‘জাতির পিতা’ কে আবারও আসন-চ্যুত করা হয়েছে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেই জেনেছিলাম যে বাঙালি ‘জাতির পিতা’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। এরপর প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডী পেরিয়ে হাইস্কুলে গেলাম; জাতীয়তারও পরিবর্তন হল – বাঙালি থেকে বাংলাদেশী হলাম। তবে বাঙালি ‘জাতির পিতা’ পেলেন না বাংলাদেশী ‘জাতির পিতা’র আসন – পুরো এক প্রজন্ম ধরে! পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের তিন দশকেরও বেশী সময় পর শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে, ‘জাতির পিতা’ আবার তাঁর হারানো আসন ফিরে পান। গত আগস্টে “সুকন্যা” হাসিনার পলায়নের পর দেশের আনাচে-কানাচে দাঁড়িয়ে থাকা শেখ মুজিবের মূর্তি আর ম্যুরালগুলো স্বতঃস্ফূর্ত জনরোষে পড়ে অপ্রয়োজনীয় নিগ্রহের শিকার হলেও তার আসন নিয়ে তেমন কথা উঠে নি। তবে, আসন যে থাকবে না সেটাও একরকম অবধারিতই ছিল।
শেখ মুজিব আমাদের ‘জাতির পিতা’ – এটা কি আসলেই মীমাংসিত সত্য? একথা অনস্বীকার্য যে উনি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান পুরুষ। ওনাকে ঘিরেই জাতি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলো। পাক হানাদারদের কাছে আত্মসমর্পণের দিন পর্যন্ত ওনার নেতৃত্ব, কারিশমা আর বাগ্মিতা মানুষকে স্বাধীনতার স্বপক্ষে এক হতে উৎসাহিত করেছিল। যুদ্ধকালীন সময়ে উনি অনুপস্থিত থাকলেও ওনার নামেই স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে এবং সারা বিশ্বের কাছে তিনিই ছিলেন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মুখ। কিন্তু, কেবল স্বাধীনতা সংগ্রামে শেখ মুজিবের ভূমিকাই কি তার ‘জাতির পিতা’ হিসাবে মর্যাদা পাওয়ার জন্য যথেষ্ট, নাকি আরও কিছু বিষয় আমাদের আমলে নিতে হবে?
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে শেখ মুজিবের ভূমিকা অনস্বীকার্য হলেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আজও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। আমরা এখনও বিভ্রান্ত, শেখ মুজিব কেন যুদ্ধ শুরুর আগমুহূর্তে পাকিস্তানিদের হাতে ধরা দিলেন? পরবর্তীতে মুজিব নিজেই এর একটা ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন – ওনার ভাষ্যমতে, উনি ভেবেছিলেন যে ধরা দিলে পাকিস্তানিরা আর বাঙালিদের রক্ত ঝরাবে না। কিন্তু, আদতে তা হয় নি; বরং এই ভাবনা স্বাধীনতা ঘোষণার প্রশ্নে তার অবস্থান কেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। ধরা দেয়ার পর পাকিস্তানিরা বিনা-রক্তপাতে বাঙ্গালিদের স্বাধীনতা দিয়ে এদেশ থেকে চলে যাবে একথা নিশ্চয় উনি ভাবেন নি! ধরা না দিয়ে শেখ মুজিব যদি আত্মগোপনে গিয়ে সরাসরি যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতেন, তা কি জনগণ আর মুক্তিবাহিনীর জন্য আরও প্রেরণাদায়ক হতো না? যদি বাঙ্গালী অফিসার-সেনারা বিদ্রোহ না করতেন, যদি তাজউদ্দীন এবং অন্য নেতারা উদ্যোগী হয়ে প্রবাসী সরকার গঠন না করতেন, কিংবা ভারতের সাহায্য পেতে ব্যর্থ হতেন, তাহলে কি আদৌ মুক্তিযুদ্ধ সফলভাবে পরিচালনা করা যেত? আমাদের স্বাধীনতা কি আদৌ আসতো কিংবা এতো দ্রুত আসতো?
আমার মনে হয় যে আমরা আসলে ভাগ্যবান – সশস্ত্র যুদ্ধের সূচনা, এর কার্যক্রমের সমন্বয় এবং সার্বিক পরিচালনা নিয়ে কোনও সুনির্দিষ্ট পূর্ব-পরিকল্পনা না থাকলেও এগুলো যেভাবে দরকার ছিল সেভাবেই ঘটেছে এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। মুক্তি-পাগল মানুষের দূর্বার প্রতিরোধ, বাঙ্গালী সৈনিকদের বিদ্রোহ, প্রবাসী সরকারের দক্ষ নেতৃত্ব, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব আর আত্মত্যাগ এবং সেই সাথে ভারতের সময়োপযোগী সহযোগিতার সফল সমন্বয় আমাদের নতুন একটা দেশ দিয়েছে। তবে, প্রশ্ন থেকেই যায়, যিনি আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন বলে দাবী করা হয়, তিনি কেন এভাবে আমাদের অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে ফেলে রেখে শক্রর হাতে স্বেচ্ছায় ধরা দিলেন? এর একটা উত্তর হতে পারে যে ঠিক সেই মুহূর্তে দেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পরিকল্পনা তাঁর ছিল না।
যদি সত্যিই ২৫শে মার্চ রাতে শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা না করতে চেয়ে থাকেন, তাহলে আমরা স্বাধীনতা ঘোষণার যে আওয়ামী বয়ানগুলো শুনি সেগুলো কতটা বিশ্বাসযোগ্য? স্বাভাবিক বুদ্ধিতে বলে যে একজন নেতা যখন তার জনগোষ্ঠী এবং ভূখণ্ডের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন, সেটা সবাইকে জানান দিয়েই করবেন, এ নিয়ে কোনও অনিশ্চয়তা রাখবেন না। লীগ-পন্থিদের কেউ কেউ বলেছেন যে ৭ই মার্চের ভাষণই স্বাধীনতার ঘোষণা, যদিও এই ভাষণের পরও পশ্চিমের নেতাদের সাথে দর-কষাকষি অব্যাহত ছিল। পাকিস্তানি জান্তাও অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ৭ই মার্চের ভাষণ বিশ্লেষণ করছিল। তারা ভেবেছিল, এই ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা আসতে পারে এবং সেক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক সামরিক অভিযান চালানোর পরিকল্পনাও তাদের ছিল। কিন্তু, সে সময়ের পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের লেখনীতেই জানা যায় যে তারা এই ভাষণ কে স্বাধীনতার ঘোষণা হিসাবে বিবেচনা করেনি। সব মিলিয়ে বলা যায় যে ৭ই মার্চের ভাষণের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম হলেও তা আসলে স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল না।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিভিন্নভাবে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে যে শেখ মুজিব তার আত্মসমর্পণের আগমুহূর্তে বিকল্প ব্যবস্থায় স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেছেন। বলা হয়েছে যে ২৫শে মার্চের রাতে শেখ মুজিব একজনকে ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে বলধা গার্ডেন থেকে তার পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে বলেছিলেন। তবে, গ্রেফতারের আগে পুলিশ ওয়্যারলেসের মাধ্যমে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠানোর দাবীটিই বেশী শোনা যায়, যদিও এর স্বপক্ষে কোন শক্ত প্রমাণ পাওয়া যায় না। অবশ্য ২৬শে মার্চ চট্টোগ্রাম আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের উদ্যোগে শেখ মুজিবের নামে স্বাধীনতার ঘোষণা একটা দূর্বল ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে কয়েকবার প্রচার করা হয়। দেশের ভেতরে হাতেগোনা কিছু মানুষই স্বাধীনতার সেই ঘোষণাগুলো শুনেছিলেন, যদিও যুক্তরাস্ট্র সরকারসহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক মাধ্যম সেদিন স্বাধীনতা ঘোষণার খবর পেয়েছিল বলা জানা যায়।
অন্যদিকে, অসংখ্য সূত্র সাক্ষ্য দেয় যে ২৭শে মার্চ কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণাটিই সবচেয়ে বেশী মানুষ শুনেছিলেন যা অনিশ্চয়তা দূর করে অনেককে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। ২৫শে মার্চ রাতের সামরিক অভিযানের সাথে জড়িত অন্তত: দু’জন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা স্বাধীনতা ঘোষণা প্রসঙ্গে কেবল জিয়ার ঘোষণার কথাই উল্লেখ করেছেন। বলা দরকার যে মেজর জিয়ার এই গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণার সুযোগ এসেছিল কিছুটা দৈবক্রমেই, কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র বাঙ্গালী কলাকুশলী আর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ন্ত্রণে থাকায়। তবে, গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি থেকেই যায় – শেখ মুজিব যদি ২৫ বা ২৬শে মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েই থাকেন, তাহলে এই অতি-গুরুত্বপূর্ণ কাজে তিনি কেন জনগণের কাছে অপরিচিত/স্বল্প-পরিচিত মানুষদের এবং কিছু অনিশ্চিত পদ্ধতির উপর নির্ভর করেছিলেন, বিশেষত: যেখানে আরও সহজ, সুনির্দিষ্ট এবং নির্ভরযোগ্য উপায় ছিল? এক্ষেত্রে নিজে সরাসরি ঘোষণা দিতে না চাইলেও শেখ মুজিব তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের সাহায্য নেন নি কেন?
আমরা এখন জানি যে তাজউদ্দীন আহমেদ ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে একটা খসড়া ঘোষণাপত্র নিয়ে ৩২ নম্বরে গিয়েছিলেন, কিন্তু শেখ মুজিব সেই শেষ সময়েও স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে রাজী হন নি এবং স্বাধীনতার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার কোনও দিক-নির্দেশনাও দেন নি! যে মানুষটি বহুদিনের নিকট রাজনৈতিক সঙ্গী তাজউদ্দীনের স্বাধীনতা ঘোষণার উদ্যোগে এভাবে পানি ঢেলে দিলেন, আওয়ামী ভাষ্যমতে তিনিই আবার খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে অতি জটিল এবং পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রায় অসম্ভব কিছু ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তানিদের হাতে ধরা দিলেন, এর ব্যাখ্যা কি? আসলে, এই সময়ের ঘটনাপ্রবাহ এবং শেখ মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণার দাবীগুলো বিশ্লেষণ করলে অনেক অসংগতিই চোখে পড়বে এবং এই দাবীগুলোকে গোঁজামিলের মাধ্যমে বিশেষ উদ্দেশ্যে একটা ফরমায়েশি ইতিহাস প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা বলেই মনে হবে।
আমার মতে, সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিয়ে থাকলেও, কিংবা যুদ্ধকালীন সময়ে অনুপস্থিত থাকলেও কেবল আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার অপরিহার্য ভূমিকার জন্যই শেখ মুজিব কে জাতির জনক হিসাবে বিবেচনার সুযোগ ছিল, যদি তিনি স্বাধীন দেশে একটি ভয়াবহ স্বৈরতন্ত্রের জনক না হতেন। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশে সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর শেখ মুজিব সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নি। অচিরেই তার দলের ভেতরে-বাইরে ভিন্নমত মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, এবং তিনি জনপ্রিয়তা আর গ্রহণযোগ্যতা হারাতে শুরু করেন। ক্ষমতা ধরে রাখতে হলে একনায়ক হয়ে ওঠা ছাড়া তার আর কোন পথ ছিল না। বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল গঠনের মাধ্যমে একদলীয় শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করে তিনি জনগণের নেতা থেকে কেবল দলের নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। বাকশাল গঠনের মাধ্যমেই বাংলাদেশে প্রথম স্বৈরশাসনের সূচনা হয় এবং শেখ মুজিব আজীবন রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে দেশ শাসনের পথ তৈরি করেন। যদিও তাঁকে অপসারণের একটা পথ সংবিধানে ছিল, কিন্তু সেজন্য তিন-চতুর্থাংশ সংসদ সদস্যের ভোটের দরকার ছিল। বাকশাল শাসনাধীন এক দলের সংসদে দলনেতার বিরুদ্ধে তিন-চতুর্থাংশ সদস্যের অনাস্থা ভোট কার্যত অসম্ভব ছিল, যা শেখ মুজিবের আজীবন শাসন নিশ্চিত করেছিল।
বাংলার মুক্তিকামী জনগণ একসময় যাকে কেন্দ্র করে স্বাধীন দেশে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ একটা বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিল, কালের পরিক্রমায় সেই মানুষটিই একচ্ছত্র ক্ষমতার লোভে তাদের প্রভু হয়ে বসেছিলেন। স্বৈরাচারী একদলীয় শাসন, পরিবারতন্ত্র, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, লাল বাহিনী-রক্ষী-বাহিনীর অত্যাচার, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি, দুর্ভিক্ষ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ সবকিছুই বাংলাদেশের জনগণ দেখেছে শেখ মুজিবের শাসনামলে। আসলে শেখ মুজিবের স্বৈরশাসন অবধারিতভাবেই সেনাবিদ্রোহ, পরিবারসহ তার হত্যা এবং পরবর্তীতে জেনারেলদের দেশ শাসনের পথ নিশ্চিত করে।
মুজিবের স্বৈরশাসনেরই যেন পুনর্জন্ম হয়েছিল হাসিনার পতিত স্বৈরশাসনে, যা হয়ে উঠেছিল আরও ভয়াবহ, আরও বিধ্বংসী! হাসিনার শাসনামলে যেখানে সেখানে মুজিবের মূর্তি-ম্যুরালের প্রতিষ্ঠা, বিভিন্ন স্থাপনার নামকরণের হিড়িক, মুজিবল্যান্ড, মুজিব-বর্ষ ইত্যাদি, ইত্যাদি – জনগণের রক্ত পানি করা পয়সায় ব্যক্তিপূজার এই বিশাল আয়োজন তো বাকশালকেই মহিমান্বিত করার অপপ্রয়াস! লোক দেখানো নির্বাচন, জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়াই বছরের পর বছর ধরে অনুগত রাস্ট্রযন্ত্রের সাহায্যে চালানো ফ্যাসিজম, অবাধ দুর্নীতি আর স্বেচ্ছাচারিতা এবং গুম-খুনের রাজনীতিতে হাসিনা তার পিতাকেও ছাড়িয়ে গেছে! তবে একথা অনস্বীকার্য যে মুজিব নিজেই বাংলাদেশে এই স্বৈরতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি সৃষ্টির প্রথম কারিগর। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনিই প্রথম স্বৈরতন্ত্রের বীজ বুনে নেতা কে দলের চেয়ে, আর দলকে দেশের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিলেন; পথ খুলে দিয়েছিলেন পরবর্তী একনায়কদের ক্ষমতা দখলের।
হাসিনার আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবকে দলীয় সম্পত্তিতে পরিণত করেছে, তাকে পূজার আরাধ্য করে একটা কাল্ট ফিগারে রূপান্তরিত করেছে। এই মুজিব কোন ভুল করেন নি, ভুল করতে পারেন না। তাঁর উচ্চারিত প্রতিটি বাক্য সত্য এবং তা কোন রকম প্রশ্ন বা সংশয়ের ঊর্ধ্বে। আসলে মুজিবের অনুকরণে হাসিনার আজীবন শাসন নিশ্চিত করার জন্যই মুজিবকে একটা কাল্ট ফিগারে পরিণত করা অতি-জরুরী ছিল – বাংলাদেশের জনগণের কাছে মুজিবকে অবিসংবাদিত জাতির পিতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা মানেই তো বাকশাল নামের স্বৈরতন্ত্রের বৈধতা দেয়া আর সেই সাথে হাসিনার স্বৈরশাসনের পথ সুগম করা।
শেখ মুজিব যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান পুরুষ, তেমনি তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম স্বৈরশাসকও। একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে তার পূর্ণাংগ মূল্যায়ন করতে হলে এই দুটো অধ্যায়ের সম্যক বিশ্লেষণের ভিত্তিতেই করতে হবে, এদের কোন একটিকে কোন অবস্থাতেই বাদ দেয়া যাবে না। আর সেক্ষেত্রে এটুকু নিশ্চিত যে একজন স্বৈরশাসক, যিনি সদ্যজাত বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশ কে অঙ্কুরেই বিনাশ করেছিলেন, তিনি আর যাই হোন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে জাতির পিতা হতে পারেন না। তাঁকে জাতির পিতা বানাতে হলে বিকল্প ইতিহাস রচনা করতে হবে, এবং সেই ইতিহাসকে টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থাও করতে হবে। শেখ হাসিনা আর তার দলদাসরা ঠিক সেটাই করেছিলেন – বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত করে, আর সেই বানোয়াট ইতিহাসের বয়ান ধরে রাখার উদ্দেশ্যে আইন বানিয়ে।
হাসিনার বিকল্প ইতিহাসে জিয়ার বিদ্রোহ আর তার স্বাধীনতা ঘোষণার কোন স্থান নেই- তিনি হয়ে যান পাকিস্তানের গুপ্তচর; তাজউদ্দীন আর প্রবাসী সরকারের ভূমিকার গুরুত্ব নেই, উল্লেখ থাকলেও তা পড়ে থাকে কোন এক অগুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের পাদটীকায়; নেই স্বাধীন দেশে শেখ মুজিবের অপশাসন, গণতন্ত্রের পতন, আর জনগণের নাভিশ্বাস উঠে যাওয়ার বিবরণ! এই বিকল্প ইতিহাসের চর্চায় ঐতিহাসিক তথ্যের গবেষণা-ভিত্তিক অনুসন্ধান আর তার নির্মোহ বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ অনুপস্থিত! অবশ্য, উদ্দেশ্য যখন শেখ মুজিবকে মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র নায়ক বানানো, বাংলার মানুষের আরাধ্য নেতা বানানো, তখন প্রকৃত ইতিহাসের তোয়াক্কা করে কে? ইতিহাসের চর্চা করা, সত্য তুলে ধরা, কিংবা সরকারের বানানো ইতিহাসের সমালোচনা করা তো সেক্ষেত্রে শাস্তিযোগ্য অপরাধ!
শেখ মুজিবর রহমান আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র হলেও স্বাধীন বাংলাদেশে তার নেতৃত্বেই প্রথম গণতন্ত্রকে কবর দেয়া হয়। গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে থাকা আজকের নতুন বাংলাদেশে তাই গণতন্ত্র-হত্যাকারী মুজিবের ‘জাতির পিতা’ হিসাবে বহাল থাকা ভীষণ রকমের বেমানান, স্ববিরোধী এবং বিভ্রান্তিকর। জাতির পিতা হিসাবে মুজিবের অধিষ্ঠান কেবল তার উদ্ভাবিত বাকশাল স্বৈরতন্ত্রেরই বৈধতা দেবে না, বরং তা যুগে যুগে হাসিনার মতো ভয়াবহ স্বৈরশাসকদের ক্ষমতা দখল করতেও উৎসাহিত করবে। সুতরাং, নতুন বাংলাদেশে ‘জাতির পিতা’ কে আবার বিদায় জানাতেই হবে।
Leave A Comment