[সিরাজ সিকদারকে নিয়ে এ পর্যন্ত কম লেখা হয়নি। বেশীরভাগ লেখাই মনে হয়েছে, কোনো দলীয় স্বার্থ পূরণের জন্য। আবার ব্যক্তি সিরাজের জীবন নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করে অনেকে তার বিপ্লবীত্বকে খাটো করেছেন। তারা আসলে তার আত্নত্যাগকেই কটাক্ষ করেছেন। প্রচলিত এই সব দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে বলে লেখার শিরোনামে ‘অন্য আলোয় দেখা’ কথাটি যুক্ত করা হয়েছে। এটি মোটেই সিরাজ সিকদারের সংক্ষিপ্ত জীবনী বা তার কর্মকাণ্ডের সামগ্রীক মূল্যায়ন নয়। বরং এটি ভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে নির্মোহভাবে এই শহীদ দেশপ্রেমিক বিপ্লবীকে দেখার একটি ছোট্ট প্রয়াস।]
অস্ত্র কোনো নির্ধারক শক্তিনয়, নির্ধারক শক্তি হচ্ছে মানুষ। সংগঠিত জনগণ অ্যাটম বোমার চেয়েও শক্তিশালী।…মাওসেতুং।
১। সর্বহারা পার্টি গঠন, ১৯৭১
গেরিলা যুদ্ধের মহানায়ক মাওসেতুং-এর নেতৃত্বে চীনের বিপ্লব ও চীনের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ ছয়ের দশকের শেষভাগে সারা বিশ্বের মতো ছড়িয়ে পড়েছিলো যুদ্ধোপূর্ব বাংলাদেশেও। পাকিস্তানী শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট, অগ্নিগর্ভ পূর্ব বাংলাকে বেশ কয়েকটি বামপন্থী গ্রুপ সশস্ত্র পন্থায় মুক্ত করতে চেয়েছিলো। মাওসেতুং-এর গেরিলা যুদ্ধ অনুসরণ করে সে সময় যে সব গ্রুপ এদেশে সশস্ত্র কৃষক বিপ্লব করতে চেয়েছিলো, সাধারণভাবে তারা পরিচিতি লাভ করে পিকিংপন্থী (পরে নকশাল) হিসেবে। আর ছিলো আওয়ামী লীগ-ঘেঁষা, ভোটপন্থায় ক্ষমতা দখলে বিশ্বাসী মনি সিং-এর নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি, যারা চিহ্নিত হয় মস্স্কোপন্থী হিসেবে।
ছয়-দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ এর নির্বাচনের পর ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
অন্যদিকে পিকিংপন্থী পূর্ব বাংলার কমিউন্স্টি পার্টির নেতৃত্বে ছিলো দুটি ভাগ। একটি অংশ টিপু বিশ্বাস ও দেবেন সিকদার মুক্তিযুদ্ধকে ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলন’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। অন্যদিকে মতিন-আলাউদ্দীনের দল ‘দুই শ্রেণী শত্রু’ মুক্তিবাহিনী ও পাক-বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করার পক্ষপাতি ছিলো। এ পার্টির নেতারা রাজশাহীর আত্রাই অঞ্চলে ছিলো বেশ তৎপর।
এর আগে তরুন বিপ্লবী সিরাজ সিকদার প্রথমে মাওসেতুং গবেষণা কেন্দ্র নামে একটি পাঠচক্রের মাধ্যমে শিক্ষিত ও বিপ্লব আকাঙ্খী যুবকদের সংগঠিত করেন। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি গঠন করেন পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন। প্রতিষ্ঠার পরেই এ গ্রুপটির মূল থিসিস ছিলো: পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের একটি উপনিবেশ এবং ‘জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের’ মাধ্যমে এ উপনিবেশের অবসান ঘটাতে হবে। এ লক্ষ্যে সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে একটি বিপ্লবী পরিষদ গঠিত হয়।
১৯৭১ সালের ২ মার্চ এই বিপ্লবী পরিষদ শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি লেখে, যা লিফলেট আকারে সারাদেশে প্রচার করা হয়। এতে স্পষ্ট লেখা হয়, আপনার ও আপনার পার্টির ছয়-দফা সংগ্রামের ইতিহাস প্রমান করেছে যে, চয়-দফা অর্থনৈতিক দাবিসমূহ বাস্তবায়ন সম্ভব সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে, পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন, মুক্তি ও স্বাধীন করে।…
এতে সিরাজ সিকদার গ্রুপ যে সব প্রস্তাব দেয়, তার ৪ নম্বর দফাটি ছিলো:
…পূর্ব বাংলার দেশ প্রেমিক রাজনৈতিক পার্টি ও ব্যক্তিদের প্রতিনিধি সমন্বয়ে ‘জাতীয় মুক্তিপরিষদ’ বা ‘জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট’ গঠন করুন।
কিন্তু আওয়ামী নেতারা সিরাজ সিকদারের এই আহ্বান উপেক্ষা করেন, যা পরে গড়ায় দুই পার্টির এক রক্তাক্ত ইতিহাসে।
১৯৭০ সালে সিরাজ সিকদারের বিপ্লবী পরিষদ বিভিন্ন জেলায় পাকিস্তানী প্রশাসন ও শ্রেনী শত্রুর বিরুদ্ধে গেরিলা অপারেশন চালায়। ওই বছরের ৮ জানুয়ারি তারা ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ ও ময়মনসিংহে ওড়ায় স্বাধীন পূর্ব বাংলার পতাকা।
পাকিস্তানী বাহিনীর আকস্মিক হামলার পর সিরাজ সিকদার বরিশালের পেয়ারা বাগানে গড়ে তোলেন প্রতিরোধ যুদ্ধ। ৩০ এপ্রিল জন্ম নেয় জাতীয় মুক্তিবাহিনী। রণকৌশল নির্ধারণ ও যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সিরাজ সিকদারের সভাপতিত্বে প্রতিষ্ঠা হয় ‘সর্বোচ্চ সামরিক পরিচালনা কমিটি’। ৩ জুন পার্টির নতুন নাম দেয়া হয়:
পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি।
বরিশাল থেকে শুরু করে দেশের কয়েকটি উপকূলীয় অঞ্চল–বিক্রমপুর, মানিকগঞ্জ, পাবনা, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন এলাকায় সর্বহারা পর্টির গেরিলারা পাক-বাহিনীর সঙ্গে বীরত্বপূর্ণ লড়াই করে।
সে সময় সর্বহারা পার্টি শত্রুমুক্ত এলাকায় (মুক্তাঞ্চল) বেসামরিক প্রশাসন পরিচালনার জন্য বেশ কিছু পর্ষদ গঠন করে। কিন্তু এই সময় সিরাজ সিকদার ত্রি-মুখী লড়াইয়ের রণ কৌশল ঘোষণা করেন, যাতে সর্বহারা পার্টি ব্যপক লোকবল হারায়। আগস্ট থেকে অক্টোবরের মধ্যে মুজিব বাহিনী ও সর্বহারা পার্টির মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বেশ কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়।
এমনই পরিস্থিতিতে অক্টোবরে সর্বহারা পার্টি দলের গেরিলাদের নির্দেশ দেয় পাক-বাহিনী, ভারতীয় বাহিনী ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করতে। কারণ সিরাজ সিকদার পাকিস্তানকে উপনিবেশবাদী , ভারতকে অধিপত্যবাদী এবং আওয়ামী লীগকে ভারতপন্থী আধিপত্যবাদী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।
নভেম্বরের মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থক মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে সর্বহারা পার্টির বহু সদস্য নিহত হয়েছিলো।
২। নকশালী মূল্যায়ন: আই অ্যাম দা পার্টি!
১৯৬৬ সালের চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের একটি বড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে দুই বাংলায়। ‘গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও’ মাওসেতুং এর এই দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা যুদ্ধ, তথা সশস্ত্র কৃষক বিপ্লবের রনোনীতি গ্রহণ করে যুদ্ধপূর্ব সময়ের বামপন্থী দলগুলোর একাংশ। সাধারণভাবে এসব বামদলগুলো পিকিংপন্থী (পরে নকশাল) হিসেবে চিহ্নিত হয়। এরই একটি পূর্ব বাংলার কমিউন্স্টি পার্টি; এই পার্টির নেতৃত্বে ছিলো আবার দুটি ভাগ। একটি অংশ টিপু বিশ্বাস ও দেবেন সিকদার মুক্তিযুদ্ধকে ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলন’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। তারা ১৯৭১ সালে রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, দিনাজপুরসহ উত্তরবঙ্গ এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে তোলেন পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ। তবে স্পষ্টতই এর বেশীরভাগ প্রতিরোধ যুদ্ধই পরিচালিত হয় মুজিব বাহিনীর বিরুদ্ধে।
এর আগে অগ্নিগর্ভ যুদ্ধপূর্ব বাংলাদেশে ১৯৬৯-৭০ সালে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানীর ন্যাপের নেতৃত্বে লাল টুপির সম্মেলন এবং সন্তোষ কৃষক সম্মেলনেও পিকিংপন্থী নেতারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (দেবেন সিকদার) কেন্দ্রীয় নেতা আজিজ মেহের ১৯৬৯ সালে সার্বক্ষনিক কর্মী হিসেবে পার্টির ঢাকা, ময়মনসিংহ ও বরিশাল আঞ্চল তদারকির দায়িত্ব পালন করেন। এরই মধ্যে ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের নয়া প্রেসিডেন্ট হিসেবে সারাদেশে সামরিক আইন জারী করেছেন।
প্রকাশ্য রাজনীতি ছেড়ে আত্নগোপনে থেকেই পার্টির নেতারা চেষ্টা করলেন মাওবাদী ছোট ছোট গ্রুপগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার। মূল দায়িত্ব দেয়া হলো আজিজ মেহেরকে। বরিশালে একজন অ্যাডভোকেটের নেতৃত্বাধীন গ্রুপের সঙ্গে আজিজ মেহেরের প্রথম দফা বৈঠক অসফল হয়। পরে মাওপন্থী ছাত্রদের একটি গ্রুপ তাদের কর্মসূচির সঙ্গে একাত্নতা প্রকাশ করে পার্টিতে যোগ দেয়। এর পর ঐক্যের ডাক নিয়ে আজিজ মেহের সাক্ষাৎ করেন সর্বহারা পার্টির প্রধান সিরাজ সিকদারের সঙ্গে।
বাকী কথা আজিজ মেহেরের ভাষ্যে:
…একটি গ্রুপ কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে তখন বিকশিত হচ্ছে ঢাকায় এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। যদিও তার সম্পর্কে বামপন্থী-বুদ্ধিজীবী মহলে নানা বিভ্রান্তি। কেউ মনে করতেন, এরা অ্যাডভেঞ্চারিস্ট, সন্ত্রাসবাদী; কেউ মনে করতেন, সিরাজ সিকদার হচ্ছেন সিআইএ’র এজেন্ট। তবে আমাদের পার্টি এ বিষয়টি এমন একপেশে, যান্ত্রিকভাবে দেখতো না।
আমি মনে করি, কমরেড সিরাজ সিকদারের একটি বিপ্লবী আকাঙ্খা ছিলো। কথাবার্তা, চলাফেরা– সবকিছুর মধ্যে ছিলো একটা আকর্ষণীয় ব্যপার। তরুণ ছাত্রকর্মী, যারা বিপ্লবের জন্য ছিলো ব্যাকুল, তারা সহজেই আকৃষ্ট হয়েছিলো। তারা কয়েকটা গেরিলা গ্রুপ করে, কয়েকটি সরকারি অফিসে বোমাবাজী করে, দেয়াল লিখনে বেশ সাড়া জাগিয়েছিলো। বিশেষ করে সিরাজ সিকদারের থিসিস আকৃষ্ট করেছিলো ছাত্র-তরুণদের।
কিন্তু আমরা মনে করতাম, এদের কর্মকাণ্ডে যতটা রোমান্টিক বিপ্লবী উপদান আছে, ততটা মার্কসীয় উপাদান নেই।
তবু অনেক চেস্টার পর ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় কমরেড সিরাজ সিকদারের সঙ্গে আমার দেখা হলো। উনি আমাদের পার্টির দলিলই পড়েননি! তার ব্যাগে দলিল ভড়ে দিলাম। সব শুনে উনি বললেন, ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার কোনো ইচ্ছা ‘তার বা তার পার্টির’ নেই। কথা শুনে মনে হলো: উনিই পার্টি!
কথাবার্তার সময় সিরাজ সিকদার বার বার তার কোটের পকেট থেকে মাওসেতুং এর লাল বই (কোটেশন ফ্রম মাওসেতুং, রেড বুক হিসেবে সারা বিশ্বে বহুল প্রচারিত) বের করে দু-এক পাতা দেখে নিচ্ছিলেন। ওনার শোল্ডার হোল্ডারে একটা রিভলবার দেখতে পেলাম। সব কিছুই যেনো একটা ‘শো’ বলে মনে হচ্ছিলো।
মনে হলো, উনি একজন উচ্চাকাঙ্খী বামপন্থী নেতা। রোমান্টিক কর্মকাণ্ডের জন্য তার গ্রুপের কিছুটা বিকাশ হয়তো হবে; তার কোনো ভবিষ্যত নেই। আমাদের পার্টির ঐক্য হলো না।…
৩। তোমার নাম, আমার নাম/ ভিয়েতনাম, ভিয়েতনাম!
সাতের দশকের শুরুতে ওপারে ভারতে চারু মজুমদারের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট) বা সিপিআই (এম-এল) জলপাইগুড়ির নকশালবাড়িতে সফলভাবে সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহ সংগঠিত করে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র একে ‘বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ’ হিসেবে চিহ্নিত করলে চারু মজুমদার পার্টিতে ঘোষণা করেন:
নকশালবাড়ির পথ ধরেই ভারতে কৃষক বিপ্লব বিদ্রোহ হবে; মাওসেতুং-এর দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধের পথই আমাদের পথ; জনযুদ্ধই মুক্তির সদন…
কলকাতার দেয়ালে লেখা হয়:
নকশালবাড়ি লাল সেলাম!
চীনের চেয়ারম্যান, আমাদের চেয়ারম্যান!
বন্দুকের নল থেকেই রাজনৈতিক ক্ষমতা বেরিয়ে আসে!
৭০এর দশককে মুক্তির দশকে পরিনত করুন!
হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী চার মজুমদারের উদাত্ত আহ্বানে বিপ্লবের আগুনে ঝাঁপ দেয়।
সে সময় নকশালরা সাইকেলের পাইপ কেটে ছড়ড়ার বুলেট ব্যবহার করে হাতে তৈরি সিঙ্গেল শট বন্দুক ‘পাইপগান’ বানায়। আর পুলিশের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া থ্রি নট থ্রি রাইফেলের নল ও কুঁদো ছেটে ছোট আকৃতি দিয়ে তৈরি করা হয় সহজে বহনযোগ্য কাটা-রাইফেল। এছাড়া কাঁচের বোতলের ভেতর আলকাতরা ও পেট্রোলের মিশ্রনে তৈরি হয় মলটোভ বোমা। নকশালবাদী আন্দোলনে গ্রাম ও শহরে ‘শ্রেনী শত্রু খতমের লাইনে’ বিপ্লব করতে এই অস্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার শুরু করে। সঙ্গে রাম দা তো ছিলোই।
নকশালবাদী আন্দোলনের ঢেউ এপারে মাওপন্থী বাম দলগুলোর মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে, এ কথা আগেই বলা হয়েছে। সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি সরাসরি চারু মজুমদারের খতমের লাইন গ্রহণ না করলেও নকশালী কায়দায় জনবিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী লাইন, তথা জোতদার নিধন কর্মসূচি চালায়। এপারেও নকশালাইট ও সর্বহারাদের মধ্যে পাইপ গান ও কাটা রাইফল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
নকশালবাড়ি আন্দোলনের পটভূমিতে কবি সুবিমল মিশ্র লিখলেন:
আবার পাইপ গান এতো বেশী গরম হয়ে আসে যে, ক্রমশ এর ব্যবহার কমে আসছে। …
অর্থাৎ মাওবাদী গ্রুপগুলো সাতের দশকে ‘শ্রেণী শত্রু খতমের’ নামে যখন পাইপগানের যথেচ্ছ ও ব্যাপক ব্যবহার শুরু করে, এমন কী তা দলীয় কোন্দল মেটাতেও ব্যবহার হতে থাকে, তখন তারা আদর্শচ্যূত হয়ে পড়ে। জনযুদ্ধের অস্ত্রের বিপ্লবী ব্যবহার না হয়ে, তা ব্যবহত হতে থাকে গোষ্ঠি বিপ্লবের নামে, কখনো ব্যক্তি স্বার্থ রক্ষাতেও। …
পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) কেন্দীয় নেতা, নকশালপন্থী আজিজ মেহের নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন, চারু মজুমদারের মতো এপাড়েও শিক্ষিত তরুণ সমাজ সহজেই সিরাজ সিকদারের বিপ্লবের থিসিসে আকৃষ্ট হয়।
সরকার বিরোধী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দায়ে পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধের সময় আজিজ মেহেরকে আটক করে ব্যপক নির্যাতন করে এবং তাকে সশস্ত্র কারাদন্ড দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয় ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে। নতুন রাজনৈতিক বন্দী এবং কয়েকজন বাঙালি জেল পুলিশের বরাতে তিনি তখন দেশের সব খবরাখবরই পেতেন। এমন কী পার্টির নেতাদের সঙ্গেও তার গোপন চিঠিপত্রের লেন দেন চলছিলো।
আজিজ মেহের বলেন,
…ওদিকে কিন্তু ভারতে নকশাল দমনের নামে হাজার হাজার তরুনকে হত্যা করা হচ্ছে; গ্রেফতার করে বিনা বিচারে আটক করে রাখা হচ্ছে। বাংলাদেশের বামেরা কখনো ডানে, কখনো বামে হেলছেন। কিন্তু তারা প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন, শ্রেণী শত্রু খতম করছেন, কখনো মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছেন। আমরা সব খবরই জেলে বসে বিশেষ চ্যানেলে পেতাম।
এই সময় কিউবায় ফিদেল ক্যাস্ট্রো-চে গুয়েভারার বিপ্লবী আন্দোলন এবং ভিয়েতনামে হো চি মিনের কৃষক বিপ্লব ওপার বাংলা-ওপার বাংলায় তরুনদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিলো। সারাদেশে শ্লোগান ওঠে:
তোমার নাম, আমার নাম
ভিয়েতনাম, ভিয়েতনাম!
এদিকে ১৯৭২-৭৪ মাওবাদী বা পিকিংপন্থী গ্রুপগুলোর মধ্যে সশস্ত্রপন্থার রণোনীতি নিয়ে বিভেদ দেখা দেয়। শিগগিরই শুরু হয়ে যায় পরস্পরকে বহিস্কার ও মৃত্যূদণ্ড ঘোষণা। সিরাজ সিকদার সর্বহারা পার্টিকে নিস্কন্টক রাখতে ‘নিপাত চক্র’ নামে পার্টির ভেতরে একটি অনুগত গ্রুপ করেছিলেন। এদের মূল কাজ ছিলো, পার্টির ভেতরের প্রতিক্রিয়াশীলদের হত্যা করা।
আজিজ মেহের জেল খানার জীবনের স্মৃতি চারণ করে বলেন,
…আমাকে নিউ ২০ সেলে স্থানান্তর করা হলো। পাশের সেলে ছিলো বৃহত্তর বরিশালের কাকচিরা গ্রামের ও বরিশাল কলেজের ছাত্র কমরেড সেলিম শাহনেওয়াজ। সে ছিলো সিরাজ সিকদারের পার্টির সদস্য। ১৯৭১ এর পরে ১৯৭৩ এ পার্টির সঙ্গে মতানৈক্য হওয়ায় সিরাজ সিকদারের নির্দেশে এই আত্নত্যাগী তরুণকে হত্যা করা হয়। যেমন হত্যা করা হয়েছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হুমায়ুন কবিরকে।…
যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে শেখ মুজিবের প্রধান রাজনৈতিক শত্রুতে পরিনত হয় মাওপন্থীরা।
আজিজ মেহের বলছেন,
(১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর জেল থেকে বেরিয়ে ) আমি দ্রুত পার্টি লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম এবং (আত্ন-গোপনের জন্য) ঢাকায় কয়েকটি শেল্টার ঠিক করে ফেললাম। ১৯৭১ সালে আমাদের পার্টি বিশেষ এক অধিবেশনে চারু মজুমদারের নকশালী লাইন গ্রহণ করে। সে সময় তারা শ্রেণীশত্রু খতমের পাশাপাশি পাক-বাহিনীকেও মোকাবিলা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তোয়াহা ও সিরাজ সিকদারের পার্টি একই রকম কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। ফলে বাংলাদেশ সরকার ও মুজিব বাহিনীর প্রধান টার্গেট ছিলো এই সব গ্রুপ। সারাদেশে ‘ধরো আর মারো’ শুরু হয়ে গেলো। শেখ মুজিব এক জনসভায় ঘোষণা করলেন: নকশাল দেখা মাত্র গুলি করা হবে। মওলানা ভাসানী প্রতিবাদ করে বিবৃতি দিলেন: নকশাল কারো গায়ে লেখা থাকে না। বিনা বিচারে কাউকে হত্যার অধিকার সরকারের নেই।…
এদিকে ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনে সর্বহারা পার্টি সারাদেশে হরতালর ডাক দেয়। পার্টির মুখপত্র ‘স্ফুলিঙ্গ’ ও প্রচারপত্রে বলা হয়,
১৬ ডিসেম্বর হচ্ছে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী শক্তির কাছে মুজিব সরকারের আত্ন সমর্পণ দিবস। একমাত্র জনযুদ্ধের মাধ্যমেই জনগণের বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠা করে প্রকৃত বিজয় আসতে পারে।
মাওবাদীদের বিরুদ্ধে মুজিব সরকারের ব্যপক দমন-পীড়ন, হত্যা-নির্যাতনের প্রতিবাদে সর্বহারা পার্টি ঢাকায় হরতাল আহ্বান করলে সন্তোষ থেকে মওলানা ভাসানী বিবৃতি দিয়ে একে সমর্থণ করেন। হরতাল সফল হয়।…
৪। কোথায় আজ সিরাজ সিকদার?
সাতের দশকের নকশাল নেতা আজিজ মেহের বলছেন:
১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনে সর্বহারা পার্টি সারাদেশে হরতালর ডাক দেয়। পার্টির মুখপত্র ‘স্ফুলিঙ্গ’ ও প্রচারপত্রে বলা হয়, ১৬ ডিসেম্বর হচ্ছে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী শক্তির কাছে মুজিব সরকারের আত্ন সমর্পণ দিবস। একমাত্র জনযুদ্ধের মাধ্যমেই জনগণের বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠা করে প্রকৃত বিজয় আসতে পারে। মাওবাদীদের বিরুদ্ধে মুজিব সরকারের ব্যপক দমন-পীড়ন, হত্যা-নির্যাতনের প্রতিবাদে সর্বহারা পার্টি ঢাকায় হরতাল আহ্বান করলে সন্তোষ থেকে মওলানা ভাসানী বিবৃতি দিয়ে একে সমর্থণ করেন। হরতাল সফল হয়।…সশস্ত্র কার্যক্রমের মুখে মুজিব সরকার নকশাল ও সর্বহারা পার্টি নিধনে ব্যপক তৎপর হয়। সর্বহারা নেতা সিরাজ সিকদার পার্টির অন্তর্দ্বন্দ্বে ধরা পড়েন। মুজিব সরকার তাকে বন্দী অবস্থায় গুলি করে হত্যা করেন। …এটি ছিলো ১৯৭২-৭৫ এ মাওপন্থী নিধনযজ্ঞের একটি ধারাবাহিকতা মাত্র।
এদিকে বিশ্বখ্যাত সাংবাদিক অ্যান্থনী মাসকেরেনহাস ১৯৮৬ সালে ‘বাংলাদেশ: আ লিগেসি অব ব্লাড’ নামক প্রামান্য গ্রন্থে তুলে ধরেন সিরাজ সিকদার হত্যার বিস্তারিত দিক। এর আগে মুজিব সরকারের পতনের পর ১৯৭৬ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় এ সংক্রান্ত কিছু সাক্ষাতকারভিত্তিক তথ্য প্রকাশিত হয়।
বলা ভালো, মাসকেরেনহাসই প্রথম সাংবাদিক যিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে গিয়ে লন্ডনের দি সানডে টাইমস পত্রিকায় তখনকার বাংলাদেশ ভূখণ্ডে পাক-বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের চিত্র তুলে ধরে ধরেন। তার সেই নিবন্ধ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক প্রামান্যগ্রন্থ ‘দ্যা রেইপ অব বাংলাদেশ’ সারা বিশ্বে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত তৈরিতে গুরুত্পূর্ণ ভূমিকা রাখে। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এই সাংবাদিকের ছিলো একে ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দীন, শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমানসহ শীর্ষ স্থানীয় রাজনীতিবিদদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ।
‘বাংলাদেশ: আ লিগেসি অব ব্লাড’ গ্রন্থে মাসকেরেনহাস মুজিব হত্যা, তিন জাতীয় নেতা হত্যা, জিয়উর রহমান হত্যাসহ যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের নানা নাটকীয় ঘটনা নিজস্ব অনুসন্ধান থেকে বর্ণনা করেন। এ জন্য তিনি শাতাধিক সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলেন।
মাসকেরেনহাস বলছেন:
ঘটনাচক্রে মাওপন্থী সিরাজ সিকদার ১৯৭৪ সালে ডিসেম্বরের শেষ দিকে চট্টগ্রামের কাছাকাছি এক এলাকা থেকে (টেকনাফ) শেষ পর্যন্ত পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হলেন।
জাকারিয়া চৌধুরির (সিরাজ সিকদারের ছোটবোন, ভাস্কর শামীম সিকদারের স্বামী) মতে, তাকে পাহারা দিয়ে ঢাকায় আনা হলো শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করানো জন্য। শেখ মুজিব তাকে তার আয়ত্বে আনতে চাইলেন। কিন্তু সিকদার কোনো রকম আপোষ রফায় রাজী না হলে মুজিব পুলিশকে ‘প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা’ গ্রহণ করতে বলে দিলেন।
জাকারিয়া বললো, সিরাজ সিকদারকে হাতকড়া লাগিয়ে চোখ-বাঁধা অবস্থায় রমনা রেস কোর্সের পুলিশ কন্ট্রোল রুমে নিয়ে আসা হয়। তারপর (২ জানুয়ারি ১৯৭৫) গভীর রাতে এক নির্জন রাস্তায় নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই সময় সরকারি প্রেসনোটে বলা হয় যে, ‘পালানোর চেষ্টাকালে সিরাজ সিকদারকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
সিকদারের বোন, জাকারিয়ার স্ত্রী শামীম জানায়, সিরাজের দেহের গুলির চিহ্ন পরিস্কার প্রমাণ করে যে, স্টেনগান দিয়ে তার বুকে ছয়টি গুলি করে তাকে মারা হয়েছিলো।
সিরাজ সিকদারকে, শেখ মুজিবের নির্দেশেই হত্যা করা হয়েছে বলে সারাদেশে রটে গেলো।
১৯ বছরের যুবতী শামীম তার ভাইয়ের হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।
সে আমাকে বলেছিলো, আমি সর্বহারা পার্টির কাছ থেকে একটা রিভলবার পেয়েছিলাম এবং এই হত্যাকারীকে হত্যা করার সুযোগের সন্ধান করছিলাম।
শামীম বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ভাস্করদের একজন। গত বছরই কেবল সে তার ভাস্কর্যের প্রেসিডেন্ট পুরস্কার লাভ করে। তার ধারণা, সে নিশ্চয়ই মুজিবকে গুলি করার দূরত্বে পেয়ে যাবে।
শামীম মুজিবের সঙ্গে দেখা করার জন্য বহুবার আর্জি পেশ করেছে। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। প্রতিবারই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে সে। তারপর সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের কলা বিভাগে তার এক প্রদর্শনীতে শেখ মুজিবকে আমন্ত্রণ জানালো। মুজিব আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি সেখানে উপস্থিত হতে ব্যর্থ হলেন।
সে স্মৃতিচারণ করে বললো, আমি ভায়নক বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলাম। আমি শত চেষ্টা করেও তাঁকে (শেখ মুজিব) আমার গুলির আয়ত্বে আনতে পারলাম না।
ভাগ্যই মুজিবকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলো। শামীম জাকারিয়ার প্রেমে পড়ে যায়। শেষে তাদের বিয়ে হলে স্বামীর সঙ্গে শামীম বিদেশে চলে যায়।
এদিকে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদ অধিবেশন বসে। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করানোর পর তার দ্বিতীয় বিপ্লব, বাকশাল প্রসঙ্গে শেখ মুজিব অধিবেশনে বলেন , স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হওয়ার পর যারা এর বিরোধীতা করেছে, যারা শত্রুর দালালী করেছে, কোনো দেশেই তাদের ক্ষমা করা হয় নাই। কিন্তু আমরা করেছি। আমরা তাদের ক্ষমা করে দিয়ে বলেছি, দেশকে ভালোবাসো। দেশের স্বাধীনতা মেনে নাও। দেশের কাজ করো। কিন্তু তারপরও এদের অনেকে শোধরায়নি। এরা এমনকি বাংলার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করতে বিদেশ থেকে টাকা নিচ্ছে। ওরা ভেবেছে, আমি ওদের কথা জানি না! একজন রাতের আঁধারে মানুষ মেরে যাচ্ছে, আর ভাবছে তাকে কেউ ধরতে পারবে না। কোথায় আজ সিরাজ সিকদার? তাকে যখন ধরা গেছে, তখন তার সহযোগীরাও ধরা পড়বে।…
এরপর মুজিব, জিয়া ও এরশাদ সরকারের দমননীতির ভেতর সর্বাহারা পার্টি বহু ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর বেশীরভাগ উপদলই আদর্শহীন সন্ত্রাসী বাহিনীতে পরিনত হয় মাত্র– সে ইতিহাস সবার জানা।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তা বাহিনীর হেফজতে মৃত্যু/বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড/ক্রসফায়ার/এনকাউন্টার/ বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার প্রশ্নে সিরাজ সিকদারই প্রথম রাজনৈতিক নেতা কি না, যিনি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম এমন রাষ্ট্রীয় খুনের শিকার হলেন–এ বিষয়টিও এসে যায়।
তাই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও বাংদেশের সঠিক ইতিহাস রচনায় শুধু শেখ মুজিব, চার জাতীয় নেতা বা জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের বিচারই শুধু যথেষ্ট নয়, শহীদ দেশ প্রেমিক বিপ্লবী সিরাজ সিকদার, কর্নেল তাহের, চলেশ রিছিলসহ সব রাজনৈতিক হত্যার বিচার হওয়া জরুরি।
অ্যান্থনী মাসকেরেনহাস তার ওই বইটির শেষ বাক্যে যেমন বলেন,
দুরাভিসন্ধী আর হত্যা, বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই চলে আসছে। এক হত্যা আরেক হত্যাকে তরান্বিত করেছে, দেশকে আবদ্ধ করেছে এক রক্তের ঋণে।…
তবে সবার আগে চাই ‘৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, এর আবশ্যিকতা সব প্রশ্নের উর্দ্ধে।।
(শেষ)
—
তথ্যসূত্র: স্মৃতি শুধু স্মৃতি নয়, আজিজ মেহের, শোভা প্রকাশ, ২০০৪।
বাংলাদেশ: রক্তের ঋণ, অ্যান্থনী মাসকেরেনহাস, অনুবাদ- মোহাম্মাদ শাজাহান, হাক্কানী পাবলিশার্স, চতুর্থ মূদ্রণ-জুলাই ২০০৬।
মাওইজম ইন বাংলাদেশ : দ্য কেস অব পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি, মো. নূরুল আমিন ।
বাংলাদেশে সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন, সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ও মুনতাসির মামুন সম্পাদিত।
কোটেশন ফ্রম মাওসেতুং, রেড বুক।
—
ছবি: সিরাজ সিকদার, আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের উদ্দেশ্যে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের খোলা চিঠি, ২ মার্চ ১৯৭১, মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-স্টেলিন-মাও — মাওবাদীদের পোস্টর, সিরাজ সিকদার, অন্তর্জাল।
[…] আর সম্ভবত এ দেশে প্রথম ‘ক্রসফায়ারের’ শিকার হন– পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টির প্রধান সিরাজ সিকদার। আলোচিত এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘কোথায় আজ সিরাজ সিকদার?’ অর্থাৎ ‘ক্রসফায়ার’টিকে বৈধতা দিতে গিয়ে তিনি চ্যালেঞ্জ করেছিলেন (দেখুন, সিরাজ সিকদার: অন্…। […]
সিরাজ সিকদার ও চারুমজুমদারা যা করে গেছেন,তা সত্যিই মানুষের মুক্তির জন্য।কোন রোমান্টিকতার জন্য নয়।যারা এসব বলে তারা আসলে মধ্যবিত্ত,তারা সব সময় মধ্যবিত্ত চর্চা করে আসছে।যেমন সি.পি.বি আর ভারতের সি.পি.এম।যারা মাওবাদ বুঝেনা তারাই এই সব বলে।ধরে নিলাম সিরাজ সিকদার ও চারুমজুদার এরা রোমান্টিক বিপ্লবী,তাহলে এইটুকু বলতে পারি রোমান্টিকতা থেকে কেউ কারো তাজা প্রাণ দিত না।বরং ভারত এবং বাংলাদেশে যারা এখন মধ্যবিত্ত চর্চা করে তারাই রোমান্টিক বিপ্লবী।
@ফারহান,
আপনার পাঠ প্রতিক্রিয়ার জন্য ধন্যবাদ। প্রতিটি বিপ্লবী মাত্রই রোমান্টিক; তবে কথা হচ্ছে গণযুদ্ধের ব্যর্থতা বা গোষ্ঠি-বিপ্লব নিয়ে। সুবিমল মিশ্র যেমনটি বলেন:
(Y)
বিপ্লব রহমান – খুব মার্জিত এবং সুন্দর একটি লেখা উপহারের জন্যে ধন্যবাদ। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে মোটামুটি কাছে থেকে তাকে দেখার সূযোগ হয়েছিলো আমার। তার মত ও পথ যাই হোক – তিনি যে একজন আদর্শবান, দেশ-প্রেমিক ও আত্বত্যাগী পুরুষ ছিলেন তাতে কারো সন্দেহ করার কোন অবকাশ নেই।
@সাইফ শহীদ,
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
আপনার নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও দেখাটুকু মুক্তমনা ডটকম-এ তুলে ধরার বিনীত অনুরোধ রইলো। :yes:
বিপ্লব রহমানকে অসংখ্য ধন্যবাদ। সিরাজ শিকদারের মতো একজন ঐতিহাসিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে লেখার জন্য। আমাদের ইতিহাস সঠিকভাবে জানার জন্য এর প্রয়োজনে অসামান্য। আরো বিস্তারিত বিশ্লেষণমূলক লেখার অনুরোধ রইলো বিপ্লব রহমানের কাছে। আজিজ মেহেরের (আগে কোন এক লেখায় বোধহয় বলেছিলেন, উনি আপনার বাবা)বইটার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্যও ধন্যবাদ। ওনার জন্যও রইলো সশ্রদ্ধ প্রণতি।
এবারে লেখার প্রসঙ্গে আসি। লেখাটা মূল্যবান। ২রা মার্চের খোলা চিঠি এক ঐতিহাসিক দলিল, এর তাৎপর্য অপরিসীম। সামগ্রিকভাবে বামপন্থীদের আর বিশেষভাবে সিরাজ শিকদারের পার্টির দূরদর্শিতাই এতে প্রমাণিত হয়। প্রমাণিত হয় যে, এরা চিন্তাচেতনায় জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকদের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর ছিলেন।
আমার লেখায় আমি বলতে চেয়েছি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের ভুমিকা আর অবদানকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। এটাও বলেছি যে, বামপন্থীরা না হলে আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ ‘গৃহযুদ্ধ’ই থেকে যেতো, ‘মুক্তিযুদ্ধে’ পরিণত হতো না। আজকাল এসব কথা কেউ শুনতে চান না। বামপন্থীদের সাথে চোরডাকাতদের এককাতারে ফেলে সমালোচনা করার একটা অসৎ প্রবৃত্তি দেখা যায় সর্বত্র। যেন, জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকরা সবাই গঙ্গাজলে ধোয়া তুলসী পাতা। যুদ্ধের সময়ে যাদের বেশির ভাগ কোলকাতায় হোটেলে আরাম-আয়েসে ছিলেন, নিয়মিত ভাতা পেতেন ভারত সরকারের কাছ থেকে, অস্থায়ী সরকারের মাধ্যমে। তারাই হয়ে গেলেন দেশপ্রেমিক, মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতা সংগ্রামী। সত্যিকারের চুরিডাকাতি আর দেশের সম্পদ লুটপাট করেছিলেন তারাই। আর যারা বনে-বাদাড়ে, পাহাড়ে-জঙ্গলে, খালে-বিলে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করলেন তারা হলেন দুষ্কৃতিকারী – যেহেতু বামপন্থী তাই হয়ে গেলেন দেশদ্রোহী।
বিপ্লবকে আবারো ধন্যবাদ, এই ধরনের লেখা আর আলোচনা যত বেশি হবে সঠিক তথ্য জানতে তা তত বেশি সহায়ক হবে।
@ইরতিশাদ,
:yes: :yes: :yes:
ভ্রাতা বিপ্লব,
ধন্যবাদ আপনাকে ব্যাতিক্রমধর্মী লেখাটি লেখার জন্য। আমার ব্যাক্তিগত ধারনা; আপনি শিকদার সাহেবের একজন অন্ধ না হলেও (এই লেখার আগে তেমনই ধারনা ছিল) বেশ বড় ভক্ত। তাই এখার শিরোনাম দেখে ধরে নিয়েছিলাম যে ওনাকে মনে হয় মহান বিপ্লবী, সাম্রাজ্যবাদের শিকার এ জাতীয় এক তরফা বিশেষনে ভূষিত করবেন 🙂 ।
তবে বলতে হচ্ছে যে মনে হয় নিরপেক্ষতা অনেকটাই বজায় রাখতে পেরেছেন। যদিও লেখাটি পড়ে বিপ্লব, শ্রেনী শত্রু খতম করা এ জাতীয় চটকদার রোমান্টিক কথাবার্তা (যা আমার কাছে অনেকটাই হঠকারী) ছাড়া সিরাজ শিকদারের থেকে গঠনমূলক বেশী কিছু আমার চোখে পড়ছে না। যিনি সামান্য মতান্ত্র হলে নিজের পার্টির লোকদেরই নির্বিচারে খতম করে ফেলেন তার উপর কোন ভরসায় আস্থা আনব?
ধর্মীয় বা যেকোন চরমপন্থী থেকে এনাদের খুব বেশী পৃথক তো আমার কাছেও মনে হয় না। ধর্মীয় চরম্পন্থীদের যেমন ধারনা দেড় হাজার বছর আগের আরব দেশের রীতিনীতি বাংলাদেশে এ যুগে অন্ধভাবে কায়েম করা হলেই অপার শান্তি নেমে আসবে তেমনি এনারাও বিশ্বাস করেন রুশ বিপ্লব বা চীনের কায়দায় বিপ্লব বাংলাদেশ বা ভারতে সম্ভব। এই মতবাদের বিরোধী যে কাউকেই তারা সহ্য করতে পারেন না, সবাই হয়ে যায় শ্রেনী শত্রু, শোধনবাদী হেনতেন। আমাদের দেশের নকশালদের কথা তেমন পড়িনি, তবে ভারতের দিকের সে আমলের প্রচুর বই এ পড়েছি এই বিপ্লব ওয়ালারা কিভাবে নিজেদের ভেতরেই ৩ গ্রুপে ভাগ হয়ে একে অপরের গলা কেটেছেন। ফ্যাসীবাদও তো মনে হয় অপেক্ষাকৃত ভাল। আমি জানি না এই ধরনের চরমপন্থীরা দেশপ্রেমিক হলেও এদের কিভাবে কোন সমাজ মেনে নিতে পারে। সে হিসেবে সব ধরনের চরমপন্থীদেরই তো দেশপ্রেমিক বলা যেতে পারে। হিটলারও তো নিজের জন্য কিছু করেননি, তার সব পাগলামী দেশের স্বার্থেই করেছেন বলা যায়। বাংলা ভাই শায়খ এনারাও তো সমাজ বদল করার উদ্দেশ্য নিয়েই বোমাবাজী করে নিরীহ মানুষ মেরেছেন। তফাত শুধু কেউ শ্রেনী শত্রু খতম করার নামে, আর কেউ ইসলাম বিরোধী শত্রু খতম করার নামে। এই চরম মনোভাব তারা মুক্তিযুদ্ধের সময়ও চাপা রাখতে পারেননি।
তবে সিরাজ শিকদারকে বিনা বিচারে ক্রশ ফায়ারে দেওয়া এবং তারপর কোন স্বাধীন গনতান্ত্রিক দেশের প্রধানের সংসদে দাঁড়িয়ে দম্ভোক্তি কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। স্বাধীন বাংলাদেশে সেটাই মনে হয় ক্রশফায়ার শিল্পের সূচনা। কোথায় যেন পড়েছিলাম যে তাক বন্দী করে ধানমন্ডিতে বংগবন্ধুর বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। এরপর বংগবন্ধুর সামনেই রাজ্জাজ তোফায়েল এনারা তাকে উত্তম মধ্যম দেন। এরপর এসপি মাহবুবের নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয়।
শামীম শিকদার মনে হয় জুডো না কিসে ব্ল্যাক বেল্ট হোল্ডার। ৮৭ সনে মনে হয় একবার তাকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ৪ ছিনতাইকারী ধরায় তিনি তাদের তুলোধূনো করে পিটিয়ছিলেন।
@আদিল মাহমুদ,
দীর্ঘ প্রতিক্রিয়াটির প্রসঙ্গে খুব বেশী দ্বিমত নেই।
শেষ দুটি প্যারায় সিরাজ সিকদারকে আওয়ামী নেতাদের সামনে মারধোর বা শামীম সিকদারের জুডো-ক্যারাটি সর্ম্পকে যা বলেছেন, আমার মনে হয়, এ সবই জনশ্রুতি।…বিশেষ করে সিরাজ সিকদারকে শেখ মুজিবের সামনে নির্যাতনের প্রসঙ্গের কোনো তথ্যসূত্র কোথাও খুঁজে পাইনি।
তবে আটের দশকে সিরাজ সিকদার হত্যার বিষয়ে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। যতদূর মনে পড়ে, সেখানে ময়না তদন্ত প্রতিবেদন তুলে ধরে বলা হয়, সিরাজ সিকদারকে অকথ্য নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।
আবারও আপনাকে ধন্যবাদ। :yes:
@বিপ্লব রহমান,
যদিও এ ব্যাপারটা খুবই প্রচলিত (ঠিক যেমন প্রচলিত শেখ মুজিবের ছেলে ব্যাংক ডাকাত ছিল), কিন্তু ব্যাপারগুলোর আসলেই বিশ্বস্ত তথ্যসূত্র আছে কিনা তা নিয়ে আমারো সন্দেহ আছে।
সিরাজ শিকদার প্রসঙ্গে বিখ্যাত হয়ে আছে “কোথায় আজ সিরাজ সিকদার” “লালঘোড়া দাবরাইয়া দিবো” জাতীয় উক্তিগুলো। কিন্তু সংসদে শেখ মুজিবের মূল উক্তিটি ছিলো এরকম –
এখানে অমি রহমান পিয়ালের একটা লেখা আছে, সেটা পড়া যেতে পারে – সিরাজ শিকদার : অমি রহমান পিয়াল
@অভিজিৎ দা,
সূত্র ধরিয়ে দেওয়ার জন্য আবারো আপনাকে ধন্যবাদ।
অমি রহমান পিয়ালের ওই লেখাটি প্রকাশ হওয়ার সময়ই পড়েছি, মন্তব্যও করেছি। লেখটিতে অরপি’র নিজস্ব তথ্য ও অনুসন্ধানের চেয়ে নানান জনশ্রুতি ও ফ্যান্টাসি বেশী প্রাধান্য পেয়েছে। এ কারণেই সেখানে ব্যক্তি সিরাজকে নিয়ে যত অক্ষর ব্যয় করা হয়েছে, তার রাজনীতি, আদর্শ ও আত্নত্যাগ নিয়ে ততটা নয়।
শেখ মুজিবের সংসদে দেওয়া প্রয়োজনীয় উক্তিটুকু আমি ব্যবহার করেছি মাত্র। সাবেক নকশাল নেতা আজিজ মেহেরের কাছে শুনেছি, ১৯৭৩-৭৪ এ শেখ মুজিব পল্টন ময়দানের জনসভায় প্রকাশ্যে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন,
সে সময় চরমপন্থীরা (সম্ভবত সর্বহারা পার্টি) দেয়াল লিখনে বলেছিল:
:yes:
@বিপ্লব রহমান,
দাদা, এই বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে এরকম একটি তথ্যসূত্র বলতে পারি-
বইটির নাম: মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক তাজউদ্দীন আহমদ
লেখক: বদরুদ্দীন আহমদ
এই মুহুর্তে প্রকাশনী সংস্থাটির নাম খেয়াল করতে পারছি না, বইটি হাতে নেই এখন, পেলে জানানো যাবে… সেখানে এই প্রসঙ্গেও আলোচনা রয়েছে।
@নিঃসঙ্গ বায়স, (Y)
লেখাটি একটু সংক্ষেপ হয়ে গেল, তাই না? আরেকটু বিস্তারিত বললে ভালো হত। পাঠক সমাবেশ থেকে প্রকাশিত ‘আন্ডারগ্রাউন্ডের দিনগুলো’ বইটি পড়ে ‘সিরাজ সিকদার; সম্পর্কে কিছুটা জেনেছিলাম(বইয়ের নামটি একটু এদিক সেদিক হতে পারে)।
অফ টপিকঃ পৃথিবীর রেজাল্ট কি হল? কেউ কি জানেন?
@সৈকত চৌধুরী,
লেখার সূচনা বক্তব্যে বলা আছে এ কথা। আশা করি আমার অবস্থান এ বার খানিকটা বোঝাতে পেরেছি।
আপনি বোধহয় রইস উদ্দীন আরিফের ‘আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন’ বইটির কথা বলতে চেয়েছেন। কিছু মনে করবেন না প্লিজ, এ বইটিতে সিরাজ সিকদার তথা সবর্হারা পার্টির চেয়ে পুস্তক লেখকের ব্যক্তিগত গল্পগাথাই বেশী রয়েছে। একই সঙ্গে রয়েছে বেশ কিছু বিভ্রান্তিমূলক তথ্য। সব মিলিয়ে বইটিকে আমার কাছে মনে হয়েছে– ট্রাশ।
@বিপ্লব রহমান,
না মানে আমি আমি ‘সিরাজ সিকদার’ সম্পর্কে একটা বিশদ ও নির্মোহ বিশ্লেষণ আশা করেছিলাম।
আর হ্যা, রইস উদ্দীন আরিফের বইটি আসলে তার নিজের জীবনী। আর তাতো অবিশ্বাস বা সংশয় করার কারণ থাকতেই পারে।
@সৈকত চৌধুরী,
ইয়ে…আমার এই লেখাটি বিশদ হয়নি মানলাম। কিন্তু নির্মোহ-ও কী হয়নি? :-/
কিন্তু যেভাবে কমিউনিজমকে ঢালাওভাবে আজকাল এই ফোরামের কেউ কেউ ধর্মের সাথে তুলনা করে, দেখলে আসলে বিরক্তই লাগে। এতটাই হতাশ লাগে যে এ নিয়ে কথাও বলতে ইচ্ছে করে না।
>>
না-করার ঠিক কি কারন আছে?
আমি ত ধর্ম আর কমিনিউজমে কোন পার্থক্যই দেখতে পাচ্ছি না। সেটা নিয়ে
লিখেওছি বারবার-
@বিপ্লব পাল,
প্রায় দেড়শ বছর আগে মার্কস-এঙ্গেলস কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোতে বলেছিলেন, ইউরোপ ভূত দেখেছে, কমিউনিজমের ভূত।…
আপনার মন্তব্য দেখে কেনো জানি না, হঠাৎ এ কথাটিই মনে পড়লো। 😉
অনুরোধ করি, মূল লেখার প্রসঙ্গে কিছু আলোচনা করার। আপনার লেখা নিয়ে আলাদা করে আলোচনা হতে পারে, তাই না?
অনেক ধন্যবাদ। 🙂
@বিপ্লব রহমান,
কমিনিউজমের জন্মের সময় ইউরোপ ভূত দেখেছিল এই সব ইতিহাস কোথায় পেলেন? ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লবের আগে পর্যন্ত মার্ক্সবাদের রূপ কি হবে, তাই নিয়ে সারা ইউরোপই উত্তাল ছিল-বিভেদও ছিল। কমিনিউস্টদের নিয়ে ভূত দেখা শুরু হয় বলশেভিক বিপ্লবের পরে-যখন লেনিন ১২ই নভেম্বরের ভোটে গোহারা হেরে গিয়ে লাল আর্মি দিয়ে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রীদের খুন করা শুরু করলেন-১৯২০ সালের মধ্যে লেনিন কত শত শ্রমিক এবং কৃষক খুন করেছেন তার ইয়াত্তা নেই-যাদের অনেকেই একদা বলশেভিকদের সমর্থক ছিল এবং ‘সাদা আর্মির সাথে তাদের কোন সম্পর্ক ছিল না। তারা লাল আর্মির খাদ্যলুটের বিরোধিতা করেছিল মাত্র। রাশিয়া থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত এই গবেষনাপত্রে
দেখতে পাবেন লেনিনের কুকীর্তিঃ
বলতে গেলে ১৯১৮ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার ইতিহাস শ্রমিক স্ট্রাইক এবং কৃষক বিদ্রহে ভর্তি। যার সবটাই রেড আর্মির বিরুদ্ধে। কিন্ত ১৯৯০ সালে সোভিয়েতের পতনের আগে-এসব ইতিহাস চেপে দেওয়া হয়েছিল।
মস্কো, পেত্রোগাড, খারকভ , ক্রনদস্ত গোটা রাশিয়া জুরেই শ্রমিকরা গর্জে উঠেছিল বলশেভিকদের বিরুদ্ধে। নাবিকরা, যারা চ্ছিল বলশেভিকদের বড় সমর্থক, তারাও শ্লোগান দেওয়া শুরু করল-Za Soviety Bez Bolshevikov : বলশেভিক সোভিয়েত ছাড় শব্দে শ্রমিকরা বিদ্রোহ ছড়িয়ে দিতে থাকে ১৯২০ সাল থেকেই ( গৃহ যুদ্ধের পরে)।
১৯১৭-২০ সালের আগের ইউরোপের বিদ্যান সমাজে কমিনিউজমের একটি বিশিষ্ট স্থান ছিল-কিন্ত বলশেভিকদের নৃশংসতায় সেই ভিত্তি নষ্ট হয়। রোজা লুক্সেমবার্গের লেখা পড়ুন–উনার মতন ডেডিকেটেড কমিনিউস্ট কজন ছিলেন? বলশেভিকদের এই অত্যাচারের খবর ইউরোপে ছড়িয়ে পরতেই, ইউরোপের বিদ্যান সমাজ লেনিনবাদি এবং লেনিনবাদ বিরোধি গোষ্টিতে তীব্র ভাবে ভেঙে যায় ( যা আগেও ছিল-কিন্ত তীব্রতর ছিল না)। লেনিনের কুকীর্তির বিরোধিতা করা ভূত দেখা কেন হবে? আসলে আপনার রাশিয়া এবং কমিনিউজমের ইতিহাস ঠিক ঠাক পরেন নি। এটা আমি কমিনিউস্টদের সাথে সব বিতর্কেই দেখেছি।
@বিপ্লব পাল,
ভাই রে, লেখা নিয়ে প্রাসঙ্গিক আলোচনার বাইরে শিবের গীত আর কতো? মাফও চাই, দোয়াও চাই। … 😛
ধন্যবাদ বিপ্লব ব্যতিক্রমধর্মী লেখাটার জন্য। আসলে আমার কাছে সিরাজ সিকদার ব্যক্তিগতভাবে কি ছিলেন, তার বোন বন্দুক নিয়ে ঘুরলো কিনা এগুলোর চেয়ে উনারা সে সময়ের প্রেক্ষিতে কি করতে চেয়েছিলেন, কার পক্ষ নিয়েছিলেন, কিসের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন অর্থাৎ তার এবং পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির রাজনৈতিক আদর্শ কি ছিল সেটাই সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে হয়। আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে তাদের সম্পর্কে যে কি রকম ভুল ধারণা বিরাজ করে সেটা তো আর আপনাকে বলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তাদের রাজনৈতিক আদর্শের সঠিকতা বেঠিকতা নিয়ে আলোচনা হতেই পারে, তাদের ভুল ত্রুটিগুলোরও সমালোচনা হতে পারে, কিন্তু যেভাবে কমিউনিজমকে ঢালাওভাবে আজকাল এই ফোরামের কেউ কেউ ধর্মের সাথে তুলনা করে, দেখলে আসলে বিরক্তই লাগে। এতটাই হতাশ লাগে যে এ নিয়ে কথাও বলতে ইচ্ছে করে না।
@বন্যা দি,
আপনাকেও ধন্যবাদ। কমিউনিস্টদের গুষ্টি উদ্ধারের মতো এতো নিখাদ বিনো্দন আর কি আছে! তবে কমিউনিস্টদের সমালোচকরা ( নাকি নিন্দুক?) ভুলে যান, বিপ্লবীদের আদর্শিক অবস্থান, সততা, দেশপ্রেম ও আত্নত্যাগ।…এই দুর্লভ আলোটুকুই আমি সিরাজ সিকদারের ওপর ফেলতে চেয়েছি। :yes:
দারুণ লিখেছেন। চমৎকার একটা আলোচনা-সমালোচনা দেখার আশায় গ্যালারিতে বসলাম।
অন্য আলোটা জাহানারার উপরে সামান্যতমও ফেললেন না দেখে একটু অবাকই হলাম।
আচ্ছা, অতীতকালে কোন রাষ্ট্র নায়ককে হত্যার পরিকল্পনা কী কোন ধরনের অপরাধের পর্যায়ে পড়ে না? মনে করুন কেউ একজন বাংলাদেশে বসে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলছে যে, গত বিএনপির সময়ে খালেদা জিয়া যখন প্রধানমন্ত্রী ছিল তখন তাকে হত্যা করার জন্য একটা রিভলবার যোগাড় করেছিল এবং নানান পরিকল্পনা করেছিল তার কাছে ঘেষে তাকে হত্যা করার। পুলিশের কী উচিত হবে না তাকে গ্রেফতার করা? যদি তাই হয়, তবে শামীম শিকদার কীভাবে গণমাধ্যমে একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিতে হত্যার পরিকল্পনার কথা নির্দ্বিধায় এবং নিঃসংকোচে বলতেন?
@ফরিদ আহমেদ,
হেঃ হেঃ আপনি বোধ হয় শামীম সিকদারকে সরাসরি দেখেননি। আমি ঢাকার যে এলাকায় বড় হয়েছি সেখানকার অনেকগুলো ভাস্কর্য শামীম সিকদারের নিজের হাতে করা। উনি কোন ‘মেয়েলী’ পোষাক পরতেন না। বাংলাদেশের মত জায়গায় থেকেও তিনি সব সময় শার্ট প্যান্ট পড়েই ঘুরতেন। আর তার হাতের পেশী দেখলে বড় বড় বডি বিল্ডারও লজ্জা পেয়ে যাবে। হাতুরি বাটালি নিয়ে ২০ ফুট উঁচু ভাস্কর্যের চূরাউ উঠে যেতেন – চোখ নাক মেরামত করতে – এগুলো নিজের চোখেই দেখা। আপনি এখানে যে দৈত্যের কথা লিখেছিলেন, শামীম সিকদারের চেহারা ছবি অনেকেটাই তার সাথে মিলে যাবে। তসলিমা নাসরীনের কল্লা চেয়ে যখন ফতোয়া দিয়েছিলো বুলবুলি হুজুর, তখন এই শামীম সিকদার একা রাস্তায় এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কর্মসূচী নিয়েছিলেন। আমরা পোলাপাইনেরা তখন তো অতকিছু বুঝি নাই, আমরা মহা শক্তিমান রমনীর বেজায় ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম, আর উনার পেছনে উনাকে সম্বোধন করতাম ‘শামীম ভাই’ বলে। 😀
এই চমৎকার লেখাটির জন্য বিপ্লবকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
@অভিজিৎ দা,
শামীম সিকদার সম্ভবত তার সময়ের সবচেয়ে সাহসী মেয়ে। অনেক পরে ১৯৯২-৯৩ সালেও সাপ্তাহিক প্রিয় প্রজন্মে আমাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি নিঃসংকোচে একই কথা বলেছিলেন।
পরে আহমদ ছফার একটি স্মৃতিচারণ থেকে জেনেছি, সাতের দশকে বখাটেরা তরুণ শামীম সিকদারের ওড়না টেনে ধরায় তিনি আর কখনো সালোয়ার-কামিজ পড়েননি, সারা জীবন ছেলেদের মতো শার্ট-প্যান্ট পরেছেন। সে সময় আহমদ ছফাকে তিনি নাকী সাইকেলের পেছনে বসিয়ে সারা ঢাকা শহর ঘোরাতেন।
শামীম সিকদারের শেখ মুজিব হত্যা পরিকল্পনাসহ আরো কিছু বিষয়ে আলাদা মন্তব্যে বলেছি।
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ। :rose:
@বিপ্লব রহমান,
সেই শামীম সিকদার এখন বঙ্গবন্ধুর একজন বড় সমর্থক।ঢাকায় তার অনেক সমাপ্তকৃত ভাস্কর্যে শামিম নুতন করে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য যোগ করেছে। ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের অনেক রাস্তায় এর সত্যতা খুঁজে পাওয়া যাবো অবশ্য আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে শামিমের এ রোগ বেড়ে যায়।
@ফরহাদ,
ঘটনা সত্যি। এর কারণ, সম্ভবত এই যে, তিনি এখন আর তরুন নন, সর্বহারা সমর্থক নন, সিরাজ সিকদারের আদরের ছোট বোন হিসেবে ভাতৃ হত্যার প্রতিশোধকামীও নন। তিনি এখন শুধুই ভাস্কর এবং বেশ খানিকটা বাণিজ্যিকও।
ধন্যবাদ। :yes:
@ফরহাদ,
দুনিয়া বড়ই বিচিত্র 🙂 ।
বন্দুকের নল বা জণগন নয়, ক্ষমতাই সকল ভালবাসার উতস।
@আদিল মাহমুদ,
— গেরিলা যুদ্ধের মহানয়ক মাওসেতুং-এর নামে বহু বছর ধরে বিকৃত এই উদ্ধৃতিটি ব্যবহার করা হচ্ছে। এক সময় বিএনপিও দেয়াল লিখনে বলেছিল:
কিন্তু মাওসেতুং কখনোই ওই কথা বলেননি। তার মূল কথাটি ছিল:
কিন্তু নকশাল, সর্বহারা, গণবাহিনীসহ এ দেশীয় চরমপন্থীরা মাওসেতুং-এর রণনীতির মূল দর্শনটিই অনুধাবন করতে পারেননি। এ কারণে তারা জনবিচ্ছিন্ন গোষ্ঠি-বিপ্লবে মেতে উঠেছিলেন। এর শেষ পরিনতি ছিল অনিবার্যভাবে আদর্শহীন সন্ত্রাসের চোরা গলিতে নিক্ষিপ্ত হওয়া এবং শেষ পর্যন্ত তাই-ই হয়েছে।
লক্ষ্যনীয়, মাওসেতুং তো এ কথাও বলেছিলেন:
অথবা
অনেক ধন্যবাদ। :rose:
@বিপ্লব রহমান,
ভ্রাতা, উক্তিটি কিন্তু মাও সে তুং এর তেমন দাবী আমি করিনি 🙂 ; কারন মাত্র কিছুদিন আগে জেনেছি যে উনি আসলে তেমন কথা বলেননি যেমনটা আপনি ব্যাখ্যা করলেন। যে শামীম এককালে ভাতৃ হত্যার প্রতিশোধ নিতে বংগবন্ধুর খোঁজে পিস্তল হাতে ঘুরছিলেন আজ তিনিই বংগবন্ধুর বন্দনায় যোগ দিয়েছেন মজা পেয়েছিলাম আর কি।
আমি ব্যাক্তিগতভাবে ডান বাম যেকোন ব্যাবস্থাই একমাত্র মুক্তির উপায় এমন রোমান্টিক কথাবার্তা বিশ্বাস করি না। বিশেষ করে যখন মানবতাবোধ ও যুক্তিবোধ হারিয়ে যায় তখন আদর্শ, দেশপ্রেম এ সব কিছুই মূল্যহীন হয়ে যায়। যুক্তিহীন ও মানবতাবোধহীন দেশপ্রেম ও আদর্শের তেমন মূল্য নেই।
চীন দেশের গণমানুষের মুক্তি আসলেই কতটা হয়েছে বলে মনে করেন? অর্থনৈতিক সূচকগুলি যাই বলুক, আমার তো মনে হয় না যে তারা খুব ভাল আছে। মানবাধিকারের অবস্থা খুবই খারাপ। এর ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরেও যেভাবে তারা দলবেধে জাহাজের মাল বহন করার কন্টেনারে করে জীবনের ঝুকি নিয়ে পাশ্চাত্যদের ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে পাড়ি দেয় শুনলে গল্পকাহিনীর মত লাগে। কত লোক যে পথে না খেয়ে মারা যায় কে তার হিসেব রাখে?
@আদিল মাহমুদ,
উহু…আপনি মাওসেতুং-এর উদ্ধৃতি বিকৃত করেছেন, সে কথা আমিও বলিনি। আমি বলতে চেয়েছি, বহু বছর ধরে বাম ও ডানেরা তাদের নানান রাজনীতি ও ধান্দাবাজী মাওসেতুং-এর নামে চালিয়ে দিয়েছে।…
চীনের সমাজতন্ত্র বা অর্থনীতি বা তাদের উৎপাদন ব্যবস্থা — ইত্যাদি তাত্ত্বিক গুঢ় আলোচনায় আমি তেমন পটু নই। আমি নিতান্তই এক অক্ষরজীবী মানুষ রে ভাই।
তবু অনুরোধ করি, যদি কথনো সময় পান, প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় বিপ্লব পূর্ব চীনের প্রেক্ষাপটে লেখা পার্ল এস. বাক’র ‘মাটির কোলে’ এবং মার্কিন সাংবাদিক এডগার স্নো’র লেখা ‘চীনের আকাশে লাল তাঁরা’ বই দুটি পড়ার। একটি পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত উপন্যাস, অন্যটি রিপোর্টারের ডায়েরি। হয়তো বই দুটি আপনাকে নতুন কোনো ভাবনা যোগাতেও পারে।…
আবারো ধন্যবাদ। :yes:
@বিপ্লব রহমান,
সময় পেলে পড়ব, ধন্যবাদ। তবে ভ্রাতা, বই পড়ে হয়ত চীন সম্পর্কে ধারনা বদলে গেলেও যেতে পারে; তবে আমি নিজে ধনতন্ত্রের দেশ ফেলায় বিপ্লবী লাল চীনে ইমিগ্রেশন নিব না 🙂 ।
চীনকে আদর্শ হিসেবে নিয়ে অনেকে বিশ্বব্যাপী বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেন বা অন্তত এককালে দেখতেন বলেই মনে যুক্তিসংগত কারনেই প্রশ্ন আসে যে সেই আদর্শবাদী দেশের লোকেরা আসলেই কতটা ভাল আছে এই আর কি।
@আদিল মাহমুদ,
হুমম… :-/
@অভিজিৎ,
আমার শৈশব, কৈশোর কেটেছে খিলগাঁওয়ে। শামীম শিকদারদের বাড়ীর কয়েকশগজের মধ্যেই ছিল আমাদের বাসা। শামীম শিকদারকে সেই তখন থেকেই দেখেছি। তিনি তখন চারুকলার ছাত্রী। প্যান্ট-শার্ট পরে একটা সাইকেলে করে চারুকলায় যাতায়াত করতেন। সেই সময়ে এধরনের পোশাক খুব কম মেয়েরাই পরতো বলা চলে। আমরা পিচ্চিপাচ্চারা বিস্ময়াবিষ্ট চোখে তাকিয়ে থাকতাম তখন তার দিকে। ধানমন্ডি, গুলশান, বনানীর মত উচ্চবিত্ত এলাকায় এটা হয়তো তেমন কোন বিরাট ব্যাপার ছিল না। কিন্তু খিলগাঁওয়ের মত নিম্নমধ্যবিত্ত এলাকায় এই দৃশ্য ছিল অভূতপূর্ব। খিলগাঁওয়ে সেই সময় প্রচুর ইভটিজার বখাটে ছেলেপেলে ছিল। কিন্তু কাউকে কখনো দেখিনি শামীম শিকদারকে সামান্যতম বিরক্ত করতে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে আরো কাছের থেকে দেখার সুযোগ হয় তাকে। টিএসসির সামনের স্বোপার্জিত স্বাধীনতা ভাস্কর্যটি আমাদের চোখের সামনেই তৈরি হয়। কারো দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে জ্বলন্ত সিগারেট হাতে হাতুড়ি বাটাল নিয়ে একা একাই ওটাতে কাজ করতেন শামীম শিকদার। তার সাহসিকতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, সমাজকে উপেক্ষা করা নিয়ে আমার কোন দ্বিধাদ্বন্দ নেই। কিন্তু পেশীবহুল দুর্ধর্ষ দৈত্য তাকে কখনোই মনে হয়নি আমার। বরং কোন এক বিচিত্র কারণে বেশ আকর্ষনীয় লাগতো তাকে আমার কাছে। বয়সের পার্থক্যটুকু অতখানি না হলে, ঠ্যাঙানি খাবার ভয়কে জয় করেও হয়তো প্রেমের প্রস্তাবটাও দিয়েই দিতাম। :heart:
“দিদি কেন ভাই?’ এতক্ষণে বুঝলাম। 😀
@ফরিদ আহমেদ,
সঙ্গে থাকার জন্য আবারো আপনাকে ধন্যবাদ।
বিনীতভাবে বলি, সিরাজ সিকদার সর্ম্পকে এই লেখাটি লেখার সময় দীর্ঘ পাঠ ও সে সময়ের একাধিক বিপ্লবীদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে মনে হয়েছে, একজন জাহানারা বা কামাল হায়দার (অন্যনাম, প্রবীর নিয়োগী) বা রোকন বা রইস উদ্দীন আরিফ বা আনোয়ার কবির বা সর্বহারার কথিত অন্য সব শীর্ষ নেতার প্রসঙ্গ নিছক বাহুল্য। কারণ, আমার কাছে মনে হয়েছে– সিরাজ সিকদার নিজেই অল ইন অল; অনেকটা ওয়ান ম্যান সার্কাস শো’র মতো। বাকীরা সবাই ছায়ার ছায়া মাত্র। একারণে লেখায় দু নম্বর সাব-হেড — নকশালী মূল্যায়ন: আই অ্যাম দা পার্টি!— যুক্ত করেছি।
ভ্রাতা, একটু বোধহয় বোঝার ভুল থেকে যাচ্ছে। আপনি লক্ষ্য করবেন, শামীম সিকদার ছিলেন সর্বহারা পার্টির সমর্থক ও সিরাজ সিকদারের বোন। আবার শ্রেষ্ঠ ভাস্করদের একজন তিনি। তাই অন্য সব সাধারণ পেশাদার সন্ত্রাসীর সঙ্গে শামীম সিকদারের হত্যা প্রচেষ্টাকে গুলিয়ে ফেলা ঠিক হবে না। … শেখ মুজিব বিনা বিচারে একজন দেশপ্রেমিক বিপ্লবী নেতাকে গুলি করে মেরে ফেলে প্রধানমন্ত্রী হয়ে যখন সংসদে দাঁড়িয়ে যখন দম্ভোক্তি করেন, কোথায় আজ সিরাজ সিকদার? তখন একজন তরুণ শিল্পী, সর্বহারা সমর্থক ও আদরের ছোট বোনের ওই রকম প্রতিশোধ স্পৃহা জাগতেই পারে। …
এছাড়া সে সময় সারাদেশেই কথিত বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও ক্ষোভ প্রকাশ্য রূপ নিয়েছিল। আওয়ামী-বাকশালী দুঃশাসন, তথা রক্ষী বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতনের বিপরীতে নকশালী সশস্ত্র আন্দোলন,জাসদের গণবাহিনী ও এমএন লারমার শান্তিবাহিনী তো বটেই। আপনাকে এই প্রেক্ষাপটটিও ভেবে দেখার অনুরোধ করি। :yes:
@বিপ্লব রহমান,
ভ্রাত, বোঝার ভুল নয়, বরং বোঝানোর ভুল বলা যেতে পেরে। অন্য সব পেশাদার সন্ত্রাসীদের সাথে তাকে গুলাইনি আমি। তার ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধস্পৃহা জাগতেই পারে, সেজন্যে একটা রিভলভারও জোগাড়যন্ত্র করতে পারেন তিনি। সেটা আমার বিষয় নয়। আমি শুধু আইনগত দিকটাই জানতে চেয়েছি। একজন মানুষ যদি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেন যে, আমি প্রাক্তন একজন রাষ্ট্রপ্রধানকে খুন করতে চেয়েছিলাম এবং সেই খুন করার বিস্তারিত পরিকল্পনাও তিনি সেই সাক্ষাৎকারে আলোকপাত করেন, তাহলে রাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে আইনগত কোন ব্যবস্থা নিতে পারে কি না?
প্রিয় প্রজন্ম নিয়মিতই পড়তাম। শামীম শিকদারে সাক্ষাৎকার যে আপনি নিয়েছিলেন সেটা জানা ছিল না। লাল সালাম কমরেড। :yes:
@ফরিদ আহমেদ,
ওহ, আচ্ছা… এইবার বুঝেছি। হুমম…ফৌজদারী অপরাধের দিক থেকে বিচার করলে এটি একটি অপরাধ বৈকি। …
একই কারণে শেখ মুজিবের আত্নস্বীকৃত খুনি ফারুক-রশিদ গংদের বিচারের সময় গণমাধ্যমে দেওয়া তাদের স্বীকারোক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধী জামাত-শিবির চক্রের অপরাধের একটি বড় প্রমাণ গণমাধ্যমের সংবাদ। নিশ্চিতভাবে তাদের বিচার শুরু হলে এইসব দলিলী প্রমানও আদালতে উত্থাপন করা হবে।
আবার দেখুন, নকশাল, সর্বহারা, গণবাহিনী, শান্তিবাহিনী — এই সব গেরিলা গ্রুপের কথা না হয় বাদই দিলাম। ১৯৭১ এ মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারাও কিন্তু অস্ত্র ধারণ করার কারণে পাকিস্তানীদের কাছে ‘সন্ত্রাসী’ ছিল!!
আসলে চূড়ান্ত বিচারে অস্ত্রের সঠিক ব্যবহার ও জয় লাভই শেষ কথা। একই করণে ওয়েব ঘেঁটে সহজেই লেনিনকে খুনী বা সিআইএ’র এজেন্ট বানিয়ে দেওয়া সহজ। কিন্তু ক্যাস্ট্রো বা চে গুয়েভারা বা হো চি মিনকে অতটা সহজে এটি সম্ভব নয়। বড়জোর ড়্যাম্বো বানিয়ে আমেরিকাকে হিরো বানানো যায়!…
তবে রাজনীতিতে নাকি শেষ কথা বলে কিছু নেই! 😀
আপনি এক সময়ের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ‘প্রিয় প্রজন্ম’কে মনে রেখেছেন দেখে খুব ভালো লাগলো। খুব সাহসের সঙ্গে এই সাপ্তাহিকটি খাগড়াছড়ির পানছড়ির লোগাং গণহত্যার (১৯৯২ সালের ১০ এপ্রিল) ওপর আমার সরেজিমন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল।..এ নিয়ে মুক্তমনা ডটকম-এ প্রকাশিত আমার ই-বুক ‘রিপোর্টারের ডায়েরি : পাহাড়ের পথে পথে’ একটি পরিচ্ছদ আছে– একটি লোমহর্ষক গণহত্যার কাহিনী।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। :yes:
এই সব রোমান্টিক বিপ্লবীরা শেষ বিচারে নিজেদের সর্বনাশ যেমন করেছেন, তেমনি দেশকে প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের হাতে ঠেলে দিয়েছন। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজেদের আর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কোন্দল আর স্বাধীন বাংলাদেশে ১৬ই ডিসেম্বরে হরতাল দেয়া আর ভারত বিরোধিতার নামে প্রকারান্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে লড়াই করে কি হাসিল হয়েছে? ভাষানীও যে ভূমিকা রেখেছেন ১৯৭২-৭৫ সালে, তা বিএনপির বর্তমান ভুমিকার মতই।
@FZ,
আপনার প্রতিক্রিয়ার জন্য ধন্যবাদ।
সিরাজ সিকদার রোমান্টিক বিপ্লবী, তার কথিত বিপ্লব আসলে মূল বিপ্লবী ক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে — এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। ১৬ ডিসেম্বর হরতাল আহ্বান বা মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধও একটি ভ্রান্ত ধারণা।
[img]http://blog.mukto-mona.com/wp-content/uploads/2010/05/purba-bangla-sromik-andolon_march02-1971.jpg[/img]
কিন্তু এর পরেও ভ্রাতা / ভগ্নি, আপনাকে বিনীত অনুরোধ জানাই, সিরাজ সিকদারকে খানিকটা অন্য আলোয় দেখার। সিরাজ সিকদার ব্যর্থ হতে পারেন। কিন্তু তার দেশ প্রেম ও আত্নগ্যাগকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। একই কথা সে সময়ের সমস্ত চরমপন্থীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। …আপনাকে লেখার ভেতরের দ্বিতীয় ইমেজটি একটু বড় করে দেখারও অনুরোধ করি। সেখানে সিরাজ সিকদারের দলই প্রথম সশস্ত্র পন্থায় পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশকে স্বাধীন করার কথা বলেছেন।
বিএনপির এখনকার আন্দোলনের সঙ্গে মওলানা ভাষানীর আন্দোলনের মিল আছে বা নেই — তা এই লেখার আলোচনায় অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু তাই বলে মওলানার ফারাক্কা বিরোধী লং মার্চ তথা ভারত বা মুজিব বিরোধীতা ভুল ছিলো বলতে চান? আজব! 😛