ইয়ারার তীরে মেলবোর্ন [০১] [০২] [০৩] [০৪] [০৫] [০৬] [০৭] [০৮] [০৯] [১০][১১][১২]
১৩
২০ জুলাই ১৯৯৮ সোমবার
১৯/১৪০ নেইল স্ট্রিট, কার্লটন, ভিক্টোরিয়া ৩০৫৩
বুঝতেই পারছো এটা আমার বাসার ঠিকানা। এতদিন পর ঠিকানা জানিয়ে চিঠি লিখলাম অনেকগুলো। মামাম, দিদিভাই, বাবা, দাদা, বৌদি, বাবু, রুপু, পূজা সবাইকে। এখন থেকে তারাও লিখতে পারবে আমাকে। ইচ্ছে করলে তুমিও লিখতে পারো এই ঠিকানায়। গ্রাউন্ড ফ্লোরে লিফ্টের পাশে সারি সারি লেটারবক্স। বিশতলা বিল্ডিং এর প্রতি তলায় দশটা করে এপার্টমেন্ট; মোট দু’শ পরিবারের দু’শটা লেটারবক্স। ১৯ নম্বর লেটারবক্সে আমার চিঠি আসবে ভাবতে ভালোই লাগছে। কিন্তু ফিল্ তো আমাকে লেটারবক্সের চাবি দেননি।
ফিল্ মানুষটা কেমন ঠিক বুঝতে পারছি না। অবশ্য একদিনের মধ্যেই সব বুঝে ফেলবো সেরকম আশা করাটা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু তার আচার আচরণ দেখে কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। পরিবেশ বা সাংস্কৃতিক পার্থক্যের কারণে এরকম অস্বস্তি হতেই পারে। তবুও এ বাসার কিছু কিছু ব্যাপার খুব একটা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। বিস্তারিত বললে তুমিও কিছুটা আন্দাজ করতে পারবে।
সকালে হোস্টেল ছেড়েছি সোয়া আটটায়। কাল রাতে ঘুমের দুর্দশার কথা তো তুমি জানো। পৌনে আটটায় ঘুম ভাঙার পর ধড়পড় করে উঠে দ্রুত রেডি হয়েছি। সুটকেস তো ধরতে গেলে খোলাই হয়নি। যে ক’টা জিনিস বাইরে ছিল তা গুছিয়ে নিতে সময় লাগলো না। রুম থেকে বেরোবার সময় ওয়াইনের বিছানার দিকে তাকিয়েছি একবার। আপাদমস্তক কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। ঘুম ভাঙলেই কি ড্রাগের নেশা জেগে উঠবে তার? জানি না।
রিসেপশানে চাবি জমা দিয়ে দশ ডলার ফেরত পেলাম। মেম্বারশিপ কার্ডে চারটা সিল এখনো বাকি। হোস্টেলের মেম্বারশিপ পাওয়া হলো না এবার। রিসেপশানিস্টকে ধন্যবাদ জানিয়ে একহাতে সুটকেস অন্যহাতে ব্যাগ দুটো নিয়ে বেরিয়ে এলাম রাস্তায়।
হোস্টেলের সামনেই ট্যাক্সিস্ট্যান্ড। গত ক’দিনে যতবারই আসা যাওয়া করেছি একটা-দুটো ট্যাক্সি সবসময়েই দেখেছি। কিন্তু আজ একটাও নেই। রাস্তায় সারি সারি গাড়ি ছুটছে তো ছুটছে। এতগুলো গাড়ি একসাথে চলছে অথচ কোন হর্ন বাজছে না- এটাই আশ্চর্যের।
ট্যাক্সির জন্য পনেরো মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে থেকেও কোন লাভ হলো না। বরং ঠান্ডা বাতাসে জমে যাবার অবস্থা। ফোন করে ট্যাক্সি বুকিং দেয়া যায়। কিন্তু এখন আর তা করে লাভ নেই। তার চেয়ে হাঁটতে শুরু করলেই হয়। পথে খালি ট্যাক্সি পেলেই উঠে যাবো।
কিছুদূর হাঁটার পরেই বুঝলাম বোকামী হয়ে গেছে। দু’কাঁধে দুটো ব্যাগ আর হাতে একটা বড় সুটকেস নিয়ে হাঁটা সহজ নয়। ফুটপাতে অনেক মানুষের ভীড়। ছুটছে সবাই। এর মধ্যে বাইশ কেজি ভরের সুটকেস হাতে নিয়ে হাঁটতে গিয়ে এই প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যেও আক্ষরিক অর্থেই ঘাম বেরিয়ে গেছে আমার।
সুটকেসটা মোটেও ভ্রমণ-সহায়ক নয়। দুটো চাকা লাগানো আছে ঠিকই, কিন্তু লম্বা হাতল নেই। ছোট্ট একটা বেল্ট লাগানো আছে যেটা ধরে টানতে গেলে আমাকে একেবারে কুঁজো হয়ে যেতে হয়। সুটকেসের আর দোষ কী। আমার সাথে অস্ট্রেলিয়া আসবে ভেবে তো আর সুটকেসটা কেনা হয়নি। এটা কেনা হয়েছিল আট বছর আগে দাদার বিয়ের সময় বৌদির জন্য। আগের দিনের গোলাপ ফুল আঁকা টিনের বাক্সের সামান্য আধুনিক সংস্করণ এই সুটকেস।
হাঁটতে হাঁটতে রয়েল চিলড্রেন হসপিটাল পর্যন্ত চলে এলাম। আর পারি না। হাঁপাতে হাঁপাতে হাসপাতালের সামনের ফুটপাতে সুটকেস রেখে তার উপর বসে পড়লাম। টপ টপ করে ঘাম ঝরে পড়ছে কপাল থেকে। ঠিকমত পরিকল্পনা করতে না জানলে এরকমই হয়। হোস্টেল থেকে বেরোবার আগেই ট্যাক্সি বুক করে রাখা উচিত ছিল।
পাঁচ-ছয় মিনিট ফুটপাতে বসে থাকার পর একটা ট্যাক্সি এসে থামলো ফুটপাত ঘেঁষে। কৃষ্ণাঙ্গ ড্রাইভার ইশারায় জানতে চাইলেন আমি যাবো কিনা। উঠে দাঁড়াতেই ট্যাক্সির পেছনের ডালা খুলে গেল। সুটকেস আর ব্যাগ দুটো সেখানে তুলে দিলাম। এ দেশের ট্যাক্সিওয়ালারা মনে হয় মালপত্রে হাত লাগায় না। নিজের জিনিস নিজেকেই ওঠাতে হয়, নামাতে হয়। নাকি এখানেও চেহারা দেখেই তিনি বুঝে গেছেন আমার গুরুত্ব বা লঘুত্ব কীরকম। আর সেই অনুসারেই আমার সাথে তাঁর আচরণ।
“হোয়ার ইউ গোয়িং টু?”
পেছনের সিটে বসতে না বসতেই ড্রাইভারের প্রশ্ন।
“কার্লটন, নেইল স্ট্রিট”
“নেইল স্ট্রিট কার্লটন? ডু ইউ নো দি হাউজ নাম্বার?”
আমি বাসার নাম্বার বললাম। ট্যাক্সি চলতে শুরু করলো।
“সিটবেল্ট, সিটবেল্ট, ফ্যাসেন ইওর সিটবেল্ট”
গাড়িতে উঠেই সিটবেল্ট বাঁধায় অভ্যস্ত হইনি এখনো। আলী সাহেব বলেছিলেন সিটবেল্ট না বাঁধলে ১৬৫ ডলার জরিমানা দিতে হয়। ড্রাইভারও একই কথা বললেন।
ড্রাইভারের বয়স পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন হবে। ছিপছিপে পাতলা শরীর। কুচকুচে কালো মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। ইংরেজি উচ্চারণে অদ্ভুত একটা টান। গাড়ির সাথে সাথে তাঁর মুখও চলছে অনবরত।
“কাম ফর স্টাডি?”
“ইয়েস”
“ইন্ডিয়ান?”
“নো, বাংলাদেশী”
“বাংলাদেশী! বাংলাদেশ ইসলামিক কান্ট্রি। ইউ আর মাই ব্রাদার দেন”
গাড়ির আয়নায় ড্রাইভারের মুখ খুশিতে ঝলমল করছে।
“আই এম আহামাদ, ফ্রম সুদান”
আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। আহামাদ বলছেন,
“বাংলাদেশ ইজ পার্ট অব পাকিস্তান রাইট? ইস্ট পাকিস্তান?”
“রং। বাংলাদেশ ইজ ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিন্স নাইন্টিন সেভেনটি ওয়ান”
আহামাদ জানালেন তাঁর পাকিস্তানী প্রতিবেশীর কাছে শুনেছেন বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশ। আমি যথাসম্ভব জোর দিয়ে একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানকে পরাজিত করার কথা বললাম। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ শুনেও আহামাদের কোন ভাবান্তর হলো না। সমান উৎসাহেই বলে যেতে লাগলেন, “ইট্ ডাজ নট ম্যাটার। উই আর অল সিটিজেন অব ওয়ান ইসলামিক ওয়ার্ল্ড”
শুনে আমার কেমন যেন বমি বমি লাগতে শুরু করলো। আহামাদ নামের সুদানি ট্যাক্সিওয়ালার সাথে আমাদের স্বাধীনতার মূল্যবোধ নিয়ে তর্ক করার কোন মানে হয় না। আর ওয়ান ইসলামিক ওয়ার্ল্ড বলতে তিনি কী বোঝেন তা নিয়েও আমার আপাতত কোন উৎসাহ নেই। আমি শুধু ভাবছি কখন এই ট্যাক্সি থেকে নামতে পারবো।
ট্যাক্সি ইউনিভার্সিটির পাশ দিয়ে গ্রাটান স্টিট হয়ে সোয়ান্সটন স্ট্রিটে এসে বামে যাবার কথা। কিন্তু সেদিকে না গিয়ে সোজা চলতে শুরু করেছে রয়েল ওম্যান হসপিটালের দিকে। আমি কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে বললাম, “নেইল স্ট্রিট কার্লটন”
“রিল্যাক্স ব্রাদার, রিল্যাক্স। আই নো দ্যা হাউজ ইউ গোয়িং। আই লিভ দেয়ার টু”
শুনে আঁৎকে উঠলাম। এ কোথায় এসে উঠছি আমি?
একটু পরেই ট্যাক্সি রথডাউনি স্ট্রিটে এসে বামে মোড় নিলো। গতকাল এদিক দিয়ে আসিনি বলে বুঝতে পারছিলাম না যে এখান থেকে নেইল স্ট্রিটে যাবার পথ আছে। এক মিনিটের মধ্যেই গাড়ি এসে থামলো বিল্ডিং এর সামনে।
“ওকে ব্রাদার। হিয়ার ইজ ইওর হাউজ”
মিটারে দেখলাম ছয় ডলার ষাট সেন্ট। চাবি ফেরত দিয়ে দশ ডলারের যে নোটটি পেয়েছিলাম তা বের করে দিলাম। তিন ডলার চল্লিশ সেন্ট ফেরত দেবার সময় একটা কার্ড দিলেন আহামাদ। ট্যাক্সি কোম্পানির কার্ডে হাতে লেখা “আহামাদ আল্রাহিম”।
“দিস ইজ মাই কার্ড। কল মি ইফ ইউ নিড। আই লিভ ইন দ্যাট বিল্ডিং” – মাঠের ওইপাড়ে একটা হলুদ রঙের তিনতলা স্কুলের মত লম্বা বিল্ডিং এর দিকে আঙুল তুলে বললেন আহামাদ। বাঁচা গেলো। আহামাদ আমার বিল্ডিং এ থাকেন না।
ট্যাক্সির পেছন থেকে সুটকেস নামাতে যাবার আগেই আহামাদ এক লাফে বেরিয়ে এলেন। নিজের হাতে সুটকেস বের করতে করতে বললেন, “উই রান এন ইসলামিক স্কুল হিয়ার। ফ্রাইডে আফটার প্রেয়ার আই উইল ইন্ট্রোডিউস ইউ আদার ব্রাদার্স”
নিজের হাতে সুটকেস রেখে এলেন বিল্ডিং এর সিঁড়ির কাছে। বললেন, “হুইজ এপার্টমেন্ট ইউ গোয়িং? আই উইল হেল্প ইউ উইথ দিস ব্যাগ”
এতটা আমি আশা করিনি। আহামাদ আমার ব্যাগ নিয়ে একেবারে এপার্টমেন্টের দরজা পর্যন্ত যেতে চাচ্ছেন। আমি তো কোন টিপ্সও দিইনি তাঁকে। অস্ট্রেলিয়াতে টিপ্স দেয়ার চলও নেই খুব একটা। তবে কি এটা ইসলামী ভাতৃত্ববোধের লক্ষণ? নাকি দলের লোক ভারী করার জন্য নিজে গিয়ে চিনে আসতে চাইছেন কোথায় উঠছি আমি? তিনি আমাকে যা ভাবছেন আমি যে তা নই জানিয়ে দেয়া উচিত।
বললাম, “থ্যাংক ইউ ব্রাদার। সো কাইন্ড অব ইউ। মাই নেম ইজ প্রদীপ। আই এম নট এ মুসলিম। আই ডু নট ফলো এনি রিলিজিয়ন”।
আহামাদের মুখ থেকে হাসি উধাও হয়ে গেলো মুহূর্তেই। তিনি প্রায় ছুটে চলে গেলেন ট্যাক্সির দিকে। আমি বললাম, “উই আর স্টিল ব্রাদার্স, রাইট?”
আহামাদ কোন জবাব দিলেন না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ট্যাক্সি নিয়ে উধাও হয়ে গেলেন।
ব্যাগ-ব্যাগেজ নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে কিছুক্ষণ হাঁপালাম। তারপর ১৯ নম্বর এপার্টমেন্টের দরজায় ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল।
“গুড মর্নিং ফিল”
“মর্নিং প্রাডিব। কাম ইন্ কাম ইন্” সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন ফিল। এ বাসার স্মোক এলার্ম সম্ভবত কাজ করে না। ফিল যেভাবে ধুমপান করছেন এতক্ষণে এলার্ম বেজে ওঠা উচিত ছিল।
সরাসরি আমাকে রুমে নিয়ে এলেন ফিল। গতকাল যেমন দেখে গিয়েছিলাম সবকিছু সেরকমই আছে। কেবল বিছানাটা মনে হচ্ছে আরো পরিপাটি করা হয়েছে। একটা টুকটুকে লাল কম্বল পাতা হয়েছে।
“গিভ মি হান্ড্রেড ডলার্স ফর টু উইক্স” সরাসরি প্রসঙ্গে চলে এলেন ফিল।
পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে দুটো পঞ্চাশ ডলারের নোট তার হাতে দিতেই তিনি একটা রসিদ দিলেন আমাকে। আগে থেকেই লিখে রেখেছিলেন। তারপর দুটো চাবি দিয়ে বললেন এপার্টমেন্টে ঢুকতে দুটো তালা খুলতে হবে।
“ডেরেল, ডেরেল” বলে হঠাৎ উচ্চস্বরে কাউকে ডাকতে আরম্ভ করলেন ফিল। লাউঞ্জ রুম থেকে কর্কশ জবাব ভেসে এলো “হোয়াট?”
“কাম হিয়ার। মিট প্রাডিব”
একুশ বাইশ বছরের একজন তরুণ এসে দাঁড়ালো আমার রুমের সামনে। লিকলিকে হাড্ডিসার তরুণের ভাঙাচোরা চেহারায় ফিলের মুখের কিছুটা প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। ভুসভুস করে সিগারেট টানছে সেও। পিতাপুত্র একই সাথে মদ সিগারেট খাওয়া এদের সংস্কৃতির অংশ।
“হাই, আই এম ডেভিড” বলে হাত বাড়িয়ে দিলো আমার দিকে। হঠাৎ চমকে উঠলাম। তার হাতের সাথে হোস্টেলে দেখা ওয়াইনের হাতের অনেক মিল। চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো ডেভিড বা ডেরেলের সাথে ড্রাগের একটা সম্পর্ক আছে। মনটা কিছুটা খারাপ হয়ে গেল। ইউনিভার্সিটির এত কাছে একটা বাসা পেয়ে যেরকম খুশি হয়েছিলাম- সে খুশির পালে ফুঁটো দেখা যাচ্ছে। তোমার মনে আছে, ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় ছাত্রশিবিরের অত্যাচারে হল ছেড়ে মেসে গিয়ে উঠেছিলাম, আর দু’দিন পরে দেখলাম ওই মেসের বেশির ভাগই শিবিরের কর্মী। এখানেও তো সেরকমই হলো মনে হচ্ছে।
ব্যাগে ছোট্ট একটা তালা লাগানো ছিল। তা খুলে রুমের দরজায় লাগিয়ে চলে এলাম। ডিপার্টমেন্টে আসতে মিনিট পাঁচেক লাগলো। লিফ্টে দেখা হলো মিকির সাথে। বললেন কলিনের সাথে দেখা করার জন্য। সেকেন্ড সেমিস্টারে ল্যাব ডেমোনেস্ট্রেশান পাওয়া যাবে। কলিনের অফিস তিন তলায়। খুঁজে বের করতে হবে।
কেনের অফিসের সামনে এসে দেখি নিবিষ্ট মনে কাজ করছেন তিনি। এখানে কারো দরজাতেই কোন পর্দা নেই। করিডোরে অনেকের আনাগোনা সত্ত্বেও এঁদের মনযোগের কোন ব্যাঘাত ঘটে না। অবশ্য সবাই কাজ করছেন দেখে করিডোরে হাঁটার গতি বা গলার স্বর এমনিতেই ছোট হয়ে আসে।
আমার অফিসের দরজা হাট করে খোলা। ঢুকে দেখি বামদিকের ডেস্কের উপর বসে পা নাচাচ্ছে একজন মোটাসোটা মেয়ে। বড়সড় জাম্বুরার মত মুখ। আমাকে দেখে পা নাচানো না থামিয়েই বললো,
“হাই। ইউ মাস্ট বি প্রাডিব। কেন্ টোল্ড মি এবাউট ইউ। আই এম ইমাজিন”
“হাই” ইমাজিনের সাথে হ্যান্ডশেক করতে করতে খেয়াল করলাম তার চিবুকে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। সম্ভবত হরমোনের সমস্যা।
“আর ইউ ডুয়িং পিএইচডি?” ইমাজিনকে জিজ্ঞেস করলাম।
“নো। দিস ইজ মাই অনার্স ইয়ার”
ইমাজিনের সাথে কথা বলে এখানকার অনার্স পদ্ধতি সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম। বাংলাদেশের ইউনিভার্সিটির সিস্টেমের সাথে এখানকার সিস্টেমের অনেক পার্থক্য। আমরা ভর্তি হবার সময়েই অনার্স ক্লাসে ভর্তি হয়ে যাই। ফার্স্ট ইয়ার অনার্স, সেকেন্ড ইয়ার অনার্স, থার্ড ইয়ার অনার্স। কিন্তু এখানে ফার্স্ট ইয়ারে কেউ হয়তো জানেই না অনার্স করবে কি না, বা করলেও ঠিক কোন সাবজেক্টে করবে। ফার্স্ট ইয়ার থেকে থার্ড ইয়ার পর্যন্ত পড়তে পড়তে কোন একটা সাবজেক্টের প্রতি ভাললাগা জন্মায়, আস্তে আস্তে সাবজেক্টটির বিভিন্ন কোর্স প্রাধান্য পেতে থাকে। থার্ড ইয়ারের শেষে ব্যাচেলর ডিগ্রি পাওয়ার পর রেজাল্টের ভিত্তিতে মাত্র কয়েকজন অনার্স করার সুযোগ পায়। ইমাজিনদের ব্যাচে ফিজিক্সে মাত্র বারোজন অনার্স করার সুযোগ পেয়েছে।
একটু পরে ইমাজিন চলে গেলো ক্লাসে। আজ থেকে সেকেন্ড সেমিস্টার শুরু হয়েছে। আমার কোন কোর্স-ওয়ার্ক নেই। তাই ক্লাস করার কোন তাড়া নেই। পিটারকে দেখছি না আজ। হয়তো আসেন নি। আমিও বেরিয়ে গেলাম একটু পরেই।
তিনতলায় নেমে অনেক ঘুরেও কলিনের অফিস খুঁজে পেলাম না। নিচে নেমে রিসেপশানে গিয়ে দেখি একজন বয়স্ক মহিলা কাজ করছেন সেখানে। কলিনের অফিস কোথায় জানতে চাইলাম। বললেন তিনতলার ফিজিক্স পোডিয়ামে। ফার্স্ট ইয়ার ল্যাব পার হয়ে যেতে হবে।
অনেক ঘোরাঘুরির পর ফার্স্ট ইয়ার ল্যাব খুঁজে পেলাম। কিন্তু ঢুকতে পারলাম না, দরজা বন্ধ। কলিনের সাথে দেখা করার জন্য মনে হয় টেলিফোনে এপয়েন্টমেন্ট করে আসতে হবে।
ফিজিক্স বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ইউনিয়ন হাউজের দিকে গেলাম। শত শত শিক্ষার্থীর পদচারণায় মুখরিত ক্যাম্পাস। পঁয়ত্রিশ হাজার শিক্ষার্থী এই ক্যাম্পাসে। বেশ ভালো লাগছে আমার। ভালোলাগার স্রোতে ভাসতে ভাসতে ফুডকোর্টে গিয়ে সাড়ে চার ডলার দিয়ে একটা স্যান্ডুইচ কিনে ফেললাম- ‘তন্দুরি উইথ চিকেন’। এরকম জঘন্য স্বাদের জিনিস আগে কখনো খাইনি।
ফিরে এসে সারা বিকেল কম্পিউটার রুমে কাটালাম। লাইব্রেরি থেকে ইউনিক্স অপারেটিং সিস্টেমের ওপর বেশ কয়েকটা বই নিয়ে এলাম। অ আ ক খ শেখার মত করে শিখতে শুরু করলাম ওপেন সোর্স অপারেটিং সিস্টেম। অজিতকে একটা ইমেইল করতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছিলাম। পাশের কম্পিউটারে কাজ করছিল একজন। বললো, “হোয়াই ডোন্ট ইউ ইউজ পাইন?”
পাইন! পাইন কী জিনিস? ছেলেটা বেশ অন্তরঙ্গ হাসিখুশি। মনে হলো তার কাছে লজ্জা পাবার কিছু নেই। লজ্জা পেলে আমারই ক্ষতি, শেখা হবে না কিছুই। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। তার নাম ক্যামরুন। পিএইচডি করছে স্ট্যাটিস্টিক্যাল ফিজিক্সে ডঃ হলেনবার্গের কাছে। ৬০৭ নাম্বার রুমে তার ডেস্ক, কেনের অফিসের পাশের রুমেই। সে শুরু করেছে দু’বছর আগে। অবশ্য এ ইউনিভার্সিটিতে আছে অনেক বছর। এখান থেকেই সে অনার্স করেছে। এখানে চার বছরের অনার্স ডিগ্রি থাকলে মাস্টার্স না করেও পিএইচডি করা যায়।
ক্যামেরুনের কাছে কম্পিউটারের প্রাথমিক শিক্ষা ভালোই হলো। ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে ডেভেলপ করা ইমেইল প্রোগ্রাম ‘পাইন’ চমৎকার। অনেকগুলো ইমেইল করলাম আজ।
সন্ধ্যাবেলা সেফওয়েতে গেলাম। বাসা থেকে এই সুপারমার্কেটে হেঁটে যেতে সময় লাগলো তিন মিনিটেরও কম। চাল আলু মিষ্টিকুমড়া টমেটো ডিম পেয়াঁজ তেল নুন সব কিনলাম। কিন্তু যেসব মসলা আমি চিনি সেসব কিছুই নাই। মরিচের গুঁড়ো খুঁজলাম অনেকক্ষণ। কিন্তু পেলাম না। বিরাট বিরাট তাকভর্তি হাজার রকমের খাবার জিনিস, রান্না করার উপাদান। কিন্তু মরিচ দেখলাম না কোথাও। এরা কি তবে মরিচ খায় না? সব্জির সেকশানে গিয়ে কাঁচা মরিচ পেলাম- ছোট ছোট প্লাস্টিকের প্যাকেটে মোড়া। এখন আর মরিচের গুঁড়ো না পেলেও চলবে। কিন্তু কাঁচা মরিচের দাম দেখে হাত থেকে পড়ে গেল মরিচের প্যাকেট। উনিশ ডলার নব্বই সেন্ট; এক কেজি মরিচের দাম! প্রায় ছয়শ’ টাকা দরের কাঁচা মরিচ খাবার সামর্থ্য আমার নেই। এমনিতেই যা দেখছি সব কিছুর দাম নিজের অজান্তেই ডলার থেকে টাকায় রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে মাথার ভেতর। তাই তো হাতে গোনা ছয়টা আলু, তিনটে পেয়াঁজ, এক চিলতে মিষ্টিকুমড়া আর এক কেজি চালের সীমায় নিজেকে বেঁধে রাখতে হচ্ছে। কাঁচা মরিচের পাশে বড় বড় লাল লাল যে জিনিস দেখা যাচ্ছে সেগুলো অনেকটা ‘বোম্বাইয়া’ মরিচের মতো দেখতে। কিন্তু দাম কাঁচা মরিচের তুলনায় অনেক কম। ‘বোম্বাইয়া’ মরিচের ঝাল যে কী জিনিস তা কি তুমি জানো? সামান্য একটুকরো দিয়েই এক বেলার তরকারি হয়ে যাবে। অস্ট্রেলিয়ার ‘বোম্বাইয়া’ মরিচের কী বিশাল সাইজ! বিশাল দেশের বিশাল মরিচ। একটাতেই এক সপ্তাহ চলে যাবে।
বাসার দরজা খুলতেই কড়া তামাকের গন্ধ নাকে এলো। লাউঞ্জ রুমে ফিলের গলা ছাপিয়ে মেয়েলী কন্ঠের হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। সকালে ফিলের স্ত্রীর সাথে দেখা হয়নি। এখন হয়তো সবাই মিলে ডিনার করছে, ফ্যামিলি টাইম। কিন্তু প্যাসেজে কোন আলো নেই। রুমের তালা খোলার জন্য হাতড়াতে হচ্ছে। শব্দ শুনে ফিল বেরিয়ে এলেন। মুখে সিগারেট।
“প্রাডিব। হিয়ার ইজ দি সুইচ” বলে লাইট জ্বালিয়ে দিলেন। দেখলাম ফিলের হাতে মদের গ্লাস, মুখের সিগারেট থেকে ভুসভুস করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। তার পেছনে একটা বড়সড় বেড়াল- কুচকুচে কালো।
“কাম হিয়ার প্রাডিব, মিট ফ্লপি”
ঘরের দরজা খুলে হাতের জিনিসপত্র নামিয়ে রেখে দেখি ফিল লাউঞ্জে ফিরে যাচ্ছেন। তাকে অনুসরণ করলো বেড়ালটা। ফ্লপির সাথে পরিচিত হবার জন্য লাউঞ্জে ঢুকলাম। বেশ বড় রুম। এক কোণায় টেলিভিশন চলছে, ছাব্বিশ ইঞ্চির কম নয়। টিভির সামনে কালো সোফায় বসে পা নাচাচ্ছেন একজন মহিলা। ইনিই কি ফ্লপি? ফিলের স্ত্রী? এর হাসির শব্দ শুনেছিলাম একটু আগে। কিন্তু এখন একদম চুপচাপ। আমি মহিলার দিকে তাকিয়ে খুব ভদ্রতার সাথে বললাম, “গুড ইভনিং”
মহিলা কোন জবাব দেয়া তো দূরের কথা, আমার দিকে ফিরেও তাকালেন না।
“ফ্লপি, ফ্লপি, সে হ্যালো টু প্রাডিব”
এভাবে বলতে হচ্ছে কেন? ফ্লপি কি আমাকে দেখতে পাচ্ছেন না? অন্ধ? কিন্তু কোন অন্ধ মানুষের সাথে কথা বলার সময়েও তো আমরা মানুষটির দিকে তাকিয়ে কথা বলি। অথচ ফিল ফ্লপির সাথে কথা বলার সময় তাকাচ্ছেন বেড়ালটার দিকে। তবে কি- হুঁ তুমি ঠিকই ধরেছো।
“ফ্লপি, ফ্লপি, সে হ্যালো টু প্রাডিব”
এবার বেড়ালটা পেছনের দু’পায়ে ভর দিয়ে সামনের দু’পা জড়ো করে নমষ্কারের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকলো কয়েক সেকেন্ড। প্রায় সব পশুই কোন না কোন কারণে এরকম ভঙ্গি করতে পারে। বিশেষ করে খাবার জোগাড় করার সময় তো বটেই। অবাক হবার মত তেমন কিছু নয়। অথচ ফিল এমন করছেন যেন তাঁর ফ্লপি নামের বেড়ালটা বিশ্বজয় করে এসেছে।
এবার ফিল শুরু করলেন ফ্লপির গুণকীর্তন। এ অঞ্চলের বেড়াল সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী হচ্ছেন ফ্লপি। তার বয়স নাকি ষোল। অনেক ছানাপোনা হয়েছে তার। ফিল তাঁর বন্ধু-বান্ধবদের বিলিয়েছেন। ইনফ্যাক্ট এ অঞ্চলের সব বেড়ালই নাকি কোন না কোন ভাবে ফ্লপির আত্মীয়। ফ্লপি মাহাত্ম্য শেষই হচ্ছে না। নিজের ছেলেকে নিয়েও ফিল এতটা উচ্ছ্বাস দেখান কি না সন্দেহ আছে। সকালে ছেলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময় একটা বাক্যও বলেননি ছেলে সম্পর্কে। এদেশে মনে হয় ছেলে-মেয়ের চেয়েও আপন হচ্ছে পোষা কুকুর-বেড়াল।
সোফায় বসা মহিলাটি কে বুঝতে পারছি না। টিভির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। অনবরত পা নাড়ানোটা না থাকলে একটা সাদা পুতুল বলে মনে হতো। ফিল যখন কিছুই বললেন না তখন তিনি যেই হোন আমার না জানলেও চলবে।
নিজের রুমে চলে এলাম। সাড়ে ছ’টা বাজে। ফিল বলেছেন সন্ধ্যা সাতটার পরে রান্নাঘরে ঢুকতে। সাতটার মধ্যে তাঁদের ডিনার সারা হয়ে যায়। তারপর শুরু হবে আমার রান্না-বান্না খাওয়া দাওয়া।
জামা-কাপড় বদলানো দরকার। রুমের দরজা বন্ধ করতে গিয়ে দেখলাম কোন ছিটকিনি নেই, কখনো ছিল বলেও মনে হয় না। এদেশের কি এটাই নিয়ম যে রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করা যাবে না। দরজায় নক না করে কেউ কারো ঘরে ঢুকে না বলেই হয়তো তাদের ছিটকিনির দরকার হয় না। কিন্তু আমার যে সংকোচ যায় না। একটা চেয়ার টেনে এনে আটকানো দরজায় সাথে লাগিয়ে দিলাম। কেউ দরজা ঠেলে ঢুকতে গেলে চেয়ারটা পড়ে গিয়ে কিছুটা সতর্কতা সংকেত অন্তঃত দেবে।
এতক্ষণে রুমের ভেতরটা ভালো করে দেখার সুযোগ হলো। টকটকে লাল কম্বল ঢাকা বিছানার পাশে একটা নড়বড়ে টেবিল, একটা ছোট্ট ড্রয়ার, আর দুটো চেয়ার। টেবিলে একটা টেবিল লাইট আছে, জ্বলে। একটা রেডিও আছে, বাজে। দরজার পাশে দেয়ালের ভেতর একটা ওয়াড্রোব, সেখানে কয়েকটা হ্যাঙ্গার ঝুলছে। আর কী লাগে একজন মানুষের?
সুটকেস খুলে জামাকাপড় বের করতে গিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। এই তো সেদিন দাদা কত যত্ন করে সুটকেসটা গুছিয়ে দিয়েছিল। এর মধ্যেই দু’সপ্তাহ চলে গেলো। প্রতিটা জিনিসের সাথে জড়িয়ে আছে আমার প্রিয়জনদের আদর-স্নেহ-ভালবাসা। ওয়াড্রোবে জামাকাপড় কোন রকমে গুছিয়ে রেখে বেরোলাম বাথরুমে যাবার জন্য।
রুম থেকে বেরিয়ে প্যাসেজের ডানদিকে টয়লেট, তারপাশে বাথরুম। টয়লেটে ঢুকে পরপর দুটো ধাক্কা খেলাম। মানসিক ধাক্কা। প্রথম ধাক্কা হলো- টয়লেটেও কোন ছিটকিনি নেই। একজনের রুমে হয়তো অন্যজন নক না করে ঢুকবে না। কিন্তু এই টয়লেট তো বাসার সবাই ব্যবহার করবে। কেউ যদি তাড়াহুড়োয় নক না করেই দরজা খুলে ফেলে? ভাবতেই কেমন জানি লজ্জা হচ্ছে।
দ্বিতীয় ধাক্কাটি আরো মারাত্মক। দরজা বন্ধ করে কমোডে বসার পর চোখ তুলে দেখি পুরো দরজা বড় বড় রঙিন পোস্টারে ভর্তি। সেখানে নানাভঙ্গিতে শুয়ে বসে দাঁড়িয়ে আছেন যাঁরা তাঁদের কারো শরীরেই কোন জামাকাপড় নেই। কী রকম রুচির মানুষ ফিল? এখান থেকেই বোঝা যায় এ বাসায় কোন মহিলা থাকেন না। পৃথিবীতে যত পর্নোগ্রাফি তৈরি হয় তার শতকরা নিরানব্বই দশমিক নিরানব্বই ভাগ দর্শক পুরুষ। যে সামান্য ক’জন মহিলা এসব দেখেন তাঁরাও তাঁদের বাসার টয়লেটে এরকম প্রদর্শনী সহ্য করবেন না। মস্ত বিপদে পড়লাম তো। ফিল নাকি ফিলের ছেলে লাগিয়েছে এগুলো? অস্ট্রেলিয়ান আইনে হয়তো এসব নিষিদ্ধ নয়, কিন্তু সবার যে এসব দেখতে ভাল লাগবে তাও তো নয়। তাছাড়া যারা এসব দেখতে পছন্দ করেন, তাঁদেরও কি সবসময় ভালো লাগে? সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই এসব দেখলে কেমন লাগে?
সাতটা বাজার পর জিনিস-পত্র নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলাম। রান্না করা আমার জন্য নতুন কিছু নয়। ক্লাস টেনে পড়ার সময় থেকেই আমার রান্না করা শুরু। তখন যেভাবে সব আয়োজন করতে হতো – সে তুলনায় এখানে তো সবকিছু প্রায় রেডি। শুরুতে একটু সমস্যা হওয়াটাই স্বাভাবিক। যেমন গ্যাসের চুলা জ্বালাতে গিয়ে দেখলাম ম্যাচ জ্বালাতে পারছি না। তরল গ্যাস ভর্তি এসব ম্যাচ জ্বালানো কঠিন কিছু নয়, কিন্তু কোন কারণে ফিলের ম্যাচটা সমস্যা করছিল। ফিল এসে সমস্যার সমাধান করে দিলেন। তাঁর সঙ্গিনী চলে যাবার পর তিনি রান্নাঘরে এসে কিছুক্ষণ এটা-ওটা গল্প করলেন। আমি ম্যাচ জ্বালাতে পারছি না দেখে হাত লাগালেন। ধূমপায়ীরা কিছু না পারলেও অন্তঃত ম্যাচ জ্বালাতে পারে যে কোন অবস্থাতেই।
ডিম আর সব্জি একসাথে একটি ডেক্সিতে আর অন্য একটিতে ভাত বসিয়ে দিলাম। সব্জিতে অতি যত্নে সামান্য একটু ‘বোম্বাইয়া’ মরিচ দিয়ে ভাবলাম কী যে ঝাল হবে! ঘন্টাখানেক পরে যখন খেতে বসলাম – দেখলাম ভাত হয়েছে ঘন ডালের মত তরল। আর যে সব্জির মারাত্মক ঝাল হবার কথা – তার স্বাদ হলো পানির মত। আমার বাবা বলেন “টাটকা সব্জি নুন আর মরিচ দিয়ে সিদ্ধ করলেও দারুণ স্বাদ হয়”। সব্জি টাটকা তাতে কোন সন্দেহ নেই। নুনেও কোন ভেজাল নেই। তাহলে ‘দারুণ স্বাদ’ না হবার কারণ ‘বোম্বাইয়া’ মরিচ। ছুরি দিয়ে কেটে জিভে লাগিয়ে দেখলাম কেমন যেন কাঁচা বরইর স্বাদ, ঝালের নামগন্ধও নেই। ‘বোম্বাইয়া’ মরিচ মনে করে আমি কী নিয়ে এলাম? সেফওয়ের রসিদটা পড়ে দেখলাম। এই বস্তুর নাম ক্যাপসিকাম। নামও শুনিনি আগে। আমি যে কেমন গাঁইয়া বুঝতে পারছো এবার?
ফিল বলেছেন রান্নাঘর পরিষ্কার রাখতে। তাই খাবার পর সবকিছু ধুয়ে মুছে জায়গামত তুলে রাখতে অনেকক্ষণ লাগলো। সারাক্ষণই ভয় হচ্ছিলো কিছু ভেঙে ফেললাম নাকি। তাছাড়া অবশিষ্ট ভাত তরকারি রাখার জন্য কিছু খুঁজে পাচ্ছিলাম না। শেষে একটা পুরনো প্লাস্টিকের কন্টেইনারে ঢেলে রাখলাম ভাত-তরকারি একসাথে। খাওয়ার সময় তো মেশাতেই হবে, আগে থেকে মিশিয়ে রাখলে দোষ কী। ফিলের ফ্রিজটা অনেক পুরনো। ভেতরে বরফ জমে আছে অনেক। তাতে অবশ্য আমার খুব একটা অসুবিধা হবার কথা নয়। যে কোন পরিস্থিতিতে টিকে থাকার শিক্ষাটাও আমার মৌলিক শিক্ষার অংশ।
এ বাসায় প্রথম রাত কাটছে আজ। ভালোই তো কাটছে। আস্তে আস্তে একটা অভ্যস্ততা চলে আসবে। এবার পার্ট-টাইম কিছু কাজ জোগাড় করতে পারলে আর কী চাই! যদিও মনের চাহিদার শেষ নেই।
একটু আগে ব্যাগ থেকে বেরুলো সৈয়দ শামসুল হকের ছোট ছোট কবিতার ছোট্ট একটা বই “পরানের গহীন ভিতর”। দিদিভাই ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। কবিতাগুলো ‘পরানের গহীন ভিতর’ গিয়ে সবকিছু এলোমেলো করে দিতে চায়। কিন্তু আমাকে তো মানতেই হবেঃ
“তোমার দ্যাশের দিকে ইস্টিশানে গেলেই তো গাড়ি
সকাল বিকাল আসে, এক দন্ড খাড়ায়া চম্পট,
কত লোক কত কামে দূরে যায়, ফিরা আসে বাড়ি-
আমার আসন নাই, যাওনেরও দারুন সংকট”।
ক্রমশঃ _______________
জাম্বুরা সাইজের মরিচের কথা পড়ে আমিও বুঝে গেসলাম কি হতে যাচ্ছে! কানাডাতে তো ওটাকে বলে ‘সুইট পেপার’ মানে মিষ্টি মরিচ!!
যাই হোক পড়ে ভাল লাগল
সেফ ওয়েতে মরিচের বর্ণনা শুনেই বুঝেছিলাম যে কলাপে খারাপী আছে। উত্তর আমেরিকায় ক্যাপসিকাম বলে না, খুব সম্ভবত আপনার ক্যাপসিকামই আমাদের বেল পেপার বা গ্রীন পেপার যা এখানে মানুষ সব্জী হিসেবে খায়।