেকটু বিস্তৃত করব। অর্থাৎ নিয়ানডার্থালদের বিলুপ্তির কারণগুলো বলার চেষ্টা করব। বর্তমান ফসিল রেকর্ড অনুসারে এটা নিশ্চিত যে, ২৮,০০০ বছর পূর্বে তাদের শেষ আস্তানা থেকেও বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল নিয়ানডার্থালরা। শেষ আস্তানা ছিল জিব্রাল্টার, আইবেরীয় উপদ্বীপের শেষ প্রান্তে অবস্থিত বর্তমান ব্রিটেন সরকার শাসিত অঞ্চল। বর্তমান স্পেন, পর্তুগাল, অ্যান্ডোরা এবং জিব্রাল্টার অঞ্চলগুলো নিয়েই আইবেরীয় উপদ্বীপ। এখানকার অপেক্ষাকৃত সহনশীল জলবায়ু এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীর বিচিত্র সমাহারই বোধহয় নিয়ানডার্থালদের টেনেছিল। তবে ভূমধ্যসাগরের পাথুরে তীরভূমির এই জীবনও বেশিদিন সয়নি তাদের, বেশ দ্রুতই প্রকৃতির কড়াল গ্রাসে জীবনপাত করতে হয়েছে প্রজাতিটিকে।

3(ইউরেশিয়া জুড়ে নিয়ানডার্থালদের ব্যাপ্তি, যেসব স্থানে তাদের ফসিল পাওয়া গেছে সেগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে)

তাদের বিলুপ্তির কারণের চেয়ে এই বিলুপ্তিতে আমাদের অবদান কতটুকু তা নিয়েই বেশি ভেবেছি আমরা। না ভাবারও কোন কারণ নেই, আমরা আসার পরই তো তারা বিলুপ্ত হয়েছে। আর এত হাজার বছর ধরে একসাথে থাকাটা তো কম কথা নয়। এত নিকট অতীতে আমাদের সমান বুদ্ধিমান আর কোন প্রজাতির সাথে তো এভাবে থাকার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য হয় নি আমাদের। তবে আমরা তাদের সাথে প্রেম করেছি নাকি যুদ্ধ করেছি তা নিয়ে বিতর্কই যেন শেষ হতে চাচ্ছে না। প্যালিওলিথিক ট্র্যাজেডির গল্পে আমরা দেখেছি কিভাবে নিয়ানডার্থাল ও আধুনিক মানুষের মুখোমুখী সংঘর্ষ হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু কিছুদিন আগে আবার নিয়ানডার্থাল জিনোম সিকোয়েন্স করে দেখা গেছে, আধুনিক মানুষ ও নিয়ানডার্থালদের মাঝে সামান্য অন্তঃপ্রজননও হয়েছে। সত্যিই এক জটিল পরিস্থিতি- যেখানে আধুনিক মানুষের দ্বারা নিয়ানডার্থালদের মেরে খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের প্রমাণও পাওয়া গেছে [৫] সেখানেই আবার কখনো কখনো দুয়ে মিলে সন্তানের জন্ম দিয়েছে। অবশ্য এতে খুব বেশি আশ্চর্য হওয়ার অবকাশ নেই- নিয়ানডার্থালরা নিজেরাও নিজেদের মাংস খেতো, আবার বর্তমানে আমরা যেমন ভালবাসি তেমনি আবার পারমাণবিক বোমায় উড়িয়ে দেই মানবতা। বিলুপ্তির সারসরি কারণ বের করা নিয়ে আরেকটা সমস্যাও রয়েছে- আধুনিক মানুষ আফ্রিকা থেকে ইউরোপে আসার সাথে সাথেই তারা বিলুপ্ত হয়ে যায়নি, বরং ২০-৩০ হাজার বছর দুটি প্রজাতি সহাবস্থান করেছে। সুতরাং নিয়ানডার্থাল বিলুপ্তিতে আমাদের সক্রিয় ভূমিকার পক্ষে খুব বেশি সাফাই গাওয়াও বিজ্ঞানসম্মত নয় এখন পর্যন্ত। তাই সবগুলো অনুকল্পই আমাদেরকে বিবেচনার মধ্যে রাখতে হবে। বর্তমানে দুটি অনুকল্প নিয়ে বিজ্ঞানীরা অনেক ভাবছেন- প্রথমত, হয়ত প্রতিকূল জলবায়ুতে টিকতে না পেরে বিলুপ্তি হয়ে গেছে তারা; অথবা হয়ত আধুনিক মানুষের বুদ্ধিমত্তার সাথে প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়াতেই বিলুপ্তি ত্বরান্বিত হয়েছে। কোন অনুকল্পেই কিন্তু বিলুপ্তিতে আধুনিক মানুষের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকে মুখ্য করে দেখা হচ্ছে না। অনুকল্প দুটোর কথা শেষ করে তারপর নিয়ানডার্থাল জিনোম থেকে পাওয়া সর্বশেষ তথ্যের আলোকে আমাদের দুটি প্রজাতির অন্তঃপ্রজনন নিয়ে কিছু কথা বলব।

জলবায়ুর মুহুর্মুহু পরিবর্তনে অসহায় নিয়ানডার্থালরা

আগেই বলেছি নিয়ানডার্থালরা যে সময়টাতে রাজত্ব করেছে তার পুরোটা জুড়েই ইউরোপে চলছিল তুষার যুগ। তাদের দেহও ঠাণ্ডার সাথে মানিয়ে নেয়ার জন্য বেশ উপযোগী ছিল। তবে এই শেষ তুষার যুগের পুরোটা সময়ও আবার এক রকম ছিল না। ৬৫,০০০ বছর পূর্ব থেকে জলবায়ুর মুহুর্মুহু পরিবর্তনে পরিবেশে বড় বড় পরিবর্তন আসতে শুরু করে। সে সময় একটি প্রাণী তার জীবদ্দশায়ই দেখে যেতে পারত, কিভাবে বিশাল বনভূমি বৃক্ষহীন বিরান ভূমিতে পরিণত হয়েছে, কিভাবে তার আশপাশের সব উদ্ভিদ ও প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে, কিভাবে অন্যরা তাদের জায়গা দখল করে নিচ্ছে। এক প্রজন্মে এত পরিবর্তন আসতে পারলে কয়েক প্রজন্মে পরিবর্তনটা কত বড় হতে পারে তা বলাই বাহুল্য। এই দ্রুত পরিবর্তনের সময়টা ছিল ৬৫,০০০ বছর পূর্ব থেকে শুরু করে ২৫,০০০ বছর পূর্ব পর্যন্ত, সময়কালটার নাম “অক্সিজেন আইসোটোপ স্টেজ ৩” (OIS-3)। গ্রিনল্যান্ড, ভেনিজুয়েলা এবং ইতালির বিভিন্ন স্থানের সুপ্রাচীন বরফ খণ্ড, পাললিক শিলা এবং পরাগরেণু থেকে পাওয়া আইসোটোপ বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা এই যুগ সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছেন। এ যুগের ভয়ানক পরিবর্তনশীলতা নিয়ানডার্থালদের কিভাবে প্রভাবিত করেছে সে সম্পর্কে জিব্রাল্টার জাদুঘরের বিবর্তনীয় বাস্তুবিজ্ঞানী ক্লাইভ ফিনলেসন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন। তার গবেষণার সূত্র ধরেই আমরা এগোব।

লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, ওআইএস-৩ শুরু হওয়ার আগে ইউরোপে হোমিনিড গোত্রের একমাত্র প্রজাতি ছিল নিয়ানডার্থাল, যুগটা শুরু হওয়ার পর আফ্রিকা থেকে হোমো স্যাপিয়েন্সরা এখানে আসতে শুরু করেছে, আর এই যুগ শেষ হওয়ার পর ইউরোপে জীবিত একমাত্র হোমিনিড প্রজাতি ছিল হোমো স্যাপিয়েন্স। এ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া খুব একটা কঠিন নয় যে, জলবায়ুর এই পরিবর্তন আধুনিক মানুষেরা সহ্য করতে পেরেছে কিন্তু নিয়ানডার্থালরা সহ্য করতে পারেনি। এখানেই আবার প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। দৈহিক দিক দিয়ে তীব্র ঠাণ্ডার সাথে মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা তো নিয়ানডার্থালদেরই বেশি ছিল, তাহলে তারাই কেন বিলুপ্ত হল, অপেক্ষাকৃত নাজুক আধুনিক মানুষেরা কিভাবে টিকে রইল? তাছাড়া এর আগেও তো তুষার যুগের তীব্রতা নিয়ানডার্থালরা সহ্য করে টিকে ছিল, এবার তারা পারল না কেন? সত্যি বলতে, তুষার যুগের তীব্রতা আগে কখনো এই পর্যায়ে পৌঁছেনি। আগে তীব্র প্রতিকূলতা কেটে যাওয়ার পর নিয়ানডার্থালরা সেড়ে ওঠার সময় পেতো, কিন্তু এবার সেড়ে ওঠার আগেই পরিবেশ আরো প্রতিকূল হয়ে গেছে। প্রতিকূলতার সাথেই পেরে উঠেনি তারা।

এর আগে জলবায়ু খুব রুক্ষ হলেও আবার স্বাভাবিকে নেমে আসত। অর্থাৎ এক সময় বনাঞ্চল বরফাবৃত হয়ে বিরানভূমিতে পারিণত হতো, আবার বরফ কেটে গিয়ে শ্যামলতা ফিরে আসতো। এই শ্যামল সময়েই নিয়ানডার্থালরা আবার সমাজ বিস্তার করত। কিন্তু ওআইএস-৩ এর সময় পরিবর্তনটা হয়েছে খুব দ্রুত। এর ফলে বাস্তুতন্ত্রে হঠাৎ করেই অভাবনীয় সব পরিবর্তন ঘটতে থেকেছে: বনভূমি হয়েছে বিরানভূমি, বলগা হরিণের স্থান দখল করেছে এক ধরণের গণ্ডার- তারপর খুব দ্রুতই অবস্থা আবার স্বাভাবিকে নেমে এসেছে। এভাবে চলতেই থেকেছে। এর ফলে দৈহিক সহনশীলতার পাশাপাশি তাদের শিকার পদ্ধতিও অকেজো হয়ে পড়েছে। আগে তারা গাছের আড়ালে লুকিয়ে থেকে বড় বড় জন্তুর উপর হামলে পড়তো, এবার গাছ না থাকায় লুকোনটাই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। খাদ্যাভ্যাসে বৈচিত্র্য অনেক কম থাকায় অন্য কিছু খেয়ে বেঁচে থাকাটাও তাদের জন্য সহজ ছিল না। পরিবর্তন যে সব সময় অধিক শীতল থেকে কম শীতল বা কম শীতল থেকে অধিক শীতলের দিকেই হয়েছে এটা বলা যায় না, আরও অনেক ধরণের জলবায়ুগত পরিবর্তন কাবু করেছে নিয়ানডার্থালদেরকে। ফিনলেসন এই মতই ব্যক্ত করেছেন। পরিবেশের পরিবর্তন আচার-অভ্যাস ও প্রযুক্তিতে যে ধরণের পরিবর্তন দাবী করছিল সেটা মেটাতে ব্যর্থ হয়েছিল তারা।

climate-change(জলবায়ু পরিবর্তনের মানচিত্র)

তবে কিছু নিয়ানডার্থাল নিজেদের পরিবর্তন করতে পেরেছিল। কয়েকটি স্থানে তাদের অস্ত্রের ধরণ এবং শিকারে পরিবর্তন এসেছিল। আর কেউ কেউ অপেক্ষাকৃত কম রুক্ষ ও সম্পদবহুল অঞ্চলে চলে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। তাদের শেষ আস্তানা জিব্রাল্টার হওয়ার কারণ এটাই। শুধু জিব্রাল্টার নয়, তাদের সবচেয়ে নবীন যে ফসিলগুলো পাওয়া গেছে তার অধিকাংশই আইবেরীয় উপত্যকায়, এই উপত্যকার শ্যামলতা এবং সম্পদবহুলতাই যে এর কারণ সে নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। এ থেকে আরেকটি বিষয়ও নিশ্চিত হওয়া যায় যে, সব স্থান থেকে তারা একবারে বিলুপ্ত হয়ে যায় নি। ২০১০ সালের এপ্রিলে PloS One জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, নিয়ানডর্থালরা অনেক বিভক্ত ছিল। আবাসস্থলের উপর ভিত্তি করে তাদেরকে তিনটি উপদলে ভাগ করা যায়: পশ্চিম ইউরোপীয়, দক্ষিণ ইউরোপীয় এবং পশ্চিম এশীয়। বোঝাই যাচ্ছে যে পশ্চিম ইউরোপ থেকে তাদের বিলুপ্তি ঘটেছে সবার পরে।[৬]

নিয়ানডার্থালদের সাথে আধুনিকদের প্রতিযোগিতা

জলবায়ুর প্রভাব স্বীকার করার পরও এটা না মেনে উপায় থাকে না যে, এদের বিলুপ্তিতে আধুনিক মানুষ তথা আমাদের কোন ভূমিকা ছিল। কারণ আমাদের কেউ কেউ আফ্রিকার ক্রান্তীয় পরিবেশ ছেড়ে ইউরোপে আসার পরই তো বিলুপ্তির ঘটনাটি ঘটেছে। প্রথমে যে গল্প ফেঁদেছি তাতে দুটি প্রজাতির সরাসরি সংঘর্ষের চিত্র ফুটে উঠেছে। চার্চিলদের এই পরীক্ষার সকল ফলাফল যদি সত্যি হয়, তাহলে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকে না যে সরাসরি সংঘর্ষ ঘটেছিল। কিন্তু তাই বলে এটা ভেবে নেয়া ঠিক হবে না যে, আধুনিকরা মেরে কেটে নিয়ানডার্থালদের মাটির নিচে পাঠিয়ে দিয়েছে। সবগুলো প্রভাবই বিবেচনা করতে হবে এবং পরিশেষে আমরা সর্বোচ্চ বের করার চেষ্টা করতে পারি, কোন প্রভাবটি বেশি প্রকট।

কি কারণে আধুনিকরা টিকে থাকল, বিলুপ্ত হয়ে গেল নিয়ানডার্থালরা? বিজ্ঞানীদের মধ্যে যথারীতি এ নিয়ে বিতর্ক আছে অনেক; কিন্তু খাদ্যের প্রতিযোগিতাই যে সবচেয়ে বড় কারণ এ নিয়ে সন্দেহ বেশ কম। অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রত্নতাত্ত্বিক কার্টিস ডব্লিউ. ম্যারিয়ান এর বিশ্লেষণ এরকম: নিয়ানডার্থালরা তাদের খাবারের ব্যাপারে খুব খুঁতখুঁতে, অর্থাৎ যা পছন্দ করে তাই, এর বাইরে কিছু খেতে চাইতো না। জার্মানির ইউনিভার্সিটি অফ টুবিঙেন এর গবেষক Hervé Bocherens তাদের হাড়ের রাসায়নিক গঠন পরীক্ষা করে এমনটিই দেখেছেন। এ যুগে হলে আমরা একে হয়ত সাংস্কৃতিক গোঁড়ামি বলতাম। তাদের পছন্দের খাবার ছিল বড় বড় স্তন্যপায়ী প্রাণী, যেমন বুনো বরাহ, লোমশ গণ্ডার ইত্যাদি। এই খাদ্যাভ্যাসে কোন সমস্যাও ছিল না, কারণ যোগান ছিল যথেষ্ট। কিন্তু ঝামেলা শুরু হল আধুনিকেরা আসার পর। আধুনিকদের খাবারের ব্যাপারে এত বাছ বিচার ছিল না, তারা বরাহ-গণ্ডার যেমন শিকার করত তেমনি আবার ছোট খাটো পশুও শিকার করতো, ফলমূল ভোজনেও অনীহা ছিল না। আধুনিকেরা নিয়ানডার্থালদের শিকারে ভাগ বসানোর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হল নিয়ানডার্থালরা। কারণ বড় স্তন্যপায়ীর অভাব থাকলেও আধুনিকেরা ঠিকই অন্য উপায়ে খাদ্যের যোগান করতে পারত, যেটা নিয়ানডার্থালদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমরা দেখেছি বিপদে পড়ে মাঝেমধ্যে নিরামিষ ভোজনের চেষ্টা করলেও তা খেয়ে জীবন চালানো তাদের পক্ষে ছিল প্রায় অসম্ভব।

কিন্তু বিলুপ্তির সব দোষ খাদ্য-সংকটের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়াটাও ঠিক হবে না। কারণ যতই নতুন নতুন ফসিল পাওয়া যাচ্ছে ততই নিয়ানডার্থাল ও আধুনিক মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক পার্থক্য কমে আসছে। এত সমরূপ হওয়ার পরও কেন বিলুপ্তি ঘটল তা নিয়ে তাই নতুনভাবে চিন্তা করছেন অনেকে। ২০০৮ সালে জিব্রাল্টারের Gorham গুহা এবং তার পার্শ্ববর্তী ভ্যানগার্ড গুহায় ব্রিটিশ ন্যাচারাল হিস্টরি মিউজিয়ামের ক্রাস্টোফার স্ট্রিংগার যেসব নিয়ানডার্থালের ফসিল পাওয়া গেছে তারা ডলফিন ও সিল মাছ শিকার করতো, সমুদ্রের তীরে ঝিনুক কুড়াতো। এমনকি পাখি ও খরগোশের মত ছোট ছোট প্রাণীও শিকার করে খেতো। বোঝাই যাচ্ছে সময়ের সাথে সাথে তারা খাদ্যাভ্যাস ও সাধ-আহ্লাদের দিক দিয়ে কিভাবে আধুনিক মানুষের সাথে পাল্লা দেয়ার মত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু পাল্লা দেয়াটা বড্ড দেরিতে হয়ে গেছে, ততদিনে তাদের মৃত্যুঘণ্টা বেজে গেছে। জার্মানির Hohle Fels গুহায় ৩৬,০০০ থেকে ৪০,০০০ বছর পূর্বে নিয়ানডার্থালদের ব্যবহৃত উপকরণ পাওয়া গেছে, এর পাশাপাশি ৩৩,০০০ থেকে ৩৬,০০০ বছর পূর্বে আধুনিক মানুষদের ব্যবহৃত উপকরণও পাওয়া গেছে। জীবাশ্ম-নৃবিজ্ঞানী ব্রুস হার্ডি এই দুই ধরণের উপকরণ তুলনা করে দেখতে পেলেন: সে সময় আধুনিক মানুষের বানানো উপকরণের বৈচিত্র্য বেশি হলেও সার্বিকভাবে নিয়ানডার্থালরা খুব একটা পিছিয়ে ছিল না, উভয়ে অস্ত্র ও উপকরণগুলো দিয়ে প্রায় একই ধরণের কাজ করত। এমনকি নিয়ানডার্থালরা রেজিন এর মাধ্যমে কাঠের সাথে পাথর জোড়া লাগাতে শিখে গিয়েছিল, এভাবেই হয়ত তারা নিক্ষেপযোগ্য অস্ত্র বানাত। একই ধরণের কাজ করলেও নিয়ানডার্থালদের অস্ত্রের পরিমাণ কেন তুলনামূলক কম ছিল সে সম্পর্কে হার্ডির মতামত হচ্ছে- এতো অস্ত্র ছাড়াও তাদের চলে যেতো।

ভাষার ব্যাপারে অনেকদিন আমরা নিয়ানডার্থালদের অবজ্ঞা করেই চলেছি। কিন্তু ইসরায়েলের কেবারা গুহা থেকে পাওয়া ‘কেবারা ২’ নামের ফসিলটি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিয়েছে। এ থেকে জানা গেছে, নিয়ানডার্থালদের জিহ্বার গোড়ায় অবস্থিত হাইঅয়েড অস্থির গড়ন আমাদের মতই এবং মুখ এবং বাগযন্ত্রে এমন কোন সীমাবদ্ধতাই নেই যা বাকশক্তিতে বাঁধার সৃষ্টি করতে পারে। তার মানে দৈহিক গঠনের দিক দিয়ে ঠিক আমাদের মত করে কথা বলায় কোনই অসুবিধা ছিল না তাদের। এ তো গেল অ্যানাটমির কথা। ২০০৭ সালে জিন পর্যায়েও বাকশক্তির পক্ষে প্রমাণ পাওয়া গেছে। মাক্স প্লাংক ইনস্টিটিউট ফর এভল্যুশনারি অ্যানথ্রোপলজি-র বিজ্ঞানী ইয়োহানেস ক্রাউস নিয়ানডার্থাল ডিএনএ নিয়ে গবেষণা করে দেখেছেন, যে জিন এর কারণে আমরা কথা বলতে পারি সেই একই জিন তাদের মধ্যেও রয়েছে, জিনটির নাম ফক্সপি২ (FOXP2 – Forkhead box protein P2)।

যত ফসিল আবিষ্কৃত হচ্ছে, জিনতাত্ত্বিক গবেষণা যত এগিয়ে যাচ্ছে ততই আধুনিক মানুষ ও নিয়ানডার্থালদের পার্থক্যরেখা সংকুচিত হয়ে আসছে। এ কারণে অনেকে দুটি প্রজাতির মধ্যকার ছোট ছোট দৈহিক ও সাংস্কৃতিক পার্থক্যকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। প্রতিযোগিতা যেহেতু খুব বেশি ছিল সেহেতু কোন দিক দিয়ে একটু এগিয়ে যাওয়ার গুরুত্বও কম ছিল না। যেমন আধুনিক মানুষেরা সেলাই করে কাপড় পরত, নিয়ানডার্থালদের পক্ষে যা রপ্ত করা সম্ভব হয়নি। আধুনিক মানুষের ফসিলের সাথে সেলাই করার সরঞ্জাম পাওয়া গেছে। এই কাপড়ই হয়ত শীতের বিপরীতে আধুনিকদের একটু বেশি সুবিধা দিয়েছিল, যদিও দৈহিক দিক দিয়ে নিয়ানডার্থালরা শীতের সাথে বেশি অভিযোজিত ছিল।

নিয়ানডার্থালদের চেয়ে আধুনিক মানুষের কর্মবণ্টন প্রক্রিয়া বেশি উপযোগী বলে প্রমাণিত হয়েছে। আধুনিকদের মধ্যে কেবল পুরুষরা শিকারে যেতো, নারীরা শিশুদের লালনপালন করত আর ঘরদোর দেখাশোনা করত। কিন্তু নিয়ানডার্থালরা নারী এমনকি শিশুদেরও শিকারে নিয়ে যেতো। ইউনিভার্সিটি অফ অ্যারিজোনার প্রত্নতাত্ত্বিক স্টিভেন কুন এবং মেরি স্টাইনার বিলুপ্তির একটি ছোট কারণ হিসেবে এই অনুকল্পটি প্রস্তাব করেছেন। নিয়ানডার্থাল নারী ও শিশুরা হয়ত শিকারকে তাড়িয়ে অপেক্ষমান পুরুষদের দিকে নিয়ে যেত, আর পুরুষরা শিকারের আসল কাজটা করত। কিন্তু এ করতে গিয়ে তাদের সন্তান প্রতিপালন ও সমাজ সংগঠনের সুযোগ অনেক কমে গিয়েছিল। যার ফলে যথারীতি আধুনিকদের তুলনায় তারা কম বংশধর রেখে যেতে পেরেছিল। অবশ্য সবাইকে কাজে না লাগিয়ে ওদের উপায়ও ছিল না। চলাফেরা করতে নিয়ানডার্থালরা আধুনিকদের তুলনায় ৩২% বেশি শক্তি খরচ করত, তাই তাদের গড়ে প্রতিদিন আধুনিকদের তুলনায় ১০০ থেকে ৩৫০ ক্যালরি বেশি খাবারের প্রয়োজন হত। অন্যদিকে আধুনিকরা যেহেতু হাটাচলায় শক্তি কম খরচ করত সেহেতু সন্তান পালন ও প্রজননে বেশি শক্তি ব্যয় করতে পারত, ফলে অপেক্ষাকৃত বেশি বংশধর রেখে যেতে পারত।

আনুমানিক ৩০,০০০ বছর পূর্বে অনেকটা হঠাৎ করেই আধুনিক মানুষের আয়ু অনেক বেড়ে গিয়েছিল। সে সময় অনেকেরই নাতি-নাতনি দেখে মৃত্যুবরণ করার সৌভাগ্য হত। এই বর্ধিত আয়ু আমাদেরকে দুটি সুবিধা দিয়েছিল। প্রথমত, আমরা প্রজননের জন্য বেশি সময় পেয়েছিলাম, দ্বিতীয়ত, বেশিদিন বাঁচায় জীবন চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য ও সংস্কৃতি শিখে সেটা পরবর্তী প্রজন্মকে শেখানোর জন্যও অনেক সময় পাওয়া গিয়েছিল। যেমন, ক্ষরার সময় কোন স্থান থেকে পানি আনতে হবে- এমন তথ্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু গল্প করার সময়ই বলেছি, নিয়ানডার্থালদের আয়ু ছিল কম, ৪০ ছিল তাদের জন্য শেষ বয়স, এই দুটি সুবিধা তাই তাদের ভাগ্য জোটেনি। সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকান অগাস্ট ২০০৯ সংখ্যায় কেইট ওং এ ধরণের ছোট ছোট পার্থক্যের এএকটি তালিকা করে দেখিয়েছেন নিয়ানডার্থালরা আধুনিক মানুষদের কোন বৈশিষ্ট্যটি কতটুকু চর্চা করত। এই তালিকা থেকেই বিলুপ্তির ঘণ্টা কিভাবে বেজেছিল সে সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া সম্ভব:

table

নিয়ানডার্থাল-আধুনিক মানব অন্তঃপ্রজনন

নিয়ানডার্থালদের আমরা ভালবেসেছিলাম নাকি তাদের সাথে যুদ্ধ করেছিলাম? এ নিয়ে বাকবিতণ্ডার শেষ ছিল না। বিজ্ঞানীরা একবার এদিকে ঝুঁকে তো আরেকবার ঐদিকে। তবে এটাও কেউ ভুলে যায়নি যে- একইসাথে ভালবাসা যায় আবার যুদ্ধও করা যায়। এক জায়গায় দুয়ের মধ্যে ভালবাসা ছিল বলে আরেক জায়গায় যুদ্ধ হতে পারবে না এমন কোন কথা আছে নাকি? একালেও তো আমরা একে অপরকে ভালবাসি আবার খুনও করি। যাহোক, দুই পক্ষে সবচেয়ে বড় বড় দুটি প্রমাণ ছিল- যুদ্ধের পক্ষে শানিদার ৩ এবং ভালবাসার পক্ষে “পর্তুগালের সংকর শিশু” (The Hybrid Child from Portugal)। জীবাশ্ম-নৃবিজ্ঞানে এই ফসিলকে ডাকা হয় “লাগার ভেলো ১” নামে, পর্তুগালের লাগার ভেলো গুহায় ১৯৯৮ সালে তাকে পাওয়া গিয়েছিল। এ বছরের নভেম্বরের শেষ দিকে এক বিকেলে প্রত্নতাত্ত্বিকদের দুটি দল পর্তুগালের আব্রিগো দো লাগার ভেলো গুহায় খননকাজ করছিল। হঠাৎ একটি ইঁদুরের গর্ত তাদের নজর কেড়ে নেয়, কারণ গর্তের আশপাশে আলগা পলিমাটি ছিল। যেসব প্রাণী গর্তে বাস করে তারা গর্ত খুঁড়তে গিয়ে অনেক সময় মাটির অনেক নিচের জিনিস উপরে নিয়ে আসে, এই ভরসাতেই এখানে খননকাজ শুরু করে তারা। এভাবেই মাটির নিচ থেকে বেরিয়ে আসে ৪ বছর বয়সের একটি মানুষের বাচ্চা, যাকে ২৫,০০০ বছর পূর্বে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। সমাধিস্থ করার আগে তার গায়ে লাল গিরিমাটির রং মাখা হয়েছিল, শোয়ানো হয়েছিল পোড়া লাতা-পাতার উপর আর সাথে দেয়া হয়েছিল হরিণের দাঁত এবং সামুদ্রিক ঝিনুকের খোলস।

hybrid-child-from-portugal(পর্তুগালের সংকর শিশু, লাগার ভেলো ১)

তখন সবাই ধারণা করে নিয়েছিল এটি আধুনিক মানুষের বাচ্চা, আইবেরীয় উপদ্বীপে ৩০,০০০ বছর পূর্ব থেকে মানুষ আসতে শুরু করেছে, সুতরাং ২৫,০০০ বছর আগে এখানে আধুনিকদের থাকাটা মোটেও অসম্ভব নয়, তাছাড়া সমাধিস্থ করার প্রক্রিয়াও আধুনিক মানুষের সাথে মিলে যাচ্ছিল। যখন দেখা গেল এর দৈহিক বৈশিষ্ট্যের সাথেও আদিম-আধুনিক ইউরোপীয়দের মিল আছে তখন সন্দেহ যেন একেবারেই মিইয়ে গেল। লম্বা চিবুক, আমাদের মত নিম্ন চোয়াল, সামনের দিকের ছোট ছোট দাঁত, ছোটখাট মুখ, নাক, স্বাভাবিক ভ্রু, তালুর পেশীতে দাগ, সরু শ্রোণীচক্র- এগুলো সব আধুনিক মানুষ তথা আমাদের প্রতিনিধিত্ব করছিল। কিন্তু আরেকটু বিশ্লেষণের পর যখন দেখা গেল নিয়ানডার্থালদের সাথেও এর মিলের অভাব নেই তখন বিজ্ঞানীদের অবাক হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। যেমন- নিম্ন চোয়ালের পেছনের দিকে বাঁকানো হাড়, বুকের শক্তপোক্ত পেশী, ছোট কিন্তু বলিষ্ঠ পা ইত্যাদি। অনেকে বলতে পারেন, আধুনিক মানুষের মধ্যেও তো এমন বৈচিত্র্য দেখা যেতে পারে, বা কোন বিকলাঙ্গতার জন্যও তো এমন হতে পারে। কিন্তু অনেক পরীক্ষার পর বোঝা গেছে, আধুনিক মানুষের মধ্যে এত বৈচিত্র্য থাকা সম্ভব না এবং এটা কোন বিকলাঙ্গতারও ফল নয়, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনই যাপন করেছে। তখনই বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন- নিয়ানডার্থাল ও আধুনিক মানুষের অন্তঃপ্রজননের মাধ্যমে এর জন্ম হয়েছে। এজন্যই নাম দেয়া হয়েছে পর্তুগালের সংকর শিশু।[২]

এই আবিষ্কার নিয়ানডার্থালদের আলাদা প্রজাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়টিকে রীতিমত হুমকিতে ফেলে দিয়েছিল। এমনকি আফ্রিকা থেকে বহির্গমনের চরমপন্থী তত্ত্বকেও প্রশ্নের সম্মুখীন করেছিল। আফ্রিকা থেকে ১ লক্ষ বছর পূর্বে বের হওয়া আধুনিক মানুষেরা যদি ইউরোপ ও এশিয়ার সব হোমিনিডদের প্রতিস্থাপনই করে থাকবে, তাহলে দুয়ের মধ্যে এমন সফল অন্তঃপ্রজনন সম্ভব হল কিভাবে? এমন কি হতে পারে না যে, নিয়ানডার্থালরা সফল প্রজননের মাধ্যমে আমাদের সাথেই মিশে গেছে, বিলুপ্ত হয়নি? আমরাই কি নিয়ানডার্থালদের উত্তরপুরুষ হতে পারি না? এ প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য জেনেটিক্স এর আশ্রয় নেয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। নিয়ানডার্থালদের সাথে যদি আমাদের সফল প্রজনন ঘটে থাকে তবে আমাদের মধ্যে অবশ্যই বেশ কিছু নিয়ানডার্থাল জিন থাকতে বাধ্য। ২০০৬ সালে জার্মানির মাক্স প্লাংক ইনস্টিটিউট অফ এভল্যুশনারি অ্যানথ্রোপলজি এবং যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫৪ লাইফ সায়েন্সেস প্রতিষ্ঠান দুটির যৌথ উদ্যোগে নিয়ানডার্থালদের জিন সিকোয়েন্স নির্ণয় করা হয়। মানুষের সকল জিন সিকোয়েন্স তো আগেই বের করা হয়েছে, এটা হয়ে যাবার পর দুটো মিলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে তাদের সাথে আমাদের প্রজননগত মিল কতটুকু।

সিকোয়েন্স বের করার পর শুরু হয় বিশ্লেষণ, দীর্ঘ ৪ বছরেও তেমন কোন মিল পাওয়া যায় না যা দিয়ে প্রমাণ করা যেতে পারে আমরা তাদেরকে কোন সময় ভালবেসেছিলাম। অবস্থার পরিবর্তন ঘটে ২০১০ সালের ৮ মে। এ দিন সায়েন্স সাময়িকীতে ৬০% নিয়ানডার্থাল জিনোমের খসড়া বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়, দেখা যায় আজ থেকে ৮০,০০০ বছর পূর্বে ভূমধ্যসাগরের পূর্ব তীরে নিয়ানডার্থালদের সাথে আধুনিক মানুষের সফল অন্তঃপ্রজনন ঘটেছিল। ক্রোয়েশিয়ার ভিন্ডিয়া গুহায় পাওয়া তিন জন নিয়ানডার্থালের ফসিল থেকে জিনের নমুনা নিয়ে তার সাথে বর্তমান পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের ৫ জন মানুষের জিনের তুলনা করে বিজ্ঞানীরা দেখলেন- আফ্রিকার বাইরে তথা ইউরেশিয়ার মানুষদের শতকরা ১ থেকে ৪ ভাগ জিন নিয়ানডার্থালদের থেকে পাওয়া। এই বিশ্লেষণ থেকে আরো বোঝা যাচ্ছে যে প্রায় ৬ লক্ষ বছর পূর্বে দুটি প্রজাতি আলাদা হয়ে গিয়েছিল। আলাদা হয়ে যাওয়ার পর পরিব্যক্তির মাধ্যমে ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে নতুন কি কি জিনের উদ্ভব ঘটেছে সেটা বুঝতে পারলেই বোঝা যাবে আমরা নিয়ানডার্থালদের থেকে কতটা আলাদা, এখন পর্যন্ত এ ধরণের মাত্র ১০০ জিন পাওয়া গেছে- এর অধিকাংশই বুদ্ধিমত্তা এবং হাড়ের গঠনের সাথে সংশ্লিষ্ট।[৭]

এই জিন বিশ্লেষণের কাজ করছেন সুইডেনের জীববিজ্ঞানী Svante Pääbo, আজ থেকে ৭ বছর আগেও তিনি ভাবতে পারেননি কোনদিন নিয়ানডার্থাল জিনোমের এতোটা বিশ্লেষণ করা সম্ভব হবে। এখন অন্তঃপ্রজননের প্রমাণ পাওয়া যাওয়ায় বিষয়টা আরও চমকপ্রদ হয়ে উঠেছে এবং খুব দ্রুতই বিশ্লেষণ শেষ করার ইচ্ছা পোষণ করছেন তিনি। তবে অন্তঃপ্রজনন প্রমাণে এই জিন বিশ্লেষণ কতটা কার্যকরি হবে তা নিয়ে সন্দেহ যাচ্ছে না। অর্থাৎ ফসিল রেকর্ডের সাথে জিনগত তথ্য মিলছে না। দুটো মিললেই কেবল তাকে নির্ভেজাল বিশ্লেষণ বলা যেতে পারে, কারণ সেক্ষেত্রে একে অন্যের প্রমাণ হিসেবে কাজ করতে পারে। প্রখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক আয়ান ট্যাটারসল সহ অনেকেই তাই আশা করছেন, ফসিল রেকর্ডের কথা ভেবে জিন থেকে পাওয়া তথ্য সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা আরও ঝালাই করবেন। ডঃ পাবো বলছেন, জিনগত পরিসংখ্যান অনুসারে অন্তঃপ্রজনন ঘটেছে মধ্যপ্রাচ্যে; এখানে ১ লক্ষ বছর আগে আধুনিক মানুষেরা এসেছিল আর ৬০,০০০ বছর পূর্ব পর্যন্ত নিয়ানডার্থালরা এখানে ছিল। সুতরাং সংমিশ্রণ হওয়া অসম্ভব নয়। কিন্তু স্ট্যানফোর্ডের অধ্যাপক ডঃ রিচার্ড ক্লাইন বলছেন, ১,২০,০০০ বছর আগে আধুনিকেরা ইসরায়েল পর্যন্ত এসেছিল মাত্র, ৮০,০০০ বছর পূর্বে তারা আবার ফিরে গেছে, তখন নিয়ানডার্থালরা তাদের স্থান দখল করেছে। এ সময় দুই প্রজাতির যথেষ্ট দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে কিনা সেটা নিশ্চিত না।

তবে ডঃ পাবো তার গবেষণার ব্যাপারে অনেকটাই আশাবাদী। তিনি মনে করছেন এই জিনতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ চরম আউট অফ আফ্রিকা তত্ত্বকে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে। ১ লক্ষ বছর আগে থেকে শুরু করে আফ্রিকা থেকে মানুষ বেরোতে শুরু করেছে এবং প্রায় ৫০,০০০ বছর পূর্ব পর্যন্ত এই বিস্তরণ চলেছিল। চরম আউট অফ আফ্রিকা তত্ত্ব বলে, এই বেরিয়ে পড়া মানুষেরাই ইউরেশিয়াতে আগে থেকে বসবাসকারী সব হোমিনিড প্রজাতিকে প্রতিস্থাপিত করেছে, কিন্তু তাদের থেকে কোন জিন নেয়নি। কিন্তু পাবো বলছেন, আমাদের জিন ভাণ্ডার একমুখী নয়, আফ্রিকার বাইরে যারা বসবাস করতে শুরু করেছিল তারা নিয়ানডার্থালদের থেকেও জিন নিয়েছে। বিজ্ঞানের চিরন্তন নিয়মে এ নিয়ে বিতর্ক কেবল বাড়তেই থাকবে, এভাবেই বেরিয়ে আসবে প্রকৃত সত্য।[৮]

নিয়ানডার্থাল জিন সংশ্লেষণের আরেকটি চমকপ্রদ কিন্তু বহুল বিতর্কিত দিক আছে। অনেকে চাইছেন একজন নিয়ানডার্থালকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনতে, অর্থাৎ ফসিলের ডিএনএ থেকে এক জন জলজ্যান্ত নিয়ানডার্থাল তৈরি করতে। তবে এতে কিন্তু আমরা নিয়ানডার্থালদের সংস্কৃতি সম্পর্কে কিছু জানতে পারব না। এ যুগে তৈরি করা নিয়ানডার্থাল কখনোই লক্ষ বছর আগের ইউরোপীয়দের মত আচরণ করবে না, বরং বর্তমানের আশপাশটাতেই অভিযোজিত হবে। তবে সে আধুনিক মানুষের কতটা নিজের মধ্যে গ্রহণ করতে পারে সেটাই দেখার বিষয়। তাদের জিনোম পুরোটা বিশ্লেষণ করা হয়ে গেলে এ নিয়ে ভাবার সময় আসবে। তবে নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন অনেকে- এই নবীন নিয়ানডার্থাল কোথায় থাকবে, গবেষণাগারে বা কোন প্রদর্শনীতে নাকি আমাদেরই মত ঘরবাড়িতে, তার জীবন কি হবে, সে কতটা অধিকার পাবে? যে কারণে গবেষণাগারে আমাদের মত মানুষ তৈরির অনুমতি দেয়া হচ্ছে সেই একই কারণ কি নিয়ানডার্থালদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে? নৈতিকতার দর্শন এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করে যাবে, বিজ্ঞান এগোবে তার পথ ধরে।[৬]

জিন থেকে পাওয়া এই তথ্যের পাশাপাশি ২০১০ সালে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার নিয়ানডার্থাল ও আধুনিক মানুষের পার্থক্যকে আরও ঘুঁচিয়ে দিয়েছে। এর আগে নিয়ানডার্থালদের বোধবুদ্ধি ও সংস্কৃতিকে মানুষের সাথে তুলনা করার ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের বেশ অনীহা ছিল। ১৯৭৯ সালে ফ্রান্সের St. Césaire নামক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে নিয়ানডার্থালদের ব্যবহৃত বেশ কিছু অলংকার ও হাড়ের তৈরি সূক্ষ্ণ সূক্ষ্ণ অস্ত্র পাওয়া যায়। অলংকার ও হাড়ের সরঞ্জাম তৈরির এই সংস্কৃতি ফরাসি ভাষায় Châtelperronian প্রযুক্তি নামে বহুল পরিচিত। এতদিন মনে করা হত এই প্রযুক্তি কেবল আধুনিক মানুষেরই আছে। ১৯৯৫ সালে এর পাশেরই আরেকটি গুহা থেকে নিয়ানডার্থালদের এমন আরো কিছু উপকরণ পাওয়া যায়। এতে বিতর্ক গাঢ়তর হয়। অনেকে বলেন, এই স্থানে হয়ত আধুনিকদের তৈরি অস্ত্র কোনভাবে নিয়ানডার্থালদের গুলোর সাথে মিশে গেছে। কেউ কেউ আবার বলেন, নিয়ানডার্থালরা না বুঝে আধুনিকদের অনুকরণ করেছে। অর্থাৎ এগুলো ব্যবহার করলেও এর তাৎপর্য সম্পর্কে তারা অজ্ঞ ছিল। এই বিতর্কে যখন তুঙ্গে তখনই স্পেনের দুটি স্থান থেকে পাওয়া নিয়ানডার্থালদের ব্যবহৃত উপকরণ বিশ্লেষণ করে ফলাফল প্রকাশ করেন ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিস্টলের বিজ্ঞানী João Zilhão। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রসিডিংস অফ দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্সেস এ তার গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়।

shell(শামুকের খোল যা নিয়ানডার্থালরা অলংকার হিসেবে ব্যবহার করত।)

তিনি যে দুটি স্থানের সরঞ্জামাদি নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন তার দুটিই স্পেনে। প্রথমটির নাম Cueva de los Aviones, ১৯৮৫ সালে এখান থেকে রিকার্ডো মোন্তেস-বের্নারদেজ তিনটি ছিদ্রযুক্ত ঝিনুকের খোলস খুঁজে পান। Zilhão বিশ্লেষণ করে দেখেন এসব খোলসের মধ্যে লেপিডোক্রোসাইট নামক লাল কণার দাগ আছে, এছাড়া গাঢ় লাল ও কালো রঙের হেমাটাইট ও পাইরাইট এর আস্তরণ পাওয়া যায়। এছাড়া একই স্থানে একটি ঘোড়ার হাড় পান যার মধ্যে লালাভ রং করা, প্রচুর পরিমাণ natrojarosite খনিজ পদার্থ দিয়ে এটা করা হয়েছে। দ্বিতীয় স্থানটি প্রথমটির খুব কাছাকাছি, নাম Cueva Antón, ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে এখানে পাওয়া যায় ছিদ্রযুক্ত শামুকের খোলস যার উপর কমলা রং করা। তো, নিয়ানডার্থালরা কেন এত বাহারী রং করেছিল এই খোলস ও হাড়গুলোর উপর? Zilhão বলছেন, natrojarosite এর একমাত্র ব্যবহার হয় কসমেটিক হিসেবে। এই খোলস ও হাড়গুলো কি কাজে ব্যবহৃত তাও অনুমান করছেন তিনি- লাল রং বিশিষ্ট ঘোড়ার হাড়টি ব্যবহৃত হতো রং করার কাজে, ছিদ্রহীন ঝিনুকের খোলটি কাজে লাগত রং রাখার পাত্র হিসেবে, আর তারা রং করত নিজেদের শরীরে। তবে প্রতিদিনই নিজেদের দেহ রাঙাতো নাকি কোন বিশেষ উপলক্ষ থাকলে করত সেটা জানার কোন উপায় নেই আমাদের। এছাড়া ছিদ্রযুক্ত যে শামুকের খোলস পাওয়া গেছে তা সম্ভবত অলংকার হিসেবে ব্যবহৃত হত, কারণ ছিদ্র থাকলে সেটাকে পাত্র হিসেবে ব্যবহার করার কোন উপায় নেই।

নিজের দেহ রাঙানো বা অলংকার পরিধান করা সে সময়কার তুলনায় খুবই উন্নত সংস্কৃতি। নিয়ানডার্থালদের এই চর্চার তিন রকম অর্থ হতে পারে: হয় আফ্রিকা ও ইউরোপ দুই স্থানে আলাদা আলাদাভাবে এমন সাংস্কৃতিক আচার-আচরণের বিবর্তন ঘটেছে, নয়ত নিয়ানডার্থাল ও আধুনিক মানুষের সাধারণ পূর্বপুরুষদের মধ্যেই এমন সংস্কৃতি ছিল, অথবা হয়ত নিয়ানডার্থাল ও আধুনিক মানুষ কোন পৃথক প্রজাতি না, দৈহিক কিছু পার্থক্য থাকলেও বোধবুদ্ধির দিক দিয়ে এদের মধ্যে কোন পার্থক্যই নেই। Zilhão শেষ অর্থটিকেই সবচেয়ে বেশি সমর্থন করেছেন। তিনি এই দুই প্রজাতির মধ্যে সংস্কৃতির যে বিবর্তন ঘটেছে তা পৃথকভাবে দেখছেন না। দুজনের মধ্যেই একই কারণে এমন সাজসজ্জার উদ্ভব ঘটেছে- জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় গোত্রে গোত্রে ভাগ হওয়ার প্রবণতা শুরু হয়েছিল, আর এক গোত্রের মানুষ আরেক গোত্রের মানুষকে চেনার জন্যই নিজেদের দেহে বিভিন্ন অর্থবহ রং করত, যাতে দেখলেই বুঝতে পারে কে আমার শত্রু আর কে আমার বন্ধু। তবে মস্তিষ্ক বিবর্তিত হতে হতে একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে আসার আগ পর্যন্ত এমন ব্যবহার আশা করা যায় না। আনুমানিক ৫ লক্ষ বছর পূর্ব থেকে ১৫ লক্ষ বছর পূর্বের মধ্যে মস্তকিষ্কের এই পরিপক্কতা এসেছিল। সুতরাং Zilhão-র মতে, ৫ লক্ষ বছর পূর্বের কোন মানুষের বাচ্চাকে যদি এই যুগে এনে লালন পালন করা হয় তাহলে বড় হয়ে তার প্লেন চালাতে পারার কথা। আরো এক ধাপ এগিয়ে তিনি বলছেন, এমনও হতে পারে আধুনিকদের থেকে নিয়ানডার্থালরা এসব শেখেনি বরং নিয়ানডার্থালদের দেখেই আধুনিকেরা এসব রপ্ত করেছে। ইউরোপে আসার আগে Châtelperronian প্রযুক্তি আধুনিকদের ছিল না, আফ্রিকা ছাড়ল আর এটা হাতে এসে পড়ল। আর স্পেনের এই দুটি স্থানে আধুনিকরা আসার ১০,০০০ বছর আগেই নিয়ানডার্থালরা এই সংস্কৃতি চর্চা করছে। সুতরাং ইউরোপের স্থানীয় নিয়ানডার্থালদের থেকেও যে আধুনিকরা সংস্কৃতি শিখতে পারে সেই সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দিতে চান না তিনি।

সব শেষে থেকে যায় কেবল সম্ভাবনা আর সন্দেহ, সংশয়ের কাঁধে ভর করেই বিজ্ঞান এগোয়। নিয়ানডার্থালরা ঠিক কি কারণে বিলুপ্ত হয়েছিল তা কিন্তু আমরা স্পষ্ট করে বলিনি; বরং একগাদা সংশয় প্রকাশ করেছি, প্রতিটি সংশয়ের সীমাবদ্ধতাও ঢেকে রাখিনি। প্রতিটি ফসিল আবিষ্কারের পর যেমন কয়েকটি বিষয় নিশ্চিত হয় তেমনি আবার নতুন কিছু সন্দেহের জন্ম হয়। বিলুপ্তির কারণ স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না, হয়ত স্পষ্ট কোন কারণ নেই, জীববিজ্ঞানের নিয়ম তো এটাই, ১ ও ১ যোগ করে ২ করে ফেলার সুযোগ এখানে বেশ কম। হয়ত নিয়ানডার্থালরা বিলুপ্তই হয়নি, হয়ত আমরাই তাদের উত্তরসূরী; যে দৈহিক পরিবর্তনকে আমরা এত বড় করে দেখছি সাংস্কৃতিক মিল হয়ত সেটাকেই ঢেকে দেবে। তবে মিল থাকলেও যে প্রতিটি দিকে একটু একটু করে পিছিয়ে ছিল নিয়ানডার্থালরা এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। হাঁটি হাঁটি পা পা করে পিছিয়ে যেতে যেতে একেবারে হারিয়েই গেল সম্ভাবনাময় একটি প্রজাতি, বা হয়ত মিলিয়েই গেল বিবর্তনের ধারায়। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত করে বলা যায়, ইউরেশিয়ার সকল স্থানের নিয়ানডার্থালদের বিলুপ্তির কারণকে এক করে দেখা যাবে না। তারা অনেক বিভক্ত ছিল এবং একেক স্থানে একেক কারণের প্রভাব বেশি ছিল। যেমন, ২৮,০০০ বছর আগে জিব্রাল্টার থেকে যারা বিলুপ্ত হয়েছে তাদেরকে যে আধুনিকদের সাথে প্রতিযোগিতায় নামতে হয়নি এটা নিশ্চিত, কারণ এরও অনেক পরে আধুনিকরা এখানে এসেছে।

তথ্যসূত্র:

[১] Richard Dawkins; “The Ancestor’s Tale”; p. 58
[২] Neanderthal; Encyclopedia Britannica online edition.
[৩] Kate Wong; “Who were the Neandertals?”; New Look at Human Evolution, Scientific American special edition, 25 August 2003
[৪] Paul R. Ehrlich; “Human natures: genes, cultures, and the human prospect”; অধ্যায় – The Neanderthal Mystery; পৃষ্ঠা – ১০১
[৫] Robin McKie; How Neanderthals met a grisly fate: devoured by humans: A fossil discovery bears marks of butchering similar to those made when cutting up a deer; The Observer, Sunday 17 May 2009
[৬] Kate Wong; “Twilight of the Neandertals”; Scientific American, August 2009.
[৭] The Neanderthal – modern human connection? May 20, 2010; BecomingHuman.org
[৮] Nicholas Wade; “Signs of Neanderthals Mating With Humans”; May 6, 2010, The New York Times